বৃহস্পতিবার, ২৯ মার্চ, ২০১২

'দেড়শ খোকা'র কাণ্ড' ছোটগল্প

দেড়শো খোকার কাণ্ড
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়

--- আপনি কেন এভাবে তিন তিনটে মঞ্চে দাঁড়িয়ে ইলেকশান প্রচার করলেন? আপনাকে ডেকে সম্মান দিয়ে এলেছি বলে?
--- জীবনে প্রথম আপনাকে জনশক্তি ফ্রন্ট-এর মতো একটা পার্টি থেকে এ্যাতো বড়ো দায়িত্ব দিয়ে কাজ করতে বলা হলো বলে আপনার লেজ মোটা হয়ে গেলো নাকি?
এমনি নানা গঞ্জনা আর তিরস্কারে স্নান করিয়ে দেওয়া হচ্ছিলো রজনীকান্ত দাস মহাশয়কে। আজ রবিবার। তাঁকে লোক দিয়ে ডেকে আনা হয়েছে জনশক্তি ফ্রন্ট-এর পার্টি অফিসে। বাচ্চাদের আঁকার ক্লাশ শেষ করে রজনীকান্ত বাবু পার্টি অফিসে এসেছেন। তিনি ঢোকা মাত্র তাঁকে লোকাল কমিটি মেম্বার থেকে শুরু করে আধা, পোয়া, সিকি যাবতীয় পার্টি সদস্য বা নেতা একযোগে আক্রমণ করেছে। রজনী বাবু বললেন,
--- আমি কী এমন বলেছি যে, আপনারা এভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। আমি তো বুঝতে পারছি না।
--- বুঝতে পারছেন না, না বুঝতে চাইছেন না? সত্যি কথা বলুন। আপনি কি বিরোধী শিবির থেকে টাকা-পয়সা খেয়েছেন?
--- আপানারা আমাকে অপমান করছেন। এভাবে ডেকে এনে অপমান করার কী দরকার ছিল? রজনী বাবু প্রতিবাদ করেন।--- আমি চিরকাল জনশক্তি ফ্রন্ট-এর ইস্তেহারে আস্থা রাখি। তাই মনে মনে চিরকাল এই দলকেই সমর্থন করেছি। আমি কি ভুল করেছি?
এর মধ্যে পার্টি অফিসে ঢোকেন জনশক্তি ফ্রন্ট-এর আয়ত্ব থেকে সবে হারানো মিউনিসিপ্যালিটির প্রাক্তন চেয়ারম্যান বিধানচন্দ্র বসু। তিনি তার সিংহাসনটি হারিয়েছেন বিগত পুরসভা নির্বাচনে। কিন্তু পার্টিতে তো তিনি একজন আঞ্চলিক হোমরা-চোমরা। তিনি পার্টি অফিসে ঢুকে অন্যদের থামিয়ে দিয়ে বললেন,
--- কী করছ তোমরা! কেন এরকম একজন বয়স্ক মানুষকে উত্যক্ত করছো? আমরা তো ওঁকে ডেকে এনেছিলাম। উনি নিজে তো আসেননি আমাদের হয়ে নির্বাচনী প্রচার করতে। আমাদের তো বোঝা উচিত ছিলো যে, রজনীকান্ত বাবু পার্টির ট্রেইন্‌ড মেম্বার নন। ফলে তাঁর বক্তব্যে তো আমরা খুশী নাই হতে পারি। তিনি তো ভুল বলতেই পারেন, যা নাকি আমাদের পক্ষে প্রতিকূল হতে পারে। উনি তো পার্টিটা করেননি বা কখনও ভোটে দাঁড়াননি। ওঁর তো দায় না থাকতেই পারে। ঠিক-বেঠিক তো হতেই পারে। তাই বলে তোমরা ওঁর মতো একজন প্রবীণ মানুষকে অপমান করতে পারো না।
প্রাক্তন পুরপিতার কথাটি মন দিয়ে শোনেন রজনীকান্ত বাবু। এই প্রচ্ছন্ন অসম্মানে মনে মনে আরো অসম্মানিত হন তিনি। অবশেষে বলতে বাধ্য হন--- আপনি ঠিকই বলেছেন, বিধান বাবু। আমার বক্তব্য আপনাদের প্রচারে এবং উদ্দেশ্যে হয়তো একটা অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। কিন্তু যদি এই নির্বাচনে আমিও প্রার্থী হতাম, তথাপি আমি ঐ কথাগুলোকে বলতাম, যেগুলো আমি তিন-তিনটে নির্বাচনী সভায় বলেছি। এটাই আমার বিশ্বাস।
--- রজনী বাবু আপনি বাড়ি চলে যান। এরা উত্তেজিত। আমি বরং আপনাকে নিরাপদে বাড়ীতে পৌঁছে দেবার জন্যেই যা বলার তা বললাম। প্রাক্তন পুরপিতা বললেন।
--- নিরাপদে বাড়ি মানে? তার মানে আপনি এখানে এই মুহূর্তে না এলে আমাকে বিপদে পড়তে হতো।
--- জানেন তো সবই।
--- না জানি না। এ দেশটা যে জঙ্গল হয়েছে, তা জানতাম না। জনশক্তি ফ্রন্টকে এমনটা জানতাম না। জানতে চাইও না।
--- এরা ছোট ছোট ছেলে। এদের মাথা গরম। এরা কি কোন ভেবে-টেবে কিছু করে।
--- আর বড়ো-রা?
--- এখন আর প্রশ্ন করবেন না, রজনী বাবু। বাড়ি যান। বেলা বাড়ছে। আমাদের ভোটের অনেক কাজ আছে। আমাদের তো আপনার মতো দু-একটা মঞ্চে বক্তব্য রাখলেই চলবে না। অনেক দায়িত্ব আছে। বুঝতেই তো পারছেন, বিরোধী দল গোটা বাংলাকে চিবিয়ে খাবার জন্যে মুখিয়ে আছে। তাদের হাত থেকে তো মানুষগুলোকে বাঁচাতে হবে।
রজনী বাবু বলেন--- বটেই তো। এ তো বিরাট দায়িত্ব। তবে আপনিও বাড়ি গিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখবেন, আমি যে বক্তব্য রেখেছি, সেটা যদি পার্টি রাখতে পারে, তবে এই বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়েও দল মানুষের আস্থা, বিশ্বাস ফিরে পেতে পারে। পেটেন্ট ক্যাম্পেইন মানুষ আর শুনতে চায় না। তারা ওসব শুনে শুনে ক্লান্ত। আমি তাদের মতো করেই যা কিছু বলেছি। এই বলে তিনি ওঠেন এবং ওদের অনুমতি নেন--- আমি তাহলে আসি?
সেদিন এইটুকু কথা বলে উঠে দাঁড়াতেই পার্টি অফিস ছেড়ে দ্যায় রজনীকান্ত বাবুকে।
রজনীকান্ত দাস। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের কাছে মাস্টার দাদু। তাদেরকে তিনি আঁকা শেখান, অঙ্ক করান, এমনকি ব্রতচারী ও ব্যায়াম প্রশিক্ষণও দেন। ফ্রী। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। আজ এটাই তাঁর জীবন, এটাই তাঁর আনন্দ। সত্তরোর্ধ বয়স্ক মানুষ। পোস্ট মাস্টার ছিলেন। এখন অবসরপ্রাপ্ত। একটি মাত্র পুত্র তাঁর। সজনীকান্ত। বাবা আর ছেলের মানসিকতায় মেলে না কারণ বাবা একটা আদর্শ নিয়ে চলেন। কিন্তু পুত্র মনে করে, এসব ফাঁপা আদর্শ, একেবারে অহেতুক। এর কোনো বাস্তবতা নেই। সারবত্তা নেই। সজনীকান্ত একটি বিখ্যাত বৈদ্যুতিন কোম্পানীতে চাকরী করে। যান্ত্রিক বিষয়ে ভালমন্দ ডিগ্রী আছে তার। ফলে সে মাইনেও ভালোই পায়। বাবার সাথে তার বিরোধ কোনো সরাসরি বিষয় নয়। ভেতরে ভেতরে। পার্থক্য নয় শুধু, একটা বৈপরীত্যও আছে। ফলে বাবার গত দুদিন আগে অরাজনৈতিক ভাবমূর্তি খসে গিয়ে যে এভাবে একটা রাজনৈতিক আকৃতি বেরিয়ে পড়বে, তা সে এবং তার বিবাহিত স্ত্রী মালা থেকে শুরু করে স্বয়ং রজনীকান্ত বাবুর নিজের স্ত্রী শ্রীলেখা পর্যন্ত মেনে নিতে পারেনি। তাই পরিবারেও তলায় তলায় একটা চোরা স্রোতের মতো ক্ষোভ বয়ে যাচ্ছিলো। আবার ছেলের অনেক বিষয়েই বাবা আপত্তি করেছেন। এক, সে বিয়ে করেছে ভালোবেসে। দুই, ছেলে নিজের বিয়েতে শ্বশুরবাড়ি থেকে ভুরি ভুরি জিনিসপত্র এনে ঘর বোঝাই করেছে। তিন, ছেলেটি রজনীকান্ত বাবু তাঁর পৌত্রকে চোখ মুছতে মুছতে হোস্টেল জীবনে যেতে দেখেছেন। এমন হাজারো বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি ক্লান্ত না হলেও তা শুনতে শুনতে ক্লান্ত বাড়ির মানুষ। স্ত্রী শ্রীলেখাও।
সমাজে কিছু মানুষ থাকেন, যারা সদা সর্বদা অপরকে বিনা স্বার্থে নানা উপদেশ, পরামর্শ দিয়ে যান, যদিও তিনি এবং সেই উপদেশ বা পরামর্শপ্রাপক জানেন যে, তাঁর যা কিছু বক্তব্য অগ্রাহ্য করা হবে। তবুও দেন। লোকে বলে, জ্ঞান দিচ্ছে। অপরদিকে বাড়ির মানুষেরও রজনীকান্ত বাবুর কাজকর্মে ঘোর আপত্তি আছে। যেমন, তিনি ছোট ছোট ছয়-সাত-আট থেকে শুরু করে বারো-চোদ্দ বয়সের ছেলেমেয়েদের কাছে পরম প্রিয়, কেননা তাদের স্কুলের পড়াশুনো থেকে শুরু করে তাদের ড্রয়িং পর্যন্ত এই মাস্টার দাদু সমাধান করে দেন, শিখিয়ে দেন। পোস্টমাস্টার হয়েও তিনি মানুষের কাছে মাস্টারমশাই ছিলেন, আজও তিনি ছোটদের কাছে মাস্টার দাদু ও তাদের অভিভাবকদের কাছে মাস্টারমশাই। রবিবার সকালে বাচ্চাদের অঙ্কন নিয়ে বসেন। বাড়িতে আপত্তি। এ বাড়ি নাকি হরিঘোষের গোয়াল হয়ে উঠেছে। স্ত্রীলেখা এর পেছনের কারণ গোটাটাই জানে। তবু ছেলের সাথে তাল মিলিয়ে সে-ও আজকাল বলে,
--- কী দরকার তোমার ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবার! একটা পয়সা তো ওদের থেকে পাও না। তবে খেটে মরো কেন? নিজে একটু বিশ্রাম নাও না।
স্বামীর বিশ্রামের জন্যে স্ত্রী এসব বলে না। বলে ছেলেকে সমর্থন দেওয়ার জন্যে, আর দিনের মধ্যে বার চারেক বৃদ্ধকে দোকানে পাঠাবার জন্যে। এসব জানেন রজনীকান্ত বাবু। রজনীকান্ত বাবু বলেন--- এসব যে বলছো, এ তো গান তো তোমার লেখাও নয়, তোমার সুর দেওয়াও নয়। কথা-সুর তো অন্যে দিয়েছে। তুমি শুধু প্যাঁ প্যাঁ করে গাইছো। কেন, বল তো?


আজ থেকে একুশ বছর আগে সজনীকান্তর পরে রজনীকান্ত বাবুর পরিবারে একটি কন্যা সন্তান এসেছিলো। যখন তার বয়স বছর পাঁচেক, তখন একদিন মেয়েটি বাড়ির সামনে উঠোনে খেলছিলো। রজনীকান্ত বাবু পোস্ট অফিস থেকে বাসে করে ফিরে রাস্তার ওপার থেকে রোজকার মতো ডেকে উঠেছেন মেয়েকে,
--- সিঞ্জিনী!
রোজই তিনি এমনটা করেন বটে। কিন্তু বিপদ তো রোজ আসে না। সেদিন এলো। বাবা ডেকেছে। বাবার ভক্ত অবুঝ মেয়ে, যা সে কোনদিন করে না, তাই করে বসলো। বাড়ির খোলা গেট দিয়ে সোজা দৌড়ে পথে। রজনীকান্ত বাবু না নারে চীৎকার করেও সামলাতে পারলেন না। যা ঘটলো, তা চোখের পলকেই ঘটে গেলো। রাস্তা পার হতে গিয়ে ছুটে আসা একটি চারচাকার নীচে হারিয়ে গেলো সিঞ্জিনী। বাবার চোখের সামনে তাঁর আত্মজা পথে লেপ্‌টে গেলো। মাত্র এক হাত দূর থেকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন রজনীকান্ত বাবু। আর্তনাদও করতে তিনি তখন শব্দ হারিয়ে ফেলেছেন। মহেশতলার বুক চিরে চলে যাওয়া নিষ্ঠুর পিচের রাস্তায় তখন রক্তস্নাত শিশু আর তার একহাত দূরে নির্বাক একটি পিতা। রাস্তা শুনশান। তিনি তখন আর্তনাদ করলেও তাঁকে সান্ত্বনা দেবার মতো কোনো মানুষ ছিলো না সেখানে।
এরপর তিনি বেশ কিছুকাল মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে একটি দীর্ঘ চিকিৎসায় ছিলেন। পোস্ট অফিসে যেতেন, কিন্তু কাজ করতে পারতেন না। তাঁকে দপ্তরে যেতেই হতো। সহকর্মীদের সহযোগিতায় কেবল পরিবারের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের স্বার্থে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হতো ডাকঘরে। তিনি কোন কাজই করতে পারতেন না। তাঁর চোখের সামনে সব গোলমাল হয়ে যেতো। শুধু কালো রাস্তায় চাপ চাপ রক্ত। সময় নাকি সব ঠিক করে দ্যায় বলে মহাপুরুষেরা বলেন। সেরেও উঠেছিলেন রজনীকান্ত বাবু। তারপর বেচে দেন সেই বাড়ি। তিনি বলেন,
--- আমার মেয়ে এ বাড়িতে নয়, আমার অন্তরে বেঁচে আছে। এ বাড়িতে আছে শুধু বেদনা, দুঃখস্মৃতি। এটা আমি বইতে পারবো না।
সেই থেকেই এই ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে তিনি সিঞ্জিনীকে খুঁজে বেড়ান। ওদের সাথেই তাঁর যত আত্মীয়তা, অন্তরঙ্গতা। এ সবটাই জানে তাঁর স্ত্রী শ্রীলেখা। কিন্তু যেন জানে না। এমন একটা ভাব। আসলে সে তাঁর ছেলের সাথে সঙ্গীতে সঙ্গত করে। হয়তো নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে মহিলা। রজনীকান্ত বাবু এ অঞ্চলে বেশ জনপ্রিয়। আজ প্রায় কুড়ি বছর তিনি এ অঞ্চলে। অন্তত দেড়শ বাচ্চাকে বিনা পয়সায় একটা আদর্শ মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়তে এবং পরীক্ষায় ভালমন্দ ফল করতে দেখছে তাদের বাবা-মায়েরা। এমনকি অনেকে রজনী বাবুকে এ্যাডমিশন টেস্ট- এর প্রফেশনাল ক্লাশ খুলতেও প্রস্তাব দিয়ে বসেছে। রজনী বাবু তাদেরকে ঘাড় ধরে বের করে দেননি বটে। তবে তারা বুঝে গেছেন যে, তারা ভুল জায়গায় ভুল প্রস্তাব দিয়েছে।
আজকের সব বাবা-মাই তো সন্তানদের নিয়ে একটু বেশী, এমনকি প্রয়োজনের থেকে বেশী ভাবিত। তাই তাদের কাছে রজনী বাবু এইসব মানুষের কাছে একটি সম্পদ। এখানেই তাঁর জনপ্রিয়তা, লোকখ্যাতি। এমনটা দেখেই গত বছর জনশক্তি ফ্রন্ট রজনী বাবুকে পুরসভার নির্বাচনে দাঁড় করাবার একটা স্বপ্ন দেখেছিলো। তোরজোড়ও করেছিলো। কিন্তু তা সম্ভব হয় নি। হয়তো বাস্তবে তা হয়েও যেতো, কিন্তু নিয়তি আড়ালে বসে মুখ টিপে টিপে হাসছিলো। সে সময় তিনি এবং তাঁর পরিবারের সকলে হঠাৎ বসন্ত রোগে পড়ে যায়। নিয়তি কে খণ্ডাবে!
জনশক্তি ফ্রন্ট জানে, রজনী বাবু তাদের রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাস রাখেন। তাই এবারে বিধানসভার রজনীকান্ত বাবুকে নির্বাচনে তাঁকে দিয়ে অন্তত অঞ্চলে কয়েকটা সভায় একজন সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে সাধারণ মানুষের কথা বলবার জন্যে আমন্ত্রণ করা হয়েছিলো। এটা একটা রাজনৈতিক গিমিক মাত্র। মানব দরদী ইমপ্রেশন তৈরী করার সস্তা চেষ্টা। রজনীকান্ত বাবুর শিক্ষা-সংস্কৃতিতে পূর্ণ এই পার্টির আস্থা ছিল । পার্টির সদস্যপদ রজনীকান্ত বাবুর নেই বটে। কিন্তু এমন একটি মানুষকে দিয়ে প্রচারের কাজ করানো পার্টির নীতিবিরুদ্ধ হলেও এই দোদুল্যমান বাতাবরণে একটা সুফলের আশায় পার্টির মাতব্বরেরা এমনটা সিদ্ধান্ত নেয়। নির্ভেজাল অরাজনৈতিক মানুষকে দিয়ে রাজনৈতিক প্রচার। বহু চিন্তার রসদ এটি।
কিন্তু তিনি গোটা বিষয়টা যেন চট্‌কে দিয়েছেন। মাঠে মেরে দিয়েছেন জনশক্তি ফ্রন্ট-এর পরিকল্পনা। তিন-তিনটে সভায় তিনি যে বক্তব্য রাখেন, তার গভীরতা কতটা বা সেই বক্তৃতা পার্টি-তে নেতাদের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া করবে, তা অনুধাবন করতে পারে না চুনোপুঁটিরা। দাদারা বক্তৃতার রেকর্ডিং শুনে ভীষণ বকাবকি করেন ছোটোদের। তাদের অভিযোগ, কেন ছোটরা সেলফোনে বিষয়টা যে হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে, তা নেতাদের জানালো না। কিন্তু একটা ভাষণের গভীরতা বুঝতে যতটুকু জ্ঞানগম্যির প্রয়োজন হয়, তা এই পার্টির দুধের শিশু পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি কেননা পার্টিতে বেনোজল ঢুকছে। একটা সময় এই পার্টিতে সমঝদার মানুষ ছিল। আজ সেদিন গেছে। পোলিটিক্যাল ভ্যাল্যুজ আর নেই। ফলে যা হয়, তাই হচ্ছে। এলোমেলো করে দে মা, লুটেপুটে খাই। এই কারণেই আজ আর মানুষের জনশক্তি ফ্রন্ট-এর ওপর তেমন কোনো ভরসা নেই। মানুষ বিকল্প খুঁজছে। উপযুক্ত না পেলেও যাকে তাঁকে দিয়ে মানুষ সেই কাজটা করাতে চাইছে যাতে জনশক্তি ফ্রন্ট আর শাসনে না থাকে। এইখানেই জনশক্তি ফ্রন্ট-এর মৃত্যুবীজ উপ্ত হয়েছে। কিন্তু মরতে মরতে তো সবটা মরে না। তাই রজনীবাবুর মতো মানুষদেরকে ডেকে আনা হয়েছে দু-একটা সভায় বক্তৃতা দেবার জন্যে। এমনকি রজনীকান্ত বাবুকে অনেকটা এই কারণেই তাঁর বেগরবাই ভাষণের মূল্য হিসেবে প্রহারেন ধনঞ্জয় দেওয়া হয়নি। বয়স্ক মানুষ। আজ কোনভাবে পানের থেকে চুন খসলে এবারে গদিটাই হারাতে হবে। এই হারানোর ভয়টাই খুঁচিয়ে দিয়েছেন রজনীকান্ত বাবু। নেতাদের মনে হয়েছে, তিনি যা বলেছেন, তা পার্টির ভাবমূর্তিতে, বিশ্বস্ততাতে আঘাত করেছে। শ্রীপঞ্চমীর মানুষ যেন একটা পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতে  শুরু করেছে। রজনীকান্ত বাবুর ভাষণটি যদি কেটে ছেঁটে তুলে ধরা যায়, তবে তা এমনটা দাঁড়াবে---
ভাইসব, আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নই। এটা আপনারা সকলেই জানেন। আমি এই শ্রীপঞ্চমীর আজ বিশ বছরের বাসিন্দা। আজকের অনেক যুবক তখন জন্মগ্রহণ করেনি, যখন আমি এখানে এসে বসবাস শুরু করি। মাত্র দু-লক্ষ টাকা কাঠা দরে এখানে আমি জমি কিনি। আজ সেই জমি বাড়ও-তেরো লক্ষ করে কাঠা। আপনারা আমাকে আজ জনশক্তি ফ্রন্ট-এর নির্বাচনী প্রচার মঞ্চে দেখে হয়তো অবাক হচ্ছেন। না ভাইসব, আমি আজও কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য নই। আমাদের গণতন্ত্র আমাকে এখানে বক্তব্য রাখতে দিয়েছে। খোদ জনশক্তি ফ্রন্ট আমাকে অনুরোধ করেছে এই পড়াক নির্বাচনী সভায় আমার বক্তব্য রাখতে। এরই নাম গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্র আমরা চাই। যে বা যারা আমাদের এই গণতন্ত্রকে হত্যা করতে চায়, তাদেরকে আমরা মার্জনা করতে পারি না। স্বাধীনতা আন্দোলনের যুগের রাজনীতি, আর আজকের রাজনীতি কিন্তু এক নয়। অনেকটা বদলে গেছে। কিন্তু আমাদের মানসিকতা সম্পূর্ণ হারায়নি। রাজনীতি বা রাজনৈতিক দল মানে মানুষ যেমন একটা মন্দ ধারনা পোষণ করেন, তা কিন্তু ঠিক নয়। এখনও অনেক রাজনৈতিক নেতারা আছেন, যারা দেশের কথা, মানুষের কথা ভাবতে চান। তিনি বা তাঁরা কে, এ কথা আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না। আপনি চোখ খোলা রাখুন। নিশ্চয়ই দেখতে পারবেন। এটা আপনাকেই খুঁজে নিতে হবে। আপনি যদি মনে করেন, সেই ব্যক্তি জনশক্তি ফ্রন্ট-এ আছেন, তবে তাঁকেই ভোট দেবেন। যদি মনে করেন, তিনি বা তাঁরা বিরোধী দলে আছেন, তবে আপনাদের অমূল্য ভোট সেখানেই পড়বে। কারোর কোনো প্ররোচনায় কান পাতবেন না। মনে সাহস রাখুন। আগামী পাঁচটা বছর কিন্তু আমাদের কিচ্ছু করার থাকবে না, যদি আমরা কোনো প্রলোভনে বা প্ররোচনায় ভোট দেই। আমি বলতে চাই না যে, এই দলকে ভোট দিন, ঐ দলকে দেবেন না। আপনি আপনার মনকে প্রশ্ন করুন এবং ভোট দিন। আমাদের একটি সুন্দর সরকার চাই। কাকে ভোট দেবো, তা কিন্তু আমরা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভাববো না। ভেবেই যাবো সেখানে। আমরা শান্তি চাই। উন্নতি হয়তো ধীরে হবে, কিন্তু আমরা শান্তি চাই, স্বস্তি চাই। আপনি যদি তাই-ই চান, তবে নিজের সিদ্ধান্তকে শক্ত করুন। নমস্কার।
কমবেশি--- এই ছিল রজনীবাবুর বক্তৃতা, বা ভাষণ অথবা জনশক্তি ফ্রন্ট-এর চোখে অপরাধের মাখনটুকু। আর সেই জন্যেই তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছে, আপনি কী মনে করেন? মঞ্চে উঠে আপনি যা খুশী তা-ই বলবেন? আমাদের নেতারা পর্যন্ত হেড-কোয়ার্টারে আলোচনা না হলে কোন মন্তব্য করতে পারেন না। আর আপনি কোন হরিদাস!
রজনীকান্ত বুঝতে পারেন, দূর থেকে গাছের যে ফলগুলো দেখতে সুন্দর লাগে, কার্যত তা সুন্দর না-ও হতে পারে। তা খেতে মন্দ এবং তা অস্বাস্থ্যকরও হতে পারে। কিন্তু পরাভব মেনে চলে যান না তিনি। স্পষ্ট প্রশ্ন করেন--- আপনারা কী মনে করেন? আপনারা মানুষকে যা বলতে বলবেন, তারা তা-ই বলতে বাধ্য? এভাবে মানুষকে পোষা জন্তু বানিয়ে রাখার রাজনীতি জনশক্তি ফ্রন্ট কবে থেকে শুরু করলো! আপনারা কি আমাদের মাথাগুলো কিনে নিয়েছেন? আমি তো আপনাদের মঞ্চে ভাষণ দিতে চাইনি। আপনারাই তো আমাকে বার বার অনুরোধ করেছেন।
পার্টির কেউ রজনীকান্ত বাবুর গা-এ হাত তোলেনি। আজকাল এসব করার অনেক সমস্যা আছে, আর সেটা পার্টি জানে। কিন্তু বিকেলবেলা যখন মাঠে পাড়া-বেপাড়ার বাচ্চাকাচ্চাদেরকে রজনীকান্ত ব্রতচারী করাচ্ছেন, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাদের মাস্টার দাদুর সাথে গলা মিলিয়ে বলছে, ছুটবো খেলবো হাসবো, সবারে ভালবাসবো, গুরুজনকে মানবো, জীবে দয়া দানবো..., তখন রজনী বাবুর ছেলে সকাল সকাল ফিরছিল অফিস থেকে। রাস্তা ছেড়ে সে নেমে পড়ে ব্রতচারীর মাঠে। ছেলের তোপের মুখে পড়েন বাবা। ছেলেকে রাস্তায় ভালমন্দ বলেছে জনশক্তি ফ্রন্ট-এর বেনোজলের স্রোত। তার মধ্যে প্রচ্ছন্ন ছিলো একটা হুমকি। সেটা সজনীর মতো শিক্ষিত ছেলের বুঝতে কোনো অসুবিধে হয়নি। সোজাসুজি সে আক্রমণ করেছে বাবাকে,
--- বাবা, তুমি কি আমাদের বাঁচতে দেবে না!
হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন রজনীকান্ত। ছেলে আবার আক্রমণ করে--- জনশক্তি ফ্রন্টএর স্টেজে তুমি কী বলেছো? এবার অবাক রজনীকান্ত। অবাক হন ছেলের আক্রমণে নয়, জনশক্তি ফ্রন্ট-এর নোংরা রাজনীতিতে। এদিকে মাস্টার দাদুর সাথে কাকুকে এমন কথা বলতে শুনে প্রাথমিক স্তরে সবে পাঠ শুরু করা ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা একটু অসন্তুষ্টই হয়, কেননা ওরা বুঝতে পারে যে, এই কাকু ওদেরকে পছন্দ করে না। বাড়িতে আকার ক্লাশ বা অঙ্কের ক্লাশ করতে গেলে এই কাকুই ওদের সাথে মন্দ কথা বলে। আধুনিক যুগের শিশু ওরা। কোনো মানুষ ললেই ওরা -টা বুঝে নেয়। তাই ওরা এ ওর মুখ তাকাতাকি করে। অনেককিছু বুঝে নেয়। ওদেরই সামনে ঘরে বাবা-মায়ের আলোচনা থেকে মাস্টার দাদুকে নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচনা ওরা কিছু না কিছু জেনে গেছে। রজনীকান্ত সবটা বুঝেও ছেলের মুখ থেকে শুনবার জন্যে বলেন,
--- তুই এখন বাড়ি যা। পরে কথা  হবে। 
বাড়িতেই পরবর্তী কথা হলো। ছেলের প্রশ্ন--- কেন তুমি এভাবে সীন ক্রিয়েট করছো, বলো তো? কী চাও তুমি?
রজনীকান্ত কোন ভূমিকা না করে পাল্টা প্রশ্ন করলেন--- আজকাল কি আমাকে আমার কাজ নিয়ে তোর কাছে জবাবদিহি করতে হবে? মনে রাখিস, তোর বাবা এখনও তোর আনা ব্যাগ ভরা টাকায় ভাগ বসায় না। আমি সামাজিক, রাজনৈতিক, এমনকি অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন।
--- আর আমাদের নিরাপত্তা? সব জায়গায় তোমার জমিদারি নাকি? সব কিছুর একটা ফরম্যাট থাকে। সেটা জানো না তো যাও কেন? তোমার জন্যে ওরা আমাকে রাস্তায় ডেকে যা-নয়-তা বললো!
--- কী যা তা বললো? মেরে ফেলবে? কেটে ফেলবে?
--- কী হবে জেনে? কী করতে পারো তুমি? তোমার পেছনে কে আছে যে, তোমাকে বা আমাদেরকে বাঁচাবে? আছে কোন দল?
--- আমার পেছনে কেউ নেই রে। শুধু আমার সামনে আছে আমার প্রতিবাদ, আমার সত্যি কথা। তোরা এভাবে বাঁচতে শিখেছিস কোথায়? আমি তো শেখাইনি।
এরই মধ্যে ঢুকে পড়ে রজনীকান্ত বাবুর স্ত্রী শ্রীলেখা। ছেলেকে চুপ করিয়ে দিয়ে তিনিই হাল ধরেন। এ্যাতোদিন পরে স্বামীকে কিছু বলার সুযোগ পেয়ে তিনি সেই সুযোগ ছাড়তে চান না। তিনিও চেচিয়ে ওঠেন--- তুমি কি দয়া করে তোমার মুখটা বন্ধ করে রাখতে পারো না? তোমার জন্যে তো আমি জ্বলে গেলাম। তোমার নিজের আত্মীয়-পরিজন গেছে, আমার বাপের বাড়ি-তো কবে চুকেবুকে গেছে, এক সন্তানকে তো খেয়েছো। এবারে যে এই সন্তানের জীবনটাও খাবে।
এই একটা বিষয়ে আজও রজনীকান্ত দুর্বল। এই প্রসঙ্গ তাঁকে সিঞ্জিনীর কথা স্মরণ করিয়ে দ্যায়। তিনি জানেন, শ্রীলেখা তাঁকে ঐ আঘাতেই আহত করে থাকে। তাই তিনি রণে ভঙ্গ দেন। নীরব হয়ে যান। এটা জেনেই আজও শ্রীলেখা তাঁকে এই অস্ত্রেই আঘাত করে।
রজনীকান্ত জানেন, অনেক মানুষ বেড়ালের জীবন কাটায়। শুধু ম্যাও ম্যাও। পায়ে পায়ে ঘোরা। এরা নীরবতা দিয়ে নিরাপত্তা কেনে। সম্মান, মর্যাদা, স্বাধীনতা ইত্যাদির কোনো মূল্য এদের কাছে নেই। তাই তিনি শুধু বলেন--- একটা রাস্তা তোমাদেরকে আমি বলে দিই। ওদেরকে বলে দিও, আমার কোন কাজের দায় তোমাদের নেই। এমনকি আমার ওপর নেমে আসা কোনো বিপদের দায়িত্বও তোমাদের নেই। আমি এ বাড়িতে আলাদা থাকি, আলাদা খাই। একটা পৃথক সত্তা। আমার বিষয়কে নিয়ে যেন তোমাদেরকে প্রশ্ন না করে। ব্যস্‌, তোমরা মুক্ত।
এই কথা বলে তিনি সরে যান সেই স্থান থেকে। তখন বাইরে কিছু ছেলেমেয়ে অপেক্ষা করছিলো মাস্টার দাদুর জন্যে। এখন যে ভূগোল ক্লাশ। কিন্তু হাওয়া সরগরম দেখে তারাও সরে পড়ে। বাড়িতেও সকলে চুপ করে যায়। এটাই রজনীকান্ত বাবুর চূড়ান্ত ঘোষণা। তাই ভেতরে ভেতরে একটা উত্তাপ পরিবারে ছাই চাপা আগুন হয়ে থাকে। উত্তাপ বাইরেও ছড়ায়। নির্বাচনের দামামা বেজে ওঠে। দোকানে, বাজারে, হাটে মাঠে, ঘাটে, ময়দানে, ঘরে-ঘরে সর্বত্র একই আলোচনা শুরু হলো। কে জিতবে? এ্যাতোকাল ধরে রাজ্যে শাসন ক্ষমতায় থাকা জনশক্তি ফ্রন্ট, নাকি নতুন সরকার। নতুন সরকার মানে পিপ্‌লস লিবারেশন ফ্রন্ট। শান্ত, গম্ভীর আর স্তব্ধ আজ বাংলা। চারদিকে একটা রুদ্ধশ্বাস বাতাবরণ, যেন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আগে থেমে থাকা আকাশ-বাতাস-নদী-নালা-খাল-বৃক্ষ-লতা-গুল্ম। কারোর মুখে কোনো বেফাঁস কথা নেই। শুধু মুখ তাকাতাকি। গণতন্ত্রের এক দানবীয় রূপ। চারদিকে অবিশ্বাস আর বিদ্বেষ। কারা যাবে, কারা আসবে।
শুধু রজনীকান্ত বাবু আর তাঁর রুকু-বিল্লু-তারক-মাধব-শিল্‌টু-বাপী-সোনাই-বাপ্পা নামে নিষ্পাপ শিশুদের মনে কোন ভাবান্তর নেই। ওদের নেই কেননা ওরা এই ভাবনা থেকে বহু দূরে নিক্ষিপ্ত। আর রজনীবাবুর নেই কারণ তিনি জানেন, যেখানেই আসন, সেখানেই দুঃশাসন। তাই তিনি নিয়মিত মাঠে যান, বাচ্চাদের পিটি করান ওদের, দৌড় করান, গান করান, আয় মোরা সবাই মিলে খেলবো রায়বেশে... অথবা চল্‌ কোদাল চালাই ভুলে মানের বালাই/ ছেড়ে অলস মেজাজ/ হবে শরীর ঝালাই...। রবিবার ওদের আঁকান পাখি-ফুল-লতা-পাতা আরো কতো কী! তিনি নিশ্চিত, মানুষ যতদিন জেগে না উঠছে, ততদিন মুক্তি নেই। কোনও সংবিধান, রাজা-মন্ত্রি-শান্ত্রী-যন্ত্রী কেউই বাঁচায় না মানুষকে। নিজেকে নিজেই বাঁচাতে হয়। আজও সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ত কথাটা শুধু পশু নয়, মানুষের সমাজেও সত্যি। আজকাল মাঝে মাঝে মনেও হয়, এই যে তিনি অঙ্ক করান বাচ্চাদের--- এই অঙ্কই যত সর্বনাশের মূল। মানুষ হিসেব কষতে শিখেছে। লাভক্ষতির খতিয়ান হিসেব করে সে। তৈরী করেছে হিসেবের খাতা। কত পেলো, কত হারালো। কী দিয়েছে, আর কী পেয়েছে। তাই এই যত হানাহানি, কাটাকাটি।
তারমধ্যেই বেরিয়ে গেলো নির্বাচনের ফল। বেবাক পতন হয়েছে জনশক্তি ফ্রন্ট-এর। মানুষ নির্বাচিত করেছে পিপ্‌লস লিবারেশন ফ্রন্টকে আর সাথে সাথে শুরু হয়েছে তাণ্ডব। তুই থুলি, না মুই থুলির হিংসা। যেখানে যার প্রতাপ, সেখানে সে নির্বিবাদে হত্যা করে চলেছে বিরোধীকে। নির্বাচনের নামে এক খেলায় মানুষের কষ্টার্জিত অর্থের আদ্যশ্রাদ্ধক্রিত্য সম্পন্ন করে এবার শুরু হয়েছে রক্তস্নান, মানুষের নিরাপত্তা শিকেয় উঠেছে। এরই মধ্যে হঠাৎ এক রাতে রজনীকান্ত বাবুর বাড়িতে বারান্দায় লাগানো কাচে এসে পড়ে ইট। ঝন্‌ ঝন্‌ করে ভেঙ্গে পড়ে কাচ। এমন অবস্থায় নিজের ঘরে পাথরের মূর্তির বসে থেকেছেন রজনী বাবু আর ভেতরে ভেতরে ভেঙ্গে খানখান হয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত যে, তাঁকে বাইরে ডাকা হচ্ছে, যাতে ইটের একটা টুকরো তাঁর মাথায় ফেলা যায়। পরদিন রুকু-বিল্লুরা প্রশ্ন করতে কোনো উত্তর দিতে পারেননি ওদের মাস্টার দাদু। ওরা বুঝবে না। আবার রজনী বাবুর মনে এ প্রশ্নও  এলো--- ওরা একেবারেই কি বুঝবে না? হয়তো গভীরতা বুঝবে না, কিন্তু বাবার সাথে বসে তো টেলিভিশনে খবরাখবর দ্যাখে, শোনে। কিছু কিছু তো ওরা ওদের মতো করে বুঝেও নেয়। জ্ঞানী ব্যক্তিরা তো বলেন, শিশু একেক জন এক একটি বড়ো বড়ো দার্শনিক। আসলে রজনীকান্ত বাবু নিজেই জানেন না, কে বা কারা করেছে এই কাজ। তিনি জানতে চানও না। হয় এটা করছে পরাভূত ও ক্ষুব্ধ জনশক্তি ফ্রন্ট অথবা বিজয়োল্লাসে মত্ত পিপ্‌লস লিবারেশন ফ্রন্ট।। রজনীকান্ত বাবুকে মনে মনে জনশক্তি ফ্রন্ট-এর সমর্থক বলে অনেকে জানেন। এটা অলিখিত ও অঘোষিত একটি তথ্য। অনেকে জনশক্তি ফ্রন্ট-এর মন্দ কাজ করার কারণে তাঁকে ঠেস দিয়ে বলেওছে, এই তো আপনাদের পার্টির চেহারা। ফলে পিপ্‌লস লিবারেশন ফ্রন্ট যে তাঁকে মন্দ চোখে দ্যাখে না, তা নয়। তিনি ঐ ওদের দলের কাগজ নেন, চাঁদা দেন, মিটিং-এ যান, বক্তৃতা শোনেন। অপরদিকে রজনী বাবুর ওপর ক্ষেপে আছে জনশক্তি। মনে হচ্ছে, গোটা রাজ্য জুড়ে তাদের হারের অন্যতম অকারণ এই রজনী বাবু। তাই তারাও ক্ষেপে-টেপে কোনো একটা কাণ্ড ঘটাতে পারে। কে ঘটিয়েছে, সেটা রজনী কান্ত বাবুর কাছে গুরুতর নয়। অন্তত সেই দল তো এই বাংলারই একটি দল। গণতন্ত্রে রাম যাবে, আর শ্যাম তো আসবেই। কিন্তু মানছে কে? একদিকে যেতে নাহি দিব। অপরদিকে মন যেতে নাহি চায়
এই ঘটনায় বাড়ির মানুষ মুখে কিছু না বললেও মাথা-টা নিচু হয়ে গেছে রজনীকান্তের। এর কিছুদিন পরে রজনী বাবু বারান্দাটাতে বসে বাচ্চাদের অঙ্ক কষাচ্ছিলেন, এমন সময় বাড়ির সামনে একগাদা ছেলে জয়োল্লাসে আবির খেলতে খেলতে আর পটকা ফাটাতে ফাটাতে চিৎকার করতে শুরু করে। বিজয় মিছিল চলছিলো। রজনী বাবু বেরিয়ে আসেন ঘরের বাইরে। বেশ কিছুক্ষণ ওদের অসভ্যতা লক্ষ্য করে শেষে বলেন,
কী করছো বাবা, তোমরা! আমি যে বাচ্চাগুলোকে অঙ্ক শেখাচ্ছি। তোমরা না হয়, মিছিলটা নিয়ে চলে যাও। এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কী মানে?
কিন্তু অসভ্য ভাষায় তারা রজনী বাবুর কথার প্রতিক্রিয়া করে--- কেন? এটা কি আপনার জনসক্তি ফ্রন্ট-এর লিজ নেওয়া জায়গা নাকি? ওসব দিন গেছে, দাদু। এবার পি.এইচ.এল.-কে মেনে নিতে শিখুন। মানুষ আপনাদের পাশে নেই।
রজনীবাবু কোমল প্রতিবাদ করেন--- এসব আমাকে বলছো কেন? আমি তো কোনো পার্টিরই কেউ নই।
--- আপনি কেউ নন্‌ তো ওদের মঞ্চে কি ঢং মারাতে গিয়েছিলেন?
রজনীকান্ত বাবু বোঝেন যে, এরা তাঁকে উত্তেজিত করতে চায়। একটা ইস্যু ওরা খুঁজছে। কিন্তু এই বাচ্চাদের ফাঁদে তিনি পা দিতে চান না। শুধু বলেন--- দ্যাখো, গত পরশু আমার বাড়িতে একবার কাচ ভাঙ্গা হয়েছে। বাড়ির মানুষ এমনিতেই আতঙ্কে আছে। এরপর এসব হলে তো ওদেরকে সামলানো তো মুশকিল হবে। তাছাড়া তোমাদেরও বলি, তোমাদের অনেকের চাকরী-বাকরি আজও হয় নি। আমার মতো বুড়ো মানুষ যদি এই অবস্থায় হঠাৎ হার্ট এ্যাটাকে মরে যায়, তবে তো তোমাদের জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে। মরা মেরে খুনের দায়ে পড়বে।
  কথার অর্থ যা-ই হোক, ওদের মধ্যে কে একজন বলে--- দ্যাখ্‌, দড়ি পুড়ে গেছে, কিন্তু পাক এখনও যায় নি। এখনও চাকরী খাবার কথা বলছে।
আর একজন বলে--- আমরা কি আপনার বাড়িতে কাচ ভেঙ্গেছি নাকি? আপনি দেখেছেন? না দেখে এসব বলছেন যে!
লতে বলতেই ওদের দুজন যে টেবিলটাতে রজনী বাবু অঙ্ক শেখাচ্ছিলেন, সেটা উল্টে ফেলে দ্যায়। রজনী বাবু লক্ষ্য করলেন, তাঁর শান্ত-শিষ্ট ছোট্ট ছোট্ট শিক্ষার্থীরা একে একে ভয়ে ভয়ে গুটি গুটি বেরিয়ে গেলো বারান্দা থেকে। তিনি শুধু বললেন--- কী করছো তোমরা! ভায়োলেন্স করছো কেন? বাচ্চাগুলো পড়া ছেড়ে যে পালিয়ে যাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছো না? কেন এসব করছো?
ততক্ষণে লিবারেশন ফ্রন্ট তাদের একছত্র লিবার্টি পেয়ে হিংস্র হয়ে উঠেছে। তারা রজনী বাবুর চেয়ারটাকে সিঁড়ি-তে আছাড় মেরে ভেঙ্গে দ্যায়। ঘরে তখন ভয়ে কাঁপছে শ্রীলেখা আর পুত্রবধূ মালা। ছেলে সজনীকান্ত তখন অফিসে। মালা তাকে টেলিফোন করে জানায় ঘটনাটা। কিন্তু সে নিশ্চিন্তে বলে,
--- এসব তো হবেই। আমি তো আর আটকাতে পারবো না। তাছাড়া আমি তো অফিসে। তবে নিশ্চিন্ত থাকো, এসব ঘটছে শুধু বাবার ওপরে। যেমন পুঁতবে, তেমনটাই তো ফলবে। বাবার এমন শিক্ষা হওয়াটা উচিত ছিল। চিন্তা করো না, ওরা বাবাকে কোন আঘাত করবে না।
ঘটনাটা স্বামীর জানা বলে মনে হলো মালার। এই আজ প্রথম সে নিজের স্বামীকে মনে মনে তেমন সমর্থন করতে পারলো না। এদিকে যখন এমন হিংস্রতা চলছিলো, তখন সবার অলক্ষ্যে প্রায় দেড়শো বাচ্চা আর তাদের অনেকের অভিভাবকেরা রজনী বাবুর বাড়ির সামনে ভিড় করে। যারা এখানে অঙ্ক কষছিলো, তারা বাড়ি ফিরে তাদের মাস্টার দাদুর ওপরে যে হামলা হচ্ছে, এই খবরটা দ্যায়। তাই এরা জমায়েত হয়েছে প্রতিরোধ করতে। মাস্টার মশাইয়ের কোনো ক্ষতি তারা হতে দেবে না। তাদের স্বার্থ এই লোকটির নিরাপত্তার সাথে জড়িয়ে আছে। হঠাৎ হামলাকারীদের এক জনের কানে যায় একটি বাচ্চার কণ্ঠ,
--- বড়োকাকা, মাস্টার দাদুকে ছেড়ে দাও।
বড়কাকা সম্বোধিত ছেলেটি ঘাড় ঘুরিয়ে দ্যাখে যে, তারই ভাইপো শ-দেড়েক ছেলেমেয়েদের মধ্যে দাঁড়িয়ে হুমকি তাদেরকে দিচ্ছে। ওদের সকলেই ঘটনাটার আসন্ন বিপদ বুঝে যায়। সাথে সাথে ওদের দুঃসাহসের বেলুনটা চুপ্‌সে যেতে শুরু করে। ওরা এটাও লক্ষ্য করে যে, ঐ ভিড়ের মধ্যে একটা ক্ষোভ যেন ফুসে ফুসে উঠছে। যে কোন ঘটনা ঘটে যেতে পারে। প্রতিরোধের জন্যে মানুষ বেরিয়ে এসেছে নিজেদের স্বার্থে।
তারপর?
আমার কথাটি ফুরলো, নটে গাছটি মুড়লো।

--------------------------------