শনিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১২

"ভূমিপুত্র" ছোটগল্প



ভূমিপুত্র
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়


ক্রিং ক্রিং ক্রিং!
মোবাইল ফোনটা ধরে রাজেন--- হিলো!  
আজ ঠিকাদারের কাছে কাজ পায়নি রাজেন। তাই ঘরেই বিছানায় গড়াচ্ছিলো। রাজেন বাউরি। অধুনাকালে বুদ্ধিজীবী মহলে মুখে মুখে প্রচারিত বড়ো আদরের নাম রাজেন বাউরি। পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে অযোধ্যা পাহাড়, তারই পাদদেশে জন্মেছে এই রাজেন বাউরি। পাদদেশ বলতে গ্রাম বাঘমুণ্ডি। একদা গম্ভীর শিং মুঢ়ার নাচে মেতে ওঠা আদিবাসীদের গ্রাম। একদা বিহারের অন্তর্ভুক্ত রৌদ্রতপ্ত অংশ, আর আজ এই পশ্চিমবাংলার অবহেলিত কালো মানুষদের, অশিক্ষিতদের আর সরল সাদাসিধে মানুষদের গ্রাম বাঘমুণ্ডি। ছৌ-নাচের জন্যে রাজেন আজকের বিস্ময় নয়। সে অধুনা কালের বিস্ময়। সে একজন নিরক্ষর সাহিত্যিক। কে জানে, কে কবে শুনেছে, এমন ঘটনা! এটা মানুষ জানে, একদা নিরক্ষর কবি ছিলো এই বাংলায়। কিন্তু একেবারে সাহিত্যিক! কিন্তু সে খবর রাজেন বাউরির জানা নেই। সে ভূমিপুত্র নামে এক উপন্যাস লিখে চম্‌কে দিয়েছে শুধু একজন অশিক্ষিত হিসেবে নয়, সমালোচকদের ভাষায়, যেন দ্বিতীয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মালো বাংলা সাহিত্যে। উপন্যাস কী? রাজেন বাউরি তার তত্ত্ব জানে না। তবু সে লিখে বসেছে উপন্যাস। এসব কিছু কিছু জানে কেবল এই গ্রামেরই একটি মেয়ে, নাম পলাশী। সে এ কালের প্রগতির আলোয় স্কুল গণ্ডি পেরিয়েছে। সে তার শেখা বিদ্যেতে লিখেছে, আর রাজেন তার আঞ্চলিক ভাষায় উপন্যাসের বাঙময় চিত্র এঁকে গেছে। আর তাতেই দাঁড়িয়ে গিয়েছে একটি গোটা উপন্যাস ভূমিপুত্র। পার্বত্য অঞ্চলে মানুষদের নিয়ে কাজে আসা একটি এন.জি..’র পদকর্তা এমন ঘটনার সংবাদ পায়, আর সে-ই পাদপ্রদীপে আলোয় নিয়ে আসে এই রাজেন বাউরিকে আর তার সৃষ্টিকে। রাজেন বিখ্যাত হয়ে যায় অনন্য প্রতিভা হিসেবে। সে তার গর্ভধারিণীর জীবনের কথা লিখেছে কাল্পনিক নানা নামে। একটি বঞ্চিতা, প্রতারিতা আর অবহেলিতা মায়ের একমাত্র সন্তান রাজেন বাউরি, যে জঙ্গলের কাঠ কেটে নয়, মজুর খেটে খেয়ে-পরে মানুষ। পড়াশুনো আর গল্পের ওপরে রাজেনের আকর্ষণ ছিল বরাবর, যার খবর জানতো কেবল পাহাড়ি মেয়ে পলাশী। পলাশী-ই তাকে এখান ওখান থেকে নানা গল্পের বই এনে রাতে আধো আলো আধো অন্ধকারে ঝুপড়ির মধ্যে বসে পড়ে শোনাতো, আর মন দিয়ে সেই সব কাহিনী শুনতে শুনতে রাজেন কোথায় হারিয়ে যেতো! হঠাৎ একদিন রাজেনের মনে সাধ জেগে ওঠে, ওর মায়ের দুঃখের জীবনের কথা ও বলবে, আর তা লিখে রাখবে পলাশী। তারই ফসল এই ভূমিপুত্র। এ উপন্যাস কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক বিপ্লবের নয়। এ একেবারে একটি নারীর অন্তরের বেদনার কথা। কিন্তু পুরুলিয়ার জনজীবন, সংস্কৃতি, নানা পরব, দারিদ্র্য, অসহায়তা, উগ্রপন্থী ইত্যাদি নানা বিষয় আপনি আপন গতিতে উঠে এসেছে ভূমিপুত্র-তে। কলকাতার বিখ্যাত প্রকাশনী থেকে ছেপে বেরিয়েছে এন.জি.. বাবুদের কল্যাণে। কালো দৃঢ় দড়ির মতো পাকিয়ে যাওয়া শরীরের ক্ষেতমজুর জনমজুর অশিক্ষিত রাজেনের ডাক পড়তে থাকে শহর থেকে। সংবাদপত্রগুলো ওর সাক্ষাৎকার নিয়ে একটা ব্যবসা ফেঁদে বসতে চায়। কিন্তু এন.জি.. বাবুদের নিষেধাজ্ঞা মেনে কোনো ডাকেই সাড়া দেয় না রাজেন। আজ হঠাৎ এক ফোন এলো। আড়মোড়া ভেঙ্গে বিছানা থেকে উঠে মোবাইলটা কানে লাগিয়ে রাজেন বলে উঠেছে,
--- হিলো!
--- তুমি কি রাজেন বাউরি কথা বলছো? ওপার থেকে একটি শহুরে নারী কণ্ঠ কথা বলে ওঠে।
পলাশীর প্রশিক্ষণে আর শহরের ভাষায় লেখা শুনে শুনে কিছু কিছু শহরের ভাষা আয়ত্ব করেছিলো। তাই ও মনে মনে ঠিক করে নেয়, যতটুকু সম্ভব নিজের ভাষা বদলে কথা বলবে। তাই কোনরকমে বলে--- হাঁ। মু রাজেন বাউরি বুটে। কিন্তুক আপনি কি মুর ভাষাটো বুঝবেন, মিডাম?
--- তুমি এমন করে বললে নিশ্চয়ই বুঝবো। আমাকে তুমি চিনবে না। আমার নাম আলোলিকা রায়। আমি একটু আধটু লিখি টিখি।
লজ্জায় মরে যায় রাজেন। মনে মনে প্রনাম জানায় মানুষটাকে। এমন বিরাট লেখিকা মানুষটা যদি ওর মতো একজনকে বলে একটু আধটু লিখি তবে তো লজ্জার কথাই বটে। তাই শ্রদ্ধায় মাথা হেঁট করে বলে--- চিনবো লাই কী রুকম? নিজ্জস চিনি। কুতো বড়ো মাপের মানুষ আপুনি! মুর সরম লাইগছে, কিনো কি আপনি মু-কে ফুন কুইরছেন, মিডাম! ইটা তো মুর কাছে অবিসাস্য কুথা। মু ইকটা মজুর আছি। আপুনকে মু চিনবো লাই! সিটা কি হয়! আপুনকার কুতো লিখা মু পুড়েছি!
--- সেকি! তুমি পড়তে পারো! আমি তো শুনলাম...
লজ্জায় লাল হয়ে গিয়ে রাজেন জানায়--- মু পুরি লাই। মু পুরি লাই। মু-কে শুনাইছে। পলাশী।
--- পলাশী? কে পলাশী? কৌতূহল প্রকাশ করেন আলোলিকা রায়।
--- পলাশী মুদের বাঘমুণ্ডির গব্ব। মিলা লিখাপুড়াটো কুইরেছে মিয়াটো। আপুনকার লিখাটো তো মুর বড়ো ভালো লাগে। মনের কুথাটো মুখির সামনে এইসে কুথা বলে। ইক্কেবারে ছবির পারা।
--- তা তুমি তো বোধহয় একটা পুরস্কার-টুরস্কার পাচ্ছো, রাজেন। জানো তো? তোমার নাম তো নমিনেশনে উঠেছে। নমিনেশন বোঝো? নমিনেশনে আছে তোমার নাম। আর তো তুমি একজন মজুর রইলে না, ভাই। এবার থেকে তো তোমাকে আরো লিখতে হবে। মানুষ তোমার লেখা সাদরে গ্রহণ করেছে। তুমি আমার কথা বুঝতে পারছো তো? আমি তো তোমার ভাষা বলতে জানি না। কী করবো, তাই এভাবেই বলছি। ফোন করে আমার নিজের থেকেই সম্মান জানাচ্ছি।
বিনয়ে বিগলিত রাজেন বলে--- মু-কে আর সরম দিবেন না, মিডাম। মুদের আবার সম্মান! কে চিনে, কে পুছে মুদের? আজ মানুষ জাইনছে, কালই সোব ভুইলে যাবে। মুদের গাড়ি লাই, বড়ো বড়ো বাড়ি লাই, ইংজিরি ভাষাটো লাই। এই গেরামের ভাষাটো শুধু জানি। আপনি বড়ো মানুষ। তাই মু-কে ভালবাসার কুথাটো বুইলছেন। ই সোব কুথা কে বলে! পুরস্কার লয়, মিডাম। মু শুধু আমার পরিচয়টো, মুর মায়ের পরিচয়টো চাই।
--- তোমার পরিচয়! তোমাকে তো মানুষ চিনছেই। আবার কীসের পরিচয়? নিজেকে এ্যাতো ছোট ভেবো না, রাজেন। তোমরাও যে পারো--- এটা তো তুমি দেখিয়ে দিলে। আসলে আমি একটা কথা তোমাকে বলবো বলে ফোন করেছি।
--- বলেন, মিডাম। আদেস কুরেন।
বিরক্ত হন আলোলিকা রায়--- কী তুমি তখন থেকে ম্যাডাম ম্যাডামরছো, বলো তো! আমি কারো ম্যাডাম নই। আমাকে মিসেস রায়  লতে পারো। আচ্ছা রাজেন, আমাকে একটা কথা বলো তো। তোমার মা-ই কি তোমার উপন্যাসের রাধারানী?
--- কিনো বলেন তো? ই কুথাটো তো অন্য কুনো লুক মু-কে পুছে লাই। আপুনি কিনো পুঁছছেন? আপুনি কি তাকে চিনেন?
--- না না, আমি কী করে চিনবো! আমি তো কখনও পুরুলিয়াতে যাই-ই নি।
--- বুটে? হ, রাধারানী মুর মা-টো আছে। উয়ার আসল নাম রাধারানী লয়। উ ছিলো লছমী। লছমী বাউরি।
কীসের কারণে যেন আলোলিকা রায় বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে দ্বিতীয় প্রশ্ন করেন--- তুমি আমাকে আর একটা কথা বলো তো, তোমার মা কি এখনও বেঁচে আছেন?
একটু হেসে দিয়ে বেশ বোদ্ধার মতো রাজেন বলে--- এই পিরথিবির সোব বিটার কাছেই তাদের মা-টো চিরকাল বেচ্চেই থাকে, মিডাম। মাটো কি কুখনও মইরে যায়! মুর মা-ও মরে লাই। মুর মইদ্দে বেইচে আছে।
 --- আচ্ছা, আমি যদি তোমার সাথে দেখা করতে চাই? তুমি দেখা করবে? তোমাকে দেখতে আমার বড়ো ইচ্ছে।
--- মু-কে! এই রুখা সুখা তেল লাই, জল লাই পিটে খাবারটো লাই। ইমন মানুষের সাথে দিখা কুইরবেন! তো আইসেন কেনে। মুদের এই রুখা-সুখা দেসে আইসেন। মুরা কুতো সুখে আছি, দেইখে যান কেনে। তা বাদে,  আরো ইকটা উপন্যাস লিখার রসদটো লিয়ে যান।
বেশ উত্তেজনায় আলোলিকা জানান--- তাহলে সামনের সপ্তাহে কিন্তু আমি যাচ্ছি। মনে থাকবে?
--- মিডাম, হামার মুনে রাখার দরকারটো লাই। হামার বিদেশ লাই, মিটিন লাই, ঘুরা-ফিরা লাই। হামাকে পেইয়ে যাবেন মাঠে, ক্ষেতে ইখানে উখানে। আইসেন কেনে।


এ্যাতোটা বলে দিয়ে এবারে রাজেন ভাবতে বসে, কেন এই এ্যাতো বড়ো মাপের লেখিকা তার মতো ব্রাত্যসমাজের একজন মানুষকে দেখতে ছুটে আসছে। কথাটা ভেবেই আবার নিজেকে বুঝ দেয়, ভূমিপুত্র প্রকাশিত হবার পরে এটাই তো একমাত্র ঘটনা নয়। অনেকেই ওর সাথে দেখা করতে চেয়েছে। দেখা করেওছে। ওকে নানা ভাষায় সাধুবাদ জানিয়েছেন বাংলার অনেক ছোট-বড়ো বুদ্ধিজীবী। ভূমিপুত্র নাকি বাংলা সাহিত্যে একটা নতুন মোড় এনে দিয়েছে। যে ভাষায় রাজেন কথা বলে, তাতে তো আর লেখা যায় না। প্রচলিত পথে সেই ভাষায় কোনো সাহিত্য লেখা চলতে পারে না। শুধু ওর গাঁয়ের একমাত্র বন্ধু এই পলাশী ছিল বলে এটা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু সম্ভব হয়ে আর এক বিপদে পড়েছে রাজেন। কথা নেই, বার্তা নেই এ-ও-সে হাজীর হচ্ছে ওর সাথে কথা বলতে। রাজেন বুঝতে পারে না, কী বৈপ্লবিক কাজ ও করে বসেছে। লিখেছে তো মায়ের দুঃখময় জীবনের কথা, তার কষ্টের কথা, আর শহরের তথাকথিত জ্ঞানী-সম্মানীয়-প্রনম্য মানুষের কথা যারা এই পুরুলিয়ার গেস্ট হাউসে থেকে অযোধ্যা পাহাড় দেখবার জন্যে একবার এসেছিলো আর নষ্ট করেছিল ওর মাকে। বাপের পরিচয় ছাড়াই রাজেন মার হাত ধরে বাঁচতে শিখেছিলো, বড়ো হয়েছিলো। কোনোদিন মায়ের কাছে বাপের কথা জানতেও চায়নি। সেই চেতনা ওর মধ্যে ছিলোও না। তবে যেদিন ও জানতে পারে যে, ওর মা ওকে গর্ভে নিয়ে শালুকডাঙ্গা থেকে মোড়লদের তাড়া খেয়ে পালাতে পালাতে একে একে হাতিনারা, মনসাবনী, চড়কতলা ইত্যাদি নানা গ্রামে আশ্রয় হারাতে হারাতে শেষে এই বাঘমুণ্ডিতে মাথা গুঁজবার আস্তানা পেয়েছে অধীর গড়াই মাস্টারের বাড়ি, সেইদিন থেকে রাজেনের মনে একটা প্রশ্ন ঘুরে ফিরে এসেছে, কেন ওর মাকে গ্রামের মানুষ এভাবে তাড়িয়ে তাড়িয়ে পাহাড় ছাড়া করেছে। কিন্তু মাকে কোনোদিন সেই প্রশ্ন করে ও বিব্রত করেনি। মা-টা ভেতরে ভেতরে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে একেবারে যখন শেষ পর্যায়ে এসে মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, সেইদিন ওকে ডেকে নিজেই নিজের জীবনের বেদনার কাহিনি বলে গিয়েছে।
জঙ্গলের পাতা কুড়িয়ে আর কাঠ কেটে কোনোরকমে জীবন ধারণ করতো লছমীর বাপ, যাকে রাজেন দেখেইনি। আর ওর মা লছমী গেস্ট হাউসে যে সব বাইরের অতিথিরা আসতো, তাদের সেবা করে, অর্থাৎ তাদের ঘর মোছা, বাসন মাজা, জল তোলা--- এইসব কাজ করেই কিছু টাকা পেতো। দারিদ্র্য থাকলেও রাজেনের মায়ের রূপ কিন্তু তাকে বঞ্চিত করেনি। প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা লছমীর কালো মাজা তেল চক্‌চকে শরীরে বেশ আঁটোসাঁটো গড়ন ছিল। কিন্তু যা একটি নারীর জীবনের সম্পদ, তা-ই রাজেনের মায়ের শত্রু হয়ে উঠেছিলো। মাদারির ঝাঁপি থেকে উদ্ধত অবাধ্য সর্প যেমন বেরিয়ে এসে মাদারিকেই একদিন ছোবল মেরে বসে, তেমনিই লছমীর রূপ-জৌলুস তাকে পবিত্র থাকতে দেয়নি। এমনই এক বৃষ্টির রাতে ঘটে গিয়েছে সেই অভিশপ্ত দুর্ঘটনা।
রাজেনের দাদাজি তখন অসুস্থ, বিছানায়। ডাক্তার-বদ্যিকে ডাকার মতো ক্ষমতা হয়নি লছমীর। গেস্ট হাউসে একদল গণ্যমান্য মানুষ এসেছিলো কলকাতা থেকে। তাদের রং রূপ দেখে লছমীর মনে হয়েছিলো, ওঁদের কাছে একটু দয়া পাবে। এই ভাবনা ভেবেই বিকেল বেলা বাবুদের ঘরের কাজ শেষ করে কিছু টাকা চেয়েছে লছমী বাপের চিকিৎসার জন্যে। বাইরে তখন অশান্ত আবহাওয়া, আর গেস্ট হাউসের ভেতরে বাবুদের মদের আসর। মদের রঙ্গিন চোখে লছমীর হাতে এক গোছা টাকা গুঁজে দিয়েছে বাবুদের মধ্যে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা যে ছিল পাণ্ডা, আর তার পরেই হাত পড়েছে ওর শরীরে। নিজেকে বাঁচাতে পারেনি লছমী। বাপের চিকিৎসার কথা ভেবে পারেনি, নাকি পারার কোনো উপায় ছিল না, তা জানে না সে নিজেও। ধোপ-দুরস্ত শিক্ষিত মানুষটা ওকে ভোগ করেছে তারিয়ে তারিয়ে। বাপ বাঁচেনি লছমীর। লছমী ওর সব হারিয়ে ঘরে ফিরে এসে দেখেছে, বাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে কখন যেন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে।
এই অবস্থায় কী করবে, এই ভাবতে ভাবতেই কেটে গেছে বেশ কিছুদিন। কিন্তু যেদিন প্রথম নিজের শরীরের মধ্যে আর একটা শরীরের অস্তিত্ব ও টের পেয়েছে, সেইদিনই আত্মহত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলো ও। রাতের অন্ধকারে একগাছা দড়ি নিয়ে পলাশ গাছের তলায় ও গিয়েওছিলো, কিন্তু সেটাও পারেনি। গর্ভে যে প্রাণ উৎসারিত হয়েছে, সে যেন মালে ডেকে উঠেছে অজানা আতঙ্কে। স্পষ্ট শুনেছে লছমি। আকাশের দিকে দুহাত তুলে কাতর প্রার্থনা জানায় লছমি,
--- হেই মা মুনসা, মুকে পথ দিখা কেনে। মুকে জীব্বনের দিশা-টো দিখা, দেবী।
দেবী কোনো দিশা কোনো দেখিয়েছিল কিনা, জানে না রাজেন, কিন্তু ও এইটুকু জানে যে, যে প্রাণ এই পৃথিবীর আলোই দেখেনি, তাকে কোনোভাবে বিনা দোষে হত্যা করতে চায়নি লছমী। যে অপরাধ সে একবার করে বসেছে, তাকে ঢাকতে গিয়ে মানুষ মারার আর একটা নতুন অপরাধ ও করতে পারেনি। জন্মেছে রাজেন বাউরি। আর সেই আজ এক বহু আলোচিত সাহিত্যিক। বাংলার বিস্ময়।


নতুন রাস্তা হবে বলে পাহাড়ে কাজ পেয়েছে রাজেন। তারই কাজে তিরিশ জন মজুরের সাথে শীতে কাঁপা গা গরম করতে করতে মাটি কোপাচ্ছিলো মন দিয়ে। এমনি সময়ে অদূরে একটি গাড়ি এসে দাঁড়ায়। আলোলিকা রায় গাড়ি থেকে নামেন। ঠিকাদার ডেকে দেয় রাজেনকে। ডোবার জলে হাত ধুয়ে এসে দ্যাখে, একেবারে মাখন দিয়ে গড়া, চক্‌চকে ত্বকে রোদ পিছলে যাওয়া এক মহিলা দাঁড়িয়ে একটা সাদা গাড়ির পাশে। গাড়ি আর মহিলাটির গাঁয়ের রং যেন মিশে গেছে। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে রাজেন বলে,
--- আপুনি মু-কে বুলাইছেন? জলদি বলেন কেনে। হাতে মিলা কামটো আছে।
--- আমিই তো তোমাকে ফোন করেছিলাম। আসবো বলেছিলাম? মনে আছে?
--- ফুন তো আমাকে কুতো মানুষ কুইরছে। এন.জি.. বাবু এই ফুন-টা মু-কে দিয়াছেন। আর রাত লাই, সকাল লাই, টিং টিং টিং বাজতেই লেগেছে এই ফুন। এইবার ডোবার জলে ফিকে দিবো এই যন্তর।
--- আমি আলোলিকা রায়।
এবারে লজ্জায় লাল হয়ে যায় রাজেন। একেবারে দুহাত জোর করে প্রনাম জানিয়ে বলে--- মুর অপরাধ মাপ কুইরবেন, মিডাম। মু তো আপুনকার কুনো ফুটো দেখি লাই। তাই চিনতে লারছি।
আলোলিকা রাজেনের হাত ধরেন। রাজেন মনের আতঙ্কে দ্যাখে, যেন ওর হাতের কালো রং মহিলার ধব্‌ধবে হাতে এক্ষুনি লেগে নোংরা করে দেবে। সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে রাজেন। মহিলা ওকে একটা পলাশ গাছের ছায়ায় টেনে এনে বসিয়ে বলেন--- তুমি আমার সাথে এসো। এখানে বড়ো রোদ। আমার কষ্ট হচ্ছে। ভয় পেয়ো না, তোমাকে ঠিকাদার কিছু বলবে না। আমি তার সাথে কথা বলে নিয়েছি। এসো, এখানে বসি।
রাজেন ছায়ায় ধপাস করে বসে বলে--- এই সাহিত্য আমার রুটি-রুজি মাইরছে, মিডাম। ইবারে কুনো ঠিকাদার মু-কে আর কামটো দিবে লাই। আমাকে শহরেই চলে যেতে হুবে।
--- চলে এসো। আমি ব্যবস্থা করে দেবো। ওখানে আমার হাতে অনেক কাজ আছে। তোমার জন্যে কাজ জুটে যাবে। কোনো চিন্তা নেই। কিন্তু এই এ্যাতো দূরে তো আমাকে কেউ চেনে না।
রাজেন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে শহরে আরামের মধ্যে থাকা ধবধবে ফর্সা সাহিত্যিকের দিকে। মনে মনে বলে, এই না হলে সাহিত্যিক! ওর নিজের মতো কালো, খড়ি ওঠা, অশিক্ষিত কোনো মানুষের যেন সাহিত্যিক হবার কোন অধিকারই নেই।
রাজেনকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকতে দেখে আলোলিকা রায় বলেন--- কী দেখছো তুমি অবাক হয়ে? এবারে মন দিয়ে আমার একটা কথা শোনো। এই যে তোমাকে সাহিত্য এ্যাকাডেমি পুরস্কার দেবার একটা কথা উঠেছে, এই নমিনেশন তুমি তুলে নাও। তুমি জানিয়ে দাও, তোমার লেখা নিয়ে কোনো বিচার হোক, তুমি চাও না।
বিস্ময়ে হতবাক রাজেন বলে--- তুলে লিবো? কিনো মিডাম? আপুনি ইমন কুথাটো কিনো বুইলছেন? মুর ইমন ক্ষতিটো মু কিনো কুইরবো?
--- ক্ষতি কেন হবে? আমি তো আছি। এই পুরস্কার তোমাকে যত টাকা দেবে, তার থেকেও বেশী টাকা আমি তোমাকে দেবো। এছাড়া তোমাকে কলকাতায় নিয়ে যাবো, কাজ দেবো। এই মাটি কুপিয়ে মাটি কুপিয়ে কাজ তোমাকে আর করতে হবে না।
আবারও বিস্ময়ে হতবাক রাজেন। আলোলিকা দেবী আবার প্রশ্ন করেন--- কী? পছন্দ হল না? দ্যাখো, তুমি হয়তো জানো না, ,আমি কিন্তু ইচ্ছে করলে এখানে না এসে কলকাতায় বসে তোমার লেখাটাকে বাতিল করতে পারি। আমার বা আমার স্বামীর সেই ক্ষমতা আছে। কিন্তু আমি তা চাই না। তুমি লিখেছো, লোকে তোমার বই পড়েছে, পড়ছে। শুধু শুধু এই পুরস্কারের ঝামেলায় যেয়ো না। তোমাকে নানা প্রশ্নের মুখেও পড়তে হবে। সে সব প্রশ্নের সব উত্তর দিতেও তুমি পারবে না। এমনকি এ লেখা তুমি আদৌ  লিখেছো কিনা, এই নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। লোকে হাসাহাসি করতেও পারে।
--- কিন্তু কিনো মিডাম, আপুনকার কি স্বার্থ? মু তো আপুনকার কুনো ভালো করি লাই, মন্দও কুরি লাই। মু শুধু মুর পরিচয়টো চাই। যে পরিচয়টো আঁধারে হারিয়ে গিঞ্ছে, সেই পরিচয়টো চাই। আপুনি কিনো বাঁধা দিবেন? আপুনকার কুনো লিখা কি পুরস্কারের নমিনেশন পেইয়েছে? ইটাই কি আপুনকার স্বার্থ?
আলোলিকা দেবী নীরবে তাকিয়ে থাকেন রাজেনের দিকে। রাজেন আবার বলে---আমি তো পুরস্কার চাই না, মিডাম। আমি আমার পরিচয়টো চাই, শুধু পরিচয়। মানুষ জানুক, কি রাজেন বাউরি কে আছে।
--- তাতে তোমার কী লাভ? তার চেয়ে তুমি ভালো খাবে, ভালো পড়বে, আমি তার ব্যবস্থা করে দেবো। এসব কি ভালো নয়?
রাজেনের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন কোনো এক গোপন কথা বলে ওর কানে কানে। গোঁ ধরে বসে রাজেন--- না মিডাম। আমাকে জানতে হুবে, আপুনি কিনো ইমন প্রস্তাবটো দিলেন হামাকে।
--- আমি তোমাকে জানাতে পারি। কিন্তু তোমাকে কথা দিতে হবে, তুমি সাংবাদিকদের কাছে তোমার বাবার পরিচয় দেবে না। তুমি নিশ্চয়ই জানো, তোমার জন্মদাতা কে। অন্তত তোমার লেখা তাই বলে। কিন্তু আমাকে চেনো না। এবার বলো, রাজী?
রাজেন কি যেন কি ভেবে বলে--- হ, রাজী। বুলেন কেনে। পুরস্কার আমার চাই না। আপুনকে চিরটাকাল গড় কুইরে এসেছি। আমি রাজী।
এবারে বেশ সঙ্কোচ আর সলজ্জ স্বরে আলোলিকা জানান--- তাহলে শোনো, যে মানুষটা তোমার মায়ের সাথে অন্যায় করেছে, আমি তার স্ত্রী। তিনি একজন নামী লেখক। আর আজ তিনি রাজনীতির এক বিখ্যাত মানুষ। সে একজন গুনী মানুষ। অনেক কষ্টে এই জায়গায় সে উঠে এসেছে। একদিন একটা হঠাৎ করে ফেলা ভুলের জন্যে তার সর্বনাশ হওয়া তো উচিত নয়। বলো। আমি চাই না, তোমার জন্যে তার পোলিটিক্যাল কেরিয়ার নষ্ট হোক। তোমারও তো কোনো লাভ নেই তেমনটা করে।
এবার রাজেন হেসে দেয়। খ্যাতির শীর্ষে অধিষ্ঠিতা আলোলিকা রায়ের দিকে মিটি মিটি তাকায় রাজেন। অবশেষে বলে--- মিডাম, আপুনকার সহরের সম্মানটো আছে, আর মুদের এই পাহাড়ের সম্মানটো কি লাই? আপুনকার শহরের জীবনটো জীবন, আর মুদের গিরামের জীবন কি কুনো জীবন লয়? মু লিখাপরাটো কুরি লাই। কিন্তুক সাহিত্যটো তো লিখতে পারি। মু-ও অনেক কষ্টে ইঠানে এসেছি। পুরস্কারটো মু লি, কি না লি--- কিন্তুক মুর পরিচয়টো মু খুয়াইতে পাইরবোক লাই।
--- তাহলে তো তুমি কথা রাখলে না। তুমি তোমার বাবার পরিচয় সাংবাদিকদের কাছে বলবে। সেটা কিন্তু তোমার পক্ষে ভালো হবে না। আর এর জন্যে আমাকে কিন্তু দায়ী করো না। এটা আমি জানিয়ে দিলাম।
রাগে অপমানে দু-চোখ লাল করে রাজেন জানায়--- সুন্‌ কিনে সহরের সাহিত্যিক। মুকে টাকা দিখাস না। লুভ দিখাস না। ইটা জঙ্গল মহল। এখানে যে মানুষগুলান থাকে, উয়াদের মাঝে মাঝে বুনের হিংস্র পশু এইসে আঘাতটো কুরে, রক্ত ঝরায়। কিন্তুক এই জঙ্গলমহলের মানুষগুলান সেই জন্তুগুলানকে আঘাতটো কুরে লা। তাই মুর কুনো বাপ লাই। বাপের দরকারটোও লাই। মুর ইকটাই পরিচয়। মু লছমী বাউরির বিটা রাজেন বাউরি। কুন জন্তু আমার মা-টোকে আঘাত দিয়েছে, সেই পরিচয় লিয়ে বাঁচার শিক্ষা মুর মা-টো মু-কে দেয় লাই। তু যা কিনে সহরে। তুর সোয়ামিটোকে জানাইন দিস, উয়ার পরিচয়ের লেইগ্যে মু বেঁইচে লাই। মু মুর মায়ের লেইগ্যে বেঁইচে আছি। মু মুর মায়ের বিটা। মু শিল্পী। মুর সেই পরিচয়টো তুই লিতে লারবি।
কথাকটা বলে রাজেন কোদালটা আবার কাঁধে তুলে নেয়। হাঁটা দেয় কাজের দিকে।  

-----------------------------


কোন মন্তব্য নেই: