স্পর্শ
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়
--- মা, তুমি আবার ঐ এক ডাই কাপড়-জামা
নিয়ে ব’সেছো! আমি তোমাকে কতবার বারণ করেছি! কতবার বলেছি, আমি টিউশন থেকে ফিরলে ও গুলো
আমাকে দাও। তুমি কি পারো! তোমার কি শরীরের সেই অবস্থা আছে? কথা শোন না কেন?
--- তুই যে কী বলিস, খোকা! তুই সকাল থেকে
বকবক ক’রে মুখের থু থু শুকিয়ে বাড়ী ফিরবি, আর আমি তোকে বলবো, ‘খোকা, এই কাপড়-চোপরগুলো কেচে দে।’ কী যে ব’লিস তুই, তার ঠিক নেই।
--- তোমার একটা অপারেশন হয়েছে, মা। আর এই
বয়সে কোনো মহিলার ওভাবে উবু হয়ে ব’সে কাপড় কাচার মতো হেভি কাজ ক’রতে নেই। শুনতে
কুৎসিত লাগলেও আমাকেই ব’লবে কাপড় কাচার কথা। আমার খারাপ লাগলেও ব’লবে।
--- কৈ, তোর বাবা তো কখনও আমাকে এইসব ক’রতে বারণ করেনি।
তোরই যত এইসব খুঁটিনাটি অভ্যেস। ওরে, এইটুকু কাচলে কিছুই হবে না রে। এই তো তোর
তিনটে জিন্স, আমার চারটে আটপৌরে শাড়ি, সায়া আর ব্লাউজ।
--- বাবা বলেনি, বাবা বলেনি। বাবা তো আর
তোমার গর্ভজাত সন্তান নয়। আমি তোমার সন্তান। আমার গায়ে লাগে। ক’রবে না, ব্যস্।
--- এ কী জ্বালা হলো! কাপড় কাচা যাবে না,
ঘর মোছা যাবে না। তবে এসব কে ক’রবে? তোর বাবা’র যেটুকু পেনশান আমি পাই, তাতে কি কাজের
লোক রাখা যায় রে! তুই যেটুকু টিউশনিতে আয় ক’রিস, তা তো তোর চাকরীর পরীক্ষার কাজেই
ব্যয় হ’য়ে যায়।
--- আমি তো ব’লেছি, আমি বাড়ি
ফিরলে বলবে, একসাথে ক’রবো। একা একা এসব ক’রতে যাবে না। ব্যস্।
এই হ’লো বুম্বা আর ওর মা’র সাথে নিত্য কলহ।
নিত্য। একবার ঘর মোছা হয়ে গেলে অথবা ঝাড়ু দেওয়া হয়ে গেলে টিউশন থেকে বুম্বা'র ফিরে আসা’র সময় হ’লে আবার নতুন ক’রে ঝাড়ু দিতে বসে,
মুছতে শুরু করে মা। কাপড় একবার কেচে নিয়ে আবার সেগুলোকে দ্বিতীয়বারের জন্যে রেখে
দেয় মা। ছেলে এলে সে যে মা’র থেকে কেড়ে নিয়ে আবার নতুন ক’রে সেই কাজ ক’রবে এই ভেবে যে,
সে মা’কে এই ভারী কাজ থেকে অব্যাহতি দিচ্ছে, আর মা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে ছেলে’র দিকে, এইটুকুই
তার আনন্দ, এইটুকুই তার প্রাপ্তি। এইটুকু পাবার জন্যেই বেঁচে থাকা। বুম্বা’র মা ব’সে থাকে এই
অভিনয়টুকু ক’রবার জন্যে। মা অন্তত অনুভব করে, স্বামী চ’লে গেলেও সে একা নয়। তার পাশে তার আত্মজ
আছে, বল আছে, ভরসা আছে, শক্তি আছে, সাহস দেবার মানুষ আছে।
আজ তিন বছর আগে বুম্বা’র বাবা মারা যান
হঠাৎ। হার্ট এ্যাটাকে। বুম্বা তখন পড়াশুনো ক’রছিল ওর নিজের ঘরে। বাবা বারান্দায় ব’সে গুন গুন ক’রে গান গাইছিলেন
অফিস থেকে ফিরে। হঠাৎই মা চেঁচিয়ে ওঠে, ‘বুম্বা, শীগ্গির আয়। তোর বাবা যেন কেমন
ক’রছে!’ ব্যস্। একটুও সময় দেননি বাবা। বিনা খরচায় চুপচাপ মাত্র একটা হার্ট-এ্যাটাকে
বিদায় নিয়েছেন। তেমন কোনো বড়ো চাকরী তিনি ক’রতেন না। ফলে তার ধার্য হওয়া পেনশান তাঁর
অনুপস্থিতিতে স্ত্রী’র প্রাপ্য কত আর হবে! প্রায় নুন আনতে পান্তা ফুরোয়
বুম্বাদের। সত্যি এর মধ্যে একটা কাজের লোক রাখা ওদের পক্ষে সম্ভব নয়। বুম্বা একে
ওকে পড়িয়ে যা পায়, তাতে দুজন টিউটরকে দিতে আর পোস্টাল অর্ডার কিনতে ব্যয় হ’য়ে যায়। তাছাড়া নানা
ম্যাগাজিন বা বইপত্র কেনা, এখানে ওখানে পরীক্ষা দিতে যাওয়া। বিস্তর খরচ। কিন্তু
বাবা চ’লে যাবার পর থেকে বুম্বা মা’কে একেবারে আঁকড়ে ধ’রেছে। মা’র বিধবা হবার বয়স হয়নি। এ কথা সত্যি যে, স্বামীকে
হারানো স্ত্রী’র পক্ষে কোনো বয়সেই সহজ কথা নয়, কিন্তু একটা বয়ঃপ্রাপ্তির ফলে এই বেদনা অনেকটা
স’য়ে নেবার শক্তি হ’য়ে যায়। কিন্তু ওর মা তো প্রিম্যাচিওর্ড ঊইডো। তাই বাবা’র না থাকার
অভাবটার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলো বুম্বা। মা’কে একাকীত্ব অনুভব
ক’রতে দেয়নি। বাবা চ’লে যাবার আগে একটাই কথা ব’লে যেতে পেরেছিলেন। তাও জড়ানো অস্পষ্ট
ভাষায় বুম্বাকে উদ্দেশ ক’রেই বলেছিলেন, ‘বুম্বা, তোর মা’কে আমি কিছুই দিতে
পারিনি রে। তুই দেখিস, তোর মা যেন একটু আরাম পায় জীবনে।’ স্তম্ভিত হ’য়ে গিয়েছিলো
বুম্বা। একটা মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার প্রাক্কালে কি নিজের মধ্যবয়স্কা স্ত্রী’র কথা ভেবে মরে? বুম্বা
দেখেছে, বাবা-মা’র মধ্যে একটা অটুট প্রেম ছিল চিরকাল। সে প্রেম এই প্রজন্মের মতো
বিজ্ঞাপনকেন্দ্রীক প্রেম নয়, বা ফ্যাশন প্রেম নয়। একটা না বলা ভাষায় অনেক কথা ব’লে দেবার প্রেম।
বুম্বা দেখতে পেতো পরিষ্কার। একটা সময় মনে হ’তো, সন্তান বড়ো হ’য়ে গেলে বাবা-মা’র এই প্রেম প্রেম
ভাব থাকা উচিত নয়। কিন্তু একটু পরিণত হ’তেই ও বুঝেছিলো, বাবা-মা’র এই প্রণয় বেশ
ঈর্ষা করার মতো বিষয়। নিশ্চিত ছিল বুম্বা, ওর জীবনে এতটা বয়সে এসে ওর হবু স্ত্রী’র সাথে এমন একটা
মধুময় সম্বন্ধ টিকে থাকবে না। এ যুগে সবকিছুই তো স্বল্পকালীন। চঞ্চল কোনো দোয়েল
পাখি’র মতো ফুস্ ক’রে কবে কোথায় উড়ে যায়! এই আছে, এই নেই।
তাই মা’কে কোন শ্রম করতে দেখলেই বুম্বা ব্যতিব্যস্ত
হ’য়ে পড়ে। বাবা’র কথাগুলো ওর মনে পড়ে--- বুম্বা, তোর মা’কে আমি কিছুই দিতে পারিনি রে। তুই দেখিস,
তোর মা যেন একটু আরাম পায় জীবনে। ফলে মা ঘর মুছতে ব’সলে হাত থেকে ন্যাতাটা কেড়ে নেওয়া, কাপড়
কাচতে দেখলে ঝাঁপিয়ে প’ড়ে একটা অংশ টেনে নেওয়া বুম্বা’র অভ্যেস। কিছু তো
করার নেই। ওর তো কোন বোন নেই যে, সে এই কাজটা ক’রে দেবে। পরিবারে ও-ই তো একচ্ছত্রাধিপতি।
তাই দায়ও ওর একারই। শুধু একটা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে বুম্বা। একে কোন চাকরী জোটাতে
পারেনি। তায় মাথার ওপর কেউ না থাকলে যে কী হয়, সে কথা বাবা চ’লে যেতে হাড়ে হাড়ে
টের পায় ও। এরপর মা’র চ’লে যাওয়া ও কল্পনাই ক’রতে পারে না। মা বারবার বলে,
--- আগে থাকতে ম’রে থাকিস কেন?
এ্যাতো পরিশ্রম ক’রছিস, চাকরী তুই পাবিই। আজ, না হয় কাল। পরিশ্রমের একটা দাম আছে না?
একদিন সত্যিই শত্রুর মুখে ছাই, আর মা’র মুখে ঘৃত-মধু
দিয়ে বুম্বা অবশেষে চাকরী পেয়েই গেলো। যে সে চাকরী নয়, মিসেলিনিয়াস সার্ভিস কমিশন
দিয়ে একেবারে অফিসার গ্রেডে চাকরী পেয়ে গেলো। মা’র মুখে হাসি ফুটিয়ে চাকরীতে জয়েনও ক’রলো। এবার বুম্বা’র এক এবং একমাত্র
কাজ হ’লো, মা’র দিকে তাকানো। যা বুম্বা বাবা’কে দিতে পারেনি, সেই অতৃপ্তি মা’কে মাধ্যম ক’রেই পূরণ ক’রবার কাজে লেগে
গেলো। মা’র জন্যে প্রথমেই যেটা বুম্বা ক’রলো, তা হ’ল বাড়িতে একটা ঠিকা কাজের লোক ঠিক ক’রে ফেলল। আপাতত ঘর
মোছা, বাসন মাজা’র লোক। মনে মনে ঠিক ক’রে ফেলল, অচিরেই রান্নাটাও মা-কে ক’রতে দেওয়া যাবে
না। যে দুটো নিয়ে মা’র সাথে যে ওর রোজকার বিবাদ, অন্তত তার একটাতে তো এবার থেকে
ছেদ পড়লো। বুম্বা দেখলো, এতে ওর মা’র মুখে প্রশান্তি’র হাসি। সন্তানের
রোজগারে মায়ের আনন্দ কোথায় হয়, মা-ই জানে। বুম্বা’কে একদিন মা ডেকে বলল,
--- জানিস বুম্বা, আমি ভেবেছি, এই যে
সরকার আমাকে প্রতি মাসে পেনশান দেয়, এটা আর নেব না।
আকাশ থেকে পড়ে বুম্বা--- বল কি! কেন? এ
তো তোমার পাওনা। সরকার দিচ্ছে। এই টাকা একেবারে তোমার নিজস্ব কিছু। তোমাকে আমার
কাছে হাত পাততে হয় না। এ যে তোমার স্বাধীনতা, মা। এটা কি তোমার কম শান্তি! কেন এটা
সারেন্ডার ক’রবে?
মা’র জবাব--- টেলিভিশনে শুনি, সরকারের ঘাড়ে
বিরাট অর্থের দেনা। তার মধ্যে যদি আমাকে বিনা কারণে এই এ্যাতোগুলো টাকা দিতে হয়,
তবে তো এটা সরকারের ওপর একটা অতিরিক্ত চাপ। তাই ছেড়ে দেবো এই পেনশান। তুই তো আয়
করিস। আর কী দরকার?
--- আর কী দরকার মানে! টাকা’র দরকার কি শেষ হ’য়ে যায় নাকি! তাছাড়া
এই টাকা সরকার তোমাকে একা দিচ্ছে নাকি? তোমার টাকা তুমি ফেরত দিলে সে তো সরকারের
তহবিলে হাতির গর্ভে চড়াই পাখির ডিম। তাতে সরকারের কোন সাশ্রয়টা হবে, শুনি। লক্ষ
লক্ষ মানুষকে সরকার এই পেনশান দেয়। তোমার মতো সকলে কি ফেরত দেবে?
--- সে তাদের কাজ তারা ক’রবে কিনা, ক’রতে পারবে কিনা, তারা
বুঝবে। আমি তো আমার কাজ করি। সরকারের প্রতিমাসে সাত-আট হাজার টাকা বেঁচে যায়। আমি
তো সরকারের হ’য়ে কিছুই করি না। কেন শুধু শুধু এই টাকাকটা নিই, বল। আমার ছেলে তো আজ উপার্জন
করে। কী বল?
মায়ের এমন কথায় মাথা নিচু হয়ে যায় বুম্বা’র, আবার উঁচু হ’য়েও যায়। মা’কে যে সাধারণ
মহিলা ব’লে জানতো বুম্বা, সেই মা যে কোনো সাধারণ মহিলা নয়, এটা আজ প্রথম অনুভব ক’রতে পারলো ও। জেনে
বিস্মিত হ’লো। মনে মনে বুঝতে পারলো, মা’কে যে অবসরে নানা গল্প-উপন্যাস ও প’ড়ে প’ড়ে শোনাতো, হয়তো তারই
প্রতিক্রিয়া মা’র ওপর প’ড়েছে। মা’র মধ্যে চিন্তা-ভাবনার একটা উত্তরণ ঘ’টে গেছে। এটা জেনে বুম্বা পরিতুষ্ট হবে,
না হেসে দেবে--- ঠিকঠাক বুঝতে পারে না। শুধু শ্রদ্ধায় মাথাটা ওর নিচু হয়। কত
মানুষই তো গল্প উপন্যাস পড়ে। কত বাড়িতেই তো বইয়ের আলাদা শেল্ফ থাকে। সেখানে থরে
থরে নানা বড়ো বড়ো লেখকের বইও থাকে। কেই বা মনে মনে সেসব বইয়ের কথা মানে, বিশ্বাস
করে! আর কেই বা সেই পথে নিজের জীবনকে চালায়! মনে মনে বুম্বা বলে, ‘বাবা, আজ তুমি
নেই। কিন্তু তুমি কি জানতে, তোমার স্ত্রী’র মধ্যে একটা বিরাট মানুষ ঘুমিয়ে ছিল?’
মা বুম্বা’কে আবার তাগাদা দেয়--- কী রে, টাকাটা
সারেন্ডার ক’রে দিই?
বুম্বা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বা না একটা কিছু
অস্পষ্ট উত্তর দিয়ে দেয়। কিন্তু এবারে ও একটা বিরাট কাজ ক’রে বসে। একদিন
রবিবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফিরে আসে এক
পেল্লায় পিসবোর্ডের বাক্স নিয়ে। বাড়িতে এনে সেটা খুলতেই একটা অদ্ভুত যন্ত্র মা
দেখতে পেয়ে বলে,
--- এটা কী রে! কোথা থেকে কিনলি? আর এটা কিনলিই
বা কেন। এতে কী হবে?
--- এটা ওয়াশিং মেশিন, মা। আর তোমাকে
বাথরুমে উবু হ’য়ে ব’সে কাপড় কাচতে হবে না। আমার সাথেও তোমার আর ঝগড়া হবে না। এটাতে কাচাকুচি আমিই
তোমাকে শিখিয়ে দেবো। এতেই এবার থেকে জামা-কাপড় কাচবে।
বিস্মিত মা বলে--- এতে কাচা হবে? পরিষ্কার
হবে সেই কাচা?
--- কেন হবে না! আমি যে দেখিয়ে দেবো ব’ললাম।
--- আমি ব’লতে চাইছি, আমি যে হাতে কাচি, তাতে
যেমনটা পরিষ্কার হয়, তেমন পরিষ্কার কি হবে? এসব তো বড়োলোকদের জন্যে বানায়
কোম্পানীগুলো। ওতে কি ওরা জামা-কাপড় কাচে নাকি? ওরা তো সব বড়ো বড়ো লন্ড্রিতে দেয়
কাচতে। আর তুই জামা-কাপড় যা নোংরা করিস! ও আমাকে হাতেই ক’রতে হবে রে। তোর
এই যন্ত্র হাঁপিয়ে যাবে। দম ফেটে যাবে তোর ওয়াশিং মেশিনের। তাছাড়া কারেন্ট পুড়বে
না?
--- আহা, কত আর পুড়বে! কেচে তো দ্যাখো
আগে। বুম্বা মা’কে বোঝাবার চেষ্টা করে।
--- কিন্তু এ্যাতোগুলো টাকা এভাবে খরচ ক’রলি? দাম কত নিলো?
--- ওটা কোনো বড়ো ব্যাপার না, মা। বাবা
যে আমার হাতে তোমার দায়িত্ব দিয়ে গেছে। তোমার জন্যে এটুকু ক’রতে পারবো না!
মাত্র সাত হাজার টাকা, মা। মাত্র সাত হাজার। এবার তোমাকে আরো একটা দারুণ জিনিস
দেবো।
--- আবার কী? পরে নিজের বোকামিতে নিজেই
লজ্জা পায় মা। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে--- ও বুঝেছি। এবারে তাহ’লে তুই বিয়ে ক’রবি, না? সেই বরং
ভালো। বিয়েই কর।
বুম্বা মা’কে থামিয়ে বলে--- বিয়ে-টিয়ে এখন নয়। অনেক
দেরী আছে। অন্য জিনিস।
--- দ্যাখ বাবা, টাকা-পয়সা একটু জমিয়ে
রাখা উচিত। তোর বিয়ে তো দিতে হবে। একটা অনুষ্ঠান তো ক’রতে হবে। বধূবরণ ক’রতে হবে, পাঁচজনকে
তো খাওয়াতে হবে। একটা খরচ আছে না!
বুম্বা মা’কে একটু পরীক্ষা ক’রতে চায়। হয়তো মা’কে ভালো মতো চিনতে চায় বুম্বা। কিন্তু
বাবা’র মৃত্যুর পর থেকে একটু একটু ক’রে মা’কে চিনতে শুরু ক’রেছে ও। তাই এবারও
মা’কে একটু টেস্ট ক’রতে চায় বুম্বা। ও মনে মনে ভেবে নেয়, ছেলে’র বিয়ে ব’লে কথা। সব মা-ই
এই একটা ব্যাপারে একটা ট্র্যাডিশনাল মনোভাব পোষণ করে। তাদের অনেক তথাকথিত
প্রত্যাশা থাকে। তাই মা’কে ব’লে বসে,
--- এ বাবা! সে সব খরচ তো বহন ক’রবে মেয়েপক্ষ।
আমাকে পকেট ঝাড়তে হবে কেন?
বুম্বা’র মা কেমন যেন হ’য়ে গেলো ছেলে’র এই কথায়। বেদনায়
যেন কুঁকড়ে গেলো ওর মা। কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে ব’লল--- আমার সন্তান
হ’য়ে তুই এমন কথা বলবি, আমি ভাবতে পারি না, বুম্বা। আমি আমার সন্তানের বিয়ে
দেবো, আর তার খরচ দেবে মেয়েপক্ষ! কেন রে? আমি কি ভিখিরি’র মা?
গর্বে বুম্বা’র বুক ফুলে ওঠে।
কিন্তু প্রসঙ্গ ধামাচাপা দেয় বুম্বা। তাড়াতাড়ি ব’লে ওঠে--- এখন আমার বিয়ে নয়, মা। আমি
চাকরী পেয়েছি, উপার্জন ক’রছি। আগে তোমাকে বেশ কয়েকটা তীর্থ ঘোরাবো, তবে বিয়ে-টিয়ে যা
হবার হবে। বাবা’র জন্যে তো কিছুই ক’রতে পারলাম না। তুমি কিন্তু এতে কোনো আপত্তি ক’রতে পারবে না। বৃন্দাবন,
গয়া, বেনারস সব। সব ঘুরবো।
মা’র মাথায় হাত--- এই বয়সে তুই এসব ঘুরবি!
তবে বিয়ে ক’রবি কবে? একবার এইসব নেশা পেয়ে ব’সলে তো ঘর-সংসার করা চুলোয় যাবে।
বিবেকানন্দ হ’য়ে উঠলে কি ভালো হবে?
--- কেন মা? বিবেকানন্দ-এর মতো ছেলে কোন মা না চায়, বলো? তিনি তো আদর্শ
সন্তান...
--- তিনি কী ছিলেন, জানি না, বাবা। তবে
কোনো মা-ই এটা মানবে না যে, তার ছেলেরা সব বিবেকানন্দ হ’য়ে যাক।
এইসব কথা চালাচালি মা আর তার সন্তানের
মধ্যে একটা সময় হ’তো। আজ তা ধীরে ধীরে তা একেবারে ক্বচিৎ কদাচিৎ হ’য়ে উঠেছে। আজকাল
কঠিন বাস্তব বুম্বা’কে তার মা’র মুখোমুখি হ’তে দেয় না। অফিসের কাজে ওকে হিল্লি
দিল্লি ক’রতে হয়। সদা সর্বদা ব্যস্ত উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী বুম্বা। কিন্তু বুম্বা
খুশি যে, ওর মা’কে আর বাড়ির কাজের লোকের মতো গতর খাটাতে হয় না। মা’কে অধুনাকালের যেসব
ইলেক্ট্রিক্যাল বা ইলেক্ট্রনিক হোম-এ্যাপ্লায়েন্স কিনে দিয়েছে, তা মা বহাল তবিয়তে
ব্যবহার ক’রছে। আজ আর বুম্বা’কে কোন টেনশান নিতে হয় না। নিজের জামাটা প্যান্টটা খুলে
ফেলে দিয়ে মা’কে ব’লে দেওয়া যায়, ‘মা, একটু কেচে রেখো।’ মা জামা প্যান্ট তুলে নিয়ে যায়, ওয়াশ
টাবে জল জমিয়ে ডিটারজয়েন্ট ঢেলে তার মধ্যে জামা কাপড় ফেলে দিব্যি কেচে রাখে। পরদিন
কাজের লোকটাকে দিয়ে পাঠিয়ে দেয় লন্ড্রিতে। ওকে অফিসের ভাত দিতে দিতেও মা’কে দেখতে পায় ফ্লোর
ক্লীনার দিয়ে ঘর সাফ ক’রতে, ওয়াশিং মেশিনটাতে কাপড় কাচতে। কিন্তু মা যেন কেমন
মুষড়ে থাকে। তেমন কথাবার্তা বলে না। যেন ‘প্রাণ নেই প্রাণ নেই’ ভাব। এর কারণটা
প্রথম প্রথম বুঝতে না পেরে হঠাৎ একদিন আবিষ্কার ক’রে বসে বুম্বা। ও বুঝতে পারে যে, মায়েদের
এটাই বৈশিষ্ট্য। প্রথমে ছেলে ‘চাকরী পাক-চাকরী পাক’ ক’রে অস্থির হয়। তেমন জুটে গেলেই মায়েরা ‘ছেলের বৌ-ছেলের বৌ’ ক’রে ব্যস্ত হয়। এটা
বোঝে বুম্বা, মা বড়ো একা। সারাদিন বাড়িতে একা থাকে মহিলা। প্রায়ই বেশ বেশী রাতে
ফেরে বুম্বা। মা’র সাথে কতটুকুই বা কথা হয়! মা’র একটা সঙ্গী দরকার। এবারে একটা বিয়ে ক’রতেই হবে ওকে।
কিন্তু নিজে বিয়ের কথাটা না পেড়ে অন্যভাবে প্রসঙ্গ তোলে বুম্বা,
--- রান্না’র লোকটা কেমন
এনেছি বলো? কেমন রাঁধছে! যে দিয়েছে, সে কিন্তু ব’লেছিলো, মহিলাটি রান্নায় বেশ পাকা। কী?
তোমার পছন্দ নয়?
মা উত্তর দেয়--- সে তোর মনের মতো হ’লেই হয়। তুই তো
আমার হাতের রান্না ছাড়া মুখেই তুলতে পারতিস না। তাই আমি আর কী ব’লবো!
--- আচ্ছা, সে ঠিক আছে। তা তোমার মেশিনে
কি কাচাকাচি হ’চ্ছে? পরিষ্কার-টরিশকার হ’চ্ছে তো?
--- সে তো তুই পরিস। তুই-ই জানিস।
--- কেন? তুমি কি তোমার কাপড়-চোপড় ওতে
কাচো না? তোমার কাপড়-চোপড় কেমন পরিষ্কার হ’চ্ছে, বলো।
--- ঠিকই আছে নিশ্চয়ই। এ্যাতো টাকা দিয়ে
কিনেছিস যখন। এ্যাতো লোকে যখন এইসব ব্যবহার ক’রছে, তখন ভালোই হবে।
এবারে বুম্বা আসল কথাতে আসে। ভালো ক’রে ও লক্ষ্য ক’রেছে যে, মা কেমন
যেন ঝিম্ মেরে আছে। তাই প্রশ্ন করে--- মা, এবারে তুমি একটু বিশ্রাম পাচ্ছো, বলো।
লাইব্রেরি থেকে নিজেই বই-টই এনে প’ড়তে পারছো। শরীরটা একটু আরাম পাছে। দ্যাখো
মা, জীবনের একটা সময়ে যেমন চাকরিজীবীদের অবসরের দরকার হয়, তেমনই তোমাদের তো একটা
অবসর থাকা দরকার। আজকে তুমি সেইটা পাচ্ছো দেখে আমি কিন্তু খুশী।
--- কিন্তু বুম্বা, আমি তো এই অবসর চাইনি
রে। এইসব যন্ত্রগুলো থেকে আমি অনেক কিছুই পাচ্ছি, রে বাবা। কিন্তু আমার ছেলে’কে পাচ্ছি না, তোকে
পাচ্ছি না। আমার সন্তান আমার থেকে কত দূরে চ’লে গেছে! আজকাল আমার হাতের রান্না খেয়ে
তোকে ব’লতে হয় না, ‘মা, এই যে কালোজিরে দিয়ে বাটা মাছের ঝোল তুমি রেঁধেছো, এর কোনো তুলনা নেই।’ আজকাল তো ‘ছাড়ো, আমায় ক’রতে দাও’ ব’লে আমার হাত থেকে
ঝাড়ুটা, ন্যাতাটা কেউ কেড়েও নেয় না। কেউ বলে না, ‘এই বয়সে তুমি কি পারো!’ বাথরুমে আমার
হাতের থেকে কাচা’র কাপড় তুই কেড়েও নিস না। তুই আছিস, কিন্তু তুই নেই। আমি বড়ো একা। অনেক কিছু
পেয়েছি, কিন্তু এই যন্ত্রগুলো তোকে আমার কাছ থেকে দূরে নিয়ে গেছে। এইটাই আমার সহ্য
হ’চ্ছে না।
বুম্বা মা’কে বোঝাতে পারে না, মা, এটাই অগ্রগতি,
এটাই উন্নতি। এটা গ্রহণ না করাটা যে বোকামি। যন্ত্র তো মানুষের মধ্যে আসবেই, মা।
মানুষ যন্ত্র না হ’লেই হ’লো। আমি কিন্তু তোমার বুম্বাই আছি, মা। একভাবে কি সবদিন
চলে, না চ’লতে হয়! এটা তো পরিবর্তন। এসব কিছুই মা’কে ও বোঝাতে পারে না। এটা ও বোঝে, মা তো
মা। সে কি এসব বোঝে, না বুঝতে চায়!
---------------------