বৃহস্পতিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১২

'মমতা' ছোটগল্প



মমতা
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়

আমার এনজিও-টির নাম Street Illiterate Salutary Organization। সকলে ছোট করে বলতো শিশো। এই শিশো শব্দটি কালের কবলে হারিয়ে আজ হয়েছে শিশু। অবশ্য আমার কাজ শিশুদেরকে নিয়েই। আমার এই শিশোর কাজই হল, রাস্তার পাশে যে সব ঝুপড়ি, বস্তি ইত্যাদি আছে, তার শিশুদেরকে জীবনের মূল স্রোতে টেনে এনে একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের খোঁজ দেওয়া। আজ থেকে বারো বছর আগে যখন এই শিশো জন্ম নেয়, তখন শুধু এই স্ট্রিট চিলড্রেনদের শিক্ষা নিয়েই আমরা কাজ করতাম না। শুরুতে একটু বড়ো করে কাজ শুরু করতে হয়েছিলো ফিনান্সারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। শিশুসহ অন্যান্যদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি থেকে শুরু করে নানা কাজ করতাম। গ্রামেগঞ্জে নানা স্থানে বিনা অর্থব্যয়ে চক্ষু চিকিৎসা, রক্ত পরীক্ষা, থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা, এমন নানা কাজ করেছি। তখন আমার নিজের অল্প বয়সজনিত কারণে একটা আদর্শ থেকে নেমেছিলাম এই কাজে। যুবক বয়স থেকে এই কাজে নিমগ্ন থাকতে গিয়ে আমি জীবনে চাকরীর চেষ্টা পর্যন্ত করতে পারিনি। বাড়িতে, আত্মীয়মহলে, এমনকি প্রতিবেশী দরবারে নানা নিন্দামন্দ আমাকে শুনতে হয়েছে। আমাকে বাউন্দুলে হিসেবে অনেক বদনাম শুনতে হয়েছে। তখন এনজিও শব্দটি মানুষ তেমন শোনেনি। এনজিও পুরো কথাটাও জানা ছিলো না মানুষের। এটি খায়, না মাথায় মাখে--- তা জানতে চায়নি কেউ। তখন থেকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে চলতে আজ শিশোকে একটা ভালমন্দ রূপ আমি দিতে পেরেছি। আজ গোটা উত্তর ২৪ পরগনা জুড়ে আমার এই সংগঠনের কাজ চলে। শিশুদের এমনকি তাদের পরিবারের বয়স্কদেরও স্বাক্ষরতা দেওয়া থেকে শুরু করে তাদের সচেতনতা তৈরী আমার এই শিশোর কাজ। কিন্তু আজ আর আমাকে বাউন্দুলে, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানে পার্টি ইত্যাদি ইত্যাদি শুনতে হয় না। বরং আজ আমি শুনি, আমি লেগেছিলাম বলেই এখানে আসতে পেরেছি। আজ আমার এটাই জীবন-জীবিকা। শুধু জীবিকা নয়, আজ প্রতিবেশী ও আত্মীয়মহলে আমি ঈর্ষার পাত্র। আমার নিজস্ব একটা গাড়ি, তিনতলা বাড়ি, বিদেশ ভ্রমণ থেকে শুরু করে সব। সবকিছুতেই আমি আমার আত্মীয়মহলে সবচেয়ে এগিয়ে। সবই আমার এই শিশোর কল্যাণে। তাই আজ মানুষ আড়ালে বলে--- ধান্ধাবাজ। সমাজের কাজ করে, না হাতী করে।
কিন্তু আমি ওসব কথায় কান দেই না, কারণ আমার শিশোতে আজ কাজ করে জীবিকা অর্জন করছে অন্তত এগারোটি মেয়ে, তেইশ জন ছেলে। তাদেরকে আমি রীতিমত মাইনে দিই। অন্তত দু-হাজার শিশু আর তাদের পিতামাতা জড়িয়ে আছে এনজিও-টির সাথে। আমার স্ত্রী কিন্তু আমাকে এ বিষয়ে মোটে পোঁছে না। সে বলে,
--- ছাড়ো তো। ফুটপাথের শিশুদের আবার পড়াশুনো। পড়াশুনো কি সবার জন্যে! সবাই যদি সব করে, তবে তো মহা মুশকিল। এইজন্যেই বর্ণাশ্রম ছিল সমাজে। সব কাজ সকলকে দিয়ে কোনোদিন হয়নি, হয়ও না। প্রকৃতি সকলকে একই সামর্থ্য দিয়ে পাঠায়নি।
আমি মুখস্ত করা কথা বলি--- সে কি! এ তো অগণতান্ত্রিক আর কায়েমি স্বার্থের কথা বলছো তুমি। একটা সভ্য দেশে এমনটা চলে নাকি!
--- চলে চলে। জোর করে অন্য কিছু চালাতে গেলে অনর্থ হয়। দেখছো না? দেশে কী অনর্থ ঘটছে?
--- কী অনর্থ ঘটছে? আমি ভ্রু কুঁচকে বলি।
অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং গভীর আস্থার সাথে আমার স্ত্রীদেবী বলেন--- চাষির ছেলেপুলে দল বেঁধে চাষ ছেড়ে চাকরী করতে ছুটছে। একদিকে চাষের জমি নিষ্ফলা যাচ্ছে, আর একদিকে যাদের সেই জমিটুকু নেই, তাদের চাকরীতে থাবা বসাচ্ছে এইসব মানুষ। বেকার সমস্যা বাড়ছে। আরে বাবা, ধাঙ্গড় যদি বলে, নোংরা ধোব না, বাবু হবো, তবে তো তোমাকে-আমাকে সেই নোংরা ঘাঁটতে হবে। সেটা পারবে তো?
আগে ভেবে না দেখলেও তক্ষণই মেনে নিতে পারিনি স্ত্রীর এ হেন অকাট্য যুক্তি। তাই বিরোধ করি--- তাই বলে শিশুর জন্মগত অধিকার থাকবে না! সে পড়াশুনো করতে পারবে না! এটা কি বিচার? ওদের এই শৈশব কি প্লাস্টিক কারখানায়, দেশলাই কারখানায়, চায়ের দোকানে খাটতে খাটতে শেষ হবার জন্যে?
আমার স্ত্রী আক্রমণ করে--- এ্যাতো যে বলছো! বলতো, কারা ওরা? আমি বলছি, শোনো। ওরা বাংলাদেশ থেকে ঝেঁটিয়ে এখানে এসে ভিড় বাড়িয়েছে। দুমদাম বাড়িঘর, ফ্ল্যাট, দোকান কিনে নিচ্ছে, বাজার দর বাড়িয়ে ফেলছে, টাকার গরম দেখাচ্ছে। এ হলো পয়সাওয়ালা মানুষগুলো। ওরা আমাদের মুখের অন্ন তো ছিনিয়ে খাচ্ছেই, এবার ঐ রাস্তার মানুষগুলো আরো কী কি ছিনিয়ে নেবে, কে জানে। আর কারখানার কথা বলছো? ওদের বাপ-মা তো ওদেরকে কাজে পাঠিয়ে ওদের রোজগার খাবে বলেই ওদেরকে পৃথিবীতে এনেছে। যার বিয়ে তার হুঁশ নেই, পাড়া-পড়শির ঘুম নেই। বাপ-মা তাদের সন্তানকে ক্যাশ করছে, আর তুমি করবে দেশোদ্ধার। ওদের ল্যাঠা ওদেরকেই সামলাতেই দাও না কেন? তুমি কে? সরকার আর পার্টি তো তোমাকে-আমাকে নয়, ওদেরকে দেখার জন্যে এক পা তুলে বসে আছে। এ্যাতোগুলো এক্সট্রা ভোট। এর মধ্যে আবার তুমি কেন?
আমি কী করে স্ত্রীকে বোঝাই, হে বঙ্গললনা, তুমি যাহা কহিতেছো, তাহা যথার্থ বটে। কিন্তু এই যে তোমার এই ঠাট-বাট--- এই সকল  তো ওই শিশুগুলাকে মাধ্যম করিয়াই ঘটে। আমি যে মুঠা মুঠা অর্থ বরাদ্দ পাই, তাহা তো তোমার উদরস্থ করিবার জন্য নহে, রানী। এই এনজিও-টিকে ভরসা করিয়াই তো তোমার এই গৃহে আগমন, শপিং নামক একটি ব্যয়বহুল নেশা করা, ভ্রমণ, ফুর্তি।
কিন্তু সব কথা তো মুখ ফুটে বলতে হয় না। সব সত্যি জানার নয়, সব সত্যি বলার নয়, সব সত্যি বোঝাবারও নয়। আমিও মানি, আমার স্ত্রী যা বলছে, তা শতকরা একশ ভাগ সত্যি। আমি এইসব এনজিও-ফেনজিও করে দেশের কোনো বিপ্লব-টিপ্লব ঘটাবো না। শুধু রাজভোগ চাই আমার। এটা একটা মোক্ষম পথ। আমি জানি যে, আজকের দিনে এসব নিতান্ত ভালো কিছু ভাবা একটা বিলাসিতা মাত্র। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু এলোমেলো বিপরীত ভাবনাও আমার মাথায় চেপে বসে। আগে এমন ভাবনাটা মোটেই হতো না। কিন্তু আজকাল রাতে ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি, কে যেন বলছে, তুমি একটা হিপোক্রিট, নরকের কীট। প্রতারণা করে জীবন ধারণ করছো।
আজও এইসব ভাবছিলাম, এই সময় আমার প্রজেক্ট এগজিকিউটিভ সমর এসে প্রায় কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে জানালো--- স্যার, ভেরি সরি, একটা কথা আপনাকে জানানো হয়নি। অবশ্য এটা আমারই দোষ। আমি আমাদের এই লেটেস্ট এক্সটেনসিভ প্রজেক্টটা কভার করতে গিয়ে একটা সাইট মিস করে গেছি। অথচ কাজটা প্রায় শেষের পথে।
আমি কৌতূহলী--- কী ব্যাপার বলো তো? কোন সাইট?
--- আর এন বোস রোড, স্যার। ওখানে বেশ কিছু স্লাম টাইপ ঝোপর পট্টি আছে। অন্তত আড়াইশো ফ্যামিলি আছে আর এন বোস রোডের দুপাশের ফুটপাথে। পুরোটা বাদ পড়ে গ্যাছে।
আমার মাথায় হাত পড়ে গেলো শুনে। প্রজেক্টটা প্রায় সমাপ্তির পথে। এটা জমা দিতে পারলেই একটা ফ্যাট গ্র্যান্ট এসে যাবে। এটা আমার শীশোর কাজের সবচেয়ে বড়ো গ্র্যান্ট। আগামী সাত দিনের মধ্যে এর টোটাল ফিচার আমাকে দিতে হবে। এমনকি এর একটা সার্ভেও করা হবে টাকা স্যাংশান করার আগে। কিন্তু হাতে সময় কৈ? সমর আমার বিরাট টেবিলটার সামনে নিতান্ত অপরাধীর মতো মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তো বলতে পারছি না, দোষটা আমারও। প্রজেক্ট সীটটা চেক করার সময় আমিও মিস করেছি এই এরিয়া। আর এন বোস রোড আমার অচেনা নয়। আমার অফিস থেকে মাত্র পাঁচটা বাস স্টপেজের পরে। শুধু তাই নয়। বরং বললে ভালো হয়, এটা আমার বিলক্ষণ চেনা লোকালিটি। এর সাথে জড়িয়ে আছে একটা অবিস্মরণীয় স্মৃতি। মাত্র দুটো বছর আগের ঘটনা সেটা।
প্রত্যুষ। মানেন প্রত্যুষ মৈত্র আমার ক্লাসমেট। ওর বিয়েতেও আমি ছিলাম। শুধু ছিলাম না, ওর বাসরঘর থেকে শুরু করে ফুলশয্যা অবধি আমার আবাধ বিচরণ ছিল। সেই প্রত্যুষ ওর বিয়ের পরের বছরেই হঠাৎ একদিন আমার সাথে কনট্যাক্‌ট করে ও। একটা ভয়ঙ্কর প্রব্লেমে ফেঁসে গিয়ে আমার হেল্প চায়। আমি ওর বাড়ীতে গিয়ে একেবারে আকাশ থেকে পড়লাম। যা ঘটেছে, তাতে না আছে ওর হাত, না আছে ওর মিসেস-এর হাত। একেবারে ঈশ্বরের মার। সত্যিই ওরা ফেঁসে গিয়েছে একটা ক্রাইসিসে। ওর মিসেস প্রেগন্যান্ট--- এটা আমি জানলাম। সেটা তো ক্রাইসিস নয়। কিন্তু এই প্রেগ্ন্যান্সির পরিণাম যে এমন ভয়াবহ হবে, তা তো কেউ ভাবেনি। ইউএসজি করে ডাক্তার বলেছে যে, বেবি এ্যাবনরম্যাল। পসিব্লি স্প্যাস্‌টিক পেশেন্ট হবে বেবি। প্রথম চাইল্ড স্প্যাসটিক হবে এটা মেনে নিতে পারে কোন প্যারেন্ট? প্রত্যুষও পারেনি। অথচ সিচুয়েশন তখন হাতের বাইরে। বেবি এ্যাতোটাই ম্যাচিওরড হয়ে গেছে যে, এ্যাবোর্‌ট অসম্ভব।
মাথা গরম করে প্রত্যুষ আমাকে বলে ওঠে--- দেব, আই কান্ট এ্যাফোর্‌ড দিস। এই চাইল্ড নিয়ে আমি কি সারা জীবন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলবো নাকি? এই আপদ নিয়ে আমি কী করবো!
আপদ কথাটা এমনভাবে বলল, যেন আমিই ওর স্ত্রীর প্রেগ্ন্যান্সির জন্যে বা এই বেবি এ্যাবনরম্যাল হবার জন্যে দায়ী। আমি অবস্থা সামাল দিতে গিয়ে বলি--- আহা, মেনে নিবি না, তো কী করবি? এতে তো কারোর হাত নেই রে। আর বেবিরই বা কী দোষ! শান্ত হ। সব ঠিক হয়ে  যাবে।
কথাকটা বললাম বটে, কিন্তু আমি নিজেও জানি, কিছুই ঠিক হবার নেই। এই বেবি যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন এর লোড ওদেরকে বইতে হবে। এটা অবশ্য মঙ্গল যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমন বেবি দীর্ঘকাল বাঁচে না।
প্রত্যুষ কী বুঝলো, জানি না। কিন্তু আমার কথা শুনে আর কোনো দ্বিতীয় মন্তব্য করলো না। শুধু আমাকে বলল,--- এ ফ্রেন্ড ইন নীড ইজ এ ফ্রেন্ড ইনডিড, দেব। আমাকে একটা হেল্প কর।
আমি টেড়িয়ে তাকিয়ে দেখলাম, ওর বৌ নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে। এই অবস্থায় কী বলতে হয়, আমি জানি না। আমি তো বিয়েই করিনি তখন। শুধু মনে মনে জপ করছি, ঐ রকম একটা প্রভার্‌ব দিব্যি দিয়ে আমাকে যেন আবার বলে না বসে, তোর শীশোতে বাচ্চাটা বিয়ে নে। আমার তো সে রকম কোনো প্রভিশন নেই। তাই ক্যাবলার মতো বললাম--- কী হেল্প চাইছিস, বল।
--- তোর তো নানা ডাক্তার-বদ্যি নিয়ে কারবার। আমাকে একটা ভালো গায়নো দে। বেশ ভালো গায়নো। পুরুষ। মহিলা হবে না। আমি তার কাছেই ডেলিভারি করাবো।
আমি ভাবলাম, পুরুষ কেন? সকলে মহিলাই তো চায়। বললামও--- কেন? পুরুষ কেন?  
ও বলল--- এটা খুব ডেলিকেট কেস। ডাক্তার বলেছে। আমি কোনো লেডি ডকের ওপর ডিপেন্ড করতে পারছি না। 
আমি কথাটা শুনলাম, মনে মনে আনন্দিত হলাম, কেননা আমি যে আশঙ্কা করছিলাম, তেমন তো কিছু বলেনি। উপরন্তু আমার কথা শুনেছে। আর যেটা ও চাইছে, সেটা তো আমার পক্ষে জলভাত। ঐ আর এন বোস রোডের যে নার্সিংহোম আছে, সেটা এতদঞ্চলের সবচেয়ে বড়ো আর অভিজাত নার্সিংহোম। এর সাথেই যুক্ত আমার বিশেষ খাতিরের ডক্টর বুধাদিত্য রায়। একডাকে চেনে সকলে। তাই প্রত্যুষের স্ত্রীকে ভর্তি করা হল লাইফ টাইম নার্সিংহোমে। কিন্তু কেন যে ও আমার পরিচিত ডাক্তার চাইছিলো, তা আমি তখন বুঝতে পরিনি। বৌ-এর নার্সিংহোমে এ্যাডমিশন হবার পর থেকেই ও ডাক্তারকে, নার্সকে জনে জনে ঐ স্প্যাস্‌টিক বেবির দায় তুলে নেবার জন্যে বা অন্য কোথাও তুলে দেবার জন্যে একটা চ্যানেল করতে চেষ্টা করছিলো। এমনকি মোটা টাকা অফার করতেও পেছোয়নি। আমাকে ডাক্তার বুধাদিত্য রায়ই আমাকে ফোনে সবটা জানালেন। শুনে তো আমি থ। জানি, এই বেবি ওর জীবনে একটা অভিশাপ। কিন্তু তাই বলে এখন থেকেই এমনটা ভেবে বসবে, আর তার প্রস্তুতি নেবে, তা ভাবিনি। ও আমার সম্মানটাও ভাবল না। এখানে আমি সম্মনীয় ব্যক্তি। ভাবলাম, ওর বৌ-ই বা কীরকম মহিলা! কিছু বলছে না!
কিন্তু হলো না। কাউকে পেলো না প্রত্যুষ যার হাতে নিজেকে দায়মুক্ত করার উপায় পাবে। কিন্তু ও যে ভয়ংকর কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারে, তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। পরে সিজারিয়ান করে প্রত্যুষের বউ-এর ডেলিভারি হতে বুঝলাম ওদের ডাক্তার ঠিকই বলেছিলেন। আমি ওইদিনই শেষবার নার্সিংহোমে গিয়েছিলাম। প্রত্যুষকে দেখে আমি আরো অবাক। ও কিন্তু কোনো বিতর্ক না করে, কোনো সীন ক্রিয়েট না করে একদম চুপ। অনেকটা ঝড়ের আগে যেমন করে আকাশে মেঘ থম মেরে থাকে। প্রত্যুষ বৌ-এর ডেলিভারি করিয়ে নিয়ে চলে গেলো। কিন্তু আমি অবাক হলাম, কেননা এই নার্সিংহোম  থেকে ডিসচার্জ নিয়ে চলে যাবার সময় আমাকে কোনো খবর দেয়নি প্রত্যুষ। ভাবলাম, দেয়নি তো বেঁচে গেলাম। আমি আর গা করিনি, কোনো খবর নেইনি। নেইনি মানে নিতে পারিনি। আমার এ্যাম্বিশন আমাকে ছুঁড়ে দিলো ব্যস্ততার জগতে। মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দিলাম, নিজের সন্তানকে স্বচক্ষে দেখার পর হয়তো সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছে প্রত্যুষ। বাবা তো। বাবা না হওয়া পর্যন্ত এক, হলে পরেই সম্পূর্ণ ভিন্ন।
কিন্তু আমার বিয়েতে ওদেরকে নিমন্ত্রণ করতে গিয়ে জানলাম, ওরা শিফ্‌ট করে গেছে। কোথায়, আমাকেও জানায়নি প্রত্যুষ। আশ্চর্য। কিন্তু ভীষণ অবাক হলাম জেনে যে, কী একটা কারণে প্রত্যুষ আর মল্লিকার মধ্যে নাকি সেপারেশন হয়ে গেছে। বাবা-মা হবার পরেই সেপারেশন। কেন, কে জানে। ভাবলাম, জানবারই বা কী দরকার! এ তো আকছার ঘটছে। আমার খুড়তুতো বোনই তো। বিয়ের সাত মাস পরেই ডিভোর্স। কিন্তু আমার চোখে মাঝে মাঝে কেন জানি, প্রত্যুষের বাচ্চাটার একবার দেখা নিষ্পাপ মুখ, ফর্শা ধবধবে চেহারা, আর কচি কচি হাতের একটিতে একটা সুতো দিয়ে টিকিট ঝোলানো নম্বর ২৪ ভেসে ভেসে উঠতো। ঐ ২৪ নম্বরটা বেশ কিছুকাল আমাকে ভুলতে দেয়নি ঘটনাটা। শেষের দিকে স্মৃতিতে শুধু ঐ নম্বরটা ভাসতো। ২৪। মনে মনে বাচ্চাটাকে কমপ্লিমেন্‌টস দিলাম, যা শালী, তোর নাম জানি না বটে। কিন্তু তুই খুব করলি যা হোক। যে বাপ তোকে প্রায় ত্যাগই করেছিলো, সে-ই তোকে দেখা ইস্তক নিশ্চয়ই ফেলতে পারেনি। থ্যাঙ্ক ইউ। একটা পাপ থেকে বাঁচিয়ে দিলি আমার বন্ধুটাকে।


সেই আর এন বোস রোড। আমার প্রজেক্ট এগজিকিউটিভ সমরের এমন ক্ষমতা হয়নি যে, এই সামান্য সময়ের মধ্যে আর এন বোস রোডের প্রায় দু-আড়াইশো ফুটপাথবাসীর রিপোর্ট বানিয়ে জমা দিতে পারবে। আমি বুঝলাম, এটা আমাকেই করতে হবে। কীভাবে একটা বিরাট কাজ ঝটিতি করে ফেলতে হয়, সেই ম্যাজিকটা তো ওর জানার কথা নয়। সমর যে জানে না, সেটা সমর নিজেও জানে। ফলে আমাকেই কাজে নামতে হবে। আমাদের আত্মীয়মহলে বলে দেব সেনশর্মা একটা জ্যান্ত ম্যাজিক। মাটি ধরলেই নাকি সোনা। আমি গোটা বিষয়টা একবার ছকে নিয়ে পরের দিনই হাজীর হলাম আর এন বোস রোডে। চোখে পড়লো সেই লাইফ টাইম নার্সিংহোম।
আমি মনে মনে ঠিক করলাম, এমন কয়েকটা ঘরে আমি আমার কোয়েরিজ চালাবো, যাতে সবকটা ঘরে আমায় ঢুকতে না হয়। এতেই আমি একটা মোটামুটি ফিচার পেয়ে যাবো। একেবারে ছকে বাঁধা কোয়েরিজ। বেছে বেছে একটা একটা করে দুটো ঘর ভিজিট করে শেষে যে ঘরটাতে এলাম, সেই ঘরটা আমাকে ভীষণ আঘাত করলো। লোকটির নাম বীরেন পাইন। দুই মেয়ে আর তিন ছেলের বাপ--- এমনটা বীরেন পাইনের বৌ জানালো। দেখলাম, বিজ্ঞাপনের ঢাউস ঢাউস হোরডিঙ্গ ছিঁড়ে এনে পুরনো ছ্যাচার বেরা দিয়ে ঘর বানিয়েছে। অন্য পাঁচজনের ঝুপড়ির মতোই ঝুপড়ি। একটা ঝুপড়িতেও শৌচকর্ম করবার কোনো ব্যবস্থা নেই। মিনিট কুড়ি হেঁটে গেলেই রেললাইন। সেখানেই প্রাতঃকৃত্য সম্পন্ন করে হয়তো। দেড় হাত চওড়া একটা ফালি বারান্দা পেরিয়ে এক চিলতে ঘর। তাতে কোনো চৌকি-টৌকি নেই। তক্তা পেরেক মেরে পাটাতন বানিয়ে খাট, আর ইট সাজিয়ে খাটের পায়া। পুরনো টালি দিয়ে ছাদ। চারদিকে শুধু পলিথিন আর পলিথিন। বর্ষায় আর ঠাণ্ডায় কীট-পতঙ্গের মতো বেঁচে থাকে ওরা। একটি মেয়ে বাইরে বসে বাসন মাজছিলো। বীরেন পাইনের বৌ আমাকে ভেতরে ডেকে নিয়ে গিয়ে জানালো যে, বীরেন গিয়েছে কাজে। ও মিউনিসিপ্যালিটির ময়লা পরিষ্কার করার কাজ করে। পাড়ায় পাড়ায় ময়লা তুলে এনে একটা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলাই ওর কাজ। আজও তাকে কর্তৃপক্ষ পার্মানেন্ট করেনি। বৌ বাড়ি বাড়ি ঠিকে ঝি-এর কাজ করে। সবে কাজ সেরে বাড়ি ফিরেছে সে। তিন ছিলের দুটি গেছে কাজে। একটি ট্রেনে হকারি করে। আমলকী ব্যাচে। আর একটি কাজ করে একটা চায়ের দোকানে। ছোটটি ঘরের মধ্যে বসে আছে সবচেয়ে ছোট কন্যা সন্তানটিকে আগলে। সবচেয়ে ছোটটি একেবারে ছোট, কিন্তু কত বয়স হবে, কে জানে। বাচ্চাটা বিছানায় শোওয়া। ছেলেটিকে দেখে আন্দাজ করতে হয়। কিন্তু শায়িত বাচ্চাটি দেখে আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। বেশ মনে হল, বাচ্চাটি বোধহয় হ্যান্ডিক্যাপড্‌। তার চেয়ে যেটা আমাকে বেশী করে ঘাবড়ে দিচ্ছিলো, সেটা হল, বাচ্চাটা কেমন যেন হাবে-ভাবে অস্বাভাবিকও লাগছে। একেই বলে স্প্যাস্‌টিক চাইল্ড। এইসব ফুটপাথবাসীদের বাচ্চাদের মধ্যে এই রোগটা তেমন করে আমি আগে পাইনি। ওদের অন্য নানা রোগ দেখেছি। ম্যালনিউট্রিশনের রোগ্‌ পোলিও, বেরিবেরি, আরো এটা ওটা। কিন্তু এই এ্যাবনরম্যালসি দেখিনি। ভাবলাম, হতেই পারে। এটাকেই কেন্দ্র করে আমি আমার স্ত্রীর ভাষায় একটু রেগে গিয়েই মহিলাটিকে বললাম,
--- তোমার একটি মেয়ে আর তিন-তিনটি ছেলে। তবুও তোমাদের আরো একটি সন্তানের কী দিরকার ছিল, বলো তো। আর এমনটা করতে গিয়ে এই রুগ্ন মেয়েটিকে পৃথিবীতে আনলে! আমার তো মনে হয়, একে বিয়ে দিতে পারবে না, একে দিয়ে তুমি কোনো উপার্জন করাতেও পারবে না। কিন্তু কে দেখবে একে? সেটা ভেবে দেখেছো? সামনের বড়ো বড়ো স্কাই স্ক্র্যাপার দেখিয়ে বললাম--- ঐ যে বাড়িগুলো দেখছো, ওখানে এমন রুগ্ন শিশু জন্মালে ওরা দেখতে পারে। ওদের টাকা আছে, পয়সা আছে। তবুও ওরা চায় না, এমন সন্তান ওদের পরিবারে আসুক। তোমরা তো সাধ করে এমনটা করলে। তোমার একটি মেয়ে রয়েছে, তিনটি ছেলে রয়েছে, তবুও...
আমাকে থামিয়ে দিয়ে মহিলাটি যা যা বলল, তাতে আমি যেন পালাতে পারলে বাঁচি। ইতিমধ্যে বড়ো মেয়েটি ওর হাতের কাজ ফেলে, হয়তো বা হাতের কাজ সেরে দরজার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর চোখেমুখে কেমন একটা ভয় ভয় ভাব। মেয়েটির বয়স পনেরো, কি ষোল হবে। সবকটি বাচ্চাই প্রায় এক দেড় বছরের ব্যবধানে জন্মেছে। ছোট ছেলেটি পরম যত্নে তার ছোট বোনটিকে মশামাছি থেকে নিজের হাত আন্দোলিত করে করে করছে। আমাদের ঘরে এইটুকু বাচ্চা একটি ছেলের মধ্যে এই কেয়ারিং বা এই স্নেহময়তা বড়ো একটা চোখে পড়ে না। তারাই তো থাকে আদরে-গোবরে। কিন্তু এই শিশুটি যেন কতটা পরিণত, কতটা সচেতন। আমার সম্বিৎ ফিরল ওদের মায়ের কথায়। সে বলল,
--- বাবু, এই বাচ্চাটাকে দেখুন তো। এবার আমাকে দেখুন। আপনার মনে হয়, এই বাচ্চা, এমন ফর্শা টুকটুকে মেয়ে কি আমার মতো কালো কুশটি মেয়েলোকের পেটে হয়?
আমি কী জবাব দেবো, জানি না। আমি এও জানি না, মেয়েটা এমন বলছে কেন। কী বলতে চায় ও? তাই বলেই দিলাম--- মানে? তোমার ঘরে পালিত হচ্ছে যে বাচ্চা, সে কি অন্য কারোর নাকি? আর ওভাবে কে কালো কুশটি, আর কে ফর্শা টুকটুকে--- তা তো বিচার করা যাবে না। আর আমি পুলিশও নই, যে তোমাকে এ্যারেস্ট করবো। আমি তো জানতে চাইছি। তুমি বলো।
মেয়েটা একবার বড়ো মেয়েটির দিকে, একবার নিজের ছোট ছেলেটির দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল--- আমি এই বাচ্চাটাকে আজ দু বছর ধরে পালছি। এর বয়স দুই বছর।
আমি হতবাক। পালছি মানে! তাই বললাম--- পালছো? তুমি কি দত্তক নিয়েছ নাকি? কিন্তু কেন গো মেয়ে? তোমার সন্তান থাকতে আবার দত্তক নিতে গেলে কেন? 
মুচকি হাসে বীরেনের বৌ। বলে--- দত্তক! এমনিতেই নিজেদের ছেলেমেয়ে পালতে পারি না। আবার দত্তক নেব কীভাবে, বাবু?
--- তবে? 
এবারে মহিলা আমার পায়ে পড়ে আর কি। হাতজোড় করে বলে--- বাবু, আপনাকে আমরা চিনি। আপনি আমাদের ঘরের বাচ্চাগুলোর জন্যে অনেক কিছু করেন। আমি সত্যি বলছি, আমি এই বাচ্চাটাকে কিন্তু চুরি করিনি।
চুরি যে ওরা করেনি, সে আমিও জানি। চুরি করে করবেটা কী? চুরি করে বিক্রি করে দেওয়া ছাড়া তো আর কোনো কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু বিক্রি যে করেনি, সে তো দেখতেই পাচ্ছি। আর সবচেয়ে বড়ো কথা হল, এই বাচ্চা কেউ কিনবেই বা কেন? তবে? মেয়েটি নিজেই উত্তরটা দেয়,
--- একে আমার বড়ো ছেলে পিলু ঐ নোংরার মধ্যে কুড়িয়ে পায়।
--- কুড়িয়ে পায়, মানে!
--- সকালে উঠে দাঁতন মাজতে মাজতে ঘাট করতে যাচ্ছিলো। সেই সময় ঐ নোংরার মধ্যে একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়। একটা তোয়ালে দিয়ে জড়ানো ছিল। নিশ্চয়ই কোনো বড়লোকের বাড়ির মেয়ে হবে। পিলুর তো ঘাট যাওয়া মাথায় উঠলো। বাচ্চাটাকে এনে হাজীর করলো বাড়িটতে। ওর বাবা তো কিছুতেই রাখবে না। কার না কার বাচ্চা! থানা পুলিশ হবে। অনাথ আশ্রমে দিয়ে দেবে। কিন্তু অনাথ আশ্রম যে কোথায় আছে, তা তো চিনি না। অনেক কান্নাকাটি করে ওর বাপকে রাজী করালাম। সেই থেকে ও আমাদের কাছেই আছে। আমার ছেলেমেয়েরা ওকে খুব ভালোবাসে। কোন বাড়ির বাচ্চা, আমরা জানি না। কেউ কখনও এই বাচ্চাটাকে খুঁজতেও আসেনি।
মায়ের কথাটাকে কেটে দিয়ে সবশেষে বড়ো মেয়েটি বলে উঠলো--- বাচ্চাটার হাতে একটা টিকিট লাগানো ছিল। তাতে লেখা ছিল ২৪
আমি যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলাম। ২৪! ও মাই গড! ২৪! আবার সেই ছোট্ট অবুঝ আর নিষ্পাপ একটা ২৪ লেখা সদ্যজাত শিশুর হাতের ছবি আমার চোখের সামনে ফুটে উঠলো। আমি ওদেরকে কী বলবো? আমি কী-ই বা করবো? কাঁদবো, না আনন্দে ফেটে পড়ব, নাকি লজ্জায় সেখান থেকে পালাব? আমি। আমি এসেছি ওদেরকে জীবনের সন্ধান দিতে, একটু নিশ্চিন্ততার আলো দেখাতে। আমি কি জানি, সুখ কী? আনন্দ কী? জীবন কী? কাকে আমি আলো দেখাবো? কোন আলো? আলোর সন্ধান আমি কি আদৌ জানি? নিজেকে সামলে নিয়ে একটু জোর করে হেসে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম,
--- ওর নাম কী? কী বলে ওকে ডাকো?
লজ্জায় গুটিয়ে গিয়ে দজারটাতে অকারণে কি একটা খুঁটতে খুঁটতে পঞ্চদশী উত্তর দিলো--- রাজকুমারী। আমার ভাই ওর নাম দিয়েছে। ওকে কি সুন্দর দেখতে! তাই আমরাও ডাকি রাজকুমারী
আমি মনে মনে ভাবি, সত্যিই তুই রাজকুমারী রে। নরক থেকে স্বর্গে এসেছিস। আমরা পারিনি। নরকেই আছি। অনেকগুলো কবিতার ছত্র, উপন্যাস আর প্রবন্ধের নানা বাক্য চোখের সামনে ভেসে ভেসে উঠছিলো। কিন্তু বাস্তবের সামনে সেগুলো জেনও ফিকে লাগছিলো। আমি বুঝলাম, এই গ্র্যান্ট-টা আমার পাওয়া হচ্ছে না। আমাকে আবার নতুন করে গোছাতে হবে। সব গোছাতে হবে। আমার শিশোকে গোছাতে হবে। নাই বা পেলাম গ্রান্ট। ওরকম কত গ্রান্ট আসবে, যাবে! আমি এই রাজকুমারীর ঘর থেকেই সব নতুন করে শুরু করবো। কাগজ-পত্র গুটিয়ে-বাটিয়ে ওদের ঘরের বাইরে এসে প্যান্টের দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে আর আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা পবিত্র শ্বাস নিতে খুব চেষ্টা করলাম। কিন্তু এই বস্তির বাইরে কোথায় সেই পবিত্র শ্বাস?

------------------------

সোমবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১২

"অস্তিত্ব" ছোটগল্প



অস্তিত্ব

হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়


অজয়ের মৃতদেহ পাওয়া গেলো রেল লাইনের ধারে। দমদম জংশন থেকে বেরিয়ে বনগাঁ লাইনের ট্রেন যখন মাল্টি লাইন ছেড়ে একটু ডান দিকে ঘুরে গিয়ে বনগাঁ ট্র্যাক ধরে, সেখানেই ওর বডি পাওয়া গেলো। তেমন কিছু হয়নি বডির। জিআরপি জানালো যে, ট্রেনে ধাক্কা লাগতেই পাশে ছিটকে পড়ে মৃত্যু ঘটেছে। অজয়ের পকেটে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। শুধু ওর মানিব্যগ, আই কার্ড, একটা স্লিপ যাতে বাড়ির ঠিকানা, ফোন নম্বর লেখা। সাধারণ চোখে এটা আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। ওর আইডেন্টিটি পুরোটাই পাওয়া গেলো বলে বাড়িতে জানাতে কোনো সমস্যা হয়নি জিআরপির। খবর পেয়ে অজয়ের বিবাহিতা দিদি এসেছে, অজয়ের দাদা ব্যাঙ্গালোর থেকে সোজা ফ্লাইটে এসেছে। কিন্তু যেহেতু অজয়ের বাবা বিজয় সরকার লোকাল থানায় একটা মিসিং ডায়রি করেছিলেন, এবং বডি আইডেনটিফাই করতে গিয়ে এটাকে একটা মার্ডার কেস বলে থানায় অভিযোগ দায়ের করে বসেছেন, সেহেতু বডি পুলিশের হাতে দিতেই হলো। পোস্ট মর্‌টেম-ফরটেম তারাই করবে। জিআরপি থেকে শুরু করে পুলিশ পর্যন্ত জানালো যে, বডির পোজিশন, কন্ডিশন ইত্যাদি দেখে ওদের ধারনা, এটা কোনো হত্যাকাণ্ড নয়। এটা নিছকই একটা আত্মহত্যা। কিন্তু বিজয় বাবু যেহেতু রাজনীতির সাথে ভালোমন্দ জড়িত, সেহেতু তাঁর একটু-আধটু প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে প্রশাসন মহলে। অজয়ের বডির সন্ধান পেতেই তিনি এফআইআর করে বসেছেন। সেই চাপেই পুলিশ বাধ্য হলো একটা তদন্ত শুরু করতে। তদন্তটা অবশ্য তাদের কাছে একটা বড়ো রহস্য হল এই কারণে যে, বিজয় বাবু কারোর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করতে পারছেন না। তাঁর জানা নেই কে বা কারা এর পেছনে থাকতে পারে। তিনি রাজনীতির এমন কোনো ব্যক্তিত্ব নন যে, তাঁর ছেলেকে হত্যা করে বিরুদ্ধ কোনো দল একটা বিরাট ফায়দা তুলবে। এমনকি তিনি দলের কোনো জঙ্গি নেতাও নন যে, তাঁর ওপরে অন্য কোনো পার্টির অতীতের বা বর্তমানের কোনো ক্ষোভ থেকে থাকবে। কিন্তু বিজয় বাবুর কথা হলো,
--- যে ছেলেটা দিব্যি এ বাড়ি থেকে শিফ্‌ট-এর জন্যে নিজে হাতে জিনিসপত্র গোছালো, কোন বাড়িতে ভাড়া যাবো আমরা, তা দেখে-টেখে পছন্দ করে এলো, দিব্যি এ বাড়ি ভেঙ্গে ফ্ল্যাটের কী ডিজাইন হবে, তা নিয়ে আমাদের সাথে আলোচনা করলো, সে কেমন করে, মানে কেনই বা আচমকা সুইসাইড করতে যাবে! আমাদের সাথে তো ওর কোনো বচসা, মতানৈক্য কিছুই ঘটেনি! এটা ডেফিনিটলি একটা প্ল্যান্‌ড মার্ডার। কোনো একটা রহস্য আছে এর পেছনে।
বিজয় বাবু এই শুধু বললেন না, প্রশাসনের ওপরে বেশ চাপ দিলেন রহস্য উদ্ধারের জন্যে। তিনি চান, তাঁর ছেলের যে বা যারা হত্যাকারী, তাদেরকে কঠিন শাস্তি তিনি দিয়েই ছাড়বেন। স্থানীয় রাজনৈতিক হোমরা-চোমরাদেরকে তো পুলিশ-প্রশাসনের একটু মন যুগিয়েই চলতে হয়। ফলে পুলিশও বিষয়টিকে একেবারে ধুয়েমুছে দিতে পারলো না। তদন্ত চালাতেই হলো। যদিও পুলিশ জানে, আজকাল এই প্রজন্ম সব সময় কোনো বিশেষ ষড়যন্ত্রেই আত্মহত্যা করে না। প্রেমে ব্যর্থতা, বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতা, পরীক্ষায় অসফলতা, জীবনে না চাইতেই সবকিছু পাওয়া বা হঠাৎ কোনো কারণে কোনোকিছু পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ায় ব্যর্থতা, এমনকি বাবা-মার যৌথ চাকরী জীবন হওয়ার ফলে তাদেরকে কাছে না পাওয়া এবং নিজে কোনো গঠনমূলক কাজে নিজেকে যুক্ত না করার ফলে একটা ওমনি এসে যাওয়া ডিপ্রেশন--- এইসব ছেলে-মেয়েকে আত্মহত্যায় প্রবৃত্ত করে। এসব পুলিশের খুব জানা বিষয়। তাই এইসব মাধ্যম করেই তদন্ত করা শুরু করে পুলিশ।
বিজয় বাবু নিজে এবং তাঁর স্ত্রী উভয়েই চাকরী করেন। ফলে বিজয় বাবুর মেয়ে ও দুই ছেলে ছোট থেকে প্রায় একা একাই জীবনে বড়ো হয়েছে। একা খেয়েছে, একা পরেছে, একা অধ্যয়ন করেছে, কিন্তু পরীক্ষায় তারা কখনও মন্দ ফল করেনি। বরং বেশ ভালো ছাত্রছাত্রী হিসেবেই ওদের পরিচিতি ছিলো। তবে অজয় তথাপি তুলনামূলকভাবে একটু বেশী একা ছিল। কেননা, বিজয় বাবুর ছেলে সঞ্জয়ের থেকেও অজয় বারো বছরের ছোট ছিল। ফলে ওদের মধ্যে সখ্য কখনও সম্ভব হয়নি। কিন্তু নানাভাবে অজয়ের একাকীত্ব সম্বন্ধে খোঁজ-খবর করে দেখেছে পুলিশ যে, এমন ঘটনা থেকে যদি ছেলেটি আত্মহনন ঘটাতো, তবে সেটা এই কলেজ জীবন পর্যন্ত এসে গড়াতো না। এর আগেই যা হবার তা হয়ে যেতো। তাছাড়া বিজয় বাবুর স্ত্রী মায়াদেবী জানিয়েছেন,
--- আমার সাথে আমার ছেলে-মেয়েদের সম্বন্ধ একেবারে বন্ধুর মত ছিল। কখনও আমরা ওদের কাছে পরিবারের সম্বন্ধে কোনোকিছু গোপন করিনি, ওদেরকে একা হতে দেইনি। সারাদিন ওদেরকে কাছে পেতাম না বলে সন্ধে থেকে সেই অভাবটা আমি পুষিয়ে দিতাম। আমি ওদেরকে কখনও হতাশ দেখিনি।
পুলিশের হাতে এবারে ঘরের বাইরে বের হওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকলো না। এর ওপরে তাদেরকে বিজয় বাবুর ধমকও খেতে হলো। তিনি এই মৃত্যুকে হত্যা বলেই ধরে বসেছিলেন। বড়ো বড়ো ব্যক্তিত্বদের এই একটা ইগো বা গোঁ থাকে বলে দেখেছে পুলিশ। কিন্তু ঠ্যালায় পড়ে পুলিশ এবারে অজয়ের একেবারে কাছের চার বন্ধুর বাড়িতে হানা দেয়। কিন্তু ব্যর্থ হয়েই ফিরতে হয়, কেননা ঐ চার বন্ধু অনীশ, বিমান, কিংশুক আর বাস্তব অজয় মারা যাবার কদিন আগে থেকে কলকাতায় ছিল না। ওরা ছিল পুরীতে। অজয়ের মৃত্যুর আগেরদিন রাতে ওরা ফিরেছে। অজয়েরও ওদের সাথে যাবার কথা ছিল, টিকেট কাটা ছিল, কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে অজয় পুরী ক্যান্সেল করে। বিষয়টা বেশ সন্দেহজনক হলেও সন্দেহজনক থাকে না, কেননা ওদের বাড়ি থেকে টেম্পোরারি  শিফ্‌টিং-এর প্রস্তুতি চলছিলো। তবু যদি কোনো তথ্য পাওয়া যায়--- এমনটা ভেবেই পুলিশের বাড়ির বাইরে তদন্তের প্রথম পদক্ষেপ। বিজয় বাবু ছেলেকে বলেওছিলেন,
--- তুই ওদের সাথে ঘুরেই আয়। এই বাড়িতে তুই জন্মেছিস, বড়ো হয়েছিস, তোর ঠাম্মা-দাদু দেহ রেখেছেন, তুই তা দেখেছিস। এই বাড়ি ভাঙ্গা পড়ছে, দেখতে তোর ভালো লাগবে না। কিন্তু কী করবো বল! এ্যাতো পুরনো বাড়ি! চারটে প্রজন্মের পুরনো বাড়িকে টিকিয়ে রাখাই তো একটা বোকামি। স্মৃতি বাঁচাতে গিয়ে নিজেরাই স্মৃতি হয়ে যাবো রে। কোনদিন এ বাড়ি তোর-আমার মাথায় এসে পড়বে! তুই ভাবিস না, আমি সব সামলে নেবো। তুই বন্ধুদেরকে নিয়ে পুরীটা ঘুরেই আয়। তাতে মনটা ভালো থাকবে। সমুদ্রের সামনে দাঁড়ালে দেখবি, এই যে মানুষের মৃত্যু, স্মৃতি, টান--- এসব কেমন মায়া-মায়া মনে হবে। প্রকৃতির কোলে গেলে বাস্তবটা বুঝতে পারবি।
সন্দেহ নেই, যেমনটা ঘটে, তেমনটাই প্রথম প্রথম মনে হয়েছিল অজয়ের। ওর দাদু-ঠাকুরমার স্মৃতি-বিজড়িত বাড়িটাকে ভেঙ্গে ফেলতে মন চায়নি ওর। ছোটমোটো আপত্তি ও জানিয়েছিলো। মাকে অজয়রা যতটা পেয়েছিলো, তার থেকেও তো ঠাম্মাকে বা দাদুকে বেশি পেয়েছিলো। ওঁদের হাতেই মানুষ হয়েছিল অজয়রা। কিন্তু শেষে বাস্তবটা মেনেও নিয়েছিলো। এসব কথা বিজয় বাবু নয়, অজয়ের বন্ধুদের কাছে থেকে জেনেছে পুলিশ। বন্ধুদের সাথে নানা কথা শেয়ার করে মানুষ। অজয়ের মৃত্যুর খবর যে ওর বন্ধুদের যথেষ্ট বিস্মিত করেছে, সেটা অনুধাবন করতে পারে পুলিশ। ওরা পুরী থেকে ফিরে এসে শুনেছে এই খবর।  ওদের বক্তব্য, অজয় আত্মহত্যা করতেই পারে না। ওকে আত্মহত্যা করার ছেলে বলে ওরা মনে করে না। কিন্তু অজয় কেন পুরীতে যায়নি, তা জানে না ওর বন্ধুরা। ফলে সন্দেহ এবারে জোর করে ঘনীভূত করতে হয় অজয়ের কোনো প্রেমঘটিত নাটকের দিকে। খুব সহজে এই তথ্য বন্ধুদের থেকে না পেলেও পুলিশ তাদেরকে সোজা বলে,
--- দ্যাখো তোমরা, বিজয় বাবু কিন্তু নিশ্চিত, এটা একটা খুনের কেস। তোমরাও বলছো, ও আত্মহত্যা করতে পারে না। তাই আমাদেরকেও কিন্তু তদন্ত করতেই হবে। তদন্ত করতে করতে এক সময় যদি জানতে পারি যে, তোমরা কিছু না কিছু লুকিয়েছো, সেটা কিন্তু তোমাদের পক্ষে ভালো হবে না। আমাদেরকে কিন্তু লাঠি ধরতে হবে আরো তথ্য জানার জন্যে।
এইকথা শুনে বাস্তব নামে ছেলেটি বলে--- স্যার, অজয় আমাদের খুব প্রিয় বন্ধু। আমরা স্কুল জীবন থেকে একসাথে আছি। ও খুন হয়ে থাকলে আমরাও তার তদন্ত চাই। তাই আমাদেরকে মেরে কিছুই হবে না। আসলে অজয় সবটা আমাদেরকেও বলতো না। ও বেশ অন্তর্মুখী ছেলে ছিল।
পুলিশ জানতে চায়--- অজয়ের কোনো প্রেম-ফ্রেম ছিল কিনা, তোমরা জানো?
কথাটা শুনে ওর বন্ধুরা বেশ দ্বিধা নিয়ে একে অপরের দিকে তাকায়। পুলিশ বোঝে যে, এমন একটা কাহিনি ছিল অবশ্যই, কিন্তু অজয়ের বন্ধুরা সে সব বলতে চাইছে না।
থানার এসআই বলেন--- দ্যাখো, এটা একটা মৃত্যুর ঘটনা। সন্দেহ করা হচ্ছে যে, অজয় খুন হয়েছে। তোমরা কিছু গোপন করো না।
এমনটা শুনে আবার বাস্তব নামে ছেলেটিই বলে ওঠে--- যদি সত্যিই আমাদের দেওয়া কোনো তথ্যে আপনাদের তদন্তের সুবিধা হয়, তাই জানাচ্ছি। অজয় একটি মেয়েকে ভালবাসতো, বলে আমরা জেনেছি। মেয়েটির নাম মেঘা। খুব ভালো ছাত্রী। মেঘা কিছু যদি বলতে পারে। তবে পুরী থেকে ফিরে এসে যতটুকু শুনেছি, অজয়ের মৃত্যুর খবরে মেঘা একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে। ওকে হাসপাতালে দিতে হয়েছিলো। জ্ঞান-ট্যান হারিয়ে ফেলেছিল। এই অবস্থায় ওর সাথে কি কথা বলা উচিত হবে?
--- বলতেই হবে। থেমে থাকলে তো চলবে না।
--- তবে স্যার, আমাদের নাম-টাম বলবেন না। আমরা যে এসব জানি, এটা কাউকে জানাবেন না।
--- কেন? এমন বলছো কেন? এই কি তোমরা অজয়ের বন্ধু!
--- সেটা নয়, স্যার। মেঘা কে জানেন? পৃথ্বীশ মজুমদার-এর মেয়ে।
--- কোন পৃথ্বীশ মজুমদার? এম.এল.এ?
--- শুধু এম.এল.এ নয়, স্যার। বিজয় বাবুর এগেইন্সট পার্টি। ওঁদের মধ্যে একেবারে আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্ক। এর মধ্যে আমরা পড়লে বিপদ হয়ে যাবে। ক্যারিয়ার একেবারে খতম হয়ে যাবে।
অফিসার বললেন--- বুঝলাম। নিশ্চিন্ত থাকো, তোমাদের নাম আমি বলবো না। কিন্তু তোমরা নিশ্চিত তো যে, পৃথ্বীশ বাবুর মেয়ের সাথে...
--- স্যার, এসব ব্যাপারে কি আমাদের যেমন তেমন কথা বলে দিলে হয়? রিস্ক আছে না? আমরাও জানতাম না। আমাদের কাছেও বলেনি অজয়। আমরা অনেক পরে জেনেছি, কিন্তু ওকে কিছু বলিনি। এখন ওর সাথে কোনো বিচ্ছেদ-টিচ্ছেদ থেকে অজয়... এ্যাতোটা বলেও সবটা বলে না বাস্তব।
এরপর পুলিশ পৃথ্বীশ বাবুর বাড়িতে যায়, এবং তাঁর মেয়ের সাথে দেখা করতে চায়। কিন্তু পৃথ্বীশ বাবু পুলিশকে বাড়িতে ঢুকতেই দেন না। তিনি জানান যে, তাঁর মেয়ে মেঘা অত্যন্ত অসুস্থ। ডাক্তার ওকে কোনোরকম উত্তেজনা, দুশ্চিন্তা বা পারিবারিক-সামাজিক অথবা রাজনৈতিক উচাটন থেকে দূরে রাখতে বলেছেন। কিন্তু পুলিশ জানাতে বাধ্য হয়,
--- কিন্তু স্যার, আমাদেরকে যে দু-একটা প্রশ্ন ওকে করতেই হবে। বিজয় বাবুর ছেলে অজয়ের মৃত্যুর সাথে জড়িয়ে আমাদের এখানে আসা। আপনি আপত্তি করবেন না। আমরা কথা দিচ্ছি, ওকে কোনোরকম হিউমিলিয়েট করবো না।
এ কথায় ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ হন পৃথ্বীশ মজুমদার। তিনি চেঁচিয়ে ওঠেন--- বিজয় বাবুর ছেলের সাথে আমার মেয়ের কী সম্পর্ক?
কোনরকমে হোঁচট খেতে খেতে আর সাবধানে শব্দ চয়ন করে করে এসআই জানান--- ওদের মধ্যে একটা আবেগসুলভ সম্পর্ক ছিল বলে আমরা জেনেছি। ঐ জন্যে অজয়ের মৃত্যুর কারণেই আপনার মেয়ে অসুস্থ হয়। আমরা তো বাধ্য, স্যার, এনকোয়ারি করতে। ব্যাপারটা বহু দূর অবধি গড়িয়েছে, স্যার।
এইসব কথাবার্তা মেয়েটি শুনে নিজেই উঠে এসেছে আর বাবার সামনেই স্বীকার করেছে যে, অজয়ের সাথে ওর সম্বন্ধ ছিল। প্রেম কোনো রাজনৈতিক গণ্ডি মানেনি, বিভিন্নতা মানেনি, শত্রুতা মানেনি। পৃথ্বীশ বাবুকে বিস্মিত করে দিয়েই মেঘা জানিয়েছে যে, অজয়ের সাথে ওর কোনো ব্রেক আপ হয়নি। এই সাথে মেয়েটি এটাও জানিয়েছে যে, গত চার-পাঁচদিন ধরে অজয় বেশ আপসেট ছিল। কেন আপসেট, সেটা অজয় মুখ ফুটে বলেনি। শুধু মুখে বিড়বিড় করতো, কী সব যেন আওড়াতো, সেইসব ছেঁড়া ছেঁড়া কথার কিছু কিছু মেঘা বুঝতে পেরেছে। যার মধ্যে আমার জীবনটাই বৃথা..., আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না..., আমাকে ভুলে যাও... এইসব কথাও ছিল। পুলিশ নিশ্চিত হয় যে, মানসিক অবসাদ থেকে এই মৃত্যু। বিত্তশালী মানুষদের পরিবারে এই একটি ব্যাধি তরুণ সমাজকে ব্যাপকভাবে আক্রমণ করছে, বলে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে। কিন্তু তবু তদন্তের একটা সুনিশ্চিত ইতি টানতে গেলে তো কোনো অসম্পূর্ণতা রাখা যায় না। তাই একেবারে ফরম্যাল প্রশ্ন করেন এসআই,
--- অজয়ের কি কোনো শত্রু-টত্রু ছিলো বলে তুমি জানো? আজকাল তো কলেজে পলিটিক্স একটা শত্রুতার বিরাট জায়গা। তেমন কোনো শত্রু...?
মেঘা জানায়--- অজয়ের সাথে নিশীথ নামে একটি ক্লাশমেট-এর দিন পাঁচ-ছয় আগে একটা প্রচণ্ড মারামারি হয়। ঐ পোলিটিক্যাল মতাদর্শগত সংঘাত। সবাই জানে। ছেলেটা একটু ষণ্ডা-গুন্ডা প্রকৃতির। ছেলেটা দল পাকিয়ে অজয়কে বেশ মারধোরও করে। অজয় বা ওর বন্ধুরা নিশীথকে কিছুই করতে পারেনি। কিন্তু অজয়ের বাবা এ্যাতো পাওয়ারফুল হয়েও কেন এই ব্যাপারটায় কোনো স্টেপ নেননি, তা আমি জানি না, স্যার। অজয় কিন্তু চলে যাবার আগেরদিন আমার সাথে দেখাও করেনি।
একেবারে সহজ হয়ে যাওয়া কেসটা যে এইভাবে আবার জটিল আঁকার ধারন করবে, তা ভাবেনি পুলিশ। দিব্যি গুটিয়ে আনছিল গোটা সমস্যাটাকে, কিন্তু মাঝখান থেকে এই প্রসঙ্গ আবার নতুন করে সমস্যা ডেকে আনলো। অজয়ের একটি শত্রু বেরোল। অজয়ের বন্ধুদের থেকে নিশীথের যে ঠিকানা পাওয়া গেলো, তাতে এই থানার বাইরের থানাও জড়িয়ে গেলো। নিশীথের বাবা একজন প্রথিতযশা চিকিৎসক। গায়নোকলজিস্ট। পুলিশ ঠিক করলো, এবারে ইনভেস্‌টিগেশিনকে একটু নতুন ঢঙে করবে। তাই গায়নোকলজিস্ট সুবিমল রায়ের অঞ্চলে একটা লোকাল এনকোয়ারি করে নিয়ে বাড়িতে ঢোকে পুলিশ। অঞ্চলে জানা যায় যে, নিশীথ দিন পাঁচ-ছয় অঞ্চলেই নেই। ফলে এই ঘটনায় নিশীথকে মূল অভিযুক্ত করে তুলতে, আর কেসটাকে গুটিয়ে তুলতে কোনো সমস্যা থাকবে না, বুঝতে পারে পুলিশ।  কিন্তু সেখানে ডাক্তারের সাথে সাক্ষাত করতেই কেসটা আরো জটিল আকার ধারণ করে। সুবিমল বাবুকে পুলিশ প্রশ্ন করে,
--- আপনার ছেলে নিশীথ কোথায়?
প্রথম দিকটা একটু হকচকিয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে ডক্টর সুবিমল জানান--- ও বাইরে গেছে।
পুলিশের প্রশ্ন--- বাইরে মানে কোথায়?
--- কেন, বলুন তো? আপনারা নিশীথের খোঁজ কেন করছেন? কী হয়েছে?
পুলিশ অজয়ের মৃত্যুর কথা গোপন করে শুধু তারিখটা উল্লেখ করে বলে যে, একটা ক্রাইম ঘটে গেছে, আর তাতে নিশীথের নাম জড়িয়ে গেছে। এবারে হেসে উড়িয়ে দেন সুবিমল বাবু। সোজা জানিয়ে দেন, আপনারা যে দিনের কথা বলছেন, নিশীথ তারও আগে থেকে আউট অফ স্টেশন। সকলেই জানে। কিন্তু পুলিশ ছাড়ে না। যেহেতু এটা কোনো প্রভাবশালী মানুষের বাড়ি নয়, সেহেতু একটু লেজে খেলার সাহস পায় পুলিশ। কেননা একজন সন্দেহজনক মানুষ অঞ্চলে না থাকলেই যে একটা ক্রাইমের সাথে যুক্ত হতে পারবে না, এমনটা অপরাধতত্ব বলে না। এসব এ্যালিবাই বানানো, বেনিফিট অফ ডাউট পাবার ফিকির হতে পারে। তারা নিশীথের যাবার জায়গার নাম, কারণ ইত্যাদি সবই জানতে চায়। কিন্তু সুবিমল বাবু এবারে কোনো শক্ত উত্তর দিতে পারেন না। বরং তিনি পুলিশের সামনে ভেঙ্গেই পড়েন। আবার বিষয়টা পুলিশের কাছে জটিল হয়ে ওঠে। সত্যিই তো, যদি নিশীথ অজয়ের মৃত্যুর কদিন আগেই বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যায়, আর তার কোনো হদিশ বাড়ির লোক করতে না পারে, তবে অজয় হত্যার পেছনে তার থাকা দাবিও করা যায় না, প্রমাণও করা যায় না। আদালতে সেই অভিযোগ ধোপে টিকবে না। শুধু একটা বিষয় এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে--- নিশীথ বাড়ি ছেড়ে, বা বাড়ি থেকে না বলে উধাও হয়েছে, এমনটা জানিয়ে সুবিমল বাবু থানায় কেন ডায়রি করেননি। যদিও তাঁর মতো একজন সামাজিক মর্যাদা সম্পন্ন মানুষ হুট করে ঘরের বিষয়ে থানা-পুলিশ করেন না। একটা পর্যায় অবধি তাঁরা অপেক্ষা করেন। যদিও ভেতরের কথা জানবার জন্যে সুবিমল বাবুকে এই বিষয়টা দিয়ে ভয় দেখানো যেতে পারে, কিন্তু বাস্তবে নিশীথ নির্দোষ প্রতিপন্ন হবেই। সুবিমল বাবু জানান যে, নিশীথ একটা চিঠি লিখে রেখে এ্যাব্‌স্কন্ড হয়ে গেছে, বাড়ি থেকে চলে গেছে। কিন্তু পুলিশ এতেও নিরস্ত হয় না। তারা এর কারণ উদ্ধার করতে চায়, কেননা এখন নিশীথ ছাড়া আর কাউকে সন্দেহের তালিকায় রাখা যাচ্ছে না। পুলিশ চায় না যে, এই শোকাহত পরিবার কোনো ঘোর অভিযোগে জড়িয়ে যাক।
পুলিশ জেনেছে, সুবিমল বাবু সম্বন্ধে অঞ্চলের মানুষ নানা কথা ফিসফাস করে বলে বটে, কিন্তু মানুষের ছোট-বড়ো নানা বিপদে-আপদে এই মানুষটার ভূমিকা অঞ্চলের মানুষ অস্বীকার করতে পারে না। অনেকে এঁকে পাগল ডাক্তার বলেও ডাকে। কিন্তু স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁর হাতযশ শুধু এই অঞ্চলেই নয়, বাইরের নানা স্থানে শোনা যায়। লোকে বলে ধন্বন্তরি। সুবিমল ডাক্তার রোগীর গায়ে হাত দিলেই নাকি রোগী অর্ধেক ভালো হয়ে যায়। অনেকেরই চিকিৎসাগত নাড়া বাঁধা আছে এই মানুষটার কাছে। এর মধ্যে পড়েন আঞ্চলিক থানার বড়বাবুও।
কিন্তু ডিউটি ইজ ডিউটি। সেখানে মা-বাপ তো বিচার করলে জীবিকা চলে না। ফলে পুলিশকে গর্তে হাত ঢোকাতেই হয়। তাতে সাপ-ই বেরোক, বা ইঁদুর। কে কার গর্তে ঢুকেছে, সে সব পরে হবে। সুবিমল বাবুই নিজে পুলিশকে সুবিধা করে দিলেন। তিনি বললেন,
--- আপনারা তো একবারও বললেন না, ঘটনাটা কী। কোন ক্রাইমের জন্যে আমার ছেলেকে আপনারা খুঁজছেন? কীভাবে, কোথায়, বিশেষ করে  ক্রাইমটা কী ঘটেছে--- এগুলো তো আমাকে মিলিয়ে দেখতে হবে। বাবা হিসেবে ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ শোনার আগে তো আমাকে জানতে হবে, অভিযোগটা কী। তাকে এ্যারেস্ট করতে হলে তো ওয়ারেন্ট দেখাতে হবে। আমি তো গ্রামের অশিক্ষিত মানুষ নই যে, যা খুশী করতে পারবেন।
এবারে পুলিশকে জানাতেই হয় যে, দিন পাঁচ-ছয় আগে নিশীথ তারই কলেজের একটি ছেলেকে কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে মারধোর করে। তারপরেই সে উধাও হয়। অথচ ছেলেটি, যার নাম অজয়, সে মারা গেছে। অজয় এই অঞ্চলের এই ভদ্রলোকের ছেলে। বাড়ির অভিযোগ, কদিন ধরে অজয়ের মধ্যে অস্বাভাবিক আচার-আচরণ দেখা গেছে। এইসব ঘটনা বার বার নিশীথকেই দোষী সন্দেহ করতে বাধ্য করছে প্রশাসনকে।
পুলিশের এই বর্ণনায় একেবারে পাল্টে যান সুবিমল বাবু। তাঁর চোখ-মুখ যেন একেবারে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়। তিনি নিজেকে সংবরণ করে শুধু একটাই প্রশ্ন করেন---অজয় মারা গেছে? আর ইউ শিয়োর, অফিসার? পুলিশের কাছ থেকে সদর্থক ইঙ্গিত পেয়ে আবার তিনি প্রশ্ন করেন--- অজয় কিভাবে মারা গেছে?
--- ট্রেনে কাটা পড়ে। সুইসাইড।
মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন সুবিমল বাবু। তাঁর এমন আচরণে পুলিশ আরো ধন্ধে পড়ে যায়। তারা সুবিমল বাবুকে ঝাঁকি দিয়ে বলে--- আপনি কি কিছু বলতে চান? তাহলে যা জানেন, খুলে বলুন। বিজয় বাবুর পরিবার একেবারে ভায়োলেন্ট হয়ে পড়েছে। একজন মানুষের এ্যাতো বড়ো একটি সন্তান যদি চলে যায়, তবে বাড়ির মানুষের মনের অবস্থা তো আপনি বুঝতেই পারেন। আপনি তো একজন চিকিৎসক। মানুষের জীবন বাঁচানোই তো আপনার প্রফেশনাল ওথ ছিল।
যেন টাল খেতে খেতে টেবিল-চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সুবিমল বাবু বলেন--- থানায় চলুন। আমাকে তো থানাতে যেতেই হবে। আমিই অজয়ের মৃত্যুর জন্যে দায়ী। আমিই অপরাধী। আমার ছেলে নয়। ও যেখানেই থাকুক, যেমন থাকুক, ও নির্দোষ।
এমন আকুতিতে পুলিশ হাল ছাড়ে না। তারা সুবিমল বাবুকে বলে--- আপনি দোষী, কি আপনার ছেলে--- সেটা না হয় আদালত বিচার করুক। আপনার সন্তানকে তো আপনি বাঁচাতে পারবেন না, ডক্টর রায়।
মলিন হেসে সুবিমল বাবু উত্তর দেন--- সব বিচার কি আর আপনাদের আদালতে হয়, স্যার! কোনো কোনো বিচার না-হয় ওপরওয়ালার হাতে ছাড়ুন। সেখানে সাক্ষী, উকিল, পেশকার, কোর্টবাবু কিছুই লাগে না। চলুন, থানায় গিয়েই সবটা শুনবেন।
পুলিশ সুবিমল বাবুকে সাথে নিয়ে বেশ ধন্ধে মাথা চুলকোতে চুলকোতে থানায় গিয়ে হাজীর হয়। সেখানে সুবিমল বাবু একেবারে নাটকীয় কাহিনি শোনান। বছর কুড়ি আগে মুর্শিদাবাদে বসবাস করতেন তিনি। সেখানেই তাঁর ভালোমন্দ পশার ছিলো, জনপ্রিয়তা ছিলো। ছোটবেলা থেকেই সুবিমল বাবু তাঁর চরিত্রে, ব্যবহারে একেবারে দুনিয়া ছাড়া ছিলেন। পরিবারে তাঁর সম্বন্ধে হাজার অপব্যাখ্যা ছিল। সামাজিক সাধারণ রীতিনীতি মানতেন না কোনোকালেই। এমনি একদিন একটি মহিলা এ্যাবরশনের জন্যে আসে তাঁর ক্লিনিকে। সুবিমল বাবু জানতে পারেন, মেয়েটির জীবিকা সমাজের রীতিনীতির পরিপন্থী ছিল। যে কোনো কারণেই হোক, এই জীবিকা মেয়েটিকে গ্রহণ করতে হয়েছিল। এসব পেশাতে মেয়েরা সাধারনত সতর্কই থাকে, কিন্তু ভবিতব্য! জীবনের প্রতিটা দিন তো একইভাবে কাটে না। সামান্য অসতর্কতা থেকে মেয়েটি গর্ভধারণ করে ফেলে। সমাজ ব্যবস্থার স্বার্থে, জীবিকার স্বার্থে এবারে তাকে মুক্ত হতেই হবে। এই সমাজ সন্তান প্রসব গর্বের তখনই মনে করবে, যখন সেটি সম্বন্ধে তারা সম্যক অবহিত হবে। এ বিষয়ে গোপন চলবে না। আমার সন্তান আমি কখন বা কীভাবে চাইবো, সেটা আমি নই, সমাজ ঠিক করে দেবে। সমবেত মানুষের সম্মতি নিয়ে তুমি একটি জীবন সাথী পছন্দ করো, তাদের সম্মতি নিয়ে তাকে নিয়ে এক ঘরে ঢোকো, বিছানায় যাও, সন্তান উৎপাদন করো। তুমি একা একা এসব করার কে! তাই অপরিজ্ঞাত গর্ভধারনে গর্ভপাত অনিবার্য। কিন্তু মন থেকে সায় দিতে পারেনি মেয়েটি। এই প্রথম বারের জন্যে সে মা হতে চলেছে। মাতৃত্ব তাকে যেন কোথায় বাস্তবের সাথে বার বার সঙ্ঘাত করিয়ে দিচ্ছিলো। বিষয়টা বুঝতে পারেন ডাক্তার সুবিমল রায়। দুনিয়ার নিয়ম-নীতির ক্ষেত্রে কালাপাহাড় ডাক্তার সুবিমল মেয়েটিকে বিবাহের প্রস্তাব দেন, নিশ্চিন্ত জীবনের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু সঙ্কটে পড়লেও মেয়েটি ডাক্তারের এমন দয়া নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়নি। সে শরীর বেচে খাওয়া মানুষ। সেটাই তার অভিমান। কিন্তু সুবিমল বাবু জানিয়ে দেন যে, তিনি মেয়েটিকে দয়া নয়, ভালবেসে বিয়ে করতে চাইছেন।
সন্তান হলে মুর্শিদাবাদের বাস উঠিয়ে সুবিমল বাবু সস্ত্রীক চলে আসেন এখানে, যাতে মেয়েটিকে অথবা সন্তানটিকে কোনো সামাজিক প্রশ্নে পড়তে না হয়। এখানে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অপরিচিত এবং নিরাপদ। ভালোই ছিলেন এখানে, কিন্তু বায়ুর আগে বার্তা ছোটেলে একটা প্রবাদ আছে, আর তাঁর জেরেই কবে যেন কোনো সূত্রে এই গোপন ইতিহাস প্রকাশ হয়। তবে তা ছিল আপাত গুপ্ত। জনপ্রিয় এই ডাক্তারের ব্যক্তিগত জীবনকে নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ স্ক্যান্ডাল ছড়ায়নি। কিন্তু গোপনে যে সেই সব নিয়ে এই সভ্য-সুশীল সমাজ আচারের মত তারিয়ে তারিয়ে খাবে না, এমনটা অপ্রত্যাশিত কখনও ছিলো না, থাকেওনি। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটলো কলেজে। দুই রাজনৈতিক দলের কোন্দলের কারণে হঠাৎই অজয় নিশীথকে বাবা-মায়ের অবাঞ্ছিত সন্তান বলে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে কলহে তাৎক্ষনিক জয় চায়। ফলে তাকে অনিবার্যভাবে প্রচণ্ড প্রহার সইতে হয় নিশীথের হাতে। কলেজ ক্যাম্পাসে সকলের সামনে এমন অপদস্ত হয়ে অজয় ওর বাবাকে কিম্বা ওর বাবার পোশ্য মাস্‌ল পাওয়ারদের দিয়ে নিশীথের একটা মোক্ষম জবাব দিতে পারতো। কিন্তু বাবার রাজনৈতিক ক্ষমতা, বদনাম বা প্রভুত্ব কোনোদিন সন্তান হিসেবে মেনে নিতে পারেনি অজয়। তাই কলেজের এসব কথা অজয় বাড়িতে প্রকাশ করে না। নানা অছিলায় নিজের শরীরের, বিশেষত মুখের ছোটবড়ো বিকৃতি কোনোভাবে গোপন করে বাড়িতে। কিন্তু বিষয়টা সেখানেই থেমে থাকে না। নিশীথ অজয়কে শায়েস্তা করলেও ওর বলা কথাগুলো না পেরেছে বিশ্বাস করতে, না পেরেছে ভুলতে। ও বাড়িতে ফিরে গিয়ে সরাসরি তার মাকে এবং পালক পিতাকে আক্রমণ করে, জানতে চায় এই স্ক্যান্ডালের ইতিহাস কী? আর গোপন করতে পারেন না সুবিমল রায় এবং তাঁর স্ত্রী। এই সত্যের মুখে দাঁড়িয়ে নিশীথ নিজেকে সত্যিই অবাঞ্ছিত মনে করে একটা চিঠি লিখে রেখে বাড়ি ছাড়ে। লিখে রেখে যায়,
আমি চলে যাচ্ছি। কোথায়, আমি জানি না। মরতেও পারি, বেঁচে থাকতেও পারি। সেটা সময় বলবে। কিন্তু একটা মিথ্যে অস্তিত্ব, অনাত্মীয়ের দয়া নিয়ে আমি বাঁচতে পারবো না। আমার জন্যে আমার অজ্ঞাতকুলশীল বাবা, আমার বারবনিতা মা কখনও কোনো প্রার্থনা করেনি। তাই আমি কারোর নই। আমার জন্যে কেউ নেই। আমাকে অজয় এই ইতিহাস না জানালে আমি কোনোদিন জানতেই পারতাম না, কী অযথা আমার অস্তিত্ব! আমি অজয়কে মেরেছি, সত্যি। নিজেকে সামলাতে পারিনি। কিন্তু ও আমার উপকারই করেছে। সেই কারণেই আমি চলে যাচ্ছি। 
এই ঘটনায় যথেষ্ট বিচক্ষণ মানুষ হয়েও এই একটি নিষ্ঠুর পরিণামে সুবিমল বাবু নিজেকে সংযত রাখতে পারেন না। তিনি অজয়কে নিষ্ঠুরভাবে প্রহার করার জন্যে নিশীথের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাইবার অছিলায় ডেকে পাঠান। তখন নিশীথ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। অজয় জানত না, তার মৃত্যুবান ছিল ডাক্তার সুবিমল রায়ের হাতে। তিনি একেবারে প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে উঠে অজয়কে জানিয়ে দেন যে, অজয়ের বাবা ওর মাকে নিয়ে বছর কুড়ি আগে ওঁর কাছে এসেছিলেন এ্যাবরশনের জন্যে। ওঁদের একটি ছেলে ও একটি মেয়ে আছে। ওঁরা বারো বছর পরে আর একটি নতুন সন্তান চান না। এতে ওঁদের সামাজিক সম্মান আহত হবে। কিন্তু ওঁদের অজ্ঞতাবশত ওঁরা সিদ্ধান্ত নিতে দেরী করে ফেলেছিলেন। এ্যাবোর্‌ট করলে পেশেন্টের প্রানহানির আশঙ্কা ছিলো বলে ওঁদেরকে ফিরে যেতে হয়। সেই সন্তানই হলো অজয়। ডাক্তারি শাস্ত্রে আনএথিক্যাল হলেও ব্যক্তিসত্তা ডাক্তারের পেশাদারী নীতি থেকে বড়ো হয়ে ওঠে। ফলে সুবিমল বাবু অজয়কে নিশীথের মতোই অবাঞ্ছিত সন্তান বলে ওর গায়ে কলঙ্ক দেগে দেন। এর পরের ঘটনা আজকের সঙ্কট।
পুলিশ এরপরে ফিরে আসে বিজয় বাবুর বাড়িতে। তাঁদেরকে এই কেসের একটা রাহা ইতি টানতে হবে। অজয়দের সারা বাড়ি তল্লাশ করে খুঁজে পুলিশ পেতে চায় অজয়ের কোনো সুইসাইডাল নোট। তাদের কথা, একটি ছেলে আত্মহত্যা করেছে, কিন্তু সে কোনো সুইসাইড নোট লিখে রেখে যায়নি--- এমনটা অপ্রত্যাশিত। শেষে জানা গেলো, মানসিক দ্বন্দ্বের চার-পাঁচটা দিনের মধ্যে একটা দিন ও ব্যাঙ্কের লকারে গিয়েছিলো। এ বাড়িতে সংসারের টাকা-পয়সা, সোনা-দানা কোনোকিছুই অন্য পরিবারের মতো ছেলে-মেয়েদের কাছে গোপনীয় ছিল না। ফলে  কেউ কোনো প্রশ্ন করেনি, কেন ও লকারে যাবে। সেখানে ওঁর আংটি আছে, চেন আছে। যুবক ছেলে--- হয়তো পরবে, মাথায় এসেছে। এবারে সেখানেই পাওয়া গেলো সুইসাইডাল নোট-টি। অনেকটা নিশীথের আদলেই লেখা একটি চিঠি। শুধু তাতে একটি অধিক তথ্য পাওয়া গেলো। সুবিমল বাবুর কাছে থেকে ফিরে অজয় কয়েকটা দিন নিজের সাথে যুদ্ধ করেছে। শেষে আর যুঝতে পারেনি। এই অপ্রার্থিত জীবন, মূল্যহীন অস্তিত্ব এবং দায়ে পড়ে বাঁচিয়ে রাখা জীবন ছেলেটি মেনে নিতে পারেনি। যে অপমানে নিশীথকে সে বিদ্ধ করেছে, সে যে নিজেই একই পরিণামের শিকার, এটা মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি ওর পক্ষে। কিন্তু মৃত্যুর আগের চার-পাঁচ দিন সে একটা উপযুক্ত অভিজ্ঞান হাতে পাবার জন্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। একটা ধন্ধ ওর মনে ছিলোই। অজয় ওদের শিফটিং-এর কাজে প্যাকিং করতে গিয়ে ওর মায়ের মেডিক্যাল ফাইলে পেয়ে যায় কুড়ি বছর আগেকার ডাক্তার সুবিমল রায়ের সেই প্রেসক্রিপশন। তখনই ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়।
বিজয় বাবু চেপে ধরেন পুলিশকে--- এখনই ঐ স্কাউন্ড্রেল ডাক্তারটাকে এ্যারেস্ট করুন। এখনই। আমার ছেলেকে সুইসাইড করায় ঐ লোকটা প্রভোক করেছে।
কিন্তু পুলিশের এসআই হেসে বলে--- কাকে কাকে এ্যারেস্ট করবো, বলুন তো, স্যার? কজনকে এ্যারেস্ট করবো? আপনাদের দুই পরিবারই নিজেদের জলজ্যান্ত সন্তান হারিয়েছেন। দুজনেই দুঃখ করুন। আর নতুন কিছু হারাবেন না, স্যার। এই হিংস্রতা থাক না। আপনারা সম্মানীয় মানুষ। এসব করলে আপনার অসম্মান, ও পক্ষেরও অপমান। আমাদের ডাকলে যে আপনাদের মান থাকে না, স্যার।

---------------------------