বুধবার, ২১ মার্চ, ২০১২

'অন্ত্যেষ্টি' ছোটোগল্প


অন্ত্যেষ্টি
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়

ক্লান্ত অবসন্ন পায়ে অনীশ চাবি ঢুকিয়ে তালা খুলে দরজা ঠেলে খুললেন। পেছনে পেছনে এসেছে সুশান্ত ভদ্র, দীপ্তেন্দু স্যান্যাল, নীলাদ্রি সেনগুপ্ত আর বরুণকান্তি গাঙ্গুলী। অনীশ খাটে এসে বসলেন চুপ করে। চুপ করে চেয়ে রইলেন নিজেরই পায়ের দিকে। অন্যতম বন্ধু দীপ্তেন্দু পরামর্শ দিলেন,
--- অনীশ, এক পেগ নেবে? শরীরটা ঠিক হয়ে যাবে। আজ সাতটা দিন, বুশেশ করে তো আজ সকাল থেকে যা ধকল গেছে।
--- হ্যাঁ। বয়স তো, হলো ভাই। দীপ্তেন্দু খারাপ বলেনি। বোঝাতে চাইলেন বরুণকান্তি।
--- না, ভাই। কিছু মনে করো না। আমার শরীরটা ভালো নেই। একেবারে মিনমিন করে বললেন অনীশ।
--- তাহলে ডক্টরকে একটা কল দিই। আমরা চলে গেলে তো তুমি একা হয়ে পড়বে। কী বলো?
দীপ্তেন্দু বলেন--- না না, ভাই। এ্যাতো খারাপ কিছু নয় যে, ডক্তরকে কল দিতে হবে। ঠিক আছি।। আমার আসলে একটু বিশ্রাম চাই।
অনীশের কথা শুনে নীলাদ্রি সেনগুপ্ত বললেন--- রাইট, বরুণ। রাইট। শুধু শারীরিক ধকল কেন ভাবছো? হি নিড্‌স সাম আইসোলেশন। তারপর আবার অনীশকে বললেন--- তাহলে ফুলের তোড়াগুলো কোথায় রাখি, বলো তো? বৌদি-ই তো গোটা-টা দেখতেন। কোথায় কী যে রাখতেন, তা তো দেখে রাখিনি। আর এই রইলো তোমার মেমেন্টো। এই মানপত্র। আর এই যে তোমার চেক-টা। এরা কেন যে বিয়ারিং চেক দ্যায়, কে জানে! ক্রস করে দিলেই তো হয়।
সুশান্ত বললেন--- ওকে দেখিয়ে রেখো কিন্তু।
--- কেন? তা নয়তো আমরা মেরে দিয়েছি, ভাববে?
--- আরে না না। অনীশ যা ভুলো! বাড়িতে কোথায় কী আছে, ও জানে নাকি?
নীলাদ্রি বিছানার ম্যাট্রেসের নীচে চেকটাকে চালান করে দিলেন। দেখিয়ে দিয়ে বললেন--- তাহলে চলি? চলো হে। ওকে একটু ঘুমোতে দাও।
অবশেষে চার প্রৌঢ় বেরিয়ে গেলেন অনীশ বাগচির বাড়ি থেকে। তাঁদের দুটি গাড়ি বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। তাতে এবার স্টার্ট পড়লো। অনীশ বাগচি তাঁর নিজের গাড়ি নিজেই গ্যারাজে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এখন বাড়িতে তিনি একা। আর আশে পাশে হয়তো বিচরণ করে বেড়াচ্ছেন তাঁর স্ত্রীর আত্মা। পাড়া-প্রতিবেশীরা যে যার জানলা দিয়ে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে, কেউ কেউ বাইরে এসে পর্‌যন্ত তাকিয়ে ছিলো অনীশ বাগচির বাড়ির দিকে। যেহেতু তিনি সেলিব্রিটি মানুষ, সেহেতু পাড়ার মানুষদের সাথে তাঁর তেমন কোন দহরম-মহরম নেই। একটা দূরত্ব রেখে তিনি বরাবর চলেছেন। তারাও কেউ সাহস করে না এগোতে। তবে সুলগ্না সবার সুখে দুঃখে প্রতিবেশীদের সাথেই ছিলো। অনেকবার অনীশ বুঝিয়েছেন,
--- সবার সঙ্গে এতোটা ঘেঁষে পড়া তাঁর নিজের পক্ষে অসুবিধেজনক। নানা মানুষ নানা সুবিধে নিতে চায়।
সত্যিই তো। সুলগ্নার জন্যেই পাড়াতে একটা ফালতু অনুষ্ঠানে অনীশকে সভাপতির আসন অলংকৃত করতে হয়েছিলো একবার। বাড়ির অশান্তি তো বাইরে এনে ফেলা ঠিক নয়। তাই সুলগ্নাকে একটা ওকওয়ার্ড সিচুয়েশনে ফেলতে চাননি তিনি। কিন্তু সুলগ্না যেমন তার প্রতিবাদ করেনি, তেমনি শোনেওনি। নীরবে নিজের পথেই চলেছে। তবে কারোর বাড়িতে বসে মেয়েলি বাক-চটুলতা তার ছিল না, ছিলো না মশলাদার গার্হস্থ গোপন সংবাদ আদান-প্রদানের অভ্যেস। পূজার্চনা আর রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা ছিলো তার জীবন। পঙ্কজ কুমার মল্লিক, কে.এল. সায়গল, কনক দাস, কানন দেবী ইত্যাদি প্রাচীন নানা দুর্লভ সব গায়ক-গায়িকার ডিস্ক কালেকশন ছিল তার। অবিবাহিত কাল থেকেই তার এই নেশা। বাপের বাড়ি থেকেই এসব এখানে এনেছিল সে। অনীশ কখনও কখনও বলতেন,
--- কী যে শোনো প্যাঁ প্যাঁ করে সায়গল সাহেবের গান, কে জানে! জর্জ বিশ্বাস শোনো। শুধু জর্জ বিশ্বাস।
হাসতো সুলগ্না। বলতো না কিছু। কাউকে যেন কিছু বলার দরকার নেই তার। নিজের কাজ নিজে নিখুঁতভাবে করে যাওয়াতেই তার আনন্দ ছিল। কারোর কাজে হস্তক্ষেপ নেই, সমালোচনা নেই, কারোর ওপরে ক্রোধ নেই, এমনকি পৃথিবীতে কেউ যেন কোন অন্যায়ই করছে না। রাজনীতি, সিস্টেম, পরিবার কিম্বা মানুষ--- সবই যেন ঠিকঠাক আপন পথে চলছে। কোন নালিশ নেই তার। কী একটা অদ্ভুত ধাতুতে তৈরি এই মহিলা, দাম্পত্য জীবন যাপন করেও বোঝেননি অনীশ বাগচি। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, প্রাণ আছে তো এই দেহে! এতো নিরালম্ব কেন? জীবনের তো একটা চাহিদা থাকে। তা-ও যেন নেই তার। যেন কোন ধারালো অস্ত্র দিয়ে ওকে কেটে ক্ষত-বিক্ষত করে দিলেও নীরবে নিভৃতে বসে নিজের শরীর থেকে রক্ত মুছতে পারে সুলগ্না। নিজের বেদনা, আনন্দ, হতাশা কোন কিছুই যেন কারোর সাথে ভাগ করে নেবার কোন দায় বা প্রয়োজন তার নেই। মাঝে মাঝে অনীশের মনে হতো, দুরন্ত স্পর্ধা মহিলার। একটা ধৃষ্টতা যেন সুলগ্নার মনের গভীরে বসানো। একটা তাচ্ছিল্যের বলয় যেন ওর চারপাশে ঘুরত। অথচ সে নিজে নির্‌বাক, নিস্পন্দ আর নিরুত্তাপ। অনীশের রাগ হতো প্রচণ্ড। ইচ্ছে হতো, ভীষণভাবে একটা অসম্মান করে দ্যায় ওকে। কিন্তু অনীশ পারেনি কখনও। নিজেকে এতটাই বিনীত, নম্র আর শান্ত রাখত সুলগ্না যে, এটা অনীশকে করতেই হতো না।
এভাবেই এক প্রাচীনা নিরুত্তাপিনীর সাথে পঁচিশটা বছর দাম্পত্য জীবন কাটিয়েছেন অনীশ। সত্যিই কি একে দাম্পত্য বলা যায়! সামাজিক মতে বিবাহ হলে, যৌনতায় সন্তান হলেই কি একটি নারী আর পুরুষ দম্পতি? এই একটা প্রশ্ন থেকে মুক্তি পেতেন না সাহিত্যিক অনীশ বাগচি। সুলগ্নার এইভাবে চলে যাওয়াকে মেনে নিতে না পেরে প্রতিবেশীরা কেউ এতো ঘটনার পরেও বাগচি বাড়ীতে আসেনি। ভালোতেও না, মন্দতেও না। এমনকি পাশের বাড়ির বাচ্চা মেয়েটা পুট্‌টুস পর্যন্ত একবারের জন্যে আসেনি এ বাড়িতে। সুলগ্না থাকতে এ বাড়িতে না আসতে পারলে বাচ্চাটার পেটের ভাত হজম হতো না। যাবতীয় বায়নাক্কা ছিল ওর সুলগ্নাকে ঘিরে। ফলে কেমন যেন একটা প্রতিবেশীদের তাচ্ছিল্যও হজম করেছেন। তিনি যে একজন প্রথিতযশা সাহিত্যিক এবং আজই সাহিত্য এ্যাকাডেমি পুরস্কার নিয়ে বাড়িতে ঢুকেছেন, তা যেন গোটা পাড়ার মানুষ জানে না। কাগজে অনীশ বাগচির নাম ছাপা হয়েছে, টেলিভিশনে দেখিয়েছে, তা যেন কারোর চোখেই পড়েনি। কেউ যেন দেখতেই চায়নি। কারোর যেন সে বিষয়ে কোন উৎসাহ নেই। কোনোদিন অনীশ বাগচি প্রতিবেশির অভিনন্দন প্রত্যাশা করেননি। এর আগেই তিনি নানা ছোট বড়ো বহুবিধ পুরস্কার পেয়েছেন। পাড়াতেও একসময় পেয়েছেন সাহিত্য সম্বর্ধনা। ঘরের দেওয়ালে বহু মানপত্র আর সুলগ্নার উদ্যোগে গড়া শেল্ফে রয়েছে নানা ধরনের মেমেন্টো। কিন্তু আজ যেন সেগুলো একা, নিঃসঙ্গ আর নিষ্প্রাণ।
-------------------

(২)

যখন ক্লাশ সেভ্‌নে পড়ে বালক অনীশ, তখন থেকেই তার গল্প লেখার একটা নেশা ছিলো। প্রথম দিকটাতে স্কুলের বাৎসরিক ম্যাগাজিন, পরে পাড়ার দুর্গাপুজোয় বেরোনো পত্রিকা, শেষে স্কুলগণ্ডি পার করে একটা-দুটো লিট্‌ল ম্যাগ। অঞ্চলের একটা পত্রিকা, তারপরে একে একে নিজের জেলা থেকে বেরিয়ে অন্য জেলায় তার লেখা যাচ্ছিলো। একটু একটু করে নাম হচ্ছিলো তার। অনীশ থেকে অনীশ বাগচি হয়ে উঠছিল সে। প্রথম দিকটাতে সকলে এটাকে কাঁচা বয়সের একটা খেলা হিসেবে ধরে নিয়েছিলো। উৎসাহ আর উদ্দীপনাও যুগিয়েছিলো। কিন্তু যখন শিক্ষাগত যোগ্যতার বইপত্র পড়ার তুলনায় তাকে অধিক দেখা গেলো লেখার নানা রসদ সংগ্রহের জন্যে ভিন্ন ভিন্ন বই পড়তে এবং পরীক্ষার ফল ক্রমে নিম্নমুখী হতে শুরু করলো, তখন বাড়ির অভিভাবকদের মন্তব্য ক্রমেই বকাবকি থেকে তিরস্কারে পর্যবসিত হতে থাকলো। কিন্তু ততদিনে লিট্‌ল ম্যাগাজিন দুনিয়ায় পাঠক সমাজের মধ্যে অনীশ বাগচির নাম বেশ একটা ক্রেজে পরিণত হয়েছে।
অনীশ-এর এই মেঘ-বৃষ্টি-আলোময় ভাবনার মধ্যে হঠাৎই একদিন একটি মেয়ে তার জীবনে এলো। তখন অনীশ এগারো ক্লাশ, আর মেয়েটি দশ। মেয়েটির নাম ছিল অনন্যা। বেশ চলছিলো, গড়ের মাঠ, আউটরামঘাট, ভিক্টোরিয়া, লাইটউস থেকে শুরু করে আমিনিয়া। কিন্তু এই মেয়েটিকেই একদিন অনীশ প্রত্যাখ্যান করে বসে। ব্যাপারটা ঘটেছিল এরকম।
চিনে বাদাম খেতে খেতে একদিন অনন্যা অনীশকে বলেছিলো--- অনীশ দা, তোমার পরীক্ষার রেজাল্ট কিন্তু ডিটোরিয়েট করছে। এবার ফেল করবে?
--- হ্যাঁ। তো কী? অনীশ সোজা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে।
--- বাঃ! ফিউচার-টা ভাবতে হবে না!
--- ভাবো। তোমার ফিউচার-টা ভাবো। আমারটা কেন? তাছাড়া শিল্পীরা তথাকথিত ফিউচার ভাবে না। তাঁদের কাছে ফিউচার বলতে কমনম্যান যা বোঝে, তা নাই হতে পারে। এটা তোমার সিঁড়িভাঙ্গা সরল ছন্দে চলা অঙ্ক নয়, অনন্যা। মনে রেখো, তুমি একজন সাহিত্যিকের গার্লফ্রেন্ড।
অনন্যা এর যে উত্তর দিয়েছিলো, সেটা ওঁদের সম্পর্কের পক্ষে ভালো যে হবে না, সেটা ও বোঝেনি। অনন্যা বলেছে--- হ্যা! সাহিত্যিক না ছাই! ছ-পাতার লিট্‌ল ম্যাগাজিনে তো টিঙ্কু টিঙ্কু গল্প লেখো। তার না আছে মাথা, না আছে মুণ্ডু। তার আবার সাহিত্যিক!
কথাটা হয়তো অনন্যা খেলাচ্ছলেই বলেছিলো। কিন্তু শিল্পীকে শালা বা শুয়োর--- যাই বলো না কেন, কিছু এসে যায় না। কিন্তু তার লেখাকে তোমায় মেপে চলতে হবে। সেখানে পানের থেকে চুন খসলে বিস্ফোরণ। এটা বোঝেনি  অনন্যা। ব্যস্‌। একদিনেই অনন্যার প্রেম চড়ুইপাখি হয়ে গেছে। কবে কোথায় ফুড়ুৎ! সেদিন অনীশের কেরিয়ার নিয়ে বা নিজের ফিউচার--- যাই হোক, সেদিন অনীশ একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল অনন্যাকে। একটা গল্প সেইখানে মাঠে বসে লিখে ফেলে অনন্যার সামনে পাঠিয়েছিল এক নম্বর সারিতে থাকা একটি সাহিত্য পত্রিকা-কে। গল্প-টার নাম ছিল স্বপ্নের ভোর। বলেছিলো,
--- এই গল্পটা তোমার সামনে বসে লিখলাম। তোমার সামনেই ডাকে পাঠাচ্ছি। এটা যদি নেক্সট সংখ্যায় ছাপা না হয়, তবে তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে এসব ছেড়ে দেবো। আর মনে রেখো, যদি এই লেখা প্রকাশ পায়, তবে আমাকে ভুলে যেয়ো।
অনীশকে ভুলে যেতে হয়েছিলো অনন্যার। লেখাটা পাঠাবার দু-মাস পরেই অনীশের লেখা ছাপা হয়। এমন অভাবনীয় সাফল্যের ননী অনীশ বাগচি এতোটাই খেয়ে ফেলে যে, সে মেয়েটাকে হিট অব দ্য মোমেন্টে বলা কথা রেখে সত্যিই প্রত্যাখ্যান করেই বসে। অনন্যা ফিরে গিয়েছিলো। কিন্তু অনীশ যে ভুল করেছে, এটা ও বুঝতে পারে পরে। এ অধ্যায় ভুলতে চাইলেও অনীশ বহুকাল এটা ভুলতে পারে না। জীবনের প্রথম প্রেম, প্রথম অনুভূতি, প্রথম একজন নারীর হাত ধরা, প্রথম ওষ্ঠাধরের স্পর্শ বলে কথা। ফলে একটা হতাশা আসতে থাকে ওর মধ্যে। লেখার রসদগুলো যেন হারাতে থাকে ওর মন থেকে। লেখাপত্র ওর কাছে একে একে অর্থহীন মনে হতে থেকে। ধীরে ধীরে লেখার জগত থেকে ছিটকে যায় ও। গালে এলোমেলো দাড়ি ওঠে, নাকের তলায় অবাঞ্ছিত রোম। বন্ধু সমাজ ওকে দেবদাস নামে পর্যন্ত ডাকাডাকি করে শুরু করে। ক্রমে প্রশংসিত অনীশ বাগচি নিন্দিত হতে থাকে।
এরপর আসে সত্তরের দশক। সারা বাংলা জুড়ে উত্তালতার যুগ। হাজার হাজার তাজা প্রাণ লুটোতে থাকে পথে ঘাটে। এ্যাকাডেমিক জগতের একেবারে চুড়োয় থাকা কত ছেলে জীবনের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তির যুদ্ধে। সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে রূপান্তরিত করার স্বপ্ন। অনীশ বাগচি যে দেবদাস নয়, স্বপ্নের ভোর গল্পটুকুই যে লেখার মতো শুধু গাল ভরা কথা সে লিখতে পারে না, সে যে কিছু করতেও পারে, তার প্রমান দিতে গিয়ে সে ঢুকে পড়ে নকশাল আন্দোলনে। অসী ছেড়ে মসী হাতে তুলে নেয় সম্ভবনাময় সাহিত্যিক অনীশ বাগচি। শুরু হয় বোমাবাজি, এ্যাকশান আর সরকারী সম্পদ বিনষ্ট করা। শুরু হয় ধর-পাকড়, এনকাউন্‌টার, জেল, প্যারল, আর অন্ধকার ভবিষ্যৎ। ভয় পেয়ে অনীশের কাকা অনীশকে পাঠিয়ে দেন আন্দামানে। সেখানে থাকতেন অনীশের ছোটপিসি। সেখানে অজ্ঞাতবাসে অনীশের কেটে যায় জীবনের মূল্যবান কয়েকটা বছর। প্রথম প্রথম প্রকৃতির মধ্যে এই দ্বীপান্তর অনীশের বেশ শাপে বর-ই হয়ে ওঠে। কিন্তু মানুষ মানুষকে ছাড়া, বিশেষত তার নিজস্ব পরিমণ্ডল ছাড়া কোনো অবস্থাতেই প্রফুল্ল থাকতে পারে না। তাই কালে কালে সেই নিরালম্ব জীবনে একসময় সে হাঁপিয়েও ওঠে। বাড়িতে বার বার করে সে চিঠি লিখতে থাকে তাকে এই দ্বীপান্তর থেকে মুক্তি দেবার জন্যে। কিন্তু অবস্থা না থিতোলে তাকে বাংলার অগ্নি বলয়ে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসা আর এক বিড়ম্বনা। ফলে সেই সঙ্গিহীন, নীরস আর নিরাসক্ত জীবন অনীশ বাগচিকে ধীরে ধীরে ঘিরে ধরতে থাকে। হয়তো সেটাও একটা শাপে বর হয়ে ওঠার কাজ করে। কর্মহীন, গর্বহীন আর সেই নিশ্চিন্ত জীবন থেকে মুক্তি পেতে অনীশ আবার কলম ধরে। গল্প থেকে তার উত্তরণ ঘটে উপন্যাস রচনায়। একটা ছোটমোটো লেখালেখির স্টক সে বানিয়েও ফ্যালে নিতান্ত অবসর বিনোদন করতে গিয়ে। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, আন্দামানে শান্ত অনুত্তেজক পরিবেশ তাকে গোটা বিষয়টা ভাবতে এবং একটা পক্ষপাতদুষ্টতাহীন মানসিকতা গড়ে তুলতে সহায়তা করে। ফলে তার লেখার মান বৃদ্ধিও পায়। তাতে পরিণত একটা ছাপ পড়ে।
অবশেষে অনীশের প্রত্যাবর্তন ঘটে। কিন্তু বাবা শর্ত দেন, যদি অনীশ বাড়িতে আসতেই চায়, তবে তাকে প্রথম শর্তে বাউন্‌ডুলেপনা ছেড়ে সংসার করতে হবে। আর দ্বিতীয় শর্ত, তাকে ঐ বেকার লেখালেখি ছেড়ে চাকরী করতে হবে। সুলগ্নাকে ওর বাবা নিজেই পছন্দ করে রেখেছিলেন আগে থেকেই। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, এই মেয়েই পারবে তাঁর পুত্রকে সুপথে ফিরিয়ে আনতে, এক সুন্দর শান্ত জীবন দিতে। সুলগ্না ছিলো কালো। হয়তো তাকে পাত্রস্থ করতে তাদের বাড়িকে অনেকটা পথ ব্যর্থতায় এগিয়ে এসে পিছিয়ে পড়তে হয়েছিলো। কিন্তু সুলগ্না ওয়াক্‌ থুঃ ছিলো না। কুটুম বাড়ির সাথে অনীশের বাবা ব্রতীশ বাগচির একটি শর্ত হয়। তথাকথিত কোনো দেনা-পাওনা নয়। অনীশের শ্বশুরমশাই অনীশকে একটি সরকারী চাকরী করিয়ে দেবেন। অনীশ চাকরীর পরীক্ষা-টরিক্ষা দেবে নিয়ম মাফিক। কিন্তু মূল কলকাঠিটি নেড়ে দেবেন তিনি। এটাই এই বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে দেনা, এটাই পাওনা। এটাই বরপণ অথবা এটাই কন্যাদায় থেকে মুক্তির বিনিময় মূল্য। মনমোহন মিত্রের সেই ক্ষমতা আছে। ঢেঁকি গিলতে হোল অনীশ বাগচিকে। বিপথু পুত্রকে বাঁচাবার আর কোন উপায়ান্তর পাননি ব্রতীশ বাগচি। চাকরী হলো, বিবাহ হলো, প্রাকৃতিক নিয়মে একটি কন্যাসন্তান স্নেহলগ্নাও এলো বাড়িতে। যেমনটি সকলের হয়, তেমনটিই হলো। পরে তার বিবাহও হল স্টেটসে সেটেল্‌ড এন.আর.আই. পাত্রের সাথে।
--------------------

(৩)

নিজের বিয়ের কথা আজও স্পষ্ট মনে আছে অনীশ বাগচির। দিনটা ছিল সতেরোই আশ্বিন। একদিকে বাংলা জুড়ে দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি, আর অন্যদিকে অনীশের বিবাহ। একমাত্র সন্তান বাবা-মাএর। তার হাত ধরে আসছে বাগচি বাড়ির পুত্রবধূ। যেন বাগচি বাড়িতে দেবী দুর্গা আসছেন--- এমন একটা সাজো সাজো রব পড়ে গিয়েছিলো। সুলগ্নাকে পছন্দ বা অপছন্দ করার কোনো অপশন ছিলো না অনীশের কাছে কারণ স্বদেশে ফিরেই অনীশ জেনেছিলো যে, তার পূর্বতন প্রেমিকা ততদিনে ঘর-সংসারে মন দিয়েছে এক সরকারী কর্মচারির সাথে। এক শিল্পীর অনিশ্চিত জীবন মোটেই তার পছন্দ হয়নি।
বিবাহের দিন থেকে প্রীতিভোজ--- গোটা বৈবাহিক অনুষ্ঠানগুলোতে সুলগ্নাকে ভালো করে লক্ষ্য করছিলো অনীশ। তার স্ত্রীকে কোন এ্যাঙ্গেলে দেখতে ভালো লাগে। অন্তত ভালো লাগানো যায়। জোর করে হলেও ভালো লাগাতে তো হবেই। স্ত্রী বলে কথা। কিন্তু বার বার অনীশের মনে হয়েছে যে, তার বাবা একটি মূর্তিমতী সাধ্বীকে কোনো মন্দির থেকে তুলে এনে তার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছেন। অনীশ লক্ষ্য করেছে, তার নব্যবধূ যেন তার বিধি-বিধান মেনেই বরণ করা স্বামীকে একবারের জন্যে গোপন দৃষ্টিতে দেখে নিতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ বোধ করছে না। এমনকি শুভদৃষ্টি পর্যন্ত তার দৃষ্টিতে কোনো মুগ্ধতার ছোঁয়াটুকু নেই। অনীশ জানে, সে সুপুরুষ না হলেও কুপুরুষ তো নয়। নববধূ বা শুভদৃষ্টি তো অনীশ এই প্রথম প্রত্যক্ষ করলো না। তার উপন্যাসে তো আলোলিকা তার স্বামীকে বিয়ের পিড়িতে দেখার জন্যে হাজারটা পরিকল্পনা করেছিলো। কিন্তু সুলগ্না যেন আচার-অনুষ্ঠান মেনে চলার প্রতি অনেক বেশী যত্নবতী।
ফুলশয্যার রাতে বিছানায় বসে এই নিয়ে কথা বলবে ভেবে রেখেছিলো অনীশ। যখনই ও এসে ফুলে সাজানো খাটে বসেছে, সুলগ্না খাট থেকে নেমে গিয়ে একেবারে গলবস্ত্র হয়ে ওকে প্রনাম করে। ঠিক যেমনটা চল ছিল পঞ্চাশ বছর আগে। অনীশ কী করছো! কী করছো!লে বাধা দিতে গিয়েছিলো। এসব কী!
সুলগ্না তাকে বলেছিলো--- এমা! এটাই নিয়ম।
--- ও! তুমি কি সব কাজ নিয়ম মেনেই করো? অনীশ পাল্টা প্রশ্ন করে দিলো।
--- চেষ্টা তো করি। নিয়ম মেনে করলে তো মঙ্গল হয়।
--- হয় বুঝি? এবার অনীশ মোক্ষম কথাটা বলে--- একটা সত্যি কথা বলবে?
--- এমা! মিথ্যে বলবো কেন? বলেই অনীশ কী বলবে, তা শোনার জন্যে যেন উৎসুক--- এমন ভাব করে তাকিয়ে থাকে সুলগ্না।
--- তুমি কি বাধ্য হয়ে এই বিয়েটা করলে?
এ কথা শোনামাত্র মেয়েটা এক টুকরো জিভ বের করে আতঙ্কিত মুখে বলেছিল--- আমার যেন নরকে ঠাঁই হয়। এমন অপরাধের কথা উঠছে কেন?
---  না, অপরাধের কথা নয়। আবার একেবারে নয়--- তা-ও নয়। বিয়েতে যদি মত থাকবেই, তবে গোটা বিয়ের অনুষ্ঠানে তুমি কেন  একবারও আমার দিকে তাকালে না? তোমার কি জানার কোনো প্রয়োজন নেই, তোমার স্বামীকে বর বেশে দেখতে কেমন লাগছে?
নিরুত্তাপ কণ্ঠে উত্তর দিলো সুলগ্না--- আমি তো আমার প্রাণের মানুষকে সকলের সামনে দেখতে চাই না। এই যে, এখন দেখছি।
অনীশের কাছে সুলগ্নার এই কথাকটা কেমন যেন ব্ল্যাক এ্যান্‌ড হোয়াইট যুগের কোন এক সিনেমার সংলাপ বলে মনে হলো। গানের কলি মুখস্ত করে যদি কেউ প্রেম নিবেদন করে বলে, মোর প্রিয়া হবে এসো রানী, দেবো খোঁপায় তারার ফুল..., তবে তো প্রেমিকা সেই যে গা ঢাকা দেবে, আর এ জন্মে যে তার দেখা পাওয়া ভার হবে, তা কে না জানে! একটা বিস্বাদে মুখটা কুঁচকে গেলো অনীশের। কিন্তু সুলগ্নার পরের সংলাপ এই আগের সংলাপকে নতুন করে ভুলিয়ে দিলো। হঠাৎই ও বলে বসলো,
--- আমার কিন্তু সিগারেটের গন্ধে কষ্ট হয় না। ভালোই লাগে।
এক ধাক্কায় যেন জেগে ওঠে অনীশ বাগচি। নারী বড়ো বিচিত্র। বহুরূপে সম্মুখে তোমার... পরের কটা লাইন আর ওর মনে পড়লো না। এমন কথা কোন নারীর মুখে শোনার জন্যে মোটেই প্রস্তুত ছিল না ও। তাই পরীক্ষা করার জন্যে বললো--- এ কথা কেন! আমি যে সিগারেট খাই, এ কথা কে বললো তোমাকে?
--- আহা! চোখ থাকলেই জানা যায়। পকেটে তো পাতলা পাঞ্জাবি ভেদ করে সে উঁকি দিচ্ছে। বড়রা সবাই দেখতে পাচ্ছিলেন। আমি সবার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছি, সবাই একটা অস্বস্তি বোধ করছিলেন। এ বাড়ির বাবা তো তোমার জ্যাঠা মশাইয়ের দিকে তাকাতেই পারছিলেন না ঐ উঁকি দেবার জন্যে। অস্বস্তি।
অনীশ বুঝলো, এ মহিলাকে যতটা অন্ধ-কানা ও মনে করেছিলো, ততটা এ নয়। তাই একটা সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে মনে মনে সুলগ্নাকে থ্যাংকস জানিয়ে অনেকক্ষণ পরে ও যেন ও দম ফিরে পেলো। কিন্তু সুলগ্নাকে মোক্ষম আক্রমণ করে করে কোষ্ঠী পাথরে ঘষে ঘষে পরখ না করে শান্তি পাচ্ছিলো না। একগাল ধোঁয়া ছেড়ে বিছানায় পা তুলে বসে অবশেষে অনীশ বলল--- এই যে তোমার বাবা আমাকে একটা চাকরী পাইয়ে দিলেন। এতে তোমার নিজের স্বামীকে অকর্মণ্য্‌ অপদার্থ মনে হচ্ছে না?
অবলীলায় সিধেসাদা উত্তর সোজা করে দিলো সুলগ্না--- কেন! আপনি যে আমার বাবাকে কন্যাদায় থেকে মুক্তি দিলেন! তার বেলা? তাতে তো বাবাকে আমার অকর্মণ্য বলে মনে হচ্ছে না। আপনজনকে বুঝি কেউ অকর্মণ্য, অপদার্থ মনে করে?
--- আমি বুঝি তোমার আপনজন?
--- আপনজন নয়? এই তো বিয়েতে কত কথাই না আপনি আমাকে বললেন! আমি আপনাকে বললাম! সংস্কৃত শব্দের মানে বোঝেন না আপনি? য়দিদং হ্রিদয়ং তব, তদস্তু হ্রিদয়ং মম... এসব তো সব প্রমিস। আমরা যে প্রমিস করলাম!
অনীশের কাছে কন্যাদায়, প্রাণের মানুষ, নরকে ঠাঁই ইত্যাদি শব্দগুলো আর আধুনিক বেশভূষা থেকে বিচ্ছিন্ন একটা নব্যবধূর সামনে নিজেকে একটা প্রাচীন তৈলচিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এবং তার আগা মাথা না বুঝতে পারা মানুষ বলে মনে হল। তবু তো এসব বিবাহের টাট্‌কা গন্ধে সয়ে যায়, যার প্রথম ও প্রধান কারণ বিপরীত যৌন অস্তিস্ব। একটি নারীর সাথে নতুন পরিচয়, যাকে চিনি না, জানি না, তার প্রতি একটা প্রাকৃতিক আকর্ষণ থাকে। এই পর্বে অনেক কথা বলতে হয়, বা অনেক কথা শুনতে হয় প্রথম প্রথম। কিন্তু দুই বিপরীত মেরুর দুটো মানুষকে একই ছাদের তলায় থাকতে হলে সেটা আর একই জায়গায় থাকে না বেশিদিন। এমনটাই হলো অবশেষে। তেলে জলে মিশ খেলো না।
অনীশের বিবাহের দু-বছরের মাথায় অনীশের বাবা ও পরে মা চলে গেলেন সংসার সমুদ্র ছেড়ে। সুলগ্না অন্তত মাস খানেক সমস্ত কাজের মধ্যে চোখ মুছেছিলো নীরবে। দেখেছে অনীশ। ওর মনে হয়েছে, এটা মহিলাদের একটা বাড়াবাড়ি। বড়ো প্রাচীন আবেগ। অনীশ লক্ষ্য করেছে যে, সুলগ্না খুব সকালে ওঠে, একপ্রস্থ স্নান করে, তারপর সংসারের যাবতীয় কাজ করে নিজে হাতে। বাড়িতে কাজের লোক রাখতে অনীহা সুলগ্নার। রান্না থেকে শুরু করে বাসন মাজা পর্যন্ত। অনীশ দেখেছে, ওর হাতের রান্নাটি নিঃসন্দেহে পাকা। কিন্তু এমনটা তো চায়নি। একটা ঠিকা লোক রেখে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। ফলে এসব সারতে সারতেই সুলগ্নার বেলা বয়ে যায়। ছুটির দিনে অনীশের নিঃসঙ্গ খাওয়ার পাট চুকিয়ে, আর এক প্রস্থ স্নান করে সে সিক্ত বস্ত্রে সুলগ্না ঢোকে ঠাকুর ঘরে। সেখানে ওর অবস্থিতি বিরক্তিকর হয়ে উঠেছিলো অনীশের কাছে। একঘণ্টা বা দু-ঘণ্টা নয়। পাক্কা তিনটি ঘণ্টা। গায়ের কাপড় গায়েই শুকোয়। ধুপকাঠির গন্ধে ঘর ম ম করে। তারপর ধুনোর পাত্রে ধুনো জ্বালিয়ে নিয়ে ধোঁয়া হাতের পাতা দিয়ে ঠেলে ঠেলে সারা বাড়িতে ধোঁয়া ছড়ানো চলে। ওর ঠাকুর ঘরে কারা কারা বিরাজ করছেন, তা অবশ্য দেখার কোনো আগ্রহ তার হয়নি কোনোদিন। কোনোকালেই অনীশ দেবভক্ত নয়। ও কার্যত অরাজনৈতিক হলেও মনে মনে কট্টর মার্ক্সবাদী মানুষ। মন্দির-মসজিদ ওর কাছে নিষিদ্ধ স্থান। সুলগ্নাকে একদিন ও ডেকেও বলেওছিলো,
--- এই যে তুমি চারটে পাঁচটা ধুপকাঠি জ্বালাও রোজ, তুমি কি জানো, এর ধোঁয়া কতটা পলিউটিং?
জিভ কেটে সুলগ্না বলেছিলও--- এমা। জানি না তো। ঠিক আছে। আর জ্বালাব না তাহলে।
কোনো বিপত্তি না ঘটিয়ে সুলগ্না মেনে নেয় স্বামীর পরামর্শ। তারপরের দিন থেকে আর কোনদিন ধুপকাঠি পুড়তে দেখেনি অনীশ। কিন্তু এমনটাতে ও খুশী হতে পারে নি। স্বামীকে ঈশ্বর বিমুখ জেনেও সুলগ্না যে বিনা তর্কে মেনে নিয়েছে, এতে যেন অনীশ কোথায় নিজেকে পরাভূত মনে করে। শান্তি পায় না মনে। ইচ্ছে করলে সুলগ্না যে পাল্টা আক্রমণ করে বলতে পারতো, তাহলে তো কার্বন মনোক্সাইডের ভয়ে পথেঘাটে নামা যাবে না। নাকে মুখে মাস্ক জড়িয়ে চলতে হবে সারা জীবন। কিন্তু কোন তর্কে সুলগ্না যেন নেই। একদিন স্ত্রীকে অনীশ আক্রমণও করেছে,
--- এই যে পুজোর ছলে বেলা তিনটে পর্যন্ত অনাহারে থাকো। কোনো গ্রন্থে কি লেখা আছে, তোমাদের উপবাস করে পুজো করতে হবে? স্নান করে ভেজা কাপড়ে তিনটে ঘণ্টা কাটাও সারা বছর। আমায় কেন বিপদে ফেলতে চাও বলো তো?
--- আমি তোমাকে বিপদে ফেলবো! মাথা খাও, এমন কথা বলো না।
মধ্যযুগীয় নারীর মতো মাথা খাও আর শুনতে না হয়--- এই কারণে অনীশ এটা নিয়ে আর বিতর্ক করেনি। কিন্তু বেশিদিন সুলগ্নার সাথে ওকে অভিনয়ও করতে হয়নি। ক্রমে ওদের মধ্যে অকথিত দূরত্ব বেড়েই গেছে। এ কথা অনীশের মনে গভীর ভাবে স্থান করে নিয়েছিলো যে, ওর বাবা এভাবে সুলগ্নার সাথে বিয়ে দিয়ে ঠিক করেননি। এভাবে শুধু শুধু দুটো জীবন নষ্টই তিনি করেননি, অনীশের হাত-পা তিনি বেঁধে দিয়েছেন শ্বশুর মশাইকে দিয়ে ওর চাকরীটা করিয়ে দিয়ে। যখনই অনীশ মুক্তি পেতে চেয়েছে, তখনই সুলগ্নার বাবার প্রতি একটা অলিখিত কৃতজ্ঞতা ওর পথ রুদ্ধ করে দাঁড়িয়েছে।
সাহিত্যিক অনীশ বাগচি সেই সময় থেকেই বুঝে গিয়েছিলেন, তাঁর এই বন্ধন থেকে মুক্তি নেই। মুক্তি পাবার একটাই পথ আছে।। এই চাকরীটা ছেড়ে দেওয়া। কিন্তু সেটা রাতারাতি ঘটানো তো সহজ কথা নয়। অর্থনীতি বলে তো একটা বিষয় আছে। আর সেটা একটা বিকল্প রাস্তা না পেলে নিতান্ত বোকার মতো ইমোশনালি ছেড়ে দেওয়ার অর্থ হলো একটা অর্থ সংকটকে ডেকে আনা। তাই আন্দামানে যে সব লেখালেখি অনীশ বাগচি সম্পন্ন করেছিলেন, তার মধ্য থেকে বেছে বেছে অগ্নি বলয় উপন্যাসটি নিয়ে ডাক ব্যবস্থাকে বিশ্বাস না করে সোজা নিজে নিজেই পৌঁছে যেতে শুরু করেছিলেন প্রকাশকদের দরজায় দরজায়। তাঁরা অনেকে অনীশ বাগচিকে এতকাল পরে চিনতে না পারলেও নামটা ভোলেননি। কপাল ভালো থাকলে কী না হয়। একটা মাস ওঁকে ঘুরতে হয়েছিলো এখানে সেখানে। তার পরই অগ্নি বলয় ছেপে বের হয় মসীবিশ্ব প্রকাশনী থেকে। শুধু তাই নয়। অগ্নি বলয়এর বিক্রি আকাশ ছোঁয়। আসতে থাকে মোটা মোটা টাকার চেক।। ছোট ছোট নানা পুরস্কার আসতেও থাকে এই অগ্নি বলয়-এর হাত ধরে। আসতে থাকে নানা অফার। আরো লেখা এবং চলচ্চিত্র রূপান্তরিত করার কথা। অগ্নি বলয় আগুনের ইতিহাস নাম নিয়ে সিনেমা জগতের রসিক মানুষকে ভাবিয়ে তুলতে বাজারে এসে পড়ে। সেল হয়তো পায় না এই সিনেমা কিন্তু অনীশ বাগচিকে তা একেবারে পর্বতের চুড়োয় তুলে দ্যায়। এরপরেই চাকরী ছাড়েন অনীশ। সেই সময়ে সদ্য মা হয়েছে সুলগ্না।
মুক্তি পেয়ে অনীশ রাতারাতি একেবারে ভিন্ন পথে বইতে শুরু করেন। বাড়িতে শুরু হয় সাহিত্যের নানা ব্যক্তিত্বের আসা-যাওয়া, তাঁদের সঙ্গে বসে নানা বিষয় আলোচনা, আলোচনা থেকে শুরু হয় মদ্যপান। সদ্য গজিয়ে ওঠা বুদ্ধিজীবী বলে কথা! যে চর্চাটা চলতো বাইরে, সেটা এসে উঠলো অন্দরে। অনীশ লক্ষ্য করেছেন, সুলগ্না সবই দ্যাখে কিন্তু সে যেন নীরব প্রতিমা। জেনো এসব কিছুই ওর জানা, দ্যাখা, অভ্যাসের মধ্যে পড়ে। ঘরে রেফ্রিজারেটর-এর তাকগুলো যে সংসারের প্রয়োজনীয় বস্তু থেকে মদেই বেশী সেজে উঠছে, তা দেখেও নীরব সুলগ্না। ওর এই ঔদাসীন্য যেন অনীশের গায়ে হাজারটা শুয়োপোকা ছেড়ে দ্যায়। এতো নীরবতা কেন? এতো স্তব্ধতা কেন? এতো শীতলতা কীসের জন্যে? এতো অহংকার আসে কোথা থেকে! অথচ অনীশের পাওয়া একটার পর একটা মেমেন্টো, অভিনন্দন পত্র, মানপত্র সব গুছিয়ে রাখা যেন সুলগ্নারই দায়িত্ব। যেন যার বিয়ে, তার হুঁশ নেই, কিন্তু পাড়া-পড়শির ঘুম নেই। 
ততদিনে বাংলার সাহিত্য আকাশে অনীশ বাগচি একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। চারটে পাঁচটা পুজোসংখ্যা থেকে শুরু করে নববর্ষ সংখ্যা, আরো নানা ফরমায়েশি লেখা পাঠাতে ব্যতিব্যস্ত সাহিত্যিক অনীশ বাগচি। একজন চাকরীজীবীর মতো সময় ধরে তিনি লিখতে বসেন, লেখেন, ওঠেন, আবার বসেন। মুড, পরিবেশ, পরিস্থিতি বা ঘটনা ব্যতিরেকেই চলে লেখা। অর্ডার এ্যান্‌ড সাপ্লাই। টাকা নিয়ে বসেছেন। লিখতেই হবে। সে লেখা আদৌ কোনো জাতের লেখা হচ্ছে কিনা, সেটাও দেখার বালাই নেই। অর্ডার সাপ্লাই করতে হবে। পয়সা এলো, গাড়ি এলো, বাড়ি এয়ার কন্ডিশন হলো। এর মধ্যে দুটো উপন্যাসের ওপর ফিল্ম বানানোও পর্‌যন্ত শুরু হয়ে গেলো বাংলার চলচ্চিত্র জগতের দুই কোর-বাণিজ্যিক চিত্র নির্মাতার হাতে। টাকা উড়ছে। ফলে লেখার মানও পড়ছে কখনও কখনও। ধারে আর কাটছে না। ভারে কাটছে। বন্ধুদের সাথে আজ চাইবাসা, কাল পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় (সেখানে আদিবাসী মেয়েদের সাথে ফষ্টিনষ্টি), পরশু গরুমারা ফরেস্ট তো পরদিন সুন্দরবন ট্যুর চলছে। গাড়িতে মদের ক্রেট উঠছে। স্বেচ্ছাচারিতা আর ফুর্তির বন্যায় ভাসছেন অনীশ বাগচি আর তাঁর সাহিত্য জগতের ছায়াসঙ্গীরা। বাড়িতে স্ত্রী? সে তো টেক্‌ন ফর গ্র্যান্‌টেড। পাকাপাকি সম্পত্তি। সেটা তো আর ভেসে যাচ্ছে না। এরই  মধ্যে পালামউতে বাসন্তিকা নামে একটি নব্যা কবিনীর সাথে এক বিরাট যৌন বদনামে জড়িয়ে গেলেন অনীশ। নার্সিংহোম-টোম অবধি গড়ালো কেসটা। বেরোলো কাগজে। কিন্তু বাড়ির কাগজওয়ালাকে ডেকে এক সপ্তাহের কাগজ মানা করে দিলেন অনীশ। অনীশ জানতেন, প্রতিবেদক থেকে শুরু করে মানুষ--- সকলে কালকেই ভুলে যাবে কী ঘটেছিলো। ভয় পান নি অনীশ কিন্তু চাননি যে, সুলগ্না কেসটা জানুক। সুলগ্না যেন কেমন একটা অদ্ভুত রিএ্যাকশন দেবে! এটাই সহ্য হয় না অনীশের।
অনীশ কোথাও বাইরে গেলে সুলগ্নার একটাই প্রশ্ন--- যদি তোমার খোঁজে কেউ আসে, কী বলতে হবে?
অনীশ দেখেছেন, একটা দিনের জন্যেও এই মহিলা বলে না, আমাকে একবার বেড়াতে নিয়ে যাও না। নীরব, নিঃশব্দ, মৃতবৎ। তাই ওকে আঘাত করে অনীশ আনন্দ পেতে চায়। চেঁচিয়ে বলে ওঠে--- দ্যাট্‌স নান্‌ অফ ইয়োর বিজনেস।
নীরবেই সরে যায় সুলগ্না। এটা জানা কথা যে, ও কোন কথা বলবে না। বলা ওর ধাতে নেই। তাই যেন বার বার চূড়ান্ত উচ্ছৃঙ্খলতা করে চলেন অনীশ। বিবাহের পর মধুচন্দ্রিমা ছাড়া কোনো একটি নতুন জায়গায় সুলগ্নাকে নিয়ে যান নি পর্যন্ত। এমন দেখেই বড়ো হয়েছে ওদের কন্যা স্নেহলগ্না। বোধ জন্মাবার পর থেকে এসব প্রত্যক্ষ করে ক্রমশ বাবার থেকে মনে মনে সে যেন সরে যাচ্ছিলো দূরে, আরো দূরে। তবে সুলগ্না বা নিজের পরিবার---- যেটাই হোক, দুটোকে নিয়েই ভীষণ রকমের পজেজিভ ছিলেন অনীশ। সেখানে কাউকে ঢুকতে দিতে তাঁর গভীর অমত। অনেকে আড়ালে বলেছে, পেটি পুরুষ মেন্‌টালিটি। এমনিতে বউকে পাত্তা দ্যায় না। ওদিকে তুমি কিছু বলো, অমনি ফোঁস করে উঠবে।
চাইবাসা গিয়ে দীপ্তেন্দু একবার বলেওছিলেন--- দ্যাখো অনীশ, তুমি বলেই বলছি। তা নয়তো কারোর পারিবারিক ব্যাপারে আমি মাথা গলাই না। যদি তোমরা দুজনে একে অপরের থেকে এতোটাই দূরে দূরে থাকো, তবে রিলেশনটা ব্রেক করে দেওয়া উচিত। বাসন্তিকা তোমায় এখনও চায়। বলো তো আমি কথা বলতে পারি।
হয়তো অনীশ নিজেই এই কথাটা একদিন বলতেন। কিন্তু দীপ্তেন্দু যেহেতু বলে বসলো, সেহেতু নেশার ঘোরে তাকে জানিয়ে দিলেন অনীশ--- ইউ আর মাই ফ্রেন্ড, দীপ্তেন্দু। এ্যান্‌ড দ্যাট্‌স অল। ডোন্ট ক্রস ইয়োর লিমিট।
আজ অনীশ বাগচি যে মাপের লেখক, তাকে খেপাতে চাননি দীপ্তেন্দু স্যান্যাল। তাঁর নিজস্ব একটি পাবলিকেশন আছে। অনীশ বাগচি তিনিই অন্যতম ব্রেক দেন তার ছোটগল্প সংকলন ছেপে বের করে। সেই থেকেই বন্ধুত্ব। হয়তো বাণিজ্যিক বন্ধুত্ব সেটা। কিন্তু দীপ্তেন্দু ছোটবেলা থেকে অনীশের বন্ধু হলে জানতে পারতেন, এটাই অনীশের চরিত্র। সূর্য একটি নক্ষত্র এ কথা কেউ বললে অনীশ তাকে অন্য কিছু বলবেনই বলবেন। প্রমান করেই ছাড়বেন, সূর্য কোন নক্ষত্র নয়। ফলে সুলগ্নার সাথে সেপারেশন হতে হতে হলো না। তবে পরে একদিন রাতে খাবার টেবিলে অনীশ সুলগ্নাকে ডেকে বললেন,
--- তোমার মেয়ে কোথায়? শুয়ে পড়েছে?
সুলগ্না অনীশের দিকে তাকায়নি। নিঃশব্দে খাবার খেতে খেতে বলেছে--- আমার মেয়ের কথা থাক। তোমার মেয়ে ঘুমোচ্ছে। বলো, কী বলবে।
--- আমাদের বোধহয় এভাবে একসাথে আর থাকা চলে না। আমরা দুজনে হয়তো মিস্‌ ম্যাচ। তুমি কী বলো?
এবার সরাসরি তাকায় সুলগ্না। তার চোখের দৃষ্টিতে যেন অনেক না বলা কথা। কিন্তু সে সামান্যা। সামান্যার মতোই বলল--- আমি তো ভাবিনি। যদি তুমি তাই চাও...।
--- এভাবে নাটক করার কোন মানে হয় না। তোমার কি আর আমাকে ভালো লাগছে? আমার তো নয়।
সুলগ্না সোজা উত্তর দিলো--- স্বামী-স্ত্রী মধ্যে ভালো লাগা বা মন্দ লাগার ব্যাপার তো নেই। আমি তো সেটাই জানি।
--- যদি আমরা আলাদা হয়ে যাই?
--- আমি কিন্তু এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারবো না। আমি এসব দেখিওনি কোনদিন, ভাবিওনি। আর তাই যদি হয়, তবে লগ্নার কী করবে? সেটা কিন্তু ভেবেই কোরো?
অনীশ বুঝতে পারে, ডিভোর্স করা যাবে না। আর কিছু না হোক, অনীশ তাঁর মেয়েকে ভালোবাসেন। তিনি জানেন, লগ্না তার বাবার জীবন ধারায় অখুশী। কিন্তু অনীশ তার কাছে একটা আশ্রয় পেতে চান। তাই দ্রুত বিষয়টাকে হাল্কা করে দেবার জন্যে কৃত্রিমভাবে সজোরে হেসে জানালো--- আমি ঠাট্টা করছিলাম। দেখছিলাম, তুমি কী বলো।
সুলগ্না যে একেবারে বোকাহাঁদা নয়, সেদিন অনীশ বুঝেছিলেন। কারন সুলগ্না ঝটিতি উত্তর দিয়েছিলো--- তুমি ইন্‌টেলেকচুয়াল মানুষ। আমি কি আর তোমার এইসব উঁচুমানের ঠাট্টার যোগ্য পাত্রী?
-----------------------

(৪)

অনীশের অবাঞ্ছিত বিবাহিত জীবনে সুলগ্না প্রথম তার সাথে সরাসরি বাক-বিতণ্ডায় জড়ালো লগ্নার বিয়েকে কেন্দ্র করে। অনীশ বিশ্বাস করতে পারেননি, এই তার শান্ত, ধীর, স্থির, নির্লিপ্ত ঊনবিংশ শতকের আদলে গড়া স্ত্রী সুলগ্না। স্নেহলগ্না একটি ছেলেকে ভালবেসে বসে। ছেলেটি একটি একজন এন.আর.আই। সে একটা বিজনেস ট্যুরে এসেছিলো ইন্‌ডিয়ায়। অনীশ আপত্তি করেছিলেন এমন পাত্রে। তার মূল কারণ ছিলো এই যে, তাঁর মেয়ে তাঁর চোখের আড়ালে চলে যাবে, তাই একটি সরকারী চাকুরের সন্ধান করছিলেন তিনি। কিন্তু স্নেহলগ্না তাঁর মায়ের কাছে একটি মেমোরান্‌ডাম দিয়ে বসেছিলো। তাই ময়দানে অবশেষে নামে সুলগ্না। অনীশকে আলাদা করে জানায়,
--- কেন তুমি ওর এ্যাফেয়ারে আপত্তি করছো? তুমি কি কোন পারসোনাল ইনফরমেশন পেয়েছো ছেলেটি সম্বন্ধে? সে কি খারাপ ছেলে?
--- আমি চাই না, তো চাই না। এতো কৈফিয়ত দিতে পারবো না। অনীশের সোজা জবাব।
সুলগ্না হেসে দ্যায়। অনীশকে বোঝায়--- তুমি তো চাইছো না ছেলেটিকে। সে-ও কিন্তু তোমাকে চায় না। ওরা শুধু একে অপরকে চায়। ওরা একে অপরকে ভালোবাসে। ব্যস্‌। এখানে আমাদের কথা এখানে কেন আসছে?
ক্ষুব্ধ হন অনীশ বাগচি। খাবার ছেড়ে উঠে যান।। বিরক্তি এড়াতে এরপর ড্রিঙ্ক করতে শুরু করেন। ফলে এ সময় তাঁর মেজাজ যেহেতু সপ্তমে থাকে, সেহেতু সোজা জানালেন--- আমি এটা নিয়ে কোনো আলোচনা করতে চাই না। ডোন্ট ডিস্টার্ব মী।
কিন্তু সুলগ্না মা। তাই অনীশকে ছেড়ে দ্যায় না। তাকেও পাল্টা আক্রমণ করে--- তুমি তোমার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছো মেয়ের ওপর। তুমি আমাকে নিয়ে সুখী হতে পারোনি জীবনে। আমি তোমাকে তোমার মতো করে কিছু দিতে পারিনি। এবার তুমি কিন্তু সেই ভুলই করছো।
সাত চড়ে রা না-কাটা সুলগ্না যে তাঁকে এভাবে আক্রমণ করতে পারে, এই ধারনা ছিলো না অনীশের। আবার ওর কাছে পরাজিত হতে হয় তাঁকে। বেশ বুঝতে পারেন, এরপরে বলার মতো তাঁর আর কিছুই নেই। তবু শেষবারের মতো চেষ্টা করেন একবার--- মেয়ে বিদেশে থাকবে আর ছেলেমেয়ে হবে ট্যাঁস! ফট্‌ ফট্‌ করে ইংরেজী বলবে, ড্যাডি-মাম্মি করবে! রাবিশ ক্রসব্রিড কালচার। এটা তোমার সহ্য হতে পারে, আমার হবে না।
--- আমার তো অনেক কিছুই সহ্য হয় না, সাহিত্যিক--- এক অন্য স্বরে বলে সুলগ্না। কিন্তু কে শুনছে আমার কথা! কে ভাবছে! তোমার কালচার কি আজ একটা ক্রসব্রিড হয়ে ওঠেনি? তুমি যা করছো, এটা তোমার বা আমাদের পরিবারে কে করতো, বলো তো?
শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে আজ হাজার অভিযোগে অনীশকে বিদ্ধ করে সুলগ্না। আজ তারই দিন। যা সে বলতে চায়, আজই সবটা বলে ফেলতে হবে। এই প্রথম এতো বছরে। অনীশ লেখক। মানুষের মনের রেখা, লেখা, ভাষা, ইঙ্গিত তিনি নাকি সবই পড়তে পারেন বলে তাঁর গুণগ্রাহীরা মনে করে। কিন্তু আজ যেন সুলগ্নাকে তিনি চিনতেই পারেন না। কোথায় পেলো এ মহিলা এতো কথা! এতো সাহস! এতো ভাষা! এমন তো আগে কখনও দ্যাখেননি তিনি। কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলো এই তেজ? আজ এই প্রথমবার যেন ওকে ভালো লাগছিল অনীশের। আজ যেন একটা ঘুমন্ত বিষধর তার ফণা তুলে জানিয়ে দিয়েছে কজে, সে দীর্ঘকাল নিদ্রিত ছিল। আজ জেগে উঠেছে। সাবধান। আশীবিষের দংশন একেবারে শমন সদনে পাঠিয়ে দেবে যাবতীয় মিথ্যেকে।
অনীশের মনে আছে, তাদের বাড়িতে একটা মেনি বেড়াল একবার কয়েকটা বাচ্চা দিয়েছিলো। দিন সাতেক পড়ে একদিন তাদেরকে স্থানান্তরিত করছিলো যেমন বেড়াল করে। পথে পাড়ার কয়েকটা গুন্ডা কুকুর ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছিলো কচি বাচ্চার লোভে। কিন্তু মা বেড়াল অসীম বিক্রমে তাদের প্রতিরোধ করছিলো। রক্ষা করছিলো তার সন্তানদেরকে আর আজ তাই করলো সুলগ্না। করলো সেই অসীম বিক্রমে। এটা বেশ ভালো লাগছিলো অনীশের। একটা নতুনের স্বাদ পাচ্ছিলো। প্রত্যেকদিনের ম্যাড়্‌মেড়ে সুলগ্না আজ যেন নতুন সাজে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সহজে ছাড়লো না অনীশ। ঘোষণা করলো,
--- আমি কিন্তু এই বিয়ে ব্যাপারে কোনো রকম দেওয়া-থোওয়া প্রথায় যাবো না, বলে দিলাম। আমি এসব এ্যালাউই করবো না।
অনীশের কথায় সুলগ্না ফিরে যায় তার চেনা অবয়বে। যেন খোলস পরে সে এতক্ষণ কথা বলছিলো। এইমাত্র খোলসটা যেন খুলে ফেলেছে। গায়ের কাপড় টেনে অনীশের রকিং চেয়ার সংলগ্না হয়ে বললো--- তুমি এতো অবুঝ কেন বলো তো? একটা নিয়ম, একটা প্রথা কি রাতারাতি উঠে যায়, না কেউ একা ওঠাতে পারে? সময় লাগবে না! তুমি এভাবে জোর করো না।
জানে অনীশ যে, সুলগ্না এসব বলছে কেমন একটা যেন গভীর আস্থা থেকে। যেন অনীশকে দিয়ে কাজটা সে সহজেই করিয়ে নেবে। তাই জিতবার জন্যে পাগল অনীশ আবার বললো--- এটা জোরের প্রশ্ন নয়, সুলগ্না। এটা নীতির প্রশ্ন। তুমি আমাকে আমার নীতির বাইরে যেতে বলবে না।
--- তাহলে তুমিও আমাকে আমার নীতির বাইরে নিশ্চয়ই যেতে বলবে না।
--- আমি কখনও তোমাকে তোমার বিশ্বাস, ভক্তি বা পূজার্চনায় বাধা তো দেইনি। আমি এসব পছন্দ করি না।
--- তাহলে আজ যা করবো, তাতেও বাধা দেবে না। আমি আমার গয়না বেঁচে আমার আমার মেয়ের জীবনের এমন দিনে উপহার বলো, বা যৌতূক--- দেবো। এটা তার কল্যাণ কামনা করে সব বাবা-মাই করেন।
আবার পরাজয়। কিন্তু সেই বাকযুদ্ধ বেশ ভালো লাগছিলো অনীশ বাগচির। বেশ চেনা মানুষটা একটু একটু করে অচেনা লাগছিলো। হলোই না হয় পরাজয়। না হয় সুলগ্না তার মেয়ের বিয়ে দিতে জেহাদ ঘোষনাই করলো। হার-মানা-হার গলায় পরলেন অনীশ। তর্ক করতে করতে আজ অনীশের ড্রিঙ্ক করাই হয়নি। কখন যেন থেমে গেছে ওঁ। গ্লাসে রঙ্গিন তরল প্রায় নষ্ট। বোতল খোলা। কিন্তু আশ্চর্য, তাতে তেমন কোনো অসুবিধে হচ্ছিলো না তাঁর। একটা পৃথক নেশা হচ্ছিল মনে মনে। একটা দূরত্বের পরিখার কারণে আজ বহুদিন, বহু বহুদিন সুলগ্নার সাথে কোন শরীরী সম্বন্ধ নেই অনীশের। কিন্তু আজ...।
বিয়ে হয়ে যায় স্নেহলগ্নার। আর বিয়ের অব্যবহিতকাল পরেই ও চলে যায় স্টেটস-এ।
-------------------------

(৫)

লে যাবার আগে সুলগ্না যে কথাগুলো বলছিলো, তা বন্ধুরা বিদায় নিতেই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলো। বিড়বিড় করলো অনীশ--- আমি ক্লান্ত নই, দীপ্তেন্দু। আমায় সব গুছিয়ে তুলতে হবে। আমি একটু ঘুমোবো, ভাই। শান্তিময় নিদ্রা। জেগে উঠে নতুন জীবন।
দিন তিনেক আগে একটা ফোন আর একটা চিঠি এসেছিলো। অনীশ বাগচি সাহিত্য এ্যাকাডেমি মনোনীত হয়েছে। খবরটা ঝটিতি জানিয়ে দিয়েছিলেন সুলগ্নাকে। শোনামাত্র এমন করে সে হেসেছিলো যে, প্রথম এ্যাওয়ার্ড পাবার কথা শুনেও অনীশ এমন করে হাসতে পারেননি। আর তাঁর দুটো দিন পরেই ডিউডোনালে সিভিয়ার আলসার, ভয়ংকর লাঙ্গ এ্যাফেক্‌শন, চারশো সুগার আর হার্টে একটা ব্লকেজ নিয়ে অজ্ঞান সুলগ্না ভর্তি হলো রুবিতে। চার দিনের জন্যে এদেশে এসে আগের দিনই লগ্না ফিরে গেছে স্টেট্‌সে। রাতে এক বিছানায় শুয়েছিলেন অনীশ আর সুলগ্না। আজ এতো বছর পর। অনেককিছু সাধ হচ্ছিলো অনীশের, যা এই প্রায় বুড়ো বয়সে মোটে মানায় না। কিন্তু সাহস হচ্ছিলো না। হঠাৎ ঘুমের মধ্যে সুলগ্নার গায়ে হাত চাপাতেই শিউরে ওঠেন অনীশ। সাথে সাথে ফোন করেন কয়েকটা। দীপ্তেন্দু, সুশান্ত আর নীলাদ্রি শন্‌ শন্‌ করে ঢুকে যায় এ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে। বরুনকান্তি আসেন একটু পরে। রুবির ডাক্তার সুলগ্নার অবস্থা লক্ষ্য করে আর অনীশ বাগচির পরিচয় পেয়ে তাঁকে বাক্য আর প্রশ্নবাণে একেবারে শরশয্যায় শুইয়ে দেন। কিন্তু অনীশ নীরব। এমনটা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। এই খেলাটায় যে এভাবে সুলগ্না জিতে বেরিয়ে যাবে, তা বুঝতেও পারেননি তিনি।
কেউ লক্ষ্য করেনি, সবার চোখের সামনে একটু একটু করে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছিলো সুলগ্না। অপারেশন করা যায়নি সেই অবস্থায়। মৃত্যু সুলগ্নাকে দুইপাশে দাঁড়িয়ে ঘন ঘন তার যাবতীয় অস্ত্রে ক্ষত-বিক্ষত করছিলো। ছ-ছটাদিন সুলগ্না যুদ্ধ করেছে সেই অস্ত্রের সাথে। মনে মনে প্রার্থনা করেছে, আজ আমাকে বাঁচতে দাও, ঠাকুর। আমি বাঁচতে চাই। একটা দিনের জন্যে বাড়িতে যাননি অনীশ। কারোর কোন অনুরোধ শোনেননি। সেদিন তাঁর একটাই ভাষা--- একেবারে ওকে নিয়ে ফিরবো। সুলগ্নার দু-দুটো আলাদা আলাদা অপারেশন হওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু কোনটা আগে?--- এটাই ছিল ডাক্তারদের কাছে প্রধান এবং একমাত্র প্রশ্ন। হিমোগ্লোবিন তুলতে হবে, ব্লাড ইম্পোর্‌ট করতে হবে। সুগার কমাতে হবে।
এমনকি মেয়েকেও একটা মেসেজ করতে পারেননি অনীশ। শুধু বরুণকান্তি গোপনে বলেছেন--- ওকে কোন রিকোয়েস্ট করো না। ওকে আজ প্রায়শ্চিত্য করতে দাও। ওকেও তো বাঁচতে হবে। একটা কিছু নিয়ে তো মানুষ বাঁচে। ম্যাডাম যে ফিরবে না, এটা আমরা সকলেই বুঝতে পারছি। কিন্তু ওকে তো ফিরতে হবে।
সাদা কাপড়ে গোটা শরীরটা ঢেকে নিস্তব্ধ নীরব দেহে পড়েছিলো সুলগ্না। সে জানতেও পারেনি, তার প্রথিতযশা স্বামী তার জন্যে পাগলের মতো ছুটছেন এক ডাক্তার থেকে আর এক ডাক্তারের কাছে। চারবন্ধু যেন এক অন্য অনীশকে দেখছেন। এঁকে এরা চেনেন না। শুধু রক্ত চাই, রক্ত চাই--- করতে করতে সুলগ্না আই.সি.সি.ইউ. থেকে ঢুকে গেলো আই.টি.ইউ.-তে। আর এখান থেকে সোজা ভেন্‌টিলেশনে। অবশেষে সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে সুলগ্না চলে গেলো। শুধু যাবার আগের দিন কাকভোরে একবার অদ্ভুতভাবে একটা সুস্থ দৃষ্টি মেলে ধরেছিলো। সম্পূর্ণ সুস্থ সেই দৃষ্টি। অনীশ আনন্দে বলে উঠেছে,
--- কোথায় ছিলে তুমি, সুলগ্না? তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? আমি যে তোমার জন্যে কতকাল অপেক্ষা করছি!
এর কোন উত্তর দেয়নি সুলগ্না।। বরং ওর সেই পুরনো নিঃশব্দ হাসিই হেসে প্রায় শ্রব্যাতীত স্বরে বলেছে--- বিজয়িনী গল্পে নবনীতাকে তুমি জিতিয়ে দিয়েছো। ভালো করেছো। নবনীতারা বড্ড হেরে যায়। ভালো গল্প লিখেছো তুমি।... শুধু এতো মদ খেয়োনা... তোমাকে লিখতে হবে...
ছেঁড়া ছেঁড়া এইসব বলতে বলতে সুলগ্নার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়েছিলো। এরপর ক্রিমেটোরিয়াম হয়ে এ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্ট এ্যাটেন্ড করে একটা প্রেস মিটের পরে বাড়ি ফিরেছিলেন অনীশ বাগচি। কটাদিনে তিনি কেমন যেন একেবারে একজন বুড়ো মানুষ হয়ে গেছেন। মন আর শরীর একেবারে ঝুঁকে গেছে। এবার তিনি ওঠেন খাট থেকে। সকলের চোখ এড়িয়ে সদর দরজা বন্ধ করেন। পায় পায় চলে যান রেফ্রিজারেটরের কাছে। সেটা খুলে বিয়ার, হুইস্কি, রাম--- সবকটা ব্র্যান্ডের বোতল বের করেন। খুলে খুলে একে একে ঢেলে দেন বেসিনে। ড্রেন দিয়ে ফেনা কাটতে কাটতে মিক্সড এ্যালকোহল বয়ে যেতে থাকে বাইরে। পাড়ার মানুষ তার গন্ধে নানা স্থানে খুঁজে বেড়াতে থাকে এর উৎস। এবার বেডরুমে যান অনীশ। বিছানা পরিষ্কার করেন নিজে হাতে, যা তিনি জীবনে করেননি এই বাহান্ন বছর ধরে। সুলগ্নার একটা ফোটোগ্রাফ খুঁজে বের করেন। বাঁধাতে দিতে হবে। গোটা ঘরটা গত এক সপ্তাহে অগোছালো আর ধুলো ভর্তি হয়ে পড়েছিলো। চেষ্টা করেন সুলগ্নার মতো করে পরিষ্কার করতে। কাজ করেন আর বিড়বিড় করেন, আমার এ ঘর বহু যতন করে/ ধুতে হবে, মুছতে হবে মোরে...।
ধোয়া মোছা সব শেষ করে স্নান করেন, ধুতি বের করে পরেন আজ পঁচিশ বছর পরে। তারপর ঢোকেন সুলগ্নার ঠাকুর ঘরে যেখানে একটা দিনের জন্যেও অনীশ বাগচি ঢোকেননি আজ পর্যন্ত। আজ নিজে হাতে সব পরিচ্ছন্ন করেছেন। এবার ঠাকুরের সিংহাসন। একটি একটি করে বিগ্রহ নামিয়ে পরিষ্কার করেন নিজে হাতে। আজ ঘরে পুজোর ফুল নেই। বাগান থাকতেও তোলারও কোনো উপায় নেই কেননা এই দৃশ্য বড়ো বেমানান হবে এই অঞ্চলে। কিন্তু শুধু এইটুকুর জন্যে কি দেবদেবী অপেক্ষা করেন? হঠাৎ একটি বিগ্রহের তলা থেকে একটি পেপার কাটিং বেরোয়। তেল চিটচিটে, পুরনো কিন্তু সযত্নে রাখা পেপার কাটিং। সাবধানে তুলে নিয়ে পড়েন অনীশ, আর চম্‌কে ওঠেন। এটা তাঁরই সেক্স স্ক্যান্‌ডাল নিয়ে কাগজে বেরোনো নিউজ। কেটে রেখেছে সুলগ্না। এইদিনের পেপারটা বাড়িতে দেওয়া বারণ ছিল। ও অবশ্য কোনো জায়গা থেকে সংগ্রহ করেছিলো। কিন্তু কেনই বা কেটে রেখেছে সুলগ্না? উত্তর আজ মেলে না।
নিয়ম না জেনে নিজের মতো পুজো করলেন কট্টর সাহিত্যিক অনীশ। প্রদীপ জ্বাললেন, ধুনো জ্বাললেন, অনেক কষ্টে সুলগ্নাকে অনুকরণ করে সারা বাড়ি ধোঁয়া দিলেন। সব কাজ শেষ করে রেকর্ড প্লেয়ারটা মুছেটুছে কনক দাসের ডিস্কটাকে তাতে চাপিয়ে দিলেন। বেজে উঠলো, আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে...। এবারে ফোনটা তুললেন। আস্তে আস্তে মেয়ের নম্বর ডায়াল করলেন। অপরপ্রান্তে শোনা গেলো রিং হচ্ছে।
--------------------------

কোন মন্তব্য নেই: