শনিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১২

নিবন্ধ ৩



শিশির কুমার ভাদুরী---- একটি নাট্যযুগ

হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়

বাংলা থিয়েটারের আজ সুদিন বলা যায়। সুদিন আজ এমন একটা অবস্থায় এসেছে যে, আজ মানুষ একশো বা দেড়শ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে গ্রাম বা শহরতলী থেকে ঠেঙ্গিয়ে কলকাতায় শিশির মঞ্চ ( নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুরীর নামে উৎসর্গীকৃত), মধুসূদন মঞ্চ, রবীন্দ্র সদন অথবা অন্য কোথাও গিয়ে কিম্বা কোনো ক্লাব বা কোন থিয়েটার সংস্থার মাধ্যমে আহ্বায়িত নানা নাট্যদলের অভিনয় অর্থ ব্যয় করে দেখতে যান। যারা থিয়েটার করেন, এটা তাঁদের কাছে অনেক দিনের একটা স্বপ্ন, একটা সম্মান। আজ তা সফল হয়েছে। তাই অনেকে আজ বেশ প্রসন্ন। তাঁরা বলেন, আজ আমাদের থিয়েটার মানুষের চোখে জাতে উঠেছে। তাদের চোখে থিয়েটারের একটা কৌলীন্যপ্রাপ্তি ঘটেছে। কেউ কেউ বলে, নাটক ছিলো একটা নীরস দুর্বোধ্য জগত। আজ সাধারণের জগতে এসে দাঁড়িয়েছে। অভিনয় জগতকে একটি জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করবার জন্যে যে থিয়েটার শিল্পের সাথে গাঁটছড়া বাঁধতে হবে, এমন বিশ্বাস আজ শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের মধ্যেও একটা স্থান পেয়েছে। কিন্তু এমনটা তো একটা সময় ছিল না। এক সময় অর্থাৎ বিগত শতাব্দীর আট বা নয়ের দশকে থিয়েটার শিল্পকে দূরদর্শনের সাথে লড়তে হয়েছিলো। তখন দূরদর্শন নতুন এসে গোটা বিনোদন জগতটাকে মাত করেছিলো। তারও আগে, নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, গত শতাব্দীর প্রথম বা দ্বিতীয় দশকে থিয়েটার ছিলো একটা অচ্ছুত, অপাংক্তেয় ও অসুষ্ঠু বা উচ্ছৃঙ্খল কাজ মাত্র। সমাজে এর কোন স্থান ছিলো না। এই কারণে মহিলাদের এই শিল্পে আসাটাকে একেবারে সমাজবিরোধী কাজ বলে মনে করা হতো। সমাজ বহির্ভূত মহিলারাই এই জগতে পদার্পণ করতো। এমনকি আজও কোথাও কোথাও বলা হয়, মেয়ে কী করে? নাটক করে বেড়ায়? ও মেয়ে কোন বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চলবে না। নাটুকে মেয়ে চলবে না। সেই সময় যে মহিলারা দেহ ব্যবসা করতো, অথবা কলগার্ল ধরনের ছিলো, তাদেরকেই নাটকে পাওয়া যেতো, কেননা তাদের জীবনে হারাবার কোন ভয় ছিল না, পাশাপাশি একটা অন্য জীবিকাও তাদের হলো। আজও গ্রাম বা শহরতলীতে মেয়েরা নাটকে আসতে যে সঙ্কোচ করে না, এমন নয়। নাটক করলে বিয়ে হবে না--- এমন একটা প্রবাদ প্রচলিতও আছে। পুরুষদেরকেও একটা সময়ে নাটুকে বলা হতো। এমনকি আজও এমনটা বলা হয়, নাটক করিস না। যেন নাটক করাটা একটা কৃত্রিম, অবিশ্বাস্য বা ভরসাহীন ফালতু কর্মমাত্র। অনেকেই মনে করে, সত্যকে গোপন করার অপর নাম নাটক করা। কিন্তু নাটক যে একটা সম্মিলিত শিল্প সমন্বয়, ইংরেজিতে যাকে বলে কালেকটিভ আর্ট, সেটা আজও মানুষের রোজকার কথাবার্তায় ব্যবহৃত হয় না। এমন মনে করা হয়, যেন দু-চারটে মিথ্যে কথা বলাই হলো নাটক করা। কিন্তু আজ অন্তত একটা কাজ হয়েছে যে, শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা এমনটা মনে করছে না। তারা নাট্যচর্চাকে একটি মহান শিল্প মনে করুক, না করুক, নাটকে অভিনয় করা যে একটা বিরাট কাজ, এমনটা বুঝে ফেলেছে। নেহাত অকর্মণ্যেরা নাটক করে আর ছিপ দিয়ে মাছ ধরে--- এমনটা আজ আর সব মানুষ মনে করে না। অন্তত এটুকু আজ হাতে এসেছে। এটুকুই একটা প্রাপ্তি নাট্যচর্চাকারীদের কাছে। আজকে তারা মানুষের চোখে যে জাতে উঠে এসেছে, এমনটা কোন বিরুদ্ধবাক্য ব্যবহার না করেই বলা যায়। এমনটা সেই থিয়েটারে প্রত্যুষকালে ছিল না। তথাকথিত ভদ্রলোকেরা নাটক দেখতে যেতেন না। ইংরেজদের দেখাদেখি বাবুসমাজ নাটকের আয়োজন করতো আর তাতে তাদের উপপত্নীরা নাচাগানা করতো বলে সন্ধেবেলা মদ্যসহ ফুর্তি করতে তারা যেতো নাট্যাভিনয় দেখতে। তারা অনেকে এইসব নাটকের পৃষ্ঠপোষকও ছিল। কিন্তু দিন বদলেছে। আজ নাট্যশিল্প যে একটা মহান শিল্প, তা মানুষ একটু একটু করে হয়তো অনুধাবন করতে পারছে। সত্যিকারের ভদ্র-শিক্ষিত মানুষ আজ পরিবার সমভিব্যাহারে নাটক দেখতে পছন্দ করেন।
কী করে এমনটা সম্ভব হলো--- এমন যদি প্রশ্ন করা যায়, নিশ্চয়ই উত্তর আসবে, লেবেদফ থেকে বিজন ভট্টাচার্য প্রমুখ মহান শিল্পীদের হাত ধরে আজ এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে নাট্যশিল্প। কথাটা নিতান্ত মিথ্যে না হলেও সম্পূর্ণ সত্য নয়। এই শিল্পের প্রতি আত্ম-নিবেদন করেছেন, এমন আরো বেশ কিছু মানুষ ছিলেন। আজ মঞ্চে মঞ্চে যাদের নাম বার বার শোনা যায়, তাঁরা হলেন স্তানিস্লাভস্কি অথবা ব্রেটল ব্রেক্সট। কিন্তু সেই তাঁরা যাঁরা তাঁদের জীবন-যৌবন-ধন-মান উৎসর্গ করেছিলেন এই তথাকথিত অচ্ছুত, অস্পৃশ্য শিল্পকলার জন্যে, তাঁদেরকে বাঙ্গলা নিশ্চয়ই ভোলেনি। নাট্যমোদী মানুষ নিশ্চয়ই ঋষি ভরত বা শুদ্রককে ভোলেনি। কিন্তু তাঁদের কথা ওঠে কৈ? আর একটু আধুনিক হলে বলা যায় যে, তাঁরা গিরিশ বাবু, অহীন্দ্র চৌধুরী, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি প্রমুখ এবং যার কথা না বললে ইতিহাসটাই প্রতিবন্ধী হয়ে থাকে, তিনি শিশিরকুমার ভাদুরী। তাঁদের কথা ওঠে কৈ? বিশেষত শিশির কুমার ভাদুরী এমন একটি পর্বতপ্রমাণ ব্যক্তিত্ব যাঁর কথা বলতে গেলে যেটুকু যোগ্যতা থাকা দরকার, তা হয়তো আমাদের সকলের নেই। অথবা পর্বতকে খুব উঁচু পর্বত বললে, বা না বললে তার কিছু যেমন যায় আসে না, তেমনি আমাদের মতো ক্ষুদ্র মানুষের একটি সামান্য রচনায় তাঁর কথা না বললে বা না বললে অন্তত তাঁর কিছু যায় আসে না। তবুলে তো একটা ব্যাপার থাকে। তাই আজ তাঁর কথা বার বার মনে আসে। মনে আসেলতে, তাঁকে চাক্ষুষ সাক্ষাৎ পাইনি বলে তাঁর সম্বন্ধে যেটুকু পড়াশুনো করা গেছে, সেই কথা মনে আসে।
তিনি আজ থেকে দুটো শতাব্দী আগের মানুষ। বিগত সহস্রাব্দের শিল্পী। কিন্তু তিনি ইতিহাস নন। জীবিত, জাজ্বল্যমান ও চির-আধুনিক। আজকের কোন নাট্যশিল্পী তাঁকে বাদ দিয়ে নাটক রচনা থেকে শুরু করে নাট্য নির্দেশনা, অভিনয়য়, আলো, মঞ্চ, সাজসজ্জা কিছুই ভাবতে পারেন বলে অন্তত একজন নাট্যদর্শক হিসেবে আমার মনে হয় না। একজন স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়া মানুষ যে তথাকথিত উচ্চ পেশায় নিজেকে নিযুক্ত না রেখে, এমনকি সাহিত্যের অধ্যাপনা ছেড়ে দৃঢ় পদক্ষেপে নাটকের জগতে একেবারে পেশাদারী হয়ে চলে আসতে পারেন, এটা ভাবাও যেন সেকালে একটা দুঃস্বপ্ন ছিল। আজকের অনেক খেলোয়াড় আছে যাদের পড়াশুনো হয়নি বলে খেলাটাকে তারা বেছে নিয়েছে। কিন্তু শিশির বাবু যে সেকালের একজন এম.., তা তো ইতিহাস বলছে। শুধুমাত্র ছাত্রজীবনে স্কুল বা কলেজে যেটুকু অভিনয় তিনি করেছেন, তা যে তাঁর অন্য অন্য সাথীদের মতো তাঁরও হৃদয় থেকে কর্পূরের মতো উদবায়ু হয়ে যায়নি, সেই নাট্যাভিনয় যে তাঁকে পরবর্তীকালে নিয়ত সতত এক অমোঘ আকর্ষণে টেনেছে, তাঁর প্রমান মিললো যখন তিনি একটি স্থায়ী চাকরী পরিত্যাগ করে একটি অনিশ্চিত জীবনে ও জীবিকায় পা রাখলেন। নাট্য জীবন। অভিনয় করবো। পেশাদারী অভিনয় করতে হবে যাতে মনের এবং প্রয়োজেনের সবটুকু ঢেলে দিতে পারি নাট্যাভিনয়ের জন্যে। সময়টা ১৯২১ সাল। অবশ্য সেকালে অপেশাদার নাট্যাভিনয় নিয়মিত ছিলো না বা ছিলো না গ্রুপ থিয়েটারের অস্তিত্ব। ছিলো বোর্ড থিয়েটার অর্থাৎ পেশাদারি নাটক। অর্থাৎ অর্থের জন্যে নাটক। আদর্শ বা দায়বদ্ধতার জন্যে নয়। তখন তাঁর সামনে নাটকে আধুনিকত্বের দিশারী কে? তাঁর আইডল কে? কেউ না। নিজের দিশারী তিনি নিজে। এই পেশায় প্রাণধারণ করা যাবে তো? ভাবেননি। এই পেশায় নিজেদের পরিবারে ঠাই মিলবে তো? তাকিয়ে দ্যাখেননি। নাটকটা করতে হবে। যেন তেন প্রকারেণ--- করতে হবে। তা নয়তো যে প্রাণ বাঁচে না। মঞ্চে আমি, নানা চরিত্রকে নিজের মতো করে ভেবে ভেবে এঁকে এঁকে দেখাবো, মানুষ দেখবে, বিস্মিত হবে, সামনে সারি সারি মাথা, অগণিত মাথা, তাদের করতালি, শিল্পীর সাথে মানুষের এই যে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের মন্দির নাটমঞ্চ, তা থেকে সরে থাকা যাবে না। এইসবই তাঁর বুকে অনুরণন হয়ে বেজেছে অহরহ। সর্বক্ষণ। নাট্যদল কী করে গঠন করা যায়, সে অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রথমেই তিনি কলকাতার একটি পেশাদারী সংস্থায় যোগ দেন। নাম ম্যাডান থিয়েটার। কতই বা বয়স তখন? তিরিশ-টিরিশ। স্কুলে বা কলেজে নাট্যাভিনয় আর একেবারে সোজা গণ-দর্শকের সামনে এসে অভিনয় করা যে অনেক অনেক পার্থক্য, তা অনুভব করেই তিনি ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যপনাকে তুচ্ছ করে বেরিয়ে আসেন। ম্যাডান থিয়েটারে ডি.এল. রায়ের লেখা আলমগির নাটকে একেবারে সোজা লিড রোলে অভিনয় করেন। স্বয়ং নায়ক আলমগির। আর প্রথম অভিনয়েই সাফল্য।  
কোনো সন্দেহ নেই, শিল্পকে পেশাদারী ক্ষেত্রে গ্রহণ করলে একটা নেতিবাচক দিক ক্রিয়া করে। দর্শকের মনোরঞ্জন করতে হয়। দর্শক ও ব্যবসার সাথে কম্প্রোমাইজ করতে হয়। নিজের চেতনা বা সত্তাকে বিক্রি করতে হয়। ফলে মন চায় না, এমন অনেক কাজ করতে হয়। আজকের মঞ্চের বাঘা বাঘা অভিনেতা যেমন ওমপুরি, নাসিরুদ্দিন শাহ্‌, নানা পাটেকর, শাবানা আজমীদেরকে দেখলে তাই দুঃখ হয়। অমন অমন প্রতিভা প্রোডিউসারদের হাতের পুতুল! কী সস্তা খেলো কাজে নিজেদেরকে হিন্দি সিনেমায় বিক্রি করছেন! টাকা চাই, আরো টাকা। মেনে নিতে হয়। শিল্পে পেশাদারিত্বে লক্ষ্মীদেবী সর্বস্বতী দেবীর ওপর রাজত্ব করেন। কিন্তু আপোষ করেননি নাকি শিশির বাবু। তিনি যা করতে চেয়েছেন, দর্শককে তাই দেখতে হয়েছে। তিনি অভিনেতা, অর্থাৎ নেতা। তিনি যা বলবেন, যা করে দেখাবেন, তাই দর্শককে দেখতে হবে, কেননা তিনি রাতের পর রাত বিষয়টি নিয়ে ভেবেছেন, জেনেছেন, পড়েছেন। দর্শক একবার অভিনয় দেখেই দুম করে ভালো বা মন্দ বিশেষণ দিয়ে দেবে, এমনটা অন্তত তিনি মেনে নেন নি। একটা উদাহরণ দিলে এই দুর্‌বিশ্বাস্য সত্যটি হয়তো পরিষ্কার হবে। একবার তিনি রীতিমতো নাটক অভিনয় করছেন। সেখানে একটি দৃশ্যে তিনি দর্শক আসনে অভিনেতা বসিয়ে রেখে অভিনয় চলতে চলতে তাকে অভিনয়ের অংশ হিসেবে দর্শক আসন থেকে সোজা তুলে এনে মঞ্চে কাজ করিয়ে নেবার পরীক্ষা করতে কিছু দর্শক জীবনে প্রথম নাটকে এমনটা দেখে বিস্মিত হয়ে সোরগোল করে ওঠে। শিশির বাবু অভিনয় বন্ধ করে দিয়ে তাদেরকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনারা যারা অভিনয়ের এই নতুন ধারাটি বুঝতে পারেননি, তাঁরা আপনাদের দয়া করে আসন ছেড়ে চলে যেতে পারেন। আপনাদেরকে টিকিটের মূল্য ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু কোন গণ্ডগোল অভিনয় চলাকালে করবেন না। পরে এই দর্শক আসন থেকে অভিনেতা উঠে আসার বিশেষ কায়দাটি নাট্যশিল্পে বার বার অনুসৃত হয়েছে। আমি সাক্ষী, উৎপল দত্ত মহাশয়ও তাঁর একটি নাটকে এমনিভাবে অভিনয় ভেঙ্গে বেরিয়ে এসে দর্শকদের সাথে এই একইভাবে একই পরিস্থিতিতে কথা বলে উঠেছিলেন। তিনি কাকে অনুসরণ করেছিলেন? শিশিরকুমার ভাদুরি। শাহজাহান চরিত্রে অহীন্দ্র চৌধুরী শাহজাহানের একদিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত দেখিয়ে অভিনয় করেছিলেন। সেটাই ছিল তখনকার চল। কিন্তু অভিনবত্বের ওপর নাম শিশির কুমার ভাদুরী। তিনি শাহজাহানকে সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্ত দেখিয়ে দাবি করেন, ইতিহাসে কোথাও সম্রাটের এক অঙ্গ পক্ষাঘাত লেখা নেই। এমন আরো অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায় এই বিরল প্রতিভা সম্বন্ধে। গল্পের শেষ নেই। তিনি যে কিংবদন্তী।
শিশির বাবু কতটা অনাপোষবাদী মানুষ ছিলেন, পেশা রক্ষা করতে গিয়ে যে তিনি নিজেকে বিক্রি করতে চাননি, তার বিরাট ও জ্বলন্ত প্রমান তাঁর স্বাতন্ত্র বোধ। আর তাই এরপরেই তিনি ম্যাডান থিয়েটারএর সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেন তাদের হাতের পুতুল হয়ে অভিনয় করবেন না বলে। তিনি শিল্পী, তিনি স্বাধীন, স্বতন্ত্র। মঞ্চের ব্যাপারে কারোর খবরদারী তিনি মেনে নেননি। হয়তো আজ গ্রুপ থিয়েটারের আমলে তাঁর এই চরিত্রকে অনেকে একনায়কতন্ত্রের আলোকে বিচার করতে পারে, কিন্তু তিনি তিনি ছিলেন। তাঁর তুলনা তিনি নিজে। তিনি স্বাধীন ছিলেন কিন্তু স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না। ম্যাডান থিয়েটার ছেড়েই কথা নেই বার্তা নেই, তিনি সরাসরি চলে যান চলচ্চিত্র জগতে। কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই আবার ঝুঁকি। তখন সিনেমাকে বলা হতো মোশন পিকচার। তিনি পরপর দুটি সিনেমায় অভিনয় করেন কথা সাহিত্যিকের রচনার ওপর--- আঁধারে আলো এবং চন্দ্রনাথ। নাট্যাভিনয় ও চলচ্চিত্রাভিনয় যে সম্পূর্ণ পৃথক, তা অন্তত যাঁরা অভিনয় করেন, তাঁরা জানেন। হয়তো সে সব কোন প্রগতিশীল প্রযোজনা নয় এবং তা তাঁর নিজের নির্দেশনার ওপরেও তৈরী হয়নি, তথাপি তাঁর শুরুটি ছিলো একেবারে হপ্‌, স্কিপ এ্যান্‌ড জাম্প
তিনি প্রথম চলচ্চিত্রে নির্দেশনা দেন মোহিনিতে। শুধুমাত্র অপরের চলচ্চিত্র নির্দেশনা দেখেই তিনি এই শিল্পটি আয়ত্ত করে নেন্‌। কোনো ব্যক্তির আয়ত্বে বা কোনো সংস্থাতে তিনি এই চলচ্চিত্র নির্দেশনা শিল্প কিম্বা ক্যামেরা শিল্প অথবা চিত্র নাট্যকার হবার শিল্প তিনি শিক্ষা করেননি। আকাশছোঁয়া আই.কিউ. ছিলো তাঁর, যাকে মানুষ বলে জাত শিল্পী। আর তারই ওপর ভর করে তিনি নাট্যাচার্য। এই চলচিত্রের পর আবার তিনি ফিরে আসেন নাট্যশিল্পে। নিজের একটি দল প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময় দল প্রতিষ্ঠার চল ছিলো না। কিন্তু তিনি যেন গ্রুপ থিয়েটার কনসেপ্ট দিয়ে গেলেন নাট্য চর্চাকারীদেরকে। গ্রুপ থিয়েটার গঠন হবার হবার পর তারা কাজ করতো একটা দায়বদ্ধতা মাথায় নিয়ে। একটা সামাজিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক দায়বদ্ধতা ছিল তাদের। তার ওপর দাঁড়িয়ে তাঁরা নাট্য রচনা ও অভিনয় করতেন। আজ অবশ্য সেই আদর্শের দিন আর নেই গ্রুপ থিয়েটারের। বিনোদের কাছে অনেকে বিকিয়ে  গেছে। কিন্তু শিশির বাবু হয়তো তেমন কোনো দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করেননি। শুধু অভিনয়প্রিয়তা তাঁকে ছুটিয়ে নিয়ে বেরিয়েছে। পর পর তিনি সীতা,চাণক্য, রীতিমত নাটক (টকি অব টকিজ---নিজের রচনা), পল্লীসমাজ, বিচারক, বরের বাজার, কমলে কামিনী আলমগির, শাহজাহান, মাইকেল, বিপ্রদাস, তখৎ-এ-তাউস, বিন্দুর ছেলে, দুখীর ইমান আরো অনেক প্রযোজনায় তিনি অভিনয় করেন মঞ্চে এবং পর্দায়। হয়তো এই সব নাটকের বা চলচ্চিত্রের তৎকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কোন উপযোগিতা বা দায়বদ্ধতা ছিল না, হয়তো এর মধ্যে কিছু কিছু নাটক ইতিহাস আশ্রিত হলেও ঐতিহাসিক নয়, ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে বা বিকৃত করেই শুধু নাটকের স্বার্থে ডি.এল. রায় প্রমুখ মানুষ সেইসব রচনা করেছিলেন, হয়তো আলমগির-শাহজাহান বা সিরাজদউল্লা চরিত্রগুলো কোন সাহিত্য রচনার আধার হতে পারে না, অন্তত ইতিহাস তা বলছে না, হয়তো এইসব নাটক রামকৃষ্ণের মতে কোন লোকশিক্ষা দেবার মতো নাটক ছিল না, তথাপি তা নাট্য ও চলচ্চিত্র জগতের উত্তরাধিকারদের কাছে এক একটি নক্ষত্র হয়ে আছে।
যেহেতু তিনি পেশাদারী ছিলেন, তিনি কখনও নাট্য বিষয়কে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে নাট্যাবেগ, নাটকীয় দ্বন্দ্ব ও সংলাপকে বেশী গুরুত্ব দিতেন, যাতে তা দর্শকদেরকে অডিটোরিয়ামে বন্দি করে রাখে। এমন নয় যে, তাঁর ইতিহাস প্রীতি ছিল না। কিন্তু মানুষের মধ্যে থিয়েটার প্রীতি সৃষ্টিতে এটুকু আপোষ তিনি করেছিলেন হয়তো। সেইসব নাটকে তিনি তাঁর নিজের সৃজনী সত্তা যে স্পষ্ট তুলে ধরেছিলেন, তাতে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। তবে তাঁর অভিনীত বিসর্জন নাটকটি এবং তাতে জয়সিংহরঘুপতি চরিত্রে তাঁর অভিনয় অবশ্যই একটি উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা। হয়তো সামাজিক বা অন্য কোনো দায়বদ্ধতা থেকে তিনি রবিঠাকুরের বিসর্জন প্রযোজনার জন্যে বেছে নেননি। এই কাব্যনাট্যে অভিনয়ের সুযোগ, নাটকীয় সংঘাত, সংলাপের ভার ইত্যাদি তাঁকে টেনেছিলো। শিল্পকে তিনি চিরকাল সুরুচিসম্পন্ন বিনোদনের বিষয় বলে দেখে এসেছেন। শিল্প পাঠশালা নয়--- এই বিতর্ক আজও আছে। এ থেকে মানুষ কোন শিক্ষা লাভ করুক, এমনটা রামকৃষ্ণ ভেবে নিলেও তিনি বাস্তববাদী হিসেবে এই বিষয়কে গুরুত্ব দেন নি। মাধ্যমটিকে মানুষের দরবারে পৌঁছে দিতে হবে। যে কোন উপায়ে তা করতে হবে। শুধু মনেন রাখতে হবে যে, নিজের মাথা বিক্রি করে দিয়ে নয়। এমনকি সেকালে নিজের দেশে নাট্যচর্চা শুধু নয়, সীতা নাটকটি নিয়ে তিনি সুদূর অ্যামেরিকা পাড়ি দেন, যে সীতার সামাজিক সত্তা সে দেশের সংস্কৃতির সাথে আদৌ মেলে না। সেকালে ও দেশে তেমন সংখ্যক বাঙ্গালী বসবাসও করতো না। কিন্তু এই দুঃসাহস তিনি দেখাতে পেরেছিলেন এবং এই একটি প্রযোজনায় ও দেশে তাঁর যথেষ্ট খ্যাতিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। আজ যখন কোনো কোনো নাট্যদল দালাল ধরে বিদেশ যায়, তখন এই বিদেশে গিয়ে এ দেশের নাট্যচর্চা প্রচারের ও প্রসারের পথটা যে তিনিই দেখিয়ে দিয়েছিলেন, তা মনে পড়ে যায়।
তাঁর এই অনাপোশবাদী মন তাঁকে বিতর্কিত মানুষ হিসেবেও উপস্থাপিত করেছিলো। এমনকি তথাকথিত রাষ্ট্রীয় সম্মাননা যে অনাপোশবাদী হিসেবে প্রত্যাখ্যান করা যায়, সেই দৃষ্টান্ত তিনিই দেখিয়েছেন। তাঁর প্রতিভা প্রত্যক্ষ করে সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ সম্মাননা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি সরাসরি ফিরিয়ে দেন। মনে মনে হয়তো বলেছিলেন এ মণিহার আমায় নাহি সাজে...। তাঁর এই প্রত্যাখ্যানের মূল কারণ এই যে, তিনি এই উপাধির বদলে একটি নাটমঞ্চ চেয়েছিলেন সরকারের কাছে। কিন্তু তা হয়নি। মানুষের অর্থ নিয়ে অনেক পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা হয়েছে, মানুষ মারার জন্যে প্রতিরক্ষা খাতে বহু টাকা ব্যয় হয়েছে। কিন্তু নাটমঞ্চ? পরে হবে। তাই তিনি নিজের উদ্যোগেই শ্রীরঙ্গম প্রতিষ্ঠা করেন, যার পরে নামকরণ হয় বিশ্বরূপা
এমন ঔজ্জ্বল্যের মধ্যেও তাঁর জীবনে সুখ আসেনি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন দুঃখী। এর জন্যে যে তিনি দায়ী নন্‌, তা নয়। তিনি এমন একটি মহিলাকে বিবাহ করেছিলেন যিনি তাঁর সংসার ছাড়া এই অতিব্যস্ত জীবন এবং অত্যন্ত পরিশ্রমজনিত কারণে মদ্যপানের অভ্যাস সইতে করতে পারেননি। একজন সাধারণ নারী হিসেবে এই যন্ত্রণা সইতে না পেরে তাঁকে আত্মহত্যা করতে হয়েছিলো। যেমনভাবে প্রতিভাশালী মানুষ জীবন যাপন করেন, তেমনই পরিবারের প্রতি শিশির বাবু অত্যন্ত উদাসীন ছিলেন। এই যন্ত্রণা তিনি তাঁর প্রথমা স্ত্রীকে দিয়েছিলেন। অবশ্য পরে তিনি নিজেকে শুধ্‌রে নেন বটে। একজন নাট্যসংযুক্ত মহিলা কঙ্কাবতী সাউকে পরবর্তীকালে বিবাহ করেন। শিশির কুমার ভাদুরী কী মাপের যোদ্ধা ছিলেন, তা একটি উপমায় অনেকটা পরিষ্কার হতে পারে। আজ জীবনের প্রায় অশীতিপর মানুষ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে আজও মঞ্চে দাপিয়ে নাটক লিখছেন, রাজা লিয়ার বা আরো নানা নাটকে অভিনয় করে চলেছেন, তা তো কেবল তাঁরই প্রদর্শিত পথ। এই বিরল প্রতিভা তো আজ তাঁরই একমাত্র জীবিত নাট্যসন্তান। এই বয়সে কিভাবে এমন শক্তি তিনি পান, যখন মানুষ এই বয়সে জবুথবু পঙ্গু জীবন যাপন করে! এই জীবনী শক্তির বীজ রোপণ করেছেন নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুরী।
হয়তো এই ইতিহাস অনেকের জানা, কিন্তু আমি নিশ্চিত, সকলের জানা নয়। তাদের উদ্দেশেই এই নাতিদীর্ঘ নিবন্ধ।
------------------------

শব্দসংখ্যা ২,৫০০


আলমগির-শাহজাহান বা সিরাজদউল্লা চরিত্রগুলো----- হয়তো প্রচলিত পাঠ্য ইতিহাস বইগুলোতে এইসব ব্যক্তিদেরকে নিয়ে নানা গল্পগাথা লেখা হয়েছে, তথাপি ইতিহাস জানে যে, এ দেশের ইতিহাসে তাদের কোন স্থান নেই। আলমগির বা সাজাহান এ দেশের কেউ ছিল না। তারা ছিল সাম্রাজ্যবাদী শাসক মাত্র। বাবরের হাত ধরে তাদের এই দেশে আগমন। আর সিরাজ? সে তো লম্পট, মদ্যপ ও একটি স্বেচ্ছাচারী তরুণ মাত্র যে তার মাতামহর অন্যায় প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠেছিল। কোন নাটকে এই চরিত্রগুলো নায়ক হওয়ার অর্থ ইতিহাসকে বিকৃত করা। মিথ কখনও কোন মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। দেশাত্মবোধ কোন মিথ্যেকে আশ্রয় গড়ে উঠতে পারে না।

বৃহস্পতিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১২

'ফেরা' ছোটগল্প


ফেরা
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়

(১)

ফ্ল্যাটের ব্যাল্‌কনি-তে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রবিবারের সকালে চা-এর আমেজ উপভোগ করছিলো প্রান্তিক। সঙ্গে দুটো বিস্কুট। চা-টা শুধু শুধু খেতে পারে না ও। এ্যাতোটা বয়সেও বাচ্চাবেলার বিস্কুট-প্রীতি যায়নি প্রান্তিকের। যারা চা-তাল মানুষ, তারা সাধারণত চা খায় কোনো অনুষঙ্গ ছাড়াই। কিন্তু প্রান্তিক আজো চা-বিস্কুট। হঠাৎই ওর চোখে পড়ে কুকুরটা। রাস্তায় বসে গ্যাছে। সামনের পা দুটো জোড় করা টান্‌ টান্‌। পেছনের পা দুটো ভাঁজ করে রাস্তায় রেখে তার ওপরেই যেন উবু হয়ে বসেছে। লেজটা নড়ছে। সামনের পা দুটো খটাখট খটাখট করে লেফ্‌ট-রাইট করছে যেন। মুখে একটা কুই কুই শব্দ আর চাকুম-চুকুম করে জিভ চাটছে। কুকুরটার দৃষ্টি সোজা দোতলায়। 
সামনের মাসে পুজো। সবাই উৎসবে উন্মত্ত। প্রান্তিকদের এবারের পুজো কাটবে বিদেশে। কিন্তু কুকুরদের তো পুজো থাকে না। আজ অন্তত মাস খানেক হয়ে গেছে, এই জরাজীর্ণ কুকুরটাকে পাড়ায় ঘুরতে দেখছে প্রান্তিক। আগে তেমন দোতলার দিকে তাকাতো-টাকাতো না। বড়োজোর একবার টেরা চোখে তাকিয়ে চলে যেতো। বেশ সলজ্জ তাকানো। যেন কাউকে কিছু বলার নেই, কিছু চাইবার নেই। কোথায় চলে যেতো, কে জানে! ওর শরীরে তেমন কোনো চমক নেই যে, চোখে পড়বে। না বড়ো বড়ো লোম, না মোটা লেজ, না বেশ ঝোলা ঝোলা কান। বরং উল্টো। কুকুরটার গায়ের লোম খাবলা খাবলা উঠে গেছে এখানে ওখানে। কোমরের হাড় দুটো ভীষণভাবে জেগে ওঠা, একটা কান খাড়া, একটা কান ভেঙ্গে ঢুকে গেছে। সেখানে একটা ঘা মতো। মাছি বসছে। সেই কানটা ঠিক মতো নাড়াতেও পারে না। যে কানটা খাড়া, সেটা নড়ে। অপুষ্টি বা খাদ্যহীনতায় শিরদাঁড়া-টা পর্যন্ত কিছুটা বেঁকে গেছে। একটা লজ্জা লজ্জা ভাব করে ঘুরে বেড়ায় পাড়ার মধ্যে। কুকুরটা মাদী কুকুর। কিন্তু শরীরে এমন জৌলুস নেই যে, বেপাড়ার কোন একটা মদ্দা কুকুরকে প্রলুব্ধ করবে। তবুও যৌবন থাকুক না থাকুক, ওরা  পোয়াতি হয় আশ্বিন মাস এলেই। কুকুরটাকে কে-ই বা খাবার-টাবার দ্যায়, কে জানে! কে জানে, এটা থাকেই বা কোথায়! দেখে বোঝা যায়, কুকুরটার গায়ে যে লোম ছিলো, তা বোধহয় লালচে আর সাদা দিয়ে ছোপ ছোপ দেওয়া। বোধহয়। নিশ্চিত বোঝার তেমন কোনো উপায় নেই। লোকে বলে ঘিয়ে ভাজা
প্রান্তিক দেখেছে, পাড়ার বাচ্চাগুলো মাঝে মাঝে ঢিল নিয়ে তাড়া করে কুকুরটাকে। দেখলে মনে হয়, কুকুরটা যেন ওদের বিরাট কোনো ক্ষতি করেছে। এমন নয় যে, ওটা সারা রাত ঘেউ ঘেউ করে পাড়ার মানুষের মাথা খায়। না কাউকে দেখলে কামরাতে যায়। শান্ত, নির্ঝঞ্ঝাট। তবুও...। তাড়া খেয়ে কুকুরটা পালাতে পথ পায় না। গায়ে তেমন শক্তিও নেই যে, ছুটে ওদের নাগালের বাইরে চলে যাবে। ঢিলটা বা লাঠিটার বাড়ি খেয়েই যায়। আঘাত খেয়েই কেউ কেউ করে ওঠে। বাচ্চাদের সেদিকে দৃকপাত নেই। যেটা ওদের কাছে খেলা, সেটা যে ওর কাছে অত্যাচার--- তা বোধহয় ওদের কেউ কখনও শেখায়নি।
প্রান্তিকের মনে পড়ে, ছোটবেলায় এমনটা ছিল না ও নিজে। রাস্তা থেকে বেড়াল ছানা বা কুকুর ছানা কুড়িয়ে নিয়ে আসতো। ভয় ছিলো, বাবা বকবে। জন্তুশুদ্ধ বাড়ি থেকে বের করে দেবে। তাই লুকিয়ে নিজের খাবারের ভাগ নিয়ে যেতো খাটের তলায় ঝুরি চাপা দিয়ে রাখা জন্তুটার জন্যে। বাবা কখনও কোনো পোশ্য বরদাস্ত করতে পারতেন না। কিন্তু বাড়িতে কোনো গরুটা বা ছাগলটা ঢুকলে বাবা তাদেরকে মারতেও দিতেন না। তাড়িয়ে দিতে বলতেন। ফলে জন্তু-জানোয়ারকে এভাবে মারা-টা শেখেইনি প্রান্তিক। তাই বাচ্চাদের এমনটা করতে দেখলেই বকে দ্যায় প্রান্তিক।
কিন্তু আজ তো কুকুরটা রাস্তাতেই বসে গেছে। প্রান্তিকের কাছে খাবার চাইছে--- এটা স্পষ্ট। কিন্তু একে খাবার দেওয়া তো বিড়ম্বনা। মাথায় উঠে বসবে। রাস্তার কুকুর। এর দিকে দয়া-দৃষ্টিপাত করা দায়। কিন্তু এর দায় নেওয়া? নৈব নৈব চ। সেটা তো চলে না। তাই কুকুরটার নির্বাক প্রার্থনায় সাড়া দিলো না প্রান্তিক। বিস্কুটের অবশিষ্ট টুকরো মুখে ফেলে দিয়ে সবে পেছন ঘুরেছে, দ্যাখে, মা দাঁড়িয়ে। কখন যেন মা এসে দাঁড়িয়েছে পাশে।
--- বিস্কুটের টুকরোটা দিলে পারতিস বেচারাকে।
--- তুমি ক্ষেপেছো! দিয়ে মরি আর কি! কাল থেকে এটাই ওর বরাদ্দ হয়ে যাবে।
--- না, আসলে কুকুরটার না বাচ্চা হয়েছে সবে। এখন তো ওর বিরাট খিদে। রাস্তার কুকুর। কে-ই বা খাবার দেবে ওকে, বল্‌!
এবারে খেয়াল হয় প্রান্তিকের--- সত্যিই তো, কুকুরটা মা হয়েছে। কুকুরটার বুক জুড়ে মাতৃস্তন। সেগুলো দুধে টই-টম্বুর। কিন্তু ততক্ষণে কুকুরটা হতাশ হয়ে হাঁটা দিয়েছে। যেই দেখেছে যে, প্রান্তিক বিস্কুটের একটু অংশও দিলো না, অমনি হাঁটা দিয়েছে। প্রান্তিক ব্যাল্কনি থেকে একটু ঝুঁকে দেখে নিলো। কিন্তু কুকুরটা নেই। অন্য কোথাও খাবারের সন্ধানে হয়তো হাঁটা দিয়েছে। একবার মনে হলো ওর, দুটো বিস্কুট দিলে কীই-বা ক্ষতি হতো!
--- তোদের কি যাওয়া ঠিক হয়ে গেছে?
প্রান্তিক একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলো। আজকাল এই একটা ব্যাপার হয়েছে। কেন যেন মনটা হঠাৎ হঠাৎ করে কোথায় চলে যায়! তাই মার কথাটা তেমন কানে ঢোকে না। মা আবার প্রশ্ন করে,
--- হ্যাঁরে, তোদের ঐ যে ভিসা, না কি বলে যেন... তা কি হয়ে গেছে?
চম্‌কে তাকিয়ে প্রান্তিক বলে--- না, মা। এখনও হয়নি। তবে হয়ে যাবে। এটা তো আমার হাতে নেই। কোম্পানী দেখছে। তাদের সব বড়ো বড়ো ব্যাপার। পাঁচটা সোর্স। ওসব পেতে সমস্যা হবে না। চিন্তা একটাই। তোমাকে ফেলে যেতে হচ্ছে।
মা বলে--- না, আমি আমার কথা ভাবছি না। আমি তো আর অসুস্থ নই। আমি ভাবছি অন্য কথা।
--- অন্য কথাটা কী?
--- ভাবছি, তোরা সবাই যদি এভাবে বিদেশে চলে যাস, তবে এই হতভাগা দেশটার কী হবে?
--- দেশটার কী হবে মানে? কী আবার হবে! সবাই তো যাচ্ছে না। কেউ কেউ। সবাই কি এই সুযোগ পায় নাকি! প্রান্তিক আত্মপক্ষ সমর্থন করে।
মা বলে--- একটা কথা ভেবে দ্যাখ, পিতু। সবাই এই দেশের সন্তান। এটা আমিও মানি যে, দেশের কাছে সবাই সমান। কিন্তু একটা দেশ কোন সন্তানের বেশী নির্ভর করে? যে সন্তান নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, দেশকে কিছু দিতে পারে, দেশের মান-মর্যাদা বাড়াতে পারে।
--- ঐ তো। ওইটাই তো বলছি, মা। একটা দেশের কোনো সন্তানকে যখন বিদেশ ডেকে নিয়ে যায়, তাকে পেতে গেলে অনেক দাম দিতে হবে জেনেও ডেকে নিয়ে যায়, সেটা কি দেশের পক্ষে গর্বের ব্যাপার হয় না? তাতে কি দেশের মান-মর্যাদা বাড়ে না, মা? তার সন্তানের ওপরে যে বিদেশ নির্ভর করে থাকে, এতে কি দেশের অহংকার হয় না?
--- শুধু অহংকার দিয়ে তো পেট ভরে না রে, পিতু। এই দেশের অন্ন-জলে তুই বড়ো হলি। এই দেশের মানুষ তোকে অর্থ দিলো এঞ্জিনিয়ারিং পড়বার জন্যে, মান-সম্মান দিলো, সরকার তোকে নানা সুযোগ-সুবিধে দিলো। আর তুই তাদেরকে ছেড়ে চললি! এটা কি ভালো, বাবা? একটা কৃতজ্ঞতাও তো থাকে, নাকি।
প্রান্তিক এসব ব্যাপার নিয়ে বেশী কথা বলতে চায় না মার সাথে। তাই মাকে এই কথাটা বলে চুপ করিয়ে দেয়। একটাই কথা ওর মনে হয়। কৃতজ্ঞতা থাক, না থাক--- কৃতঘ্নতা তো ওর মধ্যে নেই। এ দেশের মন্ত্রীগুলো তো তাও মানে না।  
অটোমোবাইল এঞ্জিনীয়ারিং পাশ করে বেরোবার আগেই প্রান্তিকের মতো ট্যালেন্টকে ক্যাম্পাস থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ইন্ডিয়ার অন্যতম প্রথম সারীর ফারগুসন অটোমোবাইল্‌স চাকরী দিয়েছে। শুধু চাকরী নয়, নিজের গাড়ি, ফ্ল্যাট, মোটা মাইনে, যখন তখন বিদেশ ভ্রমণ--- কী নয়! সব দিয়েছে। লোন নিয়ে পড়াশুনো শুরু করেছিলো ও। চাকরী করতে করতে ঝটিতি লোন পরিশোধ করে দিয়েছে। প্রান্তিকের বাবাকে কোন চিন্তা করতে হয়নি। কিন্তু তিনি ছেলের নাম, খ্যাতি বা ধন-ঐশ্বর্য কিছুই ভোগ করতে পারেননি। হঠাৎ একটি সেরিব্র্যাল আক্রমণে সোজা হাসপাতাল, আর সেখান থেকে বাড়িতে এসেছিলেন বটে, কিন্তু নিথর নিষ্প্রাণ দেহ নিয়ে এসেছিলেন। প্রথম দিকটায় পুরনো বাড়ি ছেড়ে ওরা ফ্ল্যাটে আসেনি। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর আর ঐ ঝর্‌ঝরে বাড়িতে পড়ে না থেকে তিন তলায় এসে উঠেছে। মাকে যাবতীয় ভোগ-সুখ দিয়েছে প্রান্তিক। মার নিজস্ব একটা রঙ্গিন টেলিভিশন, একটা ছোট্ট নিরামিষ রেফ্রিজারেটর, একটা শ্বেত পাথরে মোড়া ছোট্ট ঠাকুর ঘর। আসলে বাবা যা যা ভোগ করতে পারেননি, সে সব মাকে দিতে চেয়েছে প্রান্তিক। কিন্তু প্রান্তিক মনে করে, ওর যে ট্যালেন্ট, তাতে এ দেশ ওকে যথেষ্ট এন্‌টারটেইন করছে না। একবার এই কোম্পানিটা ধরে বছর দশেকের জন্যে ফরেন ঘুরে আসতে পারলেই ওর দাম বেড়ে যাবে। তারপর একটার পর একটা কোম্পানী লাইন লেগে যাবে প্রান্তিক সরকারকে তুলে নিয়ে যেতে। কে ওকে আগে নিতে পারে, কে ওকে বেশী অফার দিতে পারে--- এই নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে। কোম্পানি ওকে বিদেশ পাঠাতে চায়। তাদের মনে এটাই আশা যে, প্রান্তিক তাদের সুপারিশে যাবে বিদেশে। ফলে ওকে বেঁধে ফেলা যাবে একটা অটুট বন্ধনে। অন্তত একটা কৃতজ্ঞতা থেকে ও ছিট্‌কে যাবে না। কিন্তু প্রান্তিক জানে, একবার বাইরেটা মেরে এলে ওসব ফারগু-মারগু পাত্তা দেবে না প্রান্তিক সরকার। ফ্যালো কড়ি মাখো তেল। এ লাইনে কে কার! যেখানে চাঁদি ফুটবে সেখানে চাঁদ উঠবে। সোজা কথা। কে আমাকে কবে কি দিয়েছে, তার লেবেঞ্চুশ আমি চিরকাল চুষবো, সে গুড়ে বালি।
ইন্টারন্যাশনাল পাসপোর্ট আগে থাকতেই ছিলো প্রান্তিকের। ভিসাটার জন্যে আটকে আছে। তবে সেটা তো আর ওর মাথাব্যথা নয়। বিদেশি কোম্পানী ঠিক বুঝে নেবে বাঘের দুধ কীভাবে মেলে। সামনের মাসেই যেতে হবে। কিন্তু মাকে সাথে নেওয়া হবে না। কারণ নম্বর এক, কোম্পানী এ্যালাউ করবে না। মিনিমাম দশ বছর। অনলি ফ্যামিলি। স্ত্রী আর সন্তান। কারণ নম্বর দুই, মা তো বিদেশে যাবে না। সেখানকার মানুষদেরকে মা ম্লেচ্ছ বলে। ওরা নাকি এঁটো-কাঁটা মানে না, পুজো-অর্চনা নেই। মার তো আবার গোপাল আছে। তাকে নিত্য ভোগ দেবার ব্যাপার আছে। ছেলে তো অফিসেই খায়, আর তাই ঘরের গোপালকে ভোগ না দিতে পেরে ধাতুর গোপাল-ই সই। সে সব তো ব্রিসবেনে হবে না। এসব প্রান্তিক ভালোই বোঝে।
মা-ও জানে ছেলে, বৌ আর নাতি চলেছে বিদেশে অন্তত দশটা বছরের জন্যে। কিন্তু সে রা-টি কাটেনি। এই আজ প্রথম প্রান্তিককে দেশের দোহাই দিলো মা। এই প্রথম। প্রান্তিক জানে যে, আজকাল টেলিভিশনে প্রায়ই এই নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক হয়, ফিল্ম হয়, ম্যাগাজিন প্রোগ্রাম হয়। ব্রেনড্রেন, নারী নির্যাতন, শিশুশ্রম, বা শিশু নির্যাতন, আরো কত কী! মা এসব দ্যাখে। হাতে তো কোন কাজ নেই। মনে মনে প্রান্তিক বলেও, আরে বাবা, সিনেমা দ্যাখো না। সিরিয়াল দ্যাখে মেয়েরা। তাই দ্যাখো না। এসব বাজে ঘেঁষো কথা শুনতে কে যে বুদ্ধি দেয়, কে জানে। বাবা মারা যাবার আগে মার এসব ছিলো না। আজকাল মা আবার বই পড়া ধরেছে। সব দামী দামী বই পড়ছে অঞ্চলের এক লাইব্রেরী থেকে এনে। এর জন্যে অবশ্য দায়ী প্রান্তিকের স্ত্রী মধুরিমা। সে-ই ওর মাকে এই নেশা ধরিয়েছে। তাতে অবশ্য ওর একটা প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য আছে। শাশুড়ি যাতে রাতদিন তার সাথে নানা বিষয়ে দ্বন্দ্বে জড়াতে না পারে, তাই এই কৌশল। মহিলা ব্যস্ত থাক। প্রান্তিক বেশ বুঝতে পারে যে, মা এসব কথা বলছে বই পড়ে। কিন্তু মা তো শুধু বই পড়ে। বহির্বিশ্ব তো জানে না। বইতে এসব বড়ো বড়ো কথা লেখে লেখকেরা। অবশ্য তারা নিজেরা এসব মানে না মোটেই। এরা সব এক একটা জ্যান্ত হিপোক্রীট। সারাজীবন এদেশ ওদেশ ঘুরে বেরিয়ে শেষে লিখলেন, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...। ভালবাসিস তো দেশে থাকলেই পারতিস গোটা জীবনটা। সব বুকুনি মারা পার্টি। ওরা করলে বলে লীলা, আর আমরা করলেই বিলা!
এমনটাই ভাবে প্রান্তিক। এই ব্রিসবেনে যাবার বিষয়ে ও মধুরিমার কাছেও কোনো বিশেষ সমর্থন পায়নি। বার বার ও বলেছে--- এভাবে মাকে ফেলে যাওয়া কি ভালো হবে? বাবা নেই। মা একা হয়ে যাবে না?
মনে মনে ভেবেছে প্রান্তিক, আরে তোমার মা নাকি? মা-এর চেয়ে মাসীর দরদ বেশী। বড়লোকি করার টাকাটা আসবে কোথা থেকে? একটা শাড়ি কিনতে গেলে তো পঁচিশ শো টাকার নীচে মন ওঠে না। এই পঁচিশ শো-টা কি ভূতে যোগাবে! এই ইন্ডিয়া-তে? সে গুড়ে বালি, সোনা। তাছাড়া মার তো শরীর-গতিক ভালো। বাতব্যাধি নেই, প্রেশার নেই, রক্তে কোন কমপ্লেইন্ট নেই। বয়স মোটে আটান্ন। এটাই তো সুযোগ। আর মা একা থাকবে কেন? মন্‌টুর মার সাথে তো টাকা-পয়সা নিয়ে কথা হয়ে গেছে। সে তো এখানে থাকবে। চব্বিশ ঘণ্টা। একবার ব্রিসবেনটা ঘুরে এসে দ্যাখো না, সোনা। আর ফিরে আসতে ইচ্ছে করবে না। প্রান্তিক এ কথাও ভেবেছে, আমি তো আর চিরকালের জন্যে যাচ্ছি না। ফিরে আসবো। মোটে তো দশটা বছর। কত ছেলেমেয়ে বিধবা মাকে রাস্তায় বের করে দিচ্ছে! কিন্তু আমি তো মাকে আরো সুখ দেবো ফিরে এসে। সব যাওয়াটা কি যাওয়া নাকি! আরো ভালো করে ফেরার জন্যে যাওয়া। তাছাড়া মাকে তো এখানে না খেয়ে পড়ে থাকতে হবে না। বাবার কোন পেনশান নেই। এটা তো জানে প্রান্তিক। মাকে টাকা পাঠানো হবে, রে বাবা। ও তো কুলাঙ্গার বা অকাল কুষ্মাণ্ড নয়। কর্তব্য তো আছেই। তাই বলে নিজের দিকে না তাকালে কি চলবে? ছেলের উন্নতি হচ্ছে--- এটা কোন বাবা-মা দেখতে না চায়!
তবে প্রান্তিক দেখেছে, বয়স হলে মানুষ বেশ আত্ম-কেন্দ্রীক হয়ে যায়। সময় মতো খাওয়া, কারণে-অকারণে ডাক্তার দেখানো, ভালোমন্দ ফুড নেওয়া, মাঝে-মধ্যে বেড়ানো--- যদি ছেলের আর্থিক অবস্থা ভালো হয়, তবে এসব নেশা তাদের পেয়ে বসে। বাড়ির যে মানুষটা আয় করে, তার অবস্থা কী, সেটা বয়স্ক মানুষেরা দেখতে চায় না। তার নিজেরটুকু হলেই ব্যাস্‌। সব সময় মনে করে, আমাকে দেখাশুনো, আমাকে যত্ন-আত্মি করছে কিনা। পানের থেকে চুন খসলেই তারা মনে করে, তাদেরকে অবহেলা করা হলো। ঐ সেই বাল্মীকির বাবা-মায়ের মতো। তুমি কোথা থেকে চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য, পেয় আনলে, সেটা তো আমাদের দেখার কথা নয়। আমরা তার কী জানি! তুমি যখন ছোট ছিলে, তোমাকেও খাইয়েছি। এখন তুমি খাওয়াবে। তোমার পাপ আমরা বইবো কেন?
তবে মা প্রান্তিকের যাবার বিষয়টা কী চোখে দেখছে, এটা প্রান্তিকের বোঝা হয়ে ওঠেনি। মা মুখে কিছু বলে না। চুপ করে থাকে। প্রান্তিক লক্ষ্য করেছে, মা চুপ করে দেখেছে, তার ছেলে বাজার থেকে কী কী নতুন জামা-কাপড়, গরম জামা, চাদর, পুলওভার, কোট, টুপি ইত্যাদি কিনছে। সেগুলোর প্যাকিং-ও প্রায় রেডি। কিন্তু মা বলেনি কিছু। আজ প্রথম। প্রান্তিক জানে, মার কথাটা পুরো ফেলে দেবার কথা নয়। দেশের কৃতিরা যদি দেশের বাইরে চলে যায়, তবে দেশের অবস্থাটা কী হবে! কিন্তু সবটা কি প্রান্তিকরাই ভাববে? দেশের কোন দায় নেই? এ দেশের যেন দারিদ্র একটা কোয়ালিফিকেশন হয়ে উঠেছে। তোমার দেশ গরিব। তুমি দেশকে দাও। শুধু দাও। দেশ তোমাকে দিক, না দিক, তুমি দাও। এই যে কমনওয়েলথ গেম্‌সে একটার একটা সোনা জিতে আনছে দেশের ছেলেমেয়েরা। এর জন্যে দেশ কী করছে? কী দিচ্ছে তাদেরকে? নাথিং। দেশ এদেরকে কতটা ব্যাকআপ-ই বা দিয়েছিলো এই সোনা আনার জন্যে? নাথিং। নিজের চেষ্টায় এরা দাঁড়িয়েছে। আর অমনি মঞ্চে উঠে মন্ত্রীরা বলতে শুরু করেছে, দেশের সম্মান রক্ষা করেছে... মন্ত্রীরাই তো লুটেপুটে খাচ্ছে দেশটাকে। তাহলে আমি কোন অপরাধী?
এইসব নানা আত্মপক্ষ সমর্থন খুঁজছিলো প্রান্তিক একা একা। বৌ তো ওর সমর্থনে নেই। সে তো শুধু ভোগটুকু করতে পারে। দুর্ভোগ? না না। সে ওতে নেই। তাই প্রান্তিক এতে কোনো পাপবোধে ভোগে না। যেতে ওকে হবেই। ভাগ্যটাকে একবার নেড়ে-ঘেঁটে-তলিয়ে দেখতে চায় ও। প্রান্তিক না হলে তো অনির্বাণ যেতো। অনির্বাণ ওর থেকে জুনিয়ার। কিন্তু কৃতিত্বে ওর থেকে অনেকটা এগিয়ে। ওকেই পাঠানোর কথা হয়েছিলো। কিন্তু প্রান্তিক কোম্পানিকে পুরো ব্ল্যাকমেইল করেছে এই ডিসিশন বদলাবার জন্যে। প্রান্তিক সিনিয়ার, এক্সপেরিয়েন্সড। ওর পদটাও বেশ রেস্পনসিব্‌ল। প্রান্তিক যদি কোম্পানিকে চাকরি ছেড়ে দেবার ভয় দেখায়, তবে কোম্পানি তো ভয় খেয়ে যাবেই। ওর হাত দিয়েই নানা প্লানিং, ড্রইং, প্রজেক্ট সব পাশ হয়। এটা কোম্পানীর ট্রেড সিক্রেট। তাই মান বাঁচাতে ওকেই ব্রিসবেন পাঠাচ্ছে কোম্পানী। অনির্বাণ ক্যান্সেল।
------------------------


(২)

এইসব ভাবনা আজকাল প্রায়ই মনের মধ্যে ভিড় করে। তাই আজও এইসব ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতে প্রান্তিক ড্রাইভ করে বাড়ীতে আসছিলো। ব্যারাকপুর রোড থেকে যেই নেমেছে ওদের রাসমনী সরণিতে, হঠাৎ ওর চোখে পড়ে সেই কুকুরটা। রাস্তা দিয়ে প্রাণ বাঁচাবার মতো করে চলেছে আর ওর বুকের স্তনগুলো ধরে ঝুলছে হৃষ্টপুষ্ট কয়েকটা বাচ্চা। কুকুরটা বেঁকে গেছে বাচ্চাগুলোর ভারে। বাচ্চাগুলো কী যে পাচ্ছে ঐ হাড় জিরজিরে শরীর থেকে, কে জানে! আর ওরাই বা কী করবে! ওটাই তো ওদের খাদ্য, পানীয় আর বেঁচে থাকবার জন্যে প্রতিরোধক পথ্য বা ওষধি। বাচ্চাগুলো দেখতে বেশ লাগছে। একটা পুরো কালো, একটা কালো-সাদা ছোপ মারা, একটা তো পুরো সাদা। আরো নানা রং। আজ প্রান্তিক চেয়েছিলো, ওকে একটা বিস্কুট দেবে। গলির মুখেই তো চা-এর একটা দোকান আছে। আগেও ও দেখেছে যে, কুকুরটা ঐ চা-এর দোকানে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে কোনো একটা টুকরো পাবার প্রত্যাশায়। যদি কারোর দয়া হয়। কিন্তু দোকানটার পাশ দিয়ে যাবার সময় তো আজ প্রান্তিক কুকুরটাকে দেখতে পাবে না। সেটা তো এইমাত্র চলে গেলো। মনে মনে ভাবে ও, যাকগে। মরুকগে। গাড়ি গ্যারাজে ঢুকিয়ে ঘরে এসে দ্যাখে, মা পাপাইকে নিয়ে নিজের ঘরে বসে গান গাইছে। নিজের ঘরে সরাসরি না ঢুকে একবার মার ঘরে উঁকি দিলো। দেখলো, পাপাই ওর ঠাম্মার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে আর ঠাম্মি গান গাইছে, মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই / দীন দুখিনী মা যে তোদের, তার বেশী আর সাধ্য নাই...
--- কী ব্যাপার, মা? পাপাই যে শুয়ে আছে? এই সময়? ওর পড়াশুনো নেই? টিচার আসবে না?
--- এসেছিলো তো। কিন্তু ওর গা-টা গরম। তাই তাকে ছেড়ে দিলাম।
--- গরম? কতটা গরম? ওর মা কৈ?
--- জ্বরটা তো থার্‌মো দিয়ে দেখিনি রে। একশো-ট্যাকশো হবে।
--- একশো! এতেই কাৎ হয়ে পড়লো!
এবার প্রান্তিক একবার ডাকলো ছেলেকে। কিন্তু সাড়া পেলো না। তারপর মাকে বললো--- তুমি এ্যাতোটা বাড়াবাড়ি করো না, মা। এটা প্রশ্রয়।
--- আমার কাছে আর কতদিন প্রশ্রয় পাবে, পিতু! তোরা তো যাবার জন্যে পা উঠিয়ে বসে আছিস। তাই যে কটা দিন  আছে, থাক না আমার কাছে। এরপর তো আমাকে পাবে না।
প্রান্তিক রাগ করে মার কথায়--- এসব কী কথা, মা! না পাপাই জগৎ ছেড়ে চলে যাচ্ছে, না তুমি যাচ্ছো।
এবারে মা যেন একটু ধমকায় ছেলেকে--- তোর কি মঙ্গলামঙ্গল বলে কিছু মাথায় থাকে না! ছেলে সম্পর্কে এসব কথা কেউ কি বলে!
অবাক হয় প্রান্তিক--- কেন? আমি কী এমন বললাম? যাই হোক, তুমি মা, ওকে এসব গান দয়া করে শিখিয়ো না।
মা-ও অবাক--- এসব গান মানে? রজনীকান্তের গান। এ গান কি এসব গানের মধ্যে পড়ে? কী বলিস তুই?
--- ওদের স্কুলে এসব গান শুনলে পানিশমেন্ট দেবে। ওদের তো ভেতো বাঙ্গালী স্কুল নয়, মা। সেখানে নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। তা আমাদেরকে মেনে চলতে হয়। এসব গান ওদের চলে না।
মা বুঝতে চায় না। জীবনে সে তো এসব কথা শোনেনি। এটা যে বাস্তব। তা কী করে মাকে বোঝানো যাবে, এটা বুঝতে পারে না প্রান্তিক। প্রান্তিকের মা রেগেই বলে--- বাজে কথা বলিস না, পিতু। আমার নাতি স্কুলে গান শিখতে যায় না। পড়তে যায়। পড়ার ব্যাপারে ওরা খবরদারি করতে পারে। সেখানে আমি কিছু বলি না। কিন্তু এসব কী কথা! স্কুলটা তো একটা ফাজলামোর জায়গা নয় রে। আজ টিচারের জন্মদিন, গিফ্‌ট দাও। সেটা আবার টিচারই মনে করিয়ে দেয়। কাল ক্লাসমেটের জন্মদিন। আবার গিফ্‌ট দাও। ওটা কি জন্মদিন পালন করবার জায়গা?
--- তুমি বুঝবে না, মা। প্রান্তিক বোঝাবার চেষ্টা করে।
--- আমার বুঝে কাজ নেই। আমিও স্কুলে পড়েছি। আমি অশিক্ষিত নই রে। তোকেও স্কুলে পড়িয়েছি। তুই কি অমানুষ হয়েছিস? এমন স্কুলে পড়তে দিস কেন যেখানে নিজের কোনো সত্তা থাকে না? এমন জায়গায় যাস কেন? ভাগ্যিস বলিসনি, নিজের ধর্মটাকেও ছাড়তে হবে। এটা আমার দেশের গান। আমাদের কান্তকবির গান। দেশাত্মবোধক গান। এসবই বাচ্চাদের শেখাতে হবে।
প্রান্তিক বুঝলো, মার সাথে তর্ক করে কোনো লাভ নেই। মা আছে মার জগতে। জগতটা যে বদলে গ্যাছে, এটা তো মাকে বোঝানো যাবে না। এসব গান যে মনের মধ্যে একটা বাজে রেখাপাত করে, সেটা প্রান্তিক বোঝে। মোটা কাপড় যদি পড়াটাকে জীবনের অঙ্গ বলে গ্রহণ করতে হয়, তবে তো হয়েছে। ঐ মোটা কাপড় পরেই জীবন কাটাতে হবে। তার চেয়ে ঘরে যাওয়া ভালো। এক কাপ কফি খাওয়া অনেক দরকারি। তাই কথা না বাড়িয়ে মাথাটাকে অসহায়ভাবে নাড়তে নাড়তে সোজা ঘরে গিয়ে ঢুকলো। সেখানে মধুরিমাকে একহাত নিলো,
--- কী করো তুমি সারা দিন? পাপাই মার কাছে বসে থাকে কেন? মা ওকে উল্টো-পাল্টা বিষয় বোঝায়। তুমি কি তা জানো?
মধুরিমা মানতে চায় না। সে-ও প্রান্তিককে আক্রমণ করে--- এসব কী বলছো তুমি? তোমার দেখছি এই ব্রিসবেন যাওয়ার ব্যাপারটা পাকা হতেই তুমি বদলে যাচ্ছো। মার নাতি পাপাই। ওর জ্বর হয়েছে। আর ও ওর ঠাম্মির কাছে গিয়ে বসতে পারবে না!
--- না, পারবে না। আমি বলছি, পারবে না। মার বলা গল্প-গান ওর ক্ষতি করবে। ও একটা ইংরেজী স্কুলে পড়ে, মাধু। সেখানে এসব গান, আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ, ঠাকুরমার ঝুলি, ঠানদিদির থলে চলে না। তুমি ওর পড়া পড়াতে পারবে না বলেই আমি এ্যাতো টাকা দিয়ে টিচার রেখে দিয়েছি। তাকে কথা নেই বার্তা নেই, একটা দিনের জন্যে বিদেয় করে দিলে!
মধুরিমা রেগেমেগে জানিয়ে দেয়--- তোমার মা, তুমি করবে যা করার। আমি পারবো না। শেষে তোমার কাছেই আমায় কথা শুনতে হবে, এমনটা কেন বললে... এমনটা কেন করলে? আমি ওর মধ্যে নেই। আমরা ঠাকুমার কোলেই বড়ো হয়েছি। কৈ, আমাদের তো কোনো ক্ষতি হয়নি। আমি পাপাইকে ওর ঠাকুমার কাছে থেকে কেড়ে আনতে পারবো না। সোজা কথা।
প্রান্তিকও রেগে যায় এমন কথায়। ও বলে ওঠে--- এই জন্যেই ছেলেটার কোনো প্রোগ্রেস হচ্ছে না। মায়েরা ছেলের জন্যে দুনিয়ার সাথে লড়ে যায়। কোনো কম্প্রোমাইজ করে না। তাদের সন্তানই কিছু করে দেখাতে পারে। এভাবে গা ছেড়ে থাকলে তোমার ছেলে অষ্টরম্ভা হবে। সে এ দেশই হোক আর বিদেশই হোক।
--- আমি পারবো না, ব্যস্‌। জানিয়ে দেয় মধুরিমা।
প্রান্তিক হাঁ করে তাকিয়ে থাকে গমনোদ্যত বউ-এর দিকে। ও বেশ বুঝে নেয়, কেন বাল্মিকীর পাপ তার বাবা-মা-স্ত্রী-সন্তান শেয়ার করতে চায়নি। তাই ও নিজের হাত জোড় করে বললো--- আমার ঘাট হয়েছে, অন্যায় হয়েছে তোমাদের সুখের কথা ভাবা। তোমাদের নিয়ে কোনো গ্রামে থাকলে ভালো হতো।
--- তুমি খালি আমাদের সুখ, আমাদের সুখ কেন বলছো! আমরা কি তোমাকে বলেছি, চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে আমাদের সুখ এনে দাও? তার চেয়ে বলো, চা খাবে, না কফি? কফি আনবো?
--- আনো।
এবারে মধুরিমা গট্‌ গট্‌ করে কোমর দুলিয়ে চলে যায় রান্নাঘরের দিকে যাকে প্রান্তিক রান্নাঘর বলে না। বলে কিচেন। প্রান্তিক বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ভাবে, ওর অপরাধটা কী? এদেরকে নিয়ে বিদেশ যাবে, এদেরকে একটা ভালো পরিবেশ দেবে, আরাম, আয়েশ। আর এরা তার কোনো দামই দিচ্ছে না! এরা বুঝছে না, কোথায় যাচ্ছে এরা। আজ পর্যন্ত যারা ওসব দেশে গ্যাছে, তারা আর ফিরে আসেনি। ওখানেই জমিয়ে সংসার করছে। এরা ভাবছে যে, ব্রিসবেন বোধহয় কোনো জেলখানা। এর মধ্যে চা নিয়ে এসে মধুরিমা জানায়,
--- কফিটা ফুরিয়েছে। আমি তোমায় বলতে ভুলে গেছি। তাই চা-ই নিয়ে এলাম। পরেরবার কফি দেবো। আমি পাশের দোকান থেকে আনছি।
চা-এর কাপে একটা চুমুক মেরে প্রান্তিক বলে--- চা খাবে ওখানে। চলো, বুঝতে পারবে।
অমনি খ্যাঁক্‌ করে ওঠে মধুরিমা--- বাজে কথা বোলো না তো। তুমি গ্রামের কোনো অশিক্ষিত মেয়েকে বিয়ে করে আনোনি যে, যা বলবে, সে বুঝে যাবে। চা তো ওরা খায় আমাদের দয়ায়। ওটা উৎপাদন হয় এ দেশে। তুমি কি আর এসব জানো না! খুব জানো। এখন তোমার দুচোখে বিদেশ। ওরা এ্যা করলেও তোমার ভালো লাগছে। বাবা-মাকে ছেড়ে... একটা অজানা অচেনা বিভুই--- সেখানে চলেছি। আমাদের কেউ নেই সেখানে। তুমি কি এসব জানো না! সব জানো। এখন তোমার দু-চোখে স্বপ্ন--- বিদেশ যাবে। সেখানে আরাম করবে, আয়েশ করবে। এ দেশের পলিউশন বাজে, দারিদ্র্য বাজে, কোরাপশান বাজে, গরম ভ্যাদভ্যাদে, বৃষ্টি ঝ্যাঝ্‌ঝেরে, রাস্তা কাদা প্যাচ্‌পেচে। এসব তোমাকে ছুঁতে না পারে।  
প্রান্তিক বোকার মতো শুনলো, মেয়েটা ওর বলা কথাকটাই বেশ কায়দা করে ওকে শুনিয়ে দিলো। যার জন্যে করি চুরি, সে-ই বলে চোর! বুঝবে, একদিন ঠিক বুঝবে, তোমার এই এতো অভিযোগে অভিযুক্ত হাজব্যান্ড কী করলো তোমাদের জন্যে। ওখানে না গেলে বুঝবে না। জানি, বাড়ি ছেড়ে যেতে সকলেরই কষ্ট হয়, মায়া হয়। বিশেষ করে মেয়েদের। একটা ভয় মনের ওপর চেপে বসে। একটা গণ্ডীর মধ্যে থাকতে ভালো লাগে ওদের। থোর-বড়ি-খাড়া নিয়ে জীবন ওদের বড়ো প্রিয়। ওখানে একবার জমে গলে শেষে ওরাই ফিরে আসতে চাইবে না। মায়ের গাওয়া গানটা একবার মনে আসে। মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই...। এই যদি একটা দেশের ফিলজফি হয়, তবে তো সেই দেশের কিস্‌সু হবে না। ঐ মোটা কাপড় পরেই বেঁচে থাকতে হবে। দিনের বেলা ওটাই পড়বে, রাতে ওটাই খুলে নিয়ে গায়ে চাপা দিয়ে শোবে। পৃথিবী এগিয়ে চলেছে হু হু করে। আর আমি মোটা কাপড় মাথায় নিয়ে বাবা ব্রহ্মচারী হয়ে হেদিয়ে মরি আর কি! তাহলে এই এ্যাতো পড়াশুনো, খাটা-খাটনি এসব করার কী দরকার ছিলো! মোটা কাপড় তো গ্রামের চাষাভুষোর অবলম্বন। চাষা হোলেই হোতো।
এইসব আবোল-তাবোল ভাবতে ভাবতে একটু চোখ বুজে থাকতে চায় প্রান্তিক। একটু চোখ বুজে পড়ে থাকতে পারলেই একটু রেস্ট হয়। কিন্তু চোখটা বুজলেই ঐ ঘিয়েভাজা কুকুরটা চোখের সামনে ভেসে ভেসে উঠছে। কুকুরটা রাস্তায় বসেছিলো প্রান্তিকের দিকে তাকিয়ে। একটু খাবারের আশায়। প্রান্তিক দেয়নি। কুকুরটার বুক জুড়ে গোটা আটেক স্তন দুধে ভরো ভরো, লেজটা নড়ছে, জিভটা বার বার লালা গড়াচ্ছে বলে চেতে নিচ্ছে। মাঝে মাঝে গায়ে এটা-ওটা, মানে মশাটা, মাছিটা, পোকাটা বসলেই সেটাকে তাড়াবার চেষ্টা করছে। এটা মার জন্যেই হয়েছে। মা-ই মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, কুকুরটা বাচ্চা প্রসব করেছে। ওর এখন খাবার চাই। তাই চোখটা বুজতেই পারছিলো না কিছুতে। হঠাৎ কখন যেন সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে প্রান্তিক! ঘুমটা ভাঙল যখন, তখন রাত নটা। পাপাই এসে ডেকেছে। তারপর খাওয়া-দাওয়া সেরে নৈশ নিদ্রা।
------------------------


(৩) 

নাক দিয়ে সমানে জল গড়াচ্ছিলো প্রান্তিকের। আজকেই ভিসাটা পাওয়া গেছে। জি.এম. নিজে ফোন করে বলেছেন কথাটা। কনফার্মও করেছেন। প্রান্তিক যাবার জন্যে কতটা প্রিপারেশন নিয়েছে, সে বিষয়ে খবরা-খবরও নিয়েছেন। এমনকি তিনি সাজেশনও দিয়েছেন যে, মানুষ যেভাবে শিফ্‌ট করে, প্রান্তিক সেভাবে যেন করতে না যায়। ওখানে ফ্ল্যাট থাকবে, আর তাতে যাবতীয় নিত্য ব্যবহার্য যা কিছু, সবই থাকবে। কিন্তু এই সর্দি-টা বড়ো জ্বালাচ্ছে প্রান্তিককে। বিকেলের মধ্যে ওর জ্বর চলে আসে। একটা জিনট্যাক দিয়ে একটা লেমোলেট খেয়েছে। কিন্তু ম্যাজমেজে ভাবটা যায়নি তবুও। নাক ঝাড়তে ঝাড়তে নাকটা জ্বালা করছে এখন। পাঁচটা নাগাদ অফিস থেকে গাড়ি বের করেছে প্রান্তিক। একটু স্লো ড্রাইভ করে বাড়ি এসেছে। বাড়িতে ঢোকার আগেই গলির মোড়টায় ঢুকে একটা দৃশ্য প্রান্তিককে একেবারে ভেঙ্গেচুরে দিয়েছে। মাথার মধ্যে একটা টিপ্‌ টিপ্‌ টিপ্‌ টিপ্‌ ব্যথা করেই চলেছে।
গাড়িটা দাঁড় করাতে বাধ্য হয়েছে প্রান্তিক। রাস্তার ধারে কুকুরটা শুয়ে আছে আর গোটা পাঁচেক বাচ্চা মায়ের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আকণ্ঠ তৃষ্ণা আর ক্ষুধায় তাদের প্রাপ্য টেনে খাচ্ছে। মা-টা নীরবে পড়ে আছে ঘাসের মধ্যে। গাড়িটা দাঁড় করিয়ে তাকিয়েছিলো প্রান্তিক। কুকুরটা বেঁচে আছে তো? মনে তো হয় না। এবারে কে বা কারা যেন প্রান্তিকের মাথায় একটা হাম্বর দিয়ে দমাদম আঘাত হানতে শুরু করেছে। মাথাটা প্রচণ্ড ব্যাথায় যেন ফেটে যাবে। কোনরকমে গাড়িটা থেকে বেরিয়ে এলো ও। একটা ছেলেকে দেখতে পেয়ে ডেকে বললো,
--- হ্যাঁরে, দ্যাখ তো। কুকুরটা বেঁচে আছে কিনা।
ছেলেটা দেখে-টেখে জানালো--- না প্রান্তিকদা, বেঁচে নেই। বাচ্চাগুলো তো আর মৃত্যু বোঝে না। ওরা মার দুধের জন্যে হাঁকপাক করছে মায়ের বুকে।
প্রান্তিকের চোখে যেন একটা অন্ধকার পর্দা নেমে আসছিলো। দুটো চোখকে ঢেকে দিচ্ছিলো। মাথাটা ভয়ানক ঘুরছে। তাহলে কি জ্বরটা বেড়েছে? চট্‌ করে গাড়িতে উঠে কোনোরকমে গাড়িটা গ্যারাজ করে আর বারান্দায় উঠতে পারেনি ও। সিঁড়ির মুখেই মুখ থুব্‌রে পড়ে গিয়েছে। পড়েই অজ্ঞান। এরপর কে-ই বা ওকে তুলে এনেছে, ঘরে খাটে শুইয়েছে, কিছুই জানে না প্রান্তিক। চোখ মেলেছে অনেক রাতে। তাকিয়ে দ্যাখে, পাপাই ওর পাশে শুয়ে আছে। আর মা চরম উৎকণ্ঠায় বসে তাকিয়ে আছে ওর মুখের দিকে। মধুরিমা চেয়ারে ঢুলছে। রাত কত হলো রে বাবা! কী হয়েছে ঘটনাটা--- মনে করতে চেষ্টা করে প্রান্তিক। মনে পড়ে না। ছেলেকে তাকাতে দেখে মা তাড়াতাড়ি রান্নাঘর থেকে গরম দুধ আর দুটো বিস্কুট নিয়ে এসেছে। মধুরিমাও তাকিয়েছে শব্দ পেয়ে। তাকিয়েই বলেছে,
--- বাবা রে বাবা! কী জোর ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে! বড়াল বাড়ির মেয়েটা চীৎকার দিয়ে ডেকে উঠেছে আমাকে। ঐ তো তোমাকে দেখেছে প্রথম। আমরা কি জানতে পারতাম নাকি! শেষে ডাক্তার-ফাক্তার এনে একসা। তুমি তো কিছুই জানো না।
মা এসে প্রান্তিককে দুধটুকু খাইয়ে দেয়। তারপর শুধু নিজের মুখে আঙ্গুল রেখে ওকে চুপ করে শুয়ে থাকতে বলে। প্রান্তিক চুপ করে তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। মাকে ঠিকঠাক বুঝতে পারে না। মা কী চায়? মা কী ভাবছে? গরম দুধটা খেয়ে গায়ে যেন একটু জোর আসে প্রান্তিকের। প্রান্তিকের মা চলে যায় বারান্দায়। আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকে অসহায় মা। ছেলেটা এভাবে জ্বরে পড়েছে আর সেটাই মাকে এক চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। বিদেশ-বিভুয়ে গিয়ে কি বৌমা একা সামলাতে পারবে? পাপাই বড়ো হয়েছে। তারই বা কী হবে? সংস্কারাচ্ছন্ন মহিলা বুঝতে চায়, এসব কীসের ইঙ্গিত। অবশেষে দেওয়ালে টাঙ্গানো প্রান্তিকের বাবার আবক্ষ ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন বলে। যেন বলতে চায়, আমাকে কী করতে বলো তুমি? আমার কী করা উচিত? কিন্তু ছবি নিরুত্তর। উত্তর মেলে না।
তখন শেষ রাত। অন্তত একটু কাল তো বিশ্রাম নিতে হবে। ঘুম না আসলেও তো চোখ বুজে শুয়ে ঘুমোবার একটা চেষ্টা করতে হবে। সকাল হতেই তো শুরু হবে আবার যুদ্ধ। একটু বিশ্রাম না করলে তো দিনের অবশ্য করনীয় কাজগুলো করার সামর্থ্য থাকবে না। মধুরিমা ঘরের সবুজ আলোটা জ্বেলে দেয়। এসে শোয় প্রান্তিকের পাশে। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলতে থাকে,
--- তুমি জ্বরের মধ্যে কী সব বলছিলে আবোল-তাবোল!
প্রান্তিক পিন পিন করে বললো--- আবোল-তাবোল! বলছিলাম নাকি?
--- ঠিক আবোল-তাবোল নয়। অনেকটা আবোল-তাবোল।
--- কী বলছিলাম?
--- কী সব...। মা আমি তোমার দুধের অবমাননা করবো না... দুধের দাম দিতে না পারি, তার মর্যাদা রক্ষা করবো... আমাকে বিশ্বাস করো, মা... আমি তোমার খারাপ সন্তান নই... এইসব। তাই মা একটু চুপ হয়ে গেছে। তখন মা তোমার মাথায় জলপটি দিচ্ছিলো। ডাক্তারের একটা ইনজেকশনে আর জলপটিতে তো জ্বরটা একটু পড়লো। মা বলছিলো, বিদেশ যাও বিদেশ যাও করে করে ছেলেটার মাথাটা একেবারে খারাপ করে দিচ্ছে এই অফিস। কেউ বাবা-মাকে ছেড়ে এভাবে একটা বিদেশ-বিভুয়ে থাকতে পারে!
প্রান্তিক এবারে বালিশে মুখ লুকোয়। আজ বহুকাল পরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। মধুরিমা ওর মাথায় তখনও তার আদরের হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। প্রান্তিকের মনে পড়ে, বড়মামা ওর ছোটবেলায় একটা কার যেন লেখা, না প্রচলিত গল্প শুনিয়েছিলো। এক ছেলে তার বউ-এর প্ররোচনায় মাকে হত্যা করে মায়ের হৃদপিণ্ড বউকে যৌতূক দেবে বলে খুশী করতে নিয়ে যাচ্ছিলো। পথে ছেলেটি একটা হোঁচট খায়। মায়ের হৃদপিণ্ড সন্তানকে লক্ষ্য করে বলে ওঠে, আহা! বাবা, তোর লাগলো? এই গল্পটা কেন যে আজ হঠাৎ ওর মনে পড়লো, বুঝতে পারে না ও। মনে পড়তেই আবার চোখ ফেটে জল এলো প্রান্তিকের। বালিশে মুখ চেপে ধরে বিড়বিড় করে এবার জ্ঞানতই বলে উঠলো,
--- মা, তুমি বিশ্বাস করো। আমি তোমার খারাপ সন্তান নই। আমি ভালো হবো, মা। আমি ভালো হবো।
মধুরিমা মাথায় চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললো--- তুমি কান্নাকাটি করো না। আবার জ্বরটা বাড়বে।
প্রান্তিক এবার মধুরিমাকে উদ্দেশ করে বলে ওঠে--- জানো মাধু, আজ কয়েকটা দিন আমার মনের ওপর দিয়ে একটা ঝড় যাচ্ছে। একটা মাদি কুকুর... এই অবধি বলে প্রান্তিক মাদি শব্দটাকে সংশোধন করে নেয়। আবার বলে--- একটা মা কুকুর আমাদের পাড়ায় ঘুরছে। কোথা থেকে এলো, কে জানে। বাচ্চা দিয়েছে পাঁচ-ছটা। কিন্তু বাচ্চাগুলোকে খেতে দেবার মতো দুধ তো ওর বুকে নেই। ওর পেটে খাবারই নেই, তো দুধ দেবে কোথা থেকে! কুকুরটা মরে পড়েছিলো রাস্তায়, আর বাচ্চাগুলো ওদের মাকে ছিঁড়েকুটে দুধ খাবার প্রাণান্ত যুদ্ধ করছিলো। এই ছবিটা আমি মোটে সহ্য করতে পারছি না। একটা কিছু করতে হবে। মনে হচ্ছে বার বার--- শুধু আমার চোখের সামনে ঐ কুকুরটার জায়গায় একটা বৃদ্ধার মুখ ভেসে ভেসে উঠছে। মনে হচ্ছে, এই তো মা। আমাদের ঘরের কালোকুলো, রোগা বা মোটা, লম্বা বা খাটো মা। সবই তো মা। তাহলে আমি কী করছি!
--- তুমি আবার কী করছো? মধুরিমা অবাক হয়।
--- আমি? কি জানি, আমি কী করছি।
--- যাকগে। এখন তো ঘুমিয়ে পড়ো। এইসব আজেবাজে কথা ভাবতে হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
প্রান্তিক বিড়বিড় করে--- হ্যাঁ, আমায় সব ঠিক করতে হবে। আমায়ই করতে হবে। আমি পারবো। তুমি দেখো, আমি পারবোই।
হাল্কা সবুজ আলোতে দুলতে দুলতে কখন যেন প্রান্তিক ঘুমিয়ে পড়ে। মাথায় কেউ হাত দিলে আর তাকিয়ে থাকতে পারে না  প্রান্তিক। সেই ছোটবেলার অভ্যেস।
---------------------


(৪)


সকালে ঘুম ভাঙ্গতে তাকিয়ে দ্যাখে, মা ওর কপালে, বুকে হাত গুঁজে গুঁজে তাপ অনুভব করার চেষ্টা করছে। প্রান্তিক চোখ মেলতেই মা বললো--- যাক বাবা, টেম্পারেচারটা গ্যাছে। বেশ চিন্তায় ফেলেছিলি। এখন জ্বরটা নেই। নে, চা খেয়ে নে। জ্বর মুখে ভালো লাগবে।
প্রান্তিক একটা মলিন হাসি হাসি মুখ করে বলে--- না মা, আর চিন্তা নেই। আমি ভালো হয়ে গেছি।
--- তা যা বলেছিস। কাল জ্বরের ঘোরে কী সব বলছিলি! আমি ভাবলাম, এই বুড়ো বয়সে কি ছেলের তরকা-ফরকা লাগলো নাকি! তোর তো ছোটবেলাতে জ্বর হলেই তরকা লেগে যেতো। কি জানি!
প্রান্তিক এই প্রথম মুখ না ধুয়ে বাসিমুখেই চা-এর কাপে চুমুক মেরে মনে করলো যে, আজকের চা-টা ওর বত্রিশ বছরের জীবনে শ্রেষ্ঠ চা। তাই পরম আয়েশে বললো--- মা, তরকাই তো দরকার। তা নয়তো তো ঘোর কাটে না, মা।
মা বললো--- আমি তো অত বুঝি না বাপু। বিদেশ যাচ্ছিস। ওখানে সব ভালো ভালো বিরাট বিরাট ডাক্তার আছে, শুনেছি। একটা ফুল চেক আপ করিয়ে নিবি। কেন এমনটা হচ্ছে।
--- যাচ্ছি না তো।
মা তো অবাক। ছেলে বিদেশ যাচ্ছে, এটাই তো সে জানে। এখন বলছে, যাচ্ছে না! তাই বিস্ময়ে মা বলে--- সে আবার কী! গরম জামা-কাপড় কিনলি, সব গুছোচ্ছিস, পাপাই-টা বিদেশ যাবার নামে নেচে বেড়াচ্ছে?
--- ও তো জানে না, তুমি যাচ্ছো না। তাই নেচে বেড়াচ্ছে। যখনই জানবে, ওর ঠাম্মি যাচ্ছে না, বলে আমরাও যাচ্ছি না, তখন খুশী হবে। আমি জানি।
--- কিন্তু কেন যাবি না? জীবনে এমন সুযোগ নাকি আসে না? আমার কথা ছাড়। যাবি না-টা কেন?
মিথ্যে বলে প্রান্তিক--- ভিসা হয়নি, মা। এখন ভিসা দিচ্ছে না। এই যে সব জঙ্গী হামলা হচ্ছে না? এই কারণে ভিসা দিচ্ছে না।
--- তাহলে? মা তাকায় বিস্ফারিত চোখে।
প্রান্তিক দুর্বল গলায় বলে ওঠে--- মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই/ দীন দুখিনী মা যে তোদের, তার বেশী আর সাধ্য নাই...
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মধুরিমা হাসে। নির্ভেজাল হাসি। আনন্দের হাসি। এটাই তো ও চাইছিলো। বিদেশ মানে ইংরেজিতে কথা বলতে হবে। এটা ওর গায়ে একটা জ্বর এনে দিচ্ছিলো। ইংরাজি ওর যম। তাই ঠাকুরের কাছে মানত করেছিলো, যাওয়া না হয়

---------------------------