শনিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১১

'ভয়' ছোটগল্প




ভয়
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়


(১)

--- তোমাদের জন্যে…..  শুধু তোমাদের জন্যে আজকে এই অবস্থা। আতঙ্কে আমার হাত-পা পেটের ভেতর চলে যাচ্ছে! তোমরা দায়ী।
--- তুমি শুধু আমাদেরকেই দায়ী করছো কেন, প্রতিমা! তুমি কি চাওনি, মোহনী একটা চাকরি-বাকরি করুক?
--- না, চাইনি। চাপিয়ে দিও না তুমি। তোমার তো বেশী বেশী। তুমি তো প্রগতিশীল বাবা। মেয়ে বাড়ীতে বসে থাকলে তোমার সার্কেলে তোমার ইম্প্রেশন তো থাকে না, না। তাই মেয়েকে বাজী রেখে নিজের ইম্প্রেশন বাড়াও। সকলে বলবে, দ্যাখো, কত আধুনিক চিন্তা আমাদের মোহিত দা-র! আর তারা কিন্তু তাদের মতই চলবে। এসব গল্প সাহিত্যে চলে।
--- হ্যাঁ। সবাই নিজের মতই তো চলবে। সেটাই তো কাম্য। সেটাই তো রীতি। আমি কি তাদের মতো চলবো নাকি?
প্রতিমা লড়ে যায়--- না না। তা কেন চলবে! বাড়িতে তুমি তোমার মতো চলবে, আর বাইরে দেখিয়ে দিতে হবে বলে অন্যের ঝালে চলবে। তাতে মেয়ে যদি বিপদে পড়ে, তার জীবন যদি খাদের ধারে গিয়ে দাঁড়ায়, তবুও তো তোমাকে দেখিয়ে দিতে হবে--- তুমি আলাদা বাবা, স্বতন্ত্র বাবা। তোমার নাম বইতে লেখা হবে। লোকে তোমার জীবন কাহিনি পড়বে। আর তুমি মেয়ের উপার্জনে খাবে।  
মোহিত বাবু স্ত্রীকে বোঝাতে চেষ্টা করেন--- ছেলের উপার্জনে যদি খেতে লজ্জা না হয়, তবে মেয়ের উপার্জনে কেন হবে? আর আমি কেন মেয়ে বা ছেলের উপার্জনে খাবো? আমার উপার্জন নেই? তাছাড়া আজ ও এ্যাতোদিন চাকরী করছে । কৈ? এমন বিরোধিতা তো আগে করোনি! মেয়ে মাইনে পেয়ে আমার জন্যে কিন্তু কিছু আনে না, প্রতিমা। আনে তোমার জন্যে। এই যে কাপড়টা পরে আছো, এটাও তো মেয়ের দেওয়া, নাকি? যখন কোনো ভালো শাড়ি আনে তোমার জন্যে, তখন তো কপাৎ করে সেটা নিয়ে ওমনি সেজেগুজে তাকে দ্যাখাও, প্রতিবেশিনীকে দ্যাখাও--- মেয়ে দিয়েছে। তখন তো মনে থাকে না এসব কথা! আজকাল তো আমাকে কোনো কাপড়-চোপর কিনেও দিতে বলো না। কেন? না, মেয়ে দিচ্ছে।
এবারে অশ্রু হয়ে ওঠে প্রতিমার অবলম্বন। চোখের জল মুছতে মুছতে বলে--- কী! তুমি শাড়ির খোঁটা দিচ্ছো! মোহিনী তোমাকে এসব বলেছে বুঝি?
--- না। বাজে কথা তুমি বলো না। মোহিনী বলেছে--- এ কথা কি আমি বলেছি? আজ মেয়ের অফিস থেকে ফিরতে দেরী হচ্ছে বলে তুমি বাড়ি মাথায় করছো। আমাদের চিন্তা হচ্ছে না? তুমি চিন্তা করবে তোমার শোবার ঘরে বসে। যদি সন্ধান করতে যেতেই হয়, তবে তো বেরোতে হবে এই শর্মাকেই। তুমি তো নও। এমন কোরছ, যেন মোহিনী শুধু তোমারই মেয়ে। আমাদের কেউ নয়।
মা হার মানে না। এই যুদ্ধে সে জিতবেই। কিন্তু হাউমাউ করে কেঁদে-কেটে জেতা ছাড়া যে কোনো রাস্তা তার পক্ষে সম্ভব নয়, সেটা সে ভালো মতো জানে। ফলে যা করলে তার চলে, সে তাই করলো। বাপের বাড়ি চলে যাবার ভয় দেখিয়ে দিলো। এ সংসার নাকি তার আর ভালো লাগে না। এখানে নাকি তার কথার কোন দাম নেই। এখানে সে ঝিয়ের মতো খেটে মরে। কিন্তু কেউ তার দাম দ্যায় না। এইসব অত্যন্ত পুরনো বস্তাপচা বহুশ্রুত অভাব-অভিযোগ করতে করতে গোসা ঘর, মানে রান্নাঘরে গিয়ে নানা কাজে মন দিলো সে। কিন্তু ছেলে রোহণ মনে করলো, বাবাকে একেবারে এভাবে ছেড়ে দেওয়াটা ঠিক হবে না। সত্যিই বাবা নিজেকে একটু স্বতন্ত্র দেখাবার চেষ্টা করে। নিজেকে আলাদা করে অন্যের কাছে তুলে ধরার একটা প্রবণতা মানুষটার। মা একটাও মিথ্যে বলেনি। তাই মা পরাভব মেনে অন্তর্হিত হতে সে এবারে মার হাত থেকে পতাকা নিয়ে রিলে রেসে আবির্ভূত হলো।
--- তুমি বাবা, মাকে চুপ করিয়ে দিতে পারো। আমি কিন্তু পই পই করে বলেছিলাম যে, কল সেন্টারে চাকরী ভালো নয়। এখানে কোনো কালচার্‌ড বাড়ির মেয়ে কাজ করে না। তুমি কিন্তু শোননি।
--- শোননি মানে?
--- শোননি মানে শোননি। তুমি নানা যুক্তি দেখিয়েছো মোহিনীকে সমর্থন করে। তুমি একটু বাইরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দ্যাখো। কেউ তোমাকে সাপোর্ট করবে না।
এ্যাতোক্ষণ স্ত্রীর সাথে যে বিতর্‌ক চলছিলো, সেটা তেমন গুরু নয়। কিন্তু ছেলের কথায় মাথাটা উষ্ণ হয় মোহিতমোহন সেনের। উষ্ণ স্বরেই বলেন--- দ্যাখ রোহণ, জেটাতে তোর কোন অবদান নেই, সেটা নিয়ে কোন কথা বলিস না। কেন? কেন কেউ কাজটাকে সাপোর্ট করবে না? কারণটা কী?
--- সেটা তাদেরকেই জিজ্ঞেস করো। জানতে পারবে।
--- তার মানে তুই জানিস না। আমি কিন্তু জানি। কারণ কোন কুসংস্কার নিয়ে আমি চলি না। তাছাড়া এই যে মোহিনী কাজটা করছে, মাসে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা মাইনে নিয়ে অফিসে ঢুকেছে, আর আজ উপার্জন করছে এ্যাতোগুলো টাকা, আজ বাদে কাল প্রমোশনে আরো কয়েকটা ধাপ উঠে যাবে, তোর স্টাডি, এমনকি গোপন হাত খরচাও যোগাচ্ছে, তুই কি কোনদিন, একবারের জন্যে ওর সাথে গিয়েছিস দেখতে, কোথায় ও কাজ করে, কারা কারা সেখানে কাজ করে? তুই কি নিজে জানিস, ওখানে ভাল ঘরের মেয়েরা যায় না? না পরের মুখে ঝাল খাচ্ছিস? তুই কি জীবনে সেক্টর ফাইভে পা রেখেছিস?
অপ্রস্তুত হয় ছেলে রোহণ। নিজেকে বাঁচাতে কোনরকমে বলে--- না, আমি পা দেইনি আর আমার দেবার কোন প্রয়োজনও নেই।
--- দিতে পারবি না। তোর দ্বারা হবে না। তোর সেই ধক নেই। তুই এ্যাতোটা এলিজিবিলিটি অর্জন করিস নি। তুই কথাই বলতে পারবি না ওখানে গিয়ে। ওখানকার অফিসগুলো, বা তাদের ইন্‌টেরিওর যে মাপের, যা তাদের বেসিক ডিম্যান্‌ড, তা তুই ফুলফিল করতে তো পারবিই না, বরং তোর হাত-পা কাঁপবে ওখানে ঢুকতে। তুই বড়োজোর কোন সরকারী দপ্তরে মাছিমারা কেরানি হবি। আর তাও না জুটলে দপ্তরি হবি। গ্রুপ ডি-এর কাজ করবি। আর তা না পেলে সরকারকে গালি দিবি, চাকরী দিলো নালে। তোর দিদি কিন্তু এসব ধার ধারে নি। এম.বি.-টা করেছে, ঢুকে গেছে। একটা দিন সময় নেয় নি। ও নিজেকে ঠিক গুছিয়ে নেবে।
--- তুমি কিন্তু এইসব কথাগুলো সেদিনও বলেছিলে। আর আমাদেরকে শুনতে হয়েছিলো।
--- বলেছিলাম, তোরা শুনেছিলি কিন্তু আজো অনুধাবন করতে পারিস নি। এসব কথা বলেছিলাম, কারণ আমি ওর সাথে একটার পর একটা অফিসে গিয়েছি, ওদের কাজের নানা খবরা-খবর নিয়েছি। তুই কিন্তু বাড়ি বসেই ফটর-ফটর করেছিস। কোন কাজে লাগিস নি।
ছেলে রোহণ সেদিন বাবার সাথে লড়তে পারে নি। আজ সেদিনের বদলা নিতে হবে। আজ বাবা ফাঁপরে পড়লেও পড়তে পারে। তাই ও সহজে ছেড়ে দ্যায় না। আক্রমণ করে--- কেন? ওকে এস.এস.সি. বা পি.এস.সি.-তে বসালে কী হোতো? একটা সরকারী চাকরী পেতো। কোনো টেনশন থাকতো না। এইসব প্রাইভেট অফিসে কি আছে, বল তো বাবা?
বাবাও ছেলের কথা শুনে রেগে যান। বলতে বাধ্য হন--- আমাকে থ্রি ইডিয়ট্‌স তুই জোর করে টেলিভিশনে দেখিয়েছিস না? কী শিক্ষা পেয়েছিস সিনেমাটা থেকে? আমার তো দেখার কোন দরকার ছিল না। ওখানে যা বলেছে, তা আমার কাছে নতুন নয়। আমি এ্যাতোটা বয়সে এসে ওসব  জানি। কিন্তু তুই কি শিখলি? নাকি শুধু আমীর খানকে দেখলি, আর গান মুখস্ত করলি? ওখানে নায়িকার যার সাথে বিয়ে হবার কথা হচ্ছিলো, তাকে তোদের আমীর খান গাধালছিলো। কেন রে? বুঝেছিস কিছু? তোর দিদি এম.বি..রেছে। এবারে ও গিয়ে বসবে সরকারী চাকরী করার জন্যে? কেরানি হবার জন্যে? তুই কি পাগল-টাগল হলি? ওসব তোর জন্যে। ওর জন্যে নয়। ওর পোটেনশিয়ালিটি আছে, চ্যালেঞ্জ আছে। ওকে ওর মতো চলতে দিতে হবে, নাকি ওকে আমার মন মতো চলতে বাধ্য করবো?
এসব কলহ হোক বা বাক-বিতণ্ডা--- এসবই ততক্ষণ চলছিলো যতক্ষণ মুন্নির বাড়ি ফেরার একটা কাম্য অথবা সহনীয় সময় পেরিয়ে না যাচ্ছে। অর্থাৎ বড়োজোর রাত এগারোটা, ঊর্‌দ্ধে বারোটা। যতক্ষণ না মোহিতমোহন বাবুর মেয়ে মুনির ফেরাটা অনিশ্চিত আর আতঙ্কজনক হয়ে না উঠছে, ততক্ষণ পারস্পরিক দোষ দেওয়া-দেওয়ি, দায় চাপানো ইত্যাদি চলছিলো। কিন্তু রাত যখন বিপদসীমা পার করে দিলো, অর্থাৎ ধীরে ধীরে একটা বেজে যেতে লাগলো, তখন শুধু বাড়ীর মানুষগুলো তাদের ব্যক্তিগত মান-অভিমান ছেড়ে ঐক্যবদ্ধই হোল না, এমনকি প্রগতিশীল বাবার মনেও আতঙ্ক বাসা বাঁধতে সুরু করলো। একটা ভয় চেপে বসতে লাগলো সকলের বুকে। সাড়ে দশটা থেকে মোহিনীকে ফোনে ধরার চেষ্টা চলছে। কিন্তু বার বার কল ফেইল করছে। এমনটা এর আগে এ বাড়ীর কেউ কখনও শোনেনি। জানা, মানে কমন কিছু কথা সেলফোন রেকর্ডেড ভয়েস বলে থাকে। যেমন দিস নাম্বার পর ইয়ে সুবিধা উপলব্ধ নেহি হ্যাঁয়, আপ জিস নাম্বার পর কল কর রহে হ্যাঁয়, বো নাম্বার আভি সার্ভিস এরিয়াকি বাহার হ্যাঁয়, অথবা আপ জিস নাম্বার পর ফোন কর রহে হ্যাঁয় বো মোবাইল আব বন্ধ হ্যাঁয়। কিন্তু আজ এসব কিছুই বলছে না। চুপচাপ। নিঃশব্দ। নিস্তব্ধ। এই নৈশব্দ যে মানুষের বুকের মধ্যেকার আবশ্যিক শব্দটিকে অত্যন্ত পরিমানে বাড়িয়ে দ্যায়, তার খোঁজ তো এই নিষ্প্রাণ মোবাইল নামক যন্ত্রটি জানে না। তাই হোল। বাড়ির প্রত্যেকের হার্ট বিট রাত বাড়ার সাথে সাথে কয়েকগুণ করে বাড়তেই থাকলো।
হঠাৎ বাড়ির ছেলে রোহণ আবিষ্কার করলো যে, তার মোবাইল হ্যান্‌ডসেটে টাওয়ার বা নেট ওয়ার্ক দেখাচ্ছে না। বাবার ফোনটা তো বাবা শুধু কল করে, আর ধরে। অন্য কোনো কাজ বাবা জানে না। সেটা মালটিমিডিয়া সেটও নয়। একটা পাতি মোবাইল। রোহণ দেখলো যে, তাতেও কোনো নেটওয়ার্ক দেখাচ্ছে না। অথচ দুজনের কানেকশন অর্থাৎ সার্ভিস প্রভাইডার আলাদা। তার মানে কি? কী একটা সন্দেহ হতে রোহণ চট্‌ করে নিজের ঘরে গিয়ে কম্পিউটারটা অন করলো। নেট কানেক্ট করতে গিয়ে বুঝলো, এই মুহূর্তে গোটা ভারতবর্ষ তথা গোটা বিশ্ব একের থেকে অন্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নেটওয়ার্ল্ড কাজ করছে না। কোন এক অজানা কারণে গোটা সভ্যতা, সমগ্র অগ্রগতি, পারস্পরিক সম্পর্ক থেমে গেছে। এমনটা হতে পারে, তা জানে রোহণ। কিন্তু আজ এই প্রথম দেখলো। তার মানে জানাই যাবে না, দিদি কোথায়। কোথায় মোহিনী? ক্ষেপে গিয়ে ও একটা ঘুষি মারল টেবিলে। আজকেই সার্ভার ডেড হবার ছিল! আর দিন পেলো না! ডেড তো ডেড, একেবারে মোবাইল নেটওয়ার্ক পর্‌যন্ত।
মোহিনী ওর দিদি। ছোটবেলা থেকে একসাথে ওরা বড়ো হয়েছে। পিঠোপিঠি। রোহণ পড়াশুনোয় বরাবর ভালো। কিন্তু হায়ার স্টাডিতে এসে হঠাৎ ওর মেধা যেন থেমে যেতে শুরু করে। মোহিনী হঠাৎ ওর পড়াশুনোয় মোড় ঘোরাতে শুরু করে। একে একে গ্রাজুয়েশন শেষ করে সোজা এম.বি.. রতে চেয়ে বসেছে। মোহিতমোহন সেন অনেক কষ্ট করে কোন ধার-কর্জ না করে পড়িয়েছেন মেয়েকে। সেই মেয়ে আজকে কাজে নেমেছে আর মাসে আট-ন হাজার টাকা বাড়িতে আনে। মাকে এটা দ্যায়, সেটা দ্যায়। ভাইকে পড়ায়, তাকে পোষে মানি দ্যায়। বাড়িতে বাবার হাতে পর্‌যন্ত একটা টাকা তুলে দ্যায়। অন্তত নিজের খাই-খরচা দিতে ওর এতটুকু অসুবিধে হয় না। কিন্তু ওর ভাই আজো জি.কে, জি.আই, ম্যাথ্‌স আর কারেন্ট এ্যাফেয়ারস-এর চক্কর থেকে বেরোতে পারে নি। খুব শিগগিরি নাকি আই.জে.পি.-তে বসবে। তাতে নাকি ওর প্রোমোশন হবে আর স্যালারি হবে বারো হাজার। এই এম.বি.. ওকে নাকি দারুণ হেল্প করেছে এই প্রফেশনে। লজ্জা লাগে রোহণের মাঝে মাঝে। তাই মাঝে মাঝে দিদিকে আক্রমণও করে। মনের ঝাল মেটায়। গায়ে একটা অক্ষমতার জ্বালা ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। মাঝে মাঝে মনে হয়, দিদির সাথে জুটে যাবে কিনা। কিন্তু জ্বালাটা কিছুতেই কমে না। উত্তরোত্তর বাড়ে।
একবার মাকে জিজ্ঞেসও করে বসে--- মা, সত্যি করে বলতো, দিদি কোনো প্রেম-ফ্রেম করে বেড়াচ্ছে নাতো? এ জন্যে বাড়ি থেকে পালিয়ে-পুলিয়ে একটা কেলেঙ্কারি বাধাবে না তো?
মা ছেলের মুখে হাত চাপা দ্যায়। প্রসঙ্গটা আর ওঠে না। মেয়ে সন্তান বড়ো বালাই। তাই এবার রোহণের মা তার গোসা ফেলে রেখে দিয়ে মোহিতমোহন বাবুকে তাগাদা দিলো--- এখানে বসে না থেকে দ্যাখো না, খুকু ফিরেছে কিনা।
--- কে খুকু? মোহিনীর বাবা খুকুকে না চিনে তাকান হাঁ করে।
--- খুকু পাশের পাড়ার শ্যামল বাবুর মেয়ে। খুকুকে তো ও-ই এই কাজের সন্ধান দিয়েছিলো। অবশ্য এখন বোধহয় ওরা শুয়ে-টুয়ে পড়েছে। বেরিয়ে গিয়ে বেল বাজাতে হবে। তবু তুমি যাও। দ্যাখো। এখানে বসে বাপ-ছেলে কোন্দল কোর না।
কথাটা জানতেন না মোহিতমোহন সেন। তিনি তড়িঘড়ি বেরিয়ে যান। হয়তো ওরা ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই বলে তো খোঁজ নেওয়া যাবে না, এমন নয়। পড়শি বলে একটা কথা আছে না? এ্যাতো রাতে কাউকে ঘুম থেকে ডেকে তোলাটা ভদ্রতা নয়। কিন্তু বিপদে পড়লে নিয়ম খাটে না। তাই বেরিয়ে যান মোহিনীর বাবা।
মোহিত বাবু বাইরে গিয়ে দ্যাখেন, গোটা আকাশটা তারা ভরে গেছে। নীল রঙের মধ্যে তাদের চোখ যেন মোহিত সেনকে বিদ্রূপ করছে। যেন বলছে, আর মেয়েকে কাজ করতে পাঠাবি? পেনশানে তোর হচ্ছে না! মেয়ে আয় করবে আর তার উপার্জিত পয়সায় তুই সেইসব করবি, যা তুই নিজের উপার্জনে করতে পারবি না। এবারে দ্যাখ, ক্যামন মজা। বেশ হয়েছে। মর এবার ভাবতে ভাবতে।
এখন চারদিকে একটা অশান্তি আর হিংসার আবহাওয়া চলছে। প্রাক নির্‌বাচনের রক্তাক্ত রাজনৈতিক বাংলা এখন রোজই নানা ঘটনার সাক্ষী হচ্ছে। ঘটনা তো নয়, দুর্ঘটনা। এখানে খুন, সেখানে ঘর জ্বালানো। সেক্টর ফাইভ আলো ঝলমল জায়গা বটে। কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে এলে তো সেই সল্‌টলেক, নিউ টাউন দিয়ে আসবে। এসব জায়গা তো সমাজ বিরোধীদের মুক্ত ক্ষেত্র। এসব জায়গায় থাকেন সব প্রথম শ্রেণীর নাগরিক। মন্ত্রী, সান্ত্রী। কিন্তু তারা গুণ্ডাদেরকে তো পোষে। এইসব ডামাডোলের মধ্যে তো সমাজবিরোধীরা একটা সুযোগ নেবেই। তারা এই তালে তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে নেবে। দায় গিয়ে পড়বে যে কোনো রাজনৈতিক দলের কাঁধে। মহা আনন্দ। যখন গোটা দেশে এমন অশান্তি আর অসন্তোষ, তখন মাথার ওপরে আকাশটা যেন কিছুই জানে না। সে শান্ত, নীরব, নিস্তব্ধ, নিঃসাড়।
পায়ে পায়ে মোহিত বাবু গিয়ে দাঁড়ান খুকুদের বাড়ির সামনে। ওদের সাদা বাড়িটা চাঁদের আলোয় যেন স্নান করছে। গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকে শুনতে পেলেন মোহিত বাবু খুকুদের একতলা বাড়ির ঘরগুলো থেকে সপসপ্‌ করে ফুল স্পীডে চলা ফ্যানের শব্দ ভেসে আসছে। সবাই এখন প্রশান্তির সুপ্তিতে আচ্ছন্ন। এখন কি বেল বাজানো ঠিক হবে? কী না কী ভেবে বসে! না। এসব ভাবার সময় এখন নয়। মনটাকে শক্ত করে দিলেন বেল টিপে।
টিং টং!
না, কেউ শুনলো না। তাহলে আর একবার...। টিং টং! না, এবারেও না। এই শেষবার। টিং টং! না, এবারেও কেউ ঘর থেকে উঠলো না। ভাবলেন, আর এদেরকে বিরক্ত করা ঠিক নয়। যা হয় হবে। সমস্যা আমার। আমি অন্যের ঘুম নষ্ট করি কী করে! এমনটা ভেবে একটা অজানা আতঙ্কে হাঁটা দিলেন মোহিত বাবু। গেট অবধি গিয়ে পারেননি, এর মধ্যে পেছন থেকে একটা ঘুম জড়ানো পুরুষ কণ্ঠ,
--- কে?
মোহিত বাবু দেখেন নি, তিনি পেছন ফিরতেই খুকুদের বারান্দার আলোটা জ্বলে উঠেছিল। মাথার মধ্যে হাজার চিন্তা বাসা বাঁধলে যা হয় আর কি। ডাক শুনে তিনি পেছন ঘুরে হাতজোড় করলেন--- আমি দুঃখিত। আপনাদেরকে এই অসময়ে এ্যাতো রাতে বিরক্ত করলাম। আমি মোহিত সেন। মুন্নির বাবা।
ভদ্রলোকটি ঝাঁঝিয়ে উঠলেন--- মোহিত সেন, মানে মোহিতমোহন সেন তো? মোহিত বাবুকে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতে দেখেই ভদ্রলোক যেন ক্ষেপে উঠলেন--- কী ব্যাপার! এ্যাতো রাতে! কী চাই?
ভদ্রলোকটির আচরণে বেশ একটা তিক্ত ভাব লক্ষ্য করলেন মুনির বাবা। কোথায় যেন তিনি ইচ্ছে করেই এমনটা বলার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন! তাই তিনি জানালেন--- আপনার মেয়ে নিশ্চয়ই আমাকে চেনে। অন্তত আমার মেয়েকে তো চেনেই।
--- জানি। কিন্তু আজ আর চিনতে চাইছি না। সবাইকে চিনে রাখার ঠেকা নেই নি আমি।
বিস্মিত মোহিত বাবু। লোকটা এমন কেন বলছে, তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলেন না। তবু এ অবস্থায় নীরবে চলে যাওয়া মানে, অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর না জেনে চলে যাওয়া। অন্তত এই ভদ্রলোকটির এমন অভব্যতার একটা কারণ তো জানতেই হবে। তাই তিনি সবিনয়ে বললেন,
--- না হয় আমি এ্যাতো রাতে আপনাদের ঘুম থেকে ডেকে তুলে একটা অপরাধ করেই ফেলেছি। কিন্তু আমি তো বিপদে পড়েই এসেছি। আমার মেয়ে মুন্নি, মানে মোহিনী এখনও অফিস থেকে বাড়ি ফেরেনি। সকলে জেগে বসে আছি।
--- জেগে বসে থাকবেন না। বাড়ি চলে যান, আর মিসেসকে বলুন, তিনি যেন রেডি হয়ে বসে থাকেন। মেয়ে জামাই নিয়েই ফিরবে।
--- মানে!
--- কথায় আছে না, যে কাঁটায় মাপ, সে কাঁটায় শোধ। আজকে সেই শোধ হয়ে গেলো। আমি এখন গিয়ে আরামে ঘুমোতে পারবো। কাল থেকে মজাও মারা যাবে। আপনার মেয়ে তো আমাদেরকেও এমন অবস্থায় ফেলছিলো। অনেক কষ্ট পেয়েছি, অনেক চোখের জল ফেলেছি। আজকে শোধ। হতেই হবে। আরে ধর্‌মের কল বাতাসে নড়ে।
মানুষটাকে দেখে ঘেন্না করতে লাগলো মোহিত বাবুর। এ কেমন পিতা! পিতা হয়ে একজন পিতাকে এভাবে অভিসম্পাত করছেন! তাঁকে ক্ষমা চাইতেই হোল আবার কেননা তাঁকে তো জানতে হবে, ভদ্রলোকের এই পাগলামির কারণটা কী। হাত জোর করে বলতেই হোল--- আপনি দয়া করে তো বলবেন, আমি বা আমার মেয়ে আপনার কী এমন ক্ষতি করলাম যে, এভাবে আপনি রি-এ্যাক্‌ট করছেন? আমি তো আপনার কাছে এ্যাতো রাতে আসার জন্যে ক্ষমা চাইছি। আমি তো জানি, আমার মেয়ে আপনার মেয়েকে ওদের অফিসে চাকরীর ব্যবস্থা করেছে। তাহলে সেটাই কি তার অপরাধ? মানুষের কি কোনো উপকার করতে নেই?
--- আছে। উপকার নিশ্চয়ই করতে আছে। কিন্তু কোন শ্ত্রুরও এমন ক্ষতি করতে নেই। আপনার মেয়ে আমার মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করেছে, আর আমার মেয়ে বাড়িই ফেরেনি। পলাতক। পরে জেনেছি, ঐ শুয়োরের খোয়ারের একটা শুয়োর ওকে নিয়ে পালিয়েছে। পরে অবশ্য বাড়িতে ফোন করেছিলো। কিন্তু আমরা তাঁকে আর মেয়ে বলে মানি নি। আর আজকে আপনার মেয়ে...। বেশ হয়েছে। যান, বাড়ি গিয়ে শঙ্খ, বরন ডালা আর সিঁদুর নিয়ে অপেক্ষা করুন। মেয়ে ফোন করবে কিন্তু একা নয়। একেবারে জামাই নিয়ে।
মোহিত বাবু লজ্জায় মাথা নিচু করলেন। তিনি জানতেন না, এসব ঘটেছে। কিন্তু এখানে তার মেয়ে মুন্নির কোথায় দায়িত্ব, তা তিনি ভেবে পান না। তিনি অগত্যা হাত জোর করে ফিরলেন। বন্ধ হয়ে গেলো শ্যামল বাবুদের দরজা। মোহিত বাবুর স্ত্রী বললেন,
--- ওরা দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লো! আশ্চর্‌য! ওদের মেয়ের জন্যে মুন্নি কি কম করেছে? সারাদিন মেয়েটা মুন্নির কাছে চাকরীর জন্যে ঘ্যান ঘ্যান করতো। আর তুমি ভেজা বেড়ালের মতো চলে এলে!
মোহিত বাবু চুপ করান স্ত্রীকে। তিনি কাজের কোথায় আসেন--- আমি বলি কি, ব্যাপারটা খুব খারাপ দিকে যাচ্ছে। আমার ভয় করছে। কিন্তু আমি মুন্নিকে বিশ্বাস করি। মুন্নির নিশ্চয়ই কোন বিপদ হয়েছে। তোমার তমাল দাকে একবার বললে হয় না? সে তো একটা বড়ো পোস্টে আছে।
--- কেন? এখন তাঁকে কেন? আজ তাঁকে কী দরকার? কস্মিনকালেও তো তাদের সাথে একটু এসো জন বসো জন করো না। এখন দায়ে ঠেকে ক্যানো তাঁকে জানাবে?
--- এখন কি এসব বলার সময়? অন্তত সে তো প্রশাসনে আছে। এটা তো তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, নাকি?
বাপের বাড়ি নিয়ে তর্ক যখন, তখন তর্কে তো জিততেই হবে। সে সময় বা অসময়--- যাই হোক না ক্যানো। স্ত্রী প্রতিমা কথাটা নিজেই ভাবে নি, তা নয়। জানাই ছিলো, এমন একটা প্রস্তাব আসবে। তখন এক হাত নিয়ে শেষে তাঁকে জানালেই চলবে। তমাল দা লালবাজারে ডি.সি.ডি.ডি। অনেক দিন তাদের সাথে কোন যোগাযোগ নেই। আসলে তারাও কোন যোগাযোগ করে না। তমাল দা-দের পারিবারিক স্ট্যাটাস আর প্রতিমাদের পরিবার আকাশ-পাতাল ফারাক। কিন্তু তমাল দা তার খুড়তুতো ভাগ্নির এই মেয়ে প্রতিমাকে ভালোবাসতো। এক সময় একটা নৈকট্য ছিলো। সে তো বিয়ের আগে। তারপরে অনেকটা সময় কেটে গেছে। কিন্তু স্বামীকে বিষদাঁত না ফুটিয়ে তো কথাটা বলা যাবে না। তাই সালিশি করলো পুলিশের হয়ে,
--- হ্যাঁ, কার মেয়ে বাড়ি থেকে পালালো, কার মেয়ে অফিস থেকে ফিরছে না, কে তালা বন্ধ করে রেখে নাচতে নাচতে বিয়ে বাড়িতে রাত কাটাচ্ছে আর তার বাড়িতে চুরি হচ্ছে, এ সব দায় পুলিশের, না? তোমরা পুলিশেকে কী মনে করো? সে কি তোমাদের বডিগার্‌ড?
প্রতিমা এ কথা বলল বটে কিন্তু মনে মনে মোহিত বাবু বুঝে নিলেন যে, এবারে তার স্ত্রী তার দাদাকে খবরটি দেবে। এ্যাতোক্ষণ রোহণ টিভি খুলে বসেছিলো, দেখছিল কোথাও কোন এ্যাক্সিডেনটের খবর-টবর দেখায় কিনা। কিন্তু না। তেমন কোন নেই। তবে ওদের রিপোর্টাররাও বাইরে থেকে কণট্যাক্ট করতে পারছে না। এটা ওরা অন ক্যামেরা বললও। আচম্‌কা কোথায় যেন একটা বম্বিং হোলো! কাছেপিঠে। পর পর তিনবার। কোথায় আবার ঝমেলা লাগলো। লাগুক। রোহণকে তো বাইকটা নিয়ে বেরোতে হবে। ফোন তো লাগছে না।
----------------------



(২)


কিন্তু রোহণের বাইক নিয়ে বেরোনো আদৌ হয় না। হঠাৎ চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে চেয়ার থেকে দুম করে পড়ে যান মোহিত সেন। ধর্‌ ধর্‌ করেও ধরতে পারে না রোহণ। সে তখন সবে বেরোবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন সময় ঘটে গেলো ঘটনাটা। ঐ তিনটে বম্বের শব্দ মোহিতমোহন সেনকে আতঙ্কের শেষ আঘাতটা করে দিয়েছে। রোহণ পরিষ্কার বুঝলো, যেটা হওয়ার ছিল না, বা যেটা হওয়া বাকি ছিলো, সেটাই ঘটে গেলো। বাবার হার্ট এ্যাটাক। একটা তিন বছর আগেই হয়েছিলো। ডাক্তার বার বার মানা করেছিলেন কোনো রকম টেনশান না নিতে। কিন্তু দিদি আজ বাবার সেকেন্ড এ্যাটাকটা ঘটিয়েই দিলো। ব্যস্‌, শুরু হয়ে গেলো ছুটোছুটি, ডাক্তার, নার্সিংহোম। কিন্তু মাথায় রাখলো, তমাল মামার কাছে যেতে তো হবেই হবে। একে বাবা তো সিক। কতটা সিক, তা তো নার্সিংহোম বলতে পারবে। কিন্তু বিল যা হবে, তাও তো দেবার ক্ষমতা নেই রোহণের। তমাল মামা এলে তাঁকে ধরে অন্তত নার্সিংহোমের পেমেন্ট দিদি না ফেরা পর্‌যন্ত আটকে রাখা যেতে পারে। সুতরাং তমাল মামাকে লাগছে দু-দুটো কাজে। বাবা কোথায় টাকা-কড়ি রাখে, তার কোন খবর রাখে না রোহণ। অভিমান করেই রাখে না। সে সব হ্যান্ডল করে দিদি। রোহণের মনে হয়, যদি  বাড়ির কেউ ভেবে বসে, রোহণ বেকার বলেই টাকা-পয়সা নয়-ছয় করবে না তো? তার চেয়ে যে আয় করে, সেই দ্যাখাশুনো করুক। কিন্তু দিদি আদৌ কেমন আছে, কোথায় আছে, আর সে বাড়ি ফিরতে পারবে কিনা--- এসব চিন্তাকে কোনও প্রশ্রয় দিলো না রোহণ। ফিরবে, নিশ্চয়ই ফিরবে। ফিরতে দিদিকে হবেই।
বাড়িতে একটি ছেলে থাকলে যা হয়। মোহিত বাবু অসুস্থ তো কী হয়েছে! রোহণের যে বন্ধু সংখ্যা আছে, তাতে একটা নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে পাড়া কোনো বিষয়ই নয়। জুটে গেলো গোটা আটেক ছেলে। আর রাতের নৈঃশব্দ্যকে ভেঙ্গে একটা এ্যাম্বুল্যান্সের হুটার প্যাঁ-পুঁ-প্যাঁ-পুঁ করতে করতে ছুটলো মোহিত সেনের অচেতন দেহ নিয়ে। বাবাকে নার্সিংহোমে আই.সি.সি.ইউ-তে ঢুকিয়ে দিয়ে মাকে বললো,
--- মা, আপাতত তোমার বা আমার এখানে দুশ্চিন্তা করা ছাড়া অন্য কোনো কাজ নেই। আমার বন্ধুরা যেমন এখানে আছে থাকুক। চলো, টুক করে তোমাকে নিয়ে তমাল মামা-কে মিট করে ফেলি। তমাল মামা তোমাকে ভালোবাসে, আর তাই তুমি সামনে থাকলে এগিয়ে না এসে পারবে না।
তখন রোহণের মা কোন মত দেবার মতো অবস্থায় নেই। কিন্তু মাকে সাথে নিতেই হবে। মাকে না দেখালে তমাল মামা-র সেন্টিমেন্‌টে ঘা দেওয়া যাবে না। উপায় নেই। মা যেমন পাথরের মতো আছে তাই থাকুক। তাই মায়ের দু-গাল নিজের হাতের পাতা দিয়ে চেপে ধরে বলে রোহণ,
--- মা, তুমি আমার বাইকে আমাকে জাপটে ধরে বসে থাকবে। নড়বে না। কোনো চিন্তা নেই। তুমি পড়বে না। এখন তো ট্যাক্সিও পাবো না। আমি ঠিক তোমাকে নিয়ে যাবো। তমাল মামা-র কাছে তো যেতেই হবে, মা। দিদিকে তো খুঁজতে হবে। মিনিট কুড়ি লাগবে। জানি, তোমার এখন বাবাকে ফেলে যাওয়া কঠিন ব্যাপার। কিন্তু তুমি না গেলে এ্যাতো রাতে অত বড়ো একটা অফিসারের বাড়িতে তো গার্ড আমাকে ঢুকতেও দেবে না। বাবাকে তো আই.সি.সি.ইউ-তে ঢুকিয়েছে। ওরা ততক্ষণে ওদের কাজ করুক। আমরা যাবো আর আসবো।
জীবনে প্রথম প্রতিমা মোটর বাইকে উঠেছে। মানুষ হয়তো দায়ে পড়ে অনেকটা করতে পারে। সে জানেও না, সে কী কী করতে পারে। মা রোহনেকে জাপটে ধরে বসেছে। কাজ সেরে নার্সিংহোমে ফিরেও এসেছে আধঘণ্টার মধ্যে। এসেই মাকে জানিয়েছে,
--- তোমাকে তো মাসীর কাছে বসিয়ে দিয়ে তমাল মামা আমাকে নানা কথা জিজ্ঞেস করলো--- দিদি কোন অফিসে, কোন বাসে যাতায়াত করে, তাদের রুট নাম্বার কী কী, ক-টায় অফিস থেকে দিদি বেরোয়, বাড়িতে কোনো ঝামেলা হয়েছে কিনা‌, কোনো মত-পার্থক্য ঘটেছে কিনা--- এসব নানা তথ্য নিলো। এই গোটা রুটে যে সব পোলিস স্টেশন পড়ে, মানে সল্‌টলেক, লেক টাউন, রাজারহাট, দমদম তাদের সবার থেকে মেসেজ নেবে, কোনো এ্যাক্সিডেন্‌ট ঘটেছে কিনা, কোনো এ্যাব্‌ডাকশান কেস ঘটেছে কিনা--- সব খবর নিলো। আমাকে বলেছে, ভাবিস না, মাকে নিশ্চিন্ত থাকতে বল্‌। ইতিমধ্যে কিছু ঘটে না থাকলে ওর কোন ক্ষতি হবে না। আরো বলেছে, তুই দিদিকে নিয়ে নার্সিংহোমে চলে যা। আমি আসছি। দিদি তো এখন এখানে থাকতে চাইবে না। আমি আমার গাড়িটাতে তোর মাকে পাঠাচ্ছি। তুই বাইক নিয়ে যা। সাবধানে যাবি।
ওদেরকে পৌঁছে দিয়ে গাড়ি ফিরে গেছে। প্রতিমা দু-হাত কপালে ঠেকায়। মেয়ে, না স্বামী--- কার জন্যে, কে জানে! তবে বিড়বিড় করে স্পষ্ট বলে--- গুরুদেব, আমার পরিবারকে রক্ষা করো।
কিন্তু গুরুদেব তাঁর মনে মনে কী বললেন, তা প্রতিমা শুনতে পেলো না। আই.সি.সি.ইউ.-এর কাচ দিয়ে প্রতিমা স্পষ্ট দেখতে পেলো যে, তার বাড়ির চিরশত্রু অথচ চিরমিত্র একটা অদ্ভুত রকমের বিছানায় টান টান নিঃসাড় পড়ে আছে। তার সেই দাপট নেই। বিধাতার এক অঙ্গুলি হেলনে মানুষটা একেবারে নিষ্কল হয়ে গেছে। তার গা থেকে নানা পাইপ-এর মতো কী সব মেশিনে গিয়ে জুড়েছে। টিভি-র মতো দেখতে সেই মেশিন। জীবনে আই.সি.সি.ইউ. দেখেনি প্রতিমা। এই প্রথম। এই শব্দটার মানে যে কী, তা সঠিক জানেও না। একটা ভয় তাঁকে আচ্ছন্ন করে। চোখ দিয়ে নেমে আসে জলের ধারা। মনে মনে বলে, তুমি বাড়ি ফিরে চলো সুস্থ হয়ে। আর তোমার সাথে কোনো ঝগড়া নয়। দেখো, কথা দিলাম। এই কথা মোহিতমোহন বাবুর মননে গিয়ে পৌঁছল কিনা, তাও জানে না প্রতিমা। হঠাৎ মনে পড়ে, বাবা বলতেন, এ অবস্থায় নাকি কাঁদতে নেই তাতে অকল্যাণ হয়। জানে প্রতিমা। কিন্তু অশ্রু বাঁধ মানলে তো। মনে মনে বুঝতে পারলো প্রতিমা যে, এটাকেই বলে ভালোবাসা। সে তার স্বামীকে ভালোবাসে। ভালোবাসা করে তাদের বিয়ে নয় বটে, কিন্তু থাকতে থাকতে কবে যেন মানুষটাকে নিজের সবটুকু দিয়ে ফেলেছে। এটাও বোঝে প্রতিমা, মুন্নিটাকে ওর বাবা বড়ো ভালোবাসে। সেই ভালোবাসা থেকেই একটা দুশ্চিন্তাতে অসুস্থ হয়ে পড়েছে মানুষটা। কে না ভালোবাসে নিজের সন্তানকে! কন্যা সন্তান তো আদরের ধন বটেই। সে নিজেও তো বাসে। পুত্রসন্তান আদরের নয়, ভরসার স্থল। না, আর কোন কলহ নয়। একটাই তো জীবন। গুরুদেব বলেন, ঘরের মানুষকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসবি। এই একটাই তো তোর সুযোগ তোর ভালোবাসার। ভালোবাসায় ভুল করলেও তো সে ভালোবাসা। ভালোবাসা পাওয়াতে তো সুখ বটেই, কিন্তু তা দেওয়াতেই সুখ বেশি।
এসব আগে বুঝতে পারে নি প্রতিমা। আজ এই অবস্থায় ঠাকুর বড়ো কঠিন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে সেটা বুঝিয়ে দিচ্ছেন। পড়াশুনো তার নেই, তা নয়। তবে সে তো পুঁথিগত। গভীর কোন সাহিত্য তাকে কোনদিন টানে নি। ওই স্কুল-কলেজে টেক্সট বইতে যতটুকু পড়েছে। কিন্তু সাহিত্য না পড়লে যে চোখ অন্ধ হয়ে থাকে, আজ তা মনে হয় প্রতিমার। প্রতিমা দেখেছে, মুন্নি কত বই পড়ে। মনে এই ভাবনা আসে, মুন্নি কি ভালোবাসা শিখতে চায়? মানুষ হয়তো অন্ধকারে পড়লে মনে এইসব নানা ভাবনা আসে। তাই এ্যাতো ভাবনা তাকে গ্রাস করছে! তা নয়তো নারীমন তো অন্ধকারে কর্মহীন, গর্‌বহীন থাকতে চায়। নারীর অলস মন, অপরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থাকায় সন্তুষ্ট নারীমন। অনেকে বলে, সংসারে একটু আধটু বিবাদ-বিসংবাদ না হলে নাকি সংসার জমে না। বার বার সম্পর্কের নবীকরণ হয় তাতে। কিন্তু আজকে মনে হয় প্রতিমার যে, বিবাদ বিবাদের জন্ম দ্যায়। মনের মধ্যে একটা বৈবাদিক নেশা তৈরী করে। আজকে স্পষ্ট হয়, সেটা থেকে কিছুতে মুক্তি পাওয়া যায় না। আজ স্পষ্ট বোঝে প্রতিমা যে, কতকাল আগে বলা কোনো কথা আজ আর খাটে না। সব কিছু বদলে গেছে।
কখন তমাল দা আসে, কখন মুন্নির খোঁজ পায়, কখন প্রতিমার স্বামী চিকিৎসায় যেন একটু সাড়া দ্যায়--- কিছুই জানে না সে। বসে বসে ভাবতে ভাবতে একটা অতিন্দ্রিয়লোকে চলে যায় সে। আজকে যেন তার বোধদয় হয়। নতুন জন্ম হয়। সম্বিৎ ফিরে আসে কার যেন কোমল চেনা একটা স্পর্শে। মুন্নি।  এবারে এই প্রথম হাউমাউ করে কাঁদে প্রতিমা। ডাক ছেড়ে কাঁদে। হাল্কা হতে চায়।

--------------------------


(৩)


মোহিত সেন আজ উঠে বসেছেন। জ্ঞান ফিরেছে পরদিনই। হাল্কা হাল্কা জ্ঞান ফিরতেই শুধু বলেছেন--- মুন্নি! মুন্নি!
ডাক্তার আইসিসিইউ থেকে বেরিয়ে এসে জানিয়েছে যে, পেশেন্‌টের জ্ঞান ফিরে এসেছে। কিন্তু পেশেন্‌ট পার্টির মধ্যে মুন্নি কে, এটা নিয়ে তিনি প্রশ্ন করতে মুন্নিকে এগিয়ে দেওয়া হয়েছে। ডাক্তার আরও বলেছেন--- সকালেই পেশেন্‌টের জ্ঞান সামান্য ফিরেছিলো। তারপর আবার চোখ বুঝেছিলেন। আসলে হাইডোজের ত্র্যাঙ্কুইলাইজার দেওয়া ছিল। তখন আপনাদের কিছু বলিনি। ভাবলাম, পুরো সেন্সটা আসুক। উনি তো মুন্নিকে খুঁজেছেন।
ডাক্তার অসিত বর্মণ কলাকাতার ডাক্তার নন। তিনি সাউথ ইন্ডিয়ার চিকিৎসক। এখানে একটা অপারেশনের জন্যে পারসোনাল কল নিয়ে এসেছিলেন। এই সুবিশাল নারসিং হোমেই সেই অপারেশন হবে। পেশেন্‌ট মন্ত্রী শ্রেণিয়। কিন্তু এখানে এসে তিনি লালাবাজারের ডিসিডিডি-র ফাঁসে ফেঁসে যাবেন, তা বুঝতে পারেন নি। রোহণ মনে মনে ভাবে, প্রতিটি পরিবারের তো এমন একটা করে মামা নেই। তাহলে এদেশে তাদেরকে দ্যাখে কে? কে-ই বা এভাবে ভাবে তাদের কথা? এরপরে মুন্নি চলে যায় আইসিসিইউ-তে। বাবার সাথে দেখা করে। বাবা জড়ানো গলায় বলেন,
--- তুই ঠিক আছিস তো, মুন্নি?
মোহিনী বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে--- বাবু মশাই, এতো বালোবাসা বালো নয়।
বাবার প্রিয় সিনেমা হিন্দি সিনেমার সংলাপ এটা। বাবা ও মেয়ে একসাথে সিনেমাটা দেখেছে। সেই থেকে মাঝে মাঝে এই বাক্যটাই তারা বিনিময় করে ঠাট্টাচ্ছলে। মুন্নি সেটাই বলে বাবাকে জানিয়ে দিলো যে, সে ভালো আছে। বাবা জানতে চান,
--- কী হয়েছিলো রে আমার?
--- হৃদয়ে দাগা পেয়েছিলে। মেয়ে ফিরছে না। তাই তোমার হৃদয় এটা নিতে পারে নি। এই কিন্তু সেকেন্ড। বাবা। নো মোর। নো টেনশান। তুমি আমার ওপর একটু ভরসা করতে পারো না! এতে কিন্তু আমি খুব আঘাত পেয়েছি।
বাবা তার সুচ ফোটানো চ্যানেল করা বাঁ হাতটা তুলে জানিয়েছেন--- ভরসা করি রে, মুন্নি। তোকে করি। কিন্তু মানুষকে, এই সভ্যতাকে, এই দেশটাকে ভরসা করি না, বিশ্বাস করি না।
--- এ তোমার মাতৃভূমি, বাবা। তাঁকে তুমি অবিশ্বাস করো!
পিন পিন করে বাবা বলেছেন--- দেশ তো একটা ভূখণ্ড রে, মা। তার আর বিশ্বাস কি, আর অবিশ্বাসই বা কী? এদেশে কুকাজ তো সে করে না। সে তো নির্জীব। পাপ করে তো মানুষ। তাদেরকে বিশ্বাস করি না। তাই বড়ো ভয় পেয়েছিলাম রে।
স্বয়ং ডিসিডিডি তার সাধ্য মত চেষ্টা করেও খুঁজে পায় নি তার ভাগ্নিকে। পাবে কী করে! যেখানে  খোঁজা নিষ্প্রয়োজন বলে মনে হয়েছে, সেখানেই মুন্নি আর তার চারজন কলিগ রাত কাটিয়েছে গভীর টেনশানে। সেটা একটা নার্সিংহোম। আর সেটা খোদ সেক্টর ফাইভে। একটা রেস্তোরাতে সেদিন ওদের একটা ট্রিট পাবার কথা ছিলো। সেটা সেরে একটা ট্যাক্সি নিয়ে পাঁচজন ফিরছিলো খোশ মেজাজে, ভর পেটে। সবাই কলিগ্‌স। শুধু একজন ছিলো সিনিয়ার। এইচ.আর মিঃ তালুকদার। তিনিই ট্রিট-টা দিলেন। দুম করে বিয়ে করে বসেছেন। কাউকে কিছু বলতে পারেন নি। কিন্তু মনিদীপা তাঁকে সস্ত্রীক দেখে ফেলেছে নিউ মার্কেটে। ব্যস্‌, ক্যাচ কট কট। কিন্তু রেস্তোরা থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে উঠেই মিঃ তালুকদার জ্ঞান হারান। হার্ট এ্যাটাক। ট্যাক্সি ঘুরিয়ে ওরা চোখ-কান বুজে সোজা সেক্টর ফাইভ। ওদের হাতে থাকা স্থান এটা। ওদের অফিসের সাথে এই নার্সিংহোম চিকিৎসা বিষয়ে যুক্ত। ফলে আসামি যে গিয়ে খোদ অকুস্থলে লুকিয়েছে, তা কে বুঝবে! এখানে তাকে কে খুঁজবে! সর্‌বত্র খোঁজা হয়েছে, অফিসে দেখা হয়েছে। সেকাহ্ন থেকে ডিপার্‌ট করেছে বলে শুনেছে। কিন্তু সেখানেই পার্টি থাকতে পারে, এমনটা মনেও আসেনি। ব্যস্‌। তারপর থেকে তো পুরো নেটওয়ার্ক বসে যায়। পরদিন মুন্নি বাড়িতে ফোন করেছে সকাল সাড়ে পাঁচটায়। সবে তখন লাইন পেয়েছে। গোটা সিস্টেম রিজিউম করেছে। ফোন ধরেছে রোহণ,
--- রুনু
আর্তনাদ করে ওঠে রোহণ--- দিদি! কোথায় তুই?
--- আমি একটা নার্সিংহোমে। তোকে আগে বলি, বাড়িতে জানা, ঘাবড়াবার কিছু হয় নি। আমার কিছু হয় নি। আমাদের একজন সিনিয়ারের হার্ট এ্যাটাক হয়েছে। এদিকে গোটা নেটওয়ার্ক তো বসে গিয়েছিলো। না পারছি পেশেন্‌ট-এর বাড়িতে খবর দিতে, না পারছি নিজেদের বাড়িতে কন্‌ট্যাক্‌ট করতে। বাড়িতে সবাই খুব টেনশান করছে, না? বাবা কোথায় রে?
এবারে রোহণ আর তার পৌরুষ ধরে রাখতে পারে না। সোজা কেঁদে দ্যায়। ফোনে মোহিনী চিৎকার করে চলেছে--- রুনু! এই রুনু! বাবার কি কিছু হয়েছে? মা ঠিক আছে তো?



ডাক্তার আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় দিয়েছিলো। সেটা অতিক্রান্ত হয়ে আজ নিয়ে নিয়েছে ছিয়ানব্বই ঘণ্টা। আজ মোহিত সেন বসে আছেন জেনারেল বেডে। পাশে বসে আছে প্রতিমা। ডানদিকে একটা টুলে বসা পুত্র রোহণ। কতগুলো ওষুধ নিয়ে এসেছে দোকান থেকে। নার্সিংহোমের ভেতরেই আছে নিজস্ব দোকান। সেখান থেকেই ওষুধ সংগ্রহ করতে হয় পার্‌টিকে। কিন্তু স্বয়ং ডিসিডিডি থাকাতে ওদেরকে তেমনটা করতে হয়নি। যেমন তেমন প্রেসক্রিপশন লেখা যায় নি। রোহণ তাই নিয়ে একটা হিসেব করছে। একেবারে সামনে দাঁড়ানো তমালতরু বসু্, ‌খোদ ডিসিডিডি। পাড়ার কেউ নেই। তারা দেখা করে চলে ভিজিটিং আওয়ারসে। ডিসিডিডি-র কল্যাণে একটু ছাড়-টার পাওয়া গেছে। সামনে তমাল দাকে দেখে শুকনো হাসি দ্যান মোহিত সেন। বলেন,
--- এরা আপনাকে বড়ো ব্যস্ত করেছে। সত্যি, কী যে হোল...! মাথাটা ঘুরে...।
--- হবে না! তোমার তো সব বৈপ্লবিক কাজ। মেয়েকে কল সেন্টারে পাঠিয়েছো কাজ করতে। কে তোমাকে এই বয়সে এসব বুদ্ধি দ্যায় বলো তো, মোহিত দা?
প্রতিমা জানে, তার স্বামী তার তমাল দার থেকে বয়সে বড়ো। কিন্তু তমাল দা সম্পর্কে বড়ো। তাই উভয় উভয়কে দাদালেই ডাকে। সে ভাবে, সতুই, আজ তমাল দা ছিল বলে অনেকটা স্বস্তি হচ্ছে। কিন্তু এই অবস্থায় একজন পেশেন্‌টকে কেউ এসব বলে, তা সে মানতে পারে না। কিন্তু উপকার বড়ো বালাই। উপকারী যে সে উপকার করলেই তার সুদ চাইবে, এ কথা সকলেই জানে। তাই সে অসহায় হয়ে তাকায় তমাল দার দিকে। যদি সে চোখের ভাষা পড়তে পারে, যদি বুঝতে পারে।
মোহিত সেন লাচার। বাধ্য সে এসব শুনতে। তার বিপদের দিনে তো এই মানুষটাই দাঁড়িয়েছিলো। না হয় তাঁকে টাকা-পয়সা খরচ করতে হয় নি। মুন্নি সকালে এসে সবটা সেরেছে। কোত্থেকে মুন্নি এ্যাতো করেছে, জানেনও না মোহিত সেন। মুন্নি সকালেই হাজির হয়েছে। না হয় তাঁকে মুন্নিকে খুঁজেই আনতে হয়নি। তবুওলে তো একটা কথা থাকে। অন্তত ছিয়ানব্বই ঘণ্টা ধরে তো লোকটা তার এ্যাতো বড়ো পোস্টের দায়িত্ব ছেড়ে এখানে হাজিরা দিচ্ছে। এখানে যে পরিষেবা পেশেন্‌ট পার্টি পাচ্ছে, তা তো তারই কল্যাণে। তাই মোহিত সেন নিজের মাথাটা নীচু করে থাকেন। সন্তানের দায়িত্ব-জ্ঞানহীনতায় তো বাবা-মাকেই ভোগান্তি ভুগতে হয়। এটাই তো হয়ে আসছে। কিন্তু বাবার এই অসহায়তা সহ্য করতে পারে না মুন্নি। নিম্ন মধ্যবিত্য পরিবার। তাদের একটা নিজস্ব চরিত্র থাকে। লোকের কোথায় তাদের বেজায় যায়-আসে। এর জন্যে তারা নিজের লোককেও নানা কষ্ট দিতে কসুর করে না। হয়তো এসব কথা শুনে বাবাই হঠাৎ বলে বসবেন,
--- না রে মুন্নি, আমিই ভুল। তোকে এবারে বিয়ে করতে হবে। এসব কল সেন্টারে চাকরী-বাকরী করতে হবে না। এটা ঠিক হচ্ছে না।
সেই ভয় পেয়ে বসে মোহিনীকে। ও মনে করে নেয়, প্রথম রাতেই বেড়াল মারতে হবে। আজ, না কাল…. কাল, না পরশু করা যাবে না। তাই মামুকে বললো--- মামু, বাবা আগে বাড়ি যাক না। তারপরে না হয়...।
--- তোর মুখে এখনও কথা আসছে! তমালতরু বসু নরমে গরমে তিরস্কার করেন।
--- দ্যাখো মামু, তুমি না হয় আমাকে একটা চড় মেরে গা-এর জ্বালা জুড়োও। আমার জন্যেই তো তোমার এ্যাতো বড়ো দায়িত্ব ছেড়ে এখানে পড়ে থাকতে হয়েছে। কিন্তু বাবাকে কি এসব বলার সময় এটা?
--- তুই বাবাকে এ্যাতদিন বুঝিয়েছিস। এখন আমাকেও কি বোঝাবি নাকি?
এবারে ধৈর্‌যের বাঁধ ভেঙ্গে যায় মোহিনীর। একবার চারপাশে তাকিয়ে নেয় ও। না। বাইরের নেই ঘরের মধ্যে। তারপরে সোজা বলে দ্যায়--- আমি তোমায় অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি, তুমি এখন এসব আলোচনা বন্ধ করো। বাবার সাথে আর একটাও কথা নয়।
একটা ধমকের সুর বেজে ওঠে তার কণ্ঠে। চম্‌কে যায় আইপিএস তমালতরু বসু। একটা দুগ্ধপোষ্য বলে কী! ভাবে সে, এ্যাতক্ষণ তোর বাবাকে সামলাচ্ছিলো কে রে, মেয়ে? তুই, না আমি? এখন যে বড়ো বড়ো কথা বলছিস! তাই সে মৃদু ধমকের সুরে বলে--- তুই একটাও কথা বলবি না। একদম চুপ করে থাক। তোর জন্যেই তো বাবার এই অবস্থা। এখন বড়ো দরদ দেখানো হচ্ছে! স্বাধীনতা চাই, না? সারা রাত অন্যও জায়গায় কাটিয়ে...।
--- কন্ট্রোল ইয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ, মামু। অন্য জায়গায় কাটিয়ে মানে? হোয়াট ডু ইউ মীন? আর এসব যে হয়েছে, তা আমার জন্যে নয়। জেনে রাখো। তোমাদের মতো অকর্মণ্য প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের জন্যে। পোস্টিং আর প্রমোশনের লোভে নিজের কাজ-কর্ম ভুলে লিডারদের ল্যাডার বানিয়েছো তোমরা। আমরা নই।
সকলেই চমকে তাকায় মোহিনীর দিকে। কি সব বলছে মেয়েটা! আর বলছে কাকে? তিনি স্বয়ং কোলকাতা পুলিশের ডিসিডিডি। কিন্তু তখন মাথায় আগুন জ্বলে গেছে মুন্নির। প্রফেশনে এসে ওর মুখও খুলে গেছে। একটা মেয়েকে সকলের সামনে রাতে অন্য জায়গায় কাটিয়ে আসার অভিযোগ করা মানে একেবারে তার অবস্থান নিয়ে বিদ্রূপ অথবা ঘৃণা প্রকাশ করা। মোহিনী তখন নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে,
--- তোমরা এই গোটা কলকাতা শহরটাকে সমাজ বিরোধীদের আখড়া বানিয়েছো, আমাদের পয়সা খাচ্ছো আর বগল বাজিয়ে বেড়াচ্ছো। তোমাদের প্রত্যেকটা থানা তাদের থেকে পয়সা খেয়ে ফুলে-ফেঁপে ঢোল হচ্ছে। সব জানো তোমরা। সব। হয় তার ভাগ খাও, তা নয়তো পার্টির ভয়ে মুখে কুকুপ এঁটে চুপ করে থাকো। তুমি তোমার হাইলি কোয়ালিফায়েড মেয়ে সোনাদিদিকে তার স্বামীর পদলেহনকারী মেয়ে করে রেখেছো বলে কি আমার আমার বাবাকেও তাই করতে হবে? কী করতে আছো তোমরা? কেন একটা মহিলা রাতে কলকাতায় পথে হাঁটলে তার বাবা-মা ভয় পাবে? কোনো জবাব আছে তোমার? আমাদের উপার্জিত অর্থ থেকে মাইনে পাও, আর মনে করো---- তোমরা বিরাট সমাজসেবা করছো! তোমার রিটায়ারমেন্‌ট-এর কিন্তু বেশীদিন বাকি নেই, মামু। একদিন তোমার মেয়ের গায়ে কিন্তু হাত পড়বে এই কোলকাতায়। কোলকাতাকে তোমরা ফ্র্যাঙ্কেন্সটাইন বানাচ্ছো। তখন কাকে বলবে এসব কথা?
দম বন্ধ করে মুন্নি যে এ্যাতগুলো কথা বলেছে, তার কোনো প্রতিবাদ কেউ করেনি। ভয়ে চুপ করে বেরিয়ে যায় ডিসিডিডি তমালতরু বসু। কোনো কথা জোগায়নি তার মুখে। এ মেয়ে মুন্নি না হলে হয়তো চাব্‌কে সিধে করে দিতো। এখানে ক্যামেরা নেই, কোনো মিডিয়া নেই কিন্তু যে বা যারা আছে, তাদের সামনে এর কোনও সদুত্তর দিতে পারেনি সে। তাই তাকে নীরবে চলে যেতে হয়। মুন্নির অগ্নিমূর্তি দেখে মা বা রোহণ কেউ তমালতরু বসুর মতোই ওকে বাধা দিতে সাহস করেনি। শুধু হাসেন মোহিতমোহন সেন।

----------------