মঙ্গলবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১১

'মাস্টারমশাই' ছোটগল্প


মাস্টারমশাই

হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়

মাস্টারমশাই  আত্মহত্যা করেছিলেন । আজকেই মনে পড়লো কথাটা। বিমানমাধব বাবুও স্কুল ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁর প্রাসাদোপম বাড়ি পড়ে আছে ভূতের বাড়ি হয়ে। তিনি অনেকদিন হলো, তাঁর ফ্যামিলি নিয়ে দেশের রাজনৈতিক চাপে কোথায়, অন্য কোন প্রদেশে পাড়ি দিয়েছেন, কে জানে। খোঁজ নেইনি। আজ আমি আমার চাকরীস্থলে চলেছি। সেখানে ঠিক একটা ঘর-টর ভাড়া নিয়ে থাকবোখন। আসলে আমিও তো আজ থেকে মাস্টারমশাই হলাম। এস.এস.সি. পরীক্ষায় বসে পেয়ে গেলাম চাকরীটা। বেশ কাম বয়সেই বাধিয়ে দিয়েছি। অন্য চাকরীর পরীক্ষাগুলোতে ঘষে সময় নষ্ট করিনি। টাফ কম্পিটিশন। ভালো ভালো ছেলে একজিকিউটিভ স্টাডি ছেড়ে এ লাইনে চলে এসেছে। তাদের সাথে আমি কি পারি? এ লাইনে মানে চাকরীর পরীক্ষার প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার লাইনে। কিন্তু এগুলোর মধ্যে স্কুল সার্ভিস কমিশন পরীক্ষা বেশ সহজ। পাস করে নেতা-কেতা ধরলে করলে আজো চাকরী জুটে যায়। কোরাপশানে কী না হয়! তবে পরীক্ষায় পাসটা করতে হবে। তাছাড়া এস.এস.সি. রেগুলার পরীক্ষা হয়, ঝটপট রেজাল্ট বের হয়, চটপট এ্যাপয়েন্‌টমেন্‌ট দিয়ে দ্যায়। আমার সাবজেক্ট ইতিহাস। এতে যথেষ্ট ভ্যাকান্সি থাকে। ক্লাশ সিক্স থেকে একেবারে বারো ক্লাশ পর্‌যন্ত আমাদের সুবিশাল ক্ষেত্র। তাই ঝপ করে জুটেও গেলো। ভি.আর.-ফি.আর. সব কমপ্লিট। কাছে নয়। একেবারে অন্য জেলায় গিয়ে পরীক্ষা দিয়েছি। প্রতিযোগী কম থাকে এতে। তাই পেলাম। পুরুষ মানুষ। অন্য জেলায় কী যায় আসে! যখন লোটা-কম্বল নিয়ে রওয়ানা দেবো, বাবা বলল,
--- দেখো, চাকরী করতে যাচ্ছো। জগত উদ্ধার করতে নয়। কোনো জটিল ব্যাপারে মাথা গলাবে না। চুপচাপ পড়াবে আর ঘরে ঢুকবে। হাওয়ার প্রতিকূলে যে দৌড়য়, সে কিন্তু গাধা।
আমি বাপের সুপুত্তুর। বাবা-র এই অমূল্য জ্ঞান কি ছাড়তে পারি! আমি জানি কীসে কী করতে হয়। আমার জীবনটা সততা আর অসততার দা-এ শীলে ঘষে ঘষে নিজে ঠেকে কষ্টিপাথর বানাবার শখ আমার নেই। কিন্তু বাবার এই কথাটা আমাকে মনে করিয়ে দিলো হেরম্ব বাবুর কথা, তাঁর জীবন। তিনি জীবনে এই সোজা কথাটা বোঝেননি। তিনি যে শিক্ষক, জাতির জনক নন্‌--- এটা তিনি বোঝেননি। তাই তাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছিলো। কিন্তু আমি তাঁর মতো মরতে চাই না। অবশ্য আমি কোনদিন হেরম্ব বাবু হতেও পারবো না। না বিদ্যায়, না অধ্যবসায়ে। আমার সে পোটেনশিয়ালিটি নেই শুধু নয়, পড়ানো আমার ধাতেও নেই। বাধ্য হয়ে দু-একটা টুইশানি তো করি। কিন্তু ওরা কামাই না করে পড়তে আসছে দেখলেই মাথা উষ্ণ হয়। শুধু মাসে প্রথম সপ্তাহ-টা গভীর যত্ন নিয়ে পড়াই। সে সময় যে মাইনে নিয়ে আসে ওরা। এমনটা আমি কেন শুধু! অনেকেই। কেননা ভালো ইনকাম টিউশানিতে। আর এবার আমাকে আর পায় কে! কিন্তু এসব পাঠ ছিলো না মাস্টারমশাইয়ের। পড়ানোতেই তাঁর আনন্দ ছিলো। বিনা অর্থে আমরা যে যখন খুশি, তাঁর বাড়িতে গিয়ে পড়ে আসতাম। সেই মাস্টার মশাই গলায় দড়ি দিয়েছিলেন।

সেই অনেকের মতো আমিও স্কুলটিচার হলাম। মাস্টারমশাইয়ের মৃত্যুর সেই দিনটা আমি ভুলেই ছিলাম। ভুলে থাকলেই বাঁচা সহজ। কিন্তু আমার ভবিতব্য আমাকে সেই মাস্টারমশাই-ই বানালো আর আমাকে অতীত মনে করিয়ে দিলো আমার বাবা। আমি যেখানে পড়াবো, সেখানে ছেলেমেয়েরা স্যার আজও বলতে শেখেনি। খুব খুশি হবো তেমনটা বললে। কিন্তু সে যে মোস্ট ইন্‌টেরিওর ভিলেজ। তা নয়তো পেতাম নাকি! সুতরাং আমাকে তারা মাস্টারমশাইলেই ডাকবে। ম্যাস্‌টরও বলতে পারে। আমার শিক্ষকতা আজ আমার বাবার একটা কথায় একটা স্মৃতি রোমন্থন করিয়ে দিয়ে একটা বাবলা কাঁটা হয়ে আমার মনের এক কোনায় বিঁধে গেলো।
মাস্টারমশাই ছিলেন আমাদের স্কুলের বাংলার শিক্ষক হেরম্ব বাবু। হেরম্ব চক্রবর্তী। তিনি গলায় দড়ি দিয়েছেন। আমরা সকলেই দেখতে গিয়েছিলাম। আমরা মানে আমি-নীহার, প্রবাল, শ্যামসুন্দর, ভবেশ, সঞ্জয়, তাপস এবং আরো অনেকে। সব ক্লাশ মেট্‌স। আমাদের স্কুলের অন্য ছাত্ররা এবং শিক্ষকেরাও এসেছিলেন। হেড স্যার, প্রফুল্ল বাবু, বিমানমাধব বাবু, কুমুদ বাবু এবং আরও অনেকে। আমি একটু দেরীতে গেছি। প্রবালদের সকলের সামনেই মাস্টারমশাই-এর দেহ তাঁরই ঘরের ছাদে টাঙ্গানো সিলিং ফ্যান থেকে নামানো হয়েছে। পুলিশ নামিয়েছে লোক দিয়ে। এরপর পাঠিয়ে দেবে লাশকাটা ঘরে। মরণোত্তর ছানবিন হবে, যার ইংরেজি নাম পোস্ট মরটেম। যদিও সবাই জানে যে, এটা আত্মহত্যা, কেননা মাস্টারমশাই কোন রাজনীতি করতেন না যে, তাঁকে বিরোধী দল মেরে রেখে দেবে। অবশ্য এই মেরে দেওয়াটা তখন থেকে আজও পর্‌যন্ত আকছার ঘটছে গোটা পশ্চিমবাংলা জুড়ে। তাই অনেকে অনেক কেসে সন্দেহ করে যে, খুনও হতে পারে। পুলিশ তো এসব বিচার করে না। তাদের নিয়মই হচ্ছে, কেউ অস্বাভাবিক ভাবে মারা গেলে তার দেহটা আইনমাফিক ময়না তদন্ত করতে হয়।
--- আমি তো জানতাম, কেউ গলায় দড়ি দিয়ে মারা গেলে তার চোখ-মুখ ভয়ংকর দেখতে হয়। মরার সময় একবার বাঁচতে চায় বলে অমনটা হয় নাকি। বাবা তো পুলিশ। বাবা-ই বলেছে। কিন্তু কৈ! মাস্টারমশাইকে তা তো দেখলাম না! তাহলে মাস্টার মশাই কি একটুও বাঁচতে চাননি? তিনি তো দিব্যি চোখদুটো বুজেছিলেন, যেন ঘুমোচ্ছেন। একদম স্বাভাবিক মুখ। শুইয়ে দিলে মনে হচ্ছে, যেন এক্ষুনি উঠে বসবেন আর বলবেন, জিনু….. মজিনু বিফ--অ…….মজিনু বিফল তপে অরণ্যের বড়ি।
এসব কথা বলল শ্যামসুন্দর। আমি শুনলাম। ঐ মজিনু…’ কবিতাটা মাইকেলের। বাংলাভাষা। আসলে ছত্রটা হলো, মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি । মাস্টারমশাই অবরেণ্যে বরি কথাটাকে একেবারে ছোট করে বলতেন অরণ্যের বড়ি। এমন করেই রসে-বশে আমাদের পড়াতেন তিনি। কঠিন কবিতা সহজ হয়ে যেতো। আজকে মনে হয়, তিনি বোধহয় অবরেণ্য শিক্ষকতাকে ভুল করে বরনই করেছিলেন। বিফল তাঁর মাস্টারমশাই হবার তপস্যা। তাঁকে গলায় দড়ি দিতে হোল। খুব মনে পড়ছিল, মাস্টারমশাই আমাদের একদিন বৃষ্টির ক্লাশে একটা কবিতা শুনিয়েছিলেন। কবিতাটার কোন গভীর অর্থ সেদিন বুঝিনি। আজো যে বুঝি, তাও নয়। মাস্টারমশাই মুখস্ত করতে বলেছিলেন। এরকম অনেক কবিতাই আমাদেরকে দিয়ে তিনি মুখস্ত করাতেন। এটা মনে আছে কারণ এটা নিয়ে একটা ঘটনা ঘটেছিলো। তাই মনে আছে। কবিতাটা বাড়িতে মুখস্ত করছিলাম, শুনে আমার বাবা, যার সাথে কাব্য-সাহিত্যের বিন্দুমাত্র কোন যোগ নেই, শুধু ডি.. বা টি.. কে কবে বাড়ছে বা কমছে এসব নিয়ে যার চিন্তা, তিনি ভীষণ ধম্‌কেছিলেন। মাস্টারমশাইয়ের নামে হেডস্যারের কাছে নালিশ করেছিল বাবা। তিনি নাকি আমাদের আজেবাজে সব কবিতা পড়ান। এসব তো সিলেবাসে নেই। বকা খেয়েছিলেন মাস্টারমশাই। কবিতাটা এরকম……
শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে - ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ ……
সেদিন এসব কথাগুলো মোটে ছোয়নি আমাদের। তবে কেউ একটা সুইসাইড করেছিলো, এটা বুঝেছিলাম। আর আজ মাস্টারমশাইয়ের মৃতদেহ দেখে মনে এলো কবিতাটার আরো কতগুলো ছত্র…….

কোনদিন জাগিবে না আর
জানিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম অবিরাম ভার
সহিবে না আর -
এই কথা বলেছিল তারে,
চাঁদ ডুবে গেলে - অদ্ভুত আঁধারে
যেন তার জানালার ধারে
উটের গ্রীবার মত কোন এক নিস্তব্ধতা এসে

এরপর থেকে আমাদের আর পাঠ্যের বাইরে নতুন কোনো কবিতা পড়াতেন না মাস্টারমশাই। সেদিন তাঁর ডেডবডির সামনে দাঁড়িয়ে আমি ভেতরে-ভেতরে ভেঙ্গে যাচ্ছিলাম। কে যেন আমার ভেতরে আর্তনাদ করে বলছিল, মাস্টারমশাই, আমি এসব চাইনি। আমি এমনটা ভাবিইনি। আপনি কি আমার ওপরে রাগ করে এমনটা করলেন? কিন্তু কথাগুলো সশব্দে বলার সাহস আমার ছিল না। আজও নেই। সবাই কাঁদছিল দাঁড়িয়ে এক কারণে, আর আমি কাঁদছিলাম অন্য কারণে। আমি বেশিই কাঁদছিলাম। নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না।
মাস্টারমশাই জেল থেকে ছাড়া পেতে অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে সেদিন সকালবেলা দাঁত ব্রাশ করছিলাম। খবরটা পেলাম প্রবালের থেকে। হঠাৎ ও হাফাতে হাফাতে এসে বলল,
--- শুনেছিস? মাস্টারমশাই না, সুইসাইড করেছেন?
প্রথমটা বিশ্বাস করিনি। পরে নিজের মনেই ভাবলাম, হ্যাঁ, মাস্টারমশাই তো সুইসাইড করতেই পারেন। না করাটাই তো অসম্ভব। আজ না করলে আর কবে করবেন! মাস্টারমশাই বলতে সকেলেই জানে, কে। অন্য শিক্ষকদের আমরা স্যারলতাম। শুধু হেরম্ব বাবু মাস্টারমশাই। কিন্তু তিনি যে একেবারে সুইসাইড করবেন, এমনটা আমি ভাবিনি। মানে এ্যাতোটা ভাবিনি। খবরটা শোনামাত্র একটুকাল চুপ করে দাঁড়িয়েছিলাম। প্রথমটা পুরো বিশ্বাস হয়নি। প্রবাল এমন নানা ঠাট্টা করে। প্রবাল বলল,
--- চল। যাবি না ?
তখনও ভেবে পারিনি, যাবো তো, কিন্তু কোথায়? বিমানমাধব বাবুর বাড়ি, নাকি সোজা মাস্টারমশাই-এর বাড়ি? একবার ভাবলাম, না। এখন যাবো না। লাশ নিয়ে পুলিশ চলে যাক। চোখের সামনে মাস্টারমশাই-এর মৃতদেহ আমি দেখতে পারবো না। মনে মনে ভয়ও আছে, যদি তিনি পুরো মারা না গিয়ে থাকেন? যদি আমাকে দেখে হঠাৎ বেঁচে ওঠেন? বলে ওঠেন,
--- নীহার, শেষে তুই! তুই যে আমার ছাত্র!
তখন কী বলবো আমি! সকলে তো জেনে যাবে ব্যাপারটা। তাই আগে লাশ নিয়ে পুলিশ চলে যাক। তবে যাবো। কিন্তু মানুষ তো সেদিকেই তাকায়, যেদিকে তাকাতে তার মন সায় দ্যায় না। রাস্তায় কোনো নোংরা দূর থেকে দেখে তাকাবো না তাকাবো নারেও চোখ অবাধ্য হয়ে ওঠে। তেমনই আমার হোল। ভাবলাম, যাই না। দেখে আসি। মাস্টারমশাই চোখ মেলে উঠবেন, এটা নিছক একটা কুসংস্কার। সে কি হয় নাকি! তাই অন্যদিনের থেকে অনেক ধীরে ব্রাশ করা শেষ করে গেলাম মধুমুরলী-তে। সেখানে মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি গীতালি। আগে মাস্টারমশাই তাঁর বাড়ি-টার কোনো নাম দেননি। পড়ে তাঁর স্ত্রী মারা যেতে স্ত্রীর নামে বাড়ির নাম দিয়েছিলেন।
মাস্টারমশাই-এর বাড়িতে সবুজ রঙের গেঁট, কাঠ দিয়ে বানানো। গেট ঠেলে ঢুকে একটু লনের মতো। তার দুপাশে মাস্টারমশাইয়ের হাতে করা ছোট্ট ছোট্ট দুটো বাগান। ফুলের বাগান। দুষ্প্রাপ্য কোন ফুল নয়। সস্তা। গাঁদা, দোপাটি এইসব। রাস্তার দুধারে আধখানা করে ইট-এর সারি আড়াআড়িভাবে পুতে তার কোনা তুলে রাখা। একটা সস্তা কায়দা করা। সেগুলো আবার চুন দিয়ে সাদা রং করা। সরু রাস্তাটায় বালির পাথর ফেলে ফেলে বেশ একটা পুরনো দিনের আদল দেওয়া। এসব পাথর আজকাল ফেলে না কেউ। ওর ওপর দিয়ে হাঁটলে বেশ মুচুর মুচুর শব্দ হয়। তারপর বারান্দা। এখানে মাস্টারমশাই সকালে আর সন্ধ্যায় বসে ক্লাসিক্যাল গান আর মিউজিক শুনতেন একটা পুরনো টেপ রেকর্ডারে। আমির খাঁ সাহেব, বড়ে গোলাম আলি খাঁ, ভীমসেন জোশি। তাছাড়া সেতার-সরোদ-সানাই শুনতেন। কী বুঝতেন, কে জানে! মাস্টারমশাইকে গাইতে তো কখনও শুনিনি। বাজাতেও দেখিনি। বারান্দাটা খোলা। শুধু কাঠের কোমর-সমান রেলিং দেওয়া। সেখানেও একটা গেট মতো আছে। সেটা ঠেলে বারান্দায় ঢুকতে হয়। দেখলাম, মাস্টারমশাইয়ের ইজি চেয়ারটা বারান্দায় সেইভাবেই বারান্দায় পাতা আছে। তাতে একটা তোয়ালে রাখা, যেমনটা থাকতো বরাবর। শুধু মাস্টারমশাই বারান্দায় শোওয়া, টান টান। মুখ থেকে গা অবধি ঢাকা দেওয়া। পাড়া-প্রতিবেশিদের কয়েকটা প্রশ্ন করছে পুলিশ। তারপর দেহ পাঠিয়ে দেবে মর্গে। ফলে যে ভয়টা সংস্কার বলে মন থেকে চলে গিয়েছিলো, সেটাই আবার আমার মনে হানা দিলো, যদি মাস্টারমশাই উঠে বসেন?
মাস্টারমশাই মারা গেলে কারোর কিছু যায়-আসে না। তাঁর মেয়ে আছে একটি। বিয়ে হয়ে গেছে কবে, কোন কালে । বাবা যে মারা যাবে একদিন, এটা বোঝার বয়স তাঁর হয়েছিলো। ফলে তারও তেমন কিছু যাবে-আসবে বলে তো দেখিনি কোনোদিন। বাবা মরলো কি বাছলো--- সে খবর তো সে নিয়েছে, দেখিনি। আজও সে এখনও এসে পৌঁছয়ইনি। তাদের বাড়ি দুর্গাপুর, না মধুপুর--- কোথায় যেন শুনেছিলাম। তাই সে যে বাবার দেহটা কাটা-ছেঁড়ার আগে এসে দেখবে, এখন তার কোনো উপায় নেই। এতক্ষণ দেহ ফেলে তো রাখবে না। তাঁকে বডি নিতে হবে মর্গ থেকে। তবে স্যারের তো দেহ-চোখ সব দান করা ছিলো। সেসব কী হবে, কে জানে।
আমি গিয়ে দেখলাম, তখনও আমাদের কোনো স্যার আসেননি। একে একে তাঁরা এলেন। অবশ্য যারা কাছেপিঠে থাকেন, তাঁরাই এলেন। কোন টিচার বেদনাহত নন। তবে তাঁরা সকলে একেবারে হাবেভাবে স্বাভাবিকও নন। আগে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলো তাঁরা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। তাই ব্যাপারটা তাঁরা অনেকে ধরতেও পারছেন না। যাদের মাস্টারমশাই-এর কোয়েশ্চেন পেপার স্ক্যান্‌ডালটা জানা ছিল না, তাঁরা প্রায় সকলেই মনে করছেন যে, হেরম্ব বাবু একটা মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। একাকীত্ব তাঁকে বোধহয় গ্রাস করছিলো। এই কারণেই তিনি বিনা পারিশ্রমিকে বাড়িতে ছাত্রদের ডেকে-ডেকে এনে পড়াতেন। সময়টা কাটাতে চাইতেন। হেরম্ব বাবু কোনকালেই ছাত্র ছাড়া অন্যদের কাছে খুব বলিয়ে-কইয়ে ছিলেন না। চুপচাপ। ছাত্র ছাড়া তেমন কোনো মেলামেশাও ছিল না। না সংস্কৃতি, না সমাজসেবা। ফলে অনেকে এমনটাই মনে করে নিয়েছে সহজে। একা একা আর কতদিন থাকা যায়!
কথাটা মোটে ভুল নয়। একটা সময় ছিলো, যখন মানুষকে দ্বীপান্তর সাজা দেওয়া হতো। হাতে-পায়ে শেকল নয়, সারাক্ষণ গারদে আবদ্ধ নয়, অনেকটা মুক্ত, ছাড়া অবস্থায় জীবন কাটাতো নানা অপরাধী। শুধু কথা বলার মত কেউ থাকতো না। সেই নির্জন দ্বীপ থেকে ফিরে আসার বা পালিয়ে যাবার কোনো উপায় নাকি থাকতো না। তাতেই মানুষ নাকি পাগল-টাগোল হয়ে যেতো। বইতে পড়েছিলাম আমি, একাকীত্ব নাকি বড়ো সাজা। যাদের সন্তানেরা বিরাট কোন ডিগ্রী ধারণ করে বিদেশে চলে যায়, তাদের বাবা-মায়েদের কোটি টাকা থাকলেও তাঁরা একটা হতাশায় ভোগেন। এমন খবর তো কাগজে হরবখত বেরোচ্ছে। তাই পাড়া-প্রতিবেশী ভেবেই নিয়েছে, এই একাকীত্ব হেরম্ব বাবুর আত্মহত্যার কারণ হয়েই থাকবে। অন্তত পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করলে তাঁরা এমনই বলেছেন, ভদ্রলোকটির বিবাহিতা মেয়ে তো ন-মাসে ছ-মাসে বাপের বাড়ি আসে। আর আসবেই বা কেন! এসে তো এখানে মায়ের হাতের যত্ন-আত্মি পাবে না। মা তো নেই।
কিন্তু আমি জানি, আর জানে বিমানমাধব বাবু, আমাদের স্কুলের বিজ্ঞানের টিচার। শুধু আমরাই জানি, মাস্টারমশাই কেন গলায় দড়ি দিলেন। আমার কাছে যেটা ছিল একটা নিতান্তই বালখিল্য, সেটা বিমানমাধব বাবুর কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। তিনি চেয়েছিলেন, যেন তেন প্রকারেণ হেরম্ব বাবুকে শায়েস্তা করতে হবে। তাঁর কিং কোবরার মতো ফনা তোলা মাথাটাকে গুটিয়ে দিতে হবে। বিমানমাধব বাবুর সাথে ছিলো ওখানকার মিউনিসিপ্যাল চেয়ারম্যান সাধন সাহা। তারও স্বার্থ ছিল। আমাকেই আমাদের স্যার দাবার বোরের মতো ব্যবহার করেছিলেন। আমি সেদিন বুঝতে পারিনি। আজ বুঝি। সেদিন বিমানমাধব বাবুকে পরম আপন মনে হয়েছিলো। তাঁর ফাঁদে আমি পা দিয়েছিলাম। ভাগ্যিস ঘটনাটা কেউ জানে না! জানলে আমার গায়ের ছাল ছাড়িয়ে নিতো আমাদের স্কুলের অন্য অন্য ছাত্ররা। আমার সহপাঠীরাও। হেরম্ব বাবু যে মোটামুটি সবার প্রিয় ছিলেন।
ঝামেলাটা তাঁর শুরু হয়েছিল সাধন সাহার সাথে। মাস্টারমশাইকে সাধন বাবু তাঁর ছেলেকে বাঙ্গলা আর সংস্কৃতটা পড়াতে বলেছিলেন। পড়ানো মানে একেবারে প্রফেশনালি পড়ানো। টাকা নিয়ে। প্রায় সবাই জানে, সাধন বাবু কাউকে ফ্রী কোনোকিছু সুবিধে পাইয়ে দেন না। এটা করলে সাধন বাবুদের চলে না। তাঁরা রাজনীতি করেন। আজকের রাজনীতির গোপন পাঠ-ই হোল, কোনো কোনো মানুষকে পাইয়ে দাও এটা ওটা, আর তার থেকে তুলনামূলক অনেক বেশীকিছু পাবার ব্যবস্থা করে নাও। সেটাই করতে চেয়েছিলেন সাধন সাহা।
সাধন সাহার ছেলে আমাদের ক্লাসমেট ছিলো। আসলে, ছিলো না, হোল। দু-বছর সেভেন আর দু বছর এইটের মায়া গড়াতে গড়াতে কাটাতে পেরেছিলো বলেই আমাদের ক্লাশমেট হলো। ততদিনে তার দাড়িগোঁফ গজিয়ে গেছে। আমরা তো তপন দাদালব, না নাম ধরে ডাকবো, তা প্রথম দিকটায় ঠাহর করতে পারছিলাম না। তবে সুবিধে এই ছিল যে, তপন ছিলো একটু-আধটু আলাভোলা। তার বাবার বিপরীত। এদেরকে বলে ইডিওডিক। পাশ ওর দ্বারা হবে না, এটা সাধন সাহার মতো অনেকেই বুঝেছিলো। তাই তাকে নাম ধরে ডাকলে বা দাদা কোনটাতেই তার আপত্তি ছিলো না। আর আমাদের কোন বিপত্তিও ছিলো না। কে না চায়, একজন সিনিয়ারকে নাম ধরে ডাকতে! তাই সে ছিল আমাদের তপন।
টুঁ পাইস ফাদার মাদার সাধন সাহা কিন্তু ছেলের ব্যাপারে ছিল খুব দুর্‌বল। তখন তাঁর হাত খুলে টাকা ব্যয় করতে কোনো দ্বিধা ছিল না। পত্নী আর উপপত্নী মিলিয়ে সাধন সাহার তিন তিনটে সংসার থাকলেও সন্তান কিন্তু তাঁর ছিলো ঐ সবেধন নীলমণি তপন। সেই তপন চারবার পরীক্ষায় ভূলুণ্ঠিত হতে সাধন বাবু বিমানমাধব বাবুকে ভালোমন্দ টাকার অফার দিয়ে গৃহশিক্ষক রেখেছিলেন। তিনিই তপনকে গোটা সাইন্স গ্রুপটা পড়াতেন। পড়াতেন না হাতি। চুক্তি ছিলো যে, বিমান মাধব বাবু তপনকে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পাইয়ে দেবেন। শুধু তাই নয়, ওর খাতাপত্রে পর্‌যন্ত পাশ মার্ক দিয়ে দেবেন। এসব একরকম ওপেন সিক্রেট ছিল। অনেকে অনেককিছু জানলেও ভয়ে কেউ কিছু বলতো না। পুলিশে ছুলে আঠারো ঘা, কিন্তু নেতা ছুলে আঠারো শো ঘা। এ জ্ঞান অনেকেরই আছে। এইটে তৃতীয় বারের বার কোয়াটারলিতে পরীক্ষায় তপন কিন্তু বাঙ্গলা আর সংস্কৃত ছাড়া আর সব বিষয়ে পাশ করলো। মানে পাশ করিয়ে দেওয়া হোল। ঠিকাদার সেই বিমানমাধব বাবু। সাধন সাহা চেয়েছিলেন, ছেলেটা কোনোরকমে মাধ্যমিক পাশ করলে তাকে পুরসভায় একটা চাকরীতে ঢুকিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে শ্বাস ফেলবেন তিনি। সাধন সাহাদের রাজত্ব কতদিন চলে, তার তো কোন ঠিক নেই। গদিতে থাকতে থাকতে যা করে যেতে পারে।
যদিও তখন রাজ্য জুড়ে স্কুলের শিক্ষকেরা প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না, এমন একটা সরকারী আদেশ জারীর হিড়িক উঠেছিলো, এবং আমাদের দু-একজন শিক্ষক প্রাইভেট পড়ানো ছেড়ে দিয়েছিলেন, এমনকি একজন ভূগোলের শিক্ষক প্রাইভেট পড়ানো ছাড়তে পারবেন না বলে স্কুলের চাকরী পর্‌যন্ত ছেড়ে দিয়েছিলেন, তথাপি বিমানমাধব বাবু কিন্তু বহাল তবিয়তে চুটিয়ে বাড়িতে পড়িয়ে যাচ্ছিলেন। কেউ তাঁকে খোঁচাতো না, কারণ তাঁর পাশে ছিলেন সাধন সাহা, আর তাঁর পার্টি।
সেই সাধন সাহাই অবশেষে ধরলেন মাস্টারমশাইকে। তাঁর ছেলেকে পড়াতে হবে। মানে তাকে পরীক্ষায় পাশের সুবন্দোবস্ত করে দিতে হবে। মাস্টারমশাই তো রেগেমেগে একশা। সাধন কেন! কোন ধনেই যে তাঁর আসক্তি নেই, তা বুঝিয়ে দিলেন। সাধন সাহা মাস্টারমশাইকে কলা দেখিয়ে বলে গেলেন,
--- আরে ছাড়ুন আপনার নীতি-আদর্শ। ভাত ছড়ালে কি কাকের অভাব হয়! আপনি না হোক, অন্য লোক তো আছে। বাঙ্গলা টিচার কি আর ইস্কুলে নেই!
এসব গল্প তপন আমাদেরকে বোকার মতো বলে দিতো। কিন্তু বিষয়টা সেখানে যে থেমে থাকেনি, তা ও বা আমরা কেউই বুঝিনি। আসলে সাধন বাবু এই অপমানটা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। বস্তুত এরা শান্ত হয়ে থাকে বটে, কিন্তু একদিন একেবারে অপ্রস্তুত অবস্থায় শত্রুর বিরুদ্ধে মারাত্মক পদক্ষেপ নিয়ে ফেলে।
মাস্টারমশাই আমাদেরকে বাঙ্গলা আর সংস্কৃত ভালো মতো শিখিয়েছিলেন। তিনি বলতেন--- মানুষ যতই ডেড ল্যাঙ্গুয়েজ বলে সংস্কৃত-কে গালাগাল করুক না কেন, মানুষ এটা অধ্যয়ন করুক আর আর করুক--- বিয়েতে, পারলৌকিক কাজে, পুজোয় তো বাঙ্গলা ভাষা মানুষ মেনে নেবে না, বল্‌। সেখানে দেবভাষা চাই-ই। ফলে এটা শিখে রাখ। তোদেরও কথা বলার অনেক ত্রুটি। শব্দোচ্চারনও বিভ্রান্ত। এমনটা হলে তো মনের ভাবটাই স্পষ্ট হবে না রে। ভাষা তো ভাবের বাহক। ভাষা বলতে-লিখতে জানা চাই। সংস্কৃত তোদের জিভের আড় ভেঙ্গে দেবে। আর এটা তো খুব সহজ ভাষা। বলেই তিনি দৃষ্টান্ত দিতেন--- ধর্‌, আমি যাই--- এখানে গম ধাতু লাগবে। মনে কর্‌, তোর মনে নেই। তুই বলে দে অহং গমনং করামি। শুধু কৃ ধাতুটা মনে রাখ্‌। কিম্বা তাও না পারলে বল্‌ গমনং করামি অহং বা করামি গমনং অহং। ব্যস। যা খুশি। সব ঠিক।
এছাড়া মাস্টারমশাই নানা সংস্কৃত ছড়া বলতেন। তার নানা অর্থ। আমরা মন দিয়ে শুনতাম। সেসব সম্পূর্ণ মনেও নেই। কিন্তু বিষয়গুলো মনে আছে আজো। আর আজকে কিনা তিনি গলায় দড়ি দিলেন! কে দায়ী? আমি, না বিমানমাধব বাবু, না সাধন সাহা? আমি তাঁর বোকা, মূর্খ ছাত্র। বিমানমাধব আর বাবুদের দাবার বোড়ে। এক চালেই মাস্টারমশাইকে মাত করানো হয়েছে আমাকে দিয়ে।
দুদিন আগেই হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় একটা অঙ্ক আমি ভবেশের খাতা থেকে টুকে লিখে দিচ্ছিলাম। ব্যস্‌। মাস্টারমশাই একেবারে হাতেনাতে আমাকে ধরেছেন। চিৎকার করে উঠেছেন,
--- তুই নকল করতে শিখেছিস! তুই ধরণী বাবুর ছেলে না? এই তোর শিক্ষা! আমি তোদেরকে এই শিখিয়েছি!
হাতে-পায়ে ধরেও সে যাত্রা রেহাই পাইনি। মাস্টারমশাই বললেন--- না না। তোর বাবাকে হয় বলতে হবে, ত নয়তো তোকে এই অঙ্ক পরীক্ষায় পাশ করানো হবে না। একটা শাস্তি তোকে মাথা পেতে নিতে হবেই। এটা আমাদের দায়িত্ব। শাস্তি না পেলে তুই ফের এমন কাজ করবি।
ফেল করাতে তিনি চাননি। তাই বাবাকে ডেকে মাস্টারমশাই যা নয় তা বলেছেন। বাবা আমাকে শ্যামচাঁদ-রায়চাঁদ তো খাওয়ালেনই, হাফ ইয়ারলি অঙ্ক পরীক্ষায় পাশ করাতে দিলেন না। মানে আমি দুটো শাস্তি খেলাম। এটাই আমার মনে একটা আগুন জ্বালিয়ে দিলো মাস্টারমশাইয়ের বিরুদ্ধে। কিন্তু একটা ক্লাশ এইটের ছাত্র কী-ই বা করতে পারে! কতটুকু ক্ষমতা তার! কিন্তু বদলার নেশা আমাকে পেয়ে বসলো। সকলের মনেই বদলার নেশা থাকে। সকলেই ভাবে, আমারও দিন আসবে। অবশেষে আমারও দিন এলো।
মাস্টারমশাইয়ের একটা বড়ো দোষ ছিল, স-ক-লকে তিনি শাসন করতে চাইতেন। অন্যায় দেখতে পারতেন না। আজ এসব বুঝি। কিন্তু তিনি বুঝতে চাইতেন না যে, তিনি চাকরী করতে এসেছেন। জগত উদ্ধার করতে কেউ কোনোকালে শিক্ষক হয়নি, আর আজও হয় না। এটা জীবিকা। শুধু জীবিকা। কিন্তু মাস্টারমশাই-এর সবটাতে বাড়াবাড়ি ছিলো। আমাদের ওপর তো বটেই, এমনকি মাস্টারমশাইদের ওপর পর্‌যন্ত। এমনকি একবার তাঁকে সরকার থেকে জাতীয় শিক্ষকের মর্‌যাদা দেবার প্রস্তাব উঠেছিলো। কিন্তু হেরম্ব বাবু হাসতে হাসতে এই সম্মানের লোভ ঠেলে ফেলে দিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য, শিক্ষক এমনিতেই তো জাতীর মেরুদণ্ড। তাঁকে আলাদা করে কেন পুরস্কৃত করা! আমাদেরকে সবসময় বলতেন, স্বদেশে পূজ্যতে রাজা, বিস্বান সর্‌বত্র পূজ্যতে। কিন্তু মাস্টারমশাই বুঝতেন না যে, আজকাল এসব শুভাশিতানি চলে না। এখন পড়াশুনো করে যে, গাড়ি চাপা পড়ে সে। বেশি কেন বলি! আমি হাফ ইয়ারলিতে ফেল করলাম, আর তপন পাশ করে গেলো। তারপর আমাদের সাথে পড়তো বেণু। পড়াশুনোয় তো ভাঁড়ে মা সরস্বতী ছিল। কিন্তু সেই এখন গাড়ি হাঁকিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর আমাদের বিপ্লব। বরাবর ফার্স্ট হতো। সে দারিদ্রে পড়াশুনো টানতে না পেরে আজকাল বাড়ি বাড়ি ছাত্র পড়িয়ে অসুস্থ বাবা-মা কে টানছে।
কিন্তু এসব কে বলবে মাস্টারমশাইকে! তাই স্কুলে বা স্কুলের বাইরে প্রায় সকলেই তাঁর ওপর কোন না কোন কারণে অসন্তুষ্ট হতো। আমিও হয়েছিলাম। আর এটাকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন বিমানমাধব বাবু। আমাদের বিজ্ঞানের শিক্ষক। তখন তো বুঝিনি, এটা একটা চাল ছিল। তখন তাঁকে মনে হয়েছিলো পরম মিত্র। আমি বদলা নিতে পারবো। মাস্টারমশাইয়ের বিরুদ্ধে বদলা। আমাকে পরীক্ষা হলে ধরে তিনি আমাকে সেই সাব্জেক্‌ট-টাতে ফেল করিয়ে দিয়েছিলেন। আমাকে বদলা নিতে হবে। মারি অরি পারি যে কৌশলে।
কিন্তু সেদিন যখন মাস্টারমশাইয়ের বডি পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে, আর তখন আমার ভেতর থেকে একটা চেতনা যেন আমাকে বারে বারে দংশন করছিলো। বার বার মনে হচ্ছিলো, কেন এ কাজটা আমি করলাম! আমি এত বোকা হলাম কী করে!
মাস্টারমশাই স্কুলে এই সকলকে শাসন করার বিষয়ে অনেক টিচারের গাত্রদাহের কারণ হয়ে উঠেছিলেন। অনেকে সরকারী নির্দেশ না মেনে প্রাইভেট টিউশান করতেন। এমনকি স্কুলে ছেলেদের বুঝিয়ে দিতেন যে, তাঁদের কাছে না পড়লে নম্বর পাওয়া যাবে না। সাইন্সের টিচাররা প্রাক্‌টিক্যালে মারবেন, অন্যও টিচাররা ওড়ালে মারবেন। এসব পলিসি ছিলো একেবারে সেট করা। তাই আমরাও পড়তে যেতাম, আর আমাদের বাবা-মায়েরাও পড়তে পাঠাতেন। কখনও প্রফুল্ল বাবু, কখনও কুমুদ বাবু, তো কখনও বিমানমাধব বাবু। কিন্তু এসব শুনে মাস্টারমশাই ক্ষোভে ফেটে পড়তেন। তাঁর কথা, কেন টিচারেরা প্রাইভেট পড়াবেন? সরকার যখন ভালো মাইনে দ্যায়, সরকার যখন বিষয়টা পছন্দ করছেন না, যখন নতুন আইন সারকুলার হয়ে স্কুলে স্কুলে আসতে চলেছে, তখন সেটাকে অমর্‌যাদা কেন করবেন শিক্ষকেরা? তাঁরা তো জাতির রূপকার। তাদেরকেই তো সবচেয়ে আগে আদর্শ মেনে চলতে হবে। এইসব নানা কথা মনে করতেন তিনি। আমাদেরকে এসব কিছুই বলতেন না। তবে আমাদের অভিভাবকদেরকে ব্যক্তিগতভাবে বোঝাতেন। আমরা ছিন্নভিন্নভাবে এসব শুনতাম। কিন্তু তাতে তাঁর ওপরেই সকলে অসন্তুষ্ট হতো। এটা তিনি বুঝতেন না, বা বুঝতে চাইতেন না। এই নিয়েই বিমানমাধব বাবুর সাথে তাঁর আদায়-কাচকলায় সম্বন্ধ। একবার তো আমরা শুনেছিলাম, তাঁদের মধ্যে স্টাফরুমেই একেবারে মুখোমুখি গণ্ডগোল বেধেছিল। এমনকি অবস্থা সামলাতে মাস্টারমশাই বিমান বাবুকে হুমকি দিয়েছিলেন যে, তিনি পর্ষদে কমপ্লেইন্ট জানাবেন পর্‌জন্ত।
সন্দেহ নেই, বিমানমাধব বাবুর বিরুদ্ধে অনেকেরই কিছু না কিছু বক্তব্য ছিল। তিনি ক্লাশ না করে পার্টির মিছিল-মিটিং করে বেড়াতেন, স্কুলের মধ্যে ছাত্রদের নিয়ে একটা রাজনৈতিক সেনা সংগ্রহের সংগঠনড়তে চেয়েছিলেন ইত্যাদি। এসব নিয়ে বিরোধী দলের সমর্থক টিচিং বা নন-টিচিং স্টাফদের সাথে কদাচার করতেন। সকলেই তাঁর ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু তাঁকে মাধ্যম করে তাঁরা অনেকে প্রয়োজনে অনেক কাজও করিয়েও নিতেন। পার্টির ওপর মহলে তাঁর যাতায়াত ছিলো। তাই অনেকেরই নৌকো তাঁর ঘাটে বাঁধা ছিলো। এক কথায় স্কুলে তিনি রাজ করতেন। হেডস্যার অবধি তাঁকে সমীহ করে চলতেন। মানতে বাধ্য হতেন।
এরই মধ্যে এ্যানুয়াল পরীক্ষার আগের একদিন বিমান বাবু একটা লোককে দিয়ে আমাকে খেলার মাঠ থেকে ডেকে পাঠালেন তাঁর বাড়িতে। ছোট বকুলতলায় নাট মন্দিরের পাশে বিমান বাবুর বাড়ি। অবশ্য আমরা তাঁর কাছে সাইন্স গ্রুপটা পড়তেই যেতাম। তবে সেটা অন্য একটা বাড়িতে। শুনেছিলাম, এটা তাঁরই বাড়ি। তবে তিনি স্বীকার করতেন না। বলতেন, তিনি নাকি সেটা ভাড়া নিয়ে পড়ান। বিমান বাবুর বসত বাড়িটা দেখলে সি.বি.আই. তদন্তের যথেষ্ট অবকাশ থাকে। একটা ছোটমোটো প্রাসাদ। বিশাল ব্যাপার। কী করে যে একজন স্কুলের শিক্ষক এ্যাত বড়ো বাড়ি করতে পারেন, ভাবা যায় না। সরকারের দৌলতে না হয় তাঁদের মাইনে-টাইনে বেড়েছে। তাঁরা সুখেই আছেন। কিন্তু তাই বলে এমন প্রাসাদোপম বাড়ি! এ তো কোন কালোপথে আসা কালোটাকা ছাড়া সম্ভব নয়।
তখন ছোট ছিলাম। এসব কিছুই বুঝিনি। আজ বুঝি। তিনি রাজনৈতিক ক্ষমতার যথেচ্ছ অপব্যবহার করতেন। নানা খাতে টাকা উপার্জন করতেন। তখন এ রাজ্যে বিধানসভার নির্‌বাচন ঘিরে একটা যুদ্ধের ঢাক বাজতে শুরু করেছে। কোন কোন মানুষের মনে ভয় বা প্রত্যাশা, এবার গণেশ ওলটাবে। তাই বিমানমাধব বাবু বেশ ভয় পেয়ে ছিলেন যে, যদি মাস্টারমশাই সত্যি সত্যি তাঁর সম্বন্ধে ঢেরা পিটিয়ে দ্যান, তবে তো কেঁচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে পড়তে পারে। সেদিন এসব বুঝলে কি আর বিমান বাবুর বাড়িতে যেতাম! অনেক কাল  পরে আজ সরকার বদলেছে। তাই বিমান বাবুদের মতো অনেকেই এখানে থাকেন না। তাঁরা গা ঢাকা দিয়েছেন। একটা সময় এ্যাতটা অন্যায়-অবিচার করেছেন যে, আজ মানুষ তাদেরকে সামনে পেলে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে। কিন্তু মাস্টারমশাই সত্যি সত্যি বিমান বাবু সম্বন্ধে কোন কথা কোথাও তুলতেন কিনা, আমরা অন্তত জানিনা। তিনি তো আর রাজনীতি করতেন না। তাই শত্রুতাও ছিলো না। তবে বিমান বাবু তাঁকে সে সুযোগ দেননি। কথাটা ঘুরিয়ে বললে বলা ভালো, আমি সে সুযোগ মাস্টারমশাইকে নিতে দিইনি।
সেদিন মাঠ থেকে আমাকে ডেকে পাঠালে আমি স্যার-এর বাড়িতে ঢুকতেই দেখি, সেখানে সাধন বাবু বসা। আমাকে দেখে উঠে এলেন স্যার। আমার পিঠে হাত দিয়ে বললেন,
--- কী রে, তোকে নাকি তোদের বাংলার প্রিয় মাস্টার হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় হাতে-নাতে টুকতে দেখেছে?
আমি ভাবলাম, সে তো কবে মিটে গেছে। এখন তো ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি। মাস্টারমশাই আত্মহত্যা করার পরে আমি বাবার থেকে জেনেছিলাম, কবে যেন আমাকে গোপন করে আমাদের মাস্টারমশাই আমার হাফ ইয়ারলি পরীক্ষাটা সামলে দিয়েছেন। তাই আমি ফাইনালে বসতে পেরেছিলাম। স্যারের কথায় ভাবলাম, আমাকে আর এক প্রস্থ হয়তো শ্যামচাঁদ রায়চাঁদ সইতে হবে। চোরের মন বোঁচকার দিকে। ভীষণ রাগ হোল মাস্টারমশাইয়ের ওপর। মনে মনে তাঁকে উদ্দেশ করে বললাম, তুমি তো আজ আছো, কাল নেই। কেন বেকার-বেকার আমাকে এমন হেনস্থা করলে! কিন্তু বিমান বাবুর পরের কথাগুলো শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। তিনি আমাকে বললেন,
--- কী রে, প্রতিশোধ নিবি না?
প্রতিশোধ তো আমি নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কিভাবে তা নিতে হয়, ক্লাশ এইটের ছাত্র তাই তো জানতো না।
বিমান বাবু বললেন--- আয়, তোদের মাস্টারমশাইয়ের সাথে একটা খেলা খেলি। তোকে যেমন ফেল করালো, আমাকে তোর পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হলো, তেমন তুইও একটা খেলা খেল। শোধবোধ।
আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। পা-দুটো ঝিমঝিম করছিলো। এটা একটা পরীক্ষা, না আমাকে সত্যিই কোন উপায় দিতে চান স্যার? বুঝলাম না।। কাঁচা বয়স। কতটুকুই বা বুঝি! ভালোমন্দ, ঠিক-বেঠিক সব গুলিয়ে যায়। মাথায় নানা দুষ্টুবুদ্ধি খেলে। এটা তো এ্যাডভেঞ্চারের বয়স। হুস ফিরল বিমান বাবুর ধমকে,
--- মাথা নিচু করে থাকবি না মেয়েদের মতো। তোদের বয়সে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল কত দামাল ছেলে, ইতিহাসে পড়িস নি? তাঁরা তোর মতো মাথা নিচু করে সব সয়ে নেয়নি। মাথা উঁচু কর, পুরুষমানুষ। নয়তো বাড়ি যা।
মিথ্যেপৌরুষ কত বয়ঃপ্রাপ্ত মানুষকেই ভুল পথে হাঁটায়। আর আমি তো ছেলেমানুষ। মন বলল, না, আমি মেয়ে নই। আমি পুরুষমানুষ। কোন ভয়-টয় আমি পাই না। নেবো। প্রতিশোধ নেবো। সুযোগ পেলেই নেবো। অন্তত এদের চোখে পুরুষ হবার জন্যে আমাকে নিতে হবে। মোটে একটা অঙ্ক দেখে করেছিলাম। আমি তো অঙ্কে কাঁচাই বরাবর। সবাই তো সব বিষয়ে পাকা হয় না। অন্য কোন বিষয়ে তো এসব করিনি। সৎভাবে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। কিন্তু ক্ষমতার জোরে মাস্টারমশাই আমাকে কঠিন শাস্তি দিয়েছিলেন। আজ আমি তাঁকে শাস্তি দেবো। তাই সাহসে বুক বেঁধে বললাম,
--- কী করতে হবে, স্যার?
--- তুই কালকেই তোদের মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে যাবি। ক্ষমা চাইবি তোর কৃতকর্মের জন্যে। যেন তুই আজকে বুঝেছিস এই সত্যটা। আমার ভ্রূ কুচকে গেলো। সেটা দেখে বিমান বাবু বললেন--- ঘাবড়াস নি। এবার আসল কথাটা শোন। তোকে করতেটা হবে কী।
তারপর আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে যা বললেন, তার গভীরতা আমি বুঝলাম না। শুধু শুনলাম। বুঝলাম যে, আমাকে এ নির্দেশ অন্ধের মতো পালন করতে হবে। কিন্তু জানি না, তাতে প্রতিশোধ কী করে হয়। তবে বিমানমাধব বাবু যখন, তখন চোখ বন্ধ করে ভরসা করা যায়। বিমান বাবুই বললেন,
--- তারপর খেলাটা দ্যাখ। তোর কথা কেউ জানতেও পারবে না। আর তুইও কাউকে জানাবি না। আমি তোকে ভালোবাসি। তোর বাবার সাথে আমার ভালো সম্পর্কও। তাই তোকে একটা চান্স দিচ্ছি। নিবি কিনা দ্যাখ।
চান্স নেব না মানে! বিলক্ষণ নেবো। আলবাত নেবো। আমি মেয়ে নই, ভিতু নই। মাস্টারমশাই বলেছেন, এ্যাত ছোট বয়সে নাকি আমি টুকে বিরাট পাপ করতে শিখে ফেলেছি। স্কুলে বন্ধুদের টিটকিরি খেয়েছি। হেনস্তা হয়েছে যথেষ্ট। বদলা চাই। ছাড়বো না। সেই মুহূর্তে বিমান বাবুকে মনে হচ্ছিলো এক দেবদূত, এক দেবপুরুষ।
পরদিনই কাজটা করে ফেললাম পরিকল্পনা মতো। ব্যস্‌। আর তাঁর পরের দিনই হঠাৎ আমাদের হেডস্যার রাস্তায় ক্লাশ এইটের বেশ কয়েকটা বাংলা আর সংস্কৃতের প্রশ্নপত্র কুড়িয়ে পান। রাস্তাটা মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে যাবার রাস্তা। হেডস্যার থাকতেন হেরম্ব বাবুর পাড়ার পাশের পাড়ায়। মধুমুরলি মাড়িয়ে তাঁকে আসতে হতো। তিনি স্কুলে গিয়েও দেখেন যে, বান্ডিলে বেশ কিছু প্রশ্নপত্র কম রয়েছে। । খোঁজ শুরু  হলো। বিমানমাধব বাবুর প্ররোচনায় হেডস্যার সোজা পুলিশ-ফুলিস নিয়ে মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি চড়াও হলেন। তিনিই প্রাইম সাসপেক্‌ট। সেখানে তাঁরা প্ল্যান মতো পেয়ে গেলেন আরও কিছু প্রশ্ন। লুকনো। এ্যারেস্‌ট হয়ে গেলেন মাস্টারমশাই।
কথাটা ঝড়ের মতো ছড়িয়ে যেতে লাগলো। মানুষ নানা মন্তব্য করতে লাগলো--- দেখেছ, কেমন সাধু সেজে ঘুরে থাকে! অথচ পেটে পেটে এ্যাত! এইসব। আমাদের কয়েকজন স্যার মাস্টারমশাইকে জামিনে ছাড়িয়ে আনলেন জেল থেকে। জামিন শব্দটার অর্থ সেদিন বুঝিনি আমি। শুধু মাস্টারমশাই ছাড়া পেতে যেন আমার বুক থেকে একটা পাথর নেমে গেলো। যাক, তবু তো মাস্টারমশাই ছাড়া পেয়েছেন। কিন্তু বাড়ি ফিরেই পরের দিন তিনি সুইসাইড করেন। এ অপমান, এ অবিশ্বাস সইতে পারেন নি।
আমি কাউকে বলতে পারিনি আমার এই পাপের কথা। খ্রিস্টানদের মতো আমাদের তো কনফেশনের কোনো সিস্টেম নেই। তাই…. । বারে বারে মনে হয়েছে, যদি আমাকে সবাই ঘেন্না করে? তখন বুঝেছিলাম, ঘৃণা নিয়ে বেচে থাকা যায় না। তাই মাস্টারমশাই চলে গেলেন। এবার নিজেকে ঘৃণা করতে করতে আমাকে শিক্ষকতা করতে হবে বাকি জীবন।

-----------------------

কোন মন্তব্য নেই: