তত্ব-তালাশ (একটি নিবন্ধ)
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়
গুণীজন সর্বদা ছাত্রসামজকে বলেন, বই পড়ো। আরো গুণীজন বলেন,
বই প’ড়লেই হবে না। ভালো বই পড়ো। মন্দ বই প’ড়ে অমূল্য সময় নষ্ট ক’রো না। সর্বোচ্চ গুণীজন বলেন, এই ক্রমবর্ধমান বইয়ের পৃথিবীতে সব সময় সবচেয়ে সেরা
বই পড়বে। এখন প্রশ্ন হ’লো, ভালো বই, সেরা
বই অথবা সবচেয়ে সেরা বই কী? ছোটরা কোথায় পাবে সেই সেরা বই? জানবে কী ক’রে, কোনটা সেরা বই? কে ব’লে দেবে? গুণীজনের পরামর্শ, একজন ভালো পাঠক, একজন শিক্ষক অথবা একজন
গ্রন্থকারীককে জিজ্ঞাসা ক’রে জেনে নাও।
তিনিই ব’লে দিতে পারবেন। কিন্তু প্রশ্ন হ’লো, তিনি যে কোনো উদ্দেশ্য প্রণোদিত হ’য়ে পরামর্শ দিয়ে ব’সবেন না, তার নিশ্চয়তা কী? উদেশ্য রাজনৈতিক হ’তে পারে, শ্রেণীভাবাপন্ন হ’তে পারে এবং আরো
নানা উদ্দেশ্য হ’তে পারে। তিনি
হয়তো অসৎ নন। কিন্তু তিনি তাঁর নিজস্ব ভাবনা, বিশ্বাস বা আদর্শ থেকে বেরিয়ে এসে যে
নির্মল পরামর্শ দেবেন, তা কে ব’ললো? দেখা গেছে, স্বয়ং জন্মদাতা পর্যন্ত সন্তানকে তাঁর নিজস্ব
মতাদর্শে পরিচালিত করেন। জন্মদাতা হ’লেই যে তিনি যথার্থ হবেন, তা ভাবা’র তো কোন কারণ নেই। এমতাবস্থায় সমরেশ বসু’র ‘বিবর’ অথবা ‘বারবধূ’ নিশ্চয়ই কোনো নবম শ্রেণীর একটি ছেলে বা মেয়েকে প’ড়তে পরামর্শ দেওয়া যায় না। সেটা প’ড়ে তার অভ্যন্তরে প্রবেশের বুদ্ধিবৃত্তি তার তো হবার কথা
নয়। অথচ ঐ রচনা দুটি অমূল্য। ফলে গণ্ডগোল আছে বই পড়াতে। তাই হয়তো যে সমস্ত বইয়ের
ওপর ভালোমন্দ পণ্ডিত ব্যক্তির লেখা নানা সমালোচনা’র বই প্রকাশিত হ’য়েছে, তা প’ড়ে বুঝে নেওয়া যেতে পারে, কোন বইটা বা বইগুলো সে বা তারা প’ড়বে। ফলে সমালোচনামূলক বইয়ের কদর এই পরামর্শে বেড়েই যায়। অনেক
মানুষ বাংলা ভাষা বা অন্যান্য ভাষায় রচিত নানা গ্রন্থের ভালোমন্দ সমালোচনা লিখে
কিঞ্চিত সুনাম সুখ্যাতি শুধু নয়, দু পয়সাও উপার্জনও ক’রেছেন। সমালোচনা কথাটিরই অর্থ তো নিন্দা নয়, বরং প্রশস্তিও
হ’তে পারে। তবে মুশকিল হ’লো, একটা সময় ছিল, যখন কোনো ক্রিটিক রবি ঠাকুরের অথবা প্রথম
সারীর অন্য কোন সাহিত্যিকের কোনো প্রকাশিত কোনো গ্রন্থের বিরূপ সমালোচনা ক’রতে সাহস পেতেন না। এমন প্রশংসা ক’রতে হ’তো, যেন প্রথম
সারীর সাহিত্য সৃষ্টিকারী সকলেই এক একজন সম্যক প্রফেট। তাঁদের কোনো ভ্রান্তি বা
বিভ্রান্তি হ’তেই পারে না। আবার
আজকাল ঐ সমস্ত সাহিত্যিকদের, বিশেষত রবি ঠাকুরের বিরুদ্ধে সমালোচনা লেখা একটা
বাতিক হ’য়ে উঠেছে। এটা লেখাই যেন একটা বিরাট
কৃতিত্ব।
তাই আমি আর কোনো কিছু ক’রি, আর না ক’রি--- আমি কোনো কবি-সাহিত্যিকের
বিরাগভাজন হ’তে চাই না। কোনো
একজন কবি বা গল্পকারের লেখা কোন কবিতা বা গল্পের কোনো সমালোচনা করার মধ্যে আমি
নেই। ‘ইনি ওইটা লিখেছেন, তিনি সেইটা লিখেছেন, খুবই
ভালো কাজ ক’রেছেন, অথবা এইখানটা এমন হ’লে ভালো হ’তো, সেইখানটা তেমন
হ’লে মন্দ হ’তো না অথবা ‘ভালো হ’তো আরো ভালো হ’লে’--- এসব ব’লে কোনো জীবিত সাহিত্যিক বা জীবিত নন, এমন কোন সাহিত্যিকের সম্মানীয় আত্মা’র কোনো প্রকার কোপে প’ড়তে আমি চাই না। আমার সেই দম নেই, জ্ঞানগম্যি নেই, অভিজ্ঞতাও নেই। ও তো ক’রবেন শিক্ষক। তিনি তাঁর ছাত্রছাত্রীকে তাদের স্নাতক অথবা
স্নাতকোত্তর শিক্ষা ক্ষেত্রে বোঝাবেন, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এ রোহিনী’র মৃত্যু’র জন্যে দায়ী কে,
অথবা বঙ্কিমবাবু কিম্বা ডি.এল. রায়-এর রচনায় পাশ্চাত্য প্রভাব কতটা প’ড়েছে... ইত্যাদি প্রভৃতি। কিন্তু জানলে অবাক লাগবে, শিল্প-
সাহিত্যের সমালোচকেরা কোন কিছু সৃষ্টি করেন না ব’লেই অপরের লেখা’র ক্রিমিকিট
অনুসন্ধান করেন। আসলে এটি জানলে আরো বিস্ময় লাগবে যে, বঙ্কিম বাবু লেখার সময় মোটেই
ভাবেননি, ‘রোহিণী’ কার জন্যে মৃত্যু বরণ ক’রলো অথবা রবি
ঠাকুরের ‘নিরুপমা’ সেকালে কী ক’রে এমন কথা তার
বাবা’কে ব’ললো, ‘আমি কি একটা টাকা’র থলি!’ সেকালে এমন কথা তো
বলার মতো কোন নারীর ক্ষমতা ছিল না। কিম্বা রামসুন্দর নিরুপমা’র সর্বনাশের জন্যে কতটুকু দায়ী। এসব কিছুই লেখক নিজে ভাবেননি।
এসব লেখকের একদিকে স্বপ্ন আর একদিকে বাস্তবকে দেখে একটা বমনক্রিয়া মাত্র যার শেয়ার
তিনি মানুষের সাথে ক’রতে চেয়েছেন। নিরুপমা
রবি ঠাকুরের স্বপ্নের চরিত্র। স্বতঃস্ফূর্তভাবে রচনাকালে এসব স্বতঃপ্রণোদিতভাবে নিঃসৃত
হ’য়েছে, তা-ই তাঁরা লিখেছেন। এসবের উত্তর
তাঁরাই জানেন না। এসব নিয়ে প্রশ্ন ক’রলে তাঁরা বরং অসন্তুষ্ট হ’তেন। এসব নিয়ে কচ্কচি
ক’রলে তাঁরা ক্ষুব্ধই হন।
আসলে শিল্প-সাহিত্য শিক্ষাপ্রদানের বিষয় নয়। রবি ঠাকুর
পণপ্রথা সম্বন্ধে সাধারণ মানুষকে কী শেখাবেন! প্রতিদিন, প্রতিপলে সাধারণ মানুষ এই
অভিশাপের শিকার। রবিঠাকুরকে কি পণ দেওয়া বা নেওয়া’র পাপ ক’রতে হ’য়েছিলো? জানি না। তিনি মুক্তিরও কোনো পথ বাতলে দিতে চান নি।
আমি মনে ক’রি, যদিচ সাহিত্য শিক্ষা’র উপায় হয়, তবে তা বড়ো জোর লোকশিক্ষা। ব্যস্। আর আমি তো
সাহিত্যে একজন একেবারে শিশু কর্মচারী, নবীন চর্চাকারী? আমি জানি, ভাগ ক’রে ভোগ ক’রলে আনন্দ বৃদ্ধি
পায়, আর বেদনা পায় হ্রাস। তাই আমি সাহিত্য নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার চেষ্টা ক’রি নিছক মানুষকে বিনোদনের অছিলায় আমার ভাবনা-চিন্তা’র ভাগ দিয়ে আনন্দ বা বেদনাকে ভোগ বা উপভোগ করার জন্যে,
পুরনো কথা নতুন ক’রে শোনাবার জন্যে
যা কিনা মানুষ ভুলে যেতে ব’সেছে, অথবা আমার
মস্তিষ্কে উদ্ভূত একেবারে নতুন কোন কথা মিষ্টি ক’রে বা ঝাল মিশিয়ে পরিবেশন করার জন্যে। একা কোনো কথা ভাবতে বা মানতে তো মন চায়
না। এটাই তো মানুষের বা শিল্পী’র বিশেষত্ব। তাছাড়া
আমি যদি এমন লেখা লিখি, যা সাধারণ মানুষের হয় মাথা’র ওপর দিয়ে চ’লে যাচ্ছে, নয়
তাঁর মাথা ধ’রিয়ে দিয়ে কান ঝাঁ
ঝাঁ ক’রিয়ে ছাড়ছে, তবে তাঁরা আমাকে বর্জন ক’রবেই। সে তার কাছের মানুষটিকে ডেকে চেঁচিয়ে ব’লবে, ‘শুনছো, এ যে আবার মাস্টারি
করে!’ ছাত্ররা মাস্টারি’কে কেবলমাত্র শংসাপত্র পাবার দায়ে ঠেকে উপরোধে ঢেঁকি গেলা’র মতো স’ইতে পারে, কিন্তু সাধারণ
মানুষ? নৈব নৈব চ। এমনিতেই বর্তমানে সাহিত্যের যে শনি’র দশা চ’লছে, তাতে কার ঘাড়ে
কটা মাথা আছে যে, একটা মূল্যবান নিবন্ধ বা প্রবন্ধ কোনো সাধারণ মানুষ, নিদেনপক্ষে
বাড়ি’র বাবা বা মা’কে প’ড়ে শোনাবে! তাঁরা তাকে
তো উন্মাদ ঠাওরাবে। ভাববে, কী সব ছাইপাঁশ লিখেছে! কাজকম্ম নেই। তাই আমি ব’লি, প্রবন্ধ লিখতে হ’লে এমন একটি বিষয় নিয়ে লেখা উচিত ব’লে আমি মনে ক’রি যা মানুষ ইতিপূর্বে
ভাবেনি, শোনেনি, কল্পনাও ক’রতে পারেনি। এবার ভাগ
ক’রে ভোগ ক’রতে হবে, ভাবাতে হবে, মাথা ঘুরিয়ে দিতে হবে। সমালোচনামূলক নিবন্ধ কদাপি নয়।
তাছাড়া আমি জানি, বঙ্কিমবাবু থেকে শুরু ক’রে জীবনানন্দ দাস পর্যন্ত কোন রচয়িতা কোন সমালোচককে আদৌ
পছন্দ ক’রতেন না। ভালো ব’ললেও না, মন্দতেও না। তাঁরা এ কথা তাঁদের নানা রচনায় লিখে
গেছেন। শিল্পও-সাহিত্যে যা কিছু ভালো, তা নির্মল। মানুষ তাঁকে কোন নিবন্ধ না প’ড়েই বুকে ক’রে রাখবে। যা মন্দ
সমালোচক তার হাজার প্রশস্তি গাইলেও তাকে মানুষ বর্জন ক’রবেই। সমালোচনা লেখকরা পছন্দ ক’রলে জীবনানন্দ লিখতেন না ‘বরং তুমিই লেখো না কো একটি কবিতা।/ ছায়াপিণ্ড দিলোনা উত্তর/ বুঝিলাম, সে তো
কবি নয়...’। ফলে আমি লাচার। রাত-বিরেতে পথেঘাটে
আমাকে চলাফেরা ক’রতে হয়। আমি প্রেতযোনি
বা আত্মায় বড়ো বিশ্বাস ক’রি, মানে ভয় পাই।
তাঁদের আপত্তি’র কারণ ঘটিয়ে
নিজের অমূল্য প্রাণটা আমি কোনপ্রকার সঙ্কটের মধ্যে ঠেলে দিতে চাই না। ঘর-কন্যা
নিয়ে আমি বেঁচে-বর্তে আছি, বাবা। পৃথিবী উল্টে যাক, পাল্টে যাক। আমার জান-টা যেন
থাকে। তাছাড়া কাগজ নষ্ট করার মতো কাজ আমিও একটু-আধটু ক’রি। আমার সৃষ্টি’র সমালোচনা কেউ ক’রুক, এটা আমি চাইও
না। আমার সৃষ্টি আমার সন্তান। সে ট্যারা হোক বা বোঁচা, উচ্চদন্তী হোক বা খর্বকায়---
সে আমার সন্তান। তাকে তুমি প্রেম ক’রতে চাও, করো। না
ক’রতে চাইলে ক’রো না। কিন্তু কোনো কথা হবে না। নিতান্ত যদি সে শারীরিক
কিম্বা মানসিক বিকলাঙ্গ হয়, তো আলাদা কথা। তবুও ভদ্রতা ভব্যতা বলে, কানাকে কানা,
খোঁড়াকে খোঁড়া বলা উচিত নয়।
তাছাড়া, এও আমি বিলক্ষণ জানি, এসব লেখালেখি নিতান্ত কর্মহীন
সময় যাপনমাত্র। এর কোনো প্রভাব কোনোকালে কারোর মধ্য পড়েনি, প’ড়বেও না। গোটা কাজটা ‘আমি খুব একটা কাজ ক’রছি’ দেখাবার উপায় মাত্র। আসলে কোনো একজন ইংরেজিতে লিখেছিলেন, ‘এ রাইটার ইজ ভেইন, লেজি এ্যান্ড সেলফিশ... ।’ আমিও প্রায় তাই মনে ক’রি। লিখে-টিখে আদতে কোনো লাভ নেই, কোন ফিড্ব্যাক নেই, কোন রিফ্লেকশান নেই। শুধুমাত্র
কাগজ কেনা, কলম কেনা আর ওদের অসহায়তা’র সুযোগ নিয়ে কালোয় সাদায় মাখামাখি করা। বড়োজোর ছাপিয়ে বের ক’রে রয়ালটি খাওয়া। সিংহভাগ মানুষ গাড়িতে কোথাও যেতে যেতে সময়
কাটাবার কারণে অগত্যা বই পড়ে। আজকাল আর তা-ও করে না। কানে ইয়ারফোন নামে একটা ঠুলি
এঁটে দ্যায় মোবাইল নামে একটি সর্বনাশা যন্ত্রের সাথে সংযুক্ত তার দিয়ে। গান শোনে।
তা গান, না গানের গুঁতো--- কে জানে! আর বাড়িতে সারাদিনের কাজ সেরে ক্লান্ত দেহে মেদসর্স্ব
গৃহবধূটি বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে বই পড়ে। শুধুমাত্র নিদ্রা দেবী’কে আমন্ত্রণ ক’রবার জন্যে তাদের এই পুস্তক প্রীতি। তারা মনেও রাখে না, কী প’ড়লো, কেমন প’ড়ল। বিশ্বাস না
হয়, ইন্টারর্ভিউ নিয়ে দেখুন। তারাও আজকাল বই-টই না প’ড়ে সংসার, পর্দা, বাথুরুম, বিছানা, পোশাক-আশাক, সাজসজ্জা---
ইত্যাদি’র তত্ব-তালাশ দেওয়া সাময়িকী পড়ে। সাহিত্য
নয়। তথাপি কিছু লোক অবশ্য বাড়িতে থাকে থাকে বই সাজিয়ে রাখে। তবে তা মানুষকে কেবল
দেখাবে ব’লে। মানা’র জন্যে নয়, ‘আমি খুব পড়ুয়া’ এটাকেই জাহির ক’রবার আপ্রাণ চেষ্টা। তারাই বইমেলায় যায় ব্যাগ ভর্তি বই কিনতে। বই পছন্দ ক’রতে নয়। লোককে দেখাতে হবে যে, আমি বই কিনছি, মানে আমি খুব
একটা সংস্কৃতিবান পড়ুয়া মানুষ হ’য়ে উঠেছি। যা প’ড়লাম, তা মানি, আর নাই মানি। প’ড়েছি। আমি কথায়-কথায় বই থেকে কোট ক’রতে ওস্তাদ। যিনি লিখেছেন, তাঁর মনে থাকুক, না থাকুক, আমার
মনে আছে, আমাকে মনে রাখতে হ’য়েছে, তিনি কোথায়
কী লিখছিলেন। আমাকে তো নিজেকে প্রগতিশীল প্রতিপন্ন ক’রতে হবে। আসলে বইমেলায় যে বই ডিসপ্লে করা হয়, তা তো মানুষকে
নিমন্ত্রণ ক’রবার জন্যে এবং বই
পছন্দ ক’রবার জন্যে, তার প্রকাশকের নাম টুকে
রাখবার জন্যে এবং পরে তা কোন বইয়ের দোকান থেকে সংগ্রহ ক’রবার জন্যে, তা জানে কত জনা! আসলে
আজকাল আগের মতো বড়ো বড়ো খোলামেলা দোকান নেই যে, বই ডিসপ্লে ক’রে রাখবে। এখন স্থানাভাব, আর তাই কাউন্টার বিক্রি’র যুগ। আপনি বইয়ের নাম বলুন, প্রকাশকের নাম বলুন, তবে বইটা
হয় গো-ডাউন থেকে, কিম্বা অন্য কোন স্টল থেকে অথবা খোদ প্রকাশকের ঘর থেকে আনিয়ে দেওয়ার
চল এখন। এসব মানুষ হয় জানে না, অথবা জেনেও পরে বই কেনা’র মানে হ’লো তো লোকে দেখলো---
আমি বইমেলায় এসেছি ফালতু ঘুরতে। কোন বই-টই কিনিনি। অর্থাৎ আমি খুব পড়ুয়া-টরুয়া নই---
এটা থেকে নিজেকে বাঁচানো। এ তো চ’লতে পারে না।
তাহলে ইম্প্রেশনের কী হবে! এমনকি আজকাল সংবাদ মাধ্যমগুলো পর্যন্ত বইমেলায় কত বই
বিক্রি হ’য়েছে, তার ওপর নির্ধারণ করে--- বইয়ের
কাটতি বাড়ছে, না কমছে কিম্বা বই পড়া বাড়ছে, না কমছে। তাছাড়া সেটা তো সেজেগুজে একটা
ফ্যাশান প্যারেড ক’রবার একটা ভালো
উপায়ও বটে। তাই লেখা যদি সার্থক হ’তো, তবে এ পোড়া
বাংলা তো ব’দলে যেতো। সুতরাং সেই বই নিয়ে এতো কচকচি
আমি ক’রতে চাই না। আমার হাতে কোন কাজ নেই। তাই
গপ্পো-টপ্পো লিখে সময় কাটাই।
আসলে সভ্যতায় বিজ্ঞানের অভিষেক হ’লে যে ভাবের বা ভাবনা’র স্রোতে ভাঁটা পড়ে, এবং তা প’ড়বেই--- এ কথা কেউ
মানে কি? বইয়ের আজ এই হাল তো হবেই। বিজ্ঞান অজ্ঞানকে কোন জিনিস সহজে, স্বল্পায়াসে
পেয়ে যেতে অথবা যেগুলো পাওয়া উচিত ছিলো, সেগুলোকে উড়িয়ে পুড়িয়ে দিয়ে একেবারে নতুন
অত্যাধুনিক কিছু একেবারে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’এর হাতে তালি দিয়ে পেয়ে যাবার মতো ঐন্দ্রজালিক উপায় ক’রে দ্যায়, আর তাতে ক’রে আমাদের মধ্যে সুকুমার হ’য়ে ওঠার
মাধ্যমগুলো যে একেবারে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে দেবার একটা নেশা জন্মায়। আজকাল
তো ছেলেমেয়েরা চিঠিপত্র লেখালেখি’র ধার ধারছে না।
মোবাইলের দৌলতে ওসব তো গেছে। সো-ও-জা ‘হ্যালো!’। শর্ট মেসেজের
যুগ আজ। তাও ‘শর্ট মেসেজ’ কথাটুকু বলার মতোও সময় নেই। তাই এস.এম.এস.। সেখানেও আরো শর্ট ব্যবস্থা। ‘Good night’
না লিখে লিখে দিচ্ছে ‘Gud nite’।
নস্টালজিক না হ’লেও বলা যায়, গোটা সভ্যতা-টা ব’দলে যাচ্ছে, চোট্কে
যাচ্ছে। আজকের প্রজন্মের কথাবার্তা-তেও তাই--- আমাদের ‘বাবা’ হ’য়েছেন আজকের ‘পা’ (ভাগ্যিস ‘লেগ’ ব’লছে না)। এরপর বই পড়া? ছোঃ! সে তো ওদের কাছে গোদের ওপর
বিষফোড়া। চুলোয় গেছে। সাহিত্য পাঠের কথা ব’ললে ছেলেমেয়েরা হাসে। ভাবে, এ কোথাকার পাগল! আজকাল ছেলেমেয়েরা আর ‘শ্রীকান্ত’ বা ‘পথের পাঁচালী’ পড়ে না, টেলিভিশনে দেখে বা রূপোলী পর্দায়। জানেই না, বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালি’ প’ড়লে তা সিনেমায় দেখার আর কোনো প্রয়োজন
থাকেই না। বরং একটু অপ্রিয় সত্য ব’ললে বলা যায় যে, ঐ
চলচ্চিত্র-টি নির্মাণ-এর কোন প্রয়োজনই থাকে না। বরং, সেটা নির্মাণ বাহুল্য মাত্র। বই
যা দ্যায়, তা সিনেমা দিতে পারে না। একটা দৃষ্টান্ত আনলে বোঝা যাবে--- অপু যখন তার
বাবা-মা’র সাথে নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে চ’লে যাচ্ছে--- বিভূতিবাবু এই জায়গায় দিদির স্মৃতিকে গ্রামে
ফেলে যাবার বেলায় অপুর যে বেদনা এঁকেছেন, তা কি চলচ্চিত্র নির্মাণ ক’রে অপু’র মতো একটি শিশুশিল্পী
কেন, বিশ্বের কোনো প্রথম সারির শিল্পী’র পেছন ফিরে কেবল একটা ‘লুক’ দিয়ে বা এক রিল শুট ক’রেও দেখানো বা বোঝানো সম্ভব? দায়িত্ব নিয়ে বলা যায়, না। সম্ভব নয়। ওটা লেখাতেই
সম্ভব। হৃদয়ের বেদনাকে টেনে নিংড়ে বের ক’রে আনা লেখাতেই সম্ভব। তাহ’লে চলচ্চিত্র হোক
কোন মৌলিক কাহিনি’র ওপর, অথবা কোন
সম্ভাবনাময় অথচ ‘হ’য়ে উঠতে না পারা’ কোনো রচনা’কে মাধ্যম ক’রে। বিভূতিবাবু কেন? বিভূতিবাবুই তো তাঁর পথের পাচালি’র চলচ্চিত্র নির্মাণ ক’রে দিয়ে গেছেন খোদ উপন্যাসে। এ কথা তো মানিক বাবু স্বীকারও ক’রেছেন।
কিন্তু ‘কা কস্য পরিবেদনা’। আমরা তো আছি আমরাতেই। না, এ কথা বলা যাবে না যে, গত
শতাব্দীর প্রথমার্ধে অথবা তারও আগে জন্ম নেওয়া ছেলেমেয়েরা তাদের হাতে একেবারে
রবীন্দ্র-শরৎ-বঙ্কিম কিম্বা তারাশঙ্কর, মানিক-দের সাহিত্য-টাহিত্য চাইলেই, অথবা তাদের
জন্মদিনে সুলভে পেতো। সে সময়কার অধিকাংশ বাবা বা মা অবশ্যই প্রগতিশীল বা
সংস্কৃতিবান ছিলেন না। তাই পাঠ্যসূচি বহির্ভূত বই ‘পড়ার জন্যে’ ছেলেমেয়েরা পেতো
না। বরং ব’ললে অত্যুক্তি হবে না যে, তারা যদি কোন
জায়গা থেকে কোনো বই সংগ্রহ ক’রে এনে পড়তো, তবে
তা লুকিয়ে প’ড়তে হ’তো। বাবা বা মা দেখলে ভয়ানক ব’কতেন, পড়া’র বই প’ড়তে বাধ্য ক’রতেন। কিন্তু সেই
সময়কার ছেলেমেয়েদের তো বিনোদনের কোন উপায় ছিল না। তাই বই। বাধ্য হ’য়ে বই। বাধ্য হ’য়ে চিঠি লিখতো ব’লেই লেখার হাত
একটু আধটু হাত তাদের হ’য়েছিলো। আজকাল তো
সে পাট নেই। ফলে কেন খামোকা এই ফাল্তু জিনিসটার ভালোমন্দ আলোচনা ক’রে সময় নষ্ট ক’রি!
তার চেয়ে অন্য একটা কথা ব’লবার চেষ্টা ক’রি। এতক্ষণ যা
লিখেছি, তা প’ড়ে পাঠক হয়তো ক্ষুব্ধ
হ’য়ে গেছেন। ভাবছেন, এই পাগলটা নতুন ক’রে আবার কী ব’লবে ব’লছে। এতক্ষণ কী যে আবোল-তাবোল ব’কে গেলো, কে জানে। আবার কোন কথা ব’লতে কোন কথা পেড়ে ব’সবে! কিন্তু দিব্যি ক’রে ব’লছি, আমি সিরিয়াসলি এবার সিরিয়াস কথা ব’লবো। অন্তত আমার দৃষ্টিতে তা সিরিয়াস। অবশ্য কেউ এর বিরূপ
সমালোচনা ক’রে ফেলতেও পারেন। আমি না হয় ছোটগল্প-এর
তত্ত্ব-তালাশের কথা ব’লতে চেষ্টা ক’রি। পারি, না পারি--- চেষ্টা তো ক’রি। এই ষাটোর্ধ বছর বয়সে যে টুকু প’ড়েছি বা লিখেছি, তা থেকেই টুকরো-টাকরা অভিজ্ঞতা শেয়ার ক’রি। যদি কারোর কাজে লাগে। লাগতেও তো পারে। যদি ‘কাজে লাগবে’ ব’লে ছিনাথ বউরূপি’র কেটে ফেলা লেজটার মতো কেউ বাক্সে তুলে রাখে।
ছোটোগল্প যে বাংলা, তথা গোটা বিশ্বের সাহিত্য জগতে একটা
বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে, এ বিষয়ে তো সকলেই একমত। নানা দেশে নানা লেখক
ছোটগল্প নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ক’রেছেন, অর্থাৎ ছোটগল্পকে ভেঙ্গেচুরে তার গঠন, চলন, চরিত্র, বৈশিষ্ট্য, ঐতিহ্য
ইত্যাদি নানাভাবে ব’দলে ব’দলে দেখেছেন, কেমনতরো লেখা গ্রহণ করেন পাঠক সমাজ। তাঁরা সাহিত্য
জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র। ‘মুনিনাঞ্চ মতিভ্রমঃ’ মানুষ গ্রহণ ক’রে নেয়। তাই মাইকেল “ক্যাপটিভ লেডি”তে ‘লেডি’ বানান লিখতে পারেন ‘Ladie’। কেউ তাঁর ভুল ধ’রবে না। তিনি সেটি ইচ্ছাকৃত ক’রেছেন। এটি তাঁর
বিশেষত্ব। আপনি-আমি ক’রলেই সাত খুন কেন,
এক খুনও মাফ হবে না।
আজকাল কিছু মানুষ ছোটগল্প লিখছেন, নানা সাময়িকীতে ছাপিয়ে
দেবার সুযোগও পাচ্ছেন। তাদের মধ্য কেউ কেউ কোনো কোনো পুরস্কার-টার পেয়েও যাচ্ছেন।
কিন্তু বাস্তবে তাঁদের সকলের রচনা সাধারণ মানুষ কিনছে না, প’ড়ছে না। গল্পগুলো এতোটাই ইঙ্গিতবাহী, এতোটাই সাজেস্টিভ,
এতোখানি দুর্বোধ্য যে, তা সাধারণ মানুষের বোধের মাথা’র ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, অথবা তারা তা প’ড়ে তৃপ্ত হ’তে পারছে না।
কিন্তু লেখক বই ছাপাতে পেরে, পুরস্কার পেয়ে, কয়েকটি মঞ্চে সাধুবাদ পেয়ে বর্তে
যাচ্ছেন। তাঁরা এ কথাও ব’লছেন, ‘আজ পর্যন্ত এতো গল্প-কাহিনি লেখা হ’য়েছে যে, আর নতুন ক’রে কিছু লেখার বিষয় নাকি অবশিষ্ট নেই। সব কথাই নাকি বলা হ’য়ে গেছে। আজকে যে গল্পই লেখা হোক না কেন, পূর্বে কোনো না
কোনো গল্পে তা পাওয়া যাবে। তাঁরা বলেন, এই কারণে এখন নাকি লেখকদের উচিত সাদামাঠা
ভঙ্গিমায় গল্প না লিখে একটু পরীক্ষার ঢঙে, সহজ-সরল ঢং-এ গল্প পরিবেশন ক’রে পাঠককে এতোটা বোকা না ভেবে বেশ প্রচ্ছন্নভাবে তাদের
বোধশক্তি’র ওপর ভরসা রেখে গল্প লেখা উচিত যেগুলো
বেশ কয়েকবার প’ড়তে হবে তাদেরকে।
একা লেখক কেন! পাঠকরাও একটু খেটে-খুটে বুঝে নিতে চেষ্টা করুক গল্পের বিষয় আশয়।
অল্পায়াসে নয়, কষ্টসাধ্য ক’রে আনন্দ পাওয়াতে
হবে।’ তাঁরা আরো ব’লছেন, ‘ছোটগল্পগুলো ছোট্ট
ছোট্ট করো। বেশী বাড়িও না। বড়োজোর সাতশো-আটশো শব্দ হ’লে ভালো হয়। মূল কাহিনীটাতে সোজা এসো। রসেবশে নয়, পাঠকের মাথায়
পেরেক ঠোকার মতো ক’রে ব’সিয়ে দাও। (বেচারা পাঠক) মানুষের হাতে অত সময় নেই। কেউ একটা
তিন হাজারি শব্দের গল্প প’ড়বে না। ছোটগল্প
অনেকটা পথ হেঁটে এসেছে। গত শতাব্দী’র কায়দায় গল্প
লিখলে নাকি পাঠকেরা নতুনের স্বাদ পাবে না, স্বাদ পেতে শিখবে না, তাদের মানসিক
উত্তরণ ঘ’টবে না।
এসব নিয়ে অনেক ভেবেছি আমি। গল্প লিখতে গিয়ে বার বার থেমে
গেছি। আমি কি দুর্বোধ্য অর্থাৎ ইঙ্গিতবাহী গল্প লিখবো? নাকি আমি তথাকথিত প্রাচীন
কায়দায় বেশ বৈঠকি মেজাজে রসে-বশে-ঝালে-অম্বলে লিখবো। যেহেতু গল্প রচনা জগতে আমি
তরুণ, সেহেতু একটা রাহা সিদ্ধান্তে আসতে আমার সময় গেছে। এই জীবনে অনেকটা দেখে, অনেকটা
প’ড়ে, অনেকটা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় ক’রে, জীবন দিয়ে ও প্রাকৃতিকভাবে অনেকটা পরিণত মানসিকতা লাভ ক’রে তবে এসব ক’রবো ব’লে আজ এতদিন পরে এতে হাত দিয়েছি। তাই
ওইসব পুরস্কার প্রাপ্ত লেখকদের কথাটা কিছুতেই আমার মনে গভীর স্থান নেয়নি। আমি একমত
হ’তে পারিনি। এই হ’তে না পারা তো আমার কোনো বই পড়া জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা নয়। এ
আমার জীবন দিয়ে অনুভূত প্রতিক্রিয়া, উপলব্ধি। তথাকথিত ইন্টেলেকচুয়াল লেখকদের মত ক’রে গল্প লিখে বাড়ি’র মা বোনেদের প’ড়িয়েছি, তাদের
মতামত গ্রহণ ক’রতে চেয়েছি।
কিন্তু হতাশ হ’য়েছি কারণ তাদের
কাছে আমার গল্প গ্রহণযোগ্য হয়নি। আমার এক স্বনামধন্য কবি বন্ধু আছেন। তিনি মাঝে
মধ্যে একটি-দুটি ছোটগল্প লেখেন-টেখেন। তাঁর গল্প তাঁর কবিতা’র মতই ইঙ্গিতবাহী, অস্পষ্ট। তিনি আমার গল্পের গুণগ্রাহী হ’লেও আমায় স্পষ্ট ভাষায় ব’লেছেন, ‘ছোটগল্প অনেকটা পথ
হেঁটে এসেছে, আর একই গঠনে তা থাকবে কেন? তাই আপনার গল্প একদিন ম’রে যাবে। কিন্তু আমি যে গল্প লিখছি, তাঁর কদর কোনদিন ম’রবে না।’ হয়তো তাই। তবে আমি
জানি, তাঁর গল্প পাঠ ক’রে হয়তো এক শ্রেনী’র পাঠক কপালের ঘাম মুছবেন। কিন্তু হায়! আমি এও জানি, তাঁর
গল্প বা কবিতা তাঁর স্ত্রী বা কন্যা কদাপি পাঠ করেন না। কেন? এ কার দায়? তাহলে তাঁর
গল্প লেখা কার জন্যে? ঘরের মা বোনেদের জন্যে, না পণ্ডিতদের জন্যে? নিশ্চয়ই
একমুষ্টি বোদ্ধা পাঠকের জন্যে? মা বোনেদের মতো সাধারণ পাঠক-পাঠিকা’র কাছে আমার গল্প দুর্বোধ্য বোধ হ’লে তো তাঁরা আমার রচনা বর্জন ক’রবেন, সাহিত্য থেকে কয়েক যোজন দূরে বিচ্ছিন্ন হবেন। আমি কি তখন
তাদের বুকে আমার হাঁটু চেপে ধ’রে বাঁশ দিয়ে তাঁদের
গলায় আমার সাহিত্য তোতা পাখিটি’কে শিক্ষা
প্রদানের মতো প্রবেশ করাবো? তাঁদেরকে কি আমি ইন্টেলেকচুয়াল পাঠক বানিয়েই ছাড়বো? ভেবে
দেখেছি, অন্তত আমি তা পারবো না। আমি যে কথাটা ব’লতে চাই, যে কথাটা শেয়ার ক’রতে চাই, তা শেয়ারারদের
মতো ক’রে পরিবেশন না ক’রলে তো ঘাটতি আমার, ত্রুটি আমার। আমি তাঁদেরকে শোনাতে পারি নি
আমার কথা। একজন পণ্ডিত রাজনৈতিক নেতা যদি একটি স্থানে এসে সেই রাজনৈতিক দলের
প্রচার কাজে সে অঞ্চলের মানুষের মতো ক’রে প্রচার ক’রতে না পারেন, আর
তাঁর কথা যদি মানুষ বুঝতে না পারে, তবে সে দায় কার? এই কারণেই চণ্ডিদাস থেকে শুরু
ক’রে কৃত্তিবাস ওঝা পর্যন্ত অধিকাংশ
সৃজনশীল মানুষ সাধারণের বিচারবোধ লক্ষ্য ক’রেই তাদের রচনাকে সহজ সরল আর সাবলীল ক’রে নিবেদন ক’রেছেন। মাইকেল
অভিধান ঘেঁটে ঘেঁটে নানা শব্দ অলঙ্কারের স্বার্থে, ছন্দের স্বার্থে, মুর্ছনা’র তাগিদে একটি বিশেষ গবেষণা ধর্মী রচনাশৈলী বাংলা সাহিত্যকে
উপহার দিয়েছেন বটে, যার নাম ‘অমিত্রাক্ষর ছন্দ’। তিনি এমন কাজ ক’রে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমরত্ব লাভ ক’রেছেন অবশ্যই, তিনি কাব্যে পণ্ডিত অবশ্যই। কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষের কী হ’লো? তারা তো তাঁর রচনা থেকে বিচ্ছিন্ন। এ দেশের সাধারণ মানুষ
তাকে গ্রহণ ক’রতে পারেনি। তাঁর
রচনার পাঠক নেই। পাঠক তাঁকে চায়নি নয়। চাইতে পারেনি। তাকে মানুষ ভয় পায়। কারণ তাঁর
দুর্বোধতা, তাঁর কাঠিন্য, তাঁর শব্দকল্পদ্রুম। অথচ আজ প্রায় সাতশো বছর ধ’রে বাঙ্গালির মনে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’এর পরিবর্তে ‘শ্রীরাম পাঁচালি’র বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে আর তারই কল্যাণে বেঁচে আছেন কৃত্তিবাস ওঝা। এ দায় বা
কৃতিত্ব কার? কেন এক বিশেষ শ্রেণীর বোদ্ধা পাঠক ব্যতীত সাধারণ মানুষ তাকে বরণ ক’রতে পারেনি? এটি একটি বিরাট প্রশ্ন।
স্বামী বিবেকানন্দ নিজে সাহিত্যিক না হ’লেও একটি প্রবন্ধে তিনি যা লিখেছিলেন, তার একটি সহজ তর্জমা
ক’রলে এমনটি দাঁড়ায়--- একটি রচনায় যখন
রচয়িতা ভণিতা, শব্দ, অলঙ্কার, ভাষা, ব্যাকরণের জটিলতা সৃষ্টি করেন, তবে বুঝতে হবে
যে, তিনি তাঁর কথাটিকে সাধারণকে বুঝতে দিতে চান না অথবা তাঁর বোঝাবার মতো তেমন
মূল্যবান কোনো ভাব তাঁর নেই। তাই অমন কাঠিন্য বা জটিলতা’র আমদানি। আসলে ভাষা হ’ল ভাবের বাহক। ভাব আগে, ভাষা পরে। ভাব ছাড়া ভাষা’র কোন তাৎপর্য নেই। সুতরাং ভণিতা বা ভাষা’র প্রাধান্য দিতে গিয়ে, রচনাশৈলীকে অভিনব ক’রে তুলতে গিয়ে পাঠকদের দিকটি বিবেচনা’র বাইরে রাখলে চলবে না। নতুনত্ব ভালো, তবে তা যেন
স্পষ্টতাকে ঢেকে না দ্যায়।
বিপুল বোদ্ধা লেখকদের রচনাধর্ম যদি বিচার করা যায়, তবে তাঁদের
কথা’র মধ্যে বেশকটি স্ব-বিরোধী বিষয় লক্ষ্য
করা যায়। তাঁরা ব’লেছেন--- আজ পর্যন্ত
এতো গল্প-কাহিনি লেখা হ’য়েছে যে, আর নতুন
ক’রে কিছু লেখার বিষয় নাকি আর অবশিষ্ট নেই।
সব কথাই নাকি বলা হ’য়ে গেছে। আজকে যে
গল্পই লেখা হোক না কেন, প্রকাশিত কোনো না কোনো গল্পে তা পাওয়া যাবে।... আমি জানি
না, তাঁদের মন্তব্য যথার্থ কিনা। কিন্তু সত্যিই সব কথা কি পাঠককে বলা হ’য়ে গেছে? সব কথা কি বলা এক সময় হ’য়ে যায়? এই যে এতো ছেলেমেয়ে কলর কলর ক’রতে ক’রতে স্কুল বা
কলেজের পথে যায়, যাদের একের সাথে অপরের নিত্য সাক্ষাৎ হয়, তাঁদের কি সব কথা বলা হ’য়ে যায়? কোন কথা কি বাকি থাকে না? পৃথিবীর কত শত কোটি মানুষ
তাঁদের প্রেমিকাকে ‘আমি তোমাকে
ভালবাসি’ ব’লেছে। তার অর্থ কি এই যে, এবার থেকে নতুন ঢঙে, নতুন ভাষায় আর নতুন ভণিতায় ভালবাসা’র কথা ব’লতে ববে? ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ বলাটা প্রাচীন, অচল, অব্সলিট? এ যেন সেই ‘সেলফিশ জায়েন্ট’এর তার বন্ধু কর্নিশ
অগারের সাথে সব কথা সাত বছরে ফুরিয়ে যাবার মতো। তাঁরা আরো বলেন--- এই কারণে এখন
নাকি লেখকদের উচিত সাদামাঠা ভঙ্গিমায় কমন কথা বা বলা-হ’য়ে-যাওয়া কথা দিয়ে গল্প না লিখে একটু পরীক্ষার ঢঙে, পাঠককে
এতোটা বোকা না ভেবে একটু প্রচ্ছন্নভাবে তাদের বোধশক্তি’র ওপর ভরসা রেখে গল্প লেখা, যেগুলো বেশ কয়েকবার প’ড়তে হবে তাদেরকে, একটু ঘাম ঝরাতে দিতে হবে। একবারে সোজাসুজি
তাঁদের কাছে সব স্পষ্ট করা যাবে না।... তার অর্থ এই যে, একজন লেখক আর শিল্পী না
থেকে বিজ্ঞানী বা গবেষক হ’য়ে উঠুক পি.এইচ.ডি. পাবার জন্য। কে কত প্রচ্ছন্ন ক’রতে পারেন, সেই প্রতিযোগিতা চলুক। কিন্তু সাহিত্য একপ্রকার
বিজ্ঞান বটে, তবে তা মানব মনের না বলা, না ভাবা, না অনুভব করা নানা ব্যাখ্যাতীত
বিষয়কে কেন্দ্র ক’রে চর্চা করা’র বিষয়।। সাহিত্যিক মানুষের হৃদয়টি (হৃদযন্ত্রটি নয়)
সন্তর্পণে তুলে এনে তার খাতা’র পাতা’র ওপর রেখে তাকে সাবধানে পর্যবেক্ষন করেন। পরীক্ষা নয়,
নিরীক্ষা করেন। পাঠককে হাসান, কাঁদান, ভাবান, সান্ত্বনা দেন, সাহস দেন, রাগতে উদ্বুদ্ধ
করেন, কঠিন হ’তে বা ক্ষমা করার
কথা বলেন। রচনা’র স্টাইল নয়, বলা’র ইচ্ছে, মানসিকতা আর পাঠকই প্রধান। শিল্প শিল্পী’র মনের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবনা’র প্রকাশ মাত্র। কোন পরিকল্পনা বা যোজনা’র প্রকাশ নয়। তার জন্যে সাহিত্যকে ব্যবচ্ছেদ ক’রতে নামতে হয় না বা পরিবর্তনের জন্যেই পরিবর্তন ক’রতে হয় না। আজকে একটা দেশপ্রেমের গল্প লিখবো, এমন একটা
চরিত্র এতে সৃষ্টি ক’রবো যার এমন
ডায়মেনশন, তেমন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হবে যে মানুষের তাক লেগে যাবে--- এমন পণ ক’রে কোন কাহিনীকার জীবনে কোনো কাহিনি রচনা করেননি। পরিবর্তন
করা তো দূর। প্রকৃতপক্ষে পরিবর্তন ক’রতে হবে কিনা, এটি পাঠকই নিশ্চিত ক’রে দেবেন। কেননা সাহিত্যের লেখা তাঁদের জন্যেই। তাঁদের পঠন-পাঠনের ওপর বেঁচে
থাকে সাহিত্য ও সাহিত্যিক। জনতাই তো জনার্দন। আজকের এক শ্রেণীর লেখক বা সমালোচক এ
কথাও বলেন--- একা লেখক কেন! পাঠকরাও একটু খেটে-খুটে বুঝে নিতে চেষ্টা করুক গল্পের
বিষয় আশয়।... ছোটগল্পগুলো ছোট্ট ছোট্ট করো। বেশী বাড়িও না। বড়োজোর সাতশো-আটশো শব্দ
হ’লে ভালো হয়। মানুষের হাতে অত সময় নেই।
কেউ একটা তিন হাজারি শব্দের গল্প প’ড়বে না। গত
শতাব্দী’র কায়দায় গল্প লিখলে নাকি পাঠকেরা নতুনের
স্বাদ পাবে না, স্বাদ পেতে শিখবে না, তাদের মানসিক উত্তরণ ঘ’টবে না। আমি ভাবি, তাঁরাই তো ব’লছেন পাঠককে নাকি বোকা ভাবা’র কোন কারণ মেই। তাঁরা নাকি বোদ্ধা। তাই যদি হবে, তবে তাঁদেরকে খাটাবার বা
শেখাবার চেষ্টা কেন? তাঁরা কি ছাত্র? তাঁদের হাতে যদি তিন হাজারি শব্দের গল্প প’রবার মতো সময় না থাকে, তবে একটি কঠিনতায় ভারাক্রান্ত গল্প
তাঁদের বার বার প’ড়ে তার মর্ম বিষয়ে
যাবার সময় কোথায়? আমি ব’লি, সাহিত্যিক একজন
মাস্টারমশাই নন যার হাতে একটি তেল মাখানো বেত র’য়েছে। তিনি বিনোদন করেন মানুষের ভারাক্রান্ত জীবনে। তার মাধ্যমে নিজের
ভাব-ভাবনাকে সামান্য শেয়ার করার প্রচেষ্টাই তো শিল্প-সাহিত্য। এসব পাঠশালা নয়।
সাধারণ মানুষের ক্লাশ নেবার দায় তো লেখকের নয়। আমি কত বড়ো বুদ্ধি’র মানুষ, আমি কত কঠিন কথা ব’লতে পারি, এসব প্রকাশের উপায়ও তো সাহিত্য-কাব্য নয়। একটা বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়ে পুরস্কার
পাওয়াও তো সাহিত্যিকের লক্ষ্য হ’তে পারে না। একটি
লেখা বিপ্লব ঘটিয়ে দেবে কিনা, সেটা সময় ব’লবে। লেখক নয়। নিজের লেখাকে শত বছর বাঁচিয়ে রাখা’র পরিকল্পনা ক’রেও তো একটি সাহিত্য সৃষ্টি হ’তে পারে না। যে
টেকার, সে আপনি টেকে। ডেকাড্রন ডোজ দিয়ে জোর ক’রে টিকিয়ে রাখা যায় না। এ তো সাহিত্যিকের হৃদয়ের মধ্যে বুদবুদ হ’য়ে উঠে বেরিয়ে আসা’র চেষ্টায় ভাবনা’র প্রকাশ মাত্র। পরিকল্পনা
ক’রে সাতশো কিম্বা আটশো শব্দের বাউন্ডারি
টেনে দিলে তো সেটা আর শিল্প থাকে না। একটা বক্তিমে হ’য়ে যায়। সংক্ষিপ্ত বক্তিমে। তাই তাঁদের পরামর্শ এই যে, ছোটগল্পে
কোনো চিত্রণ থাকবে না, কোনো বর্ণন থাকবে না। এ তো সেই গরু’র পশ্চাতে সজোরে ইনজেকশনের ঠুসে দেবা’র পরামর্শ। চিকিৎসকও সুচ ফোটাতে গেলে একটু আঙ্গুল বুলিয়ে,
স্পিরিট দিয়ে, সামান্য চেপে ধ’রে ইন্দ্রজালের
মতো আচমকা সুচ ফোটানোর কাজটি করেন। রোগী যেন টের না পায় যে, সুচ ফুটলো। আর এ তো
সাহিত্য।
তাই সাধারণত ছোটগল্পের প্রচলিত অথবা এ বিষয়ে সাহিত্যের
মুনি-ঋষিদের নির্দেশিত পথেই নবীন গল্পকার হিসেবে আমি চ’লতে চেষ্টা ক’রি। বিপ্লব ঘটিয়ে দিতে নয়। এ বিষয়ে সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ-এর নির্দেশিত পথ
সম্বন্ধে প্রায় সকলেই অবহিত। সে প্রসঙ্গ উত্থাপন করা বাতুলতা। কিন্তু লক্ষ্য ক’রলে দেখা যায় যে, তাঁর ছোটগল্পের বিপুল সম্ভারে এমন একটিও
ছোট গল্প নেই, যেটি সাধারণ একজন গৃহবধূ’র বোধের পক্ষে দুঃসাধ্য হ’য়ে ওঠে। হয়তো তার
মধ্যে গভীর কোন তত্ত্ব লুকিয়ে আছে, কিন্তু আপাতভাবে তার একটি সহজ সরল আবেদনও আছে।
অর্থাৎ তিনি মানুষের সাহিত্যিক হ’তে চেয়েছেন। পণ্ডিতের
নয়। পণ্ডিত তো সবই জানেন। সাহিত্যিকের তো তাঁকে ভাবিয়ে দেবার কোনো দরকার নেই, দায়ও
নেই। পণ্ডিত নিজের ভাবনা নিজেই ভাবতে পারেন। অন্যথায় তাঁকে নেমে আসতে হবে সাধারণের
দরবারে, সাধারণের গায়ে গা ঠেকিয়ে, সাধারণের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে তাঁকে বাঁচতে হবে।
নিজের উচ্চ মঞ্চে ব’সে উঁচু থেকে উঁচু
উঁচু সাহিত্য প’ড়তে আর তার
ভালমন্দ বিচার ক’রে দেবার মতো
মাস্টারি ক’রতে হবেনা। ওটা বিদ্যালয়ে, মহাবিদ্যালয়ে
বা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক মশাইরা করুন। ওটা তাঁদের জীবিকা। তাঁদেরকে ভাতে মারা’র কোনো দরকার তাদের নেই। অনেকে কোন একটা কিছু রচনা ক’রে, নিজের গ্যাঁটের কড়ি ব্যয় ক’রে ছাপাতে দিয়ে কোন একজন বিপুল বোদ্ধাকে সমালোচনা ক’রে দিতে অনুরোধ করেন যাতে সেটি ছাপিয়ে দিয়ে তিনি খুব একটা
দারুণ কিছু রচনা ক’রেছেন, সেটা প্রতিপন্ন
ক’রতে চান। এসব তো চমক, গিমিক, প্রচার
মাত্র। বিচারক তো পাঠক। অপণ্ডিত পাঠক। সাধারণ পাঠক পাঠিকা।
আমি ব’লতে চাই, ছোটগল্প
রচনা’র সেই প্রাচীন নির্দেশিত পথ থেকে এতকাল
পরে আজ সামান্য স’রে এসে ছোটগল্প লেখা
যাবে কিনা, তা পরীক্ষাচ্ছলে নয়, প্রয়োজনে প্রয়োগ করা যাবে কিনা, তাকে নিতান্ত
প্রয়োজনে একটু অত্যাধুনিক রূপ দেওয়া যাবে কিনা, ‘অত্যাধুনিক রূপ’ ব’লতে যদি একটু প্রচলিত বা সময়োপযোগী ক’রতে বাধ্য হ’তে হয়, তবে পাপ হবে
কিনা, অপরাধ হবে কিনা--- এসব পাঠক ব’লবে? স্বতঃস্ফূর্তভাবে যদি এমনটা ঘটেই যায়, তবে কেউ মানবে কিনা, সেটা আসল কথা
নয়। পাঠক পছন্দ ক’রছে কিনা, এটাই
মুল কথা। মোট কথা, কোনো ব্যাকরনকে মাথায় রাখা যাবে না। তবে মূল বিষয়টাতে ঋষিগণ যে
পথ দেখিয়েছেন, তা থেকে স’রে আসার কোন গোঁয়ার্তুমিতে
আমি নেই। পরিবর্তনের জন্যেই পরিবর্তন নয়। বাংলা সাহিত্যের তারাশঙ্কর, আশাপূর্ণা
দেবী, এমনকি পরবর্তীকালীন সুচিত্রা দেবী’র লেখা পর্যন্ত লক্ষ্য ক’রলে যে সহজ সরল ঢং
বা ভঙ্গিমা আমরা দেখতে পাই, অথচ তার মধ্যে থাকে একটি সামাজিক, রাজনৈতিক বা
মূল্যবোধগত নানা নতুন বা মানুষের ভুলে যাওয়া প্রাচীন লোকশিক্ষা’র অনুরণন স্পষ্ট হয়, তাই অনুসরণ ক’রে যেতে হবে ব’লে আমার মনে হয়। মূল কথাটা হ’লো, পাঠককে লক্ষ্য
ক’রে যদি গল্প লেখা যায়, আমার পাঠক কারা,
কাদেরকে পাঠক হিসেবে আমি চাই, তাঁরা কী মানের, তাঁরা কত বইপত্র পড়েন, কোথাকার
বইপত্র পড়েন, গল্প-উপন্যাস সম্বন্ধে তাদের ধ্যান-ধারনা কী--- ইত্যাদি বিষয়গুলো যদি
প্রধান স্থানে রেখে, নিজেকে উচ্চ স্থান থেকে নামিয়ে এনে সাধারণের মাচায় স্থাপিত ক’রে গল্প লেখা যায়, তবে সাফল্য নিশ্চিত। ‘সাফল্য’ ব’লতে আমি কোন এ্যাওয়ার্ড পাবার কথা ব’লছি না। এ্যাওয়ার্ড যে রচনাটি পায়, তা ক্লাসিক অর্থাৎ ধ্রুপদি
রচনা। কিন্তু দেখা যায়, সাধারণ মানুষ তা পড়ে না, বা তার মূলে যাবার ইচ্ছে, সময় বা
ক্ষমতা কোনটাই তাঁর থাকে না। তবে আর সেই গ্রন্থের জনপ্রিয়তা কোথায়? কতজন অরভিন্দ
আতিগা’র ‘দ্য হোয়াইট টাইগার’ প’ড়েছে? তাহলে তাঁকে কেবলমাত্র পাঁচজনের বিচারে বুকারটি পেয়েই
খুশি থাকতে হবে। তবে আর লেখকের মূল্য কোথায়? একটি লেখা যদি মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হ’য়ে যায়, তবে সেই লেখকের হয়তো খাতা-কলমে অনেক নাম, তবে সেই
খাতা-কলম পোকায় খায়। যে বইটি ‘বেস্ট সেলার’ পায়, তা কোনদিন এ্যাওয়ার্ড পায় না, পাবেও না। অনেক গ্রন্থ
আছে তো কোন আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাবার মতো পাণ্ডিত্য সম্পন্ন নয়। কিন্তু তা যে
কোন বইয়ের বিক্রয়কে অতিক্রম ক’রেছে। অপরদিকে আমাদের
সাহিত্যিক মানিক বাবু তো না খেয়ে ম’রেই গেলেন। কেন?
তিনি তো উচ্চ মানের কাহিনি সৃষ্টি ক’রতে চেয়েছিলেন। অবশ্যই তাঁর রচনা অতি উচ্চ মানের। কিন্তু তাঁর ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ কে কে প’ড়েছে? হলপ ক’রে ব’লতে পারি, অন্তত
আমার মিসেস তো পড়েন নি। পণ্ডিতের গা ঘামাবার জন্যে তা গ্রন্থাগারের শেল্ফ-এ শোভা
পায়, ধুলো খায়। আর তাঁর সৃষ্টিকর্তা একদিন না খেয়ে ম’রে যায়।।
তাই একটি ছোটোগল্প রচনাকালে খোলা মনে কলম চালাতেই আমি
পরামর্শ দেই, তুমি একাধারে একজন প্রতিবেদক, একাধারে একজন চিত্রকর। বাইরের আর
ভেতরের উভয় দিকের প্রতিবেদন ও চিত্র তোমাকে দিতে হবে। তাতে কত শব্দ হ’লো, কটা চরিত্র হ’লো, হিতোপদেশ এসে প’ড়ল কিনা, বর্ণনা’র ঘনঘটা ব্যাকরণকে ব্যাহত ক’রলো কিনা--- এসব আগেভাগে ভাবা’র কোন দরকার নেই।
যতটুকু লিখে আনন্দ পাও, যতটুকু আপনি এসে লেখাটিকে ভরিয়ে তোলে, ততটুকুই লেখো। কোন
পণ্ডিতের কথাকে মেনে নয়। লেখা’র পরে নিজে তা প’ড়ে নিয়ে ছোট বড়ো সংশোধন ক’রে নিজের ভালো লাগছে কিনা, তা পরীক্ষা’র জন্যে দিন কয়েক পরে একবার প’ড়ে নিলেই হ’লো। শুধু মনে রাখতে হবে, এটা ছোটগল্প। তাই এর পরিসর অবশ্যই
ছোট হবে অর্থাৎ ছোট করার প্রাথমিক লক্ষ্য মাত্রা স্থির ক’রতে হবে। তাই মানুষের জীবনে ছোট ছোট নানা দুঃখ, বেদনা, সুখ,
আনন্দ, হতাশা থাকে তাদের একটিকে বেছে নিতে হবে। অনেকগুলো নয়। শুধু ছোট্ট গঠন
দেওয়াই তো ছোটগল্প নয়। আসলে ব্যাকরণ পরিহার ক’রতে হ’লে ব্যাকরণ তো জানতে হবে। আরো মনে রাখতে
হবে, যেন কোনো প্রসঙ্গ, কোন অনুচ্ছেদ, কোন বাক্য, এমনকি কোন শব্দ পর্যন্ত অকারণে
কেবল বৃহদাকার দেবার জন্যে অথবা স্বাধীনতাকে স্বেচ্ছাচারীর মতো ব্যবহার ক’রলে চ’লবে না। নিজের
দৃষ্টিতে গল্প সমাপ্ত হ’লে অচেনা কাউকে
দিয়ে একবার প’ড়িয়ে নিতে হবে।
তাঁর ভালো লাগছে কি? সে বা তিনি অবশ্যই কোন পণ্ডিত নন, বিশেষজ্ঞ নন। সাধারণ মানুষ।
বিরাট মাপের কোনো পাঠক-টাঠকও নন। একেবারে সাদামাঠা মানুষ। তিনি বলবেন, যে কথা তুমি
তোমার গল্পে প্রকাশ ক’রতে চেয়েছো, তা স্পষ্ট
কিনা, মজাদার অথবা হৃদয়স্পর্শী হ’লো কিনা। মানুষ প’ড়বার জন্যে এইগল্প অর্থ দিয়ে কিনবে কিনা। শিল্প’কে বিক্রয়যোগ্য ক’রতে হবে। একজন বিনা মাগনা গল্প পেলো আর প’ড়লো, এটা কোনো বিষয় নয়। পাঠক পড়া’র জন্যে স্বোপার্জিত অর্থ, যা সে মনে প্রাণে ভালবাসে, তা ব্যয় ক’রতে চায় কিনা, জানা জরুরী। বিক্রয়যোগ্যতা কথাটির কিন্তু
বিপদ আছে। বটতলা’র লেখা কিন্তু
দারুণ বিকোয়। সেটা অবশ্যই সাহিত্য নয়। ওগুলো একজন হতাশের জৈবিক ক্ষুধা নিবৃত্তি
করে মাত্র। তোমার কাহিনি একটি সুরুচিকর একটি কাহিনি হ’য়ে উঠলো কিনা, ব’ড়োদের প’ড়তে দিতে পারবে
কিনা কিম্বা ছোটোদের মনে এই গল্পের কোনো বিকৃত প্রভাব প’ড়বে কিনা--- এসব ভাবলেই চ’লবে। কোনো শিল্পীই চাইবেন না, তাঁর সৃষ্টি স্বল্পসংখ্যক মানুষ জানুক। তিনি
পুরস্কার-টুরস্কার পেয়ে গল্পকে পাঠিয়ে দিন ঠাণ্ডা ঘরে। তোমার গল্পটি হয়তো রবি
ঠাকুরের নির্দেশিত ছোটোগল্পের নানা বৈশিষ্ট্য অনুসরণ ক’রতে পারলো না। সে তো অনেকেই অনুসরণ করেন নি। ছোটগল্প
সম্বন্ধে এমন প্রেসক্রিপশন তো নানা মানুষ নানা সময়ে নির্দেশ ক’রেছেন। তাও তো যথার্থভাবে মানা হয়নি। গল্পকার প্রয়োজনের
তাগিদে ইম্প্রোভাইজ ক’রেছেন। এমনকি বর্তমানে
গল্পের ভাষা ব্যবহারেও অত্যাধুনিকীকরন হ’তে পারে। অর্থাৎ যদিও গল্পটি বাংলা ভাষায় রচিত, এবং এর মধ্যে নিতান্ত প্রয়োজন
ছাড়া ইংরেজি শব্দের অনুপ্রবেশ অবাঞ্ছিত লাগতে পারে, তথাপি আজকের পথেঘাটে,
হাটেবাজারে যেভাবে কথায় কথায় বাংলা’র মধ্যে ইংরেজি শব্দের
প্রয়োগ মানুষের মুখের ভাষায় প্রবেশ ক’রছে, তেমনই ঘ’টতে পারে আজকের
ছোটগল্পে। এমনকি ঊনবিংশ শতকে রচিত কোনো ছোটগল্পে হয়তো কোন বিপদসীমা অতিক্রান্ত
আবেগঘন দৃশ্য বর্ণিত হ’তো না। রবি ঠাকুর
অথবা শরৎচন্দ্র হয়তো কোন শয্যাদৃশ্য গল্পে দেবা’র প্রয়োজন বোধ করেননি, কিম্বা সেকালে তা অলিখিত নিষিদ্ধ ছিলো। তুমি নিঃসঙ্কোচে
তা আঁকতে পারো। তবে অকারণে নয়, রগ্রগে ক’রে নয়। নিষিদ্ধ বা অশ্লীল ব’লে কিছু নেই।
কতটুকু প্রয়োজন আর কতটুকু মশলা, তার ওপর নির্ভর করে শ্লীল-অশ্লীল--- এটাই বিচার ক’রতে হবে। এ ছাড়া একটি ছোটগল্প সহসা শুরু হবে কিনা, ‘শেষ হ’য়ে হইলো না শেষ...’ থাকবে কিনা--- এসব নির্ভর করে গল্পটা গ’ড়ে ওঠার পরে, ঠিক যেমন ক’রে মৃৎশিল্পী প্রতিমা গড়েন। ক্রমে ক্রমে কাঠামো, মৃত্তিকা প্রলেপন,
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গঠন, এরপর তার বাস্তব রূপদান, তার পর রং, সাজসজ্জা, আবরণ ও আভরণ
প্রদান ইত্যাদি... ঠিক তেমন ক’রেই ক্রমশ এগোতে
হবে। কী হবে--- সে উত্তর তো দেবে ভবিষ্যৎ। প্রথমে বাড়ির মানুষের এবং পরে কোনো
অপরিচিত পাঠকের ভালো লাগার ওপর তা নির্ভর ক’রবে। গল্প রচনায় শব্দ সংখ্যা নিয়ে মাথা ঘামাবার কোনো দরকার নেই। বাংলা
সাহিত্যে অনেক ছোটগল্প আছে যার শব্দ সংখ্যা চার হাজারের ওপর। তবে অনাবশ্যক কলেবর
বৃদ্ধি নয়, প্রয়োজনে তিন হাজার, সাড়ে তিন হাজার শব্দ হ’তেই পারে যদি তা পাঠককে গল্পে বেঁধে রাখতে পারে। শুধু একটু
শৈলী চাই। একটা ভীষণ রকম পরিণাম গল্পে আনতে গেলে পাঠকের মনটা একটু নরম, একটু সহজ, একটু
আবেশে আচ্ছন্ন ক’রে দিতে হয় যাতে আঘাতটা
বেশ জোরে এসে পড়ে। তাই একটু অন্যদিকে তার নজর ঘুরিয়ে নিয়ে সোজা এসে প’ড়তে হবে ভয়ঙ্কর পরিণামটাতে। তাতে আঘাতটি অপ্রত্যাশিত ও
অভাবনীয় বোধ হয়। অবশ্যই মনে রাখতে হয়, যেন প্রতিটি চরিত্র তার ভূমিকা পালনের আগে
বা পরে যেন তার অবয়ব নিয়ে পাঠকের সামনে উপস্থিত হ’তে পারে, পাঠক যেন তাকে চিনতে পারে, তার মুখের নিঃসৃত কথাবার্তা যেন
বিশ্বাসযোগ্য হয়, রিয়ালিস্টিক হয়। যে শ্রেণীকে তুমি চেন, তাঁকে কেন্দ্র ক’রেই গল্প লেখো। এ জন্যে কোনো প্রলেতারিয়েত বা কোন ডিপ্রাইভ্ড
শ্রেণিকেই যে ধরতে হবে, এসব নয়। কোন প্রগতিশীল বা বামপন্থী অথবা বামপন্থা বিরোধী
লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে লিখতে শুরু করা গল্প কিন্তু পাঠককে আকৃষ্ট ক’রতে পারে না। যে ঘটনাটা তোমাকে আঘাত ক’রলো, স্পর্শ ক’রলো, ভাবালো, সেই সবই লেখা’র উপাদান। উপাদান
আপনি আসে। খুঁজে বেড়াতে হয় না। তাই শেয়ার ক’রতে হয় পাঠকের সাথে। তবে মনের দরজাটাকে খুলে রাখতে হয়, মেলামেশা’র মাঠটাকে ঝোপঝাড়ে ঢেকে রাখলে চলে না। আমাদের সামনে নানা
ঘটনা ঘটে নিত্যদিন। তার মধ্যে নানা উপাদান থাকে গল্পের মতো। শুধু দেখা’র মতো অন্ত্যস্থ চোখ বা দৃষ্টি গুরুত্বপূর্ণ। কারোর সেটি জন্মকাল
থেকে থাকে, কারোর বেশী থাকে, কারোর কম। লিখতে লিখতে সেই চোখ খুলেও যায়। সবাই তো
লিখবেন না। কেউ কেউ লিখবেন, কেউ কেউ প’ড়বেন। এই নিয়েই লেখক আর পাঠকের সম্বন্ধ। পাঠকও তো একজন শিল্পী কেননা তিনি রসিক
ব’লেই রসময় সাহিত্য পড়েন। তিনি যে আমার
শিল্প সৃষ্টিকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন। লিখতে গেলে প’ড়তে হবে প্রচুর। একটা কাম্য, একটা অনুকূল পরিবেশের মধ্যে দিয়ে নিজেকে অভিচালিত
ক’রতে হবে, যাতে চিন্তা-ধারা’র একটা উন্মেষ ঘটে। আর যা কিছু--- স-অ-ব ইলিউশন, মিথ্যে
স্তোকবাক্য, শিল্পকে বিজ্ঞান ক’রে তোলার,
সাহিত্যকে বক্তৃতা বানিয়ে দেবার, একটা বিপ্লব ঘটিয়ে দেবার বেকার চেষ্টা।
আমি কোন প্রজ্ঞাবান মানুষ নই। জীবন থেকে, পঠন-পাঠন থেকেই
উঠে এসেছে আমার এই সমস্ত এবং অন্য যাবতীয় কথা। এসব কোন বইতে লেখা নেই। কোনো বইয়ের
কোটেশনের ধার না ধেরে আমি ইংরেজিতে একটি কথা ব’লি--- A man is none if he or she doesn’t read and a writer is also none if he or
she isn’t read.
--------------------------------
শব্দ সংখ্যা --- ৫,৩৭০
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন