আমার মুক্তি সুধায় আলোয় (একটি নিবন্ধ)
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়
মানুষ নাকি সারা জীবন ধরে জীবনের আশায় ঘুরে মরে। নবীনচন্দ্র
সেন লিখেছিলেন--- ধন্য আশা কুহকিনী/তোমার মায়ায় অসার সংসার চক্র ঘোরে নিরবধি...।
আসলে জীবনের খোঁজে’ ব’লতে যে কী বোঝায়, তা আমাকে বার বার বিভ্রান্ত করে। আমি
বুঝতে পারি না, আমি কি জীবনের খোঁজে আছি? পশুরাও জীবনের খোঁজে থাকে। তাঁদের খোঁজ তো
একটি সহজ সরল বিষয়। সেখানে কোন তঞ্চকতা নেই, দ্বিচারিতা নেই, কৃত্রিমতা নেই। বিজ্ঞানের
কোনো অধ্যায় গ্রন্থে না প’ড়লেও তারা তাদের
সহজাত প্রবৃত্তিতে জেনে গেছে যে, Struggle is for existence and here survival is for the
fittest. তাই তাদের জীবন আর জীবনানুসন্ধান অত্যন্ত সহজ। তারা শুধু ক্ষুণ্ণিবৃত্তি’র খাদ্য, নিদ্রা’র জন্যে একটা নরম-সরম (প্রধানত বালি) আশ্রয় আর মেটিং-এর জন্যে একটা পাত্রী বা
পাত্র খোঁজে। ব্যস, এইটুকু পেলেই তারা খুশি। তাদের কোন প্রগতিশীলতা নেই, রাজনীতি
নেই, সমাজসেবা নেই, নীতিনির্দেশ নেই, আদর্শও নেই আবার শোষনও নেই, পীড়নও নেই। ঐ
তিনটিই মাত্র তাদের জীবনের উপাদান। খাদ্য, নিদ্রাশ্রয় আর সঙ্গম। তার জন্যে ওরা
রক্তাক্ত হ’তে পারে, প্রাণ দিতে পারে। তাদের আর কোনো
চতুর্থ কোনো খোঁজ নেই। জীবনের আর কোন পরমার্থ নেই। কিন্তু মানুষের জীবনানুসন্ধান
বড়ো বিচিত্র। ইংরেজিতে বলে, ‘We say what we don’t do and we do what we don’t say. ফলে যখন আমি একটা সুস্থ বাতাবরণে থাকি, তখন মনে হয়, এটা কি
জীবন! একটা যথার্থ জীবনের পথ অবলম্বন করা বড়ো জরুরি। এভাবে বেঁচে থাকার কোন অর্থ
হয় না। কিন্তু যখনই সমস্যা সঙ্কট আমাকে পর্যূদস্ত করে, তখন আমি ভুলে যাই জীবনের
কথা।
মানুষ বড় বিচিত্র জীব। এই তার আকাশে দিব্যি খরতপ্ত সুর্য,
এই তা মেঘালয়। তাই মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরাও কি ঐ পশুদের মতো একটা সহজাত প্রবৃত্তিসম্পন্ন জীব নই? তা নয়তো আমাদের
জীবনের খোঁজ কোথায়? গ্রন্থে দু-কথা লেখা, আর বাস্তবে তার প্রতিফলন তো এক বিষয় নয়। কোথায়
আমাদের যথার্থ জীবনযাপনের একটা উপায় অন্বেষণ? শুধুমাত্র আমাদের নিজেদের খাবার, সারা
বছরভর সঙ্গম, আমাদের আমরণ আরাম-আয়েশ, আমাদের পারিবারিক নিরাপত্তা, একান্ত
ব্যক্তিগত শান্তি ও সুখ নিয়ে কি আমরা খুব চিন্তিত নই, উদ্বিগ্ন নই? আমরা কি আদৌ
কোনো সামাজিক জীব আছি? অর্থাৎ ‘সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে...’ এই বোধ কি আমাদের র’য়েছে? এটাই কি মনুষ্য
জীবন? আমরা কি একরকম জীবন্মৃত নই? জীবনের খোঁজে, অর্থাৎ জীবনবোধের খোঁজে, জীবনাদর্শের
খোঁজে, সত্যিকারের জীবিত থাকবার একটা উপায়-এর খোঁজে কি আমি আছি? মাঝে মাঝে এ কথাও
মনে হয়, আমরা কি সত্যিই বেঁচে আছি?
আমি কি বেঁচে থেকেও ম’রে নেই? তবে পথেঘাটে আমার চোখের সামনে যখন কোনো অসভ্য পুরুষ কোন অসহায় একটি
মেয়েকে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে শ্লীলতাহানি ক’রতে চেষ্টা ক’রে--- আমি তা দেখতে পেয়েও “আমার বলা’র কী দরকার” ব’লে মনের দরজাটা
বন্ধ ক’রে দিই। তখন মাঝে মাঝে একটা কবিতা’র দুটো ছত্র মনে পড়ে নাকি--- “আমি কী রকমভাবে বেঁচে আছি, তুই একবার এসে দেখে যা নিখিলেশ /
এই কি মানুষ জন্ম? / নাকি...।” কোনো কোনো সময়ে বাড়ি’র সামনে দিয়ে কোন প্রতিবেশী ব্যক্তির মরদেহ চারজন মানুষ ব’য়ে নিয়ে গেলে যখন দেখি, মৃতদেহ’টির মাথাটি তাদের চলা’র সাথে সমানে ন’ড়ে চ’লেছে, তার দুটি চোখ এক পবিত্র পাতা দিয়ে ঢাকা, বুক তার ওঠে
না, পড়ে না, তখন আমার মনে হয়, আমিও যেন ঐ মানুষটির মতোই এক মৃত মানুষ। ঐ বাঁশের
খাট-টায় আমি শুইনি বটে, কিন্তু আমার এ জীবন আমার মরদেহ বৈ আর কিছু নয়, আর আমিই তা ব’য়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। আমাকে ব’ইবারও কেউ নেই।
কিন্তু কোনো এক কবি আশাবাদী হ’য়ে লিখেছিলেন, মানুষকে কেউ নাকি সম্পূর্ণ নষ্ট ক’রে দিতে পারে না। তার স্বার্থবোধ, তার আত্মকেন্দ্রীকতা, তার
বস্তুনির্ভরতা তাকে পুরোপুরি অমানুষ ক’রে তুলতে পারে না। তাই আমারই মতো সে একদিন না একদিন আবিষ্কার করে যে, সে এক
মৃতপ্রায় জীবন যাপন ক’রছে। তখন তা থেকে
বেরিয়ে আসার জন্যে তার প্রয়াস প্রচণ্ড হয়। সে মুক্তি চায়। আমিও চাই। ওই যে সেই
গান, “পৃথিবী আমারে চায়, রেখো না বেঁধে আমায়,
খুলে দাও প্রিয়া, খুলে দাও বাহুডোর।” এই গান সে গাইতে চায়।
তাই মানুষ নাকি জীবনের
খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। একটা আদর্শ জীবনের খোঁজে, একটা জীবনীশক্তির খোঁজে, বিচিত্র মানুষের
বিচিত্র জীবনকে একবার পরখ ক’রে নেবার খোঁজে অথবা
জীবনের জন্যে কিছু ক’রতে সে নানা উপায়
অন্বেষণ ক’রতে বেরিয়ে প’ড়তে চায়। আবার কেউ কেউ মানুষের সমাজ ছেড়ে চ’লে যান গভীর অরণ্যে অথবা পর্বতে, নিরালম্ব জীবন কাটান, পরমপুরুষের
সাধনা করেন। এই পার্থিব জীবন তাঁদের কাছে এক মায়া মাত্র। তাঁরা জীবনের খোঁজ পান
কিনা, আমার সঠিকভাবে জানা নেই। তবে মানুষকে বাদ দিয়ে যারা নির্জনে, নিভৃতে বা
নিসঙ্গতা’র মধ্যে জীবনের খোঁজ করেন, তাদের
সম্বন্ধে আমার মনে নানা সংশয়। কেননা, ‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়...’। যারা জীবাত্মা’র সাথে পরমাত্মা’র সম্পর্ক অনুসন্ধানকে জীবনানুসন্ধান মনে করেন, তাদেরকেও
নিয়েও আমার সংশয়। আমি তাঁদেরকে চিনতে পারি না। আমি অত বড়ো কথা বুঝে উঠতে পারি না।
আমি অত্যন্ত সাধারণ। সামান্য। ছোটবেলায় মাস্টারমশাই ‘দ্য ম্যান ইউ এ্যাডমায়ার মোস্ট’-এর ওপরে রচনা লিখতে ব’লতেন। এর অর্থ তো সেই... কার জীবন তোমাকে একটা যথার্থ জীবনের পথ দেখায়, তোমাকে
বেঁচে থাকতে উদ্বুদ্ধ করে। তখন তো বড়দের উপদেশে কখনও নেতাজি, কখনও স্পার্টাকাস,
কখনও চেগুয়েভারা... এইসব নিয়ে লিখেছি। রচনা বই দেখেই টুকে টুকে লিখেছি।
মাস্টারমশাই তা-ই মুখস্ত ক’রতে ব’লেছেন। কেউ তো বলেননি, ‘তুমি তোমার মতো লেখো।’ কেউ ছোটবেলা থেকে
নানা মানুষের বিচিত্র জীবনের নানা কথা গল্পচ্ছলে আমাকে শোনাননি যে, তা থেকে মনের
মধ্যে জীবন সম্বন্ধে একটা প্রত্যয় গ’ড়ে উঠবে। তাই আমি মৃতপ্রায় মানুষ। চোখ আছে, তবু দেখিনি দেখিনি ক’রে কাল কাটাই। সব দেখতে নেই, সব ব’লতে নেই, সব জানতে নেই, সবটা ক’রতে নেই--- এমনই তো বাড়ি’র বড়দের কাছে শিখে এসেছি। আজ বুঝি, যে মানুষটাকে আমি মন থেকে সত্যি সত্যি এ্যাডমায়ার
ক’রি, যদি সত্যি তাঁর মতো কর্মকাণ্ড ক’রতে যেতাম, তো বাবা মেরে পিঠের ছাল তুলে দিতেন। ব’লতেন, ‘দেশ উদ্ধার ক’রতে যাচ্ছো! পড়ো মন দিয়ে। বেশী পাকা!’ তাই আমরা অনেকেই তো ‘এমনি এসে ভেসে যাই...’। আবার এটাও
সত্যি, যদি সত্যি সত্যি পরিবারে সকল শিশু মহাপুরুষদের পদাঙ্ক অনুসরণ ক’রে তাঁদের মতো জীবন যাপন ক’রতে শুরু ক’রে দ্যায়, তবে তো
অনাসৃষ্টি। সকলেই যদি শ্রী রামকৃষ্ণের মতো ‘মা মা!’ ক’রে জীবনটা কাটানো শুরু ক’রে, তবে সমাজ চলে
না, সংসার অসার হয়। কোনো পিতামাতা কি এমন সন্তান কামনা ক’রবেন যে চৈতন্যের মতো বিবাহ ক’রে স্ত্রী-সন্তান রেখে দিয়ে কৃষ্ণের খোঁজে অজানা’র উজানে বেরিয়ে প’ড়বে? কেউ কি এমন সন্তান গৌরবের সাথে বরন ক’রবে যে সন্তান স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের মতো পড়াশুনো না ক’রে কবিতা লিখে কাল কাটাবে?
তাহলে একটি জীবনের খোঁজে মনের দরজাটাকে খুলে রাখার উপায়টা
কী? কোন মানুষ আমার জীবনের অবলম্বন হ’তে পারেন? কোন মানুষটাকে জীবনের প্রতিটি ক্ষণে স্মরণ ক’রতে পারি, মনে মনে তাঁর শরণ নিতে পারি, তাঁকে অনুসরণ ক’রতে পারি, তাঁর অনুগামী হ’তে পারি, তাঁর মতো ক’রে জীবনটাকে
আস্বাদন ক’রতে পারি?
আমি কোন বড়ো মাপের মানুষ হতে চাইওনি বা তা হবার মতো গুণাবলী
আমার মধ্যে নেইও। এমনকি বড়ো মাপের মানুষ ব’লতে ঠিক কি বোঝায়, তা নিয়েও আমার মধ্যে যথার্থ বা সম্যক কোন ধারনা নেই। আমি
জানি না, এ সম্বন্ধে কার কতটুকু ধারনা আছে। তবে খুব স্পষ্ট ধারনা যে নেই, তা আমার
কাছে স্পষ্ট। সে গল্প না হয় অন্যদিন হবে।
আমি সামান্য মানুষ ব’লেই আমার পরিধিও সামান্য। আমি ঈশ্বর বিশ্বাসী নই। ফলে যারা জীবাত্মার সাথে
পরমাত্মা’র সম্পর্ক খুঁজতে বেরিয়ে প’ড়েছেন, তাঁদেরকে মহাপুরুষ ব’লে আমি মনে করি না। এ্যাতো ছোটমাপের মানুষ আমি যে, সমাজসেবা ক’রতে যেতেও আজকের দিনে দুঃসাহস দ্যাখাতে পারি না। পথেঘাটে,
পত্র-পত্রিকায় যে সমস্ত সংবাদ প’ড়ি, তাতে ভয় পেয়ে
যাই। আমার যদি কিছু হ’য়ে যায়, তবে বাড়ি’র মানুষগুলোর কী হবে! তারা তো আমার মুখ চেয়ে বেঁচে আছে। আমার
ওপরেই তারা নির্ভরশীল। তাই অন্যায়ের প্রতিবাদও ক’রতে পারি না। গল্প-উপন্যাসের কোন একটি চরিত্রকে নিজের জীবনবোধ লাভের জন্যে
সন্ধান থেকে প্রাপ্ত পাত্র ব’লেও ভাবতে পারি
না। ভালো লাগে শরৎচন্দ্রের জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য ক’রে দেওয়া চরিত্র সব্যসাচীকে, ভালো লাগে রবি ঠাকুরের জমিদার
হ’য়েও মনের মধ্যে পুষে রাখা একটা দেশাত্মবোধ
সম্পন্ন নিখিলেশ’কে, অথবা ভালো
লাগে গোরা’কে। কিন্তু তা তো কাহিনি’র এক একটি কল্পিত চরিত্র মাত্র। অমনটা হ’লে কেমন হ’তো!--- এইটুকু
বোঝাতেই তো ঐ চরিত্রের সৃষ্টি। বাস্তবে তো তারা নেই। আমরা সকলে ঝাঁকের কৈ, ঝাঁকে
মিশে যাচ্ছি। বেঁচে আছি। সুনীল গাঙ্গুলি’র কবিতা’র নিখিলেশের
বন্ধুটির মতো বেঁচে আছি, যে শেষ পুরোহিতের সাথে কঙ্কালের পাশাখেলা দেখতে দেখতে
জীবন কাটায়।
তবু আমাকেও একটি মানুষ খুঁজতে হয়, তার জীবনী শক্তি
প্রত্যক্ষ করার কথা ভাবতে হয়। জীবন যন্ত্রণা আমাকে মাঝে মাঝে এমন একটা উপলব্ধিতে
পৌঁছে দ্যায়, যখন মনে হয় জীবন যেন আমাকে একটা ময়াল সাপের মতো বেষ্টন ক’রে নিয়ে চেপে মেরে ফেলতে চাইছে। মৃত্যু জীবনানন্দের কবিতা’র একটা উটের গ্রীবা ধারণ ক’রে আমার জানলা দিয়ে উঁকি মেরে ব’লে যায়, ‘চল্, ম’রে যাই। এটা কি মানুষ জন্ম! তুই কি এমন জীবন চেয়েছিলি?’
তখন একটি গল্পের সেই মানুষটির কথা মনে পড়ে, যে তার জীবনে যা
কিছু ঘটে, তারই মঙ্গলময় দিক দেখতে পায়। তার বন্ধুরা তার এই আশাবাদী মানসিকতায়
বিরক্ত। একদিন তার একটি দুর্ঘটনা ঘটে আর তাতে তার একটি পা বাদ যায়। তার বন্ধুরা
মনে করে, এবার সে আর এই ঘটনা’র কোন মঙ্গলময় দিক
দেখতে পাবে না। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। সে তার বন্ধুদের বলে, ‘ভালো কি হ’ল। জানো? আমাকে আর
দুটি জুতো কিনতে হবে না। একটি কিনলেই হবে। খরচ বেঁচে গেলো।’ অর্থাৎ মৃত্যুর গহ্বরে ঢুকে জীবন’কে খোঁজা।
এই কাহিনি আমাকে যে মানুষ’টার কথা স্মরণ করিয়ে দ্যায়, যার জীবন আমাকে আন্দোলিত করে, আমাকে আলোড়িত করে,
আমাকে বিস্মিত করে, আমাকে আবার বাঁচতে বলে, তাঁর কথা ব’লতে গেলে তাঁর জীবন সম্বন্ধে মানুষকে সামান্য পরিচয় দিতেই
হয়। অবশ্যই আমি জানি, হিমালয়’কে ‘সুদৃশ’, এভারেস্ট’কে ‘সর্বোচ্চ শৃঙ্গ’ আমি না ব’ললেও সে তাই র’য়ে যাবে। আমার প্রশস্তি হিমালয়ের ভালোমন্দ নির্ধারণ করে না।
তবু মানুষ তো প্রশস্তি বাক্য ব্যবহার করে। অনেকটা গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো করে। আমিও
তাই ক’রবো। আমি এ প্রসঙ্গে তাঁর পরিবর্তে ‘হেলেন কেলার’এর নাম উচ্চারণ ক’রতে পারতাম, যিনি তিন তিনটি কর্মেন্দ্রিয় থেকে বঞ্চিত হওয়ায়
মানুষের যে অনন্য নিজস্বতা “মন”, তা অধিগত করা থেকেও বঞ্চিত ছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে
শিক্ষিকা মিস্ সুলিভানের সাহচর্যে তিনি একদিন একজন লেখিকায় পর্যবসিত হ’য়েছিলেন। লিখেছিলেন আত্মজীবনী। তিনি এক বিস্ময় বালিকা। কঠিন
জীবনীশক্তি দিয়ে প্রতিকূলতার সাথে যে সংগ্রাম তিনি ক’রেছেন, তা মানুষকে জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ ক’রতে যথেষ্ট। কিন্তু আমার দেশেও এমনতর মানুষ থাকতে আমার
বিদেশে যাবার কোনো প্রয়োজন ঘটেনি। আমি এ প্রসঙ্গে লেখিকা বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত
হোসেনের নাম ক’রতে পারতাম, যিনি
নানা প্রতিকূলতা’র মধ্যে মুসলিম
সমাজের তৎকালীন শরীয়তী বাধাবিঘ্ন ঠেলে, নারী অবরোধ থেকে নিজেকে মুক্ত ক’রে একজন প্রনম্য মানুষে নিজেকে উন্নীত ক’রেছিলেন। মানুষের জীবনে তাঁকে আদর্শ ক’রে গণ্য করা কোনো অপ্রত্যাশিত বিষয় নয়, বা আতিশয্য নয়। তবে
তিনি একজন পুরুষের আদর্শ মানুষ হিসেবে গণ্য হওয়া থেকে একজন নারী’র জীবনীশক্তি হিসেবে অনেক বেশী মূল্য পেতে পারেন। আমাদের
সমাজে যখন নারীরা ‘এটা পাচ্ছি না,
ওটা পাচ্ছি না’ ব’লে কেঁদে বেড়াচ্ছে, স্বাধীনতা অন্যের দয়ায় পাবার জন্যে
পুরুষকে ও সমাজ ব্যবস্থা’কে অভিযুক্ত ক’রছে, তখন বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত অন্তত তাদেরকে দেখিয়ে দিলেন,
অন্যকে অভিযুক্ত না ক’রে নিজে ‘হ’য়ে ওঠা’র মধ্য দিয়ে নিজেকে নারী থেকে রানী ক’রে তুলতে হবে।
তখন আমাকে উদ্বুদ্ধ করে এক নারী। তিনি কোন সামাজসেবিকা নন্,
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন্, কোন মহাপুরুষ নন্, নন্ কোন মহামানবী। তিনি একজন
শিল্পী। নৃত্যশিল্পী। হয়তো আজকের “শো-কেসের সভ্যতায়” তাঁকে নৃত্যশিল্পী হিসেবে মানুষের মনে নেই। আজ তাঁকে মানুষ
চেনে হিন্দি সিরিয়ালের ও চলচ্চিত্রের একজন অভিনেত্রী হিসেবে। কিন্তু তিনিই সেই
শিল্পী যাঁর জীবদ্দশাতেই তিনি একজন প্রনম্য সেলিব্রিটি শুধু নন্, তার ওপরে
নির্মিত হ’য়েছে দু-দুটি চলচিত্র। এ দেশের দুটি
ভাষায় প্রকাশিত সেই চলচিত্র মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছে।
আমি সুদূর দক্ষিণ ভারতের “সুধা চন্দ্রন”-এর কথা ব’লছি। আমি এক তামিল পরিবারের সেই কালো সুন্দরী মেয়েটির কথা ব’লছি, যিনি শুধু অর্থনীতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষিতা’র খেতাবই অর্জন করেননি। মাত্র সতেরো বছর বয়সেই পচাত্তর’টি মঞ্চে তাঁর নৃত্য প্রদর্শন ক’রে মানুষের নৃত্য পিপাসা’কে মুগ্ধ ক’রেছিলেন এবং “ড্যান্স এ্যাকাডেমি এ্যান্ড ভারতনাট্যম” থেকে “নৃত্য ময়ূরী” ছাড়াও “তেলেগু এ্যাকাডেমি” থেকে “নভজ্যোতি” পুরস্কারে সম্মানিত হ’য়েছিলেন।
এসব তো একটি শিল্পী’র জীবনে সাধারণ ঘটনা’র ইতিহাস। এমন
ইতিহাসের তো ছড়াছড়ি এই বাঙ্গলায়। তবে একটি তেলেগু নারী কেন আমাকে আলোড়িত করে! আর
কি কোন মানুষ ছিলো না এই পোড়া বাংলায়! আমি কি একজন নৃত্যশিল্পী যে অপর নৃত্যশিল্পী
থেকে জীবনীশক্তি লাভ ক’রে উদ্বুদ্ধ? না,
তাহলে তো এটি হ’তো একটি সামান্য
ঘটনা বা সাধারণ বিষয়। সুধা’র জীবন সাধারণভাবে
কাটেনি। তাঁর ভাগ্যই বলা যাক, বা নিয়তি অথবা তাঁর জীবনের অনুষঙ্গ অন্যান্য ঘটনা
--- কেউই তাঁকে মঞ্চে স্বাধীনভাবে নৃত্যানুষ্ঠান ক’রতে দেয়নি।
শিল্পী’র জীবনে যে সমস্ত উত্থান-পতন
থাকে, তা স্বাভাবিক। তাঁকে নানা প্রতিকূলতা’র মধ্য দিয়েই টিকে থাকতে হয়, উন্নীত হ’তে হয়। সেটাই তাঁর পরিচয়কে আরো উদ্ভাসিত করে। কিন্তু যদি একজন অভিনেত্রী’র বাকশক্তি কোন দুর্ঘটনায় বিনষ্ট হয়, তবে তো তাঁর
শিল্পসত্তা সেখানেই ইতি টেনে দিতে বাধ্য হয়। ঠিক তেমনই যখন সুধা’র মাত্র সতেরো বছর বয়স, ঠিক যখনই তাঁর খ্যাতি বিচ্ছুরিত হ’চ্ছে, তখনই একটি দুর্ঘটনা তাঁকে একেবারে অস্তিত্বের
প্রান্তসীমায় এনে দাঁড় ক’রিয়ে দ্যায়।
তামিলনাড়ু’র একটি মন্দির দর্শনে যাত্রাকালে একটি
বাস দুর্ঘটনা তাঁর ডান পা’টিকে বিপজ্জনকভাবে
আহত করে। পা-ই যার শিল্পের তুলি-ক্যানভাস, তাকেই পঙ্গু হ’তে হয়। চিকিৎসকেরা যে ভাবে আজো তাঁদের কাছে বাঁচা’র জন্যে ছুটে আসা কোন অক্ষমকে আরো অক্ষম ক’রে দ্যায় তাঁদের অজ্ঞানতা আর অপটুতা দিয়ে, ঠিক তেমনই সুধা’র চিকিৎসকটি সামান্য একটি ভুল করার কারণে সুধা’র সেই আহত পা’কে কুখ্যাত রোগ গ্যাংগ্রিন পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। একটি নৃত্যশিল্পী’র পা-এর চিকিৎসা ক’রতে গিয়ে যেটুকু সতর্কতা তার নেওয়া উচিত ছিল, যাকে মানবতা দিয়ে নয়,
পেশাদারিত্ব দিয়ে বিচার ক’রতে হয়, সেটুকু
দায়িত্বজ্ঞান এ পোড়া দেশের চিকিৎসকদের হয়নি ব’লেই তার মাশুল গুনতে হ’ল একটি উদীয়মান
শিল্পী’কে। ফলে যা হবার তা হয়। হাঁটুর নীচ থেকে
একটি সম্ভবনাময় নৃত্য শিল্পী’র পা কেটে ফেলতে
হয়। তখন তাঁর সামনে ঠেলে দেওয়া হয় একটি অভিশপ্ত হুইল চেয়ার যার ওপরে ব’সেই সুধা চন্দ্রন-এর মতো একজন শিল্পী’কে চিরকালের জন্যে হ্যান্ডিক্যাপ্ড বা অপাহিজ অথবা প্রতিবন্ধী
বিশেষণে বিশেষায়িত হবার জন্যে প্রস্তুতি নিতে হয়।
কিন্তু মানুষ তো দেবতা’র ঊর্ধ্বে যে বুদ্ধ, তারও ঊর্ধ্বস্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে, সে তা-ই ক’রে এসেছে। দেবতা বা বুদ্ধ উভয়েরই কর্ম বা কর্মক্ষমতা’র একটি ঊর্ধ্বসীমা আছে। একটা লিমিট আছে। কিন্তু মানুষ
যেহেতু ‘লিমিট’ ব’লে
কিছু জানে না, সেহেতু অসম্ভবকে সম্ভব করা, অবাস্তবকে বাস্তব করাই তার জীবন,
তার জীবনীশক্তি। তারই কারণে সে একদিন সুধাসাগরের তীরে এসে নিজেকে দাঁড় করায়। হয়তো
এই শক্তিতেই সত্যি সে একদিন সুপারম্যানের মতো একটি অতিকাল্পনিক সত্তাকেও অধিগত ক’রবে। হয়তই একদিন সত্যি সত্যি হ্যারি পটার বাস্তবে দেখা
যাবে। ম্যাজিক ব’লে তাঁর কাছে
কিছুই থাকবে না। তার উইল পাওয়ার তাকে কোথায় যে নিয়ে যাবে, তা সে নিজেই জানে না। জানতে
সে চায়ও না। সে শুধু ক’রতে চায়, হ’য়ে উঠতে চায়। এই হ’য়ে ওঠার জন্যে তার সামনে পড়ে আছে অনন্ত আকাশের থেকেও বড়ো এক অনন্ততর
ব্রহ্মাণ্ড। তা সে জয় ক’রতে চায়।
সুধাও জানতেন না, তিনি এই অভিশপ্ত জীবন থেকে নিজেকে মুক্ত ক’রে আবার মঞ্চে তাঁর শৈল্পিক পাদচারণা (পদচারনা) প্রদর্শন ক’রতে পারবেন। কিন্তু তাঁর অপরাজেয় মন প’ড়ে ছিল মঞ্চের দিকে যেখানে তাঁর পায়ে আবার বাধা হবে
ঘুঙ্গুর, আবার মৃদঙ্গ বাজবে, আবার তাল তরঙ্গ তাকে সুধাসাগর তীরে এনে দাঁড় করিয়ে
দেবে। মাত্র ছ-মাস পরে সুধা একটি পত্রিকায় চিকিৎসক শেঠি’র কথা পড়েন যিনি কৃত্রিম মনুষ্য অঙ্গ প্রতিস্থাপনে বিশেষজ্ঞ।
সুধা জানতে পারেন যে, জয়পুরের এই চিকিৎসক “রামন ম্যাগসেসাই” পুরস্কারে ভূষিত
এক প্রতিভা। সাথে সাথে তিনি তাঁকে চিঠিতে যোগাযোগ করেন। ইতিমধ্যে তাঁরা একদিন
মুম্বাইতে অপেরা হাউসে একটি কোম্পানী’র প্রদর্শনী’তে কৃত্রিম জয়পুর
ফুট প্রত্যক্ষও করেন। আবার সুধা’র মধ্যে নৃত্যের
স্বপ্ন নতুন ক’রে প্রাণ সঞ্চার
করে। ডাক্তার শেঠি সুধা’র পায়ে একটি
কৃত্রিম পা জুড়ে দেন। কিন্তু সেকালে কৃত্রিম পা কথাটির অর্থ একটি জীবন্ত যন্ত্রণা।
সেই পা ছিল কাঠ দিয়ে তৈরি। ফলে সেই পা সংযুক্ত ক’রে হাঁটাহাঁটি করাটাই একটা বিড়ম্বনা ছিল। কিন্তু সুধা সেই পা সঙ্গুক্ত ক’রে শুরু ক’রলেন নৃত্য
অনুশীলন। ফলে যা হবার তা-ই হ”লো। রক্তাক্ত হ’লেন তিনি। যন্ত্রণায় তাঁর সারা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো
অনুশীলনের সাথে সাথে। অনুশীলনের মেঝে তাঁর পায়ের রক্তে ভেসে যেতে লাগলো। কিন্তু
গল্পের কোন এক নায়িকা’র মতো, স্বপ্নের
কোন পরী’র’ মতো নৃত্যচর্চা অবিচল রেখেছেন সুধা। যন্ত্রণা তাঁকে পরাজিত ক’রতে পারেনি। ভাগ্যের সাথে যুদ্ধে সপ্তদশী সুধা ম’রে যেতেও রাজি।। হুইল চেয়ারকে বরন ক’রে নেবার জন্যে, মানুষের সমবেদনাকে সহন ক’রে নেবার জন্যে তিনি মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। ডাক্তার শেঠি
তাঁর পেশেন্ট-এর পায়ের কোথায় কোথায় রক্তপাত ঘ’টছে প্রত্যক্ষ ক’রে সেখানে সেখানে
সামান্য সামান্য পরিবর্তনও ক’রে দেন। ফলে তাঁর অনুশীলন
সামান্য সুবিধাজনক হয়। যন্ত্রণা থেকে পেরে-ওঠার আনন্দ সুধা’কে অনেক বেশী সাহস আর শক্তি যোগায়। একদিন তিনি অসম্ভবের
এভারেস্ট জয় ক’রে ফেলেন। মাত্র
তিনটি বছর পরেই তিনি আবার মঞ্চে অবতীর্ণা। নৃত্যানুষ্ঠান ছিল মুম্বাই’এর একটি মঞ্চে। আয়োজক ছিলেন “সাউথ ইন্ডিয়া ওয়েলফেয়ার সোসাইটি”। তিনি প্রীতি নামে অপর একটি নৃত্যশিল্পী’কে সাথে নিয়ে তাঁর পায়ের ইন্দ্রজাল আবার মানুষের সামনে তুলে ধরেন।। প্রমান
করেন, স্বপ্ন দেখতে জানতে হয়, বাঁচতে জানতে হয়। “হাল ছেড়ো না, বন্ধু, শুধু কণ্ঠ ছাড়ো জোরে...”--- এটাই যেন সুধা চন্দ্রনের জীবনের মন্ত্র হ’য়ে গিয়েছিলো যখন এই সঙ্গীত আদৌ রচিতই হয়নি। কিন্তু এটি আছে কোন কোন মানুষের
মনের একেবারে গহিনে, গভীরে। “ইচ্ছে, সেই তো
দিচ্ছে, নিচ্ছে...” লিখেছিলেন
রবীন্দ্রনাথ। এই তো সেই ইচ্ছে। এর নাম ইচ্ছেশক্তি, উইল পাওয়ার।
আমার জানা নেই, আর কোন পৃথিবীতে মানুষ আছেন কিনা, যার
জীবদ্দশাতেই তাঁর জীবনকে কেন্দ্র ক’রে রচিত হ’য়েছে দু- দুটি চলচিত্র--- “ময়ূরী”, দুই “নাচে ময়ূরী”। এরপর তাঁকে আর
পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এ দেশ ও বিদেশ থেকে নানা অনুষ্ঠানে তিনি নিমন্ত্রিত হ’য়েছেন নৃত্যের জন্যে। পেয়েছেন একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক
পুরস্কার। এ তাঁর যুদ্ধ জয়ের আত্মপ্রকাশ মাত্র। তিনি আজ আর নৃত্যানুষ্ঠান করেন না
বটে, তবে একটি নৃত্যের প্রশিক্ষা কেন্দ্র চালান। আজও তিনি একটি জীবিত লিজেন্ড।
মানুষের রনক্লান্ত জীবনে জীবনী শক্তি দিতে এক বিপুল ভূমিকা গ্রহণ ক’রতে পারেন।
আমার জীবনে আমি যখন কোন বড়ো সমস্যায় থাকি না, তখন একজন পেটি
মধ্যবিত্যের মত ছোট ছোট সমস্যাকে বড্ড বড়ো ক’রে দেখতে শুরু করি। তারা আমার জীবনকে ক্লান্ত করে। তখন এই সুধা চন্দ্রনের যে
পূর্ণদেহী প্রতিকৃতি-টি আমার শয়ন কক্ষের একটি দেয়ালে টাঙ্গানো, তার সামনে গিয়ে
দাঁড়াই। মনে মনে সেই নারীটির যন্ত্রণা, ব্যথা, রক্তপাত স্মরণ করি। দেখি, আমার
জীবনের ছোট ছোট নয়, বড়ো বড়ো সমস্যাগুলোও ক্রমে ছোট ছোট হ’য়ে যাচ্ছে। গুঁড়ো গুঁড়ো হ’য়ে আমার পায়ের কাছে ছড়িয়ে প’ড়ছে। আমার বাড়িতে
কোন নবাগত এলে আমাকে প্রশ্ন করে,
--- দাদা, আপনি নাটক রচনা, নাট্যাভিনয় ছেড়ে সাহিত্য রচনায়
মনোনিবেশ ক’রেছেন। এবার কি নৃত্য শিক্ষা করবেন?
আমি কী ক’রে বোঝাবো, আমি যে এঁকে আমার আইকন মানি, আইডল হিসেবে মানি। এই মেয়েটি, যে আমার
থেকে অন্তত বছর পনেরো’র ছোট, সে আমাকে
আলোড়িত করে, আন্দোলিত করে। আমি যখনই জীবনটাকে দুর্বিষহ মনে ক’রতে যাই, নিজেকে নানা সমস্যায় জর্জরিত মনে ক’রি, সমস্যা’র সমাধান ক’রতে না পেরে পালিয়ে যেতে চাই, একটি মদ্যপায়ীকে মদ খাবার
কারণ প্রশ্ন ক’রলে যেমন ক’রে সে উত্তর দ্যায়, ‘অনেক দুঃখে খেয়েছি দাদা’, তেমনি সমস্যা
থেকে গা-ঢাকা দেবার কোন একটি অজুহাত আমিও খুঁজি, তখন হাস্যমুখে এই সুধা আমার জীবনে
বেঁচে থাকবার, ল’ড়ে যাবার, হার না
মানা’র বানী ব’য়ে নিয়ে আসে। তখন আমি মনে মনে ব’লতে বাধ্য হই--- --- ‘অন্তরগ্লানি,
সংশয়ভার পলক ফেলিতে কোথা একাকার / জীবনের মাঝে স্বরূপ তোমার রাখিবারে যদি পাই।‘
---------------------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন