রাতজাগা নিদ্রা
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়
আ |
জ প্রতিম প্রথম অফিস যাবে। চাকরী মানে বেশ ভালো চাকরী। দিব্যি হেলেদুলে সকালে ঘুম থেকে উঠে শাওয়ার খুলে আরাম্সে গা ঠাণ্ডা ক’রে মাথায় বাবা’র মতো পুরনো দিনের ব্রিলক্রীম মেখে বংশের গর্ব একমাথা চুল বেশ কায়দা ক’রে ব্রাশ ক’রে নিলো। ওর ঘরে নতুন একটা ফুল সাইজ আয়না এসেছে। এখন বেশ নিজেকে পুরোপুরি দেখতে পায় ও। প্রতিম চাকরি-টা পেয়েছে শুনেই বাবা ওকে এই ভালো কাচের আয়না কিনে দিয়ে দিয়েছে। বহুকাল ধ’রে শরীর চর্চা করে আসছে প্রতিম। জিম-টিম নয়। সুভাষ ক্লাবের ব্যায়ামাগারে যায়, সেখানেই লোহা-ফোহা তোলে। শরীর-টাও মোটেই বিট্রে করেনি ওর সাথে যত-টা বিট্রে করেছিলো ওর ভবিষ্যৎ। বেশ ভালো বাইসেপ-টেপ গ’ড়ে উঠেছে। বাবা লক্ষ্য করেছে যে, ছেলে বাড়ি-র একটা কমন আয়না শরীরের এখানে ওখানে ধ’রে, হেলিয়ে, ঘুরিয়ে, ফিরিয়ে মিথ্যেই নিজের গ’ড়ে ওঠা চেহারা-টা দেখার চেষ্টা ক’রতো। তাই বাবা-র তরফ থেকে এটা প্রতিম-এর বেস্ট কমপ্লিমেন্ট। দিদি-ও দিয়েছে একটা টাইটান। দিদি’র জমানো টাকা-য় পাওয়া। গোল্ডেন। চওড়া রিষ্ট-এ বেশ জ’মে গেছে। এবারে সেই ঘড়ি-টা হাতে গ’লিয়ে হাত দিলো আলমারি-তে। চার-টে টাই কিনেছে ভিন্ন ভিন্ন স্টাইল-এর। একটা সন্তর্পণে বের ক’রে নিলো দু-আঙ্গুল দিয়ে। বড় ডেলিকেট বস্তু। তিন বিঘত কাপড়ের দাম সাত-শো। এবারে বেরোল শার্ট আর ব্লু স্যুট। প্রথমে এ্যাশ শার্ট-গায়ে গ’লিয়ে নিয়ে টাই-টাকে চাপিয়ে দিলো গলায়। বাবা-ই শিখিয়ে দিয়েছে টাই পরা-টা। নট-টা বেশ জটিল লাগছিলো প্রথম প্রথম। প্র্যাকটিস ক’রতে ক’রতে এখন রপ্ত হয়ে গেছে। এ্যাতোবড় অফিস। স্যুট-টাই ছাড়া হেড-অফিস এ্যালাও ক’রবে না। একবার দেখে নিলো প্রতিম, এ্যাশ শার্ট-এ লালের ওপর ডিজাইন-টা ভালো যাবে। আয়না সায় দিলো প্রতিম-এর মনের সাথে। নিজেকে একবার দেখতে নান দেখতেই পেছন ঘুরে তাকিয়ে দ্যাখে, মা দাঁড়িয়েছে। মা-র বাঁ হাতে একটা কাচের ছোট বাটি। তাতে দই, আরও কী কী যেন আছে! মা বাঁ হাতে ছেলে-র কপালে টিপ পরিয়ে দিলো। অফিস–এ প্রথম দিন ব’লে কথা। তাই এ্যাতো মঙ্গলকামী শুভদায়ী ব্যবস্থা। মা ব’লল,
--- দেখতে হবে না, রে। দিব্যি মানিয়েছে। তুই তো আমার রাজপুত্তুর।
ব’লতে ব’লতে মা কী যেন একটা মিষ্টি মিষ্টি মতো মুখে গুঁজে দিল! একবার প্রতিম হাসে। মা-মাসীদের এসব বাক্য মনে কত দোলা দ্যায়। সুখ দ্যায়! সেইসব পরিবার কত সুখী যে সব পরিবারে মা-এরা ছেলে-কে ‘রাজপুত্র রাজপুত্র’ দ্যাখে। হঠাৎ-ই অবাঞ্ছিত ভাবে মনে প’ড়ে যায় প্রতিম-এর, এই মা মাত্র ক’টা দিন আগে ওকে আয়না’র সামনে এইভাবেই শরীর দেখতে দেখে বলেছিলো,
--- থাক, আর খোদা-র খাশি-র মতো গতর দেখতে হবে না। যত ব্যায়াম ক’রছিস, মাথা-টা তত ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। যা, গিয়ে জল-টা তুলে দে।
স্মৃতি, তুমি বড়ো নিষ্ঠুর। বড় আঘাত করো তুমি। অপ্রয়োজনে চ’লে যেতে পারো না? মা কিন্তু দিদি-কে কখনও এমনটা ক’রে বলে না। দিদি চ’লে যাবে বিয়ে ক’রে তাইতেই মা আহ্লাদে আর বেদনায় মাখামাখি দিদি-বোনেরা কার্যত বেকার হ’লেও সমাজের চোখে তো মেয়ে-রা বেকার হয় না। তাকে কতই না আহ্লাদ দেওয়া হয়। তাই হাসি-ই পেলো। তবু মনে মনে ভাবল প্রতিম, যাক, যেটুকু হাতে আসে, তাকেই সঞ্চয় ক’রে রাখা যাক। মা-এর এই কমপ্লিমেন্ট-ই না হয় হোক প্রতিমের আজকের প্রাপ্তি। সেই গান-টা মনে প’ড়লো, ‘এমনি চিরদিন তো কভু যায় না…..।’
একটু বেশী ব্যস্ত হ’য়ে প্রতিম বারান্দায় এলো। বাবা সেখানে বাবা-র পুরনো ইজি চেয়ার-টাতে বসা। বাবা-র চোখে চশমা। প্রতিম জানে, বাবা-র ক্যাটারাক্ট আছে। ম্যাচিওর করেনি ব’লে সেটা অপারেশন করা যাচ্ছে না। বাবা-ও কাগজ-টাগজ প’ড়তে পারছে না ভালো ক’রে। ছেলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে বাবা ব’লল,
--- তা’হলে? বেরোচ্ছিস। সাবধানে যাবি। হুটও-পাটি ক’রে বাসে উঠবি না। স্যু প’রে তো কিন্তু তোর অভ্যেস নেই। সাবধানে পা ফেলবি।
মাত্র মাসখানেক আগে এই বাবা-ই প্রতিম-কে পা-এ একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে খোঁড়াতে দেখে বিদ্রূপ ক’রে উঠেছিলো,
--- পা-এ কী ঘটনা? খোঁড়াচ্ছিস যে?
--- কেটে গেছে। টিটেনাস নিয়েছি। সেপটিক না হ’য়ে যায়। ভয় হচ্ছে।
--- ভয় নেই। ভাল্লুক ডেডবডি ছোঁয় না। যারা সাবধানে চলে না, তাদের ওটুকু হয়। ওটা ভাবলে বেকারের চলে না।
প্রতিম সাবধানেই চলে। না চ’ললে তো চলে না। চলে ব’লেই আজ প্রতিমের এ্যাত কদর। বিগত চার-চারটে বছর ধ’রে ল’ড়েছে প্রতিম। একটা- র একটা চাকরীর পরীক্ষা দিয়েছে। সরকারী, বে-সরকারী--- সব। কোথায় নয়! একটা, যে কোনো একটা। না হোক গ্রুপ-ডি। মারো গুলি গ্রাজুয়েশন-এর। বাঁচতে হবে, বাঁচতে হবে। বাবা রিটায়ার্ড, মা-র কয়েকটা রোগ ধরা প’ড়েছে। ডাক্তার দেখাতে হবে। বাবা একা চারজনের পেত সামলাতে পারছে না। কত টাকা-ই বা পেনসন পায়! গরিবের খুদকুঁড়ো। হাঁ-ভাতের তিনহাত কাপড়। এদিক টানতে ওদিক খুলে যায়। প্রতিম এবারে সবটা ম্যানেজ ক’রে নেবে। গ্রুপ ডি-এর ট্যাঙ্কে গুলি। একটা বড়সড় জুটিয়ে ফেলেছে। কতটা বড়সড়, তা বোঝার ক্ষমতা বাড়ি-র কারোর নেই। ভেঙ্গে বলেও নি প্রতিম। মধ্যবিত্ত পরিবারে যতখানি খাবার, হাঁ হ’য়ে যায় তত বড়। না জানা-ই থাক।
আজকাল মাধব কাকা-র মেয়ে-টা ঘুরে ঘুরে তাকায় যাকে মনে মনে মন দিয়ে ফেলেছিল প্রায়। কিন্তু টাকা না দিলে তো মন দিয়ে ধুয়ে খাবে না নীতু। তাই পাত্তা-ফাত্তা দিতো না প্রতিম-কে। একটা বেকার ছেলে-র কী গ্যারান্টি! কিন্তু এবার! গতকাল সে তো একেবারে ডেকে ফেলল।
--- পিতু দা, আপনি নাকি একটা বড় চাকরী পেয়েছেন?
--- চেষ্টা ক’রলে-ই পায় লোকে। তুমি-ও পেতে, যদি চেষ্টা ক’রতে। খোঁচা-টা ইচ্ছে করেই মারে।
--- বাবা! বাবা! আপনি কী কথা শিখেছেন! এ্যাতো তো কথা ব’লতেন না!
--- আমি কি আর বলি! অবস্থা বলায়, নীতু।
--- একদিন আসবেন না, আমাদের বাড়ি-তে। চা আর চিপ্স দিয়ে একটা আপনার চাকরী-র সেলিব্রেশন করা যাবে।
আজ ক-দিন বেশ সাবধানে কথা বলে প্রতিম। এখন-ও তাই ব’লল--- দাঁড়াও। দাঁড়াও। বাঘ-এর পিঠে চেপে বসা যত-টা কঠিন, নীতু, টার চেয়ে কঠিন টার পিঠ থেকে নামা। জানো তো?
--- জানতাম না। আজকে শুনলাম। কিন্তু মানে-টা বুঝলাম না।
মুচ্কি হেসে সরে যায় প্রতিম। মনে মনে ভাবে, তুমি জীবনে কিছু বুঝবে না গো, চুনের বস্তা! মানে-টা নীতু-কে বোঝাবার কোন দায় আজকে নেয় না। এখন এরকম কত নীতু কত মানে বুঝতে চাইবে! বাবা-কে প্রতিম জানায়,
--- তুমি ভেবো না, বাবা। আমি মাইনে-টা পেলেই তোমার চোখটা দেখাবো। এবারে অপারেশন করাবো। ফেকো। কোনো আল্তু-ফালতু নয়।
--- বাবা! সে তো অনেক খরচ! এখনই পারবি কী ক’রে!
--- হবে, বাবা। সব হবে। তারপর মনে মনে বলে, ‘তোমাকে যে আমায় করে দেখাতেই হবে, বাবা।’
বাবা-র পা ছুঁয়ে প্রণাম ক’রে পথে নামতেই নিমাই কাকা। বাবা-র পাড়াতুতো বন্ধু। বাবা-র প্রাতঃভ্রমণের সাথী। চোখের জন্যে বাবা এখন বেরোতে সাহস করে না। নিমাই কাকা প্রতিম-কে দেখে একগাল হেসে ব’লল--- কী? অফিস চ’ললে?
প্রতিম-এর ব’লতে ইচ্ছে হ’ল--- না, কাকা। স্যুট-টুট পড়ে টয়লেট ক’রতে যাচ্ছি।’ কিন্তু আজকে অফিসে প্রথম দিন। মুড-টা কেঁচিয়ে যেতে দিতে চাইলো না। তাই ব’লল না তেমন কিছু। শুধু মুচকি হাসলো। হেসে না দাঁড়িয়ে পা বাড়াতেই নিমাই কাকা ব’লল,
--- আমি জানতাম। তোমার মধ্যে একটা চ্যালেঞ্জ ছিলো। এবারে রাধাকান্ত দা একটু স্বাস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে পারবেন।
মনে প’ড়লো প্রতিম-এর এই নিমাই কাকা ক’টাদিন আগেই প্রতিম-কে বাজার ফেরত পথে দেখে ব’লেছিলেন--- কী প্রতিম, কিছু হোল?
নিমাই কাকা-র ছেলে সম্প্রতি পি.এস.সি.- ক্লার্কশিপ-এ পেয়েছে। প্রতিম-এর ইন্টারভিউ-এর চিঠি-টা তখনও আসেনি। তাই প্রতিম মাথা নেড়ে জানালো, ‘না, কাকা। ইঙ্গিত-টা নিমাই কাকা ধ’রতে পেরে মুখে একটা ‘চুকচুক’ শব্দ ক’রে ব’লল--- ভেরি ব্যাড লাক। এ্যাতো ছেলে-র কিছু না কিছু জুটে গেলো। অথচ তুমি---! তবে তোমার-ও দোষ আছে, বাবা। এসব তো আর পরীক্ষা নয়। এলিমিনেশন টেস্ট তুমি চাকরী পাবে কিনা, তা তো ‘তোমার’ পারফরমেন্স-এর ওপর নির্ভর করবে না। ক’রবে পাশে বসা ক্যান্ডিডেট-টির ওপর। সে কেমন পরীক্ষা দিলো। সে তোমাকে মেরে বেরিয়ে তো তুমি ফক্কা। তাই মনটা-কে স্টাডি-র মধ্যে চালু রাখো। তুমি তো ‘শুন্তু’ মানে আমার ছেলে-র খবর জানো। কী পরিশ্রম-টাই না করেছে! তুমি এই স্টেশন পাড়ায় ব’সে আড্ডা দিও না। তোমার বাবা খুব চিন্তা করেন।
প্রতিম অসহায়ভাবে মুখ তুলে তাকাতেই গলা নরম ক’রে নিমাই কাকা জুড়ে দিল অন্য খোঁচা--- আহা, এলআইসি বা নিদেনপক্ষে পিয়ারলেস-টেস করতেও তো পারো।
প্রতিম-এর মনে হয়, নিমাই কাকা যেন চাকরী-র পরীক্ষা দিয়ে চাকরী-টা পেয়েছে। ও জানে, কোনোরকমে স্কুল ফাইনাল-টা পাশ করলে শুন্তু-র দাদু সেকালে রেলে দিয়েছে ঢুকিয়ে। তা নয়তো তো শেয়াল–কুকুরে ছিঁড়ে খেতো লোক-টাকে। কিন্তু আজকে দ্যাখো, চোখ পাল্টে ব’লছে, জানতো নাকি যে প্রতিম-এর মধ্যে চ্যালেঞ্জ ছিল। ব্যাটা, শুঢ্ঢা!
বাস স্টপেজ-এ যেতে অনেক-টা পথ হাঁটতে হয়। ক’দিন আগে-ও এই গোটা পথ-টা হেঁটেই মারত প্রতিম। কিন্তু আজ ডাকল--- এই রিকশা!
লোকাল স্ট্যান্ড। গোটা পাঁচেক রিকশা থাকে। জীবনে এভাবে রিকশওয়ালাকে ডাকা দুর, রিকশ চাপেইনি একা একা। এরা হাফ-বেকার। আজকাল তো এদের ভাড়া প্রায় মাথায় উঠেছে। গোটা অঞ্চলটা ভ্যান-রিকশ ছেয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশ থেকে নানা লোক আসছে আর একটা ভ্যান-রিকশ কিনে নিয়ে বা জমায় নিয়ে নেমে প’ড়ছে। অল্প ভাড়ায় প্রায় সকলেই ভ্যানে উঠছে। তাই স্ট্যান্ডে চুপচাপ ব’সে থাকতে হয় রিকশ পুলারদের। প্রতিম-এর ডাক শুনে যে রিকশ-টার লাইন ছিলো, সে এগিয়ে এলো। মুখে হাসি। নাম-ও জানে না প্রতিম। কে-ই জিজ্ঞাসা ক’রে রিকশওয়ালা’র নাম! প্রতিম ভাবল, এটা হয়তো ওর বউনি ভাড়া। তাই মুখে ফুটেছে। কিন্তু ওকে অবাক ক’রে দিয়ে, নিমাই কাকা, বাবা, দিদি, মা, সকলকে পেছনে ফেলে লোকটা ব’লে উঠলো,
--- দাদা, আপনি চাকরী পেয়ে গেছেন ব’লে মনে হ’চ্ছে?
--- হ্যাঁ, ভাই। পেলাম।
--- ভারী ভালো লাগলো। আপনি কতদিন ধরে খাটছেন! দেখি তো আপনাকে।
ব’লেই ‘আসুন আসুন’ ব’লে অভ্যর্থনা জানালো রিকশা-য়। সীটে জাঁকিয়ে ব’সে প্রতিম ব’লল--- তোমাকে একদিন খাওয়াবো। চাকরী-র খাওয়া।
--- আমাকে! ওরে বাবা! আমাদের কেউ খাওয়ায়-দাওয়ায় না।
--- আমি খাওয়াবো। আজকে প্রথম অফিস যাচ্ছি তোমার রিকশা-য়। তোমাকে খাওয়াবো না! এই রোববার। মনে থাকবে?
কোনো উত্তর দ্যায় না রিকশাওয়ালা-টা। স্ট্যান্ডে পৌঁছে একটা চাটার্ড বাসে উঠতে বেশ ভালো লাগলো প্রতিম-এর। এর আগেও উঠেছে। তবে ভিখিরি-র মতো। পকেটে রেস্ত নেই, ঠাট নেই, ঠমক নেই। কিন্তু আজ? এখনো মাইনে না পেলেও তো পাবে। ব্যাগে জয়নিং লেটার। আজকেও চাকুরে। বাসে বসেছিলো ওর স্কুলমেট ‘রক্তিম’। ওকে দেখেই ওয়েলকাম জানালো। ওকে ফোনে জানিয়েছিল প্রতিম। সেদিনও ওকে পুছতো না যে সে একেবারে রক্তিম ওকে ডেকে নিলো। একটা দুর্বোধ্য হাসি দিয়ে ব’লল,
--- সো? ইউ আর সো আওয়ার কো-প্যাসেঞ্জার। তবে একটা কথা কিন্তু মানতেই হবে, প্রতিম। ওল্ড প্রোভারব্স আর রিএলি গোল্ড।
--- ক্যানো?
--- বলে না, সবুরে মেওয়া ফলে। তুই এতোদিন যন্ত্রণা স’য়ে শেষবেলা মেরে দিলি পেনাল্টি শট-টা।
বেশি কথা ব’লল না প্রতিম। নেমে গেলো এসপ্ল্যানেডে। অফিসের সামনে একটা মুচি বসে। তাকে দিয়ে শু-টা একবার পলিশ ক’রিয়ে নিলো। এবারে ঢুকে গেলো অফিসে। ওরই পারসোনাল এ্যাসিস্টান্ট একটা মেয়ে--- নেহাল প্যাটেল। মেয়ে-টা আগের অফিসারের পি.এ. ছিলো। সে এগিয়ে এসে ওকে ওর বসা-র জায়গা-টা দেখাতে নিয়ে গেলো। একবার প্রতিম আপাদমস্তক দেখে নিলো মেয়ে-টাকে। বেশ ঝাঁ চকচকে। ছোট স্কার্ট থেকে যেটুকু নিটোল নিখুঁত পা বেরিয়ে আছে, তা দেখে বুঝে গেলো প্রতিম, মাখনের মতো স্কিন কাকে বলে। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে অবাক হয় ও। কী ক’রে মেয়ে-রা এভাবে তাদের পা বা গা তক্তকে রাখে ড়ে বাবা! অন্তত প্রতিম তো পারেনি। ক্লাশ টেন থেকে তো ফুল প্যান্ট পরছে। অথচ আপাত কালো মেয়ে-টা পর্যন্ত পা-তে বা গা-তে কেমন যেন ফর্সা। মনে মনে একবার ভেবে নিলো, ভালো। পি.এ.-কে দেখেই যদি বস-এর মন না ভরে, তবে কাজ ক’রবে কী করে? তাই সারাদিন মন দিয়ে সেরে একটা ট্যাক্সি ধ’রে ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে বাড়ি ফিরল। ইচ্ছে ক’রেই ট্যাক্সি নিলো আজ। ভালো লাগছিলো।
রাত এগারো-টা। খেতে ব’সে প্রতিম দিদি-কে পেলো অভিনব মেজাজে। দিদি ব’লল--- তুই যে আজকে একেবারে ট্যাক্সি নিয়ে ফিরলি বড়? শরীর-টরীর খারাপ নাকি তোর?
--- না না। ক্ষুদ্র উত্তর দ্যায় প্রতিম।
--- আসলে তোকে ট্যাক্সি থেকে নামতে দেখে বেশ ভালো লাগলো। একটা কেমন যেন ফিল করলাম!
জানে প্রতিম যে, দিদি সেই সময়-টাতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে নিয়েছে, পাড়ায় কে কে জানলা দিয়ে তাকাল, ফ্ল্যাট বাড়ি-টায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে। আসলে আমি অপরের উপার্জিত ধনে ভাগ বসাতে পারি, না পারি, সে ধন উপার্জন করছে, এটাই বড় কথা। আমার ভাই অমুক চাকরী-টা করে, আমার বাবা তমুক অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মচারী--- এসব ব’লেও যেন আনন্দ। অথচ যখন বাড়ি-র ছেলে-টা চাকরী পায় না, ঘ্যাঁসটাতে ঘ্যাঁসটাতে হাবশে যায়, তখন তাকে একটু ভালোবাসা, একটু সাহচর্য, একটু সাহস দেবার মতো মানুষ থাকে না। তখন এরাই তাকে ঠেলে দ্যায় আরো গহিন অন্ধকারে। যে দিদি যাকে ভাই-কে ট্যাক্সি-তে দেখে গর্বিতা, সে কিন্তু এই সেদিনও ঠোঁটে রং মাখতে মাখতে জ্বোরো ভাই-টাকে ঠেলে পাঠিয়েছিল বাজারে মিষ্টি আনতে। কেন? না, একটা পার্টি আসবে দিদি-কে দেখতে। দিদি একবার-ও ভাবেনি যে, এই সমাজে ওদের দুজনের অবস্থান কার্যত একই। আর আজ প্রতিম তাকে পেরিয়ে এগিয়ে গেল। যাকগে, এসব নাকি ভাবতে নেই। লোকে নিন্দা ক’রবে। কানা-কে কানা, খোঁড়া-কে খোঁড়া নাকি ব’লতে নেই। আজকে সেই দিদি-ই বিছানা ক’রে রেখেছে ভাই-এর জন্যে। তাই গা-টা ঢেলে দিলো প্রতিম। চাকরীজীবী’র নিশ্চিন্ত নিদ্রা।
ঝট ক’রে মনে হ’ল, নাঃ, এবারে বাথরুম যেতেই হবে। ঘাপটি মেরে এভাবে শুয়ে থাকলে তো বাথরুম পেয়ে যাবেই। উঠতে হবে। শুনতে পেলো, রাতের সেই নাম-না-জানা পাখি-টা ডাকছে। এটা আজ ক’বছর ধ’রে শুনছে প্রতিম। জাগতে জাগতে রাতের প্রতিটা শব্দ মুখস্ত হয়ে গেছে ওর। এক্ষুনি ভোরের পাপিয়া-টা ‘চোখ গেলো, চোখ গেলো’ ক’রে চেঁচিয়ে উঠবে। প্রতিম তো আজকাল প্রতি রাতেই এরকম বানানো স্বপ্ন জেগে জেগে দেখতে চাইছে। কারণ ঘুম তো আসে না। ‘নিরানব্বই থেকে এক’, আর ‘চন্দ্রবিন্দু থেকে ক’ গুনতে গুনতে ভোর হয়। একটা স্বপ্নের বড় দরকার। একটা চাকরী-র স্বপ্ন। একটা ভোরের স্বপ্ন। একটা দিনের জন্যে, মাত্র একটা রাতের জন্যে। তাই এই রাতজাগা নিদ্রা প্রতিম-এর। মনে মনেই অনেক দূর চ’লে যায়, একেবারে ঝাঁ চকচকে অফিসে পৌঁছে যায়। একবার ভাবে, স্বপ্ন-ই যদি মরে যায়, তবে বাঁচবো কী নিয়ে! তাই ও এভাবেই স্বপ্ন দেখতে চায়। চোখ তাকিয়ে স্বপ্নও। আসলে চাকরী দেবার তো কোন দেবতা নেই যার কাছে মানত-টানত করা যায়। রোজ কোনোরকমে লজ্জা-ঘেন্না ধুয়ে ফেলে রাতের খাবারটুকু খেয়ে ঘরে পালাতে বাঁচে ও। কারোর দিকে তাকাতে পারে না। সমবেদনা, সহানুভূতি, করুণা, দয়া, মেকি-ভালোবাসাভাব, তাচ্ছিল্য, হতাশা--- এ স-অ-ব চাউনিগুলোকে এই সাত-টা বছরে চিনে গেছে প্রতিম। আর জেনেও গেছে, চাকরী ওর হ’চ্ছে না। সবার তো সব হয় না। কিন্তু একটা স্বপ্ন? সেটাও কি দেখতে নেই! তাই জেগে জেগে-ই স্বপ্ন বানায়। সকালে দেরী ক’রে ঘুম ভাঙ্গে। আবার গালমন্দ--- ‘বেকারের এ্যাত ঘুম আসে কোথা থেকে?’ মেয়ে-রা নাকি শ্বশুরবাড়ি-তে গঞ্জনা পায়। তা কি এর থেকে বেশি? কে জানে! হয়তো একদিন চাকরিজীবী হবার স্বপ্ন-টা দেখতে দেখতে সেটাও লোপ পাবে। কাঠ বেকারের জীবন প্রতিম-এর। আমৃত্যু বেকারত্ব/ কল্পস্বপ্ন-ময় জীবন।
----------------------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন