শনিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১২

"ভূমিপুত্র" ছোটগল্প



ভূমিপুত্র
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়


ক্রিং ক্রিং ক্রিং!
মোবাইল ফোনটা ধরে রাজেন--- হিলো!  
আজ ঠিকাদারের কাছে কাজ পায়নি রাজেন। তাই ঘরেই বিছানায় গড়াচ্ছিলো। রাজেন বাউরি। অধুনাকালে বুদ্ধিজীবী মহলে মুখে মুখে প্রচারিত বড়ো আদরের নাম রাজেন বাউরি। পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে অযোধ্যা পাহাড়, তারই পাদদেশে জন্মেছে এই রাজেন বাউরি। পাদদেশ বলতে গ্রাম বাঘমুণ্ডি। একদা গম্ভীর শিং মুঢ়ার নাচে মেতে ওঠা আদিবাসীদের গ্রাম। একদা বিহারের অন্তর্ভুক্ত রৌদ্রতপ্ত অংশ, আর আজ এই পশ্চিমবাংলার অবহেলিত কালো মানুষদের, অশিক্ষিতদের আর সরল সাদাসিধে মানুষদের গ্রাম বাঘমুণ্ডি। ছৌ-নাচের জন্যে রাজেন আজকের বিস্ময় নয়। সে অধুনা কালের বিস্ময়। সে একজন নিরক্ষর সাহিত্যিক। কে জানে, কে কবে শুনেছে, এমন ঘটনা! এটা মানুষ জানে, একদা নিরক্ষর কবি ছিলো এই বাংলায়। কিন্তু একেবারে সাহিত্যিক! কিন্তু সে খবর রাজেন বাউরির জানা নেই। সে ভূমিপুত্র নামে এক উপন্যাস লিখে চম্‌কে দিয়েছে শুধু একজন অশিক্ষিত হিসেবে নয়, সমালোচকদের ভাষায়, যেন দ্বিতীয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মালো বাংলা সাহিত্যে। উপন্যাস কী? রাজেন বাউরি তার তত্ত্ব জানে না। তবু সে লিখে বসেছে উপন্যাস। এসব কিছু কিছু জানে কেবল এই গ্রামেরই একটি মেয়ে, নাম পলাশী। সে এ কালের প্রগতির আলোয় স্কুল গণ্ডি পেরিয়েছে। সে তার শেখা বিদ্যেতে লিখেছে, আর রাজেন তার আঞ্চলিক ভাষায় উপন্যাসের বাঙময় চিত্র এঁকে গেছে। আর তাতেই দাঁড়িয়ে গিয়েছে একটি গোটা উপন্যাস ভূমিপুত্র। পার্বত্য অঞ্চলে মানুষদের নিয়ে কাজে আসা একটি এন.জি..’র পদকর্তা এমন ঘটনার সংবাদ পায়, আর সে-ই পাদপ্রদীপে আলোয় নিয়ে আসে এই রাজেন বাউরিকে আর তার সৃষ্টিকে। রাজেন বিখ্যাত হয়ে যায় অনন্য প্রতিভা হিসেবে। সে তার গর্ভধারিণীর জীবনের কথা লিখেছে কাল্পনিক নানা নামে। একটি বঞ্চিতা, প্রতারিতা আর অবহেলিতা মায়ের একমাত্র সন্তান রাজেন বাউরি, যে জঙ্গলের কাঠ কেটে নয়, মজুর খেটে খেয়ে-পরে মানুষ। পড়াশুনো আর গল্পের ওপরে রাজেনের আকর্ষণ ছিল বরাবর, যার খবর জানতো কেবল পাহাড়ি মেয়ে পলাশী। পলাশী-ই তাকে এখান ওখান থেকে নানা গল্পের বই এনে রাতে আধো আলো আধো অন্ধকারে ঝুপড়ির মধ্যে বসে পড়ে শোনাতো, আর মন দিয়ে সেই সব কাহিনী শুনতে শুনতে রাজেন কোথায় হারিয়ে যেতো! হঠাৎ একদিন রাজেনের মনে সাধ জেগে ওঠে, ওর মায়ের দুঃখের জীবনের কথা ও বলবে, আর তা লিখে রাখবে পলাশী। তারই ফসল এই ভূমিপুত্র। এ উপন্যাস কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক বিপ্লবের নয়। এ একেবারে একটি নারীর অন্তরের বেদনার কথা। কিন্তু পুরুলিয়ার জনজীবন, সংস্কৃতি, নানা পরব, দারিদ্র্য, অসহায়তা, উগ্রপন্থী ইত্যাদি নানা বিষয় আপনি আপন গতিতে উঠে এসেছে ভূমিপুত্র-তে। কলকাতার বিখ্যাত প্রকাশনী থেকে ছেপে বেরিয়েছে এন.জি.. বাবুদের কল্যাণে। কালো দৃঢ় দড়ির মতো পাকিয়ে যাওয়া শরীরের ক্ষেতমজুর জনমজুর অশিক্ষিত রাজেনের ডাক পড়তে থাকে শহর থেকে। সংবাদপত্রগুলো ওর সাক্ষাৎকার নিয়ে একটা ব্যবসা ফেঁদে বসতে চায়। কিন্তু এন.জি.. বাবুদের নিষেধাজ্ঞা মেনে কোনো ডাকেই সাড়া দেয় না রাজেন। আজ হঠাৎ এক ফোন এলো। আড়মোড়া ভেঙ্গে বিছানা থেকে উঠে মোবাইলটা কানে লাগিয়ে রাজেন বলে উঠেছে,
--- হিলো!
--- তুমি কি রাজেন বাউরি কথা বলছো? ওপার থেকে একটি শহুরে নারী কণ্ঠ কথা বলে ওঠে।
পলাশীর প্রশিক্ষণে আর শহরের ভাষায় লেখা শুনে শুনে কিছু কিছু শহরের ভাষা আয়ত্ব করেছিলো। তাই ও মনে মনে ঠিক করে নেয়, যতটুকু সম্ভব নিজের ভাষা বদলে কথা বলবে। তাই কোনরকমে বলে--- হাঁ। মু রাজেন বাউরি বুটে। কিন্তুক আপনি কি মুর ভাষাটো বুঝবেন, মিডাম?
--- তুমি এমন করে বললে নিশ্চয়ই বুঝবো। আমাকে তুমি চিনবে না। আমার নাম আলোলিকা রায়। আমি একটু আধটু লিখি টিখি।
লজ্জায় মরে যায় রাজেন। মনে মনে প্রনাম জানায় মানুষটাকে। এমন বিরাট লেখিকা মানুষটা যদি ওর মতো একজনকে বলে একটু আধটু লিখি তবে তো লজ্জার কথাই বটে। তাই শ্রদ্ধায় মাথা হেঁট করে বলে--- চিনবো লাই কী রুকম? নিজ্জস চিনি। কুতো বড়ো মাপের মানুষ আপুনি! মুর সরম লাইগছে, কিনো কি আপনি মু-কে ফুন কুইরছেন, মিডাম! ইটা তো মুর কাছে অবিসাস্য কুথা। মু ইকটা মজুর আছি। আপুনকে মু চিনবো লাই! সিটা কি হয়! আপুনকার কুতো লিখা মু পুড়েছি!
--- সেকি! তুমি পড়তে পারো! আমি তো শুনলাম...
লজ্জায় লাল হয়ে গিয়ে রাজেন জানায়--- মু পুরি লাই। মু পুরি লাই। মু-কে শুনাইছে। পলাশী।
--- পলাশী? কে পলাশী? কৌতূহল প্রকাশ করেন আলোলিকা রায়।
--- পলাশী মুদের বাঘমুণ্ডির গব্ব। মিলা লিখাপুড়াটো কুইরেছে মিয়াটো। আপুনকার লিখাটো তো মুর বড়ো ভালো লাগে। মনের কুথাটো মুখির সামনে এইসে কুথা বলে। ইক্কেবারে ছবির পারা।
--- তা তুমি তো বোধহয় একটা পুরস্কার-টুরস্কার পাচ্ছো, রাজেন। জানো তো? তোমার নাম তো নমিনেশনে উঠেছে। নমিনেশন বোঝো? নমিনেশনে আছে তোমার নাম। আর তো তুমি একজন মজুর রইলে না, ভাই। এবার থেকে তো তোমাকে আরো লিখতে হবে। মানুষ তোমার লেখা সাদরে গ্রহণ করেছে। তুমি আমার কথা বুঝতে পারছো তো? আমি তো তোমার ভাষা বলতে জানি না। কী করবো, তাই এভাবেই বলছি। ফোন করে আমার নিজের থেকেই সম্মান জানাচ্ছি।
বিনয়ে বিগলিত রাজেন বলে--- মু-কে আর সরম দিবেন না, মিডাম। মুদের আবার সম্মান! কে চিনে, কে পুছে মুদের? আজ মানুষ জাইনছে, কালই সোব ভুইলে যাবে। মুদের গাড়ি লাই, বড়ো বড়ো বাড়ি লাই, ইংজিরি ভাষাটো লাই। এই গেরামের ভাষাটো শুধু জানি। আপনি বড়ো মানুষ। তাই মু-কে ভালবাসার কুথাটো বুইলছেন। ই সোব কুথা কে বলে! পুরস্কার লয়, মিডাম। মু শুধু আমার পরিচয়টো, মুর মায়ের পরিচয়টো চাই।
--- তোমার পরিচয়! তোমাকে তো মানুষ চিনছেই। আবার কীসের পরিচয়? নিজেকে এ্যাতো ছোট ভেবো না, রাজেন। তোমরাও যে পারো--- এটা তো তুমি দেখিয়ে দিলে। আসলে আমি একটা কথা তোমাকে বলবো বলে ফোন করেছি।
--- বলেন, মিডাম। আদেস কুরেন।
বিরক্ত হন আলোলিকা রায়--- কী তুমি তখন থেকে ম্যাডাম ম্যাডামরছো, বলো তো! আমি কারো ম্যাডাম নই। আমাকে মিসেস রায়  লতে পারো। আচ্ছা রাজেন, আমাকে একটা কথা বলো তো। তোমার মা-ই কি তোমার উপন্যাসের রাধারানী?
--- কিনো বলেন তো? ই কুথাটো তো অন্য কুনো লুক মু-কে পুছে লাই। আপুনি কিনো পুঁছছেন? আপুনি কি তাকে চিনেন?
--- না না, আমি কী করে চিনবো! আমি তো কখনও পুরুলিয়াতে যাই-ই নি।
--- বুটে? হ, রাধারানী মুর মা-টো আছে। উয়ার আসল নাম রাধারানী লয়। উ ছিলো লছমী। লছমী বাউরি।
কীসের কারণে যেন আলোলিকা রায় বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে দ্বিতীয় প্রশ্ন করেন--- তুমি আমাকে আর একটা কথা বলো তো, তোমার মা কি এখনও বেঁচে আছেন?
একটু হেসে দিয়ে বেশ বোদ্ধার মতো রাজেন বলে--- এই পিরথিবির সোব বিটার কাছেই তাদের মা-টো চিরকাল বেচ্চেই থাকে, মিডাম। মাটো কি কুখনও মইরে যায়! মুর মা-ও মরে লাই। মুর মইদ্দে বেইচে আছে।
 --- আচ্ছা, আমি যদি তোমার সাথে দেখা করতে চাই? তুমি দেখা করবে? তোমাকে দেখতে আমার বড়ো ইচ্ছে।
--- মু-কে! এই রুখা সুখা তেল লাই, জল লাই পিটে খাবারটো লাই। ইমন মানুষের সাথে দিখা কুইরবেন! তো আইসেন কেনে। মুদের এই রুখা-সুখা দেসে আইসেন। মুরা কুতো সুখে আছি, দেইখে যান কেনে। তা বাদে,  আরো ইকটা উপন্যাস লিখার রসদটো লিয়ে যান।
বেশ উত্তেজনায় আলোলিকা জানান--- তাহলে সামনের সপ্তাহে কিন্তু আমি যাচ্ছি। মনে থাকবে?
--- মিডাম, হামার মুনে রাখার দরকারটো লাই। হামার বিদেশ লাই, মিটিন লাই, ঘুরা-ফিরা লাই। হামাকে পেইয়ে যাবেন মাঠে, ক্ষেতে ইখানে উখানে। আইসেন কেনে।


এ্যাতোটা বলে দিয়ে এবারে রাজেন ভাবতে বসে, কেন এই এ্যাতো বড়ো মাপের লেখিকা তার মতো ব্রাত্যসমাজের একজন মানুষকে দেখতে ছুটে আসছে। কথাটা ভেবেই আবার নিজেকে বুঝ দেয়, ভূমিপুত্র প্রকাশিত হবার পরে এটাই তো একমাত্র ঘটনা নয়। অনেকেই ওর সাথে দেখা করতে চেয়েছে। দেখা করেওছে। ওকে নানা ভাষায় সাধুবাদ জানিয়েছেন বাংলার অনেক ছোট-বড়ো বুদ্ধিজীবী। ভূমিপুত্র নাকি বাংলা সাহিত্যে একটা নতুন মোড় এনে দিয়েছে। যে ভাষায় রাজেন কথা বলে, তাতে তো আর লেখা যায় না। প্রচলিত পথে সেই ভাষায় কোনো সাহিত্য লেখা চলতে পারে না। শুধু ওর গাঁয়ের একমাত্র বন্ধু এই পলাশী ছিল বলে এটা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু সম্ভব হয়ে আর এক বিপদে পড়েছে রাজেন। কথা নেই, বার্তা নেই এ-ও-সে হাজীর হচ্ছে ওর সাথে কথা বলতে। রাজেন বুঝতে পারে না, কী বৈপ্লবিক কাজ ও করে বসেছে। লিখেছে তো মায়ের দুঃখময় জীবনের কথা, তার কষ্টের কথা, আর শহরের তথাকথিত জ্ঞানী-সম্মানীয়-প্রনম্য মানুষের কথা যারা এই পুরুলিয়ার গেস্ট হাউসে থেকে অযোধ্যা পাহাড় দেখবার জন্যে একবার এসেছিলো আর নষ্ট করেছিল ওর মাকে। বাপের পরিচয় ছাড়াই রাজেন মার হাত ধরে বাঁচতে শিখেছিলো, বড়ো হয়েছিলো। কোনোদিন মায়ের কাছে বাপের কথা জানতেও চায়নি। সেই চেতনা ওর মধ্যে ছিলোও না। তবে যেদিন ও জানতে পারে যে, ওর মা ওকে গর্ভে নিয়ে শালুকডাঙ্গা থেকে মোড়লদের তাড়া খেয়ে পালাতে পালাতে একে একে হাতিনারা, মনসাবনী, চড়কতলা ইত্যাদি নানা গ্রামে আশ্রয় হারাতে হারাতে শেষে এই বাঘমুণ্ডিতে মাথা গুঁজবার আস্তানা পেয়েছে অধীর গড়াই মাস্টারের বাড়ি, সেইদিন থেকে রাজেনের মনে একটা প্রশ্ন ঘুরে ফিরে এসেছে, কেন ওর মাকে গ্রামের মানুষ এভাবে তাড়িয়ে তাড়িয়ে পাহাড় ছাড়া করেছে। কিন্তু মাকে কোনোদিন সেই প্রশ্ন করে ও বিব্রত করেনি। মা-টা ভেতরে ভেতরে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে একেবারে যখন শেষ পর্যায়ে এসে মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, সেইদিন ওকে ডেকে নিজেই নিজের জীবনের বেদনার কাহিনি বলে গিয়েছে।
জঙ্গলের পাতা কুড়িয়ে আর কাঠ কেটে কোনোরকমে জীবন ধারণ করতো লছমীর বাপ, যাকে রাজেন দেখেইনি। আর ওর মা লছমী গেস্ট হাউসে যে সব বাইরের অতিথিরা আসতো, তাদের সেবা করে, অর্থাৎ তাদের ঘর মোছা, বাসন মাজা, জল তোলা--- এইসব কাজ করেই কিছু টাকা পেতো। দারিদ্র্য থাকলেও রাজেনের মায়ের রূপ কিন্তু তাকে বঞ্চিত করেনি। প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা লছমীর কালো মাজা তেল চক্‌চকে শরীরে বেশ আঁটোসাঁটো গড়ন ছিল। কিন্তু যা একটি নারীর জীবনের সম্পদ, তা-ই রাজেনের মায়ের শত্রু হয়ে উঠেছিলো। মাদারির ঝাঁপি থেকে উদ্ধত অবাধ্য সর্প যেমন বেরিয়ে এসে মাদারিকেই একদিন ছোবল মেরে বসে, তেমনিই লছমীর রূপ-জৌলুস তাকে পবিত্র থাকতে দেয়নি। এমনই এক বৃষ্টির রাতে ঘটে গিয়েছে সেই অভিশপ্ত দুর্ঘটনা।
রাজেনের দাদাজি তখন অসুস্থ, বিছানায়। ডাক্তার-বদ্যিকে ডাকার মতো ক্ষমতা হয়নি লছমীর। গেস্ট হাউসে একদল গণ্যমান্য মানুষ এসেছিলো কলকাতা থেকে। তাদের রং রূপ দেখে লছমীর মনে হয়েছিলো, ওঁদের কাছে একটু দয়া পাবে। এই ভাবনা ভেবেই বিকেল বেলা বাবুদের ঘরের কাজ শেষ করে কিছু টাকা চেয়েছে লছমী বাপের চিকিৎসার জন্যে। বাইরে তখন অশান্ত আবহাওয়া, আর গেস্ট হাউসের ভেতরে বাবুদের মদের আসর। মদের রঙ্গিন চোখে লছমীর হাতে এক গোছা টাকা গুঁজে দিয়েছে বাবুদের মধ্যে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা যে ছিল পাণ্ডা, আর তার পরেই হাত পড়েছে ওর শরীরে। নিজেকে বাঁচাতে পারেনি লছমী। বাপের চিকিৎসার কথা ভেবে পারেনি, নাকি পারার কোনো উপায় ছিল না, তা জানে না সে নিজেও। ধোপ-দুরস্ত শিক্ষিত মানুষটা ওকে ভোগ করেছে তারিয়ে তারিয়ে। বাপ বাঁচেনি লছমীর। লছমী ওর সব হারিয়ে ঘরে ফিরে এসে দেখেছে, বাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে কখন যেন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে।
এই অবস্থায় কী করবে, এই ভাবতে ভাবতেই কেটে গেছে বেশ কিছুদিন। কিন্তু যেদিন প্রথম নিজের শরীরের মধ্যে আর একটা শরীরের অস্তিত্ব ও টের পেয়েছে, সেইদিনই আত্মহত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলো ও। রাতের অন্ধকারে একগাছা দড়ি নিয়ে পলাশ গাছের তলায় ও গিয়েওছিলো, কিন্তু সেটাও পারেনি। গর্ভে যে প্রাণ উৎসারিত হয়েছে, সে যেন মালে ডেকে উঠেছে অজানা আতঙ্কে। স্পষ্ট শুনেছে লছমি। আকাশের দিকে দুহাত তুলে কাতর প্রার্থনা জানায় লছমি,
--- হেই মা মুনসা, মুকে পথ দিখা কেনে। মুকে জীব্বনের দিশা-টো দিখা, দেবী।
দেবী কোনো দিশা কোনো দেখিয়েছিল কিনা, জানে না রাজেন, কিন্তু ও এইটুকু জানে যে, যে প্রাণ এই পৃথিবীর আলোই দেখেনি, তাকে কোনোভাবে বিনা দোষে হত্যা করতে চায়নি লছমী। যে অপরাধ সে একবার করে বসেছে, তাকে ঢাকতে গিয়ে মানুষ মারার আর একটা নতুন অপরাধ ও করতে পারেনি। জন্মেছে রাজেন বাউরি। আর সেই আজ এক বহু আলোচিত সাহিত্যিক। বাংলার বিস্ময়।


নতুন রাস্তা হবে বলে পাহাড়ে কাজ পেয়েছে রাজেন। তারই কাজে তিরিশ জন মজুরের সাথে শীতে কাঁপা গা গরম করতে করতে মাটি কোপাচ্ছিলো মন দিয়ে। এমনি সময়ে অদূরে একটি গাড়ি এসে দাঁড়ায়। আলোলিকা রায় গাড়ি থেকে নামেন। ঠিকাদার ডেকে দেয় রাজেনকে। ডোবার জলে হাত ধুয়ে এসে দ্যাখে, একেবারে মাখন দিয়ে গড়া, চক্‌চকে ত্বকে রোদ পিছলে যাওয়া এক মহিলা দাঁড়িয়ে একটা সাদা গাড়ির পাশে। গাড়ি আর মহিলাটির গাঁয়ের রং যেন মিশে গেছে। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে রাজেন বলে,
--- আপুনি মু-কে বুলাইছেন? জলদি বলেন কেনে। হাতে মিলা কামটো আছে।
--- আমিই তো তোমাকে ফোন করেছিলাম। আসবো বলেছিলাম? মনে আছে?
--- ফুন তো আমাকে কুতো মানুষ কুইরছে। এন.জি.. বাবু এই ফুন-টা মু-কে দিয়াছেন। আর রাত লাই, সকাল লাই, টিং টিং টিং বাজতেই লেগেছে এই ফুন। এইবার ডোবার জলে ফিকে দিবো এই যন্তর।
--- আমি আলোলিকা রায়।
এবারে লজ্জায় লাল হয়ে যায় রাজেন। একেবারে দুহাত জোর করে প্রনাম জানিয়ে বলে--- মুর অপরাধ মাপ কুইরবেন, মিডাম। মু তো আপুনকার কুনো ফুটো দেখি লাই। তাই চিনতে লারছি।
আলোলিকা রাজেনের হাত ধরেন। রাজেন মনের আতঙ্কে দ্যাখে, যেন ওর হাতের কালো রং মহিলার ধব্‌ধবে হাতে এক্ষুনি লেগে নোংরা করে দেবে। সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে রাজেন। মহিলা ওকে একটা পলাশ গাছের ছায়ায় টেনে এনে বসিয়ে বলেন--- তুমি আমার সাথে এসো। এখানে বড়ো রোদ। আমার কষ্ট হচ্ছে। ভয় পেয়ো না, তোমাকে ঠিকাদার কিছু বলবে না। আমি তার সাথে কথা বলে নিয়েছি। এসো, এখানে বসি।
রাজেন ছায়ায় ধপাস করে বসে বলে--- এই সাহিত্য আমার রুটি-রুজি মাইরছে, মিডাম। ইবারে কুনো ঠিকাদার মু-কে আর কামটো দিবে লাই। আমাকে শহরেই চলে যেতে হুবে।
--- চলে এসো। আমি ব্যবস্থা করে দেবো। ওখানে আমার হাতে অনেক কাজ আছে। তোমার জন্যে কাজ জুটে যাবে। কোনো চিন্তা নেই। কিন্তু এই এ্যাতো দূরে তো আমাকে কেউ চেনে না।
রাজেন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে শহরে আরামের মধ্যে থাকা ধবধবে ফর্সা সাহিত্যিকের দিকে। মনে মনে বলে, এই না হলে সাহিত্যিক! ওর নিজের মতো কালো, খড়ি ওঠা, অশিক্ষিত কোনো মানুষের যেন সাহিত্যিক হবার কোন অধিকারই নেই।
রাজেনকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকতে দেখে আলোলিকা রায় বলেন--- কী দেখছো তুমি অবাক হয়ে? এবারে মন দিয়ে আমার একটা কথা শোনো। এই যে তোমাকে সাহিত্য এ্যাকাডেমি পুরস্কার দেবার একটা কথা উঠেছে, এই নমিনেশন তুমি তুলে নাও। তুমি জানিয়ে দাও, তোমার লেখা নিয়ে কোনো বিচার হোক, তুমি চাও না।
বিস্ময়ে হতবাক রাজেন বলে--- তুলে লিবো? কিনো মিডাম? আপুনি ইমন কুথাটো কিনো বুইলছেন? মুর ইমন ক্ষতিটো মু কিনো কুইরবো?
--- ক্ষতি কেন হবে? আমি তো আছি। এই পুরস্কার তোমাকে যত টাকা দেবে, তার থেকেও বেশী টাকা আমি তোমাকে দেবো। এছাড়া তোমাকে কলকাতায় নিয়ে যাবো, কাজ দেবো। এই মাটি কুপিয়ে মাটি কুপিয়ে কাজ তোমাকে আর করতে হবে না।
আবারও বিস্ময়ে হতবাক রাজেন। আলোলিকা দেবী আবার প্রশ্ন করেন--- কী? পছন্দ হল না? দ্যাখো, তুমি হয়তো জানো না, ,আমি কিন্তু ইচ্ছে করলে এখানে না এসে কলকাতায় বসে তোমার লেখাটাকে বাতিল করতে পারি। আমার বা আমার স্বামীর সেই ক্ষমতা আছে। কিন্তু আমি তা চাই না। তুমি লিখেছো, লোকে তোমার বই পড়েছে, পড়ছে। শুধু শুধু এই পুরস্কারের ঝামেলায় যেয়ো না। তোমাকে নানা প্রশ্নের মুখেও পড়তে হবে। সে সব প্রশ্নের সব উত্তর দিতেও তুমি পারবে না। এমনকি এ লেখা তুমি আদৌ  লিখেছো কিনা, এই নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। লোকে হাসাহাসি করতেও পারে।
--- কিন্তু কিনো মিডাম, আপুনকার কি স্বার্থ? মু তো আপুনকার কুনো ভালো করি লাই, মন্দও কুরি লাই। মু শুধু মুর পরিচয়টো চাই। যে পরিচয়টো আঁধারে হারিয়ে গিঞ্ছে, সেই পরিচয়টো চাই। আপুনি কিনো বাঁধা দিবেন? আপুনকার কুনো লিখা কি পুরস্কারের নমিনেশন পেইয়েছে? ইটাই কি আপুনকার স্বার্থ?
আলোলিকা দেবী নীরবে তাকিয়ে থাকেন রাজেনের দিকে। রাজেন আবার বলে---আমি তো পুরস্কার চাই না, মিডাম। আমি আমার পরিচয়টো চাই, শুধু পরিচয়। মানুষ জানুক, কি রাজেন বাউরি কে আছে।
--- তাতে তোমার কী লাভ? তার চেয়ে তুমি ভালো খাবে, ভালো পড়বে, আমি তার ব্যবস্থা করে দেবো। এসব কি ভালো নয়?
রাজেনের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন কোনো এক গোপন কথা বলে ওর কানে কানে। গোঁ ধরে বসে রাজেন--- না মিডাম। আমাকে জানতে হুবে, আপুনি কিনো ইমন প্রস্তাবটো দিলেন হামাকে।
--- আমি তোমাকে জানাতে পারি। কিন্তু তোমাকে কথা দিতে হবে, তুমি সাংবাদিকদের কাছে তোমার বাবার পরিচয় দেবে না। তুমি নিশ্চয়ই জানো, তোমার জন্মদাতা কে। অন্তত তোমার লেখা তাই বলে। কিন্তু আমাকে চেনো না। এবার বলো, রাজী?
রাজেন কি যেন কি ভেবে বলে--- হ, রাজী। বুলেন কেনে। পুরস্কার আমার চাই না। আপুনকে চিরটাকাল গড় কুইরে এসেছি। আমি রাজী।
এবারে বেশ সঙ্কোচ আর সলজ্জ স্বরে আলোলিকা জানান--- তাহলে শোনো, যে মানুষটা তোমার মায়ের সাথে অন্যায় করেছে, আমি তার স্ত্রী। তিনি একজন নামী লেখক। আর আজ তিনি রাজনীতির এক বিখ্যাত মানুষ। সে একজন গুনী মানুষ। অনেক কষ্টে এই জায়গায় সে উঠে এসেছে। একদিন একটা হঠাৎ করে ফেলা ভুলের জন্যে তার সর্বনাশ হওয়া তো উচিত নয়। বলো। আমি চাই না, তোমার জন্যে তার পোলিটিক্যাল কেরিয়ার নষ্ট হোক। তোমারও তো কোনো লাভ নেই তেমনটা করে।
এবার রাজেন হেসে দেয়। খ্যাতির শীর্ষে অধিষ্ঠিতা আলোলিকা রায়ের দিকে মিটি মিটি তাকায় রাজেন। অবশেষে বলে--- মিডাম, আপুনকার সহরের সম্মানটো আছে, আর মুদের এই পাহাড়ের সম্মানটো কি লাই? আপুনকার শহরের জীবনটো জীবন, আর মুদের গিরামের জীবন কি কুনো জীবন লয়? মু লিখাপরাটো কুরি লাই। কিন্তুক সাহিত্যটো তো লিখতে পারি। মু-ও অনেক কষ্টে ইঠানে এসেছি। পুরস্কারটো মু লি, কি না লি--- কিন্তুক মুর পরিচয়টো মু খুয়াইতে পাইরবোক লাই।
--- তাহলে তো তুমি কথা রাখলে না। তুমি তোমার বাবার পরিচয় সাংবাদিকদের কাছে বলবে। সেটা কিন্তু তোমার পক্ষে ভালো হবে না। আর এর জন্যে আমাকে কিন্তু দায়ী করো না। এটা আমি জানিয়ে দিলাম।
রাগে অপমানে দু-চোখ লাল করে রাজেন জানায়--- সুন্‌ কিনে সহরের সাহিত্যিক। মুকে টাকা দিখাস না। লুভ দিখাস না। ইটা জঙ্গল মহল। এখানে যে মানুষগুলান থাকে, উয়াদের মাঝে মাঝে বুনের হিংস্র পশু এইসে আঘাতটো কুরে, রক্ত ঝরায়। কিন্তুক এই জঙ্গলমহলের মানুষগুলান সেই জন্তুগুলানকে আঘাতটো কুরে লা। তাই মুর কুনো বাপ লাই। বাপের দরকারটোও লাই। মুর ইকটাই পরিচয়। মু লছমী বাউরির বিটা রাজেন বাউরি। কুন জন্তু আমার মা-টোকে আঘাত দিয়েছে, সেই পরিচয় লিয়ে বাঁচার শিক্ষা মুর মা-টো মু-কে দেয় লাই। তু যা কিনে সহরে। তুর সোয়ামিটোকে জানাইন দিস, উয়ার পরিচয়ের লেইগ্যে মু বেঁইচে লাই। মু মুর মায়ের লেইগ্যে বেঁইচে আছি। মু মুর মায়ের বিটা। মু শিল্পী। মুর সেই পরিচয়টো তুই লিতে লারবি।
কথাকটা বলে রাজেন কোদালটা আবার কাঁধে তুলে নেয়। হাঁটা দেয় কাজের দিকে।  

-----------------------------


রবিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২

দুখের দিনে


দুখের দিনে
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়  

সকালবেলাতেই ঘোষ পাব্লিকেশনের অনন্ত বাবু এসে হাজীর দুর্গাপদ বাবুর বাড়িতে। এই সময় যে তিনি আসেন না, এমন নয়। এর আগেও এসেছেন। সেই পুরনো ধুতি আর শার্ট, মাথার যাই যাই করা চুল তেল দিয়ে পাট পাট করা, আর পায়ে কোলাপুরি চটি। অনন্ত বাবুর মুখে এই একটি হাসি সব সময় লেগেই থাকে। কারোর দুঃখের দিনেই হোক, বা সুখের দিনে। অনন্ত বাবু মানে তাঁর এই হাসি। এটা ওঁর বিজনেস প্রপ্স, না এটাই ওঁর চরিত্র--- তা জানেন না দুর্গা বাবু। মুখ যেন গোমরা করতে জানেন না ভদ্রলোকটি।
এই প্রকাশনার মাসিক একটি পত্রিকায় এবং শারদীয়াতে নিয়মিত লেখা দিতে হয় দুর্গা বাবুকে। শুধু এই পত্রিকা নয়, আরো কয়েকটি পত্রিকা আছে যেখানে নিয়মিত দুর্গাপদ মজুমদারের গল্প ও উপন্যাস ছাপা হয়। যদিও আজো পর্যন্ত তাঁর তিনটের বেশী বই ছেপে বের করেননি কেউ। এই পত্র-পত্রিকায় লেখা দিয়ে যে দুর্গা বাবুর তেমন রুটি রুজি হয়, তা নয়। আজকাল সাহিত্য কেনেই বা কে, আর পড়েই বা কে? এই বিজ্ঞান আর হাজার বিনোদনের যুগে মানুষের সময়ই বা কৈ বা ধৈর্যই কোথায়? ফলে তেমন পেমেন্ট পান না দুর্গাপদ বাবুর মতো সাহিত্যিক বা কবি সমাজ। ঐ... মনের মধ্যে বার বার কুরে কুরে খাওয়া ভাবনা-চিন্তাগুলো কোনোরকমে খাতায় প্রকাশ করে দিতে পারলে তা ছেপে বের হবার একটা হিল্লে হয়ে যায় দুর্গা বাবুদের মতো লেখকদের। ওইটাই সন্তুষ্টি। তা নয়তো এ পোড়া দেশে কত উপযুক্ত কবি আর লেখক মাথা খুড়ে মরছে তাদের একটা লেখা একবার কোনোরকমে ছেপে বের করবার জন্যে। কিন্তু আজকের প্রকাশকদের কথা--- পয়সা ফেলো, ছেপে দিচ্ছি দায়িত্ব নিয়ে। কিন্তু বিনিয়োগ? নো নো, মাই ডিয়ার। ও দিন আর নেই।
দুর্গা বাবু জানেন, অনন্ত বাবু কেন এসেছেন। এটা চলছে জুলাই-এর শেষ। ফলে লেখার তাগাদা দিয়ে যাবেন শারদ সংখ্যার জন্যে। গতকালও একজন এসে গেছেন। এ্যাডভান্স টাকা এঁরা দিয়েই দেন। আজকের সাহিত্যে জগতে এই তো কটামাত্র নামধাম করা যেতে পারে, এমন লেখক আছেন। এমন লেখকের লেখা পত্রিকায় না ছেপে বেরোলে পত্রিকার বাজারে কাটতি হবে না বলেই এঁদের পেছনে তাঁদেরকে ঘুর ঘুর করতে হয়, এমন তাগাদা দিতে হয়। তা নয়তো একটি পয়সা ঠেকাতে হবে না, এমন লেখকদের খোঁজ করলে ভুরি ভুরি পাওয়া যাবে এখানে সেখানে। কিন্তু সেইসব নাম তো বাজারে কাটবে না। পত্রিকা বেরিয়েছে কিন্তু দুর্গাপদ বাবু অথবা অশেষ ঘোষ কিম্বা প্রতুল গাঙ্গুলির লেখা থাকবে না, এমন পত্রিকা মানুষ কিনবে নাকি! সে তাঁরা হাবিজাবি যা খুশি লিখুন না কেন, ওঁদেরকেই চাই। পাঠক তো ভাবে না, একজন লেখকের লিখবার একটা নির্দিষ্ট দৌড় আছে। তার বাইরে তাঁকে দিয়ে গুষ্টির লেখা লেখালে আর যাই হোক, তাঁর মানের লেখা নামবে না। বিদগ্ধজন তাকে বলবে বস্তাপচা।
সকালের এই সময়টা দুর্গা বাবু সাধারণত এই বারান্দায় থাকেন না। তিনি নিজের ঘরে স্নান করে বসে যান লিখতে। কিন্তু আজ ঘরে যাননি। বারান্দায়টায় একা বসে আছেন। ঘরে নিঃশব্দে কাঁদছেন তাঁর স্ত্রী। বসে বসে একেবারে অনুষ্ঠান করে যে কাঁদছেন, বা মড়া কান্না কাঁদছেন, তা নয়। নিত্য-নৈমিত্যিক কাজ করতে করতে চোখ মুছছেন। কাল সকালে একটা বাজে খবর এসেছে। এমনটা ভাবতেই পারেননি দুর্গা বাবু বা তাঁর স্ত্রী। একেবারে অভাবনীয়, অপ্রত্যাশিত। দুর্গা বাবুর সদ্য বিয়ে হওয়া মেয়েটি থাকে আসানসোলে। কদিন যাবৎ মেয়েটার শারীরিক অবস্থা ভালো যাচ্ছিলো না, এমন একটা খবর আসছিলো। মাঝে মাঝে জ্বর হয়, মাঝে মাঝে সর্দি কাশি লাগে। এমনটা ওর জীবনে আগে কখনও ছিলো না। দুর্গা বাবুর মেয়ে মিনতি চিকিৎসা জগত থেকে একটু বেশীরকম দূরেই ছিল। ছেলেটাই বরং একটু অসুস্থ ছিলো বরাবর। কিন্তু আজ টেলিফোনে জামাই বলেছে যে, একটা ব্লাড টেস্ট করতেই বিষয়টা হঠাৎ ধরা পড়েছে। সাথে সাথে কেঁদে পড়েছেন স্ত্রী বিনতা। লোকে হয়তো এই অবস্থায় কতকগুলো অনেকবার শোনা, অনেকবার অনেককে বলা সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু দুর্গা বাবু মনে করেন, এ কি সান্ত্বনা দেবার বিষয়! মাকে কি এই অবস্থায় বলা যায়, স্থির হও, কেঁদো না। কান্না তো মনের আর শরীরের স্বতঃস্ফূর্ত বিষয়। আচ্ছা আচ্ছা মানুষ একে সামলে রাখতে পারলো না, তো বিনতা কোন ছার!
স্ত্রীকে বিলাপ করতে দেখতে না পেরে দুর্গা বাবু বারান্দায় এসে বসেছেন। ঘরে কিছুক্ষণ বসে ছিলেন ছেলের ছবিটার সামনে। ছবিটা তোলা হয়েছিল ও চাকরীটা পাবার ঠিক পরে। দুটো বছর ঘুরে পারেনি ছেলেটা চলে গেছে। এর মধ্যে মেয়ের এই খবর। মানুষের হৃদযন্ত্রের তো একটা সহন ক্ষমতা আছে। এ তো তা পার করে যাচ্ছে! নিজেকে বারান্দাটায় বসে নিজেই সামলাচ্ছেন দুর্গা বাবু। ভূমিকম্প, সুনামি, গ্লোবাল ওয়ারমিং যা-ই হোক, তা তো পৃথিবীর আহ্নিক বা বার্ষিক গতি থামিয়ে দিতে পারবে না। কিছুই তো থেমে থাকে না। চলতে পারছি না--- বললে হয় না। চলতে হয়। দ্য শো মাস্ট গো অন। তাই বারান্দাটায় বসে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন দুর্গা বাবু। সারা মাথার চুল খামচে খামচে ধরে মেজাজটাকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। এটা না করে কোনো উপায় নেই। এক্ষণই আসানসোলে যাবার কোন কায়দা নেই। এদিককার কাজগুলো তো সামলাতে হবেই হবে। উপন্যাস লেখা তো অফিসের কোনো করণিকের কাজ নয় যে, একটা কাউকে দিয়ে সামলে নেওয়া যাবে। সামনে পুজো। আর ওখানে গিয়ে বিশেষ কী-ই বা করবেন! বড়োজোর মেয়ে-জামাইয়ের দুঃখের একটা ভাগ নিতে পারেন। এ তো চিকিৎসারও অতীত। কিছু তো করা যাবে না। পুজোটা না কাটলে তো যাওয়াও যাবে না। ঘাড়ের ওপরে যে দায় রয়েছে। তিন তিনটে লেখা কমপ্লিট করতে হবে। তিনটে শারদীয়া আছে। তাঁদের দেওয়া অগ্রিম টাকা তো খাওয়া হয়ে গেছে।
দুর্গা বাবুর এই বাস্তববাদিতা বিষয়ে তাঁর আত্মীয়মহলে একটা বদনাম আছে। ছেলে চলে যাওয়ার সময়ে তাঁকে চোখের জল ফেলতে কেউ দ্যাখেনি। নীরবে বাবা হয়ে সব কাজ করেছেন। লোকে বলেছে, কী রে বাবা! পাথর নাকি! পাথর যে তিনি নন, তা তো তিনি নিজে জানেন। অনলি দ্য ওয়ারার নোজ হোয়ার দ্য শু পিঞ্চেস। বাবা-ই জানে বাবার ব্যথা। অন্যকে জানান দেবার বিষয় তো তা নয়। আজো তিনি চোখের জল ফেলেননি। স্ত্রী বিনতা জানে, মানুষটা কাঁদে না। কিন্তু কাঁদে। সেটা কেউ দেখতে পায় না। এই বত্রিশ বছরে তিনি বুঝে গেছেন, এই মানুষটা কে, বা কী। তাই তাঁর কোনো দাম্পত্য অনুযোগ নেই।
অনন্ত বাবু দুর্গা বাবুকে এমনটা দেখে মুখে কোনো শব্দ না করে পাশে থাকা কাঠের চেয়ারটা সশব্দে টেনে নিয়ে বসেন। আর তখনই মুখ তুলেছেন তিনি। অনন্ত বাবুকে দেখে মনের অস্থিরতাটা যেন ঢোক গিলে ফেলার মতো গিলে নিয়েছেন। এর ভাগ তো আর তাঁকে দেওয়া যায় না। দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। তাই ক্ষীণ স্বরে বলেন,
--- চিন্তা করবেন না, অনন্ত বাবু। আর দিন দশেকের মধ্যে লেখাটা পেয়ে যাবেন।
কিন্তু হাঁ হাঁ করে ওঠেন অনন্ত বাবু--- না না। আমি ওটার জন্যে আসিনি। আমি একটা বিষয় জানতে এলাম।
--- কী বিষয়, অনন্ত বাবু?
--- আসলে গত কালকে ঘোষাল পাবলিকেশনের বরুণ বাবুর সাথে দেখা হলো। উনি একটা দুঃসংবাদ দিলেন। আমি তো শুনে অবধি চম্‌কে গেছি।
ঘোষাল পাবলিকেশনের নাম বলতে বুঝতে পারেন দুর্গা বাবু, কোন দুঃসংবাদের কথা বলছেন অনন্ত বাবু। তবু না জানার মতো বলেন--- কী বিষয় বলছেন, বলুন তো?
--- আপনার মেয়ের নাকি...
--- হ্যাঁ। ঠিকই শুনেছেন। কালকে বরুণ বাবু এসেছিলেন, আর তাই তিনি জেনেছেন। তখনই সংবাদটা এলো কিনা। মেয়ের এক কারণে ব্লাড টেস্ট করতে গিয়ে আর এক সমস্যা ধরা পড়েছে।
--- সেটা কি লিউকোমিয়া?
--- হ্যাঁ। আপাতত তো তাই জানি।
--- ওরা কনফার্মড?
--- ওরা কনফার্মড কিনা, সেটা থেকে বড়ো কথা, প্যাথলজি সেন্টার কনফার্মড কিনা। তাই ওরা আরো অন্য জায়গা থেকে টেস্ট করাবে।
হাহুতাশ করলেন অনন্ত বাবু। এঁদের সাথে দুর্গা বাবুর বহুদিনের সম্পর্ক। ফলে দুর্গা বাবুর পরিবারের নানা কথা জানা এঁদের। সেই অবগতি থেকেই হাহুতাশ করলেন অনন্ত বাবু--- আপনারা তো পুত্রশোক আজো ভুলে উঠতে পারলেন না, এর মধ্যে দ্বিতীয় আঘাত!
আসলে দুর্গা বাবুর ছেলে মারা গেছে প্রায় দুটো বছর আগে। সেটা ছিল একটা মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা। বাড়ি থেকে অশান্তি করেই বেরিয়েছিল ছেলেটা। আর ফেরেনি। দুর্গা বাবুকে সোজা মর্গে লাশ সনাক্ত করতে যেতে হয়েছিলো। তারপর অন্ত্যেষ্টি, পারলৌকিক সব তাঁকেই করতে হয়েছে। চাকরী পাবার পর ছেলেটা একটি বিবাহিতা মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো। দুর্গা বাবু এটাকে ছেলের নেহাৎ বালখিল্য ভেবে বলেছিলেন,
--- জীবনে মানুষকে নানা পরীক্ষা দিতে হয় রে, পাগল। নানা প্রশ্নপত্র সল্‌ভ করতে হয়। তার সবটা মেলে বা মেলে না। তার দুঃখেই সে অস্থির। এর ওপর আবার নিজে থেকে কোনো পরীক্ষা টেনে আনিস না। এটা বিবাহ বলে কথা। স্কুল কলেজের বন্ধুত্ব নয়। মেয়েটা একটি লোকের বিবাহিতা স্ত্রী। তাদের মধ্যে কী সম্পর্ক, কতটা সম্পর্ক--- এসব তুই জানতে যাস না। ওকে ওর মতো জীবনটা যুঝে নিতে দে। তুই এর মধ্যে ঢুকলে ওদের সম্পর্কের যেটুকু সম্ভবনা, তাও নষ্ট হবে। গোটা জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে। এটা অন্যায়। বাবা হয়ে আমি কিছুতেই তোকে সমর্থন করতে পারি না।
কিন্তু চোরায় না শোনে কভু ধর্মের কাহিনি। একটা নেশা যখন মানুষের মাথায় চেপে বসে, তখন সেটাকেই পেতে সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে। তেমনটাই হলো দুর্গা বাবুর ছেলের। সে বাবাকে আক্রমণ করে বসলো--- তুমি একজন প্রগতিশীল লেখক হয়ে এসব বলছো! এটা কি প্রগতিশীলতা!
কোনোরকমে উত্তেজিত হন না দুর্গা বাবু। শান্ত স্নিগ্ধ কণ্ঠে বলেন--- আমি প্রগতিশীল লেখক, এই মনগড়া শব্দ পেলি কোথায়? আমি তো কখনও এসব দাবি করি না।
--- হও না হও, তুমি তো একজন মানবতাবাদী শিল্পী। একটি মেয়ে দিনের পর দিন তার স্বামীর অত্যাচার সইছে। এটা শিল্পী হয়ে তুমি মেনে নিতে পারো, বাবা। আমি পারি না। ওকে উদ্ধার করা আমার দায়িত্ব।
বাবা বোঝান--- নিজের বৃত্তটা বোঝ্‌, বাবা। বৃত্তের বাইরে যেতে চাস না। একটা সময়ে সইতে পারবি না। তোকে তখন কে উদ্ধার করবে? আর যদি সত্যি তোর কথা সত্যিও হয়, তবে তো তোকে অপেক্ষা করতে হবে। ওদের মধ্যে সেপারেশন না হলে...
অস্থির পুত্র অস্থিরতা প্রকাশ করে--- নীনা ঘর ছাড়লে ওর স্বামী বেঁচে যায়, বাবা। কোনো বৈধ বা অবৈধ বিষয় নিয়ে, আইনি বা বে-আইনি ঘটনা নিয়ে ওর কোনো মাথা ব্যথা নেই। ও শুধু মুক্তি পেলেই বেঁচে যায়। ফলে নীনারও মুক্তি জরুরী।
কিন্তু দুর্গা বাবু মেনে নিতে পারেন না ছেলের এই অবাস্তববাদী কথাবার্তা। এই থেকেই কলহ, এই থেকেই উত্তেজনা। অগ্নিশর্মা হয়ে ছেলে মোটর সাইকেলের চাবি ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে বেরিয়ে যায়। আর আধঘণ্টার মধ্যে ভিআইপি রোডের ওপর এ্যাক্সিডেন্‌ট করে। সাথে সাথে মৃত্যু। দুর্গা বাবু খবর পান পরদিন। একেবারে মর্গে গিয়ে ছেলের দেহ নিয়ে আসেন। সেই বেদনা কাটতে না কাটতেই আজ মেয়ের এই খবর। দুর্গা বাবু মনে মনে একটা বিষয়ে নিশ্চিন্ত যে, দুঃখ-বেদনায় বিনতা কেঁদে ফেলতে পারে। চোখের জলে বুকের সব যন্ত্রণা ধুয়ে দিতে পারে। কিন্তু তিনি তো তাও পারেন না। বুকের মধ্যে যন্ত্রণা ঘুরে ঘুরে মরে।
--- ঈশ্বরের এ কী  বিচার বলুন তো, দুর্গা বাবু! একটা মানুষকে কত যন্ত্রণা দেওয়া ঠিক, না বেঠিক--- সে বোধটুকু পর্যন্ত নেই তাঁর! আপনাদের মতো ভালো মানুষকে কি এভাবে শুধুই কষ্ট দুঃখ দিতে হয়! দুনিয়ায় মন্দ লোকেরা তো দিব্যি খেয়ে পরে সুখে কাটাচ্ছে!
শুকনো হেসে দুর্গা বাবু বলেন--- এভাবে বলবেন না, অনন্ত বাবু। এটা ঠিক কথা নয়। এটা সত্য যে, দুঃখ বেদনা মানুষ চায় না। কিন্তু মানুষের সাথে দুঃখের এই সম্বন্ধ তো অবিচ্ছেদ্য, অনিবার্য। এ থেকে তো মুক্তি নেই। আরো আশ্চর্য কি জানেন, মানুষ পকেটের টাকা খরচ করে পর্যন্ত এই দুঃখ কিনতে যায়। দুঃখের কবিতা পড়ে, দুঃখের চলচ্চিত্র দ্যাখে, দুঃখের গান শোনে। দুঃখের সাথে মানুষের অচ্ছেদ্য বন্ধন। ঘরের কোনো না কোনো ফাঁক-ফোঁকর গলে সে ঠিক ঢুকে পড়ে। সব ওলট-পালট করে দেয়।
মেনে নিতে হয় অনন্ত বাবুকে এইসব কথা। মাথা নেড়ে বলেন--- ঠিক দুর্গা বাবু। কথাটা ঠিক। আমরা ভাবি, না ভাবি--- কথাটা ঠিক। কিন্তু আমি তো এই কথা বলছি না। আমি ঈশ্বরের কথা বলছি, তার বিচারবোধ অভাবের কথা বলছি।
--- অমন কথাটাও ঠিক নয়, অনন্ত বাবু। পরম পুরুষ শুধু নেন না। দেনও। আমরা বুঝতে পারি, না পারি, দেখতে পাই, না পাই। পরম পুরুষ ঠিক এক নিয়ে আর এক সাজিয়ে দেন মানুষকে। দেখুন না, রবিঠাকুর। জীবনে একটার পর একটা দুঃখ প্রত্যক্ষ করেছেন আর এক একটি গান, এক একটি কবিতা রচনা করেছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় চরম দারিদ্রের মধ্যে ডুবতে ডুবতে লিখে রেখে গেছেন তাঁর অমর সব রচনা। কবি কৃত্তিবাস রাম-সীতার বিরহ দৃশ্য লিখে উঠতে না পারলে যখন তাঁর স্ত্রী তাঁকে না জানিয়ে ঘর ছেড়ে চলে যান একদিন, তখনই রচিত হয় সেই অনন্য বিরহ দৃশ্য। শুধু এই দেশে কেন! এই তো কার্ল মার্ক্স। তিনি তাঁর জীবনে এক একটি হারানোর বেদনা বুকে ধরেছেন আর এক একটি গ্রন্থ লিখেছেন। বেদনাই তো সেই অনন্ত খনি, অনন্ত বাবু। সংসার সমুদ্রে বেদনার মাটি খুড়ে খুড়েই তো আমাদেরকে এক একটি মুক্ত তুলে আনতে হয়। আপনি ভাববেন না। আপনাদের লেখা ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবে। আমাকে যে পৌঁছতেই হবে। স্বামী মৃত্যু বরণ করলে কি গর্ভবতী স্ত্রী প্রসব থেকে রেহাই পান? আর একটি প্রাণ ঠিক সময়ে চলে আসে। আমার কথাই ধরুন না কেন। আমার বাবা ছিলেন আমাদের অঞ্চলের একজন স্বনামধন্য সমাজকর্মী। বাবা মারা যেতে আমরা একেবারে অকুল পাথারে পড়ে যাই। তখন তো আমি উপার্জনও করি না। এই সময় আমাদের অঞ্চলেই একটি পত্রিকায় আমাকে বাবা সম্পর্কে একটি যে কোনো মানের লেখা দিতে বলা হয়। না না করতে করতে শেষে একটা সংক্ষিপ্ত কর্মজীবন লিখেই ফেলি বাবার ওপরে। কোনো সমস্যা হয় না। বাবা তো। বাবাকে তো কাছ থেকে দেখেছি। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়েই আবিষ্কার করলাম, আমার হাতে লেখা আছে। আগে তো কখনও এমনটা ভাবিনি। আমার হাতে তার পরেই প্রথম গ্রন্থে লেখা হল আমার বাবার পূর্ণ জীবন--- এক জীবনের খোঁজে। আর সেটাই তো পেয়ে গেলো এ্যাওয়ার্ড। ব্যস্‌, আমি হয়ে গেলাম নবাগত সাহিত্যিক।


কিন্তু দুর্গা বাবুর দয়াময় পরমপুরুষ তাঁর এইসব জীবন দর্শনকে একেবারে ভেঙ্গেচুরে দিয়ে তাঁকে একেবারে পরাভবের প্রান্তসীমায় দাঁড় করিয়ে দিলো দু-দিন পরেই। মেয়েকে কেন্দ্র করে স্ত্রী বিনতার মানসিক বোঝা ক্রমে তাঁর শারীরিক অস্থিরতা হয়ে উপস্থিত হলো। ভীষণ রকম উচ্চ রক্তচাপ তাঁকে পাঠিয়ে দিলো একেবারে নার্সিংহোমে। তখন দুর্গা বাবু সবে স্ত্রীকে আশ্বস্ত করতে অবশেষে আসানসোলে মেয়ের কাছেই একবার যাবেন বলে স্থির করেছেন। এই সময়ই বিনতাকে পাঠাতে হল নার্সিংহোমে। এমনকি অপারেশন করার প্রশ্নটা পর্যন্ত এসে যায়। সন্দেহ হয়, হয়তো এটা একটা হার্ট এ্যাটাক। কোনো আর্টারি হয়তো ব্লক হয়ে গেছে। প্রথমটা এই সংবাদ পাননি কোনো প্রকাশনা সংস্থা। দু-দুটো দিন কেটে যায়। দুর্গা বাবুর খোঁজ করতে এসে এঁদেরই একজন জানতে পারেন এই নতুন করে নেমে আসা ঘটনাটি। ওঁরা বেশ বুঝতে পারছিলেন, দুর্গা বাবুর পক্ষে এবারের শারদ সংখ্যায় লেখা দেওয়া আর বোধহয় সম্ভব হলো না। ভদ্রলোক একেবারে অক্টোপাসের আটটি শুঁড়ে আটকে গেছেন। মেয়ের মৃত্যু অথবা স্ত্রীর মৃত্যু, কিম্বা উভয়ের মৃত্যুই তাঁকে প্রত্যক্ষ করতে হবে।
প্রায় দল বেঁধেই তিন প্রকাশনা সংস্থার তিন কর্ণধার হাসপাতালে এসে দাঁড়ান। তাঁরা দেখতে চান, সত্যি দুর্গা বাবু চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি কী নেন। ব্যবসার ক্ষেত্রে কোনো আবেগের স্থান নেই। প্রকাশনা সংস্থার কাছে বিপদ আপদের জন্যে অবশ্যই ব্যবস্থা থাকে। দুর্গা বাবু হাত তুলে দিলেই অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে তাঁদেরকে। তাঁরা হাতে অন্য লেখা নিয়েই আজ এসেছেন হাসপাতালে। বেলা তখন সাড়ে চারটে। হাসপাতালের গেটেই দুর্গা বাবুর সাথে সাক্ষাৎ হল ওঁদের। কিন্তু অবাক হলেন অনন্ত বাবুরা। এ তো সেই দুর্গাপদ মজুমদার নয়। ভদ্রলোককে দেখে কে বলবে, ওঁর স্ত্রী হাসপাতালে, আর মেয়ে ব্লাড ক্যান্সারের পেশেন্‌ট! দিব্যি ভদ্রলোক একটি সিগারেট টানছেন বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। ওঁদেরকে দেখেই একেবারে এক গাল হেসে দিলেন না বটে কিন্তু বেশ তৃপ্ত তৃপ্ত ভাব করেই বললেন,
--- আরে আপনারা যে! কী করে জানলেন, আমি হাসপাতালে?
অনন্ত বাবু বললেন--- সেকি! আপনি কি আমজনতার মধ্যে পড়েন যে, এমনভাবে বলছেন? অবশ্য আমরা আপনার বাড়ি গিয়েই জেনেছি প্রতিবেশীদের থেকে। তা এখন ম্যাডাম আছেন কেমন?
আর একজনের প্রশ্ন---  এমনটা হলো কী করে, দাদা? ম্যাডামের কি হার্ট প্রবলেম আগে থাকতে ছিল?
প্রবোধ দিতে চেষ্টা করেন দুর্গা বাবু--- না না। সে সব তো টের পাইনি। মেয়ের কাছ থেকে দুঃসংবাদটা শুনেই উনি ভেতরে ভেতরে ভেঙ্গে পড়েন। এই থেকেই একেবারে সোজা নার্সিংহোম।
অনন্ত বাবু বলেন--- আপনি কিন্তু একদম চিন্তা করবেন না। ট্রিটমেন্টের কোনো কার্পণ্য করবেন না। আমরা পাবলিকেশন এ্যান্‌ড রাইটার্স ফোরামের সাথে কথা বলবো। টাকার অভাব হবে না। একটা এইড পেয়েই যাবো।
কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়ে দুর্গা বাবু জানালেন--- না না। আপনারা অযথা দুশ্চিন্তা করবেন না। বিনতা আজ ভালো আছে। অনেক বেটার।
পুলকিত অনন্ত বাবু বলেন--- তাই নাকি! বাঃ! সে তো ভালো কথা, দুর্গা বাবু। তা এমন ম্যাজিকটা হলো কী করে?
এবারে একগাল হেসে দিয়ে দুর্গা বাবু বললেন--- আজকে সকালে আমি ওকে ভিজিট করতে এসে কানে কানে বললাম, তোমার মেয়ের ব্লাড ক্যান্সার নয় গো। ওটা ভুল খবর। ব্যস্‌, ম্যাজিক। বিকেলে এসে জানলাম যে, ও বেশ ভালো বোধ করছে। কমপ্লিকেসিগুলো অনেকটা দূর হয়েছে।
অনন্ত বাবু একেবারে মুখটা হাঁ করে বললেন--- এভাবে জলজ্যান্ত মিথ্যে বললেন! কিন্তু বউদিকে বাড়িতে এনে কী বলবেন? তখনও তো সত্যিটা সত্যিই থেকে যাবে।
--- আমি তো মিথ্যে বলিনি, অনন্ত বাবু। আজ সকালেই তো জামাই ফোন করে জানালো, আমার মেয়ের নাম আর পদবী মিলিয়ে আর একজন মেয়ে তার ব্লাড টেস্ট করাতে দিয়েছিলো। প্যাথলজি সেন্টার ভুল করে সেই মেয়েটির রিপোর্ট আমার জামাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। আর তা থেকেই এই বিপর্যয়য়। অবশেষে বিষয়টা ধরা পড়েছে।
--- তাহলে তো আনন্দের খবর, বলুন? এক দুপুরে কিন্তু খাওয়াতে হবে।
কিন্তু দুর্গা বাবু মলিন মুখে জানালেন--- এটাকে এভাবে ব্যাখ্যা করবেন না। ঐ মেয়েটারও আমার মতো একটি বাবা আছেন, বিনতার মতো মা আছেন। তাঁদের অবস্থাও যে আমারই মতো, অনন্ত বাবু। তবে এবারে আপনাদের আরো একটি সুসংবাদ আমি দেবো।
মুখ হাঁ হয়ে থাকা প্রকাশনা সংস্থাদের কর্ণধারদের থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পেয়ে আবার বললেন দুর্গা বাবু--- আপনাদের জন্যে লেখার বেশ ভালো ভালো পরিণতি আমার মাথাতে এসে গেছে। আমার থেকে আবার তিনটে ভালো রচনা পাবেন। আমি নিশ্চিত। তাছাড়া আপনারা যে আমাকে নিয়ে এতোটা ভাবেন, এমন চিন্তা-ভাবনা করেন, এটাও কি আগে জানতাম, বলুন? বলেছিলাম না, পরমপুরুষ আমাদের থেকে শুধু নেন না। কখন যেন নিঃশব্দে আমাদেরকে দু-হাত ভরে দিয়েও যান। রবিঠাকুর লিখেছেন না, দুখের বেশে এসেছ বলে তোমারে নাহি ডরিবো হে / যেখানে ব্যথা তোমারে সেথা নিবিড় করে ধরিব হে...

-------------------------