মঙ্গলবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১১

'হৃদয়ের ভাষা' ছোটগল্প

হৃদয়ের ভাষা

হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়


রনজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সেই আসতেই হলো এ দেশে। দাদা অমূল্যধন বলেছিলেন,
--- তুই ওই দূর দেশ থেকে ঠেঙ্গাতে ঠেঙ্গাতে কেন আসতে যাবি! তুই একটা পাওয়ার দিয়ে দে আমাকে। আমি তোর ভাগেরটা তোর এ্যাকাউন্‌টে ফেলে দি। তারপর তুই যা করার, তা করিসখন।
রণজিৎ কিন্তু দাদাকে বলেছে--- না না দাদা। তোমার বয়স হয়েছে। এই সময় কোর্ট-কাছারির গোটা দায়িত্ব কেউ তোমার ছেড়ে দেয় নাকি!
আসলে রণজিৎ বাবু দাদাকে বিশ্বাস করতে পারেনি। এতোগুলো টাকার ব্যাপার। দাদার মস্তিষ্ক যদি ঘুরে যায়? জমিজমা-বাড়ি ভাগাভাগি যা কিছু হবে, তাতে তো তাঁরও একটা মতামত থাকা দরকার কেননা ভাগ তো তাঁরও আছে। না হয়, ও দেশে ওঁদের পিতৃপুরুষের যে প্রাচীন আবাস, সে সব একাই ভোগ করছে ছোটভাই। কিন্তু সেই জমি-বাড়ি নিয়ে যদি সে কিছুমাত্র মালিকানা পরিবর্তনের কথা ভাবে, মানে বিক্রীবাটা করতে চায়, তবে তাকে তো দাদারও মত নিতে হবে। সে বসবাস করছে, ঠিক আছে। কিন্তু তার জন্যে সে সবের তো মালিক সে একা হয়ে যেতে পারে না। ঠিক তেমনটাই এখানকার জমি-বাড়ি দুই ভাইয়ের সম্পত্তি আজ। বাবা সেই কোনকালে এখানে বেশ কিছু জমি কিনে কিনে রেখেছিলেন, বাড়ি করেছিলেন। তিনি বসবাস করতেন বাংলাদেশে কিন্তু বড়ো ছেলে অমূল্যধনকে পাঠিয়ে দিয়েলেন এখানে। বাবার ইন্ধনেই এখানে আসেন অমূল্য বাবু। এখানেই তাঁর পড়াশুনো, চাকরী, উন্নতি। মনে মনে মানেন অমূল্যধন যে, তাঁর দেশ বাংলাদেশ হলেও এ দেশ তাঁকে অন্ন দিয়েছে, আশ্রয় দিয়েছে এবং মাতৃক্রোড় দিয়েছে। শুধু তাঁকেই দিয়েছে কেন ভাবা? অমূল্যধনের মতো বাংলাদেশের অনেককেই দিয়েছে। এক পা ও দেশে আর এক পা এ দেশে দিয়ে বেঁচে আছে অনেকে। মনে মনে তিনি বাংলাদেশি কিন্তু তাঁর জীবনে জল-ধান-মাটি প্রায় গোটাটাই এ দেশের।
অমূল্য অনেকটা দায়ে পড়েই এ দেশ ও দেশরতে চান না। মন কী বলে, আজ আর তার উত্তর খোঁজেন না তিনি। কিন্তু এটা সত্যি বলে মানেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে শুধু মুক্তিযোদ্ধারা নয়, এ দেশের জওয়ানদের একটা বিরাট অবদান আছে। অবদান আছে এ দেশের সরকারের। এটা নিয়ে, অর্থাৎ এ দেশের সরকারের তৎকালীন এই ভূমিকাগত উদ্দেশ্য নিয়ে যে তর্ক থাক না কেন, কথাটা তো সত্যি। সে সময়ে সবচেয়ে বড়ো সাপোর্ট দিয়েছিল ইন্ডিয়া। শুধু সে সময় কেন? বাঙ্গলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু সাহেব খুন হলে তিনি যে ধর্মনিরপেক্ষ একটা বাংলাভাষা কেন্দ্রিক দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন আর তাঁর দেশের মানুষকে দেখাতে চেয়েছিলেন, তা তাঁর দেশের মানুষ যখন ভুলে গেলো, সে দেশ হিন্দুধর্মীদের দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিকে রূপান্তরিত করলো, তখন এই দেশই তো ওদেশ থেকে পালিয়ে আসা হাজার হাজার বাংলাদেশীকে আশ্রয় দিলো। তার মধ্যে পড়েন স্বয়ং অমূল্যধন বন্দ্যোপাধ্যায়। বাবা লোকনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর মধ্যে মেধা দেখে, আর ও দেশে উন্নতিতে বার বার অন্তরায় সৃষ্টি হবে জেনে অনেক বাঙ্গালীর মতো নিজের একেবারে ছোট, মাত্র ক্লাশ এইটে পড়া ছেলেকে জয় মা ভবতারিণীলে কপাল ঠুকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এ দেশে। ভরসা করলেন, এ দেশে বসবাসকারী পুরনো বন্ধু কালীচরন চট্‌টোপাধ্যায়কে। তারই পরিচয় নিয়ে এখানে মেস করে থেকে অমূল্যধন পড়াশুনো করেছেন, নাগরিকত্ব নিয়েছেন, এ দেশের মেয়ে বিয়ে করেছেন, স্ত্রী-ও সন্তানাদিদেরকে নিয়ে সরকার নির্‌বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। আজ আর তাঁকে কেউ বাংলাদেশি বলে না। তিনি ভারতীয়, তিনি সম্ভ্রান্ত।
ও দেশে যে জমি বা বাড়ি আর বিক্রি করা যাবে না, তা জেনেই বাবা লোকনাথ এ দেশে রানাঘাটে সেই বন্ধু কালীচরনকে কেন্দ্র একটু একটু করে জমি কেনেন, এবং শেষে নিজেই এক সময় পাকাপাকিভাবে এখানে চলে আসেন বড়ো ছেলের কাছে। বহুকাল মন তাঁর পড়ে ছিল সেই তথাকথিত স্বদেশে, যা তাঁর কাছে বিভূঁই মাত্র ছিলো। কিন্তু পরে মাঝে মাঝে মনে হয়েছে--- এই দুই দেশের মধ্যে যেন কোন বিভেদ নেই, বৈষম্য নেই। একই ভাষা, একই খাদ্য, একই মানুষ এই দুই দেশে। পার্‌থক্য শুধু একটা বইয়ের, যার নাম সংবিধান। আর পার্থক্য কাঁটাতারের এবং নো ম্যান্স ল্যান্ডএর। ব্যস। যে কোনো দেশেই বেঁচে থাকা যায়, যে কোনো দেশেই মরা যায়। একই মা-এর দুই ক্রোড়। একটা সময় তো একই দেশ ছিল।
নেই নেই করে লোকনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এ দেশে খুব কম জমি করেননি। আজ আর তিনি নেই। এবারে তার ভাগ-বাটোয়ারা করার সময় এসে গেছে। অমূল্যবাবু শুনেছেন, বাবাকে নিয়ে সনজিত চলে যাবে নিউজার্সিতে। ওখানেই ওদের পাঁচ বছরের বাস। ওরা আর এ দেশে ফিরবে না। জানেন অমূল্যধন যে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দিয়ে, নতুন বাংলাদেশ গড়া ভুলে গিয়ে বাংলাদেশ থেকে তো অনেকেই চলে গেছে অস্‌ট্রেলিয়ায়, জার্মানি-তে, ইউ.এস.এ-তে। সনজিতও তাই। ও দেশ থেকে বিদেশ যাবার জন্যে একটা যেন তাড়াহুড়ো পড়ে গেছে। একটা ইঁদুর দৌড়। কে আগে নিজের ছেলে বা মেয়েকে পাঠাতে পারে বিদেশে। পড়াশুনোয় একটু ভালমন্দ ফল করতে পারলে বা কোনো না কোন টেকনিক্যাল বা টেকনোজিক্যাল কোর্স করে ফেলতে পারলেই দৌড়। গোটা তৃতীয় বিশ্ব জুড়ে ব্রেনড্রেন চলছে। ওখানে যাবে, ওখানেই একজন নিজের ধর্ম-এর, এমনকি না পেলে একটা সাদা  মেয়েকেই বিয়ে করবে। এরপরেই তাদের ছেলেমেয়ে হবে হাফ সাদা, হাফ কালো। তারা ফটর-ফটর করে ইংরেজি বলবে। ওরা বাংলাভাষাই জানবে না। না হবে এ দেশি, না বিদেশি। একটা ট্যাঁশ প্রজন্ম হয়ে বেঁচে থাকবে। পদবী থাকবে সেই বাংলার বারুজ্জে বা চাটুজ্জে, কিন্তু নাম হবে জ্যাক্‌স বা মেরি। এসব ভালো লাগে না অমূল্যধন বাবুর। তিনি তাঁর কোনো ছেলেকে পাঠাননি সেখানে। অবশ্য তারাও কেউ এখানে নেই। এই দেশের মধ্যেই নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গে নাকি কোনো কাজ নেই? ডেকে পাঠালে তবে তারা আসে। কিন্তু এ ব্যাপারে তাদেরকে ডাকতে হবে না, আর তাদের ইন্টারেস্টও নেই এই সম্পত্তিতে।
অমূল্যধনের ছোটভাই রণজিৎ আজো বাংলাদেশে আছে। সেখানে ডাক্তারি করেই সে বেশ পশার জমিয়েছে। ডাক্তারি মানে হাতুরেগিরি। বাবা ডাক্তার ছিলেন বলে সেইটাই অবলম্বন করেছে সে। গ্রামের ডাক্তার। লোক ঠকিয়ে ভালমন্দ উপার্‌জন। একমাত্র ছেলে সনজিত-কে সে পাঠিয়েছে নিউ জার্সিতে। সেখানে একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে সে কাজ করে। সনজিত সেখানেই বিয়ে করেছে একটি ভারতীয় তথা বাঙালি বংশোদ্ভূত পরিবারের মেয়েকে। নাম এমিলি। সেখানেই সে বর্ন এ্যান্ড ব্রট আপ। সে-ও সার্ভিস করে। ভারতবর্ষের মুখটুকু সে দ্যাখেনি। ওদের একটি ছেলে। তার নামও বিদেশি বিদেশি। পিটার। কোনো সন্দেহ নেই যে, রনজিতের ছেলেটি লেখাপড়ায় যেমন ভালো ছিলো, তেমনি সে বৈষয়িক। বিদেশে সে গেছে তো মুখ দেখিয়ে নয়। বিদেশ ওকে ডেকে নিয়ে গেছে তাদের প্রয়োজনে। পৈত্রিক জমি-জায়গা বিক্রিবাঁটা যে হবে, তার প্রতিও সনজিতের আকর্ষণ ছিল সমান। সে মনে করে, অর্থ কারোর কখনও চাহিদাতীত হয় না। তাছাড়া সনজিত লেখাপড়াটাই শিখেছে, মনটা পড়ে আছে ওর বাবারই মতো ছোট ছোট বিষয়ে।
এবার বাবা ছেলেকে বলেছিলেন--- তুই আর শুধু শুধু সাত সাগর তেরো নদী পেরিয়ে আসিস না। আমি ম্যানেজ করে নেবোখন।
কিন্তু নিস্পাপ কণ্ঠে সনজিত বলেছে--- না বাবা। তোমাকে কোনো ভরসা নেই। তুমি হয়তো জ্যাঠামশাইকে দেখেই আবেগে গলে পড়বে। জ্যাঠামশাই সংস্কৃতে যেই দুর্গাপুজোর মন্ত্র-ফন্ত্র বলবে, অমনি তুমি কাৎ।
ফলে এই সম্পত্তিগত বিষয়ে সে তার বৌ-বাচ্চাকে ইন্ডিয়া দেখাবার নাম করে একবার ঘুরে যেতে এসেছে এখানে। সমস্ত বিষয় সম্পত্তি নিজে চোখে বুঝে নিতে চায় ও। অমূল্যধন বেশ বোঝেন, তাঁর ভাইপো শুধু তাঁকে কেন, নিজের বাবাকে পর্‌যন্ত বিশ্বাস করে না। তার জ্যাঠামশাই যে তাঁর ছোটভাইকে ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে, শুধু এমনটাই নয়। বাবাও যে কোনো দুর্‌বল মুহূর্তে তার দাদার দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে, সে সন্দেহও তার মনে ছিল। ছোট্ট ঘর ছেড়ে সে বৃহৎ বিশ্বে মিশে যেতে বেরিয়েছে বটে, কিন্তু বিশ্বায়নের অর্থনীতি তাকে এক সঙ্কীর্ণ আর্থবন্ধনে বেঁধেই রেখেছে। মনটাকে সে বৃহৎ করতে পারেনি। তার এই মধ্যপন্থা তাকে এক বিরাট শিক্ষা দিলো অবশেষে। শিক্ষা সে কতটা গ্রহণ করেছে, তা জানা না গেলেও তার বাবা-মা যে মোক্ষম শিক্ষা পেলো, সেটা নিশ্চিন্তে বলা যেতে পারে।
রণজিতের ছেলে দেশের বাইরে গেলেও তার বাবা-মা যে সেই বাংলাদেশের এঁদো গাঁয়ের মানুষ, এমনটা সে মনে রাখেনি। আর সেটাই যে একটা বিপত্তি ঘটাতে পারে, এমনটা ধারনা তার হয়ওনি। এদিকে সনজিতের মা ছেলের বিদেশ বসবাসে গদগদ। ছেলে তার কট মট ইংরেজি বলা মেয়েকে বিয়ে করেছে, নাতিও ঠা-ঠু করে ইংরেজি বলে টেলিফোনে, তাতে দস্তুরমত অহংকারই ছিল সনজিতের মা-এর। বাবারও সেই গর্ব কম নয়। এই ফাঁকে বাড়ির অন্য মানুষদেরকে তা দেখাবার একটা বাসনাও রণজিতের স্ত্রীর মনে ছিল। সেই ছেলে, পুত্রবধূ আর নাতি এলো এখানে। কিন্তু মনটা তার ভেঙ্গে গেলো প্রথম দর্শনেই। শ্বশুর-শাশুরির সামনে জেটল্যাগ কাটিয়ে ওঠার আগেই তারা সনজিতকে তাড়া দিলো দ্রুত স্টেটসে ফিরে যাবার জন্যে। তাদের ভাষা রনজিতের স্ত্রী নিজে পুরো বুঝতে না পারলে কী হবে, হাবেভাবে বুঝলো। অবশ্য এই বুঝতে না পারাটাই যে বিরাট গর্বের, তা বারংবার অপরকে বুঝিয়ে দিতে রণজিতের স্ত্রী কসুর করেনি। কিন্তু দেখাবার মতো তেমন মানুষও তো এখানে নেই, তা স্মরণে ছিলো না তার। অমূল্য বিপত্নীক। আজ সাত বছর সে গত হয়েছে। তাই যাবতীয় সম্পত্তি ভাগাভাগি করে দিয়ে অমূল্যধন এবার বেরিয়ে পড়বেন তীর্থের উদ্দেশে। তার আর তো কোন টান এখানে নেই। কার জন্যে আর এখানে থাকা!
সনজিত বাবাকে সাথে করে জ্যাঠামশাইয়ের সাথে রওয়ানা দ্যায় রানাঘাটে। সেখানেই বিস্তর জমিজমা তাদের। খদ্দের, উকিল এবং কাগজ-পত্র সবই ঠিকই করে রেখেছেন অমূল্যধন। শুধু কোর্টে যাও, সই-সাবুদ করো। ব্যস্‌। যাবার সময় নিজের স্ত্রীকে সাবধান করে দিয়ে গেছে সনজিত, সে যেন তার শাশুড়িকে চোখে চোখে রাখে। বিশেষত এই দেশ পরিবর্তনে, আর জলবায়ু পরিবর্তনে হাঁফানি নিয়ে সে বেশ কাবুই হয়ে এসেছে এ দেশে। কিন্তু বিদেশে তো শ্বশুর-শাশুড়ি প্রথা তেমন গভীর নয়। সে সংস্কৃতি তাদের নেই। সেখানে তো সকলেই স্বতন্ত্র, স্বাধীন। বিশেষত ওরিজিনের থেকে অনুকরণকারীদের বৈদেশিক ঠাট-বাঁট বেশী মাত্রায়ই থাকে। সনজিতের মা তার পৈত্রিক রোগ হাঁফানি পেয়েছে শতকরা একশ ভাগ। বারোমাসের মধ্যে সে আট মাসই পড়ে থাকে বিছানায়। ইনহেলার, নেবুলাইজার নানা ব্যবস্থা করতে হয় নানা সময়। তবু তাকে নিয়ে আসতে হয়েছে এতোটা পথ পাড়ি দিয়ে। সম্পত্তি এমনই গেঁড়ো। যথেষ্ট থাকলেও মানুষ তার হক্কের প্রাপ্য ছাড়বে না।
কিন্তু বিধি বাম হলে কে তা থেকে রেহাই পায়! রণজিৎ বেরিয়ে যাওয়ার পরই তার স্ত্রী হঠাৎ অসুস্থ হয়। তার শ্বাসের টান ওঠে ভয়ঙ্কর। কিন্তু সদ্য এ দেশে আসায় লাগেজের কোথায় তার ইনহেলার আছে, সে সময় সে হুস তার থাকে না। সে তার পুত্রবধূকে বার বার বলতে থাকে ইনহেলারের জন্যে। কিন্তু গেঁয়ো মহিলা মনে রাখতে পারে না যে, সেটার নাম ইনহেলার। তাই সে তার মতো বলে,
--- বৌমা, আমার ফিচ্‌কারিডা দ্যাও দেহি। আমার তো শ্বাস ওডে (ওঠে)।
কিন্তু তার সাধের বৌমা এ্যাস্থমার পেশেন্‌ট জীবনে দ্যাখেনি। তার শাশুরির কী যে রোগ, তা সে ধরতেই পারে না। শাশুড়ি কী যে চাইছে, তাও সে বুঝতে পারে না। সে বার বার জানতে চায়--- হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্‌ট, মম্‌? প্লীজ মেক ইট ক্লিয়ার। আই জাস্ট কান্ট গেট ইউ।
--- ফিচকারি! ফিচকারি!! বোঝো না? শ্বাসকষ্টের ফিচকারি।
অগত্যা নাতির কাছে আবেদন জানায় সে। কিন্তু নাতি তার মাকে বলে--- মম, ডিস ওল্ডি ইস হাংগ্রী। প্লীজ গিভ হার ফুড।
বার কয়েক চেষ্টা করে শাশুড়ি বিফল হয়ে ক্ষিপ্ত হয় তার শখের ইংরেজি বলা পুত্রবধূর ওপর। যত সে ক্ষিপ্ত হয়, ততই তার উত্তেজনা বাড়ে আর বাড়ে শ্বাসকষ্ট। শখের ইংরেজি যে এবার তার প্রাণনাশের কারণ হচ্ছে, তা সে হাড়ে হাড়ে টের পায়। পুত্রবধূ উন্নত দেশের বাসিন্দা। ওরা এ দেশের মতো সেলুলার ফোন ব্যবহার করে না। ফলে সনজিতকেও কোনো মেসেজ দেওয়া সম্ভব হয় না। এদিকে ক্রমশ সনজিতের মা-এর অবস্থা সঙ্গিন হতে থাকে। অবশেষে এমন পরিস্থিতি ঘটে যে, পাড়ার মানুষ ডেকে তাকে হাসপাতালে দিতে হয় এবং নানাভাবে প্রচেষ্টা করে যোগাযোগ করা হয় কোর্টে। সংবাদ পান অমূল্যধন বাবু। তাঁরা ফিরে এলে একটু সুস্থ হয়ে একটাই কথা বলে রণজিৎ বাবুর স্ত্রী,
--- আমি অগো লগে বিদেশে যামু না গো। আমাগো ঐ ফটর ফটর ইংরাজি কওয়া দেশে যাইয়া কাম নাই। ওরা আমাগো বাসা (ভাষা) বোজে (বোঝে) না। তুমি আমারে দ্যাশে নিয়া চলো। এসব সম্পত্তি থাউক। দাদা যা করনের করবেন হ্যানে। আমরা ফিরা যাই। চলো, আমরা ফিরা যাই।  

-----------------

বৃহস্পতিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১১

'অন্তর্ধান' ছোটগল্প


অন্তর্ধান
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়


সকাল থেকে বাবা-কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাবা মর্নিংওয়াকে কখনও যান না। শরীর তো তাঁর দিব্যি সুস্থ, সবল। সামান্য সর্দি-কাশি ছাড়া বড়ো একটা প্রবলেম তাঁর ছেলে-মেয়েরা দেখে নি। অসুস্থ বলতে যিনি ছিলেন, তিনি মা। মিতুর প্রবলেমটা ধরা পড়তে তিনি সেই যে বিছানায় পড়ে গিয়েছিলেন, আর ওঠেন নি। পাঁচটা মাস তিনি ভুগেছেন আর ভুগিয়েছেন বাড়ির মানুষকে। অবশ্য এটা তিনি নিজে মনে করতেন। তাঁর পুত্র বা পুত্রবধূ এমনটা কখনও মনে করে নি। সাধারণত মানুষ মোটে পাঁচ মাসে তেমনটা মনে করেও না। ফলে ভগবতী দেবী ছেলে আর ছেলের বউ-এর আদর যত্ন পেতে পেতে পাঁচ মাসেই ভব নদী পার করেছেন। মিতু অর্থাৎ মিতালি এ বাড়ির ছোট মেয়ে। তার জীবনের একটা দুর্ঘটনা মা-কে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিলো। মা হিসেবে তিনি মানতে পারেন নি তাঁর মেয়ের জীবনে এই পরিণতি। কোনো মা-ই পারেন না। সংস্কার, না সন্তান? সম্মান, না বাৎসল্য? ঐতিহ্য, না মমতা? এই প্রশ্নগুলোর মধ্যে পড়ে তিনি খান খান হয়ে গিয়েছিলেন।
বড়ো বৌ সঙ্গীতা-র মনে হোতো যে, তার শাশুড়িমাতা বোধহয় অপমানে স্বেচ্ছামৃত্যু বরন করেছিলেন। প্রথমে একটা ছোট হৃদরোগের ধাক্কা, আর তারপর বিছানা। সঙ্গীতা তেমন কোন বড়ো বাড়ির মেয়ে ছিল না। তাকে বড়ো ছেলে শুভু অর্থাৎ শুভঙ্করের জন্যে পছন্দ করে ভগবতী দেবীই এনেছিলেন। তার হাতেই সংসার দিয়ে তিনি বিদায় নিলেন। এরপর ঠিক মোটে একটা বছর। শ্বশুরমশাই অর্থাৎ পার্‌ব্বতিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় যিনি কিনা শুভঙ্কর, দীপঙ্কর, চৈতালি আর মিতালি-র বাবা, তিনি রিটায়ার করলেন ব্যাঙ্ক থেকে।
জ্যেষ্ঠা পুত্রবধূ এ বাড়িতে শ্বশুর বা শাশুড়ির প্রিয়। হয়তো নিজেরা তাকে পছন্দ করে এনেছিলেন বলেই সে প্রিয়। কিন্তু মেজো অর্থাৎ দীপঙ্করের বউ-কে তেমন একটা ভরসা করেন না পার্‌ব্বতি বাবু। তার মূল সমস্যা হলো, সে আপনিই মেজোছেলের হাত ধরে জুড়ে বসা পাখি আর তার বেশভূষা আতঙ্কজনক। মুখে সর্‌বদা মেকআপ, যেন এক্ষুণি কোনো শুটিং-এ যাবে। সন্দেহ নেই, সে একটু বেশী রকম ধনী পরিবারের মেয়ে। তাই সে চা-টাও দিতে এলে শ্বশুরমশাই চোখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে রাখেন। কে-ই বা পুত্রবধূ-র পেট, নাভিকুণ্ড, কোমর, বগল বা অর্ধন্মোচিত বক্ষ দেখতে চায়!
এই তো সেদিন সন্ধেবেলা পার্‌ব্বতি বাবু বাড়ি ফিরলেন অফিস থেকে। হাতে একটা বিরাট ফুলের বুকে আর বেশ কয়েকটা উপহার। অফিসে কী কী ঘটলো, কে কী বললো--- সব জানালেন বাড়ির মানুষদেরকে। বড়ো বৌ বললো,
--- বেশ হয়েছে। অনেক পরিশ্রম করেছেন। এবার বিশ্রাম করুন।
পার্‌ব্বতি বাবু হেসে বলেছেন--- বৌমা, তুমি যে বিশ্রামের কথা বলছো, সে তো শরীরের। মাথা কি আর বিশ্রাম নেয়! যতদিন সংসারে আছো, মাথাকে বিশ্রাম দিতে পারবে না। সে নিরলস কাজ করতেই থাকবে।
--- কেন বাবা? আপনার ছেলেরা তো প্রতিষ্ঠিত। আপনার তো আর কোন দুশ্চিন্তা থাকার কথা নয়। আর মিনুর কথা আপনি ভাববেন না। ওর এ্যাতো বড়ো বড়ো দাদা-রা রয়েছে...। আমি বলি কি, আপনি এবারে একটা আত্মচরিত লিখুন।
--- আমার আত্মচরিত! আমার কে পড়বে, বৌমা! আমার জীবনে আমি কী করেছি? কী দাম আমার আত্মচরিতের?
--- কেন! আপনার ষাট বছরের নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা আত্মচরিত। এই সংসার, এই দেশ, এই রাজনীতি, মানুষের সাথে মানুষের সম্বন্ধ--- এইসব নিয়ে। ছেপে বের করুন। লোকের উপকার হবে। আপনার থেকে মানুষ তো একটা লম্বা জীবনের কথা পাবে। তাদের সকলকেই তো এই জীবনের মুখে পড়তে হবে, বাবা। সবাই তো আর মহাপুরুষ হয় না, আর সবাই যদি মহাপুরুষের জীবনী পড়ে মহাপুরুষ হয়ে যায়, তবে তো সংসার চলে না।
পার্‌ব্বতী বাবু হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন পুত্রবধূর দিকে। মনে মনে ভাবেন, এ মেয়েটা বলে কি! সারা পৃথিবীর মানুষ জানে, মহাপুরুষের জীবনী পড়ে জীবনকে সংশোধন করতে হয়, উন্নত করতে হয়। আর ও বলে কিনা, সবাই যদি মহাপুরুষের জীবনী পড়ে, তবে নাকি সংসার চলে না! ওকে একটু নাড়া দিয়ে অন্তত জানতে হবে, কী বলে ও। তাই তিনি বলেন,
--- কী বলছো, তুমি বৌমা! এসব কথা তুমি পেলে কোথায়?
--- কেন বাবা? আমার মন বলছে। ধরুন, আমরা সকলেই যদি চৈতন্যদেবের জীবনী পড়ি আর তাই অনুসরণ করে চলি, তবে সংসার কি টেকে? আপনার ছেলে যদি আমাকে ছেড়ে দিয়ে কালই ঈশ্বরের সন্ধানে হরিবোল দিয়ে নিরুদ্দেশ চলে যায়, তবে আপনি মেনে নিতে পারবেন? আমাদেরকে সংসারে থাকা, সংসারে লড়াই করা মানুষের জীবনী পড়তে হবে। জানতে হবে, এই সংসারে নানা জটিলতা, সমস্যা, সম্পর্ক, ঘৃণা, ভালোবাসা--- এ সবের মধ্যে আমাদের কিভাবে জীবন কাটাতে হবে। এটাই তো আমরা জানি না, বাবা। তাই তো আমাদের যত কষ্ট, যত দুঃখ। আপনি এতোটা বয়স পার করেছেন। আপনার লব্ধ অভিজ্ঞতা আমাদের তো লাগবেই। আমাদের শুধু নয়। সকলের লাগবে। তাই আপনাকে আত্মচরিত লিখতে বললাম।
পার্‌ব্বতিবাবু ভাবে দেখলেন, মেয়েটা তো ঠিক বলছে। এই পৃথিবীতে মহাপুরুষের মতো চলতে গেলে মানুষ তো শুধু পাগল বলবে না, পায়ে দলেও যাবে। এ সংসারে বাঁচবার অধিকার তো কেউ কাউকে দ্যায় না। বাঁচতে হয়। লড়তে হয়। পার্‌ব্বতিবাবু একটু আধটু লেখেন-টেখেন। অফিসে ওঁদের একটা ম্যাগাজিন বের হয়, বছরে তিনবার। তাতে তাঁর লেখা তো থাকেই। নানা জিনিস লেখেন। ছোট ছোট গল্প, ফিচার, নিবন্ধ, এমনকি প্রবন্ধও তিনি লিখেছেন। কিঞ্চিৎ নাম ডাকও হচ্ছিলো তাঁর। পরে কয়েকটা লিট্‌ল ম্যাগাজিনেও লেখা দিয়েছেন।
এদিন সকালে চা নিয়ে এসেছিলো ছোট মেয়ে মিতু। সে ফিরে গিয়ে বউদিকে জানালো--- বাবা তো ঘরে নেই।
--- ঘরে নেই?
সঙ্গীতা বিস্ময় মাখানো প্রশ্নটা করেই আচমকা মিতুর কথাটার একটা প্রতিধ্বনি বড়ো বউ-এর কানে ভালো লাগে না। তেমন কোন কথা নয়। কিন্তু কেমন যেন শোনালো, বাবা তো ঘরে নেই। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে বললো সে--- তাহলে গেছেন কোথাও। আজ তো অফিসে যাবার তাড়া নেই। তবুও অভ্যেসে যেমনটা ঘুম থেকে উঠতেন, তেমনই উঠে হয়তো বসে বসে একটু ক্লান্ত হয়ে রাস্তায় হাঁটতে-টাটতে গেছেন।
এমনটাই ধারনা ছিল সকলের। কিন্তু সকাল ছটা থেকে বেলা সাড়ে দশটা হলো, তাঁর কোন দেখা নেই। শুভঙ্কর বা দীপঙ্কর অফিসে বেরোতে পারছে না। কিন্তু অফিস তো কারোর বাবারও নয়, মারও নয়। তাই শেষে তারা বের হলোও। কিন্তু বাড়িতে বলে গেলো, বাবা ফিরলেই যেন তাদেরকে জানানো হয়। কিন্তু বেলা যখন গড়িয়ে গেলো, এ বাড়ির মানুষের খাওয়া-দাওয়া গোল্লায় গেলো, তখনও পার্‌ব্বতিবাবু নিপাত্তা। পুরো অফিস ছেলেদের করা হলো না। একবার কেন, বেশ কয়েকবার তাদেরকে পার্‌ব্বতিবাবুর তখনও না-ফেরার সংবাদ দেওয়া হলো। অগত্যা তাঁদেরকে বাড়ি ফিরেও আসতে হয়েছে। বড়ো বৌ সঙ্গীতা সেই থেকে কেঁদে চলেছে। সব কাজই নিজে হাতে করছে কিন্তু ঘন ঘন বাঁ-হাতে চোখ মুছছে। আর ছোট বৌ শুভমিতা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে চলেছে। আজ আর তার মেকআপের বাহার নেই, শাড়ি এলোমেলো। দিদিভাই-এর সাথে সে-ও দু-এক ফোটা অশ্রু যে ত্যাগ করছে না, তা নয়। শুভঙ্কর বাড়ি ফিরে বললো,
--- আগে পিসিমা কে ফোন করতে হবে। সেখানে যদি...। বাবা পিসিমাকে তো খুব ভালোবাসে। রিটায়ারমেন্‌টের ঠিক পরে মানুষের এই রকম একটু বিভ্রান্তিকর মনোভাব হয়। খুব আপনজনকে দেখতে ইচ্ছে হয়। তাই শুভঙ্কর ছোটভাই দিপঙ্করকে বললো--- তুই তো সব রিলেটিভের নাম্বার রাখিস। পিসিমার নাম্বারটা দে তো।
নাম্বার এলো, ডায়াল করা হোল। শুভ জানতে চাইলো--- বাবা কি তোমাদের ওখানে গেছে গো, পিসি?
পিসির চোখ কপালে--- দাদা? কেন রে, শুভু? এসব জিজ্ঞেস করছিস কেন? কী ব্যাপার?
--- বাবাকে সকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
এবার পিসি কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। কাউমাউ করে তিনি বলে--- খুঁজে পাচ্ছিস না, মানে? কী বলছিস? এবার তার আর কথা বলবার শক্তি থাকে না। ঘণ্টাখানেক পরেই পিসি এসে হাজির। পিসির বাড়ি সোদপুরে। পিসেমশাই নেই। তাঁর পেনশনেই চলে পিসি আর তাঁর দুই মেয়ের।
তাহলে এবারে মাসিমনীকে। তার বাড়ি বাঁকুড়ায়। তাকেও ফোন লাগানো হলো। কিন্তু সে-ও জানালো যে, তার বাড়িতে তার দাদাবাবুর যাবার কোন কথা তো নেই। তথাপি যদি দাদাবাবু আসে, তবে তাকে তো অপেক্ষা করতে হবে রাত দশটা পর্‌যন্ত। কেননা যদি হঠাৎ যায়ও, তবে তো রাতের আগে তো  পৌঁছবার মতো কোন ট্রেন নেই। তাই যখন তখন সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু রাতেও কোনো ইতিবাচক ফোন এলো না । পরদিন বিকেলে মাসীমনি স্বয়ং এসে হাজীর। বাবা কিছুই প্রায় নিয়ে যান নি। এমনকি পারসোনাল ডায়রিটাও নয়। সেটা দেখেই নানা জায়গায় ফোন করা হোল। তার মধ্যে বাবার এক্স-বস, দু-জন কলিগ, দুটো প্রকাশক, আর অন্য হাবিজাবি নানা মানুষের। তাদের কাছ থেকেও তো হদিশ পাওয়া গেলো না। অফিসের ম্যানেজার হেসে বললেন,
--- এটা কোনো চিন্তার ব্যাপার নয়। আটত্রিশটা বছর। এতগুলো বছর ঘাড় গুজে কাজ করে গেছেন উনি। একটু স্বাধীনতার খোঁজে হয়তো বেরিয়েছেন। ফিরে আসবেন অবশ্যই। এখনি পোলিসে জানাবেন না। একটু দেখুন।
--- মানে! বিস্মিত হয় শুভঙ্কর।
--- আসলে আমার ফাদার-ইন-ল এমন একটা কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। তিনি ফিরেছিলেন পনেরো দিন পরে। তিনি নাকি একা একা ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। আর দেখতেও চেয়েছিলেন, বাড়ির লোক তাকে কতটা চায়।
কিন্তু পোলিসকে না জানালে তো বিষয়টা অপরাধ হয়ে যাবে। একটা মানুষ এ্যাব্‌সকন্‌ড হলো অথচ পোলিস জানলো না। বাঁকুড়া থেকে মেশো ফোনে জানালেন যে, পোলিসকে আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে খবর জানানো উচিত। তাই জানানো হবে বলে সবাই ঠিক করেই রেখেছিলো। কিন্তু কারোরই মাথায় ছিলো না যে, পার্‌ব্বতিবাবু এতদঞ্চলের সিনিয়ার সিটিজেন ফোরামে নিয়মিত যাতায়াত করতেন এবং ওখানে একটা খোঁজ নেওয়া দরকার। যদিও এখনি মেম্বারশিপ মিলবে না, তথাপি বাবা আগে থেকে তাদের সাথে খাতির রাখছিলেন। ফলে বিষয়টা সকলের মাথা থেকে সরেছিলো।
পার্‌ব্বতিবাবুর বড়ো মেয়ে চৈতালি এসে গেছে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। আজ তার সাথে বড়ো জামাই অবধি বহুকাল পরে এসেছে। এখানেই আছে। নানা দিক থেকে নানা মানুষ নানা প্রিকশন নেবার জন্যে নানা পরামর্শ দিলো। একসময় গোটা বাড়িটা নিঝুম হয়ে এলো। এক্কাদোক্কা করতে করতে কাল সকালে পার হবে ছত্রিশ ঘণ্টা।
এই ব্যানার্‌জী ভিলায় বড়ো মেয়ে বিবাহিতা। বড়ো জামাই ল্যান্ড এ্যান্‌ড রেভিনিউ ডিপার্টমেন্ট-এর বড়ো মাপের অফিসার। দুই ছেলেই প্রতিষ্ঠিত। বড়ো ছেলে শুভঙ্কর একটি লিমিটেড কোম্পানী ব্যাঙ্কের এক্সিকিউটিভ পদে আছে। নানা ব্রাঞ্চে ঘুরে ঘুরে তাকে ম্যানেজারদেরকে এবং গোটা ব্রাঞ্চের কর্মকাণ্ড সামলাতে হয়। ছোট ছেলে দীপঙ্কর এম.বি.. রেছিলো কিন্তু কোনো চাকরীতে জয়েন না করে ব্যবসা শুরু করে। অত্যন্ত ঝানু ব্যবসায়ী সে। বাবা-র থেকে ক্যাপিটাল নিয়েই তার ব্যবসা শুরু। পরে পরেই লাভ ম্যারেজ। তবে সবাই জানতো যে, ছোটছেলের বিয়েতে বাবা মত দেন নি। স্ত্রী ভগবতী দেবী পার্‌ব্বতি বাবুকে চার সন্তানের পিতৃত্ব দিয়েই চলে যান নি। মিতু অর্থাৎ ছোটমেয়ে মিতালি ছাড়া আর সকলের জীবনকে থিতু করে তবে তিনি নিষ্কৃতি নিয়েছেন পার্থিব জীবন থেকে। কিন্তু মিতুর জীবনটা তিনি মেনে নিতে পারেন নি।
আজ পার্‌ব্বতিবাবু তাঁর ছোট মেয়ের পুনঃ বিবাহ প্রায় অসম্ভব জেনেই তাকে সেলামি-টেলামি দিয়ে একটা ঘর নিয়ে একটা বুটিক করে দিয়েছেন। যদি কেউ কোনদিন তাকে সব জেনেশুনে গ্রহণ করে, তো করবে। মিতু মন্দ উপার্জন করে না। এই কাজটা শখ করে ও শিখেছিলো। আঁকাটা ওর ভালো আসে। দাদাদের পাঞ্জাবিতে, টি-শার্টে ও-ই তো রং দিয়ে এমন কিছু এঁকে দ্যায় যে, তার রূপ পাল্টে যায়।
এই তাদের মোটামুটি পারিবারিক হিস্ট্রি। কেউ কেউ বলে, হিস্ট্রি নয়, মিস্‌ট্রি। পার্‌ব্বতি বাবুর ছেলেদের উন্নতি দেখে বয়স্করা বলতো, বাপের নাম পোটাচুনি, ছেলের নাম চন্দ্রবিল্লেশ। অর্থাৎ সামান্য করণিকের ছেলেদের এতো ফুটুনি কী? আসে কোথা থেকে! বাড়িতে এ.সি, এল.সি.ডি টিভি, আরো  কত কী! অবশ্য এগুলোকে ঈর্ষা বলে মানে ব্যানার্‌জী ভিলার শুভানুধ্যায়ীরা। বাবা ছেলেদের ডেকে বলেছিলেন,
--- তোরা যে যার মত উপার্জন করিস, তো ভালো কথা। তোদের এসটাব্লিশ্‌মেন্‌ট এক্সপেনডিচার আলাদা আলদা থাক। ডাক্তার-বদ্যি, বেড়ানো বা শপিং সব আলাদা হোক। কিন্তু খাওয়া-দাওয়াটা এক সঙ্গে রাখিস। সকলে সমান কন্ট্রিবিউট করবি। কে কত আয় করলো, সেটা কোন ফ্যাক্টর নয়।
ঠোঁটকাটা দীপু অমনি বলে উঠেছে--- কেন, বাবা? লোককে দেখাবে জয়েন্ট, আর অন্তরালে নিউক্লিয়াস?
--- না রে। এতে নিজেদের মধ্যে একটা সমতা থাকে। দ্যাখ, আলাদা হতে আর কতক্ষণ! কিন্তু একসঙ্গে বেঁধে থাকা খুব কষ্টকর। ঝগড়া হোক, বচসা হোক। খাবো একসঙ্গে। ছেলেমেয়ে পড়বে নিজের সামর্থ্য মতো নিজের স্কুলে। যার যা সামর্থ্য। কিন্তু দিনে অন্তত দু-বার এক টেবিলে বসবো, একই ব্যঞ্জন খাবো। আমাদের ঠাকুরদাদের আমলে কেউ চাকরী করতো না। তাদের কোনো ব্যক্তিগত উপার্জন ছিলো না। একটাই জমি ছিলো। তারা যৌথ থাকতে বাধ্য ছিলেন। সেটা কোন কৃতিত্ব নয়। কিন্তু তোরা আপন কৃতিত্বে এক আহারে থাক।
সেই থেকে ওরা আজ পর্‌যন্ত লাঞ্চে আর ডিনারে আছে এক সঙ্গে। আজকের দিনটা পার হলে ওরা পোলিসে যাবে। এটা স্থির হয়ে আছে। পোলিস জানলে তো নানা সমস্যা। গোটা পাড়া জানবে। এখনও পাড়ায় অনেকে জানে না। বাড়ি আর আত্মীয়দের মধ্যে ব্যাপারটা গোপন আছে। আজও ওরা সবাই মিলে রাতে খেতে বসেছে। দিনে প্রায় খাওয়া হয়নি বললেই চলে। সঙ্গীতা যে সারাদিন ধরে চোখ মুছতে মুছতে মানুষগুলোর জন্যে রেঁধেছে, এবার তার সদ্ব্যবহার হবে। টেবিল জুড়ে বসেছে ভাইবোনেরা। চৈতালি আর তার বর-ও আছে। কিন্তু একটা প্রশ্নের মুখে পড়েই পার্‌ব্বতিবাবু যে এক খাবার টেবিলে বসে খাবার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা চকিতে কোথায় উড়ে গেলো। সবটাই তো মানসিকতার ব্যাপার। হৃদয়ে যদি বিশ থাকে, তবে একান্নই বা কী, আর পৃথগন্নই বা কী!  
বড়ভাই শুভঙ্কর ফেরেনি অফিস থেকে। ফোন করে সে জানিয়েছে, তার ফিরতে একটু রাত হবে। কারণটা জানায় নি। তাই খাওয়ায় সঙ্গীতাও বাদ। ছোটদের খাওয়া শেষ। যার যার ঘরে তাদেরকে পাঠানো হয়ে গেছে। সঙ্গীতা নীরবে অশ্রু মোচন করতে করতে সকলকে রাতের খাবার দিয়ে চলেছে। প্রথম রাতটাতে খাওয়ায় একটা বড়ো রকমের অনীহা ছিল সকলের। দ্বিতীয় রাতে তারাই না নারে খাবার প্রবেশ করিয়েছে উদরে। পেটও তো কারোর মায়ের নয়, বাবারও নয়। তাকে তার রসদ জোগাতে হবেই হবে। কিন্তু আজ এ কদিনেই বাবার এই নিরুদ্দেশ যেন কেমন একটা অভ্যেস হয়ে গেছে। দিব্যি সকলেই খেতে বসে গেছে। কে ভাত, কে রুটি--- তা ভাগাভাগি হয়েও গেছে। এমনকি দীপঙ্কর সঙ্গীতাকে একবার দু-বার বলেওছে,
--- বৌদি, তুমি এতো কাঁদছো কেন? আমরা তো চেষ্টা করে যাচ্ছি। আর বাবার তো কোনো খারাপ খবর আসে নি।
দীপঙ্করের বৌ তালে তাল দিয়ে বলেছে--- দ্যাখোনা। আমি কতবার বলেছি।
সঙ্গীতা উত্তর দিয়েছে--- কাঁদছি না তো, ভাই। জল যে বেরিয়ে আসছে। তাকে রুখবো কী করে?
--- নিজেকে সামলাও। তা নয়তো অসুস্থ হয়ে পড়বে যে।
--- তুমি ভাবতে পারছো, একটা মানুষ রিটায়ার করে এলো, কারোর সাথে ঝগড়া-ঝাঁটি নেই, কথা কাটাকাটি নেই, হঠাৎ বেমালুম উধাও হয়ে গেলো। এটা কি মেনে নেওয়া যায়!
দীপঙ্কর আর একটু যোগ করলো--- তুমি কি খেয়াল করেছো বৌদি? বাবা যবে থেকে লেখালেখি শুরু করেছিলো, বাবার মধ্যে কিন্তু একটা চেঞ্জ আসছিলো। লেখক-টেখক হলেই মানুষের এমন অবস্থা হয়। আমি দেখেছি। তারা এক একটা আজব আজব কাণ্ড-কারখানা করতে শুরু করে। সংসার সম্বন্ধে একদম ভাবে না।
--- কী বলছো তুমি, দীপু! প্রতিবাদ করে সঙ্গীতা--- বাবা সংসার সম্বন্ধে ভাবেন না! তাহলে ভাবেটা কে? এরকম করে বোলো না তুমি।
এমনিতেই এইসব ব্যাপার নিয়ে কোন বেশী কথা বলতে মোটে ভালো লাগে না সঙ্গীতার। তাই দীপঙ্কর আরো কি কি যেন বলে গেলো, তা শুনলো না সে। শুনলো জামাই বিমান। সে একটা মন্তব্য জুড়েই দিলো,
--- তোমরা যে যাই বলো, মনে হয়, ওই ম্যানেজারের কথাটাই ঠিক।
টেবিলে বড়ো বলতে তখন দীপঙ্কর। তাই সে একটা মৃদু আক্রমণ করলো--- তাই? তা তুমি কী করে এমন একটা ডেফিনিট সিদ্ধান্তে এসে যাচ্ছো? আমরা যারা বাবার সাথে চব্বিশ ঘণ্টা থাকি, তারাই একটা ডেফিনিট কনক্লুসনে আসতে পারছি না। আর তুমি বাইরে থেকে দুম করে বলে দিলে!
সামলে নেয় বিমান--- না, আমি কোনো কিছু মীন করতে চাইনি। আসলে শাশুড়ি মা চলে যাওয়া ইস্তক উনি কেমন যেন মুষড়ে ছিলেন। মা-র বিচ্ছেদটা বোধহয় উনি মেনে নিতে পারেন নি।
চৈতালি তার স্বামীর কথায় তাল ঠোকে। না, আমার মনে হয়, ইস্যু-টা মিতু। মিতুর ঘটনাটা ঘটে যাবার পর থেকেই তো বাড়ির আবহাওয়া বদলে গেলো। মা বিছানা নিলো, বাবা মুখ ফুটে কিছু বলতে পারতো না। তাই না?
একসঙ্গে খেতে বসা বড়ো মধুর কেননা নানা রসের কথা দিনান্তে হয়। কিন্তু যদি তা নিয়ন্ত্রিত না থাকে, তবে তা খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে দ্যায়। সেই বিষ পার্‌ব্বতি বাবুর সন্তানেরা মিশিয়ে দিলো খাবারে আর পার্‌ব্বতি বাবুর স্বপ্নে। বিষটা ছিলোই। তোলা ছিলো মনের গভীরে। এক একটা ঘটনায় তা যেমন বেরিয়ে আসে, তেমনি বেরিয়ে এলো।
চৈতালির কথায় সকলে বিস্মিত চোখে তার দিকে তাকাতে চৈতালি কন্‌টিনিউ করলো--- মিতু যদি এভাবে না ডোবাতো, তবে বাড়ির পরিবেশ নষ্ট হতো না।
এমনটা বলা মাত্র মিতু কাঁদতে কাঁদতে উঠে যায় খাবার টেবিল থেকে। তার জীবনে একটা বিরাট দুর্ঘটনা ঘটেছে তো বটেই। আর তার জন্যে সত্যি বাবা-মায়ের মাথা নিচু তো হয়েছেই, দাদাদের পর্‌যন্ত হয়েছে। সেই থেকেই তো মিতু মাথা নিচু করে আছে এ বাড়িতে। একটা ছেলের সাথে ওর একটা সম্পর্ক ছিল। ওদের মধ্যে বিয়ে হবে, এমনটা স্থিরও ছিল। হঠাৎ তিন বছর আগে হোলিখেলার দিন খেলায় খেলায় ওরা একটা আদিম পাপ ঘটে গেলো। এটাকে পাপ বলে মনে করেনি মিতু কেননা ওদের সম্পর্ক ছিলো বাড়িতে স্বীকৃত। আজ বাদে কাল বিয়ে হচ্ছেই। সকলে মেনে নিলে এ সমাজের কতই না অপরাধ আদরণীয় আর কাঙ্ক্ষিত বলে স্বীকৃত হয়! কিন্তু তোমার আমার অজ্ঞাতে ঘটলে তা পাপ। মিতুর স্বীকৃত কাজ পাপে পরিণত হোল। মিতু যখন প্রেগন্যান্ট, তখন হঠাৎ একদিন ছেলেটা কোথায় হারিয়ে গেলো। একাবারে বেপাত্তা। তাদের বাড়ির মানুষও কোন খবর দিতে পারলো না। বরং তারাও বেশ ঘাবড়ে-টাবরে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করলো। দু-তরফেই খোঁজ পড়লো ছেলেটির। কিন্তু ছেলেটি? কিন্তু সেই যে গেলো, সেই তো গেলো, আর ফিরে তো সে এলো না। কেউ বললো, দ্যাখো গে, উগ্রপন্থীদের দলে ভিড়ে গেছে। যে ইউনিভারসিটির ছাত্র! কেউ বললো, না রে না। বাড়ির লোক চুপচাপ বিদেশ-ফিদেশ পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন ঠোঁট উল্টে বসে আছে। বাড়ির মানুষ বললো,
কিন্তু ছেলেটার বাড়ির লোক বললো--- বিশ্বাস করুন। আমরা এর বিন্দু-বিসর্গ জানি না।
ফলে মিতুর মাতৃত্ব কাল ছিল ভালো, আজ হোল পাপ। কোনো স্টেপ নেওয়া যাচ্ছে না। জানাজানি হয়ে গেলে তো...। মেয়ে সন্তান বলে কথা। একেবারে ঢেঁড়া পড়ে যাবে। ফলে কিল খেয়ে কিল চুরি করে মিতু বাধ্য হোল অবশেষে এ্যাবোর্‌ট করতে। মা হওয়া তার হোল না, বধূ হওয়া তো দুরাশাই রইলো। বিষয়টা চেপে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করা গেলো বটে কিন্তু সব অঞ্চলেই রয়টার বা পিটিআই থাকে, থাকে চুড়েল ঔরৎ, যারা ফ্রী ল্যানসার শুধু নয়, ফ্রী অব কস্টও বটে। কোনো একটা খবরকে চট্‌ জলদি আরো সন্‌সনি খবর করে তুলে কান থেকে কানান্তরে, জ্ঞান থেকে জ্ঞানান্তরে, পাড়া থেকে পাড়ান্তরে পৌঁছে দেবার সামাজিক দায়িত্ব তাদের। ফলে মিতুর গোপনীয়তা একেবারে উন্মুক্ত গোপনীয়তা হয়েই গেলো। তাতে মিতুর বিয়ে হওয়াটাই প্রায় আট্‌কে গেলো। মানুষ একদিন সব নাকি ভুলে যায়। ভয়ঙ্কর সন্তান শোকও নাকি একদিন পিতা-মাতার স্মৃতি থেকে মুছে যায়। ওদের পাড়াতেও গেলো। অনেকেই আজ ডেকে কথা-টথা বলে মিতুর সাথে। সে আর অচ্ছুত অস্পৃশ্য নেই। কিন্তু যেহেতু আয়নায় দাগ লাগলে তা আর উঠতেই চায় না, তেমনি ওর নতুন জীবন শুরু করাটা রয়ে গেলো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
কিন্তু দীপঙ্কর মেনে নিলো না চৈতালির বাইরে থেকে এমন মন্তব্য। এ বাড়ির সাথে তার তো বিগত আট বছর নিত্য যোগাযোগ নেই। তাই এই সংসারের হার্ট, পাল্‌স, কিডনি ইত্যাদি ফাংশান সে জানবে কেমন করে! তবু এমন মন্তব্য কেন? তাই সে জানিয়ে দ্যায়,
--- দ্যাখ চৈতি, তোর বিয়ে হয়ে গেছে আজ আট বছর। এখন দুমদাম মন্তব্য করিস না।
--- কেন? আমি কি এ বাড়ির কেউ নই? বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েদের কি বাপের বাড়ির সাথে কোন সম্পর্ক থাকে না?
--- থাকবে না কেন? আমি তো তা বলতে চাইনি। কিন্তু তাদের বাপের বাড়ির যে কোন বিষয়ে ঠিকঠাক না জেনে মন্তব্য করা উচিত নয়।
বিমান এতক্ষণ চুপ করে ছিলো। এই ফাঁকে সে টুক করে আর একটা মন্তব্য ছোঁড়ে--- আপনি এভাবে বলছেন কেন, ছোড়দা! চৈতালি তো একটা আলোচনা করতে গিয়ে কথাটা বলেছে। কোন দোষ দিতে বলেনি। আর সত্যি তো সত্যিই।
এবার যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে মেজো বৌ--- আপনি বিমান দা, কোনো কথা না বললেই ভালো হয়। আমাদের কার যে কী রেকর্ড, তা কি বাবা জানতেন না নাকি? সবাই সব জানে। কেউ ধোয়া তুলসী পাতা নয়।
বিমানের জীবনেও পাপ আছে। বাস্তবে বিমানের চরিত্র দোষ ধরা পড়েছিলো বিবাহের পাঁচ-ছ বছর পর। সে নিয়মিত ইভনিং ক্লাবে যায় আর সেখানে নানা পরকীয়া চলে। শুধু সে নয়, অনেকেই এমনটা করে। এক্সচেঞ্জ পার্টনারে নাচ-ফাচ হয়। চৈতালির সাথে তার ঠাণ্ডা লড়াই লেগেই আছে। ব্যাপারটা জানাজানি হয়েছে বলে সে শ্বশুরবাড়িতে প্রায় আসে না বললেই হয়। চৈতালি কখনও কখনও বিমানকে ফোর নাইন্‌টি এইট.এ-র হুমকিও দিয়েছে। আজকাল আইন মেয়েদের এতটাই সাপোর্টে গেছে যে, বেশ ভয় পেয়ে গেছে বিমান। তাই আজকাল বউকে একটু কারণে অকারণে এবার সে চেঁচিয়ে ওঠে,
--- দ্যাখো মেজোবৌদি, তুমি কিন্তু আমাকে অপমান করছো।
মেজো বউদি আবার কামড়ায়--- ও! আমি অপমান করছি বুঝি! আর আপনি কী করলেন? মিতুর খাওয়ার বারোটা বাজালেন!
--- আমি একজন পুরুষ মানুষ। আমার জীবনে সত্য-মিথ্যে স্ক্যান্‌ডাল থাকতেই পারে। আর আমি তো এ বাড়িতে থাকি না। আমার সঙ্গে তোমাদের বাবা-র ম্যান-অভিমানের কোন ব্যাপার তো নেই।
শুভমিতা আবার ঝাঁপায়--- হ্যাঁ, পুরুষ মানুষ বলে ষাঁড়ের মতো রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াবেন আর গাই পেলেই চেপে ধরবেন! আর চৈতিরও কোনো হায়া নেই। নিজের স্বামীকেও তো আটকাতে পারো না। আবার কথা বলো! তুমি কি মনে করো, এসব বাবা-র মনে কোন প্রভাব ফেলতো না?
এখানে দীপঙ্কর ইন্টারফেয়ার করে--- শুধু তাই নয়, বিমান। চৈতি নিজেই তো বাবাকে তোমাদের ব্যাপারটা জানিয়েছে। বাবা যে তোমাদের ব্যাপারে আহত ছিল না, একথা তোমাদের কে বললো? বাবা তো মিতুকে এ্যাক্সেপ্ট করে নিয়েছিলো।
চৈতালি তবু হাল ছাড়ে না। কুস্তিতে নীচে পড়ে মার খেলেও পা ওপরে তুলে দিয়ে বলবে, দ্যাখ, কেমন দিলাম। তর্কযুদ্ধে বিরত না হয়ে সে জানালো--- তাই বলে মা আমাদের কারণে অসুস্থ হয়নি। এটা তো স্বীকার করবি, মেজদা।
বস্তুত সকলেই ভুলে যায় যে, আজকের মূল প্রবলেম হলো পার্‌ব্বতি বাবুর অন্তর্ধান। তাকে কোথায় গেলে পাওয়া যাবে, কিভাবে পাওয়া যাবে, কে কোন দিকটা দেখতে পারে--- এসব আজকের আলোচ্য বিষয় হওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু তার পুত্রকন্যা যখন তা মনে রাখছে না, তখন জামাইয়ের আর কী দায়! কথায় বলে, জন-জামাই-ভাগনা/তিন নয় আপনা। কথায় কথায় তারা নিজের নিজের স্তর থেকে নেমে আসে অনেকটা।
বিমান নতুনভাবে আক্রমণটা হানে--- যদি কিছু মনে না করেন, দাদা, তবে আপনাকেও বলতে পারি।
--- আবার আমাকে! কী বলবে? আমার পেছনেও কি টিকটিকি লাগিয়েছো?
--- কেন? আমি একা কেন? সবাই জানে। আপনি বাবা-র থেকে টাকা নেওয়া সত্বেও শ্বশুরবাড়ি থেকে পর্‌যন্ত টাকা নিয়েছেন ব্যবসার জন্যে। এটাও বাবা-র কাছে কোন অপমান নয়, বলতে চান? তাছাড়া মাঝে মাঝেই আপনি লোডেড হয়ে বাড়ি ফেরেন। সে সময় আপনার মুখ দিয়ে যে ভার্নাকুলার বেরোয়, তা একদিন তো আমার শোনার সৌভাগ্য ঘটেছে। বাবা কি এসব দেখেন নি?
এ কথায় রেগে যায় দীপঙ্কর। হুঙ্কার দিয়ে বলে--- আমাকে এটা করতে হয় ব্যবসার খাতিরে। বাংলা আমি খাই না। পার্‌টিতে যাই, স্কচ-হুইস্কি ছাড়া চলে না সেখানে।
--- না, ওগুলো তো মদ নয়। হেল্‌থড্রিঙ্ক। তাই না?
--- বাবা এটা মেনে নিয়েছিলেন, তা কি জানো?
--- হ্যাঁ, মেনে নেবেন তো বটেই। ওই যে লোকে বলে না, ছেলে করলে লীলা/আর জামাই করলে বিলা।
এর সাথে চৈতালি সরাসরি ওপর দিকে থুথু ছেটাল--- তাই শুধু কেন? দাদা তো বিয়ে করে এনেছে সাহা বাড়ির মেয়ে। জাত-পাত শুধু নয়, বাবা তো কালচারের ডিফারেন্সটাকেও একটা ফ্যাক্টর বলে মানতো। এটা ছোটোবৌদি জানে, আর তাই বাড়ির ঠাকুরঘরে যেতে আজও ভয় পায়। বাবাকে এইসব মেনে নিতে হয়েছিলো।
এটা মিথ্যে নয়। শুভমিতা বিয়ে হয়ে আসার পর থেকে কেন, ছোটবেলা থেকে দেখেছে, ওটা বামুন বাড়ি, আর এ বাড়ি সাহা বাড়ির বৈষম্য। এটা শৈশব থেকে ওর মনে গেঁথে গেছে। এই দু-রকম বাড়ির মধ্যে ছোঁয়াছানির ব্যাপার অবধি আর পাঁচটা শিশুর মতো ও-ও দেখেছে। ওর মা প্রাচীনপন্থী। তাই প্রথম দিন দীপঙ্করকে দেখে আর ওর পরিচয় না জেনে শুধু ও কোন বাড়ির ছেলে এইটুকু শুনে প্রদীপ-টদীপ জ্বালিয়ে দীপঙ্করকে প্রণাম অবধি করতে গিয়েছিলো। দীপঙ্করই লজ্জায় দৌড়ে দাপিয়ে পালিয়ে শাশুড়ির মান রক্ষা করেছিলো। হবু শাশুড়ি তো জানতো না যে, যুগ বদলেছে, আর এই বামুন বাড়ির ছেলেই তার বাড়ির জামাই হতে চলেছে। ফলে আমরা-তোমরার ব্যাপারটা রয়েই গেছে পুত্রবধূ আর তার শ্বশুরবাড়ির মধ্যে। চৈতালির কথাটা একেবারে ফেলে দেবার কথা যে নয়, তা জানে শুভমিতা।
বিমান খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে যাবার আগে শেষ কামড়টি দিয়ে যায়। বলে যায়--- বড়দাকেই বা বাদ দেবো কেমন করে? দাদা যে ব্যাঙ্কে কেলেঙ্কারি করে এ্যারেস্ট হলেন, সেটা কি ভুলে গেলেন? তার রেকর্ডটা আর ফর্সা রইলো কোথায়?
সঙ্গীতা এইটুকু শুনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। মনে মনে হয়তো ভাবে, একেই সে এতক্ষণ আদর করে খাবার পরিবেশন করছিলো। একটা ইস্যু ছেড়ে একে অপরের গায়ে এভাবে কাদা ছুঁড়তে দেখে সে ঘেন্নায় মরে যায়। সেখান থেকে সে সরে যায়। কিন্তু দীপঙ্কর দাদা-র বদনামের প্রতিবাদ করতে ছাড়লো না,
--- ছি ছি বিমান! মানুষটা এখানে নেই। এখন সে অফিস থেকেই ফেরেনি। আর তাকে তুমি টানছো, বিমান! আশ্চর্‌য!
--- টানছি না। বলছি। বলে কৈফিয়ত দ্যায় জামাই বিমান।
--- তাহলে শুনে রাখো, দাদা কিন্তু বেকসুর খালাস পেয়েই অন্য ব্যাঙ্কে একটা আরো হোমরা-চোমরা পোস্টে চাকরী করে।
হ্যা হ্যা করে হাসে বিমান। অত্যন্ত অর্থপূর্ণ সেই হাসি। দেখে গা-টা জ্বলে যায় দীপঙ্করের। বিমান জানায়--- কিভাবে কোর্ট থেকে বেকসুর খালাস পাওয়া যায়, আর কিভাবে অন্য ব্যাঙ্ক এ্যাপয়েন্‌টমেন্‌ট দ্যায়, তা আপনি-আমি সবাই জানি।
ঘটনাটা বেশ তাজা খবর ছিলো। বছর দুয়েক আগে শুভঙ্কর এ্যারেস্ট হয়। অভিযোগ ছিলো, সে গোপনে টাকা খেয়ে নানা কাস্‌টমারকে ব্যাঙ্কলোন পাইয়ে দিতো। পরে সেইসব কাস্‌টমারদের কোন খোঁজ পাওয়া যেতো না। ফলে ব্যাঙ্কটি একটা আর্থিক আঘাত খেয়ে প্রায় বসে পড়েছিল। তখন শুরু হয় ধর-পাকড়। অবশ্য পরে বাদীপক্ষের আইনজীবী আদালতে তেমন কোন এভিডেন্স প্রডিউস করতে না পারায় কোর্ট শুভঙ্করকে বেকসুর খালাস করতে বাধ্য হয়েছে। আগের ব্যাঙ্ক ছেড়ে সে অন্য একটি ব্যাঙ্কে জয়েন করে। বাড়ির লোক জানতো যে, দাদা টাকা খায়। দাদার ব্যয় বাহুল্য দেখে, বিদেশ ট্যুর দেখে এমনকি পার্‌ব্বতি বাবু পর্‌যন্ত আন্দাজ করেছিলেন, কোথায় একটা গলদ আছে। এটা তাঁর কাছে আঘাত যে নয়, সেটা জোর দিয়ে বলা যাবে না। কিন্তু বড়দা বলেই কেউ ঘাঁটায়নি। আসলে পার্‌ব্বতি বাবুর সংসার যেন বালুকা স্তুপের মধ্যে কুকুর বিষ্ঠা। কোদাল দিয়ে একটা ঘা মারলেই ছেত্‌রে যাবে আর দুর্গন্ধ ছড়াবে।
এর মধ্যে কলিং বেল বাজে। সবাই বোঝে যে, বড়দা এলো। গম্ভীরভাবে সঙ্গীতা দরজা খুললো কিন্তু একটা কথাও বললো না। শুভঙ্কর বাড়িতে ঢুকে দীপঙ্করকে ডেকে নিলো নিজের ঘরে। খাওয়া হয়ে গিয়েছিলো সকলের। হাত শুকোতে শুকোতে একে অপরের গায়ে এঁটো ছুড়ছিলো। বিমান নির্লজ্জের মতো চলে গেলো তার নির্দিষ্ট করা শয়নের স্থানে। ঘরটাও তখন প্রস্তুত করছিলো সঙ্গীতা নিজে। তার সামনা-সামনি পড়তে একটু অস্বস্তি হোল তার। এই মহিলা কোন কথা বলে না। বিমান মাথা নিচু করে ঘরে ঢোকে। ওদিকে শুভঙ্কর সঙ্গীতাকেও ডেকে নিয়েছে নিজের ঘরে এবং তারপর যা সে বলে, তাতে উভয়েরই বিস্ময়ের সীমা থাকে না। এমনটা যে হতে পারে, তা কল্পনাও করতে পারে না বক্তা অথবা শ্রোতা।
দীপঙ্কর বললো--- আজ বাবাকে কেন্দ্র করে যা হয়ে গেলো, তাতে মনে হচ্ছে, এসব জানলে তো একেবারে সাড়ে সর্‌ব্বনাশ।
সঙ্গীতা সব শুনছিল। সাধারণত প্রশ্ন না করলে সে কিছু বলে-টলে না। কিন্তু আজ সে কঠিন মুখে বললো--- এতক্ষণ যে কাদা ছোড়াছুড়ি করে এলে, তাতে এবারে ওই মানুষটাকে নিয়ে আর পড়ো না।
--- আর পড়বো না, কী বলছো! কটাদিন বাদে সবাই পড়বে। শুভঙ্কর তার অনুপস্থিতির নাটকটা না জেনেই জানালো।
--- এই বয়সে এটা কি তুমি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করো?
এবারে শুভঙ্কর তার স্ত্রীকে বোঝাবার চেষ্টা করে। বলে--- দ্যাখো, মা পাঁচ-পাঁচটা মাস বিছানায় ছিল। তারপরে আজ একটা বছর কেটে গেছে। বাবাকে তো তুমি দেখাশুনো করতে। তুমি তো জানো, বাবার মধ্যে কিন্তু একটা ইয়ুথ ছিলো।
কানে হাত দ্যায় সঙ্গীতা। লজ্জায় সে দেওরের সামনে দাঁড়াতে পারে না। বলে ওঠে--- চুপ করো তুমি। চুপ করো।
যে ঘটনা শুভঙ্কর বলেছে, তা হোল এই যে, তার হঠাৎ লোকাল সিনিয়ার সিটিজেন্স ফোরামের কথা মনে পড়ে যায়। সেই ফোরামের সেক্রেটারি দুর্গাপদ বাবু সাথে সে দেখা করে এসেছে। তিনি জানিয়েছেন যে, পার্‌ব্বতি বাবু সিনিয়ার সিটিজেন্স ফোরামে গিয়ে আড্ডা-টাড্‌ডা দিতেন। সেখানে একটি ডিভোর্সি মহিলার সাথে তার বিশেষ আলাপ হয়। ভদ্রমহিলা একাই থাকতেন। নিঃসন্তানা।। চাকরী করেন এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে। গতকাল থেকে তার বাড়িতেও তালা ঝুলছে। তিনি যে কোথায় গেছেন, তার খবরও কেউ জানে না। বাড়িওয়ালা জানায় যে, দু-দিন আগে পার্‌ব্বতি বাবু ও বাড়িতে গিয়েওছিলেন। এবারে ঘটনাটা বুঝতে কারোর বাকি থাকে না। সিটিজেন্স ফোরামের মেম্বাররা বলছেন যে, তারা নাকি পার্‌ব্বতি বাবুকে আর মহিলাকে নিয়ে নানা ঠাট্টা-তামাশাও করতেন। ফলে শুভর কাছে গোটা ব্যাপারটা এলোমেলো হয়ে যায়।
দীপঙ্কর বলে--- এবার যদি দুইয়ে দুইয়ে চার করতে হয়, তাহলে ব্যাপারটা এরকম দাঁড়াচ্ছে যে, বাবা ঐ মহিলাকে নিয়ে আলাদা কোথাও সংসার জমিয়েছে।
শুভঙ্কর বলে--- এটাই তো হওয়া স্বাভাবিক। অঙ্ক তো এটাই বলছে।
আবার অঙ্ক মিলিয়ে দীপঙ্কর বলে--- তাহলে পরিষ্কার হোল যে, বাবা রিটায়ারমেন্টের টাকা-পয়সা পেয়ে সোজা বেরিয়ে গেছে। তাই তো? বাবা তো আমাদের সাথে পোস্ট রিটায়ারমেন্ট কোন ডিসকাশনও করে নি।
--- হ্যাঁ, বাবা টাকা পেয়েছে ধর্‌ অন্তত লাখ বারো। এতো বছরের সার্ভিস।
--- কিন্তু এ বাড়িটার কী হবে? এমনটা বাবা করলে এটাও তো আমরা হারাবো। সে মহিলা কী ছাড়বে?
--- মানে! আকাশ থেকে পড়ে শুভ।
এবার দীপু নিচু গলায় গেয়ে ওঠে--- ও মন তল্পিতল্পা নিয়ে এবার ভালোয় ভালোয় কেটে পড়ো। দাদা, তুই জানিস না। বাবাকে কেন্দ্র করে এতক্ষণ কী হলো, কী হোল না!
সঙ্গীতা আজ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সে পরিষ্কার জানায়--- বাজে কথা বলবে না, দীপু। তোমরা এতক্ষণ যা করেছো, যা বলেছো্‌, তা তোমাদের মনের মধ্যে থাকা পাপ। বাবা এখানে কোথাও নেই, ছিলেনও না।
দীপঙ্কর কিছু একটা বলতে গিয়েছিলো কিন্তু সঙ্গীতা ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দ্যায়--- তুমি আমার কথা শোনো, দীপু। শুধু দেবর নয়, নিজের স্বামীকেও ইঙ্গিত করে সঙ্গীতা--- আর তুমিও শোন। এ কথা যেন তোমাদের মুখ থেকে এই ঘরের বাইরে না যায়। এবার বাবাকে বাবার মতো করে বাঁচতে দাও। আমি জানি না, আসলে কী হয়েছে। তবে যদি তোমরাই সত্যি হও, তবে তার জীবনকে এতোটা মন্দ চোখে দেখোনা।
এ কথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সঙ্গীতা। কিন্তু তখনও দুই ভাইয়ের মাথা থেকে তৃতীয় চিন্তা যায় নি। যদি বাড়ি ছাড়তেই হয়, তবে মিতুর কী হবে! সে তো অর্থনৈতিক এতোটা স্বচ্ছল নয় যে, দুম করে একটা ফ্ল্যাট কেনা বা বাড়ি বানানো ওর পক্ষে সম্ভব হবে। রাতে তাদের ঘুম হয়নি এভাবে আলোচনা করতে করতে। একটা সিদ্ধান্তে তারা সকলেই আসে। ঠিক হয় যে, পরেরদিন আর অপেক্ষা নয়। এবার পোলিসকে জানাতে হবে। তাতে যদি বাড়ির সম্মান যায়, যাবে। এভাবে তো আটকানো যাবে না। বাবার এমন ম্যারেজটা এ দেশের আইনে কতটা সঙ্গত, এটা নিয়েও একটা কথা বলতে হবে। দেরী হলে ঢিল হাতের বাইরে চলে যাবে। 
একটা নিশ্চিন্ত, নির্ভাবনা আর নিরুপদ্রবে চলা পরিবারে যে দুর্ঘটনা কেমন ভাবে নেমে আসে, তা এ বাড়ির মানুষ আজ বুঝলো। বাবা যদি বাড়িটা তাঁর নতুন সংসারকে লিখে না দিয়ে থাকেন, তবুও এখানে আর বসবাস করা যাবে না। এটাতে কারোর কোন সন্দেহ থাকে না। মানুষের প্রভাত অতিক্রান্ত হয় ঈশ্বরের নামে অথবা খবরের কাগজে টাটকা খবরে। কালকের টাটকা খবরে মানুষ তাদের পরিবারের কেচ্ছা জানবে এমনই কোন খবরের কাগজে। গতকাল কাউকে না বলে নানা সোর্স মারফৎ শুভঙ্কর নানা হাসপাতালেও খোঁজ-খবর নিয়েছে। কিন্তু কোথাও কোন খবর মেলেনি। ব্যানাজ্জী ভিলার সকাল হোল সকলের চোখে নানা সন্দেহ নিয়ে। জামাই বিমান বিদায় নিতে গেলে চৈতালিকে শুভঙ্কর আটকে দ্যায়। বিমানকে বলে,
--- বিমান, তুমি না হয় তোমার কাজে বেরিয়ে পড়ো। অফিস ফেরত পারলে এসো। আমাদের একটু ডিসকাশন আছে।
শুভঙ্কর স্ত্রী সঙ্গীতাকে বোঝায় যে, ডেফিনিট করে কিছু না জানলেও তো বিষয়টা জানা উচিত। সারকাম্‌সট্যান্সেস তো তাই বলছে। সঙ্গীতা কোন উত্তর দ্যায় না। বিষয়টা মিতুর সামনে ফেলা হয়। দাদাদের কাছে গোটা ব্যাপারটা শুনে মিতু বলে,
--- আমায় তোরা কী করতে বলিস, দাদা?
--- কী যে বলি, দাদা! এমনটা না দেখেছি, না শুনেছি। অসহায় দীপঙ্কর জানায়।
--- না, ভাবতে তো হবেই। শুভঙ্কর বলে। --- কথায় বলে, প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর।
--- তার মানে, তোরা শিয়োর নাকি, বাড়িটা চলে যাবে হাত থেকে? আর্তনাদ করে মিতু।
--- না না। শিয়োর কী করে? সবটাই তো এ্যাপ্রিহেনশন।
লে সিগারেট ধরায় শুভঙ্কর। ছোট ভাইকেও একটা সিগারেট বাড়িয়ে দ্যায়। ধরফরিয়ে ওঠে দীপঙ্কর। কিন্তু দাদা জানায়--- অন্তত এখন তো খা। ব্যবসায়িক বুদ্ধিটা বের কর তো। একটা চক্রব্যূহে পড়ে গেছি। বেরোবার পথ তো বের কর।
কিন্তু কোন পথ তো বের হয়ই না, বরং ওদের পথের সন্ধানকে আরো  জটিল করে দ্যায় সিনিয়ার সিটিজেন্স ফোরাম। সেক্রেটারিকে নিয়ে তাদের কয়েকজন আসেন আটটা নাগাদ। সঙ্গে একটি মহিলা। তখন সবে এ বাড়ির সকলে চা খেয়ে রেডি হচ্ছে, যাবে থানায়। ডায়রিটা এবার লেখাতেই হবে। তবুও বয়স্কদের বসতে দেওয়া হোল। মহিলাটির সাথে আলাপ করিয়ে দেওয়া হোল এই পরিবারের। এবার ওরা জানতে পারে যে, এই সেই মহিলা যাকে কেন্দ্র করে নানা সন্দেহ দানা বেধেছে। ভদ্রমহিলার নাম অরুন্ধতী দেবী। আজ থেকে পনেরো বছর তিনি  আগে ডিভোর্স করেছেন স্বামীকে, অথবা তাঁর স্বামী টাকে ছেড়েছেন। তারপর মহিলা নিজের উদ্যোগে চাকরী পেয়েছেন। ঘরে তখন যেন একটা আলপিন পড়লেও শব্দ হবে, এমন নৈশব্দ। মহিলা বলেন,
--- আমার সঙ্গে পার্‌ব্বতি বাবুর আলাপ ব্যাঙ্কে। আমাকে নানা সময়ে ব্যাঙ্কের কাজে নানা সাহায্য করেছেন তিনি। অতি সজ্জন মানুষ।
সকলেই ভাবছে, সজ্জন তো ভালো। এর পরের ঘটনাটা দয়া করে বলো। তুমি কি সজ্জন? ভালো বা মন্দ তো হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বাড়ির মানুষেরা। এখন আসল কথাটা বলে ফেললেই তো হয়। তোমরা কতদূর এগিয়েছো? শুভু, দীপু, মিতু বা চৈতি সকলেই একটা দোলনার ওপরে একবার এদিক, একবার ওদিক দোল খাচ্ছে। কিন্তু অরুন্ধতী দেবীর কথা সকলের একগাল মাছি ফেলে দিলো,
--- আমি শুনলাম, আপনারা আমার বাড়িতে গিয়েছিলেন। যদি আমি কিছু ইনফরমেশন দিতে পারি। কিন্তু আমি তো ছিলাম না এখানে। আসলে আমার একটি বোন আছে। উইডো। ও বাথরুমে পড়ে  গিয়ে বাঁ পা-টা ভেঙ্গে বসে। আমি তার ওখানে টালিগঞ্জে গিয়েছিলাম। ওকে নিয়ে ফিরে এসে এই খবরটা শুনি। আমি তো শক্‌ড।
ঘরে তখনও সেই আলপিন নীরবতা। সঙ্গীতা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কান্না লুকোতে ভেতরে ঢুকে গেলো। তার মনে হোল, বাড়ির সকলের আলোচনায় আর প্ররোচনায় সে নিজেও কখন শ্বশুরমশাইকে আবার বিবাহিত হয়েছেন বলে ভাবতে শুরু করেছে। বাড়ির বিষাক্ত আলোচনা তার মনকেও বিষিয়ে দিয়েছে।
--- আপনারা পোলিসে যান নি? এ্যাটওয়ান্স যান। অরুন্ধতী দেবী পরামর্শ দেন। নিজেরা খোঁজাখুঁজি করে আর দেরি করবেন না।
বাড়ির কেউ কেন পোলিসে যায় নি, সে কথা এই মহিলাকে বলে আর কেউ কলঙ্ক বাড়াতে চাইলো না। কিন্তু মহিলা বললেন--- এতক্ষণ তিনি অন্তর্ধান রয়েছেন। কোথায় কী হয়েছে, কোনো গ্যারান্টি আছে কি?
এবার আনুষ্ঠানিকভাবে যাওয়া হয় প্রশাসনে।। অফিসারকে জানানো হয় গোটা ব্যাপারটা। একজন এস.আই. আসেন এনকোয়ারীতে। সকলকে তিনি এমনভাবে নানা প্রশ্ন করতে থাকেন যে, যেন সকলের মনে হয়, ওরা অপরাধী। বাবাকে গুম করে দিয়েছে কোনো অভীষ্ট সাধনে। তবু মুখে কেউ বিরূপ কিছু বলেনি। তাদের মন থেকে একটা বিরাট পাথর নেমে গেছে আর বাবা সম্বন্ধে এবার নানা দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। বাবা অতগুলো টাকা কী করলো, সেগুলো গেলো কোথায়, তবে কি বাবাকে কেউ কিডন্যাপ করলো! কৈ? কোনো র্যানসাম তো চাওয়া হয় নি। আবার একথাও মনে হল যে, হয়তো কেসটা থিতোলে চাওয়া হবে। এমনটাও তো হয়। কাগজে তো নানা খবর দ্যায়। সেগুলোর সাথে মেলাতে শুরু করে পুত্র-কন্যা-পুত্রবধূ। বিপদের স্তর কেটেছে। এবার সম্পদের ব্যাপারটা তো দেখতে হবে। এমনও হতে পারে যে, বাবাকে কেউ বা কারা একটা ফ্রডউল্যান্‌ট ইনভেস্‌টমেন্‌ট-এ আট্‌কে ফেলেছে। আজকাল নানা কায়দা করছে মানুষ। নানা রকম টোপ দিচ্ছে। মানুষ নিতান্ত একটু ভালো করে বাঁচার জন্যে সহজে সস্তায় কোনো উপায় খুঁজছে। সেটাই হচ্ছে ইম্পস্‌টারদের মোক্ষম সুযোগ। এখানে লটারি, ওখানে টাকা নিয়ে ডাব্‌ল করে দেওয়া, কী নয়! শুধু অশিক্ষিত গ্রামের মানুষ নয়, নিতান্ত শহরের শিক্ষিত মানুষও এদের চক্রে পা দিচ্ছে। বাবা হয়তো এদের হাতে নিঃস্ব হয়ে আর বাড়ি আসতে পারছে না।
পোলিস পার্‌ব্বতি বাবুর ঘরে ঢুকে কোনো চিহ্ন, কোন কাগজপত্র, কোন চিঠি-চাপাটি অনুসন্ধান করে কিছুই পেলো না। অফিসারটি বিফল মনোরথ হয়ে অগত্যা জানালেন,
--- আমার তো এককপি ফোটোগ্রাফ চাই মিঃ ব্যানার্‌জ্জীর।
এটাই কাল হোল। কোন পুত্রই বাবার কোন ফোটোগ্রাফ পোলিসকে দিতে পারে না। এমনকি সঙ্গীতা পর্‌যন্ত জানালো যে, বাবার সে রকম কোনো ফটো নেই। অফিসারটি এমনটা শুনে একটা বেমক্কা মন্তব্য করে বসলেন,
--- আপনারা নিজের বাবার কোনো ছবি আপনাদের কাছে রাখেন নি! তাঁর মৃত্যুর পর তাহলে কি তাঁর কোনো ছবি আপনাদের কাছে থাকবে না?
হঠাৎই এই কথাটায় সকলের খেয়াল হোল, বাবার ছবি তো দেয়ালে বাধানো অবস্থায় টাঙ্গানো আছে। সেটা তো দেওয়া যায়। কিন্তু ফ্রেম ভেঙ্গে দিতে হবে। সেটা সাম্প্রতিক ছবি নয়। বাবার অফিস থেকেই ছবিটা তুলেছিলো। সেটাকেই বাঁধিয়ে রাখা হয়েছিলো। তাই আজ সেটাকেই কাজে লাগলো। ছবিটা পাড়তেই তার পেছন থেকে বেরিয়ে পড়লো একটা চিঠি। সামান্য আঠা দিয়ে সাঁটা। ঝাঁপিয়ে পড়ে শুভঙ্কর চিঠিটা নিতে যেতেই এস.আই. ভদ্রলোক সেটা টেনে নিলেন। তিনিই খুললেন। মনে মনে পড়ে ফেললেন গোটা চিঠিটা। এটা পার্‌ব্বতি বাবুর অন্তর্ধানের পেছনে কোন ক্লু হতে পারে। কিন্তু চিঠি পড়ে একটু মুচকি হেসে তিনি সেটা তুলে দিলেন শুভঙ্করের হাতে। তার সাথে বললেন,
--- এটা আপনাদের জন্যে। আপনাদের বাবার লেখা নোট। পড়ুন।
সকলের সামনেই চিঠিটা মেলে ধরলো শুভঙ্কর। হুমড়ি খেয়ে পড়লো সবাই। দীপঙ্কর, শুভমিতা, চৈতালি, মিতালি। কিন্তু কোনো আগ্রহ দেখালো না সঙ্গীতা। যেন চিঠিতে কী লেখা, ওর জানা। চিঠিটাতে সকলকেই সম্ভাষণ করা হয়েছে। তারপর লেখা হয়েছে,
যখন তোমাদের হাতে এই চিঠি পড়বে, তখন আমি তোমাদের থেকে অনেক দূরে। না, ভয় পাবার কারণ নেই। আমি আত্মহত্যা করিনি। বেঁচে আছি। বহু দূরে আছি। এই কারণেই চিঠিটাকে এভাবে গোপন করে রেখেছি যাতে তোমরা একটু সময় নষ্ট করো আর আমি নাগালের বাইরে চলে যেতে পারি। দ্যাখো, তোমাদের জন্যে আমি বাবা হিসেবে তেমন কিছু করে যেতেও পারিনি, রেখে যেতেও পারিনি। সামান্য চাকরী করেছি। কত আর মাইনে পেয়েছি! কিন্তু শুভুকে কস্ট এ্যাকাউন্‌টস পড়ানো, দীপুকে এম.বি.. করানো, বাড়িটাকে সকলের বসবাস করার মতো করে গড়ে দেওয়া, চৈতির বিবাহ, মিতুর বুটিক, তোমাদের মায়ের চিকিৎসা--- এসব ব্যাপারে তোমাদের আমি কোন ভার নিতে বলিনি। আজ আমি নিঃস্ব। আমি যা করেছি, তা নিতান্তই সামান্য। প্রতিটি বাবাই এটুকু করতে চান। কেউ পারেন, কেউ পারেন না। আমি বাড়িটাকে পর্‌যন্ত বন্ধক রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, তোমাদেরকে ঋণে জড়াবো না। কিন্তু পেনশান বিক্রি করেও পুরো বাঁচাতে পারিনি। লাখ তিনেক এখনও বাকি আছে। বন্ধক আছে একটি ব্যাঙ্কে। তোমরা প্রতিষ্ঠিত। এটুকু অর্থ পরিশোধ করে বাড়িটাকে উদ্ধার করো। অবসর গ্রহণের পর বাড়িতে ফিরে তোমাদের থেকে যে আদর পেয়েছি, তা আমার সঞ্চয় হয়ে থাক। এটা আমি হারাতে চাই না। সারা জীবন স্বাধীনভাবে চলেছি। আজ কপর্দকহীন হয়ে কারোর দয়া, করুণা, সমবেদনা পেতে চাই না। এ আমি ভোগ করতে পারবো না। কিছুকাল আগে একটি ধর্মীয় সেবা সঙ্ঘের হয়ে আমি একটি আর্টিকেল লিখি। তখন তারা আমাকে পারিশ্রমিক দিতে চায়। কিন্তু আমি তা গ্রহণ করিনি। তারা জানিয়েছিলো, ভবিষ্যতে যে কোন সময় তারা আমার ডাকে হাজির হবে। আজ আমি তাদের সাথেই বহু দূরে। আজ আমি কোন পরিবারের নই। জনসেবায় যুক্ত। আমার সাথে এই সঙ্ঘের শর্ত, আমি এদের হয়ে লিখবো, এদের একটা ইতিহাস আমি তুলে ধরবো এদেরই একটি পত্রিকায়। এদের নাম গোপনই থাক। আমায় তোমরা খুঁজো না। চিনতেও পারবে না। সব শেষে বলি, তোমাদের অক্ষম বাবা কে ক্ষমা কোর।
                                                                        ভবদীয়,
                                                                শ্রী পার্‌ব্বতি চরণ বন্দ্যোপাধ্যায়
-------------------------