সোমবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১১

একদিন হঠাৎ



একদিন হঠাৎ

হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়

                                                            
মা
থায় হেনা লাগিয়ে ব’সেছিল মৈথেলি। আজকে উইক অফ। এই উইক অফ’টাতেই ও একটু রূপচর্চা করে। রূপচর্চা মানে একটু চুলের যত্ন, একটু মুখের ত্বক দেখাশুনো, একটু নখ শেপ করা। এমনিতে তো সময় হয় না। টেকনোপলিসের ব্যাক অফিসে আছে ও। বিরাট ওয়ার্ক লোড। শুধু অফিসে কাজ করলেই হয় না। ল্যাপটপ-এ বাড়িতে ব’সেও অনেক কাজ আপডেট করতে হয়। এদিকে বাড়িতে বাবা শয্যাশায়ী। জোর ক’রে কোম্পানি থেকে ভোলানটারি রিটায়ারমেনট ক’রিয়ে দেবার আঘাতটা মেনে নিতে না পারায় একটা সেরিব্রাল এ্যটাক বাবাকে বিছানায় ফেলে দিয়েছে। আজ মৈথেলির মাকে গোটা ভেতরটা আর ওকে বাইরেটা সামলাতে হয়। যে টাকা বাবা পেয়েছে, তা ব্যাঙ্কে ফিক্সড করলেও তো ভিক্ষা। তাই মৈথেলিকে বাবার অমত সত্বেও বাড়ি থেকে বেরোতে হয়েছে। ও অফিসে বেরিয়ে যায় সকাল সাতটায়। তারপর থেকে সে-ই মা। সংসার সামলায়, বাবাকে সামলায়, কিন্তু মুখে রা-টি কাটে না। মানুষ যে নিতান্ত আপনজনকেও শুশ্রূষা করতে করতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তা যেন মাকে দেখে বুঝতে পারে না মৈথেলি। ক্লান্ত হয়ে মেয়ে বাড়ি ফেরে, তাকেও দেখতে হয় সেই মাকেই। মৈথেলির কিছু করারও নেই। অনেকবার ভেবেছে, চাকরীটা ছেড়ে মার পাশে থাকবে। তবে মা একটু সঙ্গী পায়। মা-টা আর পারেনা এই বয়সে। কিন্তু ভয় হয়। এ্যাতোগুলো টাকা মাইনে! মার যদি কিছু হয়ে যায়, তবে অন্তত বাড়িতে কাজের লোক, নার্স বা অন্য কোন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখতে গেলে টাকা চাই। বাবার জমানো টাকাতে সারা জীবনটা চলবে না, চলতে পারে না। তাই বিয়ে-টিয়ে করার কথা ভাবতে পারে না মৈথেলি। একগাদা রূপ নিয়েও মৈথেলি আইবুড়ি। অবশ্য ওর হাবভাব দেখে কোন ছেলে ওর আইবুড়িত্ব ঘোচাতে ধারে-কাছে ঘেঁষে না। ঘেঁষাই সার হবে। ঘেঁষাঘেঁষি তো হবে না। হতে পারে না। বাবা বা মা ছেড়ে ওর পক্ষে চলে যাওয়া সম্ভব নয়।
মৈথেলি কালকেও রাত তিনটে পর্যন্ত ল্যাপটপ-এ কাজ করেছে। মনে মনে ভেবেছে, কাল তো উইক অফ। বেশ করে স্নান-টান করে খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে নেবে ঘণ্টা বারো। তাই-ই করে ও। কিন্তু---। ভাবলেই তো হয় না। ভাগ্য চাই। ঘুম তো হলই না, মাকে নিয়ে বেরোতে হোল। বাবা বলল,
--- যা না, মাকে একটু রেখেই আয় না। সারাটা দিন না হয় এখানে সাধনা থাকবে। অবশ্য না থাকলেও তেমন কিছু হবে না। রান্না তো করেই যাবি। আমি তো চলতে-টলতে পারি, না কি! ম্যানেজ করে নেবখন।
--- তুমি বেশি পাকামো করো না তো। চুপ করে চা-টা খাও। আমরা বড়রা বুঝবো, কী করতে হবে।
মেয়ের রসিকতায় বাবা চুপ করে। বাবার শরীরটা এমন খারাপ হওয়া ইস্তক মেয়ে এমনটাই বলে। এটুকুই তো জীবন। মেয়ে আর তার মায়ের সাথে একটু রঙ্গ-রসিকতা। এটা তো ছাড়া যায় না। মেয়ে-ও তাই শিখেছে। আমরা বড়রা মানে মেয়ে, ও নিজে, ওর মা আর কাজের লোক সাধনা। মাঝে মাঝে সাধনাকে বললে সন্ধে পর্যন্ত সে এ বাড়িতে কাটিয়ে দেয়। অন্তত টিভি-টা তো দেখতে পারে প্রান ঢেলে। সেই প্রস্তাব-টাই বাবা দিয়েছে। কিন্তু মেয়ে চুপ করিয়ে দিয়েছে। অবশ্য পরে সেই প্রস্তাব-টাই মানতে হোল ওদেরকে। তবে একটু অধিকন্তু চাপিয়ে নিয়ে। মা যে-কটা দিন বড়মামার বাড়িতে থাকবে, ততদিন দু-বেলাই খাবার আসবে হোম ডেলিভারি থেকে। আর সে-ই সাধনা অন্য কাজ সেরে-তেরে এ বাড়িতে সন্ধে পর্যন্ত কাটাবে। ওর খাওয়াটাও আসবে হোম ডেলিভারি থেকে। মৈথেলি ফিরে আসে সন্ধে সাত-টার মধ্যে। তখন সাধনা চলে যাবে। কটা মাত্র দিন। মা ফিরে এলেই সাধনা যেমন কাজ করে চলে যায়, তেমনই যাবে।
মাকে যেতেই হচ্ছে বড়মামার বাড়ি। বাবা-ই জোর করল। সত্যি-ই তো। যাওয়া তো উচিত। দিদুনের বয়স হয়েছে। তার ওপর এটা থার্ডবার এ্যাটাক। যদি সারভাইভ না করে? তবে মার মনে একটা খিঁচ সারা জীবনের জন্যে ধরে থাকবে। তাছাড়া একটা মানসিক উচাটন নিয়ে তো কাজও করা যায় না। নানা ভুল্ভাল হবে, চোখের জল ফেলবে, বাবা নিজেকে অপরাধী মনে করবে। তাই বাবা-ই বলল,
--- যা না। মাকে রেখে আয় না। তুই তো আছিস। কী আর হবে!
মৈথেলি জানে, মার বিরাট দুর্বলতা মার বাপের বাড়ি। সেখানে কারোর এ্যাতোটুকু কিছু হলে মা অস্থির দারুন হয়। বাবা-ও জানে। তাই এ্যাতো কথা বাবা বলছে।
মাথায় হেনা মেখে বসেছিল তো এসব জানার আগে। ল্যাপটপ ছিল লাপ-এ। ন-আঙুল চলছিলো ঝড়ের বেগে। কাল রাতে পুরোটা সারতে পারেনি। একটু বাকি ছিল। সেটাকে সবে কাজটা কমপ্লিট করেছে, বেজে উঠলো আমার রাত পোহালো---। এটা মৈথেলির রিং টোন। কানে ধরতেই বড়মামা।
--- মিতু, তোর মা কোথায় রে?
--- ক্যানো, বড়মামা?
--- আস্তে কথা বল। মা কোথায়?
--- মা তো কিচেনে। ক্যানো? বলো না।
--- আরে, বলবো বলেই তো ফোনটা করলাম। কিন্তু দিদিকে বলা যাবে না।
ফিসফিস করে মৈথেলি বলে--- কী হয়েছে গো, বড়মামা? দিদুন ক্যামন আছে? ভালো তো?
--- না। সকালে একটা এ্যাটাক হয়েছে। তাই তোকে জানালাম। তোর মাকে বললে তো জানিস---। তুই তো এখন বেরোবি অফিসে। ফেরার পথে একবার ঘুরে যাস। তা হলেই হবে। তোর মার কাছে দোষ কেটে যাবে।
--- না। আমার তো আজ উইক অফ। কিন্তু বড়মামা, মাকে আদৌ না বলাটা কী ভালো হবে? তার মা বলে কথা। তুমি তো জানো সবই। আমি দেখছি, কী করা যায়।
--- দ্যাখ, যেটা ভালো বুঝিস। কিন্তু সাবধানে।
--- দিদুন কোথায় এখন? নার্সিংহোম-এ কি?
--- হ্যাঁ।
--- তুমি ভেবো না। দেখছি, কোনটা সুবিধে হয়।
ফোনটা কেটে মনে মনে একটা গৎ আওড়ে নেয় মৈথেলি। মাকে কী বলবে, কেমন কায়দায় বলবে। এই কারণেই বাড়িতে গোটা সিস্টেম পালটে ফেলতে হোল। মা কিন্তু সব শুনে-টুনে তেমন কোন রি-এ্যাকশন দেখালো না। শুধু তার যাওয়া পাকা হতে একবার মেয়েকে বলল,
--- তুই অফিস সামলে এসব পারবি?
কিন্তু মেয়ের চোখ পাকানোতে মা-ও চুপ করে যায় বাবার মতো।



মা
কে নিয়ে বেরিয়েছে মৈথেলি। তিনটে বেজে গেলো। বাবার খাবার ব্যবস্থাটা করে বাবাকে খাইয়ে-দাইয়ে উঠেছিলো। কিন্তু সাধনা তো তার কাজকর্ম সেরে আসবে। ও না এলে যাওয়া চলে না। এমনকি ও রাজি না হলে আদৌ মার যাওয়া হতো না হয়তো। স্টেশনের কাছেই মৈথেলিদের বাড়ি। বড়মামার বাড়ি যেতে ট্রেন ধরতে হয়, শিয়ালদায় নেমে বাস। স্টপেজে নেমে মিনিট ছয়েক হেঁটে বড়মামার বাড়ি। ও অফিস যায় বাস-এ। সোজা এক বাসেই অফিস। নো ঝুট, নে ঝামেলা। এক ঘণ্টার জার্নি। বসার সীট-টীট জুটে যায়। টারমিনাস ওদের বাড়ির সামনেই। ফলে ট্রেনে ওঠা একটা বিরাট বিরক্তিকর ব্যাপার মনে করে মৈথেলি। সেই ভিড়, ঠেসাঠেসি, গাদাগাদি, গায়ের দুর্গন্ধ। এসব বালাই নেই ওর বাসে। যারাই বাসটায় ওঠে, তাদের পকেটে রেস্ত আছে। ভাড়া বেশি। শিয়ালদা থেকে বাস মানে লক্কর-ঝক্কর। চৌতিরিশ-এর বি--- না যেন কত! মাই গড! আজকে মারাই যাবে টেকনোপলিসের একজিকিউকিউটিভ ম্যাডাম মিত্র। মামার বাড়ির সামনে যে রাস্তা, সেটা তো দুঃস্বপ্নের মতো। দোকান-ফোকান কিছু নেই। শুধু গাদা গাদা হকার ফুটপাথ ফখল করে বসে আছে। প্লাস্টিক টাঙ্গিয়ে, উনুন জ্বালিয়ে, যমের মতো মাছ কাটার বঁটি খাড়া করে--- সে এক যা তা কাণ্ড। হাঁটার কোন কায়দা নেই। কোনরকমে শরীর একিঁয়ে-বেঁকিয়ে পেরোতে হবে পথটা। বড়মামারা ভাড়া থাকে। বাড়িটা প্রায় তিনশো বছরের পুরনো। দাদুর বাবা ভাড়া নিয়েছিলেন। ভাড়া ছিল তেরো টাকা। মালিক অনেক দয়া ভিক্ষা চাইবার পর আজ তা হয়েছে সাকুল্যে একশো বারো টাকা। আজকাল মালিক ভাড়া নিতে আসেওনা। তার তো গাড়ি ভাড়াও পোষাবে না। সাকুল্যে তিনটে ঘর। কিন্তু স্যাতলা পড়া ছাল ওঠা দেওয়াল, রহস্যময় কড়ি-বড়গার ছাদ। মনে হয়, জোবচারণক-এর আমলের কোন বাড়িতে এসে উঠেছি। কিন্তু যেতে হবে। একটাও কিল খেতে না চাইলেও কেউ যদি ধরে কিল মারে, তবে যে কটা মেরে পারে, তা খেতে হবে। কিচ্ছু করার নেই। আজ অন্তত বছর ঘুরে গেছে, বড়মামার বাড়িতে যায়নি মৈথেলি।
ট্যাক্সি নেয়ার ক্ষমতা নেই মৈথেলির, তা নয়। কিন্তু ফাঁকা লোকাল ট্রেনটা দাঁড়ানো দেখতে পেয়েই মনে হলো, টাকাটা বাঁচানো যাক। তাহলে মামার হাতে আরো কিছু বেশি টাকা দেওয়া যাবে। তাই টিকিটটা কেটে ট্রেনে উঠেছে। শুরুতে তেমন ভিড়-টিড় ছিল না। কিন্তু দুটো স্টেশন যেতে না যেতে পিল পিল করে মানুষ ছুটে এসে ট্রেনের দরজায় ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগলো। বেলা বাজে তিনটে। এ্যাতো বেলায় এরা সব যায়টা কোথায়! একটু বাড়িতে কি তিষ্ঠোতে পারে না! কী মানুষ রে বাবা! এদের সবার তো বিপদ ঘটেনি। দরজার সামনে একটা ফলওয়ালা তার ঝাঁকাটা ঘটের মতো বসিয়ে রেখেছে আর নিজে কয়েকটা ফল হাতে নিয়ে ভেতরে ডেমো দিতে গেছে। কীভাবে মানুষ উঠবে গাড়িতে! ওর মা না হয় ভেতরে ঢুকে গেছে। শিয়ালদায় নামতে কোন প্রবলেম হবে না। কিন্তু একটা জিনিস অবাক হয়ে দেখছে মৈথেলি--- কেউ তেমন ভ্রুক্ষেপ করছে না। কেউ কিছু বলছে না। তারপর শুরু হোল বাদাম, দাদ, হাঁজা, চুলকানি, লেবু লজেন্স, পেয়ারা, আপেল--- মানে হরেকরকম্বা। এবার এলো সারা গায়ে মোবাইল কভার থেকে শুরু করে সেফটিপিন পর্যন্ত ঝুলিয়ে বিক্রী। তার গা-এ কী আছে, আর কী নেই! তারপর তাদের গা জ্বালানো কণ্ঠে আর কায়দায় হকিং। একেকজন একেকরকম। কী বিরক্তিকর! এরপর একটা রুই-কাতলা-ট্যাংরা-তেলাপিয়া উঠলেই সোনায় সোহাগা। ষোলো কলা পূর্ণ হয়। গোটা বাজারটাকে ট্রেনে এনে তোলা যায়। সত্যি, একটা বিদেশীর কাছে এ দৃশ্য!--- কী লজ্জা! কী লজ্জা! ভাগ্যিস, এটা ঘোর গ্রীষ্মকাল নয়। যাত্রীরা তো একে অপরের গায়ে ডলাই-মলাই করতে করতে চলেছে। তাতে যদি ঘেমো হতো তো কথাই নেই। কিন্তু সবাই নির্বিকার! মৈথেলি হাঁ করে দ্যাখে, কী অদ্ভুত এ্যাড্যাপটেশন! কী টলারেন্স! সরকার করছেটা কী! এই কি ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম? বসে বসেই অস্থির হয়ে উঠছে ও। দাঁড়িয়ে থাকলে তো হয়তো মেরে-মুরেই দিতো।
কিন্তু মৈথেলির মায়ের কোন হেলদোল নেই। মা একটু চুপচাপ। মেয়ে সবটা খুলে না বললেও নানা চিন্তা হয়তো করছে। মা তার ছোট্ট গণ্ডির বাইরে ভাবতে জানে না। রাজনীতি, অর্থনীতি, বেকারী, গণহত্যা, দুর্নীতি, জঙ্গি--- কিছুই না। আজকে বোধহয় নিজের মাকে নিয়ে খুব ভাবছে। মা একটু বেশি ভাবে। সত্যিটা বুঝতে পারে না। আরে, তুমি তো  ডাক্তার নও। ভেবে-চিন্তে তো কোন স্টেপ নিতে পারবে না। ভাববে, ডাক্তার আর বড়মামা। তাছাড়া তোমার মা-এর বয়স হয়েছে। চলে যাবার বয়স থেকে বেশি। মেনে নাও। বড়মামীরও তো বয়স হয়েছে। সে বেচারি কি পারে এ্যাতো নার্সিং করতে!
শিয়ালদায় নামতে দেখলো, সেখানেও গিজ গিজ করছে হকার। গোটা প্লাটফর্ম-টা জুড়ে ওদের রাজত্ব। হাজার পসরা সাজিয়ে বসে আছে। সেই যে, আমার এ ছোট্ট ঝুড়ি, এতে রাম-রাবণ আছে---। মানুষ এমন করে ডাকছে যেন ওদের থেকে জিনিস-পত্র কিনতেই মানুষ বেরিয়েছে বাড়ি থেকে। ওদিকে স্টেশনে জন-সমুদ্র ঢুকছে-বেরুচ্ছে। মৈথেলিকে এসব পোয়াতে হয় না। ও যায় সেক্টর ফাইভ-এ। সেটা তো ঝাঁ চক-চকে করপোরেট পাড়া। ওর অফিস তো কথাই নেই। সরকারি লেভেলের আচ্ছা-আচ্ছা উছছ-পদস্থ কর্মচারীও ওই অফিসে কোন কাজে ঢুকতে দু-বার ভাববে।
কিন্তু রবিঠাকুর বলেছেন, আজি সবার রঙে রঙ মেলাতে হবে। তার মানে, যাত্রীদের সাথে রং-মেলান্তি করতে করতে, গা ঘষতে ঘষতে অগত্যা মা-কে নিয়ে বেরলো স্টেশন থেকে। সামনেই এবার বাস। সেটা ততটা জ্বালালো না। স্টপেজে নেমে সেই কুখ্যাত রাস্তা। এখানে-ওখানে ছড়ানো শালপাতা, পলিথিন, মাছের আঁশ, ফলের আর তরকারির খোসা-ভুতি গড়াগড়ি খাচ্ছে। সেসব ডিঙিয়ে-পেরিয়ে যেতে হবে। ফলে সালোয়ারটা খানিক তুলে নিয়ে ঘিন ঘিন করা গা সামলাতে সামলাতে নিজেকে কন্ট্রোল কন্ট্রোললতে বলতে যখন পৌঁছল বড়মামার বাড়িতে, তখন বিকেল পাঁচটা। সস্তায় জার্নির তিন অবস্থা। বড়মামা, ভাই, পঞ্ছুমামারা সব গেছে নার্সিং হোম-এ। এখন সেখানে যাবার কোন মানেই হয় না। নার্সিংহোমটা কাছাকাছি নয়। তাছাড়া চেনাও নয়। থাক, এখানেই ডিটেল জেনে নেওয়া যাবেখন। মা বলল,
--- তুই কিন্তু এখনই চলে যাস না, মিতু। একটু বসে যা।
--- ক্যানো গো?
--- মামারা ফিরুক আগে। অন্তত জেনে যা, দিদুন কেমন আছে।
সেটা তেমন জরুরি নয়। তবুও মনে মনে ভেবে নেয় মৈথেলি--- কত আর রাত হবে! সাত-টা, বা আট-টা। বসাটা ভদ্রতা। টা নয়তো বাবা-ও জানতে চাইবে তার শাশুড়ির খবর। তাই মাকে বলল--- সে তো বটেই। এ্যাতোদূর এলাম ক্যানো?
ল্যাপটপটা তাড়াহুড়োয় আনেনি সাথে। আনলে বসে কিছু কাজ এ্যাডভান্স করে নেওয়া যেতো। ঘুম তো কলা হলনা। শরীর-টা বেশ ঝুঁকে আসছে। ক্লান্ত লাগছে। মোটে ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়েছে রাতে। এতে কি হয়! তাই বড়মামীকে বলে নিজেই চা বানালো, সকলকে দিলো, আর ফ্লাস্কে রেখে নিজে নিলো। যদি ম্যাজমেজে ভাবটা যায়। সোফায় বসে দেখলো, তলাকার তাকে একটা লেডিস ম্যাগাজিন রয়েছে। সেটা উল্টে-পাল্টে দেখে ঝিমুনি ভাবটা কাটাতে চাইলো মৈথেলি।




খান থেকে বেরোতে সেই বেজে গেল সাড়ে সাতটা। ভাই বলল--- চল দিভাই, তোকে এগিয়ে দিয়ে আসি।
--- না না, তুই বাড়িতে থাক। বড়মামী তো দিদুনকে দ্যাখে। তুই একটু তোর মাকে দ্যাখ। মা কিন্তু ভেঙ্গে পরবে। আমি বেরিয়ে যাবো ঠিক। আমি তো একাই চলি রে, বাবা।
বেরিয়ে পড়ে শেষে মৈথেলি। কিন্তু রাস্তায় এসে দ্যাখে, একি! গোটা রাস্তা শুনশান। কোন হকার-ফকার কোথাও নেই। সব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। এ্যাতো সকাল সকাল সব গেলো কোথায়! ওদের বিক্রী-বাটা কি মিতে গেলো! এটা কি সম্ভব! তাহলে কি হল্লাগাড়ি আসবে বলে কোন খবর আসতে সব কেটে পড়েছে? ওদের সাথে তো পুলিশের একটা আঁতাত থাকে। আগে থাকতে এসব খবর এসে যায়। ওরাই ভক্ষক, আবার ওরাই তো রক্ষক এদের। সর্বনাশ! এ তো কেউ কোথাও নেই! একটা দমকা হাওয়া যেমন রাস্তায় পড়ে থাকা কাগজের টুকরোগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে যায়, ত্যামন করে এদেরকে কোথায় নির্বাসন দিয়ে এসেছে! এর আগেও তো এখানে এসেছে ও। রাত অন্তত সাড়ে নটা অবধি তো রাস্তাটায় লোকারণ্য থাকে। অবাঞ্ছিত স্পর্শ বাঁচাতে হেলে, গা বেঁকিয়ে-চুরিয়ে পার হতে হয়। তা নয়তো যেখানে সেখানে পা পড়ে যাবে, যার-তার গায়ে ধাক্কা লাগবে। কিন্তু এ তো ভালো জ্বালা হোল। এতো রাত দুটোর রাস্তা! ঈশ্বর যেন ওর প্রার্থনা শুনে একটা পরিষ্কার রাস্তা ওকে উপহার দিয়েছেন। এবারে তো নো ঝুট, নো ঝামেলা। কিন্তু বেশ ভয় ভয় করছে তো! অচেনা অজানা জায়গা। তাই একবার মনে মনে ভাবল মৈথেলি, তাহলে ফিরে গিয়ে ভাইকে সাথে নিয়ে আসবে। ও যদি বাসে তুলে দিয়ে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই নারীত্বে লাগলো ওর। ক্যানো? একজন পুরুষকে এভাবে অবলম্বন করতে হবে ক্যানো? ভাই হলেও ও তো পুরুষ বৈ অন্য কিছু নয়। যদি দুম করে কোন অবাঞ্ছিত মন্তব্য করে বসে? থাক। কী আর হবে! একবার পেছনে তাকিয়ে ফেলে আসা রাস্তাটা দেখে নিয়ে একটু সাহসিনীর মতো পা দাবড়ে-দাবড়ে এগিয়ে চলল মৈথেলি। একটু এগিয়েই মনে হোল, কেউ বাঁ কারা যেন ফলো করছে। একটু ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখে নিলো। হ্যাঁ, পেছনে আসছে দুটো লোক। চুপচাপ। সন্দেহজনক নয়, আবার সন্দেহজনক। একটু ভেবে মৈথেলি হাঁটা-টা একটু আস্তে করে দিলো। ওমা! লোকগুলোও তো ওদের গতি আস্তে করেছে! কী কেস? এবারে সাহসে ভর করে সোজা পেছন তাকায় মৈথেলি। মা বলে, ভয় পেলে নাকি এসব হয়। আসলে কেউ নেই, কিন্তু কেউ আছে বলে মনে হয়। কিন্তু কৈ? কেউ তো নেই! খেয়েছে! ভূত-টুত নাকি রে বাবা! বেমালুম উবে গেলো লোকদুটো! এখানে তো কোন গলি-ঘুজি নেই যে, ঢুকে পড়বে।
ভূত কখনও দ্যাখেনি মৈথেলি। কিন্তু এ দেশের মেয়ে ভূত মানে না, মানে, সে মেয়ে নয়। তাকে বলা হয়--- এ মেয়ে তো মেয়ে নয়, দেবতা নিশ্চয়। ফের হাঁটতে গিয়ে গতি-টা বেশ বারিয়ে নিলো মৈথেলি। হঠাৎই ও আবিষ্কার করলো যে, ওরা দুজন নয়। এবারে চারজন জোরপায়ে ওকে ফলো করছে। মৈথেলি জানে, ওরা ওর থেকে কিছু নিতে পারবে না। ও সোনা-ফোনা পরে না। আর ব্যাগ-এ ত্যামন কিছু নেই। অনেকাটাই মাকে দিয়ে এসেছে বড়মামার হাতে দেবে বলে। অন্তত মা তো বড় বোন। তাই আর কোন চান্স না দিয়ে, সময় নষ্ট না করে এবারে দে ছুট। ওই তো বাস স্টপেজ। ওখানে তো লোকজন থাকবে নিশ্চয়ই। দেখলো, হ্যাঁ, আছে। একটা বাসও দাঁড়িয়ে আছে। ওদেরই বাস। ধাঁ করে বাসে উঠে তবে নিশ্বাস নিলো মৈথেলি। যাক বাঁচা গেলো। ম বলল, না, তাহলে গোটাটা মনেরই ভুল। ওরা হয়তো নীরিহ মানুষ। বেকার ভয় পাচ্ছিলো।
শিয়ালদা স্টেশনে এসে দেখলো, আর একটা বিস্ময় ওর জন্যে অপেক্ষা করছিলো। গোটা শিয়ালদা চত্বর-টা খা খা। কোন হকার নেই। চাকরীর ফর্মওয়ালা থকে শুরু করে লেবুওলা পর্যন্ত। কেউ নেই। হোলটা কী! প্লাটফর্ম-এর বাইরে নেই, ভেতরে নেই। সিগারেট-বিড়ি তো আগেই উঠেছে। সাজানো-গোছানো একটাও দোকান, এমনকি হুইলারসগুলো পর্যন্ত নেই। এই তো যাবার সময় দেখে গেলো। এর মধ্যে সব গেলো কোথায়! না হয় নতুন সরকার এসেছে। নানা ম্যাজিক করছে রোজ। করুক। কিন্তু এটা কী! দেশ কি পাল্টে যাচ্ছে দ্রুত? কলকাতাকে তিলোত্তমা করতে সরকার হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। কিন্তু এটা কি সম্ভব! এ্যাত দ্রুত! চারদিকে যদি এরকম নৈশব্দ থাকে, তবে তো মহা মুশকিল। না, প্যাসেঞ্জার আছে। তারা নানা ট্রেনে রোজকার মতো উঠছে-নামছে। সেখানে কোন গণ্ডগোল নেই। তবে আজকে ভিড় বেশ বে-এ-শ পাতলা। হঠাৎ মনে পড়লো, ওহো! আজ তো ঈদ ছিল। জেনারেল বাঁ সরকারি ছুটিগুলো মৈথেলিরা ভোগ করতে পারে না বলে মনেও থাকে না, কবে কোন কমন হলিডে। ওদের তো তা নেই। প্লাটফর্ম খুঁজে দেখলো যে, ওর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। শিডিউল টাইম জানে না ও। জানবার-ই বা কী দরকার! ছাড়বে তো বটে। এবারে তো নিশ্ছিন্ত! কিন্তু ট্রেনের মধ্যেও এলো আতঙ্ক। একেই ভীষণরকম পাতলা প্যাসেঞ্জার, আর তার ওপর আজকে তো একটাও হকার-টকার নেই। নো লেবু লজেন্স, নো হরেকরকম পাঁজি-পুঁথি, নো বাদাম, নো সেদ্ধ ডিম। কী কেস রে বাবা! সব গেলো কোথায়? ও লেডিস-এ ওঠেনি। লেডিস কামরা কোথায় পড়ে, জানেও না মৈথেলি। আজকে অত খোঁজাও যাবে না। গোটা চার নম্বর প্লাটফর্ম-টা ঘুমন্ত সাপের মতো একটু বেঁকে শুয়ে আছে। আরও আগে এগিয়ে যাওয়া যেতো। কিন্তু ক্যামন যেন অন্ধকার অন্ধকার! বড্ড নির্জন, বড্ড একা একা। একটা নিরাপত্তাহীনতা গ্রাস করছিল ওকে। কবে যেন কে বলেছিল, লেডিস কামরায় কোনোদিন ভুলেও উঠবি না। সব অসভ্য মহিলা উঠে বেজায় ঝামেলা করতে করতে যায়। মুখ খারাপ করে। তাছাড়া আজ যদি জেনারেল-এর এমন হাল হয়, তবে সেখানে তো একটাও মহিলা পাওয়া যাবে না। থাক, বাবা। দরকার নেই মহিলা সঙ্গ করার। পুরুষেরা অতটা অসভ্য হয়ে পারেনি এখনও।
কিন্তু ট্রেন যখন ছাড়ল, তখন কামরায় সর্বসাকুল্যে গোটা দশেক যাত্রী। ট্রেন-টা ছাড়তে না ছাড়তে-ই গেতের মুখে দাঁড় করানো লোহার রড-টা দক্ষ হাতে ধরে কামরাটায় উঠে পড়লো চারটে লোক। মৈথেলির মনে হোল, এরাই যেন রাস্তার সেই চারটে লোক। ওকে ফলো করতে করতে ট্রেন অবধি এসে উঠেছে। ওই রাস্তায় আলো ছিল বটে। কিন্তু তা সেই কভার দেওয়া টিউব লাইট। তাতে পোকা আটকে পড়ে পড়ে আর মরে মরে তা তো অন্ধকার। অন্ধকারে তো লোক চারটের মুখ দেখতে ভালো দেখতে পায়নি মৈথেলি। এসব নিশ্চয়ই রাজনৈতিক গুন্ডা নয়। রাজনীতি তো ও করে না। ওদের অফিসে তো কোন ইউনিয়ন-ফিউনিওন নেই। তাহলে শত্রুতা-টা কী? ওকে ফলো কেন? ট্রেন ছাড়তেই লোকদুটো হঠাৎ তাদের মাজা থেকে আগ্নেয়াস্ত্র বের করলো। বেশ পরিষ্কার হওয়া গেল যে, ওরা ডাকাত। ঘড়ি, চেন, মানিব্যাগ, মোবাইল, আংটি, কেড়ে নিতে এসেছে। যেভাবে কলকাতায় হকার তুলে শহর-টাকে তিলোত্তমা বানানো চলছে, তাতে তো লোক এই ব্যবসা ধরবেই। আজকে এমনটাই প্রথম মনে হয় মৈথেলির। ও ভাবে, তা নয় তো ওদের স্ত্রী-সন্তান খাবে কী? যে কটা পুরুষ কামরাটায় বসেছিল, সব চুপচাপ। কোনো রা টি নেই মুখে। মৈথেলির হাসি পেলো, এরা সব নাকি পুরুষমানুষ। বাড়িতে গিয়ে বউ-এর ওপরে পৌরুষ দেখায়। এখন দ্যাখো, যেন ভ্যাদা মাছ। ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানে না। এর মধ্যে একটা লোক মৈথেলির কাছে এসে কোন কথা না বলে প্রায় বুকে হাত দেবার মতো করে হাড় বারিয়ে ওর গলার চেন-টা ধরল।
--- এটা খুলে দেবেন, না টেনে নেবো?
কাঁপতে কাঁপতে ও বলল--- এটা……… না……… ইমিটেসন………। আমি……… সোনা……… পরি না।
--- কেন সোনা পরিস না, শালী?
লে এবারে ওর যত্নে ক্রীম মাখা, ফেসিয়াল করা তুলতুলে গালে পড়লো লোকটার হাতে মারা ঠাস শব্দ করা একটা চড়।



ব্য
স। চড় খেয়ে একটা ঝটকায় চোখ তাকিয়ে দেখলো মৈথেলি, সামনে ওর মামাতো ভাই দাঁড়িয়ে।
--- দিভাই, তুই খুব ক্লান্ত, না? পত্রিকা-টা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলি। ঠাম্মা একটু বেটার রে। তুই এবারে বেরিয়ে যা। বাড়িতে তো পিশেমশাই আছেন। তোকে তো যেতেই হবে। আর রাত করিস না। সাড়ে সাত-টা বাজে। আমি তোর জন্যেই ছুটতে ছুটতে আসছি। আমি তো জানি, তুই খবরটা জেনেই যাবি। চল, তোকে এগিয়ে দিই।
--- থাক। তোরা ক্লান্ত না? আমি পারবো। তোর দিভাই কি লবঙ্গ লতিকা নাকি?
ভাই-কে থামিয়ে দিয়ে এবারে মা-কে ডেকে মার হাতে বেশ কিছু টাকা দিয়ে, নিজের চোখেমুখে জলের ঝাঁপটা মেরে বেরিয়ে পড়ে মৈথেলি। বেরবার সময় কাকে উদ্দেশ করে যেন প্রনাম-ও করে নেয় একবার। রাস্তায় এসে দেখল, নাঃ, সব ঠিকই তো আছে। চারদিক আলো ঝলমল। লোহার রডে বাল্ব ঝুলিয়ে কত হকার নানা জিনিস বিক্রী করছে। জমজমাট গোটা রাস্তা। দুটো লোক বসে দারুন দারুন পারশে মাছ বেচছে। রূপোলি ঝকঝকে মরা মাছ। কিন্তু দেখতে জ্যান্ত জ্যান্ত। পারশে মাছগুলো যেন মৈথেলিকে ডেকে বলল, এই মেয়েটা, ভেলভেলেটা / ঝোল খাবি? তো মাছ নিয়ে যা। পারশে মাছ প্রিয় মৈথেলির। মনটাও দিব্যি ফুরফুরে লাগছে। তাই কোনো অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবেই আড়াই শো টাকা দরে কিনে নিলো হাফ কেজি। গোটা রাস্তা-টা যেন নাম-না-জানা উৎসবে মেতেছে। কত দোকান! কত হকার! এখানে কে কাকে ফলো করবে! কার বাবার সাধ্য! এ্যাতগুলো মানুষ আছে না! মেরে তক্তা খসিয়ে দেবে। মাছওয়ালাকে বলল--- বড়ভাই, একটু ভালো করে প্যাক করে করবেন? আমি তো ট্রেনে অনেকটা যাবো। কেউ গালাগাল না করে।
--- কোনো চিন্তা দিভাই। আজি কেটে সাইজ করে দারুন করে দিচ্ছি। আপনি মনেও রাখতে পারবেন না, প্যাকেটে মাছ, না আপেল।
--- আপনি আবার কাটবেন? আপনার তো অনেকটা সময় নষ্ট হবে, ভাই।
--- আপনি দিদি, বোধহয় বাজার-টাজার জান না, না? এটা আমাদের করতেই হবে। আমাদের কে শুনবে, বলুন?
মাছ-টা প্যাক করে নিয়ে হাঁটা দিলো মৈথেলি। গুনগুন করে গানও ধরল, আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ, সুরের বান্ধনে….. এবারে ছ-খানা হ্যান্ড-রুমাল কিনলো ফুট থেকে। বেশ ভালো। দোকানে কিনলে অনেক দাম নিত। স্টেশনে এসে স্টেশন-এ এসে দেখলো, নাঃ, কলকাতা আছে কলকাতাতেই। কোথাও কোনো চেঞ্জ নেই, কোনো নতুন আইন নেই, কোনো সর্বনাশ ঘটেনি কোথাও। ঠাণ্ডা মাথায় টিকেট-টা কাটল মৈথেলি। ভিড়ে ভিড়াককার শিয়ালদা স্টেশন। প্ল্যাটফর্ম চেঁচামেচি-তে পরিপূর্ণ। চিৎকার চেঁচামেচি ব্যস্ততা / এই নিয়ে হোলো কলকাতা…….। ট্রেনে উঠে আরামে নিশ্চিন্তে চোখ-টা বুজে নিলো মৈথেলি। না, ঘুম আসছে না। বড় আরাম লাগছে। মন গাইছে, বড় বিস্ময় লাগে……. আজকে প্রথম রাস্তায় বেরিয়ে বড় আনন্দ লাগছে ওর। কোথাও কোনো বিপদ নেই, খেদ নেই, ক্ষোভ নেই, রাগ নেই, ঘেন্না নেই, ছুৎমার্গ নেই। চারদিকে মানুষ আছে। অনেক অনেক মানুষ। তারাই তো ভরসা। তারাই তো পানের থেকে চুন খসলে ছুটে আসবে। এতাই তো আমাদের চেনা শহর। আমাদের তিলোত্তমা। মনে পড়ে, টেলিভিসন-এ রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম রাদিস বলছিলেন যে, কলকাতা নাকি বড় নিরাপদ শহর। এমনটা নাকি লন্ডন-এ সম্ভব নয়। কে জানে বাবা!
হঠাৎ কানে আসে, ছোলে! এ সেদ্ধ ছোলে! মশলা ছোলে!
চোখ তাকায় মৈথেলি। একটা বাচ্চা ছেলে রাত নটায় একটা ঝুড়িতে লাল কাপড় দিয়ে আবৃত করে সেদ্ধ ছোলা বেচছে। কাপড়ের ওপর সাজিয়ে রেখেছে অর্ধেক করে কাটা পাতিলেবু। এই মশলা ছোলা ছোটবেলা খেতো মৈথেইলি। আজ দেখে নোলা-টা সপ সপ করে উথলো। বড় হয়ে অবধি এসব তো খাওয়াই হয় না।
--- আমাকে চার টাকার দেতো, বাবা। ফাইন করে দিবি কিন্তু। লেবু দিবি না।
এ্যাতো রাতে কোনো দিদিমনি ছোলা কিনবে--- এমনটা ছেলে-টার অভিজ্ঞতায় নেই। তাই খুব মন দিয়ে ঝালনুন-টুন দিয়ে লোভনীয় মিক্সচার বানালো। একটু মুখে দিয়ে মৈথেলি বলল--- দারুন বানিয়েছিস। তোর নাম কী রে?
--- মনটু।
--- কোথায় থাকিস তুই?
--- আগরপারায়। রেলবস্তিতে।
--- শোন, এরপর থেকে লেবুগুলো না, কেটে কেটে রাখবি না। বিষ হয়ে যাবে। বুঝলি?
ছেলেটা মাথা নেড়ে সায় দিতেই ওকে টাকা দেয় টেকনোপলিসের এক্সিকিউটিভ মিস মিত্র। আর এই প্রথম ওরকম একটা নোংরা ছেলের চিবুক নিজের পাঁচ আঙ্গুলের মাথা দিয়ে ছুঁয়ে নিজের ঠোঁটে ছোঁয়াতে গিয়েও ছোঁয়াল না মৈথেলি। বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। সবাই দেখছে।





















মঙ্গলবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১১

'মাদারি' ছোটগল্প


 


মাদারি
এখানে পরশু এসেছি আমরা/ কাছেই একটা ফ্লাট বাড়ি গড়ে উঠছে/ নাম 'শ্যামলী এপার্টমেন্ট'/ এখানেই একটা ফ্লাট কিনব বলেই অলরেডি বুকিং করেছি/ কিন্তু প্রমোটার-এর হাতে ছেড়ে দিলে তো চলে না/ নিজেকে দেখাশুনো করে নিতে হয়/ তাছাড়া ডিজাইনিং-এর ব্যাপার আছে/ কোথায় কী কেমন হবে/ কিচেন, বৈঠাকখানা বা বারান্দা/ ভেতরের রং- বা কী হবে/ সুমু, মানে আমার পাঁচ বছরের যে ছেলে, তার মা' এসব ব্যাপারে দারুন খুঁতখুঁতে স্বভাব/ তাই ভাড়া নিয়েছি ফ্লাট-এর কাছেই একটা বাড়ি/ এখানে বছর দশেক আগে একবার এসেছিলাম একটা নিমন্ত্রণে/ এসেই জায়গাটা পছন্দ হয়ে গিয়েছিল/ তাই বসবাসের এই সিদ্ধান্ত/ এসেছি যখন, এখানকার বাজার-হাট, মুদিখানা, মনোহারী দোকান--- এসব চিনে নিতে তো হবেই/ কিছুই চেনা হয়নি/ এমনকি সুমু' স্কুল পর্যন্ত ঠিক হয়নি/ গোছগাছ করতে করতেই সময় চলে যাচ্ছে/ রং মিলিয়ে নতুন পর্দা কেনা, নতুন নতুন আসবাবপত্র...... আরও কত কি! ফ্লাটে নাকি এসব করতে হয়/ তা নয়তো মান থাকে না/ তাই ফাঁক পেলেই একটু ঘরে চিনে নিই এটা-ওটা/ তবে ছেলে' স্কুল নিয়ে কোনো চিন্তা নেই, কেননা সে পারে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে/ সেখানে তো টাকা- ব্যাপার/ টাকা ধরো, ছাত্র ভরো/ ছেলে সুমু কদিন ধরে বায়না করছিল একটা ভিডিও গেমস-এর জন্য/বায়না ঠিক নয়, ওর ওমা- ওকে দেবে বলে কমিট করেছে/ সর্ত ছিল, সুমু- লাস্ট পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে হবে/ হয়েছে/ দেবে বাবা, কমিট করে মা/ ওই যে বাচ্চাদের ছড়াটা--- ফাথার আর্নস মানি, মাথার স্পেন্দস মানি/ মা তার জীবনে কোনকালে ভালো ফল না করুক, ছেলেকে তা করতেই হবে/ মেরে ধরে বানাতে হবে/ তা নয়তো মান থাকে না/ তাই ভিডিও গেমস/
বেরিয়েছি/ দেখলাম, দশ বছর আগের দিন শেষ/ দ্রুত সব পাল্টে যাচ্ছে/ এখানে যেমনটা দেখে গিয়েছিলাম, তেমনটা আর নেই/ একটা আধা শহর-শহর ভাব ছিল/ এবারে এসে দেখি, ইট-কাঠ-পাথরের অরন্য হতে চলেছে/ আমিও তো তেমন- একটা আশ্রয় খুঁজছি/ অনেকগুলো ফ্লাট বাড়ি স্কাই রাইজের মতো দাম্ভিক মাথা তুলেছে/ আর ফ্লাট না হওয়া বাড়িগুলোকে সূর্যের আলো থেকে শুধু বঞ্চিতই করছে না, তাদেরকে দুয়ো দিচ্ছে/ ছাড়া শপিং মল, নানা স্বদেশী-বিদেশী কোম্পানি- জুতো, জামা-কাপড়ের শোরুম, রিবোক, আদিদাস, কস্টলি জুএলারী শোরুম, মোবাইল শপ, ঘড়ির শোরুম ...... আরো কত কি! সব ঝপাঝপ গড়ে উঠছে/ মানুষ তাই হামলে পড়ছে এখানে ছশ-সাতশ স্কয়ার ফিট কিনবে বলে/ আমিও তাদের মধ্যে পরি বটে/ ফ্লাই ওভার-টোভার দিয়ে একেবারে রীতিমত পশ এলাকা/ আমি উন্নতি পছন্দ করি/ যদি থার্ড ওয়ার্ল্ড দেশগুলোর উন্নতির মতো উন্নতি বা অগ্রগতি বলতে শহর শিল্প সভ্যতা বোঝায়, তবে আমি তা ভালবাসি/ রিটায়ার করে কোনো প্রত্যন্ত গ্রামে নির্জনে বসবাসের কোনো অভিপ্রায় আমার নেই/ আই ওয়ান্ট ফেসীলিটিস এন্ড আভেলেবিলিটিস/ কিন্তু পরিবর্তন বা অগ্রগতি যে আমাকে এভাবে আঘাত করবে, তা ভাবিনি/

যাইহোক, ছেলেকে নিয়ে বেরিয়েছি একটা ভালো দোকানের খোঁজে/ মহার্ঘ ভিডিও গেমস কিনতে হবে, মাযের সম্মান রাখতে হবে/ পেয়ে যাব/ যথেষ্ট বড় বড় দোকান রয়েছে এখানে/ পেয়েও গেছি/ ছেলে খুশি ভিডিও গেমস পেয়ে/ মনে মনে ভাবি, এসব মহার্ঘ তো আমরা পাইনি/ বাবা-কে দিয়ে ঘুরি-লাটাই কেনাতে পারিনি আমার ছোটবেলাতে/ লাট্টু কেনাতে পারিনি/ বেলুন বা আতসবাজি পর্যন্ত কেনাতে পারিনি/ এসব কোনটাই নাকি ভদ্রলোকের ছেলে-মেয়েদের কেনা উচিত নয়/ তখন তো বয়স কচি/ তাই বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে পারিনি, 'ভদ্রলোকের লক্ষনটা কী, বাবা? এসব না কেনা? না, যারা এসব কিনছে, তারা অভদ্র বলেই কিনছে? আমাদের পাড়াতেই বিরাট বড়লোক উকিলবাবু' ছেলে দিব্যি ঘুরি ওরায় বিশ্বকর্মা পুজোতে, কালী পুজোতে বাজি পড়ায়/ তাহলে.....? তারা কি সব......?' না, জিজ্ঞাসা করিনি কথা/ সে সাহস হয়নি/ মেনে নিয়েছি/ বাধ্য হয়েছি মেনে নিতে/
কিন্তু না, আমি পাইনি বলে ছেলেকে পকেট ভরিয়ে সব দেব, আমি যা পাইনি, তা ওকে পেতে হবেই--- এমন কোনো কমিটমেন্ট আমি করিওনি বা করিওনা/ তাই পকেট খসিয়ে বউ-এর মান রেখেছি/
দোকান থেকে বেরিয়ে মনে পড়ল, ছেলের মা বলেছিল দশ টাকার ফুল কিনে আনতে/ পুজোর ফুল/ কুচো ফুল, বেলপাতা, তুলসীপাতা, আমের পল্লব, দুর্বা ইত্যাদি/ কোথায় পাই? কোথায় পাই--- করতে করতে পেয়ে গেলlম ফুটে বসা একটা বুড়োকে/ সে ফুল নিয়ে বসেছে/ কিন্তু বুড়োটার কাছে ফুলের অর্ডার দিতে গিয়ে আমি তো / মন বলছে, একে যেন আমি চিনি? মনে হচ্ছে, যেন চিনি চিনি/ কিন্তু কেমন করে চিনি, এটাই মনে আসছে না/ স্মৃতির সাথে বাস্তব চিত্রটাকে মেলাতে পারছি না/ ততক্ষনে কেক্জন খদ্দর ফুল নিয়ে চলেও গেল/ অবশেষে সুমু বলল,
--- বাপি, ফুল নাও/ বাড়ি গিয়ে ভিডিও গেমস খেলতে হবে না?
সাথে সাথে বুড়োটাও বলল--- কিতনা চাহিয়ে বাবুজি?
আমি কেমন অন্যমনস্ক/ এই সময় হঠাত পাশের একটা গলি থেকে সাইকেলে একটা লোক একটা ডুগডুগি বাজিয়ে বাজিয়ে বেরিয়ে এলো/ তার সাইকেলের দুপাশে রেখেছে  চট দিয়ে বানানো বিরাট বিরাট দুটো ব্যাগের মতো খাপ/ সে ডুগডুগি বাজাচ্ছে, আর মুখে চেচিয়ে বলছে,
--- পুরানো ভাঙ্গা লোহা, কাগজ বিক্রি---!
ব্যাস, ম্যাজিক/ আমি ফুলঅলাকে চিনে গেলাম/ যেইমাত্র ডুগডুগি শুনলাম, গত অতীত কlলটা আমার সামনে বর্তমান কাল হয়ে  উঠলো/ ফুলওয়ালা আর কেউ নয়, স্বয়ং আফজল মিয়া/ কিন্তু মুসলমান হয়ে হিন্দুদের পুজোর ফুল বেচছে! বিরল দৃশ্য/ মনে মনে বললাম, 'সাবাস পেট, তুমি তো অন্তত দুটো যুযুধান গোষ্ঠীকে খাবারের কারণে মিলিয়ে দিয়েছ/' কিন্তু আফজল মিয়া ফুল বেচছে কেন? তাহলে বাদশা-বেগম কই? ওহ! মনে পড়ল, এতদিনে তাদের তো মরে যাবার বয়স হয়েছে/ তারা তো আর আমাদের মত আশি-একশ বছর বাঁচে না/ সাকুল্যে তিরিশ, কি চল্লিশ হবে হয়তো/ আমি না বলে পারলাম না,
--- তুমি আফজল মিয়া না?
নিজের মুখে আঙ্গুল দিল আফজল--- সlব, চুপ যাইয়ে/ মেহেরবানী করকে চুপ যাইয়ে/ কই সুন না লে/ মুসলমান হোকে ফুল বেচ রহা হু/ তো গলত হয় না? বলে আফজল মিয়া আমার পায়ে হাত দিতে গেল/
আমি তিন হাত সরে গিয়ে আস্তে বললাম--- তুমি আফজল মিয়া তো?
একটা সাদা ঘোলাটে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল লোকটা--- আপ কইসে পেহ্চান্তে হ্যায় হামকো, বাবু
--- আগে তুমি বলো/
মাথা নেড়ে মনে নিল সে/ আবার বললাম--- তুমি মাদারী না? বান্দর খেলা দেখাতে না? বাদশা-বেগম?
বুড়োটা তেমনি ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে আমার দিকে। কোন উত্তর নেই। সেই চোখে বিস্ময়, না ভয়--- আমি বুঝতে পারলাম না। আমি আবার বললাম,
--- তুমি আমাকে চেন না। আমি বাদশা-বেগমের খেলা কত দেখেছি! থাকতাম শ্যামনগরে। তিমি সেখানে বাঁদর খেলা দেখাতে আসতে। তখন আমি এতটুকু। বলে আমি সুমুকে দেখিয়ে দিলাম। এটাও বললাম---এটা কিন্তু আমার ছেলে।
একগাল হেসে আফজল বলল--- বহুত খুব। তবতো আপনি হামার বেটা-বেটির খেল্‌ দেখিয়েছেন। আমি মাথা নাড়তে বলল--- ক্যা বাত! ক্যা বাত!
আমি ভাবলাম, আফজল মিয়াঁ বাদশা -বেগমকে বেটা-বেটি বলছে কেন। সে তো দুটো বাঁদর আর বাঁদরী। তাই বললাম--- না, তোমার বেটা-বেটি নয়। বাদশা-বেগম।
--- বহি তো। ও দোনো তো হামার বেটা বেটি ছিল, খোকাবাবু। হামাকে রেখে চলিয়ে গিলো। বলে নিজের কাপড়ের খুটে চোখ মুছল আফজল। যেন কোন আপনজন কেউ চলে গেছে। আমার ছেলে বিস্মিত। আমার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বলল,
--- বাপি, তোমাকে লোকটা খোকাবাবু বলছে কেন ?
আমি ছেলের প্রশ্নের উত্তর দিলাম। ইংরেজিতে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলাম। ওর মার ওর মার কঠিন আদেশ, ছেলের সাথে বাংলা কথা বলতে পারব না। সে নিজে না পারুক, আমাকে ইংরেজি বলতে হবে। আমার মিসেসের সে মানও রাখলাম। আফজলকে বললাম,
--- বাদশা-বেগমএর খানা মিলল না কেন ? তুমি কি বিমার পড়েছিলে?
ললাম বটে কিন্তু চোখের সামনে ভেসে উঠলো আমাদের ছোটবেলা। আমাদের বাবার দৌলতে আমাদের ছোটবেলায় তো ফুটবল খেলেলে পা ভাঙ্গবে। তাই বল কেনা যাবে না। ক্রিকেট খেললে মাথা ভাঙ্গবে। তাই ব্যাট-বল দেওয়া যাবে না। আতসবাজি পোড়ালে দুর্ঘটনা হবে। তাই আমোদ-প্রমোদ প্রায় কিছুই ছিল না। বাবা এসব দিতে পারেননি, না দিতে চাননি, তা জানি না। কিন্তু আফজল মিঞা ছিল আমাদের আমোদ, আমাদের প্রমোদ। সে আমাদের পাড়ায় পাড়ায় ডানহাতে একটা অদ্ভুত কায়দায় তার ম্যাজিক ডুগডুগি ধরে সেটা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বাজিয়ে খেলা দেখাতে আসতো। প্রায় রোজ। সাথে থাকতো তার বাঁদর বাদশা আর বাঁদরী বেগম। তাদের গায়ে জামা, পরনে প্যান্ট। আফজলের নিজের হাতে বানানো বস্ত্র। বেশ রঙিন। অনেকটা বাউলদের জোব্বার মতো দেখতে। বাঁদর দুটো আমাদের জীবনের সাথে এমনভাবে জড়িয়ে ছিল যে, তাদেরকেই মনে হতো আমাদের জীবনের আনন্দ, আমাদের স্ফূর্তি। তারা না এলে পড়ায় মন বসতো না আমাদের। একবার খেলাটা দেখলেই আমরা এনার্জি কালেক্ট করে নিতাম। খেল্‌ মানে--- স্বামী বউ-এর আদেশে জল তুলছে, রান্না করছে, বউ-কে খুশি করছে, তোয়াজ করছে, তারপর আনন্দে ডিগবাজি খাচ্ছে। নানা খেল্‌। আর আফজলের অদ্ভুত ডুগডুগির শব্দ। কী দারুন দক্ষতা! ঐ বাজনা ছাড়া যেন বাঁদরকেই মানায়ই নয়া। আর আজ তা উঠে এসেছে পুরনো কাগজওয়ালার হাতে। কী অন্যায়! শিল্পের কী অপব্যবহার! কিন্তু শিল্পী হিসেবে আফজল কিন্তু কোন খেতাব পায়নি, পাবেও না। সে যে শিশুদের আনন্দ দেয়, তাদের মনকে তাজা রাখে, চাঙ্গা রাখে--- এর কোন মূল্য নেই। মূল্য ছিল না আমাদের মা-বাবার কাছেও। খেলা শেষ হতে না হতে মা বা বাবা আমাদের ঘরে ডেকে নিয়ে যেতো। ওরা হয়তো ভাবতো, ওরা বাচ্চা-কাচ্চা ধরে নিয়ে যায়। শুধু সুমুর মা নয়, সকলেই। আজকের মায়েদের মতো আমাদের মায়েরাও আমাদের আমোদ-প্রমোদ থেকে, স্বাধীনতা থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে ‘’পড়া পড়া পড়া’’রে অতিষ্ঠ করত, উদ্‌ব্যস্ত করে মারত। আমাদের বাবাদের সময়েও তাদের মায়েদের হাতে এমনটা ঘটতে পারতো। কিন্তু তাঁদের মায়েদের সেটুকু অবসর ছিল না। তারা তো দাসী-বান্দীর মতো খিদ্‌মদ খেটে মরত। ছেলের পড়াশুনো দেখবে কবে!
যাইহোক, বাড়ি থেকে ডাকলে সব বাচ্চারা একে একে চলে যেতো। আফজল অল্প হেসে মাথায় করাঘাত করে সব গুটিয়ে-বাটিয়ে চলে যেতো। আমাদের বড়রা ভাবতোও না, আফজলকে কিছু দিতে হবে। এটা ওর জীবিকা। কিন্তু আমরা আমাদের টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে আফজলকে দিতাম। দিতাম, কারণ ও যেন পরদিন আবার আসে। কিছু না পেলে তো ও আসবে না। ওকে যে আমাদের চাই। একটুখানি আনন্দ, একটুখানি খেলা, একটুখানি হাসি। এই তো ছিল আমাদের জীবনীশক্তি, সঞ্জীবনী সুধা।
সম্বিত ফিরল আফজলের কথায়।
--- ক্যায়সে খানা মিলবে, খোকাবাবু! তব তো আপলোগ বড়ে হো যা রহে থে। ফির কোই খোকা-খুকু বান্দর কা খেল্‌ মাদারি কা খেল্‌ দিখতো না। ফির সানিমা আ গয়া, টিভি আ গয়ি। উস্‌ মে আচ্ছা আচ্ছা খেল্‌ দিখানা সুরু হো গিয়া। ঘর বয়ঠে বয়ঠে সব খোকা-খুকু হরেক রকম নয়া নয়া খেল্‌ দিখতো। হামি কিতোবার এসেছে! সব বাচ্চা লোগো কো ডেকেছে ভি। ডমরু বাজিয়েসে জোর জোর সে। শোর ভি মচায়েথে, আও! বাদশা বেগম কা খেল্‌ দেখো। মগর কোই বাচ্চা লোগ নেহি আয়া। বান্দর কা খেল্‌ বাচ্চা লোগো কা পাস ফালতু হো গয়া। আপকা বাদশা বেগম কো ক্যায়সে খানা মিলবে, খোকাবাবু! কৌন পয়সা দিবে! খানা দিতে পারি না। নিজে খাই সাত্তু ঔর পানি। বাদশা বেগম তো বো খানা খেতো না। একরোজ হামি দিমাগ খরাপ করকে বোলা, যা বাদশা, যা বেগম, খুদ কা খানা খুদ ঢুন্‌ড লে। খুদ বাচ লে। ছোড় মুঝে। মাফ কর। মগর বো তো কহিঁ গিয়া নেহি। বাপুজিকো ছোড়কে কাঁহা যাবে! খানা মিলতো না। ফির--- এক রোজ বো দোনো গুজার গিয়া।
চুপ করে শুনছিলাম আফজলের দুঃখ-কষ্টের কথা। আফজল চোখ মুছছিল। এসব তো আমার বা আমাদের জানা। আমার বাবা গল্প করতেন, তাঁদের সময়ে নাকি বহুরূপী ছিল। কালী-দুর্গা-কৃষ্ণ--- অনেকটা গো এজ ইউ লাইক-এর মতো নানাভাবে সেজে মেকআপ নিয়ে আসতো, সকলকে চমকে দিতো, পয়সা পেতো। আমি তো তাদের দেখিনি? তারমানে, তারা তখন ঐ বাদশা বেগমের মতো না খেতে পেয়ে মরে গিয়েছিলো বোধহয়। এমনি মরে যাচ্ছে ছৌ নৃত্য। তাই এই শিল্প নিয়ে টিকে থাকবার জন্য একদল ছৌকে মৌ বানাচ্ছে। হয়তো বাদশা বেগম কে বাঁচতে হলে তেমনই কিছু করতে হতো। নিষ্পাপ বাঁদর খেলার সাড়ে সর্বনাশ হতো। আজ আবেগকে ছেড়ে বেগ-এর হাত ধরে আমাদের বাড়িতে এসেছে টিভি, ভিসিডি, ভিডিও গেম্‌স, মোবাইল, ইন্টারনেট, রক, পপ, বলিউড, ট্রলিউড। কী নয়! এক নিমেষে হাজার খেল্‌। আজকে প্রথম আক্ষেপ করলাম, নতুন তো আসবেই। কিন্তু এভাবে! পুরনোকে একেবারে নিশ্ছিহ্ন করে দিয়ে, নির্মূল করে দিয়ে, শেষ করে দিয়ে! তা নয়তো কোথায় গেলো সেই ভালুক খেলাওয়ালা, সাপ খেলাওয়ালা, যা দেখে আমরা নয়ন জুড়োতাম? কিম্বা কোথায় গেল আমার বাবার মুখে শোনা পুরনো দিনের গম্ভীরা, ভাওয়াইয়া, যা মানুষকে কাঁদাতো- হাসাতো? রবিবাবুকাবুলিওয়ালা কি আর কোনোদিন ছবিবাবুর কণ্ঠের আদলে বলবে, খোকি, তুমি সসুরবাড়ি যাবিস?--- এ স্লোগান তো আজকের সভ্যতার স্লোগান। একদিকে টাকা খেয়ে গোপনে চোরা শিকারিদের অরন্যে ঢুকিয়ে দাও, আর অন্যদিকে কালেভদ্রে একটা দ্যাখনদারি ইন্সপেকশন করো। ব্যাস, কাজ শেষ। পরিবেশ বাঁচাও। মানুষ মরে যাচ্ছে ? যাক, কুছ পরোয়া নেই। রাস্তায়, ঘাটে, বস্তিতে, কুঁড়েতে ফুটপাথে, ব্যাধিতে, নেশায়, না খেয়ে, অখাদ্য খেয়ে তারা মরে যাক, পচে যাক, ধরে যাক। ওরা তো উচ্ছের ঝার। হাতির পাল ঢুকে দশটা বাড়ি ভেঙ্গে দিয়েছে বা ফসল বিনষ্ট করেছে? চুপ করে থাকো। ফসল তো আবার হবে। কিন্তু ওরা যে পরিবেশ বাঁচাবে। বাঘে কাঁকড়া ধরতে যাওয়া দুটো মানুষকে থাবা মেরে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে? যাক না। বাঘ তো বাঁচাতে হবে। তুমি বাঁচো, না বাঁচো। কিন্তু হে সভ্যতা! কার জন্যে এই পরিবেশ রক্ষা। শুধু পরিবেশ তো শুধু বাবুদের পেট ভরায়। কিন্তু আফজলরা? ওদের কী হবে? পশুকে নিয়ে সারা বিশ্বব্যাপী মাতামাতি চলবে। অথচ চিড়িয়াখানা থাক। পশু দেখিয়ে সরকার পয়সা কামাক। কিন্তু আফজলেরা? নৈব নৈব চ। সকলেই জানে, সার্কাস পার্টি বা আফজলেরা তো তাদের বাঁদর, বাঘ, ভালুক, সিংহকে সবাই তাদের ছেলেমেয়ে মনে না করুক, মূলধন তো মনে করে। পশুরাই তো ওদের ভাত দেয়। তাই মূলধনের তো যত্ন নিতেই হয়। কিন্তু এখন তা চলবে না, চলবে না।
হে সভ্যতা! হে বিজ্ঞান! তুমিও তো দেখছি, নদীর মতই নিষ্ঠুরা। এ কুল গড়ো, ও কুল ভাঙো। একদিকে মানুষকে নতুনভাবে বাঁচার রসদ এনে দাও, আবার অন্য হাতে না খাইয়ে মারো। সভ্যতা বলছে--- সারভাইভাল অব দি ফিটেস্‌ট। চুপ করে থাকো। দেশ এগোচ্ছে। সভ্যতা এগোচ্ছে। একটা সময় আসবে, চারদিকে সভ্যতা সভ্যতা গন্ধ ভাসবে। সব ছকে চলবে। চারদিক ঝাঁ- চকচকে হয়ে যাবে। সব পালটে যাবে। যান্ত্রিক হয়ে যাবে।
আমার চিন্তার তার কেটে দিলো আফজল মিয়াঁ। সে তার বুড়ো হাড় নিয়ে রাস্তার পাশেই নানা রকম অঙ্গভঙ্গি করছে। অনেকটা বাঁদরের মতো। অনেকটা বাদশার মতো। কী ব্যাপার! ওর তো চোট-টোট লেগে যাবে। মাথাটা গেল নাকি? বুড়ো মানুষ! আজ আমাকে দেখে কি পুরনো দিনের কথা মনে পড়তে মাথাটা---।  হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, না। মাথা খারাপ নয়। একটা সত্যি জানলাম আজ। আফজল শুধু পয়সার জন্যে আমাদেরকে বাঁদর খেলা দেখাতো না। একটা মহান উদ্দেশ্য তার ছিল যেটা আমাদের বাবা-ও আমাদেরকে অনীহা বা অক্ষমতা থেকে দিতে পারেনি। সেটা হল নির্মল আনন্দ। তাই তো আমার ছেলেকে বাঁদর খেলা দেখাতে চেষ্টা করছে। আমার ছেলে জীবনে যা দ্যাখেনি, তার একটা আস্বাদ পাচ্ছে। আফজলের খেলা দেখে আমার ছেলে সুমু হেসে কুটিপাটি। আফজলকে দেখেই এতো খুশি! তাহলে বাদশা-বেগম না জানি কতটা আনন্দ দিতে পারতো আমার ছেলেকে! আমি কোনোদিন ওকে এতোটা আনন্দ দিতে পেরেছি কি? ওর পুরনো ভিডিও  গেম্‌সটা নিয়েও ওকে খেলতে খেলতে এতোটা খুশী হতে দেখিনি।
-----------------------