সোমবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১২

"অপরাধ" ছোটগল্প



অপরাধ

হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়

আজ চারদিন পরে বাইরের আলো দেখলো লাল্‌টু। ঘরের বাইরে এসে একটা ছোট্ট করে আড়মোড়া ভেঙ্গে তাকালো আকাশের দিকে। মনে মনে একবার ভাবলো, মানুষ যে কী চায়, সে নিজেই জানে না। আজকে দিনটাকে, এই রোদটাকে, ওদের বাড়ির নিমগাছটাকে বেশ পরিষ্কার আর ঝকঝকে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আজ কতদিন পরে বাইরের জগৎ-টাকে দেখছে। ওদের বাড়ির উঠুন, এ্যাসবেসটসের চাল-টা, উঠুনে পলিথিনের সীটের আড়ালে ঢেকে রাখা ওর রানী। সব যেন নতুন আর খুব সুন্দর। অথচ সেদিনও, মানে দিন পাঁচেক আগেও মনে মনে ভাবছিলো, এই রোজ রোজ ঘুম থেকে ওঠো, গান্‌ডে-পিণ্ডে গিলে বেরোও রানীকে নিয়ে। অন্তত পনেরো থেকে ষোলো ঘণ্টা স্টিয়ারিং ধরে থাকো। এই ট্র্যাফিক জ্যাম আর দুর্ঘটনা ঠাসা কলকাতায় নিজের আর কিছু মানুষের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছোটো--- টালা থেকে টালিগঞ্জ। পেট চোঁ চোঁ করলে কোনো ধাবায় ঢুকে দুটো রুটি মারো ডাল দিয়ে। তারপর বিড়ি আর চা--- এই দুজনের ওপরে ভর করেই তো সারাটা দিন ছুটোছুটি। কিন্তু আজ পাঁচটা দিন কাজে না বেরোতে পেরে মনে হচ্ছে, এই কাজটা ছিল বলেই জান-টা আছে। বাড়িতে বসে থাকে কোন শালা! একটা পুরুষ মানুষের পক্ষে কি বাড়িতে বসে থাকা সম্ভব? বাইরের জগত যে পুরুষকে চুম্বকের মতো টানে। কিন্তু মাঝে মাঝে শরীরটাতে যেন একটা ক্লান্তি আসে। তখন কটাদিন একটু জিরোতে চায় মন। সেদিন লাস্ট প্যাসেঞ্জারকে নামিয়ে দিয়ে সোজা বাড়িতে কেটে পড়েছে। রিস্ক নেয়নি। যদি রাস্তায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায়! ঘণ্টা দুয়েক ধরেই গায়ে জ্বরটা একটু একটু করে বাড়ছিলো। কিন্তু শেষের দিকে একেবারে ধাঁই ধাঁই করে বেড়ে যাচ্ছিলো, চোখদুটো জ্বালা করছিলো, মাথাটা ছিঁড়ে পড়ছিল। জ্বর নিয়ে যতক্ষণ পেরেছে প্যাসেঞ্জার টেনেছে। মনে পড়ে, বাগুইআটি-তে একজনকে নামিয়ে দিয়ে আর ঝুঁকি নেয়নি। সোজা বাড়ি। তারপর পাঁচটা দিন কেটে গেছে বিছানায় প্রায় অজ্ঞান হয়ে। সময় কেটেছে জ্বরে, পথ্যে আর ওষুধে। একবার মনেমনে ভেবেছিলো, ওর যদি একটু পানদোষ থাকতো, তবে সেদিন আরো অনেকটা সময় হয়তো প্যাসেঞ্জার টানলেও টানতে পারতো। অন্যেরা তো জ্বর-ফর পাত্তা দেয় না। মাল টেনে নেয়। ব্যস্‌। একেবারে ফিট। কিন্তু মদ খাওয়াটা ওর ঠিক ধাতে সয় না। এজন্যে অন্যদের কাছে বেশ হেনস্তা হতেও হয় ওকে। কিন্তু যা একজন পারে না, তো পারে না।
এবারে লাল্‌টু উঠুনে নেমে একটানে সরিয়ে দেয় রানীর গায়ে ঢাকা দিয়ে রাখা পলিথিনের ঢাকনাটা। বেরিয়ে পড়ে রানীর সোনা মাখা শরীরটা। ঢাকা দেওয়া থাকলেও একটা আলগা ধুলো তো পড়েই। যেহেতু ঝর্না আজকে ওকে বেরোতে অনুমতি দিয়েছে, সেহেতু বালতি করে জল এনে এবারে রানীর একটু গা-টা ধোয়াতে হবে, একটু পরিষ্কার তো করতে হবে। দরজাগুলো হাট করে খুলে রেখে একটু ভাল করে ঝাড়ু দিতে হবে। প্যাসেঞ্জারদের পায়ের ধুলোতে ভেতরটা বড্ড নোংরা হয়। এটা ওর নিজের মাল। রানীর গায়ে কোথাও একটু দাগ লাগলেও ওর নিজের গায়ে লাগে। আগে যখন কুমুদবাবুর ট্যাক্সি চালাতো লাল্‌টু, তখন সেটাকে এ্যাতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখতো না। অন্যের মাল, কে-ই বা অতো যত্ন নেয়! দুসরো কা মাল, দরিয়া মে ঢাল্‌। কিন্তু ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে রানীকে কিনেছে আজ দু-বছর। এখনও ই.এম.আই. দিতে হচ্ছে মাসে মাসে। প্যাসেঞ্জার আজকাল কমে গেলেও লাল্‌টুর চলে যায় মোটামুটি। বাড়িতে বৌ, বোন আর একটা ছেলে। বছর আটেক বয়স। নুন আনতে পান্তা ফুরোলেও, বোন অতসীর বিয়েটা আজও দেবার মতো কোন ব্যবস্থা করে উঠতে না পারলেও মনে মনে ভেবে রেখেছে, ব্যাঙ্ক-এর লোনটা শোধ হলে সংসারটা একটু ভালো করে ম্যানেজ করতে পারবে। তখন অতসীর বিয়ে নিয়ে ভাববে। মনে মনে ঠিক করে, আগে ভেতরটা ঝাড়ু দিয়ে তারপরে রানীর গায়ে জল দেবে। একে একে চারটে দরজাই খুলে দেয় লাল্‌টু। তারপর ডিকি থেকে ঝাড়ুটা বের করে নিয়ে সামনের দিকটা পরিষ্কার করে আচ্ছা করে। পেছনের দরজাদুটো খুলে যেই ঝাড়ু লাগিয়েছে, ওমনি হঠাৎ খেয়াল করে একটা বেগুনি রঙের প্যাকেট প্যাসেঞ্জারদের পায়ের কাছে পড়ে আছে। জিনিসটা হাতে নিয়ে দ্যাখে, সেটা একটা সোনার দোকানের ব্যাগ। সোয়েটের কাপড় দিয়ে বানানো। বেশ ভারী। বুকের ভেতরটা লাল্‌টুর ছ্যাৎ করে ওঠে। এটা কি সত্যিই কোনো গয়নার ব্যাগ? কোনো প্যাসেঞ্জার ফেলে গেছে? কোন প্যাসেঞ্জার? এটা নিশ্চয়ই ঐ লাস্ট প্যাসেঞ্জারটা। বাগুইআটি-তে নেমেছিলো। পরিষ্কার মনে পড়ছে। ঐ লোকটাকে গাড়িতে তুলছিলো না লাল্‌টু। বেশ বুঝতে পারছিলো যে, জ্বরটা বাড়ছে। স্টিয়ারিংটা হাতে কাঁপছিলো। কিন্তু লোকটাকে কিছুতে ফেরাতে পারেনি লাল্‌টু। বাগুইআটি বলেই এই প্যাসেঞ্জার নিয়েছে। এখান থেকে ওর বাড়ি খুব দূরে হবে না। তাই ওনাকে নামিয়ে দিয়েই ও সোজা ফিরে গেছে বাড়ি। কোনোরকমে গাড়িটাকে টালির চালের নীচে ঢুকিয়ে শরীরটাকে জোর করে টেনে রানীকে পলিথিন সীট দিয়ে ঢেকে বিছানআয় পড়েছে ধরাস করে। তারপরে তো গত পাঁচদিনের ইতিহাস।
এবারে একবার পেছনটা দেখে নেয় ও, বাড়ির কেউ কাছেপিঠে আছে কিনা। তারপর ধীরে ব্যাগটার চেনটা খোলে। চোখের সামনে বেরিয়ে পড়ে একগাদা গয়না। একটা একটা করে লাল্‌টু দ্যাখে, হার, চুড়ি, দুল, বোতাম, চুর আরো কী কী যেন! সব গয়নার নাম ও জানে না। চট্‌ করে ব্যাগটা আটকে দেয় লাল্‌টু। মনের মধ্যে একটা অপরাধী উদ্দাম নেচে ওঠে। বিয়েতে শ্বশুরবাড়ি থেকে ও পায়নি কিছুই। ঝর্নার সাথে ওর প্রেম হয়, ঝর্নাদের বাড়িতে আপত্তি হয়, আর পালিয়ে আসে ঝর্না। ঝট্‌ করে বিয়ে করে নেয়। আজো ঝর্নাদের বাড়িতে ওদের স্থান নেই। ঝর্নার বাপের বাড়ির বেশ ভালোই অবস্থা। সন্দেহ নেই, লাল্‌টুর কোনো মেয়ে নেই। তাই মেয়ে বিয়ে দেবার কোনো চাপ নেই। কিন্তু বাবা-তো অতসীর বিয়েটা দিয়ে যেতে পারেনি। এই একটা দায় আছে লাল্‌টুর। আজ সেই দায়টা ওকে হঠাৎ অপরাধী হয়ে উঠতে একটা ইন্ধন দেয়। এই ব্যাগটা যদি ও চেপে দেয়, তবে তো একটা হিল্লে হয়। ঝর্নাকে বলবে না কিছু। চুপচাপ ঢুকিয়ে রাখবে কোথাও। ঢুক্‌ করে ওর একটা পাত্র দেখে মেরে দেবে বিয়েটা। চমকে যাবে ঝর্না। অবশ্য ঝর্নাও তো হাতে-গলায় সব কমদামি ইমিটেশন পরে ঘোরে। তাকেও তো ও কিছুি দিতে পারেনি। এই মাল অতসীর বিয়েতেই লাগাবে। তা নয়তো এই এ্যাতোগুলো গয়না ওর পক্ষে ম্যানেজ করা সম্ভব নয়। ঝর্না সন্দেহ করবে। মনে মনে একবার ঠিক করে নেয়, পাঁচটা দিন তো কেটেই গেছে। লোকটার যে সর্বনাশ হবার তা তো হয়েই গেছে। তাতে তো ওর অপরাধ নেই। ও তো জানতোই না। বেশ মনে পড়ছে, লোকটা অনেককিছু কিনেটিনে গাড়িতে উঠেছিলো। হাতে অনেকগুলো প্যাকেট-ট্যাকেট ছিল। ওগুলো নানা জামা-কাপড়ের প্যাকেট--- বোঝাই যাচ্ছিলো। লোকটা উঠেছিলো বৌবাজার থেকে। ওখানেই কোনো একটা সোনার দোকান থেকে এইসব গয়না বানিয়েছে লোকটা। শেষে নিজেকে এইসব ভাবনা থেকে মুক্তি দেয় লাল্‌টু। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, ঐ লোকটার কথা আর ভাববে না। পৃথিবীতে বহু মানুষ আছে, যারা অন্যের ধনে বড়োলোক হয়ে দিব্যি আছে। সুখে-শান্তিতে জীবন কাটাচ্ছে। কৈ, তাদের তো কোনো ক্ষয়-ক্ষতি হচ্ছে না? লোভে পাপ,পাপে মৃত্যু--- এসব একদল মানুষ বলে। গুরুদেবরা বলে, অপরের সর্বনাশ করলে তা ঘুরে নিজের ওপরেই অভিশাপ হয়ে নাকি বর্তায়। ভ্যাট্‌! ওসব ফালতু কথা। অতসীর বিয়ে না দিতে পারলেও তো একটা পাপ ওর কপালে জুটবে। অবিবাহিত বোন বাড়িতে বসিয়ে রাখাও তো ভাইয়ের পক্ষে দায়িত্ব-জ্ঞানহীনতা। না না, এসব জ্ঞানের কথা ভাবলে চলবে না। এসব ভেবেই তো গরিব বারবার মরে। না, এই সুযোগ হারাবে না ও। ঈশ্বর ওকে দিয়েছেন। এটা তাঁর আশীর্বাদ। মাথায় করে রাখবে এই বেগুনী রঙের প্যাকেট। অতসীর সাথে ঝর্নার রাতদিন খ্যাচর খ্যাচর এবারে শেষ হবে। লাল্‌টু চমকে দেবে সবাইকে। দেখিয়ে দেবে, লাল্‌টুও পারে।
এইসব ভাবতে ভাবতে একটু আনমনা হয়েছে লাল্‌টু, আর ঠিক তখনই ওর ঠিক পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে অতসী। ওকে ধমকে বলে--- দাদা, একটু শরীরটা ভালো হয়েছে, ওমনি গাড়ি ধুতে শুরু করেছো! এক-দুদিন গাড়ি না ধুলে কি খুব খারাপ হবে?
লাল্‌টু নিশ্চিন্ত হয়, অতসী তাহলে কিছু দ্যাখেনি। তাই তাড়াতাড়ি বলে--- রানী আমাদেরকে পেটের ভাত দেয় রে, অতসী। ওকে একটু যত্ন নেবো না! আমি কি এ্যাতোটাই অকৃতজ্ঞ?
অতসীর দিকে তাকিয়ে কথাটা বলতে বলতে লাল্‌টু মনে মনে ভাবছিলো, ঘোমটা দিয়ে অতসী দাঁড়ালে কেমন দেখাবে। বেশ সুন্দর লাগছিলো অতসীর কল্পিত মুখটা। কিন্তু ধীরে ধীরে লাল্‌টুর চোখের সামনে অতসীর মুখটা মুছে যেতে যেতে কোন একটা অচেনা মেয়ের মুখ ভেসে উঠতে থাকে। ও বুঝতে পারে না, মেয়েটা কে। কোনোদিন দ্যাখেনি একে। কিন্তু মেয়েটা যেন ওকে বলছে, দাদা, আমার বিয়ে যে হবে না। ঐ গয়নাগুলো না পেলে যে পাত্রপক্ষ বিয়ের মণ্ডপ থেকে উঠে যাবে। তুমি থাকতে আমার এই সর্বনাশ হবে?
লাল্‌টুর মাথার মধ্যে একটা চক্কর খেয়ে যায়। একটা বিয়ে বাড়ির দৃশ্য ওর চোখের সামনে ধোঁয়া ধোঁয়া ফুটে ওঠে--- বিয়ে হচ্ছে, সানাই বাজছে, মেয়েরা অকারণে হাসাহাসি করছে, বর এলো, বিয়ের পিড়িতে বসলো, আর তারপরে মেয়ের বাপ কথার খেলাপ করায় ছেলে উঠিয়ে নিয়ে তারা চলে যাচ্ছে...। ঘুরপাক ক্ষেয়ে যায় লাল্‌টুর মাথা। এ কী! এসব কী দেখছে? কে এই মেয়ে? এ কি ঐ ভদ্রলোকটার মেয়ে নাকি? অতসীর রূপ ধরে সামনে এসেছে? তাহলে কি সত্যিই ও কোনো পাপ করছে? এভাবে বোনকে বিয়ে দেওয়ায় কি ওর কল্যাণ হবে? তাছাড়া অতসী যদি কোনোদিন জানতে পারে, কি ওর দাদা অন্য একটা মেয়ের বিয়ের গয়না নিয়ে নিজের বোনকে দিয়েছে, তবে তো দাদা হয়ে ও মুখ দেখাতে পারবে না। কোথা থেকে এইসব পেলো, এটাও তো ঝর্নার বা অতসীর মুখের বিরাট প্রশ্ন হয়ে ওর মাথায় চেপে বসবে। তাদের তো কোনো উত্তরও দিতে পারবে না। না, এবারে আর কোনো দ্বিধা নয়, কোনো দ্বন্দ্ব নয়। না, এ গয়না ফেরত দিতেই হবে। যেভাবে হোক ফেরত দিতে হবে। লোকটা বাগুইআটিতে নেমেছিলো। লোকটার বাড়ি তাহলে সেখানেই কোথাও হবে। সেখানে থানায় জমা দিলে নিশ্চয়ই মানুষটার হাতে গয়না চলে যাবে। এরপর যা হবার, হবে।
গাড়ি ধোওয়া বন্ধ রেখে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে পড়ে লাল্‌টু। কত আর সময় লাগবে বাগুইআটি? মিনিট পনেরো। এখনও তো রাস্তায় জ্যাম হবার সময় হয়নি। থানায় পৌঁছে ডিউটি অফিসারের কাছে গিয়ে ঘটনাটা জানায়। আর তারপরে সেই বেগুনি রঙের চেন দেওয়া ব্যাগটা টেবিলের ওপর রাখে। ডিউটি অফিসার ব্যাগ খুলে একে একে সব গয়নাগুলো বেছে বেছে দ্যাখে। থানার অন্ধকার ঘরের মধ্যে লাল্‌টুর ট্যাক্সি রানীর গায়ের রঙের মতো ঝকমকিয়ে ওঠে গয়নাগুলো। ডিউটি অফিসার একবার জিডি বুকটা খুলে মিলিয়ে দ্যাখেন, দিন পাঁচেক আগে সত্যিই নলিনীরঞ্জন দাস নামে এক ব্যক্তি এমন একটা অরনামেন্‌ট মিসিং ডায়রি করিয়েছে। তখন তিনি নিজেই ছিলেন ডিউটিতে। লোকটার কান্নাভেজা মুখটা আজও তাঁর মনে পড়ছিলো। কিন্তু তার এ্যাতোদিনে তো তার মেয়ের বিয়ে আর বসে নেই নিশ্চয়ই। ডিউটি অফিসার বলে ওঠেন,
--- তা তুই যে এইসব ফেরত দিচ্ছিস, কী ব্যাপার? তুই কি রাজা হরিশ্চন্দ্র নাকি? ঘটনাটা কী, বল তো।
লাল্‌টু অবস্থা বৈগুণ্যে আজ ট্যাক্সি চালালেও ও এমন ঘরের ছেলে নয় যে, ওকে একেবারে তুই-তোকারি করা যায়। তাই একটু ক্ষোভের সঙ্গেই ও বলে--- না স্যার, হরিশ্চন্দ্র-টরিশ্চন্দ্র না। কিন্তু অন্যের জিনিস নিয়ে ভোগ করার ইচ্ছে আমার নেই।
--- তাই যদি হবে, তবে আজ পাঁচদিন পরে কেন এলি?
লাল্‌টু সেই ঘটনাও বলে। এই সাথে ও বলে--- স্যার, কী কী গয়না আছে দেখে মিলিয়ে আমাকে একটা কাগজে লিখে দিন, আমি কী কী গয়না জমা দিয়েছি।
--- কেন? লিখে দিতে হবে কেন? অফিসার রেগে গিয়ে প্রশ্ন করেন।
--- বাঃ, দিতে হবে না! আমি যে জমা দিলাম, তার কোনো প্রমান আমার হাতে থাকবে না! তা নয়তো আমিই তো ফেঁসে যাবো। আমাকে তো আমার বাড়ির লোককেও দেখাতে হবে যে, আমি এগুলো জমা দিয়েছি। তা নয়তো তারা আমাকে সন্দেহ করবে না?
--- সন্দেহ তো আমিও তোকে করছি। সেই লোক যদি এসে বলে, এর থেকে এই সরানো হয়েছে, সেইটা হারিয়ে গেছে--- তবে তো তোকেই ধরবো, রে ব্যাটা। উপকার করতে গিয়ে এমনিতেই ফাঁসবি। তার চেয়ে, তুই ফুটে পড়। আমি তাকে একটা বুঝিয়ে দেবোখন।
কিন্তু লাল্‌টু গোঁ ধরে থাকে। কাগজে ওকে লিখে দিতেই হবে, কী কী ও জমা দিয়েছে। ওর কথা, লোকটা যদি এমন কথা বলে, তবে ওকে তলব করলেই ও এসে হাজীরা দেবে। দাঁড়াবে লোকটার সামনে। বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে ডিউটি অফিসার এবারে বলেন,
--- তোর সাধু সাজবার যেমন এ্যাতোই শখ, তবে দাঁড়া। তোকে সাধু সাজবার একটা ব্যবস্থা করেই দিচ্ছি। আমি লোকটাকে ডেকেই পাঠাচ্ছি।
এই কথা বলে ডায়াল ঘুরিয়ে খবর দেন নলিনীরঞ্জন দাসকে।
এর পরের ঘটনাগুলো ঘটে একেবারে নাটকের মতো। মিনিট দশেকের মধ্যে একেবারে হন্তদন্ত হয়ে যে মানুষটা এসে থানায় ঢুকলো, তাঁকে বেশ চিনতে পারে লাল্‌টু। সেদিন জ্বরের ঘোরে একে দেখেছিলো বটে, কিন্তু কেন জানি মুখটা ও ভোলেনি। কোনো কোনো প্যাসেঞ্জারের মুখ এমনিই মনে থেকে যায়। ঝরে পড়া লোকটা থানায় ঢুকেই বলেন,
--- কিছু কি হলো, স্যার? আমি যে অকুল পাথারে পড়ে আছি। আগামী পরশু আমার মেয়ের বিয়ে। আমার মাথার ঘায়ে তো কুকুর পাগল হবার যোগার। নতুন করে আমি কোথা থেকে এই এ্যাতোগুলো টাকা যোগার করবো! টাকা অন্যের থেকে ধারকর্জ করলেও অত গয়না বানাবার সময়ই বা কৈ?
লাল্‌টু খেয়াল করে, লোকটার চোখের কোলে কালি পড়েছে, মাথার চুল তথাকথিত ভদ্রলোকদের মতো বিন্যস্ত নয়, গালের দাড়িতে পোঁচ পড়েনি বেশ কিছুদিন। একেবারে হুড়োন্যাড়া অবসথা। কন্যাদায়গ্রস্ত মানুষদের বোধহয় এমনই দেখতে হয়, মনে হয় লাল্‌টুর। মনে মনে ও ভাবে, ভাগ্যিস নিজের মনের লোভটাকে সামলাতে পেরেছে। তা নয়তো এই অসহায় মানুষটার অভিশাপ লাগতো ওর পরিবারের মাথায়। সর্বনাশ হতো ওর। ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যেই করেন। কে বলেছে, ভগবান নেই!
ডিউটি অফিসার বলেন--- কিছু না হলে কি এমনি এমনি ডেকেছি আপনাকে! এবারে লাল্‌টুকে দেখিয়ে দিয়ে বলেন--- একে চেনেন?
ভদ্রলোকটি ঘাড় ঘুরিয়ে লাল্‌টুকে একবার দেখে জানান--- না, চিনি না তো।
--- নলিনী বাবু, আপনি যে ট্যাক্সিতে উঠেছিলেন, সেই ট্যাক্সিটার নম্বর দেখেছিলেন কি?
--- না। তা তো দেখিনি। এ্যাতো নানা দুশ্চিন্তায় ছিলাম যে, সে সব করা হয়নি। কেন স্যার? কী হয়েছে? আপনি কি সেই ট্যাক্সি ড্রাইভারকে পেয়েছেন? সে কি স্বীকার করছে না? আমি শিয়োর, আমি গাড়িতে ফেলেই নেমে গেছি। আমি নামার আগেই বাড়ী থেকে একটা ফোন পাই। আমার স্ত্রী বলেন, ছেলে বাড়ী থেকে কেউ কেউ এসেছেন কোনো একটা কাজে। আমি তাড়াহুড়ো করে অন্য অন্য জিনিসগুলো নিলেও হঠাৎ গয়নার ব্যাগটা নিতে ভুলে গিয়েছিলাম। ওটা বোধহয় গাড়ির জাকিং-এ নিচে-টিচে পড়ে গিয়ে থাকবে। বাড়ি গিয়ে আমার মনে হয়, আমি গয়নার ব্যাগটা ট্যাক্সি থেকে নামাইনি। সাথে সাথে ছুটে আসি রাস্তার মোড়ে, যদি গাড়িটা অন্য প্যাসেঞ্জারের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু এসে দেখি রাস্তা ফাঁকা, শুনশান। আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে।
লাল্‌টু লক্ষ্য করে যে, এই ডিউটি অফিসার এই আপাদমস্তক ভদ্রলোকটিকেও অপমান করতে ছাড়ছে না। অফিসার বলে--- আপনারা গাড়িতে উঠবেন, নাম্বার দেখবেন না, নিজের পকেট সামলে চলবেন না, পকেট মার যাবে, ঘরের মেয়েকে ঘরে কন্ট্রোল করে রাখতে পারবেন না, সে অজানা ছেলের সাথে পালাবে--- আর থানায় এসে আমাদের মাথা খাবেন। পুলিশ নাকি কিছুই করছে না। আপনাদের একটু সাবধানে থাকবার কোনো দায় নেই। তাই তো? এই আমি যদি আপনাকে আপনার গয়নাগুলো ফেরত দিতে না পারি, তবে আমাদের নামে বলে বেড়াবেন, আমরা অকর্মণ্য। কী? তাইতো? আমাদের হাতে তো আর কোনো কাজ নেই, না?
লাল্‌টু ভাবে, পুলিশের এ ছাড়া আর কীইবা কাজ থাকতে পারে! ছাদের কড়িকাঠ গোনা? শান্তি-শৃঙ্খলা আর মানুষদের নিরাপত্তা দেখাই তো তোমাদের কাজ, বাপু। শুধু শুধু এই মানুষটাকে বাতেলা দিচ্ছো কেন? কিন্তু মুখে কিছু বলে আর ঝামেলা বাড়াতে চায় না।
কিন্তু নিরুত্তাপ আর নিরুপদ্রপ এই লোকটি গলবস্ত্র হয়ে বলে--- কী আর করবো বলুন! অপরাধ আমার হইয়েইছে। আর তো তা কিছু করা যাবে না। তার শাস্তি তো পাচ্ছি। এখন বলুন, আমাকে ডেকে পাঠালেন কেন?
বেশ ক্রেডিট নিয়ে ডিউটি অফিসার জানান--- আমাকে দেখতে নয়। এই সেই ড্রাইভার। এর গাড়িতেই আপনি উঠেছিলেন। চিনতে পারছেন? 
লোকটার অসহায় মুখ দেখে লাল্‌টু বুঝলো, বিলক্ষণ লোকটি লাল্‌টুকে চিনতে পারেননি। কোন মানুষই বা একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারকে মনে রাখে! কিন্তু অবাক হল লাল্‌টু এই দেখে যে, ডিউটি অফিসার এমনভাবে বিষয়টা তুলে ধরছে যে, মনে হচ্ছে, এই ট্যাক্সি ড্রাইভারকে সে নিজে খুঁজে এনেছে। সে এ দেশের ল এ্যান্‌ড অর্ডার রক্ষায় অত্যন্ত তৎপর। অফিসারটা একবারও মুখে বলল না, এই ড্রাইভার নিজে এসেছে এই মাল ফেরত দিতে।
ডিউটি অফিসার বেগুনি ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে বলেন--- এই নিন আপনার হারাধন গয়নার ব্যাগ। এবারে মিলিয়ে দেখে নিন, সব ঠিক আছে কিনা।
গয়নার ব্যাগটা দেখে লোকটার দু-চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ে। দু-হাতে জামার হাতায় চোখ মুছে নিয়ে বলেন--- আপনি যখন উদ্ধার করেছেন, ঠিক থাকবে নিশ্চয়ই। কোথায় আর যাবে! আমাদের দেশে আজো কর্মঠ পুলিশ কর্মচারী আছে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। 
মানুষটাকে বাধা দিয়ে ডিউটি অফিসার বলেন--- তবুও একবার দেখে নিন।
মানুষটা ব্যাগটা খুলে একে একে মিলিয়ে দেখতে থাকেন গয়নাগুলো। কিন্তু কী একটা যেন খুঁজে পাচ্ছেন না, এমনভাবে বার বার মিলিয়ে দেখেই যেতে থাকেন। লাল্‌টু বা ডিউটি অফিসার দুজনেই বুঝতে পারে যে, আরো কিছু ছিল ব্যাগটার মধ্যে, যেগুলো লোকটি খুঁজে পেতে চাইছেন। কিন্তু পাচ্ছেন না বলেই  বারবার দেখছেন, আবার কোনো ভুল হল কিনা। লোকটির থেকে এ ব্যাপারে অনেক বেশী আগ্রহী ডিউটি অফিসার নিজেই বললেন,
--- কী, কিছু কি মিসিং?
লোকটা একবার ফ্যাল ফ্যাল করে তাকান অফিসারের দিকে, একবার লাল্‌টুর দিকে। তারপর বিড়বিড় করেই বলেন--- এই পেয়েছি, এটাই যথেষ্ট। ও আমি ম্যানেজ করে নেবো। ওতে কিছু হবে না। আমি ম্যানেজ করে নেবো। ঠিক আছে...। আমি এবার আসি, স্যার?
কিন্তু দায়ে পড়ে সততা আর লোক দেখানো সিন্সিয়ারিটির পরাকাষ্ঠা ডিউটি অফিসার তো ছাড়বার পাত্র নন। লাল্‌টুকে একটা শিক্ষা দেবার একটা সুযোগ পেয়েই যান। ওর মনে ক্ষোভ, ড্রাইভারটা বড়ো ঠ্যাঁটা। তিনি আবার বলেন--- না, আপনি গেলেই তো হবে না। আপনাকে তো গয়নার দোকানের ক্যাশমেমো দেখাতে হবে, সই-সাবুদ করতে হবে যে, আপনি পেয়েছেন। কী কী পেয়েছেন। তাই বলছি, আপনি কি সব পেয়েছেন, নাকি কিছু মিসিং আছে? আপনার চোখমুখ তো...
অসহায়ভাবে আমতা আমতা করে লোকটা বলেন--- না, মানে... একজোড়া বালা ছিলো...।
মানুষটার কথা শেষ হবার আগেই ডিউটি অফিসারের মোটা মোটা আঙ্গুলের চওড়া হাতের একটা বিরাশি সিক্কার চড় এসে পড়ে লাল্‌টুর গালে। চড়ের সাথে অনুষঙ্গ হিসেবে ধমকে বলেন--- কী রে, রাজা হরিশ্চন্দ্রের ব্যাটা? এবার? বলেছিলাম না?
চড়টা খেয়ে মাথাটা লাল্‌টুর বন্‌ করে ঘুরে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে লাল্‌টু রোখ করে বলে ওঠে--- দেখুন দাদা, ওর ভেতরে সোনার বালাই থাকুক, আর লোহার হাতকড়াই থাকুক, আপনি যেমনটা রেখেছিলেন, তেমনটাই আছে। আর শুনে রাখুন, আপনি হয়তো ভাবছেন, অফিসার আমাকে ধরে এনেছেন। কিন্তু সেটা নয়। আমি নিজেই এসেছি ফেরত দিতে। আপনি বাগুইআটিতে নেমেছিলেন। তাই ভেবেছিলাম, আপনার বাড়ি এখানেই হবে হয়তো। তাই এই থানাতেই এসেছি। আপনার বালা-ফালা আমি সরাইনি। হ্যাঁ, দুটো অপরাধ আমি করেছি। এক, অন্যের হলেও ব্যাগটা আমি একবার খুলেছিলাম। দুই, একবার ভেবেছিলাম, ফেরত দিতে আসবো না। মেরে দেবো। চুরি করা, আর চুরি করবো ভাবা--- দুটোই তো অপরাধ। এই দুটো অপরাধ আমি করেছি। কিন্তু চুরিটা করতে পারিনি। এই চুরি আমার হজম হবে না মনে করেই ফেরত দিতে এসেছি। আপনার বালা আপনিই বুঝুন। শালা, সৎ মানুষের দিন নেই, দেখছি। কেন যে বেকার সততা মারাতে এলাম, কে জানে!
তখনই লোকটার সেলফোনটা বেজে ওঠে। থানায় বসে আছেন বলে কলটা কেটে দিয়ে লোকটা লাল্‌টুকে বললেন--- তুমি নিজে এসেছো ফেরত দিতে? অফিসার, আপনি নিজে বলবেন যে, ও নিজে এসেছে! তোমাকে যে কী বলে আমি আশীর্বাদ করবো, জানি না, বাবা। আজও মানুষ সৎ আছে। আজো আকাশে চন্দ্র-সূর্য ওঠে, দিন হয়, রাত যায়। সব শেষ হয়ে যায়নি তাহলে! আসলে দ্যাখো বাবা, আমি তো কিছু বলতে চাইনি। উনি বারবার জিজ্ঞেস করছেন বলেই...। আমি যে এইকটা ফেরত পেয়েছি, এই-ই যথেষ্ট। পাবো না--- এই তো ধরে বসেছিলাম। তবু তো পেলাম। এই বা কম কী?
আবার লোকটার সেলফোনটা বাজে। এবারে আর কেটে না দিয়ে ফোনটা ধরেন লোকটা। হ্যালোলে কি যেন শোনেন একমনে, আর লোকটার মুখের চেহারা বদলে যেতে থাকে। অবশেষে ফোনটা কেটে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। লাল্‌টুকে জড়িয়ে ধরে বলেন--- আমাকে তুমি ক্ষমা করো, ভাই। আমি ঘোর অপরাধ করেছি। আমি তোমাকে সন্দেহ করেছি। আমার বালা হারায়নি। সোনার দোকানেই আছে। এইসব উচাটনে আমার মাথার ঠিক ছিল না। সব ভুলে গেছি। বালাদুটোয় একটা ডিফেক্ট ছিলো বলে দোকানেই দিয়ে এসেছিলাম। এখন দোকান থেকে ডেলিভারি নেবার জন্যে ফোন করেছে। আমি যে বড়ো অপরাধ করে ফেলেছি, অফিসার।
কথাকটা বলে লোকটা যেন লাল্‌টুর পা জড়িয়ে ধরতে এগিয়ে এলেন। লাল্‌টু লাফ মেরে পিছিয়ে যায়। চেঁচিয়ে ওঠে--- করেন কী! করেন কী!
কাতর অনুনয়ে লোকটা লাল্‌টুকেবলেন--- আসলে মেয়ের বিয়ে তো। একজন পিতাই জানে, কন্যাদায়গ্রস্ত অবস্থা কী। তুমি কিন্তু আমার ওপরে রাগ করো না, বাবা। একা হতে সবটা সামলাতে গিয়ে নানা ভুলভাল হচ্ছে আমার। আমায় তুমি ক্ষমা করো। আমার জন্যেই তোমার এ্যাতোটা হেনস্তা হল।
লাল্‌টু নিজেকে সামলে নিয়ে বলে--- না না, রাগ-টাগ করিনি। আমি জানি, কন্যাদায় কী। 
এবারে মানুষটা লাল্‌টুর হাতদুটো ধরে বলেন--- তুমি বাবা, আমার মেয়ের বিয়েতে একবার আশীর্বাদ করতে এসো। তুমি না এলে আমার মেয়ের এই নতুন জীবন যে সর্বাঙ্গসুন্দর হবে, সার্থকও হবে না, বাবা। আমি তোমাকে নিমন্ত্রণ করছি। তুমি আসবে তো? আমি ঠিকানা লিখে দিচ্ছি। আমি তোমাকে দেখিয়ে সকলকে জানাবো, মানুষ আছে এখনও। সততা বলে, মনুষ্যত্ব বলে কথাগুলো কথা আছে। ওগুলো শুধু কথার কথা নয়।
লাল্‌টু পেছন ফেরে চলে যাবার জন্যে। যাবার আগে বলে যায়--- ধুর! ভদ্রলোকের বাড়ির কোনো বিয়েতে কেউ একটা ট্যাক্সি ড্রাইভারকে নিমন্ত্রণ করে নাকি! পাগল!

------------------------