বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১২

বৃহন্নলা (ছোটগল্প)


বৃহন্নলা
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়

শ্রীদেবী মাজায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে চীৎকার করে বলছিলো--- এরা নিজেদেরকে পুরুষ ভাবে। পুরুষ, না হাতী। সব হিজরা। হাতে শুধু চুড়িটা পরে না। এদের লজ্জা লাগে। পুরুষ সেজে থাকতে হবে তো। পুরুষ হবার সব সুযোগ-সুবিধে খেতে হবে তো। এরা সব মেয়েদের ওপরে পুরুষের মস্তানি আর শরীরের গস্তানি দেখায়। সব কটা হারামি। আমরা পাড়ায় এলে এদের আবার জাত যায়। আমাদের সামনে ওদের বাড়ি থেকে বেরোতে ভদ্রতায় বাধে। আর আজ? তোদের প্রতিবেশী একটা বিপদে পড়েছে। আর তোরা ঘরে ঢুকে বসে আছিস! এরা আমাদের কেউ নয়, রে হিজরার দল! তোদের প্রতিবেশী রে। কাল তো তোদের পাশে তোদের প্রতিবেশী থাকবে না।
শ্রীদেবী আশেপাশের সব বাড়ির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে এইসব গালি-গালাজ করছিলো। এই মধ্য বয়সে রেগে গিয়ে নাকের পাটা ফুলিয়ে ফেলেছে সে। ফর্শা কান দুটো লাল হয়ে গেছে। মনে হয়, যেন সামনে যাকে পাবে, তাকে গঙ্গাজলে ধুইয়ে দেবে। আর অসিতবরণ বাবু বার বার তার হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছেন। কিন্তু শ্রীদেবী বার বার তাঁর হাত ছাড়িয়ে এগিয়ে আসছে। হিংস্র রাজনৈতিক দলের সব নেতারা যে যার ছুট ছাট কেটে পড়েছে তাদের আঞ্চলিক কার্‌যালয় ছেড়ে।
শ্রীদেবী আসলে সত্যি সত্যি শ্রীদেবী নয়। সে মৃন্ময়ী। কিন্তু আজ সে শ্রীদেবী। সাধারণ ভদ্র মানুষ তাকে এই নামেই চেনে। তাকে এই নাম দিয়েছে তারাই। সে তো আজ অন্তত বছর পঞ্চাশ আগে। তাতে কোনদিন আপত্তি করেনি সে। তাকে দেখতে সুন্দর এবং তা সে জানে। সুন্দর সুগঠিত দেহবল্লরী এককালে ছিলো তার। কিন্তু গণ্ডগোল এই যে, তাকে নিয়মিত দাড়ি কামাতে হয়। প্রকৃতির হাতে শিকার সে। হরমোনের দুর্‌বিপাকে সে হয়ে গেলো নারী থেকে অর্ধনারী। নারীপুরুষের যৌথ অস্তিত্ব। এদের নাম হোল হিজরা। ইংরেজিতে বলে ইউনাচ। ফলে একটা অসাংস্কৃতিক ভাষায় চিহ্নিত হয় এরা। তা হোল নপুংসক। শুধু চেহারায় একটা নায়িকা-নায়িকা ভাব থাকায় মৃন্ময়ী আজ শ্রীদেবী। মৃন্ময়ী জানে, সে সুন্দরী। যে কোন সাধারণ মেয়ের ঈর্ষার পাত্রী সে। আমতলার একটি মেয়ে তো তাকে একদিন ডেকে বলেওছে,
--- কিছু মনে করো না, শ্রীদেবী। তোমার নাম তো জানি না। সবাই এই নামে ডাকে বলে ডাকছি। একটা কথা বলি। আমাকে যদি তোমার মতো দেখতে হতো, তবে আমার এতদিনে বিয়ে হয়ে যেতো। শুধু আমি কালো আর কালো রং জয় করার মতো খুব সুন্দরী নই বলে আজও বাবা-মার চিন্তার কারণ হয়ে আছি।
শ্রীদেবী এ পাড়ায় একটি সদ্যজাত বাচ্চার খবর পেয়ে তার দলবল নিয়ে এসেছিলো। যখন ফিরে যাচ্ছিলো, তখন সে বাড়িরই ভাড়াটে মাধব বাবুর মেয়ে পথে ডেকে বলেছে কথাগুলো। মৃন্ময়ী মেয়েটির দু-গালে হাত রেখে বলেছে,
--- কি করবো, বল! আমি যদি পারতাম, তবে আমার পুরো রূপটাই তোমাকে দিয়ে দিতাম। কিন্তু আমি তো ঠাকুর রামকৃষ্ণ নই। তিনি অন্যের ব্যাধি নিজের শরীরে নিয়ে নেবো, আর নিজেরটা অন্যকে দেবো। বকল্মা নেবার সাধ্য কি আমার! তবে জানো তো, রূপ কারোর জীবনে আশীর্‌বাদ, কারোর জীবনে অভিশাপ।
--- বলো কি! রূপ আবার অভিশাপ!
--- হ্যাঁ গো। আমার রূপ থেকে কী হবে, বল তো? আমার তো অত বড়ো অপারেশন করার মতো টাকা নেই যে, পুরো মেয়ে হয়ে যাবো। শুনি তো, কেউ কেউ তা-ও হচ্ছে। অথচ কত মানুষের চোখে কত লালসা দেখি। কত নোংরা ইশারা! গা-টা ঘিন ঘিন করে। ইশারায় নয়। তাদের ঘরে স্ত্রী আছে, জেনে।
এ অঞ্চলে শ্রীদেবী আসছে আজ বহুকাল। প্রথম এসেছিলো একেবারে ওর যৌবনের প্রত্যুষকালে। তখন ও ছিপছিপে। তন্বী। কিন্তু সে আজ দলের নেতৃ। প্রায় মধ্য বয়স তার। এখানে সে সবচেয়ে বেশি দিন আছে। এখানকার মানুষের কাছে সে পরিচিত আর প্রিয়। এখানকার সকলকে সে চেনে। এমনকি নামে নামে অবধি চেনে। কেশব পণ্ডিত, যাদব মাস্টার, ব্যাঙ্কের ভবতোষ বাবু, কলকাতার কাপড়ের ব্যবসায়ী নলিনী সাহা, যুবক ছেলে-ছোকরা রিন্‌টু, টেক্কা, বিমান, সমর... সব। যাদের বাড়িতে কোনদিন বাচ্চা নাচাতে যায় নি, তাদেরকেও ও চেনে। আজ অবধি হিজরাদের তথাকথিত কোন অভব্যতা ওকে করতে হয় নি।
আজ প্রথম এ অঞ্চল জানলো, শ্রীদেবীর মুখের ভাষা মানে কলকাতার ঢাকনা খোলা ম্যানহোল। কিন্তু আজ কেন এতোটা খেপে গেলো তার বাহিনী? এটা এ অঞ্চলে জিজ্ঞাসা করার মতো কেউ নেই। কারোর সাহস নেই যে, জিজ্ঞাসা করে। এই শ্রীপুরের সকলকে উদ্দেশ করেই তো অকথ্য গালি-গালাজ করছে। দাঁড়িয়েছে এসে অসিতবরন বাবুর পাশে।
অসিতবরণ বাবু ঠিক বাবু বলতে যা বোঝায়, তা ঠিক ছিলেন না। বাবু তো আজকের মানুষ হয় অর্থে। তিনি শিক্ষিত হলেও বিত্তবান ছিলেন না। তিনি এখানে বসবাস করতেন আজ থেকে বছর উনিশ-কুড়ি আগে। তারপর কী একটা অজানা কারণে এখান থেকে চলে যান বলেই পাড়ার মানুষ জানে। ফিরে এসেছেন এই বছরখানেক আগে। বাড়ির সংলগ্ন একটা খাতা-বই-পেন্সিলের দোকান আছে তার। পাড়ার মানুষ তাদের বাচ্চা-কাচ্চাদের খাতা-বই এই দোকান থেকেই কেনে বটে, তবে তিনি পাইকারী ষ্টেশনারী গুড্‌স-এর কারবার করেন বলেই অঞ্চলের সবাই জানে। এই ব্যবসাই তার ছিলো এবং এই ব্যবসায়ীই তিনি আবার এখানে পত্তন করেছেন। অঞ্চলের সকলে এটাও জানে, অসিতবরণ বাবুর দুটি মেয়ে। চিন্ময়ী আর মৃন্ময়ী। দুজনেই এখানে জন্মেছে। চিন্ময়ীকে পাড়ার সকলেই দেখেছে। সে সুন্দরী ও শিক্ষিতা। শহরে মামার বাড়ি থেকে পড়াশুনো করে। এখানে সে থাকে না। ছোট মেয়ে জন্মের পরই তিনি শ্রীপুর ছেড়ে চলে যান। কিন্তু অসিত বাবু ফিরে আসার পরেও তার ছোট মেয়ে মৃন্ময়ীকে পাড়ার মানুষ দেখেনি। সবাই জানে, আজো সে বাবা-মার সাথে এই শ্রীপুরেই থাকে কিন্তু সে একেবারে বাড়ির মধ্যেই থাকে। বাইরে বের হয় না। কারণটা অবশ্য কেউ জানে না। আজকাল মানুষ অত অন্যকে নিয়ে ভাবে না। বিশেষত যে মহিলা মহল এটা নিয়ে নানা কথা রাষ্ট্র করে, তাদের অনেকেই এখানে আজ থাকে না। অসিত বাবু কোনো পাওয়ারফুল মানুষ না হলেও তার একটা স্বাভাবসিদ্ধ গাম্ভীর্‌য আছে। পাড়ার সকলের সকল বিষয়ে তিনি আছেন কিন্তু তার বাড়ির আর কেউ তেমন নেই। অসিত বাবুর স্ত্রীও পাড়ার মহিলা মহলে তেমন মিশতেন না। একসাথে মন্দিরে যাওয়া, কোন ব্রতপালন করা কিম্বা অন্য পরিবারে দুর্নামে মুখর হয়ে ওঠা--- এসব কোন বিষয়ে তাকে দেখা যেতোও না, আজও যায় না।
এই ফিরে আসা নিয়ে অসিত বাবুর সাথে লোকাল একটি পোলিটিক্যাল পার্টির সাথে বিরোধ চলছে। দীর্ঘদিন বাড়িটা পড়েছিলো। প্রায় ভূতের বাড়ির চেহারা নিচ্ছিলো। এমন সময় এই বাড়িতে বসবাস করার মতো মানুষ নেই দেখে ঐ পোলিটিক্যাল পার্টির কিছু সভ্যের অসভ্যতায় বাড়িটা কয়েকজন বাংলাদেশি মানুষ হস্তগত করে। তালা-টালা ভেঙ্গে তারা এখানে কিছুকাল বসবাস করে ওদেরই ইন্ধনে। ওদের সাথে ঐ বসবাসরীদের কী চুক্তি ছিলো, তা কেউ না জানলেও কেউ তেমন প্রতিবাদ করতে ভরসা পায় নি। কে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে যায়! অনেকের ধারনা এও হয়েছিলো, হয়তো অসিত বাবুর সাথে এই রাজনৈতিক দলের কোন নিগোসিয়েশন হয়েছে। পরে তারাই বহিরাগতদেরকে হটিয়ে দিয়ে আর অসিতবাবু আর ফিরে আসবেন না, মনে করে এটাকেই পার্টি অফিস বানাবার একটা তালে ছিল তারা। কিন্তু বাংলাদেশিদের উঠিয়ে দেবার পরই হঠাৎ এসে হাজীর হন অসিত বাবুরা। ঘরে লাগানো তালা ভেঙ্গে তারা ঢোকেন এবং বসবাস শুরু করেন। সেই থেকেই একটা বিবাদ চলছে এই পার্টির সাথে। আজ যখন এই পার্টি প্রায় বুঝে ফেলেছে যে, তারাই এই নির্‌বাচনে জিতছে, তখন তারা সরাসরি উৎপাত শুরু করে দিয়েছে অসিতবাবুকে উৎখাত করার জন্যে। তাদের স্বপ্নে অসিত বাবু ভেটো দিয়েছেন বলে এবারে তারা সরাসরি যুদ্ধে নেমে পড়েছে। শুধু ভোট সম্পন্ন হয়নি বলেই তারা একটু সিঁটিয়ে আছে। কিন্তু চাপ তারা সৃষ্টি করেই চলেছে। এই আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্কটা সইতে পারছিলেন না অসিত বাবু। তিনি সাধারণ গৃহী মানুষ। তার পক্ষে এই চাপ নেওয়া অসম্ভব হয়ে উঠছিলো। তিনি এত বড়ো যোদ্ধা নন। তার মতো একজন শান্ত, নির্‌বিরোধী আর মাটির মানুষকে উদ্বাস্তু করে দেওয়া একটা রাজনৈতিক দলের পক্ষে তেমন কিছু নয়। তিনি পার্টিকে বার বার বলেছেন,
--- এটা তো আমার বাড়ি। আমি তো বিশেষ কারণে ছিলাম না এখানে। আপনারা আমাকেই তাড়িয়ে দেবেন! এটা কী রকম বিচার! আমার পেছনে তো দাঁড়াবার মতো কেউ নেইও। আমি আপনাদের আটকাতেও পারবো না। আমার অপরাধ কি এই যে, আমি কিছুকাল এখানে ছিলাম না? এই নিয়ে আপনারা দেশ শাসন করবেন!
একটা মানুষ যদি রুখে দাঁড়ায়, তবে তার সাথে যোঝা যায়, তাকে পরাস্ত করার নানা ফন্দি-ফিকির বের করা যায়। কিন্তু মানুষটা যদি আগেই হেরে বসে থাকে, তবে একটা মুশকিলে গণ্ডগোল হয়। পাড়ার রাস্তায় হঠাৎ ঢুকে পড়া নবাগত হ্যংলা কুকুরটাকে যখন অঞ্চলের তাগড়া কুকুর আক্রমণ করে, আর তাতে যদি হ্যংলাটা কেউ-মেউ করে একেবারে শুয়ে পড়ে, হাত-পা ছড়িয়ে পরাভব স্বীকার করে, তবে তো আর অঞ্চলিক মস্তানি করা যায় না। তাই সেই রাজনৈতিক দলের নেতারা অসিত বাবুকে বলেছে,
--- আপনি একটা দাম-টাম ধরুন। আমরা দিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু জায়গাটা আমাদের চাই। আপনি কথা না শুনলে ঐ দামটাও পাবেন না।
শুধুমাত্র নির্‌বাচন নিয়ে টেনশান ছিলো বলেই উচ্চ মহল থেকে এখনই কোন ঘটনা ঘটাতে চায়নি বড় মাপের নেতারা। এই করতে করতে কিছুকাল কেটে গেছে। কিন্তু আজ ভোটে জিততেই তারা একেবারে আছড়ে পড়েছে অসিত বাবুর ওপর। তার দোকানে ছোটমোটো হামলা চালিয়েছে দু-দুবার। চাঁদা চেয়েছে বিরাট বিরাট এ্যামাউন্‌ট। তারা জানে যে, অসিত বাবু দিতে পারবেন না। আর সেটাই হবে ওদের হাতের অস্ত্র। পারেননি বলেই হামলাটা সহ্য করতে হয়েছিলো তাকে। একজন নেতা এসে তাকে বলেছিলো,
--- ছেলে-ছোকরার কারবার। ওরা নানা ঝামেলা করবে। আমি দাঁড়িয়ে থেকে নিগোসিয়েশন করে দিচ্ছি। আপনি ওদের কথায় রাজী হয়ে যান।
কিন্তু অসিত বাবু জানান--- আমি একটু ভয় পেয়েই ছিলাম। কিন্তু হামলা যখন হয়েছে, তখন আমার আর ভয় নেই। এবার আমি আর ভয় পাই না। ওরা যা পারে করুক।
পাড়াতে কয়েকটা বাড়িতে তিনি ঘুরে ঘুরে একটা প্রতিবাদের শিবির গড়তেও চেয়েছিলেন। কয়েকজন মানুষকে বলেওছিলেন---  আমরা তো এবারে এদেরকেই ভোট দিয়ে এনেছি। আমরা কি সকলে মিলে এর প্রতিবিধান করতে পারি না? এরা তো আমাকে বাস্তুহারা করতে চাইছে।
কিন্তু পাড়ার মানুষ তার দিকে ফিরেও তাকায়নি। তারা নিরুপদ্রব নামক এক জাতীয় প্রাণী। মানুষ তো বোধহয় নয় বলে মনে হয়েছে অসিত বাবুর। কে কোথায় মরলো, কার বাড়িতে ডাকাত পড়লো, কে খবর রাখে! আমার বাড়িতে তো পড়েনি। তাই আমার কী দরকার আগ বাড়িয়ে পার্টির সাথে ঝামেলা করবার! এখানে থাকতে হবে, করে খেতে হবে। ফলে একটু-আধটু সয়ে নিতে হবে। এতেই তারা অভ্যস্ত। জলে থেকে কুমীরের সাথে তো যুদ্ধ করা যাবে না--- এই প্রবাদটা মানুষ জীবনের অবলম্বন করে নিয়েছে। কিন্তু মানুষ যে জলে নেমে আজ সেই কুমীরকে ধরে নিয়ে আসছে, তা নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই তাদের। তখনই অসিত বাবুর পাশে দাঁড়াতে চলে আসে একদল বৃহন্নলা। শ্রীদেবী তাদের পাণ্ডা।
শ্রীদেবী এমনটা নয়, যেমনটা ভাষা সে আজ ব্যবহার করলো। ও যথেষ্ট ভদ্র এবং সভ্য। রূপের জন্যে মানুষ তাকে শ্রীদেবীলে ডাকলেই আগে ও তাঁদেরকে বলতো--- আমার সাথে একজন সেলিব্রিটির নাম এভাবে জড়িয়ে দিয়ো না। এতে তার অপমান হয়। তিনি একজন অভিনেত্রী। তার কত সম্মান!
কিন্তু কেউ শোনেনি ওর কথা। ও পাড়ায় ঢুকলেই পাড়ার মানুষ বাড়ির নানা প্রকশিত বা গোপন ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে আর নিজের স্ত্রীর দৃষ্টি  এড়িয়ে ওকে দ্যাখে। শ্রীদেবী দেখার মতো পাত্রী বটে। অনেককে অনেককিছু দেখাবার বাসনাও শুনতে হয়েছে এই শ্রীদেবীকে। তাই ভদ্রলোকদের ভদ্রতার সীমা বা পরিসীমা সে চেনে। তাই এরাই আগ বাড়িয়ে ওর নামে নানা নিন্দা-মন্দ করতে ছাড়ে না। এইসব দেখে দেখে এই অঞ্চলে শুধু নয়, ও বড়োই হয়েছে এই নোংরামির মধ্যে। কিন্তু এই অঞ্চলের সাথে যেন ওর একটা আত্মিক যোগ ঘটে গেছিলো। শ্রীপুরের মানুষ জানে যে, ঠিক এই অঞ্চলের জন্যে নয়, এই অসিত বাবুর জন্যেই এই অঞ্চলের সাথে শ্রীদেবীর এতো অন্তরঙ্গতা। তাই সে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এই মানুষটার জন্যে।
কীসের এই অন্তরঙ্গতা? সে এক অধ্যায়। গল্পের মধ্যে গল্প।



তখন অসিত বাবু সদ্য বিবাহ করেছেন। বছর ঘুরতেই তিনি যে পেপার মিলে কাজ করতেন, সেটা নেতাদের আর কর্মীদের সংগঠনের নান দাবি-দাওয়ায় আর গা জোয়ারিতে বন্ধ হয়ে যায়। ঘরে তখন নতুন বৌ। সে-ও সদ্য মা হয়েছে। মেয়ে সন্তান জন্মেছে অসিত বাবুর। চিন্ময়ী। স্ত্রী বিনতা তার স্বামীর এই অবস্থার জন্যে অপয়া কন্যা সন্তান চিন্ময়ীকেই দায়ী করে। তার আবির্ভাবেই এই দুর্‌বিপাক। একে মেয়ে সন্তান, তার ওপর এই সঙ্কট। অসিত বাবু স্ত্রীকে বললেন,
--- ওভাবে বলো না। ও তো নিজে আসেনি। আমরাই তো এই অভাবের সংসারে ওকে এনে বিপদে ফেলেছি। দেখবে, সব ঠিক হয়ে যাবে। মেয়ে আমার লক্ষ্মী, মা চিন্ময়ী। আমার কষ্ট ও নিজেই ঠিক করে দেবে।
কিন্তু মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়েছিলো অসিত বাবুর। এখন কী করবেন! স্ত্রীকে প্রবোধ দেওয়া আর বাস্তব তো এক নয়। সংসারের হাঁ-মুখ খাদ্য দিয়ে তো ভরাতে হবে। এই সময়ে যথারীতি শ্রীদেবী এসে হাজীর। তখন সে এখানে নতুন এসেছে। কাউকে চেনে না, কারোর ওপরে তার মায়া বা দয়ার কোনো প্রশ্নই নেই। ঈশ্বর তাকে যে অস্ত্রে আহত করেছেন, তা তো করেছেনই। তার ওপর মানুষের ক্লেদাক্ত মন সে দেখেছে বিস্তর। অনেক গঞ্জনা তার ভাগ্যে ঘটেছে। ফলে শ্রীদেবী মনে মনে ভদ্র সমাজের প্রতি ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। সে তখন তন্বী, যুবতী। হাসপাতাল থেকে এ বাড়ির খবর সে সংগ্রহ করে দলবল নিয়ে হানা দিয়েছে। হাতের চেটোয় প্রশিক্ষিত এক বিশেষ কায়দায় তালি মারতে মারতে কর্কশ কণ্ঠে ডেকে বের করেছে অসিত বাবুকে। ততক্ষণে ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে বিনতা। এদেরকে কী দিয়ে বিদায় করবেন, জানা নেই। ঘরে তো ভাঁড়ে মা ভবানী। কিন্তু এদেরকে ভয় কে না পায়! খাই মেটাতে না পারলে এরা নাকি একেবারে যা তা করে। বেইজ্জত করে ছাড়বে। কিন্তু অসিত বাবুর শান্ত, নিষ্পাপ আর সত্যভাষণ যেন গোটা ভীতিকর পরিবেশটাকে বদলে দিলো।
তিনি বেরিয়ে এসেছেন বাইরে। শ্রীদেবীকে হাত জোড় করে তিনি বলেন--- তুমি তো এসেছো, বোন। কিন্তু কী দিয়ে তোমাদের আশীর্‌ব্বাদ আমার সন্তানের জন্যে চাইবো, তা আমি জানি না। আমাদের পেপার মিল বন্ধ হয়ে গেছে। রোজগার-পাতি নেই। আমি যা দেবো, তাতে কি তোমাদের সন্তুষ্টি হবে?
শ্রীদেবী অসিতবরণ বাবুকে দেখার পর থেকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিলো। তখনও সে কোনো উত্তর দেয়নি। তখন অসিতবরণ বাবু তার সযত্নে রাখা লক্ষ্মীর ঘটটা বের করে নিয়ে আসেন। আর তার নিজের স্ত্রীকে দেওয়া নতুন তাঁতের শাড়িটা আনেন। সেগুলো শ্রীদেবীর হাতে দিয়ে বলেন,
--- এসব তুমি রাখো।
এবারে যেন সম্বিত ফেরে শ্রীদেবীর। সে বলে ওঠে--- আপনার মেয়ে তো ঘরের লক্ষ্মী। সেই লক্ষ্মীর ঘট আমাদের দিচ্ছেন? এটা কি করছেন! একটা মঙ্গলামঙ্গল বলে তো আছে।
হেসে অসিত বাবু বলেন--- তুমিও তো অতিথি। সেও তো নারায়ণ। সৎকার তো করতে হবে, ভাই। যদি লক্ষ্মীদেবী আমায় এমনটা করতে বাধ্য করেন, তবে আমি তো নিমিত্তমাত্র। তুমি এটা নাও। তাহলেই আমি খুশি হবো।  আর তো দেবার মতো কিছু নেই আমার। আর খালি হাতে তো অতিথিকে ফেরাতে পারি না।
শ্রীদেবী তার সাঙ্গপাঙ্গদের দিকে তাকিয়ে নীরবে একটা সমর্থন নেয়। অবশেষে তাই ঢুকিয়ে নেয় নিজেদের ব্যাগে। অসিত বাবু বলেন--- তুমিই আমার দিকে অমনভাবে তাকিয়ে ছিলে কেন, বলতো। আমি কি তোমার চেনা কেউ?
শ্রীদেবী এবারে বলে--- আপনাকে দেখতে অনেকটা আমার দাদার মতো। যেদিন আমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হয়, সেদিন দাদা খুব কেঁদেছিলো। আমার বাবা খুব বড়ো এ্যাডভোকেট। পাঁচজনে এক ডাকে তাকে চেনে জানে। আমি নাম বলছি না। আজকে দাদার কথা খুব মনে পড়ছে।


এই মেলোড্রামাটিক দৃশ্যটার একখানেই যবনিকাপাত ঘটে যেতো, যদি বিধাতা তার খেলাটা আরো না খেলতেন। পেপার মিল বন্ধ হয়ে যেতে কোনো কাজ পান না অসিত বাবু। অথচ বসে থাকার কোনো উপায় নেই। বাড়িতে দুটো মুখ হাঁ করে বসে আছে। তাই নানা দপ্তরে দপ্তরে খাতা-বলপেন-রাবার স্ট্যাম্প আরো নানা স্টেশনার্‌স সাপ্লাই করা শুরু করেন তিনি। মোটামুটি চলছিলো তার ব্যবসা। কিন্তু তার মধ্যেই শ্রীদেবীর দলবল তাকে রাস্তায় ঘিরে ধরে। ভর দুপুরে সেদিনের সেই অভিজ্ঞতা তিনি আজও স্মরণ করলে লজ্জায় মাথা হেঁট করেন।
সেদিন অসিত বাবু চলেছেন দু-হাতে দুটো ব্যাগ নিয়ে। চলেছেন পৌরসভা অফিসে। সেখানে কিছু কার্‌বন পেপার, বল পেনের রিফিল, রাইটিং প্যাড সাপ্লাই করার কথা ছিলো। বেলা বাজে দেড়টা। মাথার ওপর ভয়ঙ্কর সূর্‌যটা যেন তার ওপর কোনো পুরনো রাগের প্রতিশোধ নেবার জন্যে তার উত্তাপ আরো বাড়িয়ে দিয়ে হা হা করে হাসছে। ছাতা নেবার উপায় নেই। দু হাতেই রয়েছে দুটো ব্যাগ। ঘামছেন অসিত বাবু। যখন তখন মাথা ঘুরে পড়ে যাবার যোগার। হঠাৎ...। তিনি তাকিয়ে দেখেন, তার চারদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে শ্রীদেবী আর তার দলবল। রাস্তা শুনশান। কেউ কোত্থাও নেই। পাশে চা-এর দোকানের লোকটা ঝিমোচ্ছে। অসিতবরণ বাবুর বুকের মধ্যে একটা বিরাট লোহার বল একটা পেন্ডুলামের মতো ধরাস ধরাস করে একবার এপাশে, একবার ওপাশে আঘাত করতে শুরু করে। অসিত বাবু ভাবতে শুরু করেন, কী চায় ওরা? ওরা বৃহন্নলা। মহাভারতে স্বয়ং অর্জুন নাকি অজ্ঞাতবাসে বৃহন্নলা সেজে ছিলেন কিছুকাল। নামটা শুনতে বেশ মধুর, কিন্তু ওদের সম্বন্ধে মানুষের যে কুৎসিত অভিজ্ঞতা, তা তো খুব নিশ্চিন্ত নয়। অসিত বাবু ভাবেন, হঠাৎ এই ভর দুপুরে ঘিরে ধরেছে কেন?
--- দাদা, তোয়ার সাথে চা খাবো। ঐ দোকানে।
শ্রীদেবীর কণ্ঠে এমন অবাস্তব বায়না শুনে কিছুটা আশ্বস্ত হতে পরতেন অসিত বাবু। ভাগ্যিস, চা-টুকু শুধু খেতে চেয়েছে। কিন্তু তাতেও তার মনে হয়েছে, হে ধরণী, দ্বিধা হও। কেননা তখন অসিতবাবুর পকেটে মাত্র তিনটি টাকা। চা খাবার খরিদ্দার অন্তত জনা দশেক। তারপর যদি চা-এর সাথে টা চেয়ে বসে, তবে তো অসিতবাবুকে নিজেকেই এই মুহূর্তে দোকানে বন্ধক রাখতে হবে। তাই দায় এড়াবার জন্যে প্রায় করজোড়ে বললেন,
--- আমি মিউনিসিপ্যালিটিতে যাবো, ভাই। ওরা আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। এখন...
--- কত আর সময়, দাদা! তোমাকে কতদিন পরে পেলাম! চলো তো।
অসিতবাবুর হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় শ্রীদেবী। মনে মনে প্রার্থনা করেন অসিত বাবু, হে মা বিপদত্তারিনী, আমাকে রক্ষা করো। আমি যেন রোদের তাপে এখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তাহলে অন্তত এই অপমান থেকে এই মুহূর্তে রক্ষা পাই।
বড়ো আপনজনের মতো বলে শ্রীদেবী--- এই রোদে একটা ছাতা মাথায় দাওনি তুমি! মাথাটা যে ঘুরে পড়ে যাবে।
লেই নিজের ছাতাটা ধরে অসিতবাবুর মাথায়। অসিত বাবুর বাঁপাশে দাঁড়ানো একজন স্থূলদেহী বলে ওঠে--- আহা, তুই কি চোখের মাথা খেয়েছিস নাকি? দেখছিস না, দুটো হাতই আটকা! কোন হাতে ছাতা নেবে দাদা?
--- তাহলে অন্তত একটা রিকশা-টিকশা তো নিতে পারো। এ্যাতো মাল নিয়ে কি তুমি কি হেঁটে যেতে পারো!
অসিতবরণ বাবু ভাবেন, পারি তো অনেককিছু। কিন্তু রিকশায় যে আটটা টাকা কান মুচড়ে নিয়ে নেবে, রে। এটা বাঁচাতে পারলে যে বাড়ির একবেলা আহার হয়। কথাকটা তিনি মুখে বলেননি বটে। কিন্তু মন বলে, এবার তোরা আমাকে ছাড়। সেটাই আমার প্রতি তোদের অপার করুণা হবে। তোদের চা খাওয়াবার মতো অবস্থা আমার নয় রে। কিন্তু এইসবও তো মুখে বলা যায় না। পৌরুষে আটকায়। ওদের সাথে পাশের দোকানে বসতেই হয়। সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখেন অসিত বাবু, ওদের খাওয়ার আগেই তিনি উঠে গিয়ে মালিককে নিজের হাতঘড়িটা দিয়ে আসবেন। পরে একদিন এই গাণ্ডেপিণ্ডে খাবার দাম মিটিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবেন নিজের বিয়ের ঘড়ি। ততক্ষণে মোচ্ছব মেরে চা, কেক, বিস্কুট সাঁটাচ্ছিল শ্রীদেবীরা। কারোর পউষ মাস, কারোর সর্‌বনাশ। তাড়াতাড়ি চা শেষ করে অসিতবরণ বাবু কাউন্‌টারে উঠে গেছেন। হাত থেকে ঘড়িটা খুলতে যাবেন, তাঁর হাতটা চেপে ধরেছে শ্রীদেবী। রাগ করে বলে,
--- আমি তো তোমার সাথে চা খেতে চেয়েছি। তোমাকে তো দাম দিতে বলিনি, দাদা।
কে যেন সপাটে অসিত বাবুর গালে একটা চড় কষিয়ে দ্যায়। লজ্জায় তিনি কুঁকড়ে যান। বিপত্তারিনী মা কি তাঁর কথা সত্যিই শুনেছেন? চোখে জল এসে গিয়েছিলো তাঁর। কিন্তু নিজেকে সংযত করেন। শ্রীদেবীদের কোনো দিকে খেয়াল নেই। তারা দিব্যি চা খেয়ে তার দাম-টাম দিয়ে নিজেদের পথে হাঁটা দিলো।
দোকানদার একটা হাই তুলে বললো--- কালে কালে কত যে দেখবো!
মনে মনে হাসলেন অসিতবরণ। ভাবলেন, তুমি এখনও কিছুই দেখোনি, ভাই। অনেক বাকি।
অসিতবরণ বাবুর প্রথম সন্তান মেয়ে চিন্ময়ী হবার পর একটি ছেলের জন্যে তাঁর স্ত্রী বায়না করতে দ্বিতীয় সন্তানটিকে পৃথিবীতে আনা হয়। কিন্তু বিধাতা না চাইলে কি হয়! তাই হোল। উপরন্তু হাসপাতালে ডাক্তার জানিয়ে দিলেন যে, এই সন্তানের নাকি সেক্স বদলে যাবার প্রবণতা আছে। যে কোন দিন এই ছেলে সন্তানটি মেয়ে হয়ে যেতে পারে। ইউনাচ বা হিজড়েদের কথা শুনেছেন অসিতবরণ, কিন্তু তাদের শারীরিক বিজ্ঞান সম্বন্ধে তেমন কিছুই তিনি জানেন না। কিন্তু একটি মেয়ে কী করে যে পরে হঠাৎ ছেলে হয়ে পারে, এইটা তাঁর মাথায় আসেনি। স্ত্রী বিনতা বিষয়টা জানুক, না জানুক, এমন কথা শোনা মাত্র পুরুত-টুরুত ডেকে অসিত বাবুকে কিছু না বলেই বাড়ির শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করা শুরু করেছিলো। শুধু মনে মনে প্রার্থনা করছিলো, এমন অঘটন যেন না হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখতে পেলো, সেই সন্তান ধীরে ধীরে বৃহন্নলাতেই পর্‌যবসিত হলো। ততদিনে তার নাম দেওয়া হয়ে গেছে মৃন্ময়ী। এখন কী করবেন বাবা-মা? এ অবস্থায় কী করতে হয়, তা-ও তো জানা নেই। বিনতা বললো,
--- এই ছিল ঠাকুরের মনে! এই জন্যে তাঁকে দু-বেলা অন্ন-জল দিই! প্রার্থনা করি তাঁর কাছে! এ তো চোখের সামনে টেনে নিয়ে যাবে গো একদিন। না, আজ থেকে আর ঠাকুর পুজো নয়।
অসিতবরণ অসহায় মুখ করে বললেন---তাহলে কী হবে, বিনু?
--- ঠাকুরের কাছে মানত করেছিলাম, যেন একটা ছেলে হয়। এর চেয়ে ঠাকুর সন্তান না দিলেই পারতেন।
--- ঐ যে চিন্ময়ী জন্মের পর আমার চাকরীটা যেতে ঠাকুরের সামনে তাঁর দান চিন্ময়ীকে তুমি অপয়া বলেছিলে না! তারই শাস্তি তিনি দিলেন বোধহয়।
আবার যথাসময়ে এলো শ্রীদেবী। তার দলবলের হাতে তালি পড়লো, তাদের কর্কশ কণ্ঠ সচকিত করলো বাবা-মা-কে। নাচতে দাও না দাও, বাচ্চা ওদের হাতে দিতেই হবে। ওরা দেখে নেবেই, লিঙ্গ কী। ওদের গোষ্ঠীর হলে নিয়ে চলে যাবে। কোন দরদ মায়া মমতা মানবে না। এমনটা দেখেছে বিনতা। না নিয়ে তো উপায় নেই। এই সন্তান নিয়ে তো একটা পরিবার এই নিষ্ঠুর সমাজে বাঁচতেও পারবে না। মানুষ তাঁদেরকে খুঁচিয়ে মারবে। শ্রীদেবী বাচ্চা হাতে নিয়ে বলে ওঠে,
--- কী নাম দিলে গো, দাদা?
একটা কাঁটা গলায় বিঁধলে যে কষ্ট ফুটে ফুটে ওঠে, তেমনই একটা ঢোক গিলে নিতে নিতে জবাব দিলেন অসিত বাবু--- মৃন্ময়ী। বড় বোন চিন্ময়ী। তুমি তো জানো।
শ্রীদেবীর আর বাচ্চার ঢাকা তুলে দেখা হয় না। অস্ফুটে বলে--- মৃ-ন্ম-য়ী! আর নাম খুঁজে পেলে না, গো দাদা! চিন্ময়ীর সাথে মিলিয়ে শ্রীময়ী, আদ্যাময়ী, হিরণ্ময়ী দিতে পারলে না? একেবারে মৃন্ময়ী?
--- কেন বলতো? এটা কি ভালো নাম নয়?
--- কী ভালো, তার নজীর তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, দাদা। দেখছো না, কী ভালো!
বিস্মিত হন অসিতবরন। বলেন--- তাহলে তুমি কি শ্রীদেবী নও? তোমার নামও মৃন্ময়ী? আশ্চর্‌য!
শ্রীদেবী বলে--- আমাদের জন্মকথা কাউকে বলা নিয়ম নয়, দাদা। কিন্তু তোমায় দাদালে ডেকেছি। তাই জানাচ্ছি। আমি বড়ো ঘরের মেয়ে। আমার বাবা-মা আমার এ অবস্থা দেখে কী করেছিলেন, আমি জানি না। আমি তখন ছোট। তবে আমাকে এ দলে সহজে ছেড়ে দেননি, সেটা জানতে পেরেছিলাম। আমি বাড়িতেই বড়ো হয়েছি, পড়াশুনো করেছি। কিন্তু আমাদের আত্মীয়-পরিজন যেদিন আমার পরিচয় জানতে পেরেছে, সেদিন থেকে বাবা-মাকে উত্যক্ত করতে শুরু করেছিলো। আমাকে নাকি সমাজে রাখা যাবে না। এই আধুনিক যুগেও যে একঘরে করে দেওয়া যায়, তা আমি দেখেছিলাম। দ্যখো, এই সমাজ চোর-গুন্ডা-বদমাইশদেরকে বহন করতে পারে। কিন্তু আমাদেরকে নয়। কেন বলো তো, দাদা?
বোকার মতো মুখ করে বলেন--- আমি জানি না, মৃন্ময়ী।
আজ এতদিন পরে অসিত বাবুর কণ্ঠে মৃন্ময়ী ডাক শুনে শ্রীদেবী আবেগে ভেসে যায়। এই শ্রীদেবী নাম ওকে মানুষ দিয়েছে ওর রূপ দেখে। নামটা যেন ওর একটা ছদ্মবেশ। নিজেকে ভুলে থাকার একটা আড়াল। আজ আবার নিজের দাদার কথা মনে পড়ে খুব। সে খুব কেঁদেছিল মৃন্ময়ী চলে যেতে। মাকে বলেছিলো মৃন্ময়ী,
--- আমাকে এখানে রেখো না, মা। তাহলে আমাকে বা তোমাদেরকে সমাজ বাঁচতে দেবে না। আমাকে আমার জায়গায় চলে যেতে দাও।
মৃন্ময়ীর মা কেঁদে পড়েছিলেন--- কী বলছিস তুই! তুই আমাদেরকে ছেড়ে চলে যাবি! পারবি থাকতে?
মৃন্ময়ী ততদিনে বুঝতে শিখেছে, কথার পিঠে কথা বলতে শিখেছে। তারই জোরে মাকে বলেছে--- বিয়ে তো আমাকে দিতেই হতো, মা। ছেড়ে তো আমাকে দিতেই হোতো। মেয়ে সন্তানকে কি তুমি ঘরে আটকে রাখতে পারো? তার চেয়ে এই ভালো। একজনের জন্যে সবাই মরা ঠিক নয়। মৃণ্ময়ীর মা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাউ হাউ করে কেদেছিলেন সেদিন। মনে মনে বুঝতে পেরেছিলেন, মেয়েকে তিনি হারাবেনই। এইসব মনে আছে শ্রীদেবীর। আজ এতদিন পরে সমব্যথী পেয়ে যেন চোখ ছাপিয়ে জল আসতে চায় ওর।
এইসব কথাবার্তার মধ্যে কখন যেন ঢাকা তুলে সে দেখে নিয়েছে শিশু মৃন্ময়ীকে। বাবা বা মা কেউই খেয়াল করেনি। হঠাৎ নিজের দলবলকে উদ্দেশ করে বলে--- তোরা যা না। ঐ মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে। ওটা মেরে আয় না। আমি দুটো কথা বলে আসছি।
নেতৃ যেমনটা আদেশ দ্যায়, তেমনটাই পালন করে সকলে। ওরা বেরিয়ে যেতেই শ্রীদেবী বলে অসিত বাবুকে--- দাদা, এ সন্তান তুমি রাখতে পারবে না। এতো...
ততক্ষণে বিনতা তার হাতদুটো জোড় করে বসে পড়েছে শ্রীদেবীর পায়ের কাছে। অনুনয় করে বলে উঠেছে--- তুমি তো ওকে দাদা বলো, ভাই। দয়া করে ওকে নিয়ো না। আমার সন্তান গেলে আমি বাঁচবো না।
--- বা-মার সন্তান গেলে তারা বাঁচে না, বৌদি। কিন্তু বাঁচতে হয়। কিন্তু তুমি একে ধরে রাখবে কী করে? তোমাদের ভদ্র সমাজ তো ওকে রাখতে দেবে না। এটা সত্যি যে, আজ কেউ কারোর খবর নেয় না। সময় নেই। কিন্তু মহিলা? এই মহিলারাই তো তোমার সর্‌বনাশ করবে। এদের তো হাতে কোন কাজ নেই। এরা তো পরের ঘরের খবর নিয়েই দিন কাটায়। ভাল খবর নিয়ে নয়। কার কোথায় ঘা, তারই খবর নেবে এরা। তারা তো ওকে বা তোমাদের বাঁচতে দেবে না, দিদি। মানুষ কাচের বাক্সে মাছ পোষে। দেখছো কখনও? রং-বেরঙ্গের মাছ?  তাতে যদি একটা মাছ কোনভাবে অসুস্থ হয়, তবে অন্য মাছেরা তাঁকে ঠুকরে মেরে দ্যায়। জানো?  কিন্তু ওরকম অসুস্থ মাছেদের সাথে ওকে রাখবে, দেখবে কেউ মারবে না। মানুষও তাই করে।
--- তাহলে কী করবো, বলে দাও, মৃন্ময়ী।
পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন অসিত বাবু। তার দিকে তাকিয়ে জানা বা চলতি কথাটা শ্রীদেবী বলতে পারেনি। যে সত্যির হয়ে এতক্ষণ সওয়াল করে আসছিলো, তা সে রাখতে পারেনি। তাই সে বলে ওঠে অসম্ভব কথাটা--- তোমাকে দাদালে ডেকেছি। দাদা বলে মেনেছি। তোমাকে কষ্ট পেতে দেখতে পারি না। জানি না, কতটা পারবে, তবু বলবো পালাও। ঘরবাড়ি বন্ধ রেখে এখান থেকে পালাও যাতে এখানকার মানুষ আত্মীয়তা করতে এসে এ কথা জানতেও না পারে। অন্তত এই মেয়ে বড়ো না হলে এখানে এসোনা। তখন কেউ তোমার খবর নিতে আসবে না। কোথায় যাবে, কোথায় থাকবে, কী করবে, এ আমি জানি না।
পালিয়েছিলেন অসিত বাবু। একবার চেষ্টা করে দেখতে চেয়েছিলেন,  কীভাবে মেয়েকে বাঁচানো যায়। একবার এই জেলা, একবার ঐ জেলা ঘুরে বেরিয়েছেন। কোনো একটা স্থানেই একটু পরিচিতি হলেই সেখান থেকে আবার পালিয়েছেন। কিন্তু ঘরের মধ্যে যখন শত্রু বসে থাকে, তার থেকে পালাবেন কী করে! এই ঘরের শত্রু হলো চিন্ময়ী। অসিত বাবুর বড়ো মেয়ে। সে বড়ো হয়ে জেনে গেছে এই যাযাবরীর বৃত্তান্ত গুহ্যকথা। সাথে সাথে বাবাকে সোজা বলেছে,
--- বাবা, আমাকে মামা বাড়িতে পাঠিয়ে দাও। এখানে থাকলে আমার লেখাপড়া হবে না। তোমরা একাবার এ জায়গা, আর একবার সে জায়গা করবে। এতে আমার পড়াশুনোর ক্ষতি হবে।
অসিতবরণ বলেছেন--- কী বলছিস তুই! ও তো তোর ছোটবোন।
কিন্তু কর্কশ প্রশ্ন চিন্ময়ীর--- তুমি কি নিশ্চিত করে বলতে পারবে, ও আমার ভাই, না বোন? তার চেয়ে আমাকেই পাঠিয়ে দাও মামাদের কাছে। আমাকে তো আমার জীবন নিয়ে ভাবতে হবে। এভাবে তো ভেসে বেড়ালে আমার চলবে না।
কথাটা শুনতে নিষ্ঠুর হলেও সত্যি, এটা বোঝেন অসিত বাবু। চিন্ময়ী বড়ো হচ্ছে, তার উঁচু ক্লাশ হচ্ছে। আজ বাদে কাল তার বিয়ে হবে। একটা স্বতন্ত্র সুখী জীবন চায় ও।। এই গলার কাটা নিয়ে বাবা-মা বাঁচতে চাইতে পারে। ওর পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। কিন্তু অসিতবরন বাবু বড়ো  মেয়েকে মন থেকে সমর্থন করতে পারেন নি কোনদিন। এভাবে তার পালিয়ে যাওয়া তিনি মেনে নিতে পারেননি। আজ বোঝেন, শ্রীদেবী ঠিকই বলেছে। শত্রু বাইরে নয়, একেবারে ভেতরে। কিন্তু বেরিয়ে যখন পড়েছি, ভাই, থামলে তো আর চলবে না...। এটা তার একটা যুদ্ধ। বিশেষত চিন্ময়ী চলে গেলে এটা তার একটা মিশন হয়ে ওঠে। একটা চ্যালেঞ্জ। অনেক কষ্ট তাঁকে পেতে হয়েছে। একবার চাকরী, একবার ব্যবসা। একটা জায়গায় একবার জমিয়ে বসেই আবার তল্পিতল্পা গুটিয়ে অন্য জায়গায়। একটা অজানার উজানে ভেসে বেড়ান অসিতবরণ, বিনতা আর মৃন্ময়ী। একটু বড়ো হয়ে মৃন্ময়ী গোটা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলেছে,
--- বাবা, কত দৌড়বে! এভাবে কি ছুটে বেড়ানো সম্ভব! তোমাদের তো বয়স হচ্ছে। কোথায় লুকোবে আমাকে! কতদিন লুকোবে?
অসিত বাবু শুধু নিজের মুখে নিজের আঙ্গুল রেখে নিঃশব্দে মেয়েকে চুপ করিয়ে দিয়েছেন। ছুটে বেরিয়েছেন বছর পনেরো-ষোলো। এ তার যুদ্ধ। এতো সহজে হার মানতে তিনি চান নি। অবশেষে মেয়ে একটু বড়ো হলে, একটু বুঝতে শিখলে ফিরে এসেছেন বাড়িতে। ছোট মেয়ে তার সোনার টুকরো। ভীষণ মেধা তার। অসিত বাবু মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে পারেননি বটে, কিন্তু বাড়িতে বাবা-ই এনে দিয়েছেন নানা বই আর জিজে টাকে পড়িয়েছেন। পড়তে পড়তে কাগজে কলমে নয়, কার্‌যত বেশ শিক্ষিত হয়ে উঠেছে মৃন্ময়ী। বরং বলা যায়, তথাকথিত শিক্ষিতদের থেকে বেশীই সে অধ্যয়ন করে ফেলেছিল। এখন সে বাবার ব্যবসার কাজে নানা সহযোগিতা দিয়ে বাবার ব্যবসাটাকে বড় করেছে। আজ বস্তুত একটু সুখের মুখ দেখেছে মা বিনতা। বড়ো মেয়ে চিন্ময়ী বাড়িতে কোন যোগাযোগ না রাখলেও দুঃখে ভেঙ্গে পড়েননি তাঁরা। এমনকি মামাদের দায়িত্বে তার বিয়েও হয়ে গেছে। অসিত বাবু বিনতাকে নিয়ে শুধু একবার গিয়েছেন সেখানে। তাঁর পক্ষে যতটুকু যৌতূক দেওয়া সম্ভব, বা তাঁর মানসিকতা ছিল, ততটুকু দিয়েছেন। অসিত বাবুর শ্যালকেরা চিন্ময়ীর বিবাহ নিয়ে অসিত বাবুকে বিরক্তও করেনি। আসলে জামাইবাবু আর দিদির কাজকর্মে তাদের কোন সমর্থন নেই।


বিগত বছর পাঁচেক তাঁদেরকে বাড়ি পরিবর্তন করতে হয়নি, ব্যবসার উপার্জন নিয়ে মাথাব্যথা করতে হয়নি। তাই এরপরেই তাঁরা ফিরে এসেছেন বাড়িতে। শ্রীপুরে। এখন মৃন্ময়ী নিজেই নিজেকে আড়াল করতে শিখে ফেলেছে। এই বাড়ি তখন ভূতের বাড়ি। অবশ্য ভূতেদের হাত থেকে তা রাজনৈতিক দাদাদের হাতে যাবো যাবো অবস্থা। এখানেই অসিত বাবুর সাথে রাজনৈতিক দলের সংঘাত বাধে।
বাড়িতে তিনি একটি দোকান মতো করেছেন। আসলে এটিই তাঁর ব্যবসার দপ্তর বলা যাক, স্টোর বা গো-ডাউন অথবা এ্যান্‌টিচেম্বার... সবই। এখানেই একটা কম্পিউটার নিয়ে কাজ করে মৃন্ময়ী। অন লাইনে ব্যবসা সে জমিয়ে ফেলেছে। সুচ থেকে শুরু করে হাতি অবধি বিক্রি সামলায় মৃণ্ময়ী। বৃহন্নলা মৃন্ময়ী। লোকচক্ষুর অন্তরালে বসে সে কাজ করে বাবার ব্যবসার। এখানকার মানুষের মনে তাকে নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে বটে, কিন্তু দীর্ঘ কুড়িটা বছর পরে পাড়া-প্রতিবেশির সাথে সম্পর্কটা তো আগের মতো থাকে না। নতুন করে পাততে হয়। এখানে যা ছিল, তা ঠিক তেমনটা আর নেই। যাকে অসিতবাবু জন্মাতে দেখেছেন, সে তো আজ যুবক। যাকে বয়স্ক দেখেছিলেন, তিনি আজ আর নেই। পাড়াতে ফ্ল্যাট উঠছে তুরীয় গতিতে। পুরনো মানুষ পাড়া ছেড়ে চলে যাচ্ছে নতুন নতুন জায়গায় ফ্ল্যাটে, নতুন মানুষ ঢুকছে। স্থান শূন্য তো থাকে না। ফলে মৃন্ময়ীকে নিয়ে বেশ কিছুটা নিরাপত্তা অনুভব করেন অসিত বাবু। কেউ হঠাৎ প্রশ্ন করবে না, মৃন্ময়ীকে দেখতে চাইবে না। অন্তত অকাজের মানুষ প্রশ্ন করছে না, কেন মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন না, মেয়েটা কী করে, ওকে তো জন্মের পর দেখলামই না ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তাঁর এই পল্লব পরিচিতি যে তাঁর কাছে একটা বিপদ হয়েও উঠতে পারে, সেটা তিনি কেন, কেউই অনুভব করে নি। আজ যখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি তাঁর সমস্যাটা বোঝাতে চাইলেন, তাদের সহযোগিতা চাইলেন, তখন সকলেই ঠোঁট ওলটালো। একটা রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে কেউই দাঁড়াতে সাহস দেখালো না। একজন তো বলেই দিলো,
--- দেখুন কাকু, আপনি আমাদের অনেক দিনের প্রতিবেশী। কিন্তু এখান থেকে চলে যাবার সময় তো আমাদেরকে বলে যাননি আপনি কোথায় যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন। ফলে আপনি কোথায় কী করেছেন, কেন এই পোলিটিক্যাল পার্টি আপনার পেছনে পড়লো, তা তো আমরা জানি না। কী ভেবে এগোবো?
অসিত বাবু বুঝলেন, এটা তাঁর যে একার সমস্যা নয়, সেটাই এরা বুঝতে চাইছে না। এরা একটা বিকৃত সিস্টেমকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। এই গোটা সিস্টেম যে মানুষকে গিলে ফেলবে একদিন, সেটাই বুঝতে চাইছে না। ফলে তিনি ধরে নেনে, তাঁকে একা লড়তে হবে। আর না পারলে এ বাড়ি ছাড়তে হবে। কিন্তু তাঁর মতো নির্‌বিরোধী মানুষকে যেন ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিলো মৃন্ময়ী। তাঁর কন্যা। এক গুপ্ত কক্ষে বসে নীরবে কাজ করা বৃহন্নলা। যে এতো বছর নিজের নিরাপত্তার জন্যে বাইরে আসেনি, অসূর্‌জম্পশ্যা থেকেছে, সে বেরিয়ে এলো। লোকচক্ষে বেরিয়ে এলো বাবার পাশে দাঁড়াতে। পার্টি থেকে অসিত বাবুকে একটা টাকার অফার দিতে এসেছিলো একদিন। সেই প্রথম মানুষ দেখলো, কে মৃন্ময়ী। তাদের কারোর চক্ষে বিস্ময়, কারোর চোখে ব্যঙ্গ, কেউ লজ্জিত, কেউ ঘৃণাভরে মুখ ফিরিয়ে নিলো। একটা বহুমুখী প্রতিক্রিয়া দেখলেন অসিত বাবু। অনেক বাধা দিয়েছিলেন মেয়েকে। তার সামাজিক অস্তিস্ব নিয়ে নানা বিপদের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কিন্তু মৃন্ময়ী জানিয়েছে যে, সে তো সবই হারিয়েছে। এই সমাজের থেকে তার পাবার কিছু নেই। হারাবার আছে অনেককিছু। ও পার্টির ছেলেদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ওদের জুলুমের উত্তর দিয়েছে শক্ত ভাষায়।
এর খেসারত দিতে হোল অসিত বাবুকে সেদিন রাতে। একটা অর্ডার ডেস্প্যাচের ব্যবস্থার জন্যে পরিবহন দপ্তরে কিছু কাজ সেরে ফিরছিলেন একটু বেশী রাতে। রাস্তায় একদল দুষ্কৃতি তাঁকে হেনস্তা করে, জখম করে। এই পরিবারে একটা আতঙ্ক ছড়াতে চাইলো তারা। পরেরদিন পথে ঘাটে সর্‌বত্র পোষ্টার পড়লো, হিজরা নিয়ে পাড়ায় থাকা চলবে না, সমাজের নির্দিষ্ট নিয়ম মানতে হবে। দেওয়ালে দেওয়ালে মৃন্ময়ীর বিরুদ্ধে স্লোগান। একটা চেনা ছকে চাপ সৃষ্টি করে অসিত বাবুকে পাড়া ছাড়া করবার খেলায় নামলো পার্টি। এই বাড়িটাকে পাওয়া যতটা না দরকার হয়ে পড়লো, তাঁর চেয়ে এটা একটা পার্টির সম্মানের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ালো। একটা হিজরার এমন জেহাদ তো মেনে নেওয়া যায় না। পরদিন সকালেই বিরোধী দলের কিছু মানুষ এসে হাজির হোল। এটাকে একটা রাজনৈতিক রং দিয়ে ঘোলা জলে কিছু মাছ ধরার একটা ছক কষে তারা অসিত বাবুদের সমব্যথী হবার নাটক করলেও অসিত বাবু সোজা জানালেন,
--- আপনারা এটাকে নিয়ে আর ঘাঁটবেন না। আপনাদের হাতে অনেক কাজ। আমি কারোর বিরুধে কোন কথাটি বোলব না। আমার যা হবার, তা হবে। আমি যেমন একবার মার খেয়েছি, বাড়ী আমি ছাড়ছি না। কোনো অবস্থায় নয়। আমি আমার সম্পূর্ণ বিনাশ অবধি দেখবো।
কিন্তু ঘটনা তো একই জায়গায় থেমে থাকে না। বায়ুর আগে বার্তা ছুটে যায় দূর থেকে দূরান্তে। এ সংবাদ পৌঁছে যায় শ্রীদেবীর কানে। তার দাদা আজ বিপদাপন্ন। সে মৃন্ময়ীর মতই নিজের ঘরে বসে থাকতে পারে না। আজ সে মধ্য বয়স্ক। সেই রাতেই অসিত বাবুর অগোচরে একদল বৃহন্নলা থানায় ডায়রি করেছে, ডেপুটেশন দিয়েছে ডি.এম. আর এস.পি.’র অফিসে, বিধায়কের দপ্তরে। এমনকি মিডিয়া ডেকে বাইট দিয়েছে জুলুমবাজির বিরুদ্ধে। সবশেষে আজ পাড়াতে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে শ্রীদেবী চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করে বলেছে,
--- এখানে সবকটা হারামি থাকে। হিজরা থাকে এ পাড়ায়।
কিন্তু বেলা নটাতেও কারোর বাড়ির পর্দা সরিয়ে কোন মুখ প্রতিবাদ তো দূর, একবার দেখে নিতেও সাহস করেনি কেউ। যেন দুয়ার দিয়ে ঘুমিয়ে আছে পাড়া...।
-------------------------