রবিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১১

'ছুটি' ছোটগল্প


ছুটি
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়

        হঠাৎ জ্ঞান ফেরে ইতি-র। তাকিয়ে দ্যাখে যে, ওর একপাশে দাঁড়িয়ে একজন পুলিশ। তাঁর মাথায় টুপি। ইতি প্রথমটায় ভয়ই পেয়ে যায়। তাহলে কি কাকীমা ওকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে এনেছে? কিন্তু ও তো চুরি-টুরি কিছুই করেনি! তাহলে ওর দোষটা কী, বুঝতে পারে না ইতি। হঠাৎ এটাও লক্ষ্য করে যে, ও শুয়ে আছে বিছানায়। কাকিমাদের বিছানায়। এবারে ও আরও ভয় পেয়ে যায় এতে। ও মনে করতে পারে না, কে ওকে এনে এখানে শুইয়েছে। কী হয়েছিলো, তাও ঠিকঠাক মনে পড়েছে না। তাহলে কাকিমারা কোথায়? এবারে ঘাড় ঘুরিয়ে বাঁ দিকে তাকায়। দ্যাখে যে, কাকিমা আর কাকু দাঁড়িয়ে। পাশে তনু মাসী। তাদের চোখেমুখে একটা অন্ধকার। কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে যেন। ঠিক তেমন কাকীমা আর কাকুর মুখ। যেন মেঘ আকাশে থম্‌ মেরে আছে মেঘে। বৃষ্টির আগে যেমনটা হয়। কী হয়েছে, মনে করে উঠতে পারে না ইতি। একদিকে পুলিশ, আর একদিকে কাকু-কাকিমা। বুল্‌টি দিদি কৈ? হঠাৎ পায়ের কাছে চোখ পড়তে দেখলো যে, সেখানে দাঁড়িয়ে পাশের ফ্ল্যাটের কাঞ্জিলাল জেঠু, দোতলার ইস্কুল দিদিমনি, দোতলার আর একজন কাকু। পরান কাকু। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ধরতে পারে না ও।
হঠাৎ পুলিশের লোকটি প্রশ্ন করে--- এখন কেমন আছো তুমি?
মাথা কাৎ করে জবাব দ্যায় ইতি যে, ও ভালো আছে।
--- এবারে আমার কথার উত্তর দাও তো। তুমি এই বাড়িতে কেমন আছো? এখানে থাকতে কি তোমার ভালো লাগে?
এ কথাটার মানে বুঝতে পারে না ইতি। ভাবে, এসব কথা কেন বলছে পুলিশটা! তাই হা করে তাকিয়ে থাকে। পুলিশটা আবার প্রশ্ন করে--- তোমাকে কি এ বাড়ির লোকেরা মারধোর করে?
একবার কাকু-কাকিমাদের দিকে তাকায় ইতি। বেশ বুঝতে পারে যে, তাঁরা ভয়ে কুঁকড়ে আছে। মনে মনে এও বুঝতে পারে, কেউ একজন এসব কথা বলেছে পুলিশটাকে। কে বলতে পারে? এসব তো জানে কাঞ্জিলাল জেঠিমা। কিন্তু সে তো এখানে নেই! ইতি কী করে পুলিশকে বলে যে, ওকে এ বাড়িতে মারধোর করা হয়! এ বাড়িতে ও আছে আজ এ্যাতদিন। এখানকার ভাত খেয়েছে ও। যারা ওকে ভাত দিয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশকে কী করে বলবে! পুলিশ মানেই তো ধরে নিয়ে যাওয়া। যদি কাকু-কাকিমাকে ধরে নিয়ে যায়, তবে বুল্‌টি দিদি-র কী হবে! সে যাবে কোথায়? বাবা-মাকে ছেড়ে একা একা থাকা যে কী কষ্ট, তা হাড়ে হাড়ে জানে ইতি। তাই চুপচাপ মাথা নেড়ে জানিয়ে দ্যায়, না, আমাকে কেউ মারে না।
ইস্কুল দিদিমনি এবারে ওকে বলে--- তুই ভয় পাস না? সত্যি করে বল্‌। তোকে কেউ মারবে না। তোকে বুল্‌টি দিদির মা মারে কিনা?
--- না তো। মারে না তো। এবারে এই প্রথম মুখ ফাঁক করে মৃদু উত্তর দ্যায় ও।
--- তুমি বলছো, তুমি এ বাড়িতে ভালো আছো?
পুলিশটার প্রশ্ন শুনে ইতি আবার বলে--- হ্যাঁ, ভালো আছি।
--- তোমাকে এ বাড়িতে সবাই ভালবাসে।
--- হ্যাঁ, ভালবাসে।
স্পষ্ট দেখতে পায় ইতি যে, কাকিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মানে যেন তার ধরে প্রাণ এলো। এতক্ষণ সে দম বন্ধ করেছিল। ইতি তো জানে না, ও বেফাঁস কিছু বলে দিলেই তো ওর কাকু-কাকিমা অনিমা আর অনিমেষ ফেঁসে যাবে। এমনিতেই তো একটা অপরিণত বয়সের মেয়েকে বাড়িতে কাজের লোক হিসেবে রেখেছে। এটা তো আইন বিরুদ্ধ। তার ওপর শারীরিক নির্‌যাতন! কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়ে ইতি পুলিশের কাছে গোপন করে গেলো বিষয়টা।
ইতি শুনলো, কাঞ্জিলাল জেঠু বলল--- আসলে মেয়েটা পুলিশ-টুলিশ দেখে ঘাবড়ে গেছে। তাই সত্যিটা বলতে চাইছে না। ফ্যাক্‌ট হলো, আমরা ওদের সার্ভিস নেই, কিন্তু ওদেরকে আত্মীয় বলে মনে করি না। কিন্তু কখন যেন, ওদের মনেরও অজান্তে, আমাদেরকে ওরা আত্মীয় করে ফ্যালে!
লোকাল থানার এস.আই. ললেন--- সেটা তো আমার কিছু করার নেই, মিসেস গাঙ্গুলী। আমি যা শুনবো, সেটাই তো রিপোর্ট করবো। আপনাদের ভিক্‌টিম তো নিজেই নিজেকে ভিক্‌টিমাইজ্‌ড বলছে না। এ বিষয় তো আমি তদন্ত করে দেখতে যাবো না। হ্যাঁ, তবে এটা তো চাইল্ড লেবারের মধ্যে পড়ে। সেটা একটা কমপ্লেইন্ট হতে পারে। কিন্তু আমার বাড়িতেও তো একটা এরকম বাচ্চা মেয়ে কাজ করে। কী করবেন? আমাদের লোক চাই আর ওদের খাবার চাই। কিছু তো করার নেই, না? আমরা ওদেরকে না নিলে ওরা না খেয়ে মরবে। আইন মানো, কিন্তু ভুখা মরো--- এটা তো কোন কথা নয়। এটা নিয়ে আর জল ঘোলা করবেন না।
--- আপনি অন্তত এটা তো জানুন, মেয়েটা গোটা ফ্ল্যাটে একা থাকলো কী করে? কোন  গ্রাউন্ডে একটা ফ্যামিলি একটা নয়-দশ বছরের বাচ্চা মেয়েকে ফেলে এভাবে বেড়াতে যেতে পারে। এটা তো একটা ইম্মরাল ব্যাপার।
সেকেন্ড ফ্লোরের স্কুল মিস্‌ট্রেস অতসী গাঙ্গুলীর এমন নালিশে প্রতিবাদ করলো অনিমেষ অর্থাৎ ইতির বর্তমান প্রভু, যাকে সে কাকু বলেই সম্বোধন করে--- আপনি কেন স্যারকে বার বার করে আমাদের বিরুদ্ধে যেতে টেম্পটেড করছেন, বলুন তো মিসেস গাঙ্গুলী? আপনার কী ইন্টারেস্‌ট? আমরা কি আপনাদের কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি? ইতি তো বলেছে, আমরা ওকে মারধোর করি না। ও এখানে ভালো আছে। আপনার এত মাথা ব্যথা কেন? এটা কি আপনার স্কুল নাকি?
--- আপনি চুপ করুন, মিঃ রায়। একটাও কথা বলবেন না। আপনি বুঝতে পারছেন না, ইতি আপনাদেরকে সেভ করছে? আপনি এটা খুব ভালো মতো জানেন। এটা নিয়ে আপনার সাথে বহুবার আমার কথা কাটাকাটি হয়নি?
কিন্তু ইতি জানিয়ে দিলো যে, সে নিজেই কাকু-কাকিমাদের সাথে বেড়াতে যেতে চায়নি। কাকু-কাকিমা ওকে বার বার যেতে বলেছিলো। কিন্তু ট্রেনে উঠতে নাকি ওর ভয় করে। আর এও বলল যে, তনুমাসী দুবেলা এখানে আসে। এসব কথা শুনে অবশ্য অনিমা আর অনিমেষ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলো, কেননা ইতি এমন কথা কস্মিনকালেও বলেনি তাদেরকে যে, ওর ট্রেনে উঠতে ভয় করে। তারা ভালো মতো বুঝে নিলো ইতি তাদেরকে বিপদ থেকে রক্ষা করে দিচ্ছে। তা নয়তো এ কেস তো তাদেরকে হাজত বাস করিয়ে ছাড়ত। একে শিশুশ্রম করানো যার জন্য আজকাল বেশ ধরপাকড় চলছে। তার ওপর তাকে লক এ্যান্‌ড কী করে গোটা বাড়িতে একা ফেলে বেড়াতে চলে যাওয়া। দুটিই গর্হিত অপরাধ। শিশুশ্রমটা আটকানো যায় এই বলে যে, ইতির বাবা-মা ওদের হাতে-পায়ে ধরে ওকে রেখে গেছে এখানে। খেতে দিতে পারছে না। ওরা একেবারে হত দরিদ্র। সত্যিই তো, সরকার আইন করেছে, কিন্তু আইন কীভাবে বলবৎ থাকে, তার জন্যে যে ব্যবস্থা নিতে হয়, তা তো করেনি। ফলে আইন আছে আইনের জায়গায়, বাস্তব আছে বাস্তবে। ইতিদের পেটে ভাত নেই। আর তাই তারা কাজ করতে বেরোতে বাধ্য। তা নয়তো খাবে কী! তথাপি আইন তো আইনই। সরকারের আবার সমালোচনা কী! তুমি বড় জোর পরেরবার ভোট-টা এই পার্টিকে দেবে না। ব্যস্‌। তাই আইনের যে কড়াকড়ি চলছে, তাতে তো অনিমা-অনিমেশ হালে পানি পেতো না। তখন কে দেখত বুল্‌টিকে! তাই মনে মনে ইতির কাছে তারা একটু কৃতজ্ঞ যে হলো না, তা নয়।
ইতি দেখলো, পুলিশটা চলে গেলো। ফ্ল্যাটের সকলে নানা দৃষ্টিতে ইতির কাকু-কাকিমাদের দিকে তাকাতে তাকাতে যে যার ঘরে একে একে ফিরে গেলো। শুধু দোতলার কল্যানেশ্বরী বালিকা বিদ্যামন্দিরের শিক্ষিকা অতসী গাঙ্গুলী বলে গেলেন,
--- শিখুন। ঐ ইতির কাছে শিখুন। কীভাবে আপনাদেরকে আজ বাঁচিয়ে দিলো। ইচ্ছে করলেই আপনাদের সর্‌বনাশ করতে পারতো ও।
এই দিদিমণিকে ভয় করে ফ্ল্যাটের নানা মানুষ। এর মূল কারণ হলো, তিনি একটা রাজনৈতিক দলের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। তাঁর ঘরে নানা সভা-সমিতি হয়। ভালোমন্দ মানুষ আসে। ফলে সবাই জানে যে, এঁর লোকবল আছে, প্রভাব-প্রতিপত্তিও আছে। তাই অনিমা-অনিমেষ চুপচাপ হজম করে গেলো বিষয়টা। কিন্তু অনিমার বোন বলল,
--- তোরা এই মহিলার কথার উত্তর দিস কেন, বল্‌ তো!
--- ঝামেলাটা তো তুই পাকালি। এত লোক-টোক ডাকার কী দরকার ছিলো?
--- আমি ঝামেলা পাকালাম! আমি তো সকালেও ফোন করেছিলাম। তখনও তো ও ভালই ছিলো।
--- তখন ভালো থাকলে হঠাৎ এমনটা কী করে হলো, বলতো? এটা কেমন একটা অবাস্তব শোনাচ্ছে না?
তনিমা জানাল--- মেয়েটা অন্তত আমাকে তো শরীর খারাপ-টারাপ কিছু বলেনি। বললে তো আমি তখনই ছুটে আসতাম। এতোকিছু তো ঘটতো না। বিকেলে আবার যখন ফোন করলাম, তখন দেখি, ফোন ধরছে না। অন্তত বার পাঁচেক রিং করলাম। বেজেই যাচ্ছে। তখন তো বাবীন আসবে স্কুল থেকে। তাকে খাওয়ানো, পড়তে বসানো, হোম-ওয়ার্ক করানো। কত কাজ! সব তো মাথায় উঠলো। পাশের ফ্ল্যাটের জবা দি-র ওপর বাবীনের দায়িত্ব ছেড়ে একটা অটো নিলাম। ডুপ্লিকেট দিয়ে তোদের দরজা খুলে দেখি, মেয়েটা সেই সামনের বারান্দাটায় মাটিতে পড়ে আছে। ওর গা জ্বরে পুরে যাচ্ছে। তোদের থার্‌মো তো খুঁজে পেলাম না। এবার আমি কী করবো, বলতো? থার্‌মোর জন্যে পাশের ফ্ল্যাটে বেল দিতেই ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। আমি তো জানি, তিনি অফিসে। আজ তো উইক ডে। তাঁর মিসেস নিশ্চয়ই বেরোবেন। কিন্তু তা হোল না। ব্যস্‌, জানাজানি হয়ে গেলো। ওরা তোদের খোঁজ করতেই আমাকে বলতে হোল যে, তোর শ্বশুরবাড়িতে একজন অসুস্থ। তাই তোরা সেখানে গেছিস। ইতি যে একা ফ্ল্যাটে আছে, তা তো ওরা জানেনই না। ওরা জানে যে, তোরা গত দিন-তিনেক বাড়িতে নেই। তোদেরকে ওরা কেউ ফ্ল্যাটে দেখেনি। আমি যে এ ফ্ল্যাটে বসবাস করছি না, এটা ওরা জানে, দেখলাম। ওরা ভেবেছিলো, তোরা ইতিকে নিয়েই পুজোর ছুটিতে বাইরে গেছিস। এর মধ্যে ঐ মহিলা, মানে ঐ স্কুল মিস্ট্রেস কোথা থেকে যেন ফিরেছে ফ্ল্যাটে। ব্যস্‌। সকলে তাকেই মন্ত্রী মনে করে হাজারগণ্ডা নালিশ করলো। এসব শুনে সে-ও রেগেমেগে একেবারে কাই। ডাক্তার-টাক্তার সবই সে আনলো বটে। কিন্তু আমাকে তো এই মারে কি সেই মারে। পুলিশ তো ঐ ডেকেছে। তোদের তো ফোন করেছি অনেক পরে।
দিদি অভিযোগ করে--- তোকে তো বলেছিলাম, গোটা চারেক দিন পালা করে এখানে কাটা। আকাশকে বল্‌ একটু মানিয়ে নিতে। কিন্তু তুই তো রাজী হলি না। এসব কি হতো? কী হেনস্তা! কী হেনস্তা!
ছোট বোন ফোঁস করে ওঠে--- তোদের হেনস্তার জন্যে কি তুই আমাকে দায়ী করছিস, দিদি?
--- তা নয়তো কী? মানুষের ভাই-বোন থাকে কী করতে? তুই-ই বল্‌ না। পাশে থাকবার জন্যেই তো?
--- তার মানে! আমরা কি তোদের পাশে থাকি না, বলতে চাস?
--- না, বলতে চাইনি কিছুই। ঘটেছে। এটাই তো তার নমুনা।
দিদির মুখে এমনটা শুনে এবারে রণে ভঙ্গ দিতে চায় ছোটবোন তনিমা। কিন্তু পশ্চাদপসারন করার আগে প্রতিপক্ষকে একটা একটা শেষ প্রত্যাঘাত না করে এমন পরাভব মেনে নেওয়া ঠিক নয় বলে মনে করলো সে। তাই বলল,
--- এখন আমায় দুষছিস! তোরাই বা কাজের মেয়েটাকে না নিয়ে কেন বাইরে যাবি? ও কি মানুষ নয়? বুল্‌টির সাথে ইতির মালিক চাকর-এর পার্থক্য ছাড়া আর কী কোন পার্থক্য আছে রে? তুই-ও তো মা। ওরা দুজনই তো শিশু। তুই কেন মেয়েটার কথা ভাবলি না?
এ কথায় বেজায় রেগে যায় বড়োবোন অনিমা। এর একটা মোক্ষম জবাব দিতে তার জিভ লকলক করে ওঠে। বলেও দ্যায়--- ও, তাহলে ঐ মাস্টারনী যা বলছিলো, তা তোরও পেটে পেটেও ছিল, বল্‌। ভালো। বেশ ভালো বোনের পরিচয় দিলি, তুই তনু। মনে থাকবে।
--- এসব কথা পেটে ছিলো, কি মাথায় ছিলো, তা তো বলতে পারব না রে, দিদি। তবে কথাটা যদি সত্যি হয়, তবে পেট, না মাথা, কোথায় ছিলো, সেটা বড়ো কথা নয়।
অনিমেষ এতক্ষণ বেশ তারিয়ে-তারিয়ে দুই বোনের কলহ শুনছিলো। বেশ লাগছিলো। অনিমেষদের নিজেদের ভাই-বোনদের মধ্যে মোটে সুসম্পর্ক নেই বলে ও একটা অন্তর্‌জ্বালায় ভুগতো। অনিমাদের ভাই-বোনদের মধ্যে একটা বেশ শক্ত বন্ধন আছে। বেশ চোখে পড়বার মতো বন্ধন। তাই একটা ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স কাজ করতো ওর মনে। একটা ঈর্ষা ওকে সর্‌বদা খোঁচা দিতো। আজকে তার সামনে সেই তথাকথিত বন্ধন-এর খোলসটা ছিঁড়ে পড়তেই বেশ লাগছিলো। আজকে অনিমা আর অনিমেষ যেন সম-শ্রেণীভুক্ত হয়ে পড়লো। এ্যাতোদিন ছিলো বিজাতীয়। কিন্তু এবারে সে বুঝে নিলো, এখনই কথা না বললেই নয়। এদেরকে নিরস্ত করা দরকার। নিজের স্ত্রীকে বিলক্ষণ চেনে সে। অনেকদূর নেমে যেতে পারে এই মহিলা। আজকেই কোনো ফাইনাল সিদ্ধান্তে এসে না পৌঁছোয়। তাই দুজনকেই থামিয়ে দিয়ে বলল,
--- একটা থার্ড গ্রেডের সাবজেক্ট নিয়ে তোমরা এত এক্সাইটেড হচ্ছো কেন? চলো, চা বানাই। ব্যাল্কনিতে বসে খাই। ডাক্তার দেখেছে, ওষুধ দিয়েছে। ব্যস্‌। ঠিক হয়ে যাবে। তবে এটা কিন্তু স্বীকার করতেই হবে, ইচ্ছে করলে ইতি আমাদের একেবারে ফাঁসিয়ে দিতে পারতো।
--- এটা কোন কথা হলো না, জামাইবাবু। আপনাদের যে অন্যায়টা হয়েছে, সেটা মেনে নিন। ইতি মেয়েটা ভালো। ওকে কদর দিন।
এবারে আস্তে শ্যালিকার কানের কাছে মুখটা নামিয়ে এনে অনিমেষ বলল--- আরে, আমি তো সাথে নিতেই চেয়েছিলাম। তোমার দিদি-ই তো…… আর জানোই তো তোমার দিদিকে। একটা ধুয়ো ধরলে বা একটা কথা বলে ফেললে তা থেকে নড়ানো সকলের কম্ম নয়।
বাস্তবে তনিমাই প্রথম আবিষ্কার করেছে ইতিকে। সকালে সত্যি-ই সে ফোন করেছিলো। টেলিফোনে ইতিকে দিয়ে মুসুর ডাল, ভাত আর তরকারি রাঁধিয়েছে। ফোনের বিল তুলেছে নিজের। ফুর্তি করেছে অনিমা, আর গ্যাঁট গচ্ছা দিয়েছে তনিমা, হ্যাপা সামলেছে তনিমা, আবার গালও খাচ্ছে সেই তনিমা-ই। এটাই ওর ভাগ্য বলে মনে করে ও। প্রথম কটাদিন বেশ নিয়ম মেনেই ফোন করছিলো। দিনে চারবার।কে আসছে, কে যাচ্ছে--- সব জেনে শুনে নিচ্ছিলো। কিন্তু একটা কাজে নৈমিত্তিকতা এলেই তো মানুষ হঠাৎ অনিয়মিত হয়। তাই বিকেলে ছেলে বাবীন-কে স্কুল থেকে আনতে যাবার সময় একবার ফোন করবে, ভেবেছিলো। পরে ভাবলো, থাক না।  জলে তো পড়ে নেই মেয়েটা। ঘরে আছে।  সেখানে তো ওকে কেউ এ্যাবডাকশন করবে না। পরে ফোন করলেই হবে। কিন্তু শেষে কী হলো, মনে করলো, নাঃ, একবার খোঁজ নিয়েই দেখি। দিদি ফিরে মেয়েটাকে ঠিক জিজ্ঞেস করবে, মাসি কতবার ফোন করতো রে? দিদিকে হাড়ে হাড়ে চেনে বোন। তাই হঠাৎ ফোনটা করে বসে। হয়তো এটা ওর ইনটিউশন। ওর সাবকন্সাস মাইন্ড হয়তো কিছু একটা আন্দাজ করছিলো। আর তাই ফোন করতেই দেখে যে, ইতি ফোন ধরছে না। এবারে তনিমা মহা বিপদে পড়ে যায়। এবার কোনদিকে যায়! দিদিদের পাশের ফ্ল্যাটের কারোর ফোন নম্বর জানা নেই। থাকলে জেনে নেওয়া যেতো। অগত্যা নিজের ছেলের দায়িত্ব অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে ডিউটি করতে ছুটতে হলো। ছোট বড়ো নানা কাজে দিদি ছুটে আসে ছোট ভাই-বোনেদের বাড়িতে। এটা সত্যি। ফলে দিদির কাজটা যদি কোনোভাবে অবহেলিত হয়, তবে দিদি কী বলবে, আর বলবে না--- তার ঠিক নেই। কিন্তু এখানে যে এমনটা হবে, মানে এতোটা হবে, তা দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি তনিমা। কিন্তু বিষয়টা যে মাপে গিয়ে পৌঁছলো যে, এখান বসে চা-টুকু খাবার পরিবেশ আর নেই। তাই রাগ দেখিয়ে হাঁটা দিলো সে। এটা ছাড়া দিদির সাথে এঁটে ওঠা সম্ভব নয়। পেছনে অনিমেষ ডাকলো বটে, তবে এটাও তার বুঝতে কোনো অসুবিধে হলো না যে, তনিমা অনিমারই বোন। তাই নিজে চা খাবার জন্যে সে-ও উঠে গেলো। পুজোর ছুটিতে ঘুরতে গিয়ে যে এভাবে ফিরে আসতে হবে, তা তো ভাবেনি। গোটা টাকাটা জলে গেলো। রোমিং চার্জ কাটবে জেনেও মোবাইলটা খোলা রেখেছিলো।সেটাতে হঠাৎ তনুর কল আসে,
--- জামাই বাবু, আপনারা আজকেই ফিরুন। এখানে ঘটনা ঘটেছে।
--- কেন তনু? কী হয়েছে! তোমাদের কোনো বিপদ-টিপদ হোল নাকি?
--- আমাদের মানে, আপনাদের ইতি তো মহা বিপদ করেছে!
--- কী করেছে? পালিয়েছে নাকি? আমি জানতাম। তোমার দিদিকে বার বার করে ওকে ফেলে…..
--- আগে শুনুন না। আপনি যা ভাবছেন, তা নয়। ও ভয়ানক অসুস্থ। হাই ফিভার। জ্ঞান হারিয়ে ছিল। শুধু তাই নয়। কেসটা তো পুলিশ কেস হচ্ছে।
--- পুলিশ কেস মানে!
--- আসুন, তারপরে দেখবেন। আমি যতটা পেরেছি, করেছি। এবারে তো আপনাদের লাগবে।
অনিমেষ চোখে অন্ধকার দ্যাখে। এত সহজ ফিরে যাওয়া! ওদের তো টিকিট কাটা রয়েছে। আজ বা কালকের টিকিট পাবে কোথা থেকে? শেষে অনেক বেশি গচ্ছা দিয়ে দালাল ধরে তবে ফিরতে পেরেছে। আর ফিরে তো হেনস্তার চূড়ান্তও।

-----------------------


(২)

এ বাড়িতে ইতি এসেছিলো ওর বাবার হাত ধরে। বাবার কারখানাটা বন্ধ হয়ে গেলো দুম করে। কাজ নেই, কম্ম নেই বাবার হাতে। শেষে বাবা বাজারে সবজি নিয়ে বসতে শুরু করে দিলো। বেচা-কেনার অভ্যেস নেই। তাই বাবা কিছুতেই সুবিধে করে উঠতে পারছিলো না। হঠাৎই ইতি জানতে পারে,  ওর মা আবার মা হবে। ইতির পক্ষে এর গভীরতা জানার কথা নয়। তবু অভাবের ঘরে শিশুরা অনেক বেশি পরিণত হয় বলে এটা অন্তত বুঝে নিলো যে, ওর আদর খাবার আর কিছুই অবশিষ্ট রইলো না। একে বাবার টাকা-পয়সার অবস্থা খারাপ, অন্য দিকে ছোট একজন আসছে। এবার সেই সবটা পাবে। কিন্তু ওকে যে বাড়ি ছাড়তে হবে, সেটা মোটেও ভাবেনি ও। বাবার কাজ যেতেই মা কাজ শুরু করে দিয়েছিলো অন্যের বাড়িতে। ঠিকা ঝি। কিন্তু মা-র পেট-টা ফুলে যাওয়ায় মা আর যেতে পারছিলো না কাজে। ঠাকুরকে নানা নিন্দামন্দ করে ইতি। ভাবে, ঠাকুর ইচ্ছে করলেই এই নতুন বাচ্চা আসাটা বন্ধ করতে পারতো। বাবা কী করে চালাবে! মা তবু কটা টাকা আনতো। ইতির মনের মধ্যে বার বার উঁকি দিয়েছে আর একটা কথা--- ভাই, না বোন? কে আসছে? এমনটা ভাবতে গিয়ে ওর মনে একটা আনন্দও হয়েছে। ইতি দিদি হবে। ভাই বোন যেই হোক, ও দিদি হবে। এমনটা ভাবার পর থেকেই কবে যেন বাড়িতে এই সমাগত নতুন অতিথিকে ও ভালোবেসে ফ্যালে। আর ঠিক তখনই একদিন বাবা ওকে এই কাকু-কাকিমাদের বাড়িতে দিয়ে যায়। বাবা কানে কানে ওকে বুঝিয়ে যায়,
--- এখানে তুই ছোটো-খাটো কাজ করবি, টাকা আয় করবি। তোর যদি ভাই হয়, তবে তুই নিজের টাকায় ভাইকে ভাইফোঁটা দিতে পারবি, জামা দিতে পারবি, জুতো দিতে পারবি। কী, ভালো হবে না?
মনে মনে ভাবে ইতি, ভালো তো হবে। কিন্তু ও বাবা-মাকে ছেড়ে কোনোদিন কোথাও থাকেনি। তখন তো এই কাকু-কাকিমা কলকাতায় থাকতো না। বাড়ির সকলের সাথে একসঙ্গে ইতিদের গ্রামেই বড়ো রাস্তার কাছে বিরাট বাড়িতে থাকতো। সেখান থেকেই কাকু অফিস যেতো। কিন্তু কাকুর এই কলকাতায় চলে আসার কথা চলছিলো। অতো দূর থেকে কাকু অফিস যেতে পারছিলো না। সেই কারণেই আগেভাগে ইতিকে কাজে নিয়ে রাখে তারা। বাবা-ই ইতিকে নিয়ে এসেছিলো কাকুদের বাড়িতে। মা এ বাড়িতে কাজ করতো। বাবা কাকুর সাথে দেখা করে বলেছিল,
--- আপনি তো নতুন জায়গায় চলে যাবেন। সেখানে আপনাদের নানা কাজে একজন কাজের লোক লাগতে পারে। কলকাতায় তো কাজের লোক পাওয়া সহজ নয়।
কাকু বলেছিলো--- হ্যাঁ, তো? তুমি এসব আমাকে বলছো কেন?
--- আসলে আমার কারখানাটা তো বন্ধ হয়ে গেলো। তার ওপরে ঝুমুরের আবার বাচ্চা হবে। বেশ আতান্তরে পড়ে যাবো। বাচ্চা দুটোকে খাওয়াবো কী?
কাকু জানত যে, ঝুমুর মানে ওদের বাড়ির ঠিকা ঝি। নিখিলের বৌ। তাই কাকু বলল--- এ্যাতোটুকু মেয়েকে কাজে লাগাবে! ভালো। তা তুমি আমার কাছে কী চাও?
--- আমার মেয়েটাকে আপনারা নিয়ে যান না। আপনারা চেনা-জানা পরিবার। আপনাদের কাজে লাগবে। আমাদেরও একটু সুবিধে হবে।
--- ঐ টুকু মেয়ে! ও কী করবে? ওর দ্বারা কি কোন কাজ হবে?
--- গরিবের ঘরের ছেলেমেয়ে, বাবু। ওরা সব পারে। ইতি-ও পারবে। তারপর ইতিকে দেখিয়ে বাবা বলে--- ওর নামই ইতি। একটা পেট থেকে তো রেহাই পাই। আর সংসারে দুটো টাকাও তো আসে।
--- সংসারে টাকা? তা কত চাও তুমি?
--- সে আপনি দেবেন বিবেচনা করে।
--- শ-তিনেক টাকার বেশি কিন্তু দেওয়া সম্ভব নয়।
--- তাই দেবেন। আমি মাঝে মাঝে গিয়ে নিয়ে আসবো টাকা।
বাবার কথাগুলো ভালো লাগেনি ইতির। একদিকে বাবা বলছে, ইতি নিজের টাকা দিয়ে ভাই হলে তাকে এটা ওটা কিনে দিতে পারবে। আবার বলছে, মাঝে মাঝে এসে বাবা টাকা নিয়ে যাবে। কিন্তু ইতির খুব ভালো লেগেছে মার কথা। মা এসব শুনে বাবাকে খুব বকেছে। মা একেবারেই রাজী হয়নি মেয়েকে কাজে পাঠাতে। বাবাকে মা পরিষ্কার বলেছে,
--- তুমি আমার সাথে এইসব কথা বলেছো? আমার কিন্তু আমার মেয়েকে আমি কাজে পাঠাবো না। ওকে আমি ভালো বিয়ে দেবো। আমার এই পেটের সন্তানটাই অপয়া। তোমার কারখানাটা গেলো, মেয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। তার চেয়ে আমার পেট খসিয়ে দাও।। আমি আর মা হবো না।
বাবা মা-কে কিছু বলতে না পারলেও ইতি ছুটে এসে মার মুখে হাত চাপা দিয়েছে। মাকে আদর করে বলেছে--- মা, এমন বোলো না। আমি কাজ করবো, মা। আমাকে একটা ভাই দাও। আমার একটা ভাই চাই। আমি তাকে ফোঁটা দেবো। আমি যে মাইনে পাবো, তাই দিয়ে ভাইকে জামা, জুতো কিনে দিয়ে ফোঁটা দেবো। সবাই ভাইফোঁটা দ্যায়। আমি তো দিতে পারি না। তুমি এমন কথা বলো না। বামুন বাড়িতে বোনেরা ওদের ভাইদেরকে কেমন ফোঁটা দ্যায়, শাঁখ বাজে, উলু দ্যায়! আমার খুব ইচ্ছে হয়, মা। আমি মধুকা-র মেয়ে শ্যামলীর থেকে ভাইফোঁটার মন্ত্র শিখে নিয়েছি। বলে মাকে শুনিয়ে দিয়েছে ইতি--- ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা / যম দুয়ারে পড়লো কাঁটা…..’
মা নীরবে তাকিয়ে থেকেছে মেয়ের দিকে। এইটুকু মেয়ের মধ্যে এ্যাতবড়ো একটা দিদি-কে দেখতে পায় মা। তারপর মেয়েকে জরিয়ে ধরে ইতির মা কেঁদেছে, আর বাবাকে বলেছে,
--- দাও। ওকে কাজেই দাও। আমার মেয়েটা যে এ্যাত বড়ো হয়ে গেছে, তা তো জানতাম না। কিন্তু ওর মাইনের একটা টাকা এই সংসারে আনবে না। ওতে ওর বিয়ে হবে। বড়ো করে বিয়ে। খবর্দার!
তাই বাবার এখানে এসে কোনদিন টাকা নেওয়া হয়নি। সব জমা হচ্ছে কাকুর কাছে। এখানে এসে ইস্তক ইতি দেখেছে, কাকিমা বুল্‌টিকে নিয়ে একা সামলাতে পারে না। আলাপ-আলোচনায় শুনেছে, এই বাজারে ঠিকে ঝি রাখা নাকি একটা মুশকিল। ঠিকে ঝি-রা নাকি খুব কামাই-টামাই করে। তাই আর কোনো কাজের লোক নেই এ বাড়িতে। কলকাতায় এসে ইতিকেই ঘর মোছা, বাসন মাজা, সবজি কাটা সব শিখে নিতে হয়েছে। এসব কিছুই জানত না ইতি। মা তো এসব কিছুই ওকে দিয়ে করাতো না। শুধু খেলে বেড়ানো কাজ ছিল ওর। তাই কিছুই জানতো না ইতি। কিন্তু মনে জোর নিয়ে আগামী দিনের দিদি ইতি এ বাড়িতে কাজ করতো। কেননা যদি ওর ভাই হয়, তবে ও নিজের টাকা দিয়ে তাকে জামা-জুতো কিনে দিয়ে ফোঁটা দিতে পারবে। বাবার কথাটা কানে বাজতো, মার কথাটা মনে একটা দোলা দিতো, আমার মেয়েটা যে এ্যাত বড়ো হয়ে গেছে, তা তো জানতাম না। কিন্তু ওর মাইনের একটা টাকা এই সংসারে আনবে না। ওতে ওর বিয়ে হবে। বড়ো করে বিয়ে। খবর্দার!
আর তাই শরীর ভেঙ্গে এলেও কাজ করতো ইতি। কাজের শেষে ঘুমিয়ে পড়লে আর কোনো সার থাকে না ওর। দেহটা কোথায় যে চলে যায়! ঘুমে অজ্ঞান হয়ে যায় একেবারে। কাকিমাকে ধাক্কাধাক্কি করে তুলতে হয়। ব্যস্‌। আবার বাক্যবাণ শুরু হয়। কিন্তু শরীরটাকে যে ও তুলতেই পারে না। উঠেই তো গাড়ি চলতে থাকবে। সকালে টিফিন খেতে খেতে বাজে বেলা দশটা। খিদেয় পেটের মধ্যে ঝাঁ ঝাঁ করে। কিন্তু মুখে রা-টি কাটে না। মাঝে মাঝে হাফিয়েও পড়ে বটে। কিন্তু এখানে খাওয়া-দাওয়াটা ভালো। সপ্তাহে দুটোদিন মাংস হয়। যদিও কাকিমা ভালো রাঁধে না, তবু তো মাংস। কাকু যেদিন রাঁধে, সেদিন খেতে ভালো হয়। এখানে একটা জিনিস খুব ভালো লাগে ওর। টিভি। রাতে বেশ টিভিতে সিরিয়াল দেখা যায়, সিনেমা দেখা যায়। অবশ্য কাকিমা যেগুলো দেখে, সেগুলোই গিলতে হয়, কাকিমার সাথে তা দেখে হাসতে হয়, না বুঝলেও কাঁদতে হয়। সারাদিনে শুধু তখনই কাকিমা ওর সাথে ভালো কথা বলে। সুখদুঃখ লেনদেন করে। নিজের নয়, যারা অভিনয় করে, তাদের সুখদুঃখ।
এখানে প্রথম দিকটা, কাজ বলতে ছিলো শুধু ফাই-ফরমাশ। যেমন, চায়ের জল চড়িয়ে দে, রান্নাগুলো ফ্রীজ থেকে বের করে টেবিলে রাখ, গরম করে নে, বুল্‌টি দিদি ফিরেছে, ওর জলকাদা মাখা জুতো-টুতো পরিষ্কার করে রাখ। এইসব। পরে এই কাজের ফিরিস্তি বাড়তে বাড়তে গোটা সংসার।। এখন ইতিই যেন এ বাড়ির আধা ঘরনি। ন-বছরের একটা মেয়ে প্রায় গোটা সংসারটা চালায়।
বাবা যেদিন ওকে নিয়ে এসেছিলো, সেদিন এসব কাজের কথা বার্তার মাঝখানে ঢুকে পড়েছিল কাকিমা। অর্থাৎ অনিমা। বুল্‌টির দিদির মা। সে একেবারে পাকা ব্যবস্থার মানুষ। সোজা ইতির বাবাকে জানিয়ে দিয়েছিলো,
--- দ্যাখো নিখিল, কাজে দিচ্ছো, দাও। আমাদের কিন্তু তেমন কোনো দরকার নেই। কিন্তু তুমি বলছো, তাই……। তবে ওকে দুমদাম বাড়িতে নেবার জন্যে কিন্তু বায়নাক্কা করবে না। তোমাদের তো আবার দুদিন গেলেই প্রেম উথ্‌লে ওঠে। সব বাড়ির একটা সিস্টেম কিন্তু থাকে। মানতে পারবে তো?
মেনে নিয়েছিল বাবা, মেনে নিয়ে আছে ইতি এখানে। গোটা একটা বছরে আজ পর্‌যন্ত একবারও বাড়ি যাওয়া হয়নি ওর। ভাইফোঁটা কবে দেবে, সেসব ভুলতে বসেছে ইতি। কিন্তু ও জেনেছে যে, সত্যিই ওর একটা ভাই হয়েছে। তাই মনের মধ্যে সাধ যে, সামনের বছরে যাবে ফোঁটা দিতে। তাই এ বছর কাকিমাকে বলেওছিলো। কিন্তু ওরা এ বছর বাইরে কোথায় যেন ঘুরতে-টুরতে যাবে। তাই এবছরটাও চুপচাপ বসে গেছে ইতি। মুখে কোন রা কাটেনি। রা কেটেও তো লাভ নেই। এখানে এসে শুধু সংসারে কাজে নয়, অনেক ব্যাপারে সে-ও অনেকটা বড়ো হয়ে গেছে। ওর মা মনে করেছিলো যে, তার মেয়ে বড়ো হয়েছে শুধু মনের বড়ত্বে, মহত্বে। কিন্তু এখানে এই একটা বছর থেকে সংসার জীবন সত্যিই ওকে অনেকটা বড়ো করে দিয়েছে। বিশেষ করে কাকিমা, হাতের প্রহার আর বাক্যবাণ। সেসব নীরবে সহ্য করতে হয় ওকে আর চিনতে হয় সংসারকে। তার সাথে কাকু-কাকিমার মধ্যে নিজেদের ঘরে কথাবার্তা। সেসব কানে আসে ওর। কাকিমা বলেছে যে, কাকুর নাকি নসুগঞ্জ থেকে কলকাতা আসতে তেমন কোন কষ্টই ছিলো না। শুধুমাত্র কাকুকে দিয়ে একটা ফ্ল্যাট কিনিয়ে মানে মানে এরা সরে পড়েছে বড়ো পরিবার থেকে। তাছাড়া কাকিমা কাকুকে সন্দেহ করে। কাকু নাকি কোন কোন মেয়েদের সাথে মেলামেশা করে। কাকুকে নজরে রাখতে কাকিমার এসব ব্যবস্থা। কাকুও মাঝে মাঝে কোনো কোনো রাতে বাড়ি ফেরে না। বলে, অফিসের কাজে নাকি বাইরে যেতে হয়। কাকিমা বলে, কাকুর মা-টা নাকি রাক্ষুসী। আর কত কী! এইসব শুনে শুনে মনে মনে ভাবে ইতি, ওকেও তো মা বিয়ে দেবে বলেছে। তবে ওকেও কি এসব শিখে রাখতে হবে? শাশুড়ির সাথে কি এমনটাই করতে হয়? ইতি একটা বিষয়ে ধন্যবাদ দ্যায় কাকিমাকে। সেটা রান্না। ওকে কাকিমা রান্না শিখিয়ে দিয়েছে। নিজের স্বার্থেই দিয়েছে। কিন্তু তাতে লাভ তো ওরই হয়েছে। ওর বিয়ে হলে ওর বরকে তো না খেয়ে অফিস যেতে হবে না। মনে এইসব নানা কথা ভাবে ইতি আর কাজ করে। মনে আশা, এ বছর না হোক, পরের বছর তো বাড়ি যাবে। অনেক টাকা জমেছে ওর। ভাইকে ভালো করে ফোঁটা দেবে। কাকিমা বলেছে,
--- এ বছর যেতে হবে না। সামনের বছর বাড়ি যাবি। আর কথা বাড়াবি না।
ইতি শুনেছে, প্রথম প্রথম কাকু কাকিমাকে বলতো--- মেয়েটাকে দিয়ে এভাবে কাজ করিয়ো না। টিকবে না। তাছাড়া ওর বয়সটা কিন্তু এসব করার মতো নয়। কেস খেয়ে যাবে।
কাকিমা কাকুকে ধমক দিয়ে বলেছে--- তুমি থামো তো। আমাদের সমাজে মেয়েরা এসব ক্ষমতা নিয়েই জন্মায়। রান্নাবাটি খেলতে খেলতে আমরা রান্না শিখি। পুতুল খেলতে খেলতে সংসার। ওসব তোমাকে ভাবতে হবে না। দয়া করো, মেয়েটার সামনে এসব বোলো না।
শুনেছে ইতি। শুনতে হয় না। কাকিমার যে গলা, তাতে শুনতে না চাইলেও শোনা হয়ে যায়। কাকিমা আরও বলেছে--- একটা সংসারে একটা মানুষ পোষার খরচ জানো? কী দিয়ে পোষাবে? তুমি তো একেবারে তিনশো দেবে বলে এসেছো। দুশো বলতে পারলে না! তিনশো দিয়ে ওকে কি বসিয়ে খাওয়ানোর জন্যে আনা হয়েছে? ওদের বাড়িতে এ বয়সে ওদের বাবা-মা কী কী কাজ করায়, জানো তুমি? তুমি পুরুষমানুষ। সবদিকে তাকাতে হবে না। শুধু নিজেকে সামলে চলো। এটা আমাকেই বুঝতে দাও।
ইতি দেখেছে যে, কাকু একটু কাকিমাকে খুশি করে করে চলে। কেন? বুঝতে পারে না ইতি। এইভাবেই বছখানেকের মধ্যে অনেকটা বড়ো হয়ে গেছে ও। ও দেখেছে, ওর জন্যে এখানে কোনো নতুন জামা-টামার ব্যাপার নেই। না পুজো, না পয়লা বৈশাখ। ওকে বুল্‌টি দিদির ফেলে দেওয়া জামা পরতে হয়। এটা সত্যি যে, সেই জামাই জীবনে চোখ দেখেনি ইতি। বেশ নতুন নতুন। কিন্তু পুরনো, বাসি তো বটে। তবু তাতে কোনো আপত্তি করেনি ও। তাই পরেছে। একটাই খট্‌কা, ভাইকে দেখতে পাবে কবে? ভাই কতটা বড়ো হোল? উত্তর পায় না। বাবা ওকে যে এখানে দিয়ে গেছে, তার পর থেকে আর বাবারও কোনো পাত্তা নেই। বাড়ির কোন খবর নেই। মা কেমন আছে, জানে না ইতি?
এখানে কাকিমাকে মা হিসেবে পাবে, ভেবেছিলো। কিন্তু তা জোটে নি। এখানে কোন স্বাধীনতা পায় নি। একটা চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ জীবন। শুধু কাকিমা যখন বাড়িতে থাকে না, অনেকক্ষণের জন্যে বাজারে যায়, তখন ইতি একা একা টিভি দ্যাখে, কাকিমার একটা শাড়ি নিয়ে পরে বৌ সাজে, আয়নায় নিজেকে দ্যাখে। শুধু তখনই ভাইয়ের কথা মনে পড়ে না। নিজে নিজে আয়নায় নিজেকে দেখে লজ্জা পায় ইতি। ভাবে, একদিন এভাবেই বৌ সেজে ও শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। কতবার ভেবেছে, একবার বুল্‌টি দিদির ভালো জামা পরে দেখবে, কাকে দেখতে বেশি ভালো লাগে। কিন্তু সে সব তো থাকে আলমারিতে। পাবার তো কোন উপায় নেই। তাছাড়া কাকিমা একবার যদি এসব জানতে পারে, তবে খুন্তির ছেঁকা খেতে হবে। এখানে খুন্তির ছেঁকা, বেলনির বাড়ি, গায়ে কোনো গরম তরকারি, মাছের ঝোল বা ডাল ছুঁড়ে দেওয়া তো ওর একটা প্রাপ্য হয়ে গেছে। তবে পাশের কাঞ্জিলাল জেঠু-জেঠিমা আর ও পাশের ইস্কুলের দিদিমণি ওকে খুব ভালোবাসে। প্রথম প্রথম কাকিমা মারধোর করলে ও চেঁচাতো আর তাতে কাঞ্জিলাল জেঠিমা আর ইস্কুলের দিদিমণি এসে এই কাকিমাকে খুব ধমকাতো। এখন ইতিকে কাকিমা কিছু করলেও চেঁচানো বারণ। তাহলে না হলে না-খাইয়ে রাখে। ইতিকে ফ্ল্যাটের কারোর সাথে কথাও বলতে দ্যায় না এরা। ওকে তো দোকান-টোকান যেতে হয় না। তাই এই চার দেওয়ালের মধ্যে ও একেবারে আটকা। শুধু এই ফ্লাটের সামনের বারান্দাটাতে আসা বারণ নয়। তাও কাজ ফেলে নয়। বিকেল বেলা। এখানে দাঁড়ালে সোজা বাস রাস্তা দেখা যায়। ওপর থেকে বেশ দেখায়। বাস যায়, গাড়ি যায়। মনে মনে ঐ সব বাসে উঠে কতদূর চলে যায় ইতি! বাড়িতেও চলে যায়। এখানে পাশেই একটা পার্ক আছে। সেখানে বিকেলে বাচ্চারা, ওর বয়সী ছেলে-মেয়েরা খেলতে আসে। তারা সব বড়লোক বাড়ির ছেলেমেয়ে। দূর থেকে ওদের খেলেতে দ্যাখে আর ইতি মনে মনে নানা খেলা খেলে। ওর তো খেলা হয় না। একটু পরেই চা করো, খাবার গরম করো শুরু হবে। নানা ফরমায়েশ। কাজ করে আর মনে মনে ভাইয়ের বয়স হিসেব করে ও। হামা দিছে কিনা, বসতে পারছে কিনা, দাঁড়াতে পারছে কিনা--- নানা হিসেব করে। বুক বাঁধে নতুন আশায়। এবারে না হয় পারলো না। সামনের বছর বাড়িতে তো যাবেই। এখানেই ইতি ভাইফোঁটা দ্যায় বুল্‌টি দিদির একটা ফেলে দেওয়া পুতুলে। সেটাই ওর ভাই। মন্ত্রটা একেবারে মুখস্ত ওর। এ বারে যখন কাকিমারা হঠাৎ ওকে জানালো যে, তারা কাকুর অফিসের একটা কাজে যাবে, আর ওকে থাকতে হবে, তখন ও বলেছিলো,
--- আমি একা থাকবো কী করে! আমি কোনদিন একা থাকিনি তো। আমার ভয় করবে।
খ্যাঁক্‌ করেছে কাকিমা--- ভয় করবে! কেন? এখানে ভয় কী? এটা কি তোদের শেয়াল ডাকা গ্রাম? রাতের অন্ধকারে ঘুটঘুটে বাড়ি? লোডশেডিং হলেল তো ইনভার্‌টার আছে। ভয় বললেই হলো! ফালতু বাহানা করিস না। সবাই চলে গেলে বাড়িটা দেখবে কে? দিব্যি একা একা খাবি দাবি। সব বাজার-টাজার করা থাকবে ফ্রিজে। চিন্তা কী?
--- তাহলে তোমরা ফিরলে আমি কিন্তু বাড়ি যাবো। ভাই ফোঁটা দেবো।
এ কথায় রেগে আগুন হয় কাকিমা। তেলেবেগুলে জ্বলে উঠে বলে--- তুই আমাকে শর্ত দিচ্ছিস নাকি? আমি যাবো আর তার বিনিময়ে আমরা ফিরলে তুই যাবি? কী পেয়েছিসটা কী? তোর বাবাকে কী বলেছিলাম, মনে আছে? যখন-তখন বাড়ি যাওয়া চলবে না।
--- আমি তো অনেকদিন বাড়িতে যাই না। ভাইকে দেখিনি। ওকে ফোঁটা দেবো, ওর জন্যে জামা কিনবো, মিষ্টি কিনবো। ওকে তো আমি দেখিইনি।
দাঁত খেঁচায় কাকিমা--- আদিখ্যেতা! তা কিনবি যে, টাকা পাবি কোথায়? আর ভাইকে দেখলে কি তোদের পেট ভরবে? ভাই দেখবে! বুল্‌টি দিদি কোন ভাইফোঁটা দ্যায়?
--- সে তো বুল্‌টি দিদির কোন ভাই নেই, তাই। আমার তো ভাই আছে।
কাকিমা অন্য সময় হলে মেরে ইতির চামরা গুটিয়ে দিতো এ কথায়। কিন্তু আজ কোন মারধোর জুটলো না। কারণটা জানে ইতি। এখন মার জুটবে না। ওরা যে বেড়াতে যাচ্ছে। কাজে, না হাতি। এখানে থাকতে থাকতে অনেক কিছুই শিখে ফেলেছে। আজকাল বাড়িতে খাওয়া-দাওয়াও বদলেছে। এসবই কাকিমার ছলাকলা। ও জানে এসব। শিখে ফেলেছে। এও জানে যে, এখন কোনো মারধোরে যাবে না কাকিমা। সে শুধু কাকুকে ডেকে বলল,
--- শোনো, তোমার সাধের গাঁয়ের কাজের মেয়ের কথা শোনো। কী চীজ এনে ফেলেছো বাড়িতে! একসাথে থাকছে, খাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে অথচ তোমার মেয়েকে বলছে যে, ওর কোনো ভাই নেই, আর ওর আছে। কী বেইমান!
ইতি এর কোনো উত্তর দেয়নি। ও জানে এসব নাকে কান্না হচ্ছে কাকিমার নাটক। এখন বেড়াতে যাবে তো। তাই এসব ন্যাকামো করছে। ইতির কাছে নিজেকে অসহায় দেখাচ্ছে। ফিরে এসেই নিজ মূর্তি ধরবে। এরা গত বারের মতো এবারেও বাইরে থেকে তালা মেরে যাবে।
তাই গেছে ওরা। বাইরে থেকে তালা দিয়ে গেছে। শুধু তনু মাসী সকাল-বিকেল ফোন করে খবর নেয় সব ঠিকঠাক আছে কিনা। ইতির কোনো অসুবিধে হলে কী কী করতে হবে বলেও দ্যায়। এই সময়টা একটা মজা হয় ইতির। বাইরে বেরোতে যে পারে না, তা তো নতুন কিছু না। কিন্তু এই ক-টা দিন ও একেবারে স্বাধীন। কেউ বকার নেই, মারার নেই, ঘরের কাজকম্ম কম। একটু বিশ্রাম পায় ইতি। প্রাণ ভরে টিভি দেখতে পারে। কেউ বাঁধা দেবার নেই। তাই একা থাকতে ভয় ভয় করলেও এই বিশ্রামের, এই স্বাধীনতার সুযোগটাকে নষ্ট হতে দিতে চায় না ও। কিন্তু গতকাল ওর সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরে চুরমার হয়ে গেলো। সমস্ত পরাধীনতা, কষ্ট, অনাচার যে ও সহ্য করে চলেছে, তার তো একটা কারণ আছে। সেই কারণটাই শেষ হয়ে গেলো। বাড়িতে যাবার জন্যে যে একটা আগ্রহ মনের মধ্যে বাঁচিয়ে রেখেছিলো, তা মরে পচে গেলো।
কাল সকাল থেকে একটু জ্বর জ্বর লাগছিলো। মনে ভেবেছিলো ইতি যে, এমনটা তো হয়ই। সবদিন কাকিমাকে বলেও না ও। বললেও কাকিমা কী সব ওষুধ আছে, তা দ্যায়। দেখেছে ইতি। সেটা খেলে জ্বর চলে যায়। সেই ওষুধটা চেনে ইতি। ডাক্তার ডাকে না। রান্না শেষ হয়ে গেছে। আজ চান করবে না, ভেবে বারান্দাটায় এসে দাঁড়িয়েছে। বেশ একটু রোদ এসে পড়েছে। রোদটা গায়ে লাগলে বেশ আরাম লাগছে। মনে ভেবেছে যে, আজ ভাতও আর খাবে না। মুড়ি আছে টিনে। খেতে খেতে আর রাস্তার লোক দেখতে দেখতে ঠিক জ্বর সেরে যাবে। রাস্তা দিয়ে ব্যস্ত মানুষ চলেছে। মনে মনে চিন্তা করছিলো ইতি, বাবা নিশ্চয়ই এখন সবজি নিয়ে বাজারে এসেছে। মা নিশ্চয়ই এতদিনে বাড়ি বাড়ি কাজ করতে বেরিয়েছে। এসবের মধ্যে সবচেয়ে বেশি করে যেটা মনে এসে বাসা বাঁধে, সেটা ভাইকে দেখার বাসনা। কত বড়ো হলো, দিদিকে চিনবে তো? দিদি যে তোকে দেখবার জন্যে ব্যাকুল হচ্ছে, রে ভাই। আমি সামনের বারে তোকে ঠিক ফোঁটা দেবো। কারোর কোন কথা আমি শুনবো না।
এইসব ভাবছিলো আর চোখের জল মুছছিলো ইতি। হঠাৎ সামনের ফ্ল্যাট থেকে কে যেন ইতিকে দেখে ডেকে ওঠে। প্রথমটা বুঝতে পারেনি ও। রোদটা বেশ পিঠে এসে পড়ছে। আরামে চোখটা বুজে আসছিলো ওর। শীতের একটু একটু ঠাণ্ডা আমেজ আসছে। সামনের ফ্ল্যাটটা এই ফ্ল্যাটের একদম গায়ে লাগানো। তার সব জানলাগুলো বন্ধই ছিলো। কিন্তু কে যেন ডাকলো ওকে,
--- এই ইতু!
ইতু নামটা তো ওর গ্রামের নাম। এখানে তো কেউ ঐ নামে ডাকে না। কাউকে দেখতে পায় না ইতি। আমেজে একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছিলো ওর। চোখে ধাঁধা দেখে ইতি। হঠাৎ আবিষ্কার করে, সামনের ফ্ল্যাট থেকে একটা জানলা খুলে কে যেন ওর দিকে তাকিয়ে ওকেই ডাকছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখে, এ তো কল্পনা পিসি। নসুগঞ্জের কল্পনা পিসি। ওকে খুব ভালবাসে। পিসি বলে ওঠে,
--- ওমা! তুই এখানে থাকিস? এই ফ্ল্যাটে? আমি জানতেও পারিনি। এদিকের জানলাগুলো বন্ধ থাকে তো। এই ফ্ল্যাটে বামুন বাড়ির বড়ো ছেলে থাকে বুঝি? আমি তো জানিই না রে। আমি অবশ্য এই দিন চারেক এখানে এসেছি।
--- তুমি কি এই ফ্ল্যাটে রান্না করো? বাবা-মা কেমন আছে। গো পিসি? কিন্তু ইতি হঠাৎ ওর ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করতে যাবে, তখন পিসি বলল,
--- বাবা-মা? কেমন আর থাকবে! তা তুই সব জেনেও বাড়িতে গেলি না কেন রে?
--- আমি এ বারেও বাড়ি যেতে পারবো না গো, পিসি। সামনের বার পুজোতে বাড়ি যাবো। ভাইকে ফোঁটা দেবো।
চোখ বড়ো বড়ো করে কল্পনা পিসি বলে--- তুই কি কিছুই জানিস না? তোকে এরা কি কিছুই বলেনি? এরা তো সব জানে।
অজানা আশঙ্কায় ইতির মনে একটা কু-ডাক কে যেন ডেকে ওঠে। ও বলে--- কি গো পিসি? কী বলবে? কী জানবো? সবাই কেমন আছে গো?
--- তোর ভাইটা যে বাঁচলো না রে, ইতু। গত মাসে শেষ সোমবারে চলে গেলো। তিনদিনের জ্বরে ঠাকুর তাকে নিয়ে নিলো।
মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে ইতির। পিসি কী সব বলছে, কিছুই বুঝতে পারে না। মাথাটা ঝনঝন করে ওঠে, চোখদুটো টনটন করে। কোন রকমে নিজেকে সামলে বলে ওঠে--- তুমি এসব কী বলছো, কল্পু পিসি! কী বলছো! তুমি এসব  জানলে কী করে?
--- আমি জানবো না! আমি তো এখানে সবে এসেছি। ইতু, তোর ভাইটা মা বাবা কিছুই বলতো না রে। শুধু দিদ্দি আর দিদ্দি। কী ফুটফুটে দেখতে হয়েছিলো! তুই তো দেখিসই নি।
মাথাটা বন্‌বন্‌ করে ঘুরতে থাকে ইতির। ওর মন বলে ওঠে, গত মাসের শেষ  সোমবারে মানে কাকুদের বেড়াতে যাবার ঠিক আগে। এরা তাহলে সবটা জানে! ওকে বলেনি, পাছে ওদের বেড়াতে যাওয়াটা বাদ যায়। এরা এ্যাত নিষ্ঠুর! তাহলে ওর সাধের ভাইটা আর নেই! তাকে একবার চোখের দেখাও দেখতে পেলো না দিদি! চোখে কেমন যেন অন্ধকার দ্যাখে ও। মন বলতে থাকে, তাহলে মা-টা এখন কী করছে? মা তো কেঁদে কেঁদে সারা হচ্ছে! মা-টা তো এবারে মরেই যাবে। ভাইটাকে দেখবে বলেই তো চোখ-কান বুজে এখানে পড়ে থাকা, মার খাওয়া, মাইনে জমানো। তবু তো একদিন ফোঁটা দেবে। কিন্তু এখন এসব আর কী হবে! ভগবান এটা কী করলো! না। আর এখানে নয়। মা-র কাছে যেতে হবে। মাকে দেখতে হবে। মাকে বাঁচাতে হবে।
চোখদুটো জ্বালা করছিলো ইতির। মনে হচ্ছিলো, যেন চোখ ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসবে। সারা গায়ে একটা প্রচণ্ড শীত লাগছিলো। গা-টা কেমন যেন গুলিয়ে উঠছে। হঠাৎ সব অন্ধকার হয়ে গেলো। মাটিতে লুটিয়ে পড়লো ইতি। আর কিছু ওর মনে নেই।
-----------------


(৩)


একটু ঘোর কাটতেই আস্তে আস্তে সবকথা মনে পড়ে ইতির। শরীরে জোর নেই।। তবু টেনে হিঁচড়ে শরীরটাকে তুলে আজকে প্রথম একটা বোঝাপড়ার জন্যে গিয়ে দাঁড়ালো কাকু-কাকিমার সামনে। হাতের পিঠে চোখ মুছে নিয়ে দশ বছরের মেয়ে ইতি চব্বিশ বছরের মহিলার মতো বলল,
--- আমার আর ছুটি চাই না। আমার পাওনা-গণ্ডা মিটিয়ে দাও। আমি এখানে আর কাজ করবো না।
হাঁ করে তাকিয়ে রইলো অনিমা আর অনিমেষ। ওরা যেন নতুন এক ইতিকে দেখছে।

--------------------

মঙ্গলবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১১

'মাস্টারমশাই' ছোটগল্প


মাস্টারমশাই

হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়

মাস্টারমশাই  আত্মহত্যা করেছিলেন । আজকেই মনে পড়লো কথাটা। বিমানমাধব বাবুও স্কুল ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁর প্রাসাদোপম বাড়ি পড়ে আছে ভূতের বাড়ি হয়ে। তিনি অনেকদিন হলো, তাঁর ফ্যামিলি নিয়ে দেশের রাজনৈতিক চাপে কোথায়, অন্য কোন প্রদেশে পাড়ি দিয়েছেন, কে জানে। খোঁজ নেইনি। আজ আমি আমার চাকরীস্থলে চলেছি। সেখানে ঠিক একটা ঘর-টর ভাড়া নিয়ে থাকবোখন। আসলে আমিও তো আজ থেকে মাস্টারমশাই হলাম। এস.এস.সি. পরীক্ষায় বসে পেয়ে গেলাম চাকরীটা। বেশ কাম বয়সেই বাধিয়ে দিয়েছি। অন্য চাকরীর পরীক্ষাগুলোতে ঘষে সময় নষ্ট করিনি। টাফ কম্পিটিশন। ভালো ভালো ছেলে একজিকিউটিভ স্টাডি ছেড়ে এ লাইনে চলে এসেছে। তাদের সাথে আমি কি পারি? এ লাইনে মানে চাকরীর পরীক্ষার প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার লাইনে। কিন্তু এগুলোর মধ্যে স্কুল সার্ভিস কমিশন পরীক্ষা বেশ সহজ। পাস করে নেতা-কেতা ধরলে করলে আজো চাকরী জুটে যায়। কোরাপশানে কী না হয়! তবে পরীক্ষায় পাসটা করতে হবে। তাছাড়া এস.এস.সি. রেগুলার পরীক্ষা হয়, ঝটপট রেজাল্ট বের হয়, চটপট এ্যাপয়েন্‌টমেন্‌ট দিয়ে দ্যায়। আমার সাবজেক্ট ইতিহাস। এতে যথেষ্ট ভ্যাকান্সি থাকে। ক্লাশ সিক্স থেকে একেবারে বারো ক্লাশ পর্‌যন্ত আমাদের সুবিশাল ক্ষেত্র। তাই ঝপ করে জুটেও গেলো। ভি.আর.-ফি.আর. সব কমপ্লিট। কাছে নয়। একেবারে অন্য জেলায় গিয়ে পরীক্ষা দিয়েছি। প্রতিযোগী কম থাকে এতে। তাই পেলাম। পুরুষ মানুষ। অন্য জেলায় কী যায় আসে! যখন লোটা-কম্বল নিয়ে রওয়ানা দেবো, বাবা বলল,
--- দেখো, চাকরী করতে যাচ্ছো। জগত উদ্ধার করতে নয়। কোনো জটিল ব্যাপারে মাথা গলাবে না। চুপচাপ পড়াবে আর ঘরে ঢুকবে। হাওয়ার প্রতিকূলে যে দৌড়য়, সে কিন্তু গাধা।
আমি বাপের সুপুত্তুর। বাবা-র এই অমূল্য জ্ঞান কি ছাড়তে পারি! আমি জানি কীসে কী করতে হয়। আমার জীবনটা সততা আর অসততার দা-এ শীলে ঘষে ঘষে নিজে ঠেকে কষ্টিপাথর বানাবার শখ আমার নেই। কিন্তু বাবার এই কথাটা আমাকে মনে করিয়ে দিলো হেরম্ব বাবুর কথা, তাঁর জীবন। তিনি জীবনে এই সোজা কথাটা বোঝেননি। তিনি যে শিক্ষক, জাতির জনক নন্‌--- এটা তিনি বোঝেননি। তাই তাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছিলো। কিন্তু আমি তাঁর মতো মরতে চাই না। অবশ্য আমি কোনদিন হেরম্ব বাবু হতেও পারবো না। না বিদ্যায়, না অধ্যবসায়ে। আমার সে পোটেনশিয়ালিটি নেই শুধু নয়, পড়ানো আমার ধাতেও নেই। বাধ্য হয়ে দু-একটা টুইশানি তো করি। কিন্তু ওরা কামাই না করে পড়তে আসছে দেখলেই মাথা উষ্ণ হয়। শুধু মাসে প্রথম সপ্তাহ-টা গভীর যত্ন নিয়ে পড়াই। সে সময় যে মাইনে নিয়ে আসে ওরা। এমনটা আমি কেন শুধু! অনেকেই। কেননা ভালো ইনকাম টিউশানিতে। আর এবার আমাকে আর পায় কে! কিন্তু এসব পাঠ ছিলো না মাস্টারমশাইয়ের। পড়ানোতেই তাঁর আনন্দ ছিলো। বিনা অর্থে আমরা যে যখন খুশি, তাঁর বাড়িতে গিয়ে পড়ে আসতাম। সেই মাস্টার মশাই গলায় দড়ি দিয়েছিলেন।

সেই অনেকের মতো আমিও স্কুলটিচার হলাম। মাস্টারমশাইয়ের মৃত্যুর সেই দিনটা আমি ভুলেই ছিলাম। ভুলে থাকলেই বাঁচা সহজ। কিন্তু আমার ভবিতব্য আমাকে সেই মাস্টারমশাই-ই বানালো আর আমাকে অতীত মনে করিয়ে দিলো আমার বাবা। আমি যেখানে পড়াবো, সেখানে ছেলেমেয়েরা স্যার আজও বলতে শেখেনি। খুব খুশি হবো তেমনটা বললে। কিন্তু সে যে মোস্ট ইন্‌টেরিওর ভিলেজ। তা নয়তো পেতাম নাকি! সুতরাং আমাকে তারা মাস্টারমশাইলেই ডাকবে। ম্যাস্‌টরও বলতে পারে। আমার শিক্ষকতা আজ আমার বাবার একটা কথায় একটা স্মৃতি রোমন্থন করিয়ে দিয়ে একটা বাবলা কাঁটা হয়ে আমার মনের এক কোনায় বিঁধে গেলো।
মাস্টারমশাই ছিলেন আমাদের স্কুলের বাংলার শিক্ষক হেরম্ব বাবু। হেরম্ব চক্রবর্তী। তিনি গলায় দড়ি দিয়েছেন। আমরা সকলেই দেখতে গিয়েছিলাম। আমরা মানে আমি-নীহার, প্রবাল, শ্যামসুন্দর, ভবেশ, সঞ্জয়, তাপস এবং আরো অনেকে। সব ক্লাশ মেট্‌স। আমাদের স্কুলের অন্য ছাত্ররা এবং শিক্ষকেরাও এসেছিলেন। হেড স্যার, প্রফুল্ল বাবু, বিমানমাধব বাবু, কুমুদ বাবু এবং আরও অনেকে। আমি একটু দেরীতে গেছি। প্রবালদের সকলের সামনেই মাস্টারমশাই-এর দেহ তাঁরই ঘরের ছাদে টাঙ্গানো সিলিং ফ্যান থেকে নামানো হয়েছে। পুলিশ নামিয়েছে লোক দিয়ে। এরপর পাঠিয়ে দেবে লাশকাটা ঘরে। মরণোত্তর ছানবিন হবে, যার ইংরেজি নাম পোস্ট মরটেম। যদিও সবাই জানে যে, এটা আত্মহত্যা, কেননা মাস্টারমশাই কোন রাজনীতি করতেন না যে, তাঁকে বিরোধী দল মেরে রেখে দেবে। অবশ্য এই মেরে দেওয়াটা তখন থেকে আজও পর্‌যন্ত আকছার ঘটছে গোটা পশ্চিমবাংলা জুড়ে। তাই অনেকে অনেক কেসে সন্দেহ করে যে, খুনও হতে পারে। পুলিশ তো এসব বিচার করে না। তাদের নিয়মই হচ্ছে, কেউ অস্বাভাবিক ভাবে মারা গেলে তার দেহটা আইনমাফিক ময়না তদন্ত করতে হয়।
--- আমি তো জানতাম, কেউ গলায় দড়ি দিয়ে মারা গেলে তার চোখ-মুখ ভয়ংকর দেখতে হয়। মরার সময় একবার বাঁচতে চায় বলে অমনটা হয় নাকি। বাবা তো পুলিশ। বাবা-ই বলেছে। কিন্তু কৈ! মাস্টারমশাইকে তা তো দেখলাম না! তাহলে মাস্টার মশাই কি একটুও বাঁচতে চাননি? তিনি তো দিব্যি চোখদুটো বুজেছিলেন, যেন ঘুমোচ্ছেন। একদম স্বাভাবিক মুখ। শুইয়ে দিলে মনে হচ্ছে, যেন এক্ষুনি উঠে বসবেন আর বলবেন, জিনু….. মজিনু বিফ--অ…….মজিনু বিফল তপে অরণ্যের বড়ি।
এসব কথা বলল শ্যামসুন্দর। আমি শুনলাম। ঐ মজিনু…’ কবিতাটা মাইকেলের। বাংলাভাষা। আসলে ছত্রটা হলো, মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি । মাস্টারমশাই অবরেণ্যে বরি কথাটাকে একেবারে ছোট করে বলতেন অরণ্যের বড়ি। এমন করেই রসে-বশে আমাদের পড়াতেন তিনি। কঠিন কবিতা সহজ হয়ে যেতো। আজকে মনে হয়, তিনি বোধহয় অবরেণ্য শিক্ষকতাকে ভুল করে বরনই করেছিলেন। বিফল তাঁর মাস্টারমশাই হবার তপস্যা। তাঁকে গলায় দড়ি দিতে হোল। খুব মনে পড়ছিল, মাস্টারমশাই আমাদের একদিন বৃষ্টির ক্লাশে একটা কবিতা শুনিয়েছিলেন। কবিতাটার কোন গভীর অর্থ সেদিন বুঝিনি। আজো যে বুঝি, তাও নয়। মাস্টারমশাই মুখস্ত করতে বলেছিলেন। এরকম অনেক কবিতাই আমাদেরকে দিয়ে তিনি মুখস্ত করাতেন। এটা মনে আছে কারণ এটা নিয়ে একটা ঘটনা ঘটেছিলো। তাই মনে আছে। কবিতাটা বাড়িতে মুখস্ত করছিলাম, শুনে আমার বাবা, যার সাথে কাব্য-সাহিত্যের বিন্দুমাত্র কোন যোগ নেই, শুধু ডি.. বা টি.. কে কবে বাড়ছে বা কমছে এসব নিয়ে যার চিন্তা, তিনি ভীষণ ধম্‌কেছিলেন। মাস্টারমশাইয়ের নামে হেডস্যারের কাছে নালিশ করেছিল বাবা। তিনি নাকি আমাদের আজেবাজে সব কবিতা পড়ান। এসব তো সিলেবাসে নেই। বকা খেয়েছিলেন মাস্টারমশাই। কবিতাটা এরকম……
শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে - ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ ……
সেদিন এসব কথাগুলো মোটে ছোয়নি আমাদের। তবে কেউ একটা সুইসাইড করেছিলো, এটা বুঝেছিলাম। আর আজ মাস্টারমশাইয়ের মৃতদেহ দেখে মনে এলো কবিতাটার আরো কতগুলো ছত্র…….

কোনদিন জাগিবে না আর
জানিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম অবিরাম ভার
সহিবে না আর -
এই কথা বলেছিল তারে,
চাঁদ ডুবে গেলে - অদ্ভুত আঁধারে
যেন তার জানালার ধারে
উটের গ্রীবার মত কোন এক নিস্তব্ধতা এসে

এরপর থেকে আমাদের আর পাঠ্যের বাইরে নতুন কোনো কবিতা পড়াতেন না মাস্টারমশাই। সেদিন তাঁর ডেডবডির সামনে দাঁড়িয়ে আমি ভেতরে-ভেতরে ভেঙ্গে যাচ্ছিলাম। কে যেন আমার ভেতরে আর্তনাদ করে বলছিল, মাস্টারমশাই, আমি এসব চাইনি। আমি এমনটা ভাবিইনি। আপনি কি আমার ওপরে রাগ করে এমনটা করলেন? কিন্তু কথাগুলো সশব্দে বলার সাহস আমার ছিল না। আজও নেই। সবাই কাঁদছিল দাঁড়িয়ে এক কারণে, আর আমি কাঁদছিলাম অন্য কারণে। আমি বেশিই কাঁদছিলাম। নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না।
মাস্টারমশাই জেল থেকে ছাড়া পেতে অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে সেদিন সকালবেলা দাঁত ব্রাশ করছিলাম। খবরটা পেলাম প্রবালের থেকে। হঠাৎ ও হাফাতে হাফাতে এসে বলল,
--- শুনেছিস? মাস্টারমশাই না, সুইসাইড করেছেন?
প্রথমটা বিশ্বাস করিনি। পরে নিজের মনেই ভাবলাম, হ্যাঁ, মাস্টারমশাই তো সুইসাইড করতেই পারেন। না করাটাই তো অসম্ভব। আজ না করলে আর কবে করবেন! মাস্টারমশাই বলতে সকেলেই জানে, কে। অন্য শিক্ষকদের আমরা স্যারলতাম। শুধু হেরম্ব বাবু মাস্টারমশাই। কিন্তু তিনি যে একেবারে সুইসাইড করবেন, এমনটা আমি ভাবিনি। মানে এ্যাতোটা ভাবিনি। খবরটা শোনামাত্র একটুকাল চুপ করে দাঁড়িয়েছিলাম। প্রথমটা পুরো বিশ্বাস হয়নি। প্রবাল এমন নানা ঠাট্টা করে। প্রবাল বলল,
--- চল। যাবি না ?
তখনও ভেবে পারিনি, যাবো তো, কিন্তু কোথায়? বিমানমাধব বাবুর বাড়ি, নাকি সোজা মাস্টারমশাই-এর বাড়ি? একবার ভাবলাম, না। এখন যাবো না। লাশ নিয়ে পুলিশ চলে যাক। চোখের সামনে মাস্টারমশাই-এর মৃতদেহ আমি দেখতে পারবো না। মনে মনে ভয়ও আছে, যদি তিনি পুরো মারা না গিয়ে থাকেন? যদি আমাকে দেখে হঠাৎ বেঁচে ওঠেন? বলে ওঠেন,
--- নীহার, শেষে তুই! তুই যে আমার ছাত্র!
তখন কী বলবো আমি! সকলে তো জেনে যাবে ব্যাপারটা। তাই আগে লাশ নিয়ে পুলিশ চলে যাক। তবে যাবো। কিন্তু মানুষ তো সেদিকেই তাকায়, যেদিকে তাকাতে তার মন সায় দ্যায় না। রাস্তায় কোনো নোংরা দূর থেকে দেখে তাকাবো না তাকাবো নারেও চোখ অবাধ্য হয়ে ওঠে। তেমনই আমার হোল। ভাবলাম, যাই না। দেখে আসি। মাস্টারমশাই চোখ মেলে উঠবেন, এটা নিছক একটা কুসংস্কার। সে কি হয় নাকি! তাই অন্যদিনের থেকে অনেক ধীরে ব্রাশ করা শেষ করে গেলাম মধুমুরলী-তে। সেখানে মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি গীতালি। আগে মাস্টারমশাই তাঁর বাড়ি-টার কোনো নাম দেননি। পড়ে তাঁর স্ত্রী মারা যেতে স্ত্রীর নামে বাড়ির নাম দিয়েছিলেন।
মাস্টারমশাই-এর বাড়িতে সবুজ রঙের গেঁট, কাঠ দিয়ে বানানো। গেট ঠেলে ঢুকে একটু লনের মতো। তার দুপাশে মাস্টারমশাইয়ের হাতে করা ছোট্ট ছোট্ট দুটো বাগান। ফুলের বাগান। দুষ্প্রাপ্য কোন ফুল নয়। সস্তা। গাঁদা, দোপাটি এইসব। রাস্তার দুধারে আধখানা করে ইট-এর সারি আড়াআড়িভাবে পুতে তার কোনা তুলে রাখা। একটা সস্তা কায়দা করা। সেগুলো আবার চুন দিয়ে সাদা রং করা। সরু রাস্তাটায় বালির পাথর ফেলে ফেলে বেশ একটা পুরনো দিনের আদল দেওয়া। এসব পাথর আজকাল ফেলে না কেউ। ওর ওপর দিয়ে হাঁটলে বেশ মুচুর মুচুর শব্দ হয়। তারপর বারান্দা। এখানে মাস্টারমশাই সকালে আর সন্ধ্যায় বসে ক্লাসিক্যাল গান আর মিউজিক শুনতেন একটা পুরনো টেপ রেকর্ডারে। আমির খাঁ সাহেব, বড়ে গোলাম আলি খাঁ, ভীমসেন জোশি। তাছাড়া সেতার-সরোদ-সানাই শুনতেন। কী বুঝতেন, কে জানে! মাস্টারমশাইকে গাইতে তো কখনও শুনিনি। বাজাতেও দেখিনি। বারান্দাটা খোলা। শুধু কাঠের কোমর-সমান রেলিং দেওয়া। সেখানেও একটা গেট মতো আছে। সেটা ঠেলে বারান্দায় ঢুকতে হয়। দেখলাম, মাস্টারমশাইয়ের ইজি চেয়ারটা বারান্দায় সেইভাবেই বারান্দায় পাতা আছে। তাতে একটা তোয়ালে রাখা, যেমনটা থাকতো বরাবর। শুধু মাস্টারমশাই বারান্দায় শোওয়া, টান টান। মুখ থেকে গা অবধি ঢাকা দেওয়া। পাড়া-প্রতিবেশিদের কয়েকটা প্রশ্ন করছে পুলিশ। তারপর দেহ পাঠিয়ে দেবে মর্গে। ফলে যে ভয়টা সংস্কার বলে মন থেকে চলে গিয়েছিলো, সেটাই আবার আমার মনে হানা দিলো, যদি মাস্টারমশাই উঠে বসেন?
মাস্টারমশাই মারা গেলে কারোর কিছু যায়-আসে না। তাঁর মেয়ে আছে একটি। বিয়ে হয়ে গেছে কবে, কোন কালে । বাবা যে মারা যাবে একদিন, এটা বোঝার বয়স তাঁর হয়েছিলো। ফলে তারও তেমন কিছু যাবে-আসবে বলে তো দেখিনি কোনোদিন। বাবা মরলো কি বাছলো--- সে খবর তো সে নিয়েছে, দেখিনি। আজও সে এখনও এসে পৌঁছয়ইনি। তাদের বাড়ি দুর্গাপুর, না মধুপুর--- কোথায় যেন শুনেছিলাম। তাই সে যে বাবার দেহটা কাটা-ছেঁড়ার আগে এসে দেখবে, এখন তার কোনো উপায় নেই। এতক্ষণ দেহ ফেলে তো রাখবে না। তাঁকে বডি নিতে হবে মর্গ থেকে। তবে স্যারের তো দেহ-চোখ সব দান করা ছিলো। সেসব কী হবে, কে জানে।
আমি গিয়ে দেখলাম, তখনও আমাদের কোনো স্যার আসেননি। একে একে তাঁরা এলেন। অবশ্য যারা কাছেপিঠে থাকেন, তাঁরাই এলেন। কোন টিচার বেদনাহত নন। তবে তাঁরা সকলে একেবারে হাবেভাবে স্বাভাবিকও নন। আগে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলো তাঁরা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। তাই ব্যাপারটা তাঁরা অনেকে ধরতেও পারছেন না। যাদের মাস্টারমশাই-এর কোয়েশ্চেন পেপার স্ক্যান্‌ডালটা জানা ছিল না, তাঁরা প্রায় সকলেই মনে করছেন যে, হেরম্ব বাবু একটা মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। একাকীত্ব তাঁকে বোধহয় গ্রাস করছিলো। এই কারণেই তিনি বিনা পারিশ্রমিকে বাড়িতে ছাত্রদের ডেকে-ডেকে এনে পড়াতেন। সময়টা কাটাতে চাইতেন। হেরম্ব বাবু কোনকালেই ছাত্র ছাড়া অন্যদের কাছে খুব বলিয়ে-কইয়ে ছিলেন না। চুপচাপ। ছাত্র ছাড়া তেমন কোনো মেলামেশাও ছিল না। না সংস্কৃতি, না সমাজসেবা। ফলে অনেকে এমনটাই মনে করে নিয়েছে সহজে। একা একা আর কতদিন থাকা যায়!
কথাটা মোটে ভুল নয়। একটা সময় ছিলো, যখন মানুষকে দ্বীপান্তর সাজা দেওয়া হতো। হাতে-পায়ে শেকল নয়, সারাক্ষণ গারদে আবদ্ধ নয়, অনেকটা মুক্ত, ছাড়া অবস্থায় জীবন কাটাতো নানা অপরাধী। শুধু কথা বলার মত কেউ থাকতো না। সেই নির্জন দ্বীপ থেকে ফিরে আসার বা পালিয়ে যাবার কোনো উপায় নাকি থাকতো না। তাতেই মানুষ নাকি পাগল-টাগোল হয়ে যেতো। বইতে পড়েছিলাম আমি, একাকীত্ব নাকি বড়ো সাজা। যাদের সন্তানেরা বিরাট কোন ডিগ্রী ধারণ করে বিদেশে চলে যায়, তাদের বাবা-মায়েদের কোটি টাকা থাকলেও তাঁরা একটা হতাশায় ভোগেন। এমন খবর তো কাগজে হরবখত বেরোচ্ছে। তাই পাড়া-প্রতিবেশী ভেবেই নিয়েছে, এই একাকীত্ব হেরম্ব বাবুর আত্মহত্যার কারণ হয়েই থাকবে। অন্তত পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করলে তাঁরা এমনই বলেছেন, ভদ্রলোকটির বিবাহিতা মেয়ে তো ন-মাসে ছ-মাসে বাপের বাড়ি আসে। আর আসবেই বা কেন! এসে তো এখানে মায়ের হাতের যত্ন-আত্মি পাবে না। মা তো নেই।
কিন্তু আমি জানি, আর জানে বিমানমাধব বাবু, আমাদের স্কুলের বিজ্ঞানের টিচার। শুধু আমরাই জানি, মাস্টারমশাই কেন গলায় দড়ি দিলেন। আমার কাছে যেটা ছিল একটা নিতান্তই বালখিল্য, সেটা বিমানমাধব বাবুর কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। তিনি চেয়েছিলেন, যেন তেন প্রকারেণ হেরম্ব বাবুকে শায়েস্তা করতে হবে। তাঁর কিং কোবরার মতো ফনা তোলা মাথাটাকে গুটিয়ে দিতে হবে। বিমানমাধব বাবুর সাথে ছিলো ওখানকার মিউনিসিপ্যাল চেয়ারম্যান সাধন সাহা। তারও স্বার্থ ছিল। আমাকেই আমাদের স্যার দাবার বোরের মতো ব্যবহার করেছিলেন। আমি সেদিন বুঝতে পারিনি। আজ বুঝি। সেদিন বিমানমাধব বাবুকে পরম আপন মনে হয়েছিলো। তাঁর ফাঁদে আমি পা দিয়েছিলাম। ভাগ্যিস ঘটনাটা কেউ জানে না! জানলে আমার গায়ের ছাল ছাড়িয়ে নিতো আমাদের স্কুলের অন্য অন্য ছাত্ররা। আমার সহপাঠীরাও। হেরম্ব বাবু যে মোটামুটি সবার প্রিয় ছিলেন।
ঝামেলাটা তাঁর শুরু হয়েছিল সাধন সাহার সাথে। মাস্টারমশাইকে সাধন বাবু তাঁর ছেলেকে বাঙ্গলা আর সংস্কৃতটা পড়াতে বলেছিলেন। পড়ানো মানে একেবারে প্রফেশনালি পড়ানো। টাকা নিয়ে। প্রায় সবাই জানে, সাধন বাবু কাউকে ফ্রী কোনোকিছু সুবিধে পাইয়ে দেন না। এটা করলে সাধন বাবুদের চলে না। তাঁরা রাজনীতি করেন। আজকের রাজনীতির গোপন পাঠ-ই হোল, কোনো কোনো মানুষকে পাইয়ে দাও এটা ওটা, আর তার থেকে তুলনামূলক অনেক বেশীকিছু পাবার ব্যবস্থা করে নাও। সেটাই করতে চেয়েছিলেন সাধন সাহা।
সাধন সাহার ছেলে আমাদের ক্লাসমেট ছিলো। আসলে, ছিলো না, হোল। দু-বছর সেভেন আর দু বছর এইটের মায়া গড়াতে গড়াতে কাটাতে পেরেছিলো বলেই আমাদের ক্লাশমেট হলো। ততদিনে তার দাড়িগোঁফ গজিয়ে গেছে। আমরা তো তপন দাদালব, না নাম ধরে ডাকবো, তা প্রথম দিকটায় ঠাহর করতে পারছিলাম না। তবে সুবিধে এই ছিল যে, তপন ছিলো একটু-আধটু আলাভোলা। তার বাবার বিপরীত। এদেরকে বলে ইডিওডিক। পাশ ওর দ্বারা হবে না, এটা সাধন সাহার মতো অনেকেই বুঝেছিলো। তাই তাকে নাম ধরে ডাকলে বা দাদা কোনটাতেই তার আপত্তি ছিলো না। আর আমাদের কোন বিপত্তিও ছিলো না। কে না চায়, একজন সিনিয়ারকে নাম ধরে ডাকতে! তাই সে ছিল আমাদের তপন।
টুঁ পাইস ফাদার মাদার সাধন সাহা কিন্তু ছেলের ব্যাপারে ছিল খুব দুর্‌বল। তখন তাঁর হাত খুলে টাকা ব্যয় করতে কোনো দ্বিধা ছিল না। পত্নী আর উপপত্নী মিলিয়ে সাধন সাহার তিন তিনটে সংসার থাকলেও সন্তান কিন্তু তাঁর ছিলো ঐ সবেধন নীলমণি তপন। সেই তপন চারবার পরীক্ষায় ভূলুণ্ঠিত হতে সাধন বাবু বিমানমাধব বাবুকে ভালোমন্দ টাকার অফার দিয়ে গৃহশিক্ষক রেখেছিলেন। তিনিই তপনকে গোটা সাইন্স গ্রুপটা পড়াতেন। পড়াতেন না হাতি। চুক্তি ছিলো যে, বিমান মাধব বাবু তপনকে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পাইয়ে দেবেন। শুধু তাই নয়, ওর খাতাপত্রে পর্‌যন্ত পাশ মার্ক দিয়ে দেবেন। এসব একরকম ওপেন সিক্রেট ছিল। অনেকে অনেককিছু জানলেও ভয়ে কেউ কিছু বলতো না। পুলিশে ছুলে আঠারো ঘা, কিন্তু নেতা ছুলে আঠারো শো ঘা। এ জ্ঞান অনেকেরই আছে। এইটে তৃতীয় বারের বার কোয়াটারলিতে পরীক্ষায় তপন কিন্তু বাঙ্গলা আর সংস্কৃত ছাড়া আর সব বিষয়ে পাশ করলো। মানে পাশ করিয়ে দেওয়া হোল। ঠিকাদার সেই বিমানমাধব বাবু। সাধন সাহা চেয়েছিলেন, ছেলেটা কোনোরকমে মাধ্যমিক পাশ করলে তাকে পুরসভায় একটা চাকরীতে ঢুকিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে শ্বাস ফেলবেন তিনি। সাধন সাহাদের রাজত্ব কতদিন চলে, তার তো কোন ঠিক নেই। গদিতে থাকতে থাকতে যা করে যেতে পারে।
যদিও তখন রাজ্য জুড়ে স্কুলের শিক্ষকেরা প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না, এমন একটা সরকারী আদেশ জারীর হিড়িক উঠেছিলো, এবং আমাদের দু-একজন শিক্ষক প্রাইভেট পড়ানো ছেড়ে দিয়েছিলেন, এমনকি একজন ভূগোলের শিক্ষক প্রাইভেট পড়ানো ছাড়তে পারবেন না বলে স্কুলের চাকরী পর্‌যন্ত ছেড়ে দিয়েছিলেন, তথাপি বিমানমাধব বাবু কিন্তু বহাল তবিয়তে চুটিয়ে বাড়িতে পড়িয়ে যাচ্ছিলেন। কেউ তাঁকে খোঁচাতো না, কারণ তাঁর পাশে ছিলেন সাধন সাহা, আর তাঁর পার্টি।
সেই সাধন সাহাই অবশেষে ধরলেন মাস্টারমশাইকে। তাঁর ছেলেকে পড়াতে হবে। মানে তাকে পরীক্ষায় পাশের সুবন্দোবস্ত করে দিতে হবে। মাস্টারমশাই তো রেগেমেগে একশা। সাধন কেন! কোন ধনেই যে তাঁর আসক্তি নেই, তা বুঝিয়ে দিলেন। সাধন সাহা মাস্টারমশাইকে কলা দেখিয়ে বলে গেলেন,
--- আরে ছাড়ুন আপনার নীতি-আদর্শ। ভাত ছড়ালে কি কাকের অভাব হয়! আপনি না হোক, অন্য লোক তো আছে। বাঙ্গলা টিচার কি আর ইস্কুলে নেই!
এসব গল্প তপন আমাদেরকে বোকার মতো বলে দিতো। কিন্তু বিষয়টা সেখানে যে থেমে থাকেনি, তা ও বা আমরা কেউই বুঝিনি। আসলে সাধন বাবু এই অপমানটা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। বস্তুত এরা শান্ত হয়ে থাকে বটে, কিন্তু একদিন একেবারে অপ্রস্তুত অবস্থায় শত্রুর বিরুদ্ধে মারাত্মক পদক্ষেপ নিয়ে ফেলে।
মাস্টারমশাই আমাদেরকে বাঙ্গলা আর সংস্কৃত ভালো মতো শিখিয়েছিলেন। তিনি বলতেন--- মানুষ যতই ডেড ল্যাঙ্গুয়েজ বলে সংস্কৃত-কে গালাগাল করুক না কেন, মানুষ এটা অধ্যয়ন করুক আর আর করুক--- বিয়েতে, পারলৌকিক কাজে, পুজোয় তো বাঙ্গলা ভাষা মানুষ মেনে নেবে না, বল্‌। সেখানে দেবভাষা চাই-ই। ফলে এটা শিখে রাখ। তোদেরও কথা বলার অনেক ত্রুটি। শব্দোচ্চারনও বিভ্রান্ত। এমনটা হলে তো মনের ভাবটাই স্পষ্ট হবে না রে। ভাষা তো ভাবের বাহক। ভাষা বলতে-লিখতে জানা চাই। সংস্কৃত তোদের জিভের আড় ভেঙ্গে দেবে। আর এটা তো খুব সহজ ভাষা। বলেই তিনি দৃষ্টান্ত দিতেন--- ধর্‌, আমি যাই--- এখানে গম ধাতু লাগবে। মনে কর্‌, তোর মনে নেই। তুই বলে দে অহং গমনং করামি। শুধু কৃ ধাতুটা মনে রাখ্‌। কিম্বা তাও না পারলে বল্‌ গমনং করামি অহং বা করামি গমনং অহং। ব্যস। যা খুশি। সব ঠিক।
এছাড়া মাস্টারমশাই নানা সংস্কৃত ছড়া বলতেন। তার নানা অর্থ। আমরা মন দিয়ে শুনতাম। সেসব সম্পূর্ণ মনেও নেই। কিন্তু বিষয়গুলো মনে আছে আজো। আর আজকে কিনা তিনি গলায় দড়ি দিলেন! কে দায়ী? আমি, না বিমানমাধব বাবু, না সাধন সাহা? আমি তাঁর বোকা, মূর্খ ছাত্র। বিমানমাধব আর বাবুদের দাবার বোড়ে। এক চালেই মাস্টারমশাইকে মাত করানো হয়েছে আমাকে দিয়ে।
দুদিন আগেই হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় একটা অঙ্ক আমি ভবেশের খাতা থেকে টুকে লিখে দিচ্ছিলাম। ব্যস্‌। মাস্টারমশাই একেবারে হাতেনাতে আমাকে ধরেছেন। চিৎকার করে উঠেছেন,
--- তুই নকল করতে শিখেছিস! তুই ধরণী বাবুর ছেলে না? এই তোর শিক্ষা! আমি তোদেরকে এই শিখিয়েছি!
হাতে-পায়ে ধরেও সে যাত্রা রেহাই পাইনি। মাস্টারমশাই বললেন--- না না। তোর বাবাকে হয় বলতে হবে, ত নয়তো তোকে এই অঙ্ক পরীক্ষায় পাশ করানো হবে না। একটা শাস্তি তোকে মাথা পেতে নিতে হবেই। এটা আমাদের দায়িত্ব। শাস্তি না পেলে তুই ফের এমন কাজ করবি।
ফেল করাতে তিনি চাননি। তাই বাবাকে ডেকে মাস্টারমশাই যা নয় তা বলেছেন। বাবা আমাকে শ্যামচাঁদ-রায়চাঁদ তো খাওয়ালেনই, হাফ ইয়ারলি অঙ্ক পরীক্ষায় পাশ করাতে দিলেন না। মানে আমি দুটো শাস্তি খেলাম। এটাই আমার মনে একটা আগুন জ্বালিয়ে দিলো মাস্টারমশাইয়ের বিরুদ্ধে। কিন্তু একটা ক্লাশ এইটের ছাত্র কী-ই বা করতে পারে! কতটুকু ক্ষমতা তার! কিন্তু বদলার নেশা আমাকে পেয়ে বসলো। সকলের মনেই বদলার নেশা থাকে। সকলেই ভাবে, আমারও দিন আসবে। অবশেষে আমারও দিন এলো।
মাস্টারমশাইয়ের একটা বড়ো দোষ ছিল, স-ক-লকে তিনি শাসন করতে চাইতেন। অন্যায় দেখতে পারতেন না। আজ এসব বুঝি। কিন্তু তিনি বুঝতে চাইতেন না যে, তিনি চাকরী করতে এসেছেন। জগত উদ্ধার করতে কেউ কোনোকালে শিক্ষক হয়নি, আর আজও হয় না। এটা জীবিকা। শুধু জীবিকা। কিন্তু মাস্টারমশাই-এর সবটাতে বাড়াবাড়ি ছিলো। আমাদের ওপর তো বটেই, এমনকি মাস্টারমশাইদের ওপর পর্‌যন্ত। এমনকি একবার তাঁকে সরকার থেকে জাতীয় শিক্ষকের মর্‌যাদা দেবার প্রস্তাব উঠেছিলো। কিন্তু হেরম্ব বাবু হাসতে হাসতে এই সম্মানের লোভ ঠেলে ফেলে দিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য, শিক্ষক এমনিতেই তো জাতীর মেরুদণ্ড। তাঁকে আলাদা করে কেন পুরস্কৃত করা! আমাদেরকে সবসময় বলতেন, স্বদেশে পূজ্যতে রাজা, বিস্বান সর্‌বত্র পূজ্যতে। কিন্তু মাস্টারমশাই বুঝতেন না যে, আজকাল এসব শুভাশিতানি চলে না। এখন পড়াশুনো করে যে, গাড়ি চাপা পড়ে সে। বেশি কেন বলি! আমি হাফ ইয়ারলিতে ফেল করলাম, আর তপন পাশ করে গেলো। তারপর আমাদের সাথে পড়তো বেণু। পড়াশুনোয় তো ভাঁড়ে মা সরস্বতী ছিল। কিন্তু সেই এখন গাড়ি হাঁকিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর আমাদের বিপ্লব। বরাবর ফার্স্ট হতো। সে দারিদ্রে পড়াশুনো টানতে না পেরে আজকাল বাড়ি বাড়ি ছাত্র পড়িয়ে অসুস্থ বাবা-মা কে টানছে।
কিন্তু এসব কে বলবে মাস্টারমশাইকে! তাই স্কুলে বা স্কুলের বাইরে প্রায় সকলেই তাঁর ওপর কোন না কোন কারণে অসন্তুষ্ট হতো। আমিও হয়েছিলাম। আর এটাকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন বিমানমাধব বাবু। আমাদের বিজ্ঞানের শিক্ষক। তখন তো বুঝিনি, এটা একটা চাল ছিল। তখন তাঁকে মনে হয়েছিলো পরম মিত্র। আমি বদলা নিতে পারবো। মাস্টারমশাইয়ের বিরুদ্ধে বদলা। আমাকে পরীক্ষা হলে ধরে তিনি আমাকে সেই সাব্জেক্‌ট-টাতে ফেল করিয়ে দিয়েছিলেন। আমাকে বদলা নিতে হবে। মারি অরি পারি যে কৌশলে।
কিন্তু সেদিন যখন মাস্টারমশাইয়ের বডি পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে, আর তখন আমার ভেতর থেকে একটা চেতনা যেন আমাকে বারে বারে দংশন করছিলো। বার বার মনে হচ্ছিলো, কেন এ কাজটা আমি করলাম! আমি এত বোকা হলাম কী করে!
মাস্টারমশাই স্কুলে এই সকলকে শাসন করার বিষয়ে অনেক টিচারের গাত্রদাহের কারণ হয়ে উঠেছিলেন। অনেকে সরকারী নির্দেশ না মেনে প্রাইভেট টিউশান করতেন। এমনকি স্কুলে ছেলেদের বুঝিয়ে দিতেন যে, তাঁদের কাছে না পড়লে নম্বর পাওয়া যাবে না। সাইন্সের টিচাররা প্রাক্‌টিক্যালে মারবেন, অন্যও টিচাররা ওড়ালে মারবেন। এসব পলিসি ছিলো একেবারে সেট করা। তাই আমরাও পড়তে যেতাম, আর আমাদের বাবা-মায়েরাও পড়তে পাঠাতেন। কখনও প্রফুল্ল বাবু, কখনও কুমুদ বাবু, তো কখনও বিমানমাধব বাবু। কিন্তু এসব শুনে মাস্টারমশাই ক্ষোভে ফেটে পড়তেন। তাঁর কথা, কেন টিচারেরা প্রাইভেট পড়াবেন? সরকার যখন ভালো মাইনে দ্যায়, সরকার যখন বিষয়টা পছন্দ করছেন না, যখন নতুন আইন সারকুলার হয়ে স্কুলে স্কুলে আসতে চলেছে, তখন সেটাকে অমর্‌যাদা কেন করবেন শিক্ষকেরা? তাঁরা তো জাতির রূপকার। তাদেরকেই তো সবচেয়ে আগে আদর্শ মেনে চলতে হবে। এইসব নানা কথা মনে করতেন তিনি। আমাদেরকে এসব কিছুই বলতেন না। তবে আমাদের অভিভাবকদেরকে ব্যক্তিগতভাবে বোঝাতেন। আমরা ছিন্নভিন্নভাবে এসব শুনতাম। কিন্তু তাতে তাঁর ওপরেই সকলে অসন্তুষ্ট হতো। এটা তিনি বুঝতেন না, বা বুঝতে চাইতেন না। এই নিয়েই বিমানমাধব বাবুর সাথে তাঁর আদায়-কাচকলায় সম্বন্ধ। একবার তো আমরা শুনেছিলাম, তাঁদের মধ্যে স্টাফরুমেই একেবারে মুখোমুখি গণ্ডগোল বেধেছিল। এমনকি অবস্থা সামলাতে মাস্টারমশাই বিমান বাবুকে হুমকি দিয়েছিলেন যে, তিনি পর্ষদে কমপ্লেইন্ট জানাবেন পর্‌জন্ত।
সন্দেহ নেই, বিমানমাধব বাবুর বিরুদ্ধে অনেকেরই কিছু না কিছু বক্তব্য ছিল। তিনি ক্লাশ না করে পার্টির মিছিল-মিটিং করে বেড়াতেন, স্কুলের মধ্যে ছাত্রদের নিয়ে একটা রাজনৈতিক সেনা সংগ্রহের সংগঠনড়তে চেয়েছিলেন ইত্যাদি। এসব নিয়ে বিরোধী দলের সমর্থক টিচিং বা নন-টিচিং স্টাফদের সাথে কদাচার করতেন। সকলেই তাঁর ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু তাঁকে মাধ্যম করে তাঁরা অনেকে প্রয়োজনে অনেক কাজও করিয়েও নিতেন। পার্টির ওপর মহলে তাঁর যাতায়াত ছিলো। তাই অনেকেরই নৌকো তাঁর ঘাটে বাঁধা ছিলো। এক কথায় স্কুলে তিনি রাজ করতেন। হেডস্যার অবধি তাঁকে সমীহ করে চলতেন। মানতে বাধ্য হতেন।
এরই মধ্যে এ্যানুয়াল পরীক্ষার আগের একদিন বিমান বাবু একটা লোককে দিয়ে আমাকে খেলার মাঠ থেকে ডেকে পাঠালেন তাঁর বাড়িতে। ছোট বকুলতলায় নাট মন্দিরের পাশে বিমান বাবুর বাড়ি। অবশ্য আমরা তাঁর কাছে সাইন্স গ্রুপটা পড়তেই যেতাম। তবে সেটা অন্য একটা বাড়িতে। শুনেছিলাম, এটা তাঁরই বাড়ি। তবে তিনি স্বীকার করতেন না। বলতেন, তিনি নাকি সেটা ভাড়া নিয়ে পড়ান। বিমান বাবুর বসত বাড়িটা দেখলে সি.বি.আই. তদন্তের যথেষ্ট অবকাশ থাকে। একটা ছোটমোটো প্রাসাদ। বিশাল ব্যাপার। কী করে যে একজন স্কুলের শিক্ষক এ্যাত বড়ো বাড়ি করতে পারেন, ভাবা যায় না। সরকারের দৌলতে না হয় তাঁদের মাইনে-টাইনে বেড়েছে। তাঁরা সুখেই আছেন। কিন্তু তাই বলে এমন প্রাসাদোপম বাড়ি! এ তো কোন কালোপথে আসা কালোটাকা ছাড়া সম্ভব নয়।
তখন ছোট ছিলাম। এসব কিছুই বুঝিনি। আজ বুঝি। তিনি রাজনৈতিক ক্ষমতার যথেচ্ছ অপব্যবহার করতেন। নানা খাতে টাকা উপার্জন করতেন। তখন এ রাজ্যে বিধানসভার নির্‌বাচন ঘিরে একটা যুদ্ধের ঢাক বাজতে শুরু করেছে। কোন কোন মানুষের মনে ভয় বা প্রত্যাশা, এবার গণেশ ওলটাবে। তাই বিমানমাধব বাবু বেশ ভয় পেয়ে ছিলেন যে, যদি মাস্টারমশাই সত্যি সত্যি তাঁর সম্বন্ধে ঢেরা পিটিয়ে দ্যান, তবে তো কেঁচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে পড়তে পারে। সেদিন এসব বুঝলে কি আর বিমান বাবুর বাড়িতে যেতাম! অনেক কাল  পরে আজ সরকার বদলেছে। তাই বিমান বাবুদের মতো অনেকেই এখানে থাকেন না। তাঁরা গা ঢাকা দিয়েছেন। একটা সময় এ্যাতটা অন্যায়-অবিচার করেছেন যে, আজ মানুষ তাদেরকে সামনে পেলে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে। কিন্তু মাস্টারমশাই সত্যি সত্যি বিমান বাবু সম্বন্ধে কোন কথা কোথাও তুলতেন কিনা, আমরা অন্তত জানিনা। তিনি তো আর রাজনীতি করতেন না। তাই শত্রুতাও ছিলো না। তবে বিমান বাবু তাঁকে সে সুযোগ দেননি। কথাটা ঘুরিয়ে বললে বলা ভালো, আমি সে সুযোগ মাস্টারমশাইকে নিতে দিইনি।
সেদিন মাঠ থেকে আমাকে ডেকে পাঠালে আমি স্যার-এর বাড়িতে ঢুকতেই দেখি, সেখানে সাধন বাবু বসা। আমাকে দেখে উঠে এলেন স্যার। আমার পিঠে হাত দিয়ে বললেন,
--- কী রে, তোকে নাকি তোদের বাংলার প্রিয় মাস্টার হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় হাতে-নাতে টুকতে দেখেছে?
আমি ভাবলাম, সে তো কবে মিটে গেছে। এখন তো ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি। মাস্টারমশাই আত্মহত্যা করার পরে আমি বাবার থেকে জেনেছিলাম, কবে যেন আমাকে গোপন করে আমাদের মাস্টারমশাই আমার হাফ ইয়ারলি পরীক্ষাটা সামলে দিয়েছেন। তাই আমি ফাইনালে বসতে পেরেছিলাম। স্যারের কথায় ভাবলাম, আমাকে আর এক প্রস্থ হয়তো শ্যামচাঁদ রায়চাঁদ সইতে হবে। চোরের মন বোঁচকার দিকে। ভীষণ রাগ হোল মাস্টারমশাইয়ের ওপর। মনে মনে তাঁকে উদ্দেশ করে বললাম, তুমি তো আজ আছো, কাল নেই। কেন বেকার-বেকার আমাকে এমন হেনস্থা করলে! কিন্তু বিমান বাবুর পরের কথাগুলো শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। তিনি আমাকে বললেন,
--- কী রে, প্রতিশোধ নিবি না?
প্রতিশোধ তো আমি নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কিভাবে তা নিতে হয়, ক্লাশ এইটের ছাত্র তাই তো জানতো না।
বিমান বাবু বললেন--- আয়, তোদের মাস্টারমশাইয়ের সাথে একটা খেলা খেলি। তোকে যেমন ফেল করালো, আমাকে তোর পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হলো, তেমন তুইও একটা খেলা খেল। শোধবোধ।
আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। পা-দুটো ঝিমঝিম করছিলো। এটা একটা পরীক্ষা, না আমাকে সত্যিই কোন উপায় দিতে চান স্যার? বুঝলাম না।। কাঁচা বয়স। কতটুকুই বা বুঝি! ভালোমন্দ, ঠিক-বেঠিক সব গুলিয়ে যায়। মাথায় নানা দুষ্টুবুদ্ধি খেলে। এটা তো এ্যাডভেঞ্চারের বয়স। হুস ফিরল বিমান বাবুর ধমকে,
--- মাথা নিচু করে থাকবি না মেয়েদের মতো। তোদের বয়সে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল কত দামাল ছেলে, ইতিহাসে পড়িস নি? তাঁরা তোর মতো মাথা নিচু করে সব সয়ে নেয়নি। মাথা উঁচু কর, পুরুষমানুষ। নয়তো বাড়ি যা।
মিথ্যেপৌরুষ কত বয়ঃপ্রাপ্ত মানুষকেই ভুল পথে হাঁটায়। আর আমি তো ছেলেমানুষ। মন বলল, না, আমি মেয়ে নই। আমি পুরুষমানুষ। কোন ভয়-টয় আমি পাই না। নেবো। প্রতিশোধ নেবো। সুযোগ পেলেই নেবো। অন্তত এদের চোখে পুরুষ হবার জন্যে আমাকে নিতে হবে। মোটে একটা অঙ্ক দেখে করেছিলাম। আমি তো অঙ্কে কাঁচাই বরাবর। সবাই তো সব বিষয়ে পাকা হয় না। অন্য কোন বিষয়ে তো এসব করিনি। সৎভাবে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। কিন্তু ক্ষমতার জোরে মাস্টারমশাই আমাকে কঠিন শাস্তি দিয়েছিলেন। আজ আমি তাঁকে শাস্তি দেবো। তাই সাহসে বুক বেঁধে বললাম,
--- কী করতে হবে, স্যার?
--- তুই কালকেই তোদের মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে যাবি। ক্ষমা চাইবি তোর কৃতকর্মের জন্যে। যেন তুই আজকে বুঝেছিস এই সত্যটা। আমার ভ্রূ কুচকে গেলো। সেটা দেখে বিমান বাবু বললেন--- ঘাবড়াস নি। এবার আসল কথাটা শোন। তোকে করতেটা হবে কী।
তারপর আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে যা বললেন, তার গভীরতা আমি বুঝলাম না। শুধু শুনলাম। বুঝলাম যে, আমাকে এ নির্দেশ অন্ধের মতো পালন করতে হবে। কিন্তু জানি না, তাতে প্রতিশোধ কী করে হয়। তবে বিমানমাধব বাবু যখন, তখন চোখ বন্ধ করে ভরসা করা যায়। বিমান বাবুই বললেন,
--- তারপর খেলাটা দ্যাখ। তোর কথা কেউ জানতেও পারবে না। আর তুইও কাউকে জানাবি না। আমি তোকে ভালোবাসি। তোর বাবার সাথে আমার ভালো সম্পর্কও। তাই তোকে একটা চান্স দিচ্ছি। নিবি কিনা দ্যাখ।
চান্স নেব না মানে! বিলক্ষণ নেবো। আলবাত নেবো। আমি মেয়ে নই, ভিতু নই। মাস্টারমশাই বলেছেন, এ্যাত ছোট বয়সে নাকি আমি টুকে বিরাট পাপ করতে শিখে ফেলেছি। স্কুলে বন্ধুদের টিটকিরি খেয়েছি। হেনস্তা হয়েছে যথেষ্ট। বদলা চাই। ছাড়বো না। সেই মুহূর্তে বিমান বাবুকে মনে হচ্ছিলো এক দেবদূত, এক দেবপুরুষ।
পরদিনই কাজটা করে ফেললাম পরিকল্পনা মতো। ব্যস্‌। আর তাঁর পরের দিনই হঠাৎ আমাদের হেডস্যার রাস্তায় ক্লাশ এইটের বেশ কয়েকটা বাংলা আর সংস্কৃতের প্রশ্নপত্র কুড়িয়ে পান। রাস্তাটা মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে যাবার রাস্তা। হেডস্যার থাকতেন হেরম্ব বাবুর পাড়ার পাশের পাড়ায়। মধুমুরলি মাড়িয়ে তাঁকে আসতে হতো। তিনি স্কুলে গিয়েও দেখেন যে, বান্ডিলে বেশ কিছু প্রশ্নপত্র কম রয়েছে। । খোঁজ শুরু  হলো। বিমানমাধব বাবুর প্ররোচনায় হেডস্যার সোজা পুলিশ-ফুলিস নিয়ে মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি চড়াও হলেন। তিনিই প্রাইম সাসপেক্‌ট। সেখানে তাঁরা প্ল্যান মতো পেয়ে গেলেন আরও কিছু প্রশ্ন। লুকনো। এ্যারেস্‌ট হয়ে গেলেন মাস্টারমশাই।
কথাটা ঝড়ের মতো ছড়িয়ে যেতে লাগলো। মানুষ নানা মন্তব্য করতে লাগলো--- দেখেছ, কেমন সাধু সেজে ঘুরে থাকে! অথচ পেটে পেটে এ্যাত! এইসব। আমাদের কয়েকজন স্যার মাস্টারমশাইকে জামিনে ছাড়িয়ে আনলেন জেল থেকে। জামিন শব্দটার অর্থ সেদিন বুঝিনি আমি। শুধু মাস্টারমশাই ছাড়া পেতে যেন আমার বুক থেকে একটা পাথর নেমে গেলো। যাক, তবু তো মাস্টারমশাই ছাড়া পেয়েছেন। কিন্তু বাড়ি ফিরেই পরের দিন তিনি সুইসাইড করেন। এ অপমান, এ অবিশ্বাস সইতে পারেন নি।
আমি কাউকে বলতে পারিনি আমার এই পাপের কথা। খ্রিস্টানদের মতো আমাদের তো কনফেশনের কোনো সিস্টেম নেই। তাই…. । বারে বারে মনে হয়েছে, যদি আমাকে সবাই ঘেন্না করে? তখন বুঝেছিলাম, ঘৃণা নিয়ে বেচে থাকা যায় না। তাই মাস্টারমশাই চলে গেলেন। এবার নিজেকে ঘৃণা করতে করতে আমাকে শিক্ষকতা করতে হবে বাকি জীবন।

-----------------------