ছুটি
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়
হঠাৎ জ্ঞান ফেরে ইতি-র। তাকিয়ে দ্যাখে যে, ওর একপাশে দাঁড়িয়ে একজন পুলিশ। তাঁর মাথায় টুপি। ইতি প্রথমটায় ভয়ই পেয়ে যায়। তাহলে কি কাকীমা ওকে পুলিশে ধ’রিয়ে দিতে এনেছে? কিন্তু ও তো চুরি-টুরি কিছুই করেনি! তাহলে ওর দোষটা কী, বুঝতে পারে না ইতি। হঠাৎ এটাও লক্ষ্য করে যে, ও শুয়ে আছে বিছানায়। কাকিমাদের বিছানায়। এবারে ও আরও ভয় পেয়ে যায় এতে। ও মনে ক’রতে পারে না, কে ওকে এনে এখানে শুইয়েছে। কী হ’য়েছিলো, তাও ঠিকঠাক মনে প’ড়েছে না। তাহলে কাকিমারা কোথায়? এবারে ঘাড় ঘুরিয়ে বাঁ দিকে তাকায়। দ্যাখে যে, কাকিমা আর কাকু দাঁড়িয়ে। পাশে তনু মাসী। তাদের চোখেমুখে একটা অন্ধকার। কালো মেঘ ঘ’নিয়ে এসেছে যেন। ঠিক তেমন কাকীমা আর কাকুর মুখ। যেন মেঘ আকাশে থম্ মেরে আছে মেঘে। বৃষ্টির আগে যেমনটা হয়। কী হয়েছে, মনে ক’রে উঠতে পারে না ইতি। একদিকে পুলিশ, আর একদিকে কাকু-কাকিমা। বুল্টি দিদি কৈ? হঠাৎ পায়ের কাছে চোখ প’ড়তে দেখলো যে, সেখানে দাঁড়িয়ে পাশের ফ্ল্যাটের কাঞ্জিলাল জেঠু, দোতলার ইস্কুল দিদিমনি, দোতলার আর একজন কাকু। পরান কাকু। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ধ’রতে পারে না ও।
হঠাৎ পুলিশের লোকটি প্রশ্ন করে--- এখন কেমন আছো তুমি?
মাথা কাৎ ক’রে জবাব দ্যায় ইতি যে, ও ভালো আছে।
--- এবারে আমার কথার উত্তর দাও তো। তুমি এই বাড়িতে কেমন আছো? এখানে থাকতে কি তোমার ভালো লাগে?
এ কথাটার মানে বুঝতে পারে না ইতি। ভাবে, এসব কথা কেন ব’লছে পুলিশটা! তাই হা ক’রে তাকিয়ে থাকে। পুলিশটা আবার প্রশ্ন করে--- তোমাকে কি এ বাড়ির লোকেরা মারধোর করে?
একবার কাকু-কাকিমাদের দিকে তাকায় ইতি। বেশ বুঝতে পারে যে, তাঁরা ভয়ে কুঁকড়ে আছে। মনে মনে এও বুঝতে পারে, কেউ একজন এসব কথা ব’লেছে পুলিশটাকে। কে ব’লতে পারে? এসব তো জানে কাঞ্জিলাল জেঠিমা। কিন্তু সে তো এখানে নেই! ইতি কী ক’রে পুলিশকে বলে যে, ওকে এ বাড়িতে মারধোর করা হয়! এ বাড়িতে ও আছে আজ এ্যাতদিন। এখানকার ভাত খেয়েছে ও। যারা ওকে ভাত দিয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশকে কী ক’রে ব’লবে! পুলিশ মানেই তো ধ’রে নিয়ে যাওয়া। যদি কাকু-কাকিমাকে ধ’রে নিয়ে যায়, তবে বুল্টি দিদি-র কী হবে! সে যাবে কোথায়? বাবা-মাকে ছেড়ে একা একা থাকা যে কী কষ্ট, তা হাড়ে হাড়ে জানে ইতি। তাই চুপচাপ মাথা নেড়ে জানিয়ে দ্যায়, ‘না, আমাকে কেউ মারে না।’
ইস্কুল দিদিমনি এবারে ওকে বলে--- তুই ভয় পাস না? সত্যি ক’রে বল্। তোকে কেউ মারবে না। তোকে বুল্টি দিদির মা মারে কিনা?
--- না তো। মারে না তো। এবারে এই প্রথম মুখ ফাঁক করে মৃদু উত্তর দ্যায় ও।
--- তুমি বলছো, তুমি এ বাড়িতে ভালো আছো?
পুলিশটার প্রশ্ন শুনে ইতি আবার বলে--- হ্যাঁ, ভালো আছি।
--- তোমাকে এ বাড়িতে সবাই ভালবাসে।
--- হ্যাঁ, ভালবাসে।
স্পষ্ট দেখতে পায় ইতি যে, কাকিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মানে যেন তার ধরে প্রাণ এলো। এতক্ষণ সে দম বন্ধ ক’রেছিল। ইতি তো জানে না, ও বেফাঁস কিছু ব’লে দিলেই তো ওর কাকু-কাকিমা অনিমা আর অনিমেষ ফেঁসে যাবে। এমনিতেই তো একটা অপরিণত বয়সের মেয়েকে বাড়িতে কাজের লোক হিসেবে রেখেছে। এটা তো আইন বিরুদ্ধ। তার ওপর শারীরিক নির্যাতন! কিন্তু সকলকে অবাক ক’রে দিয়ে ইতি পুলিশের কাছে গোপন ক’রে গেলো বিষয়টা।
ইতি শুনলো, কাঞ্জিলাল জেঠু ব’লল--- আসলে মেয়েটা পুলিশ-টুলিশ দেখে ঘাবড়ে গেছে। তাই সত্যিটা ব’লতে চাইছে না। ফ্যাক্ট হ’লো, আমরা ওদের সার্ভিস নেই, কিন্তু ওদেরকে আত্মীয় ব’লে মনে ক’রি না। কিন্তু কখন যেন, ওদের মনেরও অজান্তে, আমাদেরকে ওরা আত্মীয় ক’রে ফ্যালে!
লোকাল থানার এস.আই. ব’ললেন--- সেটা তো আমার কিছু করার নেই, মিসেস গাঙ্গুলী। আমি যা শুনবো, সেটাই তো রিপোর্ট ক’রবো। আপনাদের ভিক্টিম তো নিজেই নিজেকে ভিক্টিমাইজ্ড ব’লছে না। এ বিষয় তো আমি তদন্ত ক’রে দেখতে যাবো না। হ্যাঁ, তবে এটা তো চাইল্ড লেবারের মধ্যে পড়ে। সেটা একটা কমপ্লেইন্ট হ’তে পারে। কিন্তু আমার বাড়িতেও তো একটা এরকম বাচ্চা মেয়ে কাজ করে। কী ক’রবেন? আমাদের লোক চাই আর ওদের খাবার চাই। কিছু তো করার নেই, না? আমরা ওদেরকে না নিলে ওরা না খেয়ে ম’রবে। আইন মানো, কিন্তু ভুখা মরো--- এটা তো কোন কথা নয়। এটা নিয়ে আর জল ঘোলা ক’রবেন না।
--- আপনি অন্তত এটা তো জানুন, মেয়েটা গোটা ফ্ল্যাটে একা থাকলো কী ক’রে? কোন গ্রাউন্ডে একটা ফ্যামিলি একটা নয়-দশ বছরের বাচ্চা মেয়েকে ফেলে এভাবে বেড়াতে যেতে পারে। এটা তো একটা ইম্মরাল ব্যাপার।
সেকেন্ড ফ্লোরের স্কুল মিস্ট্রেস অতসী গাঙ্গুলীর এমন নালিশে প্রতিবাদ ক’রলো অনিমেষ অর্থাৎ ইতির বর্তমান প্রভু, যাকে সে কাকু ব’লেই সম্বোধন করে--- আপনি কেন স্যারকে বার বার ক’রে আমাদের বিরুদ্ধে যেতে টেম্পটেড ক’রছেন, বলুন তো মিসেস গাঙ্গুলী? আপনার কী ইন্টারেস্ট? আমরা কি আপনাদের কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি? ইতি তো ব’লেছে, আমরা ওকে মারধোর ক’রি না। ও এখানে ভালো আছে। আপনার এত মাথা ব্যথা কেন? এটা কি আপনার স্কুল নাকি?
--- আপনি চুপ করুন, মিঃ রায়। একটাও কথা ব’লবেন না। আপনি বুঝতে পারছেন না, ইতি আপনাদেরকে সেভ ক’রছে? আপনি এটা খুব ভালো মতো জানেন। এটা নিয়ে আপনার সাথে বহুবার আমার কথা কাটাকাটি হয়নি?
কিন্তু ইতি জানিয়ে দিলো যে, সে নিজেই কাকু-কাকিমাদের সাথে বেড়াতে যেতে চায়নি। কাকু-কাকিমা ওকে বার বার যেতে ব’লেছিলো। কিন্তু ট্রেনে উঠতে নাকি ওর ভয় করে। আর এও ব’লল যে, তনুমাসী দুবেলা এখানে আসে। এসব কথা শুনে অবশ্য অনিমা আর অনিমেষ বিস্ময়ে হতবাক হ’য়ে গিয়েছিলো, কেননা ইতি এমন কথা কস্মিনকালেও বলেনি তাদেরকে যে, ওর ট্রেনে উঠতে ভয় করে। তারা ভালো মতো বুঝে নিলো ইতি তাদেরকে বিপদ থেকে রক্ষা ক’রে দিচ্ছে। তা নয়তো এ কেস তো তাদেরকে হাজত বাস ক’রিয়ে ছাড়ত। একে শিশুশ্রম করানো যার জন্য আজকাল বেশ ধরপাকড় চ’লছে। তার ওপর তাকে লক এ্যান্ড কী ক’রে গোটা বাড়িতে একা ফেলে বেড়াতে চ’লে যাওয়া। দুটিই গর্হিত অপরাধ। শিশুশ্রমটা আটকানো যায় এই ব’লে যে, ইতির বাবা-মা ওদের হাতে-পায়ে ধ’রে ওকে রেখে গেছে এখানে। খেতে দিতে পারছে না। ওরা একেবারে হত দরিদ্র। সত্যিই তো, সরকার আইন ক’রেছে, কিন্তু আইন কীভাবে বলবৎ থাকে, তার জন্যে যে ব্যবস্থা নিতে হয়, তা তো করেনি। ফলে আইন আছে আইনের জায়গায়, বাস্তব আছে বাস্তবে। ইতিদের পেটে ভাত নেই। আর তাই তারা কাজ ক’রতে বেরোতে বাধ্য। তা নয়তো খাবে কী! তথাপি আইন তো আইনই। সরকারের আবার সমালোচনা কী! তুমি বড় জোর পরেরবার ভোট-টা এই পার্টিকে দেবে না। ব্যস্। তাই আইনের যে কড়াকড়ি চ’লছে, তাতে তো অনিমা-অনিমেশ হালে পানি পেতো না। তখন কে দেখত বুল্টিকে! তাই মনে মনে ইতির কাছে তারা একটু কৃতজ্ঞ যে হ’লো না, তা নয়।
ইতি দেখলো, পুলিশটা চ’লে গেলো। ফ্ল্যাটের সকলে নানা দৃষ্টিতে ইতির কাকু-কাকিমাদের দিকে তাকাতে তাকাতে যে যার ঘরে একে একে ফিরে গেলো। শুধু দোতলার কল্যানেশ্বরী বালিকা বিদ্যামন্দিরের শিক্ষিকা অতসী গাঙ্গুলী ব’লে গেলেন,
--- শিখুন। ঐ ইতির কাছে শিখুন। কীভাবে আপনাদেরকে আজ বাঁচিয়ে দিলো। ইচ্ছে ক’রলেই আপনাদের সর্বনাশ ক’রতে পারতো ও।
এই দিদিমণিকে ভয় করে ফ্ল্যাটের নানা মানুষ। এর মূল কারণ হলো, তিনি একটা রাজনৈতিক দলের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। তাঁর ঘরে নানা সভা-সমিতি হয়। ভালোমন্দ মানুষ আসে। ফলে সবাই জানে যে, এঁর লোকবল আছে, প্রভাব-প্রতিপত্তিও আছে। তাই অনিমা-অনিমেষ চুপচাপ হজম ক’রে গেলো বিষয়টা। কিন্তু অনিমার বোন ব’লল,
--- তোরা এই মহিলার কথার উত্তর দিস কেন, বল্ তো!
--- ঝামেলাটা তো তুই পাকালি। এত লোক-টোক ডাকার কী দরকার ছিলো?
--- আমি ঝামেলা পাকালাম! আমি তো সকালেও ফোন ক’রেছিলাম। তখনও তো ও ভালই ছিলো।
--- তখন ভালো থাকলে হঠাৎ এমনটা কী ক’রে হ’লো, বলতো? এটা কেমন একটা অবাস্তব শোনাচ্ছে না?
তনিমা জানাল--- মেয়েটা অন্তত আমাকে তো শরীর খারাপ-টারাপ কিছু বলেনি। ব’ললে তো আমি তখনই ছুটে আসতাম। এতোকিছু তো ঘ’টতো না। বিকেলে আবার যখন ফোন ক’রলাম, তখন দেখি, ফোন ধ’রছে না। অন্তত বার পাঁচেক রিং ক’রলাম। বেজেই যাচ্ছে। তখন তো বাবীন আসবে স্কুল থেকে। তাকে খাওয়ানো, প’ড়তে বসানো, হোম-ওয়ার্ক করানো। কত কাজ! সব তো মাথায় উঠলো। পাশের ফ্ল্যাটের জবা দি-র ওপর বাবীনের দায়িত্ব ছেড়ে একটা অটো নিলাম। ডুপ্লিকেট দিয়ে তোদের দরজা খুলে দেখি, মেয়েটা সেই সামনের বারান্দাটায় মাটিতে প’ড়ে আছে। ওর গা জ্বরে পুরে যাচ্ছে। তোদের থার্মো তো খুঁজে পেলাম না। এবার আমি কী করবো, বলতো? থার্মোর জন্যে পাশের ফ্ল্যাটে বেল দিতেই ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। আমি তো জানি, তিনি অফিসে। আজ তো উইক ডে। তাঁর মিসেস নিশ্চয়ই বেরোবেন। কিন্তু তা হোল না। ব্যস্, জানাজানি হ’য়ে গেলো। ওরা তোদের খোঁজ ক’রতেই আমাকে ব’লতে হোল যে, তোর শ্বশুরবাড়িতে একজন অসুস্থ। তাই তোরা সেখানে গেছিস। ইতি যে একা ফ্ল্যাটে আছে, তা তো ওরা জানেনই না। ওরা জানে যে, তোরা গত দিন-তিনেক বাড়িতে নেই। তোদেরকে ওরা কেউ ফ্ল্যাটে দেখেনি। আমি যে এ ফ্ল্যাটে বসবাস ক’রছি না, এটা ওরা জানে, দেখলাম। ওরা ভেবেছিলো, তোরা ইতিকে নিয়েই পুজোর ছুটিতে বাইরে গেছিস। এর মধ্যে ঐ মহিলা, মানে ঐ স্কুল মিস্ট্রেস কোথা থেকে যেন ফিরেছে ফ্ল্যাটে। ব্যস্। সকলে তাকেই মন্ত্রী মনে ক’রে হাজারগণ্ডা নালিশ ক’রলো। এসব শুনে সে-ও রেগেমেগে একেবারে কাই। ডাক্তার-টাক্তার সবই সে আনলো বটে। কিন্তু আমাকে তো এই মারে কি সেই মারে। পুলিশ তো ঐ ডেকেছে। তোদের তো ফোন ক’রেছি অনেক পরে।
দিদি অভিযোগ করে--- তোকে তো ব’লেছিলাম, গোটা চারেক দিন পালা ক’রে এখানে কাটা। আকাশকে বল্ একটু মানিয়ে নিতে। কিন্তু তুই তো রাজী হ’লি না। এসব কি হ’তো? কী হেনস্তা! কী হেনস্তা!
ছোট বোন ফোঁস ক’রে ওঠে--- তোদের হেনস্তার জন্যে কি তুই আমাকে দায়ী ক’রছিস, দিদি?
--- তা নয়তো কী? মানুষের ভাই-বোন থাকে কী ক’রতে? তুই-ই বল্ না। পাশে থাকবার জন্যেই তো?
--- তার মানে! আমরা কি তোদের পাশে থাকি না, ব’লতে চাস?
--- না, ব’লতে চাইনি কিছুই। ঘ’টেছে। এটাই তো তার নমুনা।
দিদির মুখে এমনটা শুনে এবারে রণে ভঙ্গ দিতে চায় ছোটবোন তনিমা। কিন্তু পশ্চাদপসারন করার আগে প্রতিপক্ষকে একটা একটা শেষ প্রত্যাঘাত না ক’রে এমন পরাভব মেনে নেওয়া ঠিক নয় ব’লে মনে ক’রলো সে। তাই ব’লল,
--- এখন আমায় দুষছিস! তোরাই বা কাজের মেয়েটাকে না নিয়ে কেন বাইরে যাবি? ও কি মানুষ নয়? বুল্টির সাথে ইতির মালিক চাকর-এর পার্থক্য ছাড়া আর কী কোন পার্থক্য আছে রে? তুই-ও তো মা। ওরা দুজনই তো শিশু। তুই কেন মেয়েটার কথা ভাবলি না?
এ কথায় বেজায় রেগে যায় বড়োবোন অনিমা। এর একটা মোক্ষম জবাব দিতে তার জিভ লকলক ক’রে ওঠে। ব’লেও দ্যায়--- ও, তাহলে ঐ মাস্টারনী যা ব’লছিলো, তা তোরও পেটে পেটেও ছিল, বল্। ভালো। বেশ ভালো বোনের পরিচয় দিলি, তুই তনু। মনে থাকবে।
--- এসব কথা পেটে ছিলো, কি মাথায় ছিলো, তা তো ব’লতে পারব না রে, দিদি। তবে কথাটা যদি সত্যি হয়, তবে পেট, না মাথা, কোথায় ছিলো, সেটা বড়ো কথা নয়।
অনিমেষ এতক্ষণ বেশ তারিয়ে-তারিয়ে দুই বোনের কলহ শুনছিলো। বেশ লাগছিলো। অনিমেষদের নিজেদের ভাই-বোনদের মধ্যে মোটে সুসম্পর্ক নেই ব’লে ও একটা অন্তর্জ্বালায় ভুগতো। অনিমাদের ভাই-বোনদের মধ্যে একটা বেশ শক্ত বন্ধন আছে। বেশ চোখে প’ড়বার মতো বন্ধন। তাই একটা ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স কাজ ক’রতো ওর মনে। একটা ঈর্ষা ওকে সর্বদা খোঁচা দিতো। আজকে তার সামনে সেই তথাকথিত বন্ধন-এর খোলসটা ছিঁড়ে প’ড়তেই বেশ লাগছিলো। আজকে অনিমা আর অনিমেষ যেন সম-শ্রেণীভুক্ত হয়ে প’ড়লো। এ্যাতোদিন ছিলো বিজাতীয়। কিন্তু এবারে সে বুঝে নিলো, এখনই কথা না ব’ললেই নয়। এদেরকে নিরস্ত করা দরকার। নিজের স্ত্রীকে বিলক্ষণ চেনে সে। অনেকদূর নেমে যেতে পারে এই মহিলা। আজকেই কোনো ফাইনাল সিদ্ধান্তে এসে না পৌঁছোয়। তাই দুজনকেই থামিয়ে দিয়ে ব’লল,
--- একটা থার্ড গ্রেডের সাবজেক্ট নিয়ে তোমরা এত এক্সাইটেড হ’চ্ছো কেন? চলো, চা বানাই। ব্যাল্কনিতে ব’সে খাই। ডাক্তার দেখেছে, ওষুধ দিয়েছে। ব্যস্। ঠিক হ’য়ে যাবে। তবে এটা কিন্তু স্বীকার ক’রতেই হবে, ইচ্ছে ক’রলে ইতি আমাদের একেবারে ফাঁসিয়ে দিতে পারতো।
--- এটা কোন কথা হ’লো না, জামাইবাবু। আপনাদের যে অন্যায়টা হ’য়েছে, সেটা মেনে নিন। ইতি মেয়েটা ভালো। ওকে কদর দিন।
এবারে আস্তে শ্যালিকার কানের কাছে মুখটা নামিয়ে এনে অনিমেষ ব’লল--- আরে, আমি তো সাথে নিতেই চেয়েছিলাম। তোমার দিদি-ই তো…… আর জানোই তো তোমার দিদিকে। একটা ধুয়ো ধ’রলে বা একটা কথা ব’লে ফেললে তা থেকে নড়ানো সকলের কম্ম নয়।
বাস্তবে তনিমাই প্রথম আবিষ্কার ক’রেছে ইতিকে। সকালে সত্যি-ই সে ফোন ক’রেছিলো। টেলিফোনে ইতিকে দিয়ে মুসুর ডাল, ভাত আর তরকারি রাঁধিয়েছে। ফোনের বিল তুলেছে নিজের। ফুর্তি করেছে অনিমা, আর গ্যাঁট গচ্ছা দিয়েছে তনিমা, হ্যাপা সামলেছে তনিমা, আবার গালও খাচ্ছে সেই তনিমা-ই। এটাই ওর ভাগ্য বলে মনে করে ও। প্রথম কটাদিন বেশ নিয়ম মেনেই ফোন ক’রছিলো। দিনে চারবার।কে আসছে, কে যাচ্ছে--- সব জেনে শুনে নিচ্ছিলো। কিন্তু একটা কাজে নৈমিত্তিকতা এলেই তো মানুষ হঠাৎ অনিয়মিত হয়। তাই বিকেলে ছেলে বাবীন-কে স্কুল থেকে আনতে যাবার সময় একবার ফোন করবে, ভেবেছিলো। পরে ভাবলো, ‘থাক না। জলে তো প’ড়ে নেই মেয়েটা। ঘরে আছে। সেখানে তো ওকে কেউ এ্যাবডাকশন ক’রবে না। পরে ফোন ক’রলেই হবে।’ কিন্তু শেষে কী হলো, মনে করলো, ‘নাঃ, একবার খোঁজ নিয়েই দেখি। দিদি ফিরে মেয়েটাকে ঠিক জিজ্ঞেস করবে, ‘মাসি কতবার ফোন ক’রতো রে?’ দিদিকে হাড়ে হাড়ে চেনে বোন। তাই হঠাৎ ফোনটা ক’রে বসে। হয়তো এটা ওর ইনটিউশন। ওর সাবকন্সাস মাইন্ড হয়তো কিছু একটা আন্দাজ ক’রছিলো। আর তাই ফোন ক’রতেই দেখে যে, ইতি ফোন ধ’রছে না। এবারে তনিমা মহা বিপদে প’ড়ে যায়। এবার কোনদিকে যায়! দিদিদের পাশের ফ্ল্যাটের কারোর ফোন নম্বর জানা নেই। থাকলে জেনে নেওয়া যেতো। অগত্যা নিজের ছেলের দায়িত্ব অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে ডিউটি ক’রতে ছুটতে হ’লো। ছোট বড়ো নানা কাজে দিদি ছুটে আসে ছোট ভাই-বোনেদের বাড়িতে। এটা সত্যি। ফলে দিদির কাজটা যদি কোনোভাবে অবহেলিত হয়, তবে দিদি কী ব’লবে, আর ব’লবে না--- তার ঠিক নেই। কিন্তু এখানে যে এমনটা হবে, মানে এতোটা হবে, তা দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি তনিমা। কিন্তু বিষয়টা যে মাপে গিয়ে পৌঁছলো যে, এখান ব’সে চা-টুকু খাবার পরিবেশ আর নেই। তাই রাগ দেখিয়ে হাঁটা দিলো সে। এটা ছাড়া দিদির সাথে এঁটে ওঠা সম্ভব নয়। পেছনে অনিমেষ ডাকলো বটে, তবে এটাও তার বুঝতে কোনো অসুবিধে হ’লো না যে, তনিমা অনিমারই বোন। তাই নিজে চা খাবার জন্যে সে-ও উঠে গেলো। পুজোর ছুটিতে ঘুরতে গিয়ে যে এভাবে ফিরে আসতে হবে, তা তো ভাবেনি। গোটা টাকাটা জলে গেলো। রোমিং চার্জ কাটবে জেনেও মোবাইলটা খোলা রেখেছিলো।সেটাতে হঠাৎ তনুর কল আসে,
--- জামাই বাবু, আপনারা আজকেই ফিরুন। এখানে ঘটনা ঘ’টেছে।
--- কেন তনু? কী হ’য়েছে! তোমাদের কোনো বিপদ-টিপদ হোল নাকি?
--- আমাদের মানে, আপনাদের ইতি তো মহা বিপদ ক’রেছে!
--- কী করেছে? পালিয়েছে নাকি? আমি জানতাম। তোমার দিদিকে বার বার ক’রে ওকে ফেলে…..
--- আগে শুনুন না। আপনি যা ভাবছেন, তা নয়। ও ভয়ানক অসুস্থ। হাই ফিভার। জ্ঞান হারিয়ে ছিল। শুধু তাই নয়। কেসটা তো পুলিশ কেস হ’চ্ছে।
--- পুলিশ কেস মানে!
--- আসুন, তারপরে দেখবেন। আমি যতটা পেরেছি, ক’রেছি। এবারে তো আপনাদের লাগবে।
অনিমেষ চোখে অন্ধকার দ্যাখে। এত সহজ ফিরে যাওয়া! ওদের তো টিকিট কাটা র’য়েছে। আজ বা কালকের টিকিট পাবে কোথা থেকে? শেষে অনেক বেশি গচ্ছা দিয়ে দালাল ধ’রে তবে ফিরতে পেরেছে। আর ফিরে তো হেনস্তার চূড়ান্তও।
-----------------------
(২)
এ বাড়িতে ইতি এসেছিলো ওর বাবার হাত ধ’রে। বাবার কারখানাটা বন্ধ হ’য়ে গেলো দুম ক’রে। কাজ নেই, কম্ম নেই বাবার হাতে। শেষে বাবা বাজারে সবজি নিয়ে ব’সতে শুরু ক’রে দিলো। বেচা-কেনার অভ্যেস নেই। তাই বাবা কিছুতেই সুবিধে ক’রে উঠতে পারছিলো না। হঠাৎই ইতি জানতে পারে, ওর মা আবার মা হবে। ইতির পক্ষে এর গভীরতা জানার কথা নয়। তবু অভাবের ঘরে শিশুরা অনেক বেশি পরিণত হয় ব’লে এটা অন্তত বুঝে নিলো যে, ওর আদর খাবার আর কিছুই অবশিষ্ট র’ইলো না। একে বাবার টাকা-পয়সার অবস্থা খারাপ, অন্য দিকে ছোট একজন আসছে। এবার সেই সবটা পাবে। কিন্তু ওকে যে বাড়ি ছাড়তে হবে, সেটা মোটেও ভাবেনি ও। বাবার কাজ যেতেই মা কাজ শুরু ক’রে দিয়েছিলো অন্যের বাড়িতে। ঠিকা ঝি। কিন্তু মা-র পেট-টা ফুলে যাওয়ায় মা আর যেতে পারছিলো না কাজে। ঠাকুরকে নানা নিন্দামন্দ করে ইতি। ভাবে, ঠাকুর ইচ্ছে ক’রলেই এই নতুন বাচ্চা আসাটা বন্ধ ক’রতে পারতো। বাবা কী ক’রে চালাবে! মা তবু ক’টা টাকা আনতো। ইতির মনের মধ্যে বার বার উঁকি দিয়েছে আর একটা কথা--- ভাই, না বোন? কে আসছে? এমনটা ভাবতে গিয়ে ওর মনে একটা আনন্দও হ’য়েছে। ইতি দিদি হবে। ভাই বোন যেই হোক, ও দিদি হবে। এমনটা ভাবার পর থেকেই কবে যেন বাড়িতে এই সমাগত নতুন অতিথিকে ও ভালোবেসে ফ্যালে। আর ঠিক তখনই একদিন বাবা ওকে এই কাকু-কাকিমাদের বাড়িতে দিয়ে যায়। বাবা কানে কানে ওকে বুঝিয়ে যায়,
--- এখানে তুই ছোটো-খাটো কাজ ক’রবি, টাকা আয় করবি। তোর যদি ভাই হয়, তবে তুই নিজের টাকায় ভাইকে ভাইফোঁটা দিতে পারবি, জামা দিতে পারবি, জুতো দিতে পারবি। কী, ভালো হবে না?
মনে মনে ভাবে ইতি, ভালো তো হবে। কিন্তু ও বাবা-মাকে ছেড়ে কোনোদিন কোথাও থাকেনি। তখন তো এই কাকু-কাকিমা কলকাতায় থাকতো না। বাড়ির সকলের সাথে একসঙ্গে ইতিদের গ্রামেই বড়ো রাস্তার কাছে বিরাট বাড়িতে থাকতো। সেখান থেকেই কাকু অফিস যেতো। কিন্তু কাকুর এই কলকাতায় চ’লে আসার কথা চ’লছিলো। অতো দূর থেকে কাকু অফিস যেতে পারছিলো না। সেই কারণেই আগেভাগে ইতিকে কাজে নিয়ে রাখে তারা। বাবা-ই ইতিকে নিয়ে এসেছিলো কাকুদের বাড়িতে। মা এ বাড়িতে কাজ ক’রতো। বাবা কাকুর সাথে দেখা ক’রে ব’লেছিল,
--- আপনি তো নতুন জায়গায় চ’লে যাবেন। সেখানে আপনাদের নানা কাজে একজন কাজের লোক লাগতে পারে। কলকাতায় তো কাজের লোক পাওয়া সহজ নয়।
কাকু বলেছিলো--- হ্যাঁ, তো? তুমি এসব আমাকে ব’লছো কেন?
--- আসলে আমার কারখানাটা তো বন্ধ হ’য়ে গেলো। তার ওপরে ঝুমুরের আবার বাচ্চা হবে। বেশ আতান্তরে প’ড়ে যাবো। বাচ্চা দুটোকে খাওয়াবো কী?
কাকু জানত যে, ঝুমুর মানে ওদের বাড়ির ঠিকা ঝি। নিখিলের বৌ। তাই কাকু ব’লল--- এ্যাতোটুকু মেয়েকে কাজে লাগাবে! ভালো। তা তুমি আমার কাছে কী চাও?
--- আমার মেয়েটাকে আপনারা নিয়ে যান না। আপনারা চেনা-জানা পরিবার। আপনাদের কাজে লাগবে। আমাদেরও একটু সুবিধে হবে।
--- ঐ টুকু মেয়ে! ও কী করবে? ওর দ্বারা কি কোন কাজ হবে?
--- গরিবের ঘরের ছেলেমেয়ে, বাবু। ওরা সব পারে। ইতি-ও পারবে। তারপর ইতিকে দেখিয়ে বাবা বলে--- ওর নামই ইতি। একটা পেট থেকে তো রেহাই পাই। আর সংসারে দুটো টাকাও তো আসে।
--- সংসারে টাকা? তা কত চাও তুমি?
--- সে আপনি দেবেন বিবেচনা ক’রে।
--- শ-তিনেক টাকার বেশি কিন্তু দেওয়া সম্ভব নয়।
--- তাই দেবেন। আমি মাঝে মাঝে গিয়ে নিয়ে আসবো টাকা।
বাবার কথাগুলো ভালো লাগেনি ইতির। একদিকে বাবা ব’লছে, ইতি নিজের টাকা দিয়ে ভাই হ’লে তাকে এটা ওটা কিনে দিতে পারবে। আবার ব’লছে, মাঝে মাঝে এসে বাবা টাকা নিয়ে যাবে। কিন্তু ইতির খুব ভালো লেগেছে মার কথা। মা এসব শুনে বাবাকে খুব ব’কেছে। মা একেবারেই রাজী হয়নি মেয়েকে কাজে পাঠাতে। বাবাকে মা পরিষ্কার ব’লেছে,
--- তুমি আমার সাথে এইসব কথা বলেছো? আমার কিন্তু আমার মেয়েকে আমি কাজে পাঠাবো না। ওকে আমি ভালো বিয়ে দেবো। আমার এই পেটের সন্তানটাই অপয়া। তোমার কারখানাটা গেলো, মেয়ে বাড়ি ছেড়ে চ’লে যাবে। তার চেয়ে আমার পেট খ’সিয়ে দাও।। আমি আর মা হবো না।
বাবা মা-কে কিছু ব’লতে না পারলেও ইতি ছুটে এসে মার মুখে হাত চাপা দিয়েছে। মাকে আদর ক’রে বলেছে--- মা, এমন বোলো না। আমি কাজ ক’রবো, মা। আমাকে একটা ভাই দাও। আমার একটা ভাই চাই। আমি তাকে ফোঁটা দেবো। আমি যে মাইনে পাবো, তাই দিয়ে ভাইকে জামা, জুতো কিনে দিয়ে ফোঁটা দেবো। সবাই ভাইফোঁটা দ্যায়। আমি তো দিতে পারি না। তুমি এমন কথা ব’লো না। বামুন বাড়িতে বোনেরা ওদের ভাইদেরকে কেমন ফোঁটা দ্যায়, শাঁখ বাজে, উলু দ্যায়! আমার খুব ইচ্ছে হয়, মা। আমি মধুকা-র মেয়ে শ্যামলীর থেকে ভাইফোঁটার মন্ত্র শিখে নিয়েছি। ব’লে মাকে শুনিয়ে দিয়েছে ইতি--- ‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা / যম দুয়ারে পড়লো কাঁটা…..’
মা নীরবে তাকিয়ে থেকেছে মেয়ের দিকে। এইটুকু মেয়ের মধ্যে এ্যাতবড়ো একটা দিদি-কে দেখতে পায় মা। তারপর মেয়েকে জরিয়ে ধ’রে ইতির মা কেঁদেছে, আর বাবাকে ব’লেছে,
--- দাও। ওকে কাজেই দাও। আমার মেয়েটা যে এ্যাত বড়ো হ’য়ে গেছে, তা তো জানতাম না। কিন্তু ওর মাইনের একটা টাকা এই সংসারে আনবে না। ওতে ওর বিয়ে হবে। বড়ো ক’রে বিয়ে। খবর্দার!
তাই বাবার এখানে এসে কোনদিন টাকা নেওয়া হয়নি। সব জমা হ’চ্ছে কাকুর কাছে। এখানে এসে ইস্তক ইতি দেখেছে, কাকিমা বুল্টিকে নিয়ে একা সামলাতে পারে না। আলাপ-আলোচনায় শুনেছে, এই বাজারে ঠিকে ঝি রাখা নাকি একটা মুশকিল। ঠিকে ঝি-রা নাকি খুব কামাই-টামাই করে। তাই আর কোনো কাজের লোক নেই এ বাড়িতে। কলকাতায় এসে ইতিকেই ঘর মোছা, বাসন মাজা, সবজি কাটা সব শিখে নিতে হ’য়েছে। এসব কিছুই জানত না ইতি। মা তো এসব কিছুই ওকে দিয়ে করাতো না। শুধু খেলে বেড়ানো কাজ ছিল ওর। তাই কিছুই জানতো না ইতি। কিন্তু মনে জোর নিয়ে আগামী দিনের ‘দিদি’ ইতি এ বাড়িতে কাজ ক’রতো। কেননা যদি ওর ভাই হয়, তবে ও নিজের টাকা দিয়ে তাকে জামা-জুতো কিনে দিয়ে ফোঁটা দিতে পারবে। বাবার কথাটা কানে বাজতো, মার কথাটা মনে একটা দোলা দিতো, ‘আমার মেয়েটা যে এ্যাত বড়ো হ’য়ে গেছে, তা তো জানতাম না। কিন্তু ওর মাইনের একটা টাকা এই সংসারে আনবে না। ওতে ওর বিয়ে হবে। বড়ো ক’রে বিয়ে। খবর্দার!’
আর তাই শরীর ভেঙ্গে এলেও কাজ ক’রতো ইতি। কাজের শেষে ঘুমিয়ে প’ড়লে আর কোনো সার থাকে না ওর। দেহটা কোথায় যে চ’লে যায়! ঘুমে অজ্ঞান হ’য়ে যায় একেবারে। কাকিমাকে ধাক্কাধাক্কি ক’রে তুলতে হয়। ব্যস্। আবার বাক্যবাণ শুরু হয়। কিন্তু শরীরটাকে যে ও তুলতেই পারে না। উঠেই তো গাড়ি চ’লতে থাকবে। সকালে টিফিন খেতে খেতে বাজে বেলা দশটা। খিদেয় পেটের মধ্যে ঝাঁ ঝাঁ করে। কিন্তু মুখে রা-টি কাটে না। মাঝে মাঝে হাফিয়েও পড়ে বটে। কিন্তু এখানে খাওয়া-দাওয়াটা ভালো। সপ্তাহে দুটোদিন মাংস হয়। যদিও কাকিমা ভালো রাঁধে না, তবু তো মাংস। কাকু যেদিন রাঁধে, সেদিন খেতে ভালো হয়। এখানে একটা জিনিস খুব ভালো লাগে ওর। টিভি। রাতে বেশ টিভিতে সিরিয়াল দেখা যায়, সিনেমা দেখা যায়। অবশ্য কাকিমা যেগুলো দেখে, সেগুলোই গিলতে হয়, কাকিমার সাথে তা দেখে হাসতে হয়, না বুঝলেও কাঁদতে হয়। সারাদিনে শুধু তখনই কাকিমা ওর সাথে ভালো কথা বলে। সুখদুঃখ লেনদেন করে। নিজের নয়, যারা অভিনয় করে, তাদের সুখদুঃখ।
এখানে প্রথম দিকটা, কাজ ব’লতে ছিলো শুধু ফাই-ফরমাশ। যেমন, চায়ের জল চড়িয়ে দে, রান্নাগুলো ফ্রীজ থেকে বের ক’রে টেবিলে রাখ, গরম করে নে, বুল্টি দিদি ফিরেছে, ওর জলকাদা মাখা জুতো-টুতো পরিষ্কার ক’রে রাখ। এইসব। পরে এই কাজের ফিরিস্তি বাড়তে বাড়তে গোটা সংসার।। এখন ইতিই যেন এ বাড়ির আধা ঘরনি। ন-বছরের একটা মেয়ে প্রায় গোটা সংসারটা চালায়।
বাবা যেদিন ওকে নিয়ে এসেছিলো, সেদিন এসব কাজের কথা বার্তার মাঝখানে ঢুকে পড়েছিল কাকিমা। অর্থাৎ অনিমা। বুল্টির দিদির মা। সে একেবারে পাকা ব্যবস্থার মানুষ। সোজা ইতির বাবাকে জানিয়ে দিয়েছিলো,
--- দ্যাখো নিখিল, কাজে দিচ্ছো, দাও। আমাদের কিন্তু তেমন কোনো দরকার নেই। কিন্তু তুমি ব’লছো, তাই……। তবে ওকে দুমদাম বাড়িতে নেবার জন্যে কিন্তু বায়নাক্কা ক’রবে না। তোমাদের তো আবার দুদিন গেলেই প্রেম উথ্লে ওঠে। সব বাড়ির একটা সিস্টেম কিন্তু থাকে। মানতে পারবে তো?
মেনে নিয়েছিল বাবা, মেনে নিয়ে আছে ইতি এখানে। গোটা একটা বছরে আজ পর্যন্ত একবারও বাড়ি যাওয়া হয়নি ওর। ভাইফোঁটা কবে দেবে, সেসব ভুলতে ব’সেছে ইতি। কিন্তু ও জেনেছে যে, সত্যিই ওর একটা ভাই হ’য়েছে। তাই মনের মধ্যে সাধ যে, সামনের বছরে যাবে ফোঁটা দিতে। তাই এ বছর কাকিমাকে বলেওছিলো। কিন্তু ওরা এ বছর বাইরে কোথায় যেন ঘুরতে-টুরতে যাবে। তাই এবছরটাও চুপচাপ ব’সে গেছে ইতি। মুখে কোন রা কাটেনি। রা কেটেও তো লাভ নেই। এখানে এসে শুধু সংসারে কাজে নয়, অনেক ব্যাপারে সে-ও অনেকটা বড়ো হ’য়ে গেছে। ওর মা মনে ক’রেছিলো যে, তার মেয়ে বড়ো হ’য়েছে শুধু মনের বড়ত্বে, মহত্বে। কিন্তু এখানে এই একটা বছর থেকে সংসার জীবন সত্যিই ওকে অনেকটা বড়ো ক’রে দিয়েছে। বিশেষ ক’রে কাকিমা, হাতের প্রহার আর বাক্যবাণ। সেসব নীরবে সহ্য ক’রতে হয় ওকে আর চিনতে হয় সংসারকে। তার সাথে কাকু-কাকিমার মধ্যে নিজেদের ঘরে কথাবার্তা। সেসব কানে আসে ওর। কাকিমা ব’লেছে যে, কাকুর নাকি নসুগঞ্জ থেকে কলকাতা আসতে তেমন কোন কষ্টই ছিলো না। শুধুমাত্র কাকুকে দিয়ে একটা ফ্ল্যাট কিনিয়ে মানে মানে এরা স’রে প’ড়েছে বড়ো পরিবার থেকে। তাছাড়া কাকিমা কাকুকে সন্দেহ করে। কাকু নাকি কোন কোন মেয়েদের সাথে মেলামেশা করে। কাকুকে নজরে রাখতে কাকিমার এসব ব্যবস্থা। কাকুও মাঝে মাঝে কোনো কোনো রাতে বাড়ি ফেরে না। বলে, ‘অফিসের কাজে নাকি বাইরে যেতে হয়।’ কাকিমা বলে, ‘কাকুর মা-টা নাকি রাক্ষুসী।’ আর কত কী! এইসব শুনে শুনে মনে মনে ভাবে ইতি, ওকেও তো মা বিয়ে দেবে ব’লেছে। তবে ওকেও কি এসব শিখে রাখতে হবে? শাশুড়ির সাথে কি এমনটাই ক’রতে হয়? ইতি একটা বিষয়ে ধন্যবাদ দ্যায় কাকিমাকে। সেটা রান্না। ওকে কাকিমা রান্না শিখিয়ে দিয়েছে। নিজের স্বার্থেই দিয়েছে। কিন্তু তাতে লাভ তো ওরই হ’য়েছে। ওর বিয়ে হ’লে ওর বরকে তো না খেয়ে অফিস যেতে হবে না। মনে এইসব নানা কথা ভাবে ইতি আর কাজ করে। মনে আশা, এ বছর না হোক, পরের বছর তো বাড়ি যাবে। অনেক টাকা জমেছে ওর। ভাইকে ভালো ক’রে ফোঁটা দেবে। কাকিমা ব’লেছে,
--- এ বছর যেতে হবে না। সামনের বছর বাড়ি যাবি। আর কথা বাড়াবি না।
ইতি শুনেছে, প্রথম প্রথম কাকু কাকিমাকে ব’লতো--- মেয়েটাকে দিয়ে এভাবে কাজ ক’রিয়ো না। টিকবে না। তাছাড়া ওর বয়সটা কিন্তু এসব করার মতো নয়। কেস খেয়ে যাবে।
কাকিমা কাকুকে ধমক দিয়ে ব’লেছে--- তুমি থামো তো। আমাদের সমাজে মেয়েরা এসব ক্ষমতা নিয়েই জন্মায়। রান্নাবাটি খেলতে খেলতে আমরা রান্না শিখি। পুতুল খেলতে খেলতে সংসার। ওসব তোমাকে ভাবতে হবে না। দয়া করো, মেয়েটার সামনে এসব বোলো না।
শুনেছে ইতি। শুনতে হয় না। কাকিমার যে গলা, তাতে শুনতে না চাইলেও শোনা হ’য়ে যায়। কাকিমা আরও ব’লেছে--- একটা সংসারে একটা মানুষ পোষার খরচ জানো? কী দিয়ে পোষাবে? তুমি তো একেবারে তিনশো দেবে ব’লে এসেছো। দুশো ব’লতে পারলে না! তিনশো দিয়ে ওকে কি ব’সিয়ে খাওয়ানোর জন্যে আনা হ’য়েছে? ওদের বাড়িতে এ বয়সে ওদের বাবা-মা কী কী কাজ করায়, জানো তুমি? তুমি পুরুষমানুষ। সবদিকে তাকাতে হবে না। শুধু নিজেকে সামলে চ’লো। এটা আমাকেই বুঝতে দাও।
ইতি দেখেছে যে, কাকু একটু কাকিমাকে খুশি ক’রে ক’রে চলে। কেন? বুঝতে পারে না ইতি। এইভাবেই বছখানেকের মধ্যে অনেকটা বড়ো হ’য়ে গেছে ও। ও দেখেছে, ওর জন্যে এখানে কোনো নতুন জামা-টামার ব্যাপার নেই। না পুজো, না পয়লা বৈশাখ। ওকে বুল্টি দিদির ফেলে দেওয়া জামা প’রতে হয়। এটা সত্যি যে, সেই জামাই জীবনে চোখ দেখেনি ইতি। বেশ নতুন নতুন। কিন্তু পুরনো, বাসি তো বটে। তবু তাতে কোনো আপত্তি করেনি ও। তাই প’রেছে। একটাই খট্কা, ভাইকে দেখতে পাবে কবে? ভাই কতটা বড়ো হোল? উত্তর পায় না। বাবা ওকে যে এখানে দিয়ে গেছে, তার পর থেকে আর বাবারও কোনো পাত্তা নেই। বাড়ির কোন খবর নেই। মা কেমন আছে, জানে না ইতি?
এখানে কাকিমাকে মা হিসেবে পাবে, ভেবেছিলো। কিন্তু তা জোটে নি। এখানে কোন স্বাধীনতা পায় নি। একটা চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ জীবন। শুধু কাকিমা যখন বাড়িতে থাকে না, অনেকক্ষণের জন্যে বাজারে যায়, তখন ইতি একা একা টিভি দ্যাখে, কাকিমার একটা শাড়ি নিয়ে প’রে বৌ সাজে, আয়নায় নিজেকে দ্যাখে। শুধু তখনই ভাইয়ের কথা মনে পড়ে না। নিজে নিজে আয়নায় নিজেকে দেখে লজ্জা পায় ইতি। ভাবে, একদিন এভাবেই বৌ সেজে ও শ্বশুরবাড়ি চ’লে যাবে। কতবার ভেবেছে, একবার বুল্টি দিদির ভালো জামা প’রে দেখবে, কাকে দেখতে বেশি ভালো লাগে। কিন্তু সে সব তো থাকে আলমারিতে। পাবার তো কোন উপায় নেই। তাছাড়া কাকিমা একবার যদি এসব জানতে পারে, তবে খুন্তির ছেঁকা খেতে হবে। এখানে খুন্তির ছেঁকা, বেলনির বাড়ি, গায়ে কোনো গরম তরকারি, মাছের ঝোল বা ডাল ছুঁড়ে দেওয়া তো ওর একটা প্রাপ্য হ’য়ে গেছে। তবে পাশের কাঞ্জিলাল জেঠু-জেঠিমা আর ও পাশের ইস্কুলের দিদিমণি ওকে খুব ভালোবাসে। প্রথম প্রথম কাকিমা মারধোর ক’রলে ও চেঁচাতো আর তাতে কাঞ্জিলাল জেঠিমা আর ইস্কুলের দিদিমণি এসে এই কাকিমাকে খুব ধমকাতো। এখন ইতিকে কাকিমা কিছু ক’রলেও চেঁচানো বারণ। তাহলে না হ’লে না-খাইয়ে রাখে। ইতিকে ফ্ল্যাটের কারোর সাথে কথাও ব’লতে দ্যায় না এরা। ওকে তো দোকান-টোকান যেতে হয় না। তাই এই চার দেওয়ালের মধ্যে ও একেবারে আটকা। শুধু এই ফ্লাটের সামনের বারান্দাটাতে আসা বারণ নয়। তাও কাজ ফেলে নয়। বিকেল বেলা। এখানে দাঁড়ালে সোজা বাস রাস্তা দেখা যায়। ওপর থেকে বেশ দেখায়। বাস যায়, গাড়ি যায়। মনে মনে ঐ সব বাসে উঠে কতদূর চলে যায় ইতি! বাড়িতেও চ’লে যায়। এখানে পাশেই একটা পার্ক আছে। সেখানে বিকেলে বাচ্চারা, ওর বয়সী ছেলে-মেয়েরা খেলতে আসে। তারা সব বড়লোক বাড়ির ছেলেমেয়ে। দূর থেকে ওদের খেলেতে দ্যাখে আর ইতি মনে মনে নানা খেলা খেলে। ওর তো খেলা হয় না। একটু পরেই ‘চা করো, খাবার গরম করো’ শুরু হবে। নানা ফরমায়েশ। কাজ করে আর মনে মনে ভাইয়ের বয়স হিসেব করে ও। হামা দিছে কিনা, ব’সতে পারছে কিনা, দাঁড়াতে পারছে কিনা--- নানা হিসেব করে। বুক বাঁধে নতুন আশায়। এবারে না হয় পারলো না। সামনের বছর বাড়িতে তো যাবেই। এখানেই ইতি ভাইফোঁটা দ্যায় বুল্টি দিদির একটা ফেলে দেওয়া পুতুলে। সেটাই ওর ভাই। মন্ত্রটা একেবারে মুখস্ত ওর। এ বারে যখন কাকিমারা হঠাৎ ওকে জানালো যে, তারা কাকুর অফিসের একটা কাজে যাবে, আর ওকে থাকতে হবে, তখন ও বলেছিলো,
--- আমি একা থাকবো কী করে! আমি কোনদিন একা থাকিনি তো। আমার ভয় ক’রবে।
খ্যাঁক্ ক’রেছে কাকিমা--- ভয় করবে! কেন? এখানে ভয় কী? এটা কি তোদের শেয়াল ডাকা গ্রাম? রাতের অন্ধকারে ঘুটঘুটে বাড়ি? লোডশেডিং হলেল তো ইনভার্টার আছে। ভয় ব’ললেই হ’লো! ফালতু বাহানা ক’রিস না। সবাই চ’লে গেলে বাড়িটা দেখবে কে? দিব্যি একা একা খাবি দাবি। সব বাজার-টাজার করা থাকবে ফ্রিজে। চিন্তা কী?
--- তাহলে তোমরা ফিরলে আমি কিন্তু বাড়ি যাবো। ভাই ফোঁটা দেবো।
এ কথায় রেগে আগুন হয় কাকিমা। তেলেবেগুলে জ্ব’লে উঠে বলে--- তুই আমাকে শর্ত দিচ্ছিস নাকি? আমি যাবো আর তার বিনিময়ে আমরা ফিরলে তুই যাবি? কী পেয়েছিসটা কী? তোর বাবাকে কী ব’লেছিলাম, মনে আছে? যখন-তখন বাড়ি যাওয়া চ’লবে না।
--- আমি তো অনেকদিন বাড়িতে যাই না। ভাইকে দেখিনি। ওকে ফোঁটা দেবো, ওর জন্যে জামা কিনবো, মিষ্টি কিনবো। ওকে তো আমি দেখিইনি।
দাঁত খেঁচায় কাকিমা--- আদিখ্যেতা! তা কিনবি যে, টাকা পাবি কোথায়? আর ভাইকে দেখলে কি তোদের পেট ভ’রবে? ভাই দেখবে! বুল্টি দিদি কোন ভাইফোঁটা দ্যায়?
--- সে তো বুল্টি দিদির কোন ভাই নেই, তাই। আমার তো ভাই আছে।
কাকিমা অন্য সময় হ’লে মেরে ইতির চামরা গুটিয়ে দিতো এ কথায়। কিন্তু আজ কোন মারধোর জুটলো না। কারণটা জানে ইতি। এখন মার জুটবে না। ওরা যে বেড়াতে যাচ্ছে। কাজে, না হাতি। এখানে থাকতে থাকতে অনেক কিছুই শিখে ফেলেছে। আজকাল বাড়িতে খাওয়া-দাওয়াও ব’দলেছে। এসবই কাকিমার ছলাকলা। ও জানে এসব। শিখে ফেলেছে। এও জানে যে, এখন কোনো মারধোরে যাবে না কাকিমা। সে শুধু কাকুকে ডেকে ব’লল,
--- শোনো, তোমার সাধের গাঁয়ের কাজের মেয়ের কথা শোনো। কী চীজ এনে ফেলেছো বাড়িতে! একসাথে থাকছে, খাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে অথচ তোমার মেয়েকে ব’লছে যে, ওর কোনো ভাই নেই, আর ওর আছে। কী বেইমান!
ইতি এর কোনো উত্তর দেয়নি। ও জানে এসব নাকে কান্না হচ্ছে কাকিমার নাটক। এখন বেড়াতে যাবে তো। তাই এসব ন্যাকামো ক’রছে। ইতির কাছে নিজেকে অসহায় দেখাচ্ছে। ফিরে এসেই নিজ মূর্তি ধরবে। এরা গত বারের মতো এবারেও বাইরে থেকে তালা মেরে যাবে।
তাই গেছে ওরা। বাইরে থেকে তালা দিয়ে গেছে। শুধু তনু মাসী সকাল-বিকেল ফোন ক’রে খবর নেয় সব ঠিকঠাক আছে কিনা। ইতির কোনো অসুবিধে হলে কী কী ক’রতে হবে ব’লেও দ্যায়। এই সময়টা একটা মজা হয় ইতির। বাইরে বেরোতে যে পারে না, তা তো নতুন কিছু না। কিন্তু এই ক-টা দিন ও একেবারে স্বাধীন। কেউ বকার নেই, মারার নেই, ঘরের কাজকম্ম কম। একটু বিশ্রাম পায় ইতি। প্রাণ ভ’রে টিভি দেখতে পারে। কেউ বাঁধা দেবার নেই। তাই একা থাকতে ভয় ভয় ক’রলেও এই বিশ্রামের, এই স্বাধীনতার সুযোগটাকে নষ্ট হ’তে দিতে চায় না ও। কিন্তু গতকাল ওর সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরে চুরমার হ’য়ে গেলো। সমস্ত পরাধীনতা, কষ্ট, অনাচার যে ও সহ্য করে চ’লেছে, তার তো একটা কারণ আছে। সেই কারণটাই শেষ হ’য়ে গেলো। বাড়িতে যাবার জন্যে যে একটা আগ্রহ মনের মধ্যে বাঁচিয়ে রেখেছিলো, তা ম’রে প’চে গেলো।
কাল সকাল থেকে একটু জ্বর জ্বর লাগছিলো। মনে ভেবেছিলো ইতি যে, এমনটা তো হয়ই। সবদিন কাকিমাকে বলেও না ও। বললেও কাকিমা কী সব ওষুধ আছে, তা দ্যায়। দেখেছে ইতি। সেটা খেলে জ্বর চ’লে যায়। সেই ওষুধটা চেনে ইতি। ডাক্তার ডাকে না। রান্না শেষ হ’য়ে গেছে। আজ চান ক’রবে না, ভেবে বারান্দাটায় এসে দাঁড়িয়েছে। বেশ একটু রোদ এসে প’ড়েছে। রোদটা গায়ে লাগলে বেশ আরাম লাগছে। মনে ভেবেছে যে, আজ ভাতও আর খাবে না। মুড়ি আছে টিনে। খেতে খেতে আর রাস্তার লোক দেখতে দেখতে ঠিক জ্বর সেরে যাবে। রাস্তা দিয়ে ব্যস্ত মানুষ চ’লেছে। মনে মনে চিন্তা ক’রছিলো ইতি, বাবা নিশ্চয়ই এখন সবজি নিয়ে বাজারে এসেছে। মা নিশ্চয়ই এতদিনে বাড়ি বাড়ি কাজ ক’রতে বেরিয়েছে। এসবের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক’রে যেটা মনে এসে বাসা বাঁধে, সেটা ভাইকে দেখার বাসনা। কত বড়ো হলো, দিদিকে চিনবে তো? দিদি যে তোকে দেখবার জন্যে ব্যাকুল হচ্ছে, রে ভাই। আমি সামনের বারে তোকে ঠিক ফোঁটা দেবো। কারোর কোন কথা আমি শুনবো না।
এইসব ভাবছিলো আর চোখের জল মুছছিলো ইতি। হঠাৎ সামনের ফ্ল্যাট থেকে কে যেন ইতিকে দেখে ডেকে ওঠে। প্রথমটা বুঝতে পারেনি ও। রোদটা বেশ পিঠে এসে প’ড়ছে। আরামে চোখটা বুজে আসছিলো ওর। শীতের একটু একটু ঠাণ্ডা আমেজ আসছে। সামনের ফ্ল্যাটটা এই ফ্ল্যাটের একদম গায়ে লাগানো। তার সব জানলাগুলো বন্ধই ছিলো। কিন্তু কে যেন ডাকলো ওকে,
--- এই ইতু!
ইতু নামটা তো ওর গ্রামের নাম। এখানে তো কেউ ঐ নামে ডাকে না। কাউকে দেখতে পায় না ইতি। আমেজে একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছিলো ওর। চোখে ধাঁধা দেখে ইতি। হঠাৎ আবিষ্কার করে, সামনের ফ্ল্যাট থেকে একটা জানলা খুলে কে যেন ওর দিকে তাকিয়ে ওকেই ডাকছে। ভালো ক’রে তাকিয়ে দেখে, এ তো কল্পনা পিসি। নসুগঞ্জের কল্পনা পিসি। ওকে খুব ভালবাসে। পিসি বলে ওঠে,
--- ওমা! তুই এখানে থাকিস? এই ফ্ল্যাটে? আমি জানতেও পারিনি। এদিকের জানলাগুলো বন্ধ থাকে তো। এই ফ্ল্যাটে বামুন বাড়ির বড়ো ছেলে থাকে বুঝি? আমি তো জানিই না রে। আমি অবশ্য এই দিন চারেক এখানে এসেছি।
--- তুমি কি এই ফ্ল্যাটে রান্না করো? বাবা-মা কেমন আছে। গো পিসি? কিন্তু ইতি হঠাৎ ওর ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস ক’রতে যাবে, তখন পিসি ব’লল,
--- বাবা-মা? কেমন আর থাকবে! তা তুই সব জেনেও বাড়িতে গেলি না কেন রে?
--- আমি এ বারেও বাড়ি যেতে পারবো না গো, পিসি। সামনের বার পুজোতে বাড়ি যাবো। ভাইকে ফোঁটা দেবো।
চোখ বড়ো বড়ো ক’রে কল্পনা পিসি বলে--- তুই কি কিছুই জানিস না? তোকে এরা কি কিছুই বলেনি? এরা তো সব জানে।
অজানা আশঙ্কায় ইতির মনে একটা কু-ডাক কে যেন ডেকে ওঠে। ও বলে--- কি গো পিসি? কী ব’লবে? কী জানবো? সবাই কেমন আছে গো?
--- তোর ভাইটা যে বাঁচলো না রে, ইতু। গত মাসে শেষ সোমবারে চ’লে গেলো। তিনদিনের জ্বরে ঠাকুর তাকে নিয়ে নিলো।
মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে ইতির। পিসি কী সব ব’লছে, কিছুই বুঝতে পারে না। মাথাটা ঝনঝন ক’রে ওঠে, চোখদুটো টনটন করে। কোন রকমে নিজেকে সামলে ব’লে ওঠে--- তুমি এসব কী বলছো, কল্পু পিসি! কী বলছো! তুমি এসব জানলে কী করে?
--- আমি জানবো না! আমি তো এখানে সবে এসেছি। ইতু, তোর ভাইটা ‘মা’ ‘বাবা’ কিছুই ব’লতো না রে। শুধু ‘দিদ্দি’ আর ‘দিদ্দি’। কী ফুটফুটে দেখতে হ’য়েছিলো! তুই তো দেখিসই নি।
মাথাটা বন্বন্ ক’রে ঘুরতে থাকে ইতির। ওর মন বলে ওঠে, গত মাসের শেষ সোমবারে মানে কাকুদের বেড়াতে যাবার ঠিক আগে। এরা তাহলে সবটা জানে! ওকে বলেনি, পাছে ওদের বেড়াতে যাওয়াটা বাদ যায়। এরা এ্যাত নিষ্ঠুর! তাহলে ওর সাধের ভাইটা আর নেই! তাকে একবার চোখের দেখাও দেখতে পেলো না দিদি! চোখে কেমন যেন অন্ধকার দ্যাখে ও। মন বলতে থাকে, তাহলে মা-টা এখন কী ক’রছে? মা তো কেঁদে কেঁদে সারা হচ্ছে! মা-টা তো এবারে ম’রেই যাবে। ভাইটাকে দেখবে ব’লেই তো চোখ-কান বুজে এখানে প’ড়ে থাকা, মার খাওয়া, মাইনে জমানো। তবু তো একদিন ফোঁটা দেবে। কিন্তু এখন এসব আর কী হবে! ভগবান এটা কী করলো! না। আর এখানে নয়। মা-র কাছে যেতে হবে। মাকে দেখতে হবে। মাকে বাঁচাতে হবে।
চোখদুটো জ্বালা করছিলো ইতির। মনে হচ্ছিলো, যেন চোখ ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসবে। সারা গায়ে একটা প্রচণ্ড শীত লাগছিলো। গা-টা কেমন যেন গুলিয়ে উঠছে। হঠাৎ সব অন্ধকার হয়ে গেলো। মাটিতে লুটিয়ে প’ড়লো ইতি। আর কিছু ওর মনে নেই।
-----------------
(৩)
একটু ঘোর কাটতেই আস্তে আস্তে সবকথা মনে পড়ে ইতির। শরীরে জোর নেই।। তবু টেনে হিঁচড়ে শরীরটাকে তুলে আজকে প্রথম একটা বোঝাপড়ার জন্যে গিয়ে দাঁড়ালো কাকু-কাকিমার সামনে। হাতের পিঠে চোখ মুছে নিয়ে দশ বছরের মেয়ে ইতি চব্বিশ বছরের মহিলার মতো ব’লল,
--- আমার আর ছুটি চাই না। আমার পাওনা-গণ্ডা মিটিয়ে দাও। আমি এখানে আর কাজ করবো না।
হাঁ করে তাকিয়ে রইলো অনিমা আর অনিমেষ। ওরা যেন নতুন এক ইতিকে দেখছে।
--------------------