অস্তিত্ব
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়
অজয়ের মৃতদেহ পাওয়া গেলো রেল লাইনের ধারে। দমদম জংশন থেকে বেরিয়ে বনগাঁ লাইনের ট্রেন যখন মাল্টি লাইন ছেড়ে একটু
ডান দিকে ঘুরে গিয়ে বনগাঁ ট্র্যাক ধরে, সেখানেই ওর বডি পাওয়া গেলো। তেমন কিছু হয়নি
বডি’র। জিআরপি জানালো যে, ট্রেনে ধাক্কা লাগতেই পাশে ছিটকে প’ড়ে মৃত্যু ঘটেছে। অজয়ের
পকেটে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। শুধু ওর মানিব্যগ, আই কার্ড, একটা স্লিপ যাতে বাড়ি’র ঠিকানা, ফোন
নম্বর লেখা। সাধারণ চোখে এটা আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। ওর আইডেন্টিটি পুরোটাই
পাওয়া গেলো ব’লে বাড়িতে জানাতে কোনো সমস্যা হয়নি জিআরপি’র। খবর পেয়ে অজয়ের বিবাহিতা দিদি এসেছে,
অজয়ের দাদা ব্যাঙ্গালোর থেকে সোজা ফ্লাইটে এসেছে। কিন্তু যেহেতু অজয়ের বাবা বিজয় সরকার
লোকাল থানায় একটা মিসিং ডায়রি ক’রেছিলেন, এবং বডি আইডেনটিফাই ক’রতে গিয়ে এটাকে
একটা মার্ডার কেস ব’লে থানায় অভিযোগ দায়ের ক’রে ব’সেছেন, সেহেতু বডি পুলিশের হাতে দিতেই হ’লো। পোস্ট মর্টেম-ফরটেম
তারাই ক’রবে। জিআরপি থেকে শুরু ক’রে পুলিশ পর্যন্ত জানালো যে, বডি’র পোজিশন, কন্ডিশন
ইত্যাদি দেখে ওদের ধারনা, এটা কোনো হত্যাকাণ্ড নয়। এটা নিছকই একটা আত্মহত্যা। কিন্তু
বিজয় বাবু যেহেতু রাজনীতি’র সাথে ভালোমন্দ জড়িত, সেহেতু তাঁর একটু-আধটু
প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে প্রশাসন মহলে। অজয়ের বডি’র সন্ধান পেতেই তিনি এফআইআর ক’রে ব’সেছেন। সেই চাপেই
পুলিশ বাধ্য হ’লো একটা তদন্ত শুরু ক’রতে। তদন্তটা অবশ্য তাদের কাছে একটা বড়ো রহস্য হ’ল এই কারণে যে,
বিজয় বাবু কারোর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ক’রতে পারছেন না। তাঁর জানা নেই কে বা কারা
এর পেছনে থাকতে পারে। তিনি রাজনীতি’র এমন কোনো ব্যক্তিত্ব নন যে, তাঁর
ছেলেকে হত্যা ক’রে বিরুদ্ধ কোনো দল একটা বিরাট ফায়দা তুলবে। এমনকি তিনি দলের কোনো জঙ্গি নেতাও
নন যে, তাঁর ওপরে অন্য কোনো পার্টি’র অতীতের বা বর্তমানের কোনো ক্ষোভ থেকে
থাকবে। কিন্তু বিজয় বাবু’র কথা হ’লো,
--- যে ছেলেটা দিব্যি এ বাড়ি থেকে শিফ্ট-এর
জন্যে নিজে হাতে জিনিসপত্র গোছালো, কোন বাড়িতে ভাড়া যাবো আমরা, তা দেখে-টেখে পছন্দ
ক’রে এলো, দিব্যি এ বাড়ি ভেঙ্গে ফ্ল্যাটের কী ডিজাইন হবে, তা নিয়ে আমাদের সাথে
আলোচনা ক’রলো, সে কেমন ক’রে, মানে কেনই বা আচমকা সুইসাইড ক’রতে যাবে! আমাদের
সাথে তো ওর কোনো বচসা, মতানৈক্য কিছুই ঘটেনি! এটা ডেফিনিটলি একটা প্ল্যান্ড
মার্ডার। কোনো একটা রহস্য আছে এর পেছনে।
বিজয় বাবু এই শুধু ব’ললেন না,
প্রশাসনের ওপরে বেশ চাপ দিলেন রহস্য উদ্ধারের জন্যে। তিনি চান, তাঁর ছেলে’র যে বা যারা
হত্যাকারী, তাদেরকে কঠিন শাস্তি তিনি দিয়েই ছাড়বেন। স্থানীয় রাজনৈতিক
হোমরা-চোমরাদেরকে তো পুলিশ-প্রশাসনের একটু মন যুগিয়েই চ’লতে হয়। ফলে
পুলিশও বিষয়টিকে একেবারে ধুয়েমুছে দিতে পারলো না। তদন্ত চালাতেই হ’লো। যদিও পুলিশ
জানে, আজকাল এই প্রজন্ম সব সময় কোনো বিশেষ ষড়যন্ত্রেই আত্মহত্যা করে না। প্রেমে
ব্যর্থতা, বন্ধু’র বিশ্বাসঘাতকতা, পরীক্ষায় অসফলতা, জীবনে না চাইতেই সবকিছু পাওয়া বা হঠাৎ কোনো
কারণে কোনোকিছু পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ায় ব্যর্থতা, এমনকি বাবা-মা’র যৌথ চাকরী জীবন
হওয়ার ফলে তাদেরকে কাছে না পাওয়া এবং নিজে কোনো গঠনমূলক কাজে নিজেকে যুক্ত না করার
ফলে একটা ওমনি এসে যাওয়া ডিপ্রেশন--- এইসব ছেলে-মেয়েকে আত্মহত্যায় প্রবৃত্ত করে। এসব
পুলিশের খুব জানা বিষয়। তাই এইসব মাধ্যম ক’রেই তদন্ত করা শুরু করে পুলিশ।
বিজয় বাবু নিজে এবং তাঁর স্ত্রী উভয়েই
চাকরী করেন। ফলে বিজয় বাবু’র মেয়ে ও দুই ছেলে ছোট থেকে প্রায় একা একাই জীবনে বড়ো
হয়েছে। একা খেয়েছে, একা প’রেছে, একা অধ্যয়ন ক’রেছে, কিন্তু পরীক্ষায় তারা কখনও মন্দ ফল
করেনি। বরং বেশ ভালো ছাত্রছাত্রী হিসেবেই ওদের পরিচিতি ছিলো। তবে অজয় তথাপি তুলনামূলকভাবে
একটু বেশী একা ছিল। কেননা, বিজয় বাবু’র ছেলে সঞ্জয়ের থেকেও অজয় বারো বছরের ছোট
ছিল। ফলে ওদের মধ্যে সখ্য কখনও সম্ভব হয়নি। কিন্তু নানাভাবে অজয়ের একাকীত্ব
সম্বন্ধে খোঁজ-খবর ক’রে দেখেছে পুলিশ যে, এমন ঘটনা থেকে যদি ছেলেটি আত্মহনন ঘটাতো,
তবে সেটা এই কলেজ জীবন পর্যন্ত এসে গড়াতো না। এর আগেই যা হবার তা হয়ে যেতো। তাছাড়া
বিজয় বাবু’র স্ত্রী মায়াদেবী জানিয়েছেন,
--- আমার সাথে আমার ছেলে-মেয়েদের সম্বন্ধ
একেবারে বন্ধু’র মত ছিল। কখনও আমরা ওদের কাছে পরিবারের সম্বন্ধে কোনোকিছু গোপন ক’রিনি, ওদেরকে একা
হ’তে দেইনি। সারাদিন ওদেরকে কাছে পেতাম না ব’লে সন্ধে থেকে সেই অভাবটা আমি পুষিয়ে
দিতাম। আমি ওদেরকে কখনও হতাশ দেখিনি।
পুলিশের হাতে এবারে ঘরের বাইরে বের হওয়া
ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকলো না। এর ওপরে তাদেরকে বিজয় বাবু’র ধমকও খেতে হ’লো। তিনি এই
মৃত্যুকে হত্যা ব’লেই ধ’রে ব’সেছিলেন। বড়ো বড়ো ব্যক্তিত্বদের এই একটা ইগো বা গোঁ থাকে ব’লে দেখেছে পুলিশ। কিন্তু
ঠ্যালায় প’ড়ে পুলিশ এবারে অজয়ের একেবারে কাছের চার বন্ধু’র বাড়িতে হানা দেয়। কিন্তু ব্যর্থ হ’য়েই ফিরতে হয়,
কেননা ঐ চার বন্ধু অনীশ, বিমান, কিংশুক আর বাস্তব অজয় মারা যাবার কদিন আগে থেকে কলকাতায়
ছিল না। ওরা ছিল পুরী’তে। অজয়ের মৃত্যু’র আগেরদিন রাতে ওরা ফিরেছে। অজয়েরও ওদের
সাথে যাবার কথা ছিল, টিকেট কাটা ছিল, কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে অজয় পুরী
ক্যান্সেল করে। বিষয়টা বেশ সন্দেহজনক হ’লেও সন্দেহজনক থাকে না, কেননা ওদের বাড়ি
থেকে টেম্পোরারি শিফ্টিং-এর প্রস্তুতি চ’লছিলো। তবু যদি
কোনো তথ্য পাওয়া যায়--- এমনটা ভেবেই পুলিশের বাড়ি’র বাইরে তদন্তের প্রথম পদক্ষেপ। বিজয়
বাবু ছেলে’কে ব’লেওছিলেন,
--- তুই ওদের সাথে ঘুরেই আয়। এই বাড়িতে
তুই জন্মেছিস, বড়ো হয়েছিস, তোর ঠাম্মা-দাদু দেহ রেখেছেন, তুই তা দেখেছিস। এই বাড়ি
ভাঙ্গা প’ড়ছে, দেখতে তোর ভালো লাগবে না। কিন্তু কী ক’রবো বল! এ্যাতো পুরনো বাড়ি! চারটে
প্রজন্মের পুরনো বাড়ি’কে টিকিয়ে রাখাই তো একটা বোকামি। স্মৃতি বাঁচাতে গিয়ে
নিজেরাই স্মৃতি হয়ে যাবো রে। কোনদিন এ বাড়ি তোর-আমার মাথায় এসে প’ড়বে! তুই ভাবিস
না, আমি সব সামলে নেবো। তুই বন্ধুদেরকে নিয়ে পুরীটা ঘুরেই আয়। তাতে মনটা ভালো
থাকবে। সমুদ্রের সামনে দাঁড়ালে দেখবি, এই যে মানুষের মৃত্যু, স্মৃতি, টান--- এসব
কেমন মায়া-মায়া মনে হবে। প্রকৃতি’র কোলে গেলে বাস্তবটা বুঝতে পারবি।
সন্দেহ নেই, যেমনটা ঘটে, তেমনটাই প্রথম
প্রথম মনে হ’য়েছিল অজয়ের। ওর দাদু-ঠাকুরমা’র স্মৃতি-বিজড়িত বাড়িটাকে ভেঙ্গে ফেলতে
মন চায়নি ওর। ছোটমোটো আপত্তি ও জানিয়েছিলো। মা’কে অজয়রা যতটা পেয়েছিলো, তার থেকেও তো
ঠাম্মা’কে বা দাদু’কে বেশি পেয়েছিলো। ওঁদের হাতেই মানুষ হয়েছিল অজয়রা। কিন্তু শেষে বাস্তবটা মেনেও
নিয়েছিলো। এসব কথা বিজয় বাবু নয়, অজয়ের বন্ধুদের কাছে থেকে জেনেছে পুলিশ। বন্ধুদের
সাথে নানা কথা শেয়ার করে মানুষ। অজয়ের মৃত্যু’র খবর যে ওর বন্ধুদের যথেষ্ট বিস্মিত ক’রেছে, সেটা
অনুধাবন ক’রতে পারে পুলিশ। ওরা পুরী থেকে ফিরে এসে শুনেছে এই খবর। ওদের বক্তব্য, অজয় আত্মহত্যা ক’রতেই পারে না। ওকে
আত্মহত্যা করার ছেলে ব’লে ওরা মনে করে না। কিন্তু অজয় কেন পুরীতে যায়নি, তা জানে
না ওর বন্ধুরা। ফলে সন্দেহ এবারে জোর ক’রে ঘনীভূত ক’রতে হয় অজয়ের কোনো
প্রেমঘটিত নাটকের দিকে। খুব সহজে এই তথ্য বন্ধুদের থেকে না পেলেও পুলিশ তাদেরকে
সোজা বলে,
--- দ্যাখো তোমরা, বিজয় বাবু কিন্তু
নিশ্চিত, এটা একটা খুনের কেস। তোমরাও ব’লছো, ও আত্মহত্যা ক’রতে পারে না। তাই আমাদেরকেও
কিন্তু তদন্ত ক’রতেই হবে। তদন্ত ক’রতে ক’রতে এক সময় যদি জানতে পারি যে, তোমরা কিছু না কিছু
লুকিয়েছো, সেটা কিন্তু তোমাদের পক্ষে ভালো হবে না। আমাদেরকে কিন্তু লাঠি ধ’রতে হবে আরো তথ্য জানা’র জন্যে।
এইকথা শুনে বাস্তব নামে ছেলেটি বলে---
স্যার, অজয় আমাদের খুব প্রিয় বন্ধু। আমরা স্কুল জীবন থেকে একসাথে আছি। ও খুন হ’য়ে থাকলে আমরাও
তার তদন্ত চাই। তাই আমাদেরকে মেরে কিছুই হবে না। আসলে অজয় সবটা আমাদেরকেও ব’লতো না। ও বেশ
অন্তর্মুখী ছেলে ছিল।
পুলিশ জানতে চায়--- অজয়ের কোনো
প্রেম-ফ্রেম ছিল কিনা, তোমরা জানো?
কথাটা শুনে ওর বন্ধুরা বেশ দ্বিধা নিয়ে
একে অপরের দিকে তাকায়। পুলিশ বোঝে যে, এমন একটা কাহিনি ছিল অবশ্যই, কিন্তু অজয়ের
বন্ধুরা সে সব ব’লতে চাইছে না।
থানা’র এসআই বলেন--- দ্যাখো, এটা একটা মৃত্যু’র ঘটনা। সন্দেহ
করা হ’চ্ছে যে, অজয় খুন হয়েছে। তোমরা কিছু গোপন ক’রো না।
এমনটা শুনে আবার বাস্তব নামে ছেলেটিই ব’লে ওঠে--- যদি
সত্যিই আমাদের দেওয়া কোনো তথ্যে আপনাদের তদন্তের সুবিধা হয়, তাই জানাচ্ছি। অজয়
একটি মেয়েকে ভালবাসতো, ব’লে আমরা জেনেছি। মেয়েটির নাম ‘মেঘা’। খুব ভালো
ছাত্রী। মেঘা কিছু যদি ব’লতে পারে। তবে পুরী থেকে ফিরে এসে যতটুকু শুনেছি, অজয়ের
মৃত্যু’র খবরে মেঘা একেবারে ভেঙ্গে প’ড়েছে। ওকে হাসপাতালে দিতে হয়েছিলো। জ্ঞান-ট্যান
হারিয়ে ফেলেছিল। এই অবস্থায় ওর সাথে কি কথা বলা উচিত হবে?
--- ব’লতেই হবে। থেমে থাকলে তো চ’লবে না।
--- তবে স্যার, আমাদের নাম-টাম ব’লবেন না। আমরা যে
এসব জানি, এটা কাউকে জানাবেন না।
--- কেন? এমন ব’লছো কেন? এই কি
তোমরা অজয়ের বন্ধু!
--- সেটা নয়, স্যার। মেঘা কে জানেন?
পৃথ্বীশ মজুমদার-এর মেয়ে।
--- কোন পৃথ্বীশ মজুমদার? এম.এল.এ?
--- শুধু এম.এল.এ নয়, স্যার। বিজয়
বাবু’র এগেইন্সট পার্টি। ওঁদের মধ্যে একেবারে আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্ক। এর মধ্যে আমরা
প’ড়লে বিপদ হয়ে যাবে। ক্যারিয়ার একেবারে খতম হয়ে যাবে।
অফিসার ব’ললেন--- বুঝলাম। নিশ্চিন্ত থাকো, তোমাদের
নাম আমি ব’লবো না। কিন্তু তোমরা নিশ্চিত তো যে, পৃথ্বীশ বাবু’র মেয়ে’র সাথে...
--- স্যার, এসব ব্যাপারে কি আমাদের যেমন
তেমন কথা ব’লে দিলে হয়? রিস্ক আছে না? আমরাও জানতাম না। আমাদের কাছেও বলেনি অজয়। আমরা
অনেক পরে জেনেছি, কিন্তু ওকে কিছু ব’লিনি। এখন ওর সাথে কোনো বিচ্ছেদ-টিচ্ছেদ
থেকে অজয়... এ্যাতোটা ব’লেও সবটা বলে না বাস্তব।
এরপর পুলিশ পৃথ্বীশ বাবু’র বাড়িতে যায়, এবং
তাঁর মেয়ে’র সাথে দেখা ক’রতে চায়। কিন্তু পৃথ্বীশ বাবু পুলিশকে বাড়িতে ঢুকতেই দেন
না। তিনি জানান যে, তাঁর মেয়ে মেঘা অত্যন্ত অসুস্থ। ডাক্তার ওকে কোনোরকম উত্তেজনা,
দুশ্চিন্তা বা পারিবারিক-সামাজিক অথবা রাজনৈতিক উচাটন থেকে দূরে রাখতে বলেছেন।
কিন্তু পুলিশ জানাতে বাধ্য হয়,
--- কিন্তু স্যার, আমাদেরকে যে দু-একটা
প্রশ্ন ওকে ক’রতেই হবে। বিজয় বাবু’র ছেলে অজয়ের মৃত্যু’র সাথে জড়িয়ে আমাদের এখানে আসা। আপনি
আপত্তি ক’রবেন না। আমরা কথা দিচ্ছি, ওকে কোনোরকম হিউমিলিয়েট ক’রবো না।
এ কথায় ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ হন পৃথ্বীশ
মজুমদার। তিনি চেঁচিয়ে ওঠেন--- বিজয় বাবু’র ছেলে’র সাথে আমার মেয়ে’র কী সম্পর্ক?
কোনরকমে হোঁচট খেতে খেতে আর সাবধানে শব্দ
চয়ন ক’রে ক’রে এসআই জানান--- ওদের মধ্যে একটা আবেগসুলভ সম্পর্ক ছিল ব’লে আমরা জেনেছি। ঐ
জন্যে অজয়ের মৃত্যু’র কারণেই আপনার মেয়ে অসুস্থ হয়। আমরা তো বাধ্য, স্যার,
এনকোয়ারি ক’রতে। ব্যাপারটা বহু দূর অবধি গড়িয়েছে, স্যার।
এইসব কথাবার্তা মেয়েটি শুনে নিজেই উঠে
এসেছে আর বাবা’র সামনেই স্বীকার ক’রেছে যে, অজয়ের সাথে ওর সম্বন্ধ ছিল। প্রেম কোনো রাজনৈতিক
গণ্ডি মানেনি, বিভিন্নতা মানেনি, শত্রুতা মানেনি। পৃথ্বীশ বাবু’কে বিস্মিত ক’রে দিয়েই মেঘা
জানিয়েছে যে, অজয়ের সাথে ওর কোনো ব্রেক আপ হয়নি। এই সাথে মেয়েটি এটাও জানিয়েছে যে,
গত চার-পাঁচদিন ধ’রে অজয় বেশ আপসেট ছিল। কেন আপসেট, সেটা অজয় মুখ ফুটে বলেনি। শুধু মুখে বিড়বিড়
ক’রতো, কী সব যেন আওড়াতো, সেইসব ছেঁড়া ছেঁড়া কথা’র কিছু কিছু মেঘা বুঝতে পেরেছে। যার
মধ্যে ‘আমার জীবনটাই বৃথা..., আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না..., আমাকে ভুলে যাও...’ এইসব কথাও ছিল। পুলিশ
নিশ্চিত হয় যে, মানসিক অবসাদ থেকে এই মৃত্যু। বিত্তশালী মানুষদের পরিবারে এই একটি
ব্যাধি তরুণ সমাজকে ব্যাপকভাবে আক্রমণ ক’রছে, ব’লে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে। কিন্তু তবু
তদন্তের একটা সুনিশ্চিত ইতি টানতে গেলে তো কোনো অসম্পূর্ণতা রাখা যায় না। তাই
একেবারে ফরম্যাল প্রশ্ন করেন এসআই,
--- অজয়ের কি কোনো শত্রু-টত্রু ছিলো ব’লে তুমি জানো?
আজকাল তো কলেজে পলিটিক্স একটা শত্রুতার বিরাট জায়গা। তেমন কোনো শত্রু...?
মেঘা জানায়--- অজয়ের সাথে নিশীথ নামে
একটি ক্লাশমেট-এর দিন পাঁচ-ছয় আগে একটা প্রচণ্ড মারামারি হয়। ঐ পোলিটিক্যাল
মতাদর্শগত সংঘাত। সবাই জানে। ছেলেটা একটু ষণ্ডা-গুন্ডা প্রকৃতি’র। ছেলেটা দল
পাকিয়ে অজয়’কে বেশ মারধোরও করে। অজয় বা ওর বন্ধুরা নিশীথ’কে কিছুই ক’রতে পারেনি। কিন্তু
অজয়ের বাবা এ্যাতো পাওয়ারফুল হয়েও কেন এই ব্যাপারটায় কোনো স্টেপ নেননি, তা আমি
জানি না, স্যার। অজয় কিন্তু চ’লে যাবার আগেরদিন আমার সাথে দেখাও করেনি।
একেবারে সহজ হয়ে যাওয়া কেসটা যে এইভাবে
আবার জটিল আঁকার ধারন ক’রবে, তা ভাবেনি পুলিশ। দিব্যি গুটিয়ে আনছিল গোটা
সমস্যাটাকে, কিন্তু মাঝখান থেকে এই প্রসঙ্গ আবার নতুন ক’রে সমস্যা ডেকে
আনলো। অজয়ের একটি শত্রু বেরোল। অজয়ের বন্ধুদের থেকে নিশীথের যে ঠিকানা পাওয়া গেলো,
তাতে এই থানা’র বাইরের থানাও জড়িয়ে গেলো। নিশীথের বাবা একজন প্রথিতযশা চিকিৎসক।
গায়নোকলজিস্ট। পুলিশ ঠিক ক’রলো, এবারে ইনভেস্টিগেশিন’কে একটু নতুন ঢঙে ক’রবে। তাই
গায়নোকলজিস্ট সুবিমল রায়ের অঞ্চলে একটা লোকাল এনকোয়ারি ক’রে নিয়ে বাড়িতে
ঢোকে পুলিশ। অঞ্চলে জানা যায় যে, নিশীথ দিন পাঁচ-ছয় অঞ্চলেই নেই। ফলে এই ঘটনায়
নিশীথ’কে মূল অভিযুক্ত ক’রে তুলতে, আর কেসটাকে গুটিয়ে তুলতে কোনো সমস্যা থাকবে না,
বুঝতে পারে পুলিশ। কিন্তু সেখানে
ডাক্তারের সাথে সাক্ষাত ক’রতেই কেসটা আরো জটিল আকার ধারণ করে। সুবিমল বাবু’কে পুলিশ প্রশ্ন
করে,
--- আপনার ছেলে নিশীথ কোথায়?
প্রথম দিকটা একটু হকচকিয়ে গেলেও নিজেকে
সামলে নিয়ে ডক্টর সুবিমল জানান--- ও বাইরে গেছে।
পুলিশের প্রশ্ন--- বাইরে মানে কোথায়?
--- কেন, বলুন তো? আপনারা নিশীথের খোঁজ
কেন ক’রছেন? কী হয়েছে?
পুলিশ অজয়ের মৃত্যু’র কথা গোপন ক’রে শুধু তারিখটা
উল্লেখ ক’রে বলে যে, একটা ক্রাইম ঘ’টে গেছে, আর তাতে নিশীথের নাম জড়িয়ে গেছে। এবারে হেসে উড়িয়ে
দেন সুবিমল বাবু। সোজা জানিয়ে দেন, আপনারা যে দিনের কথা ব’লছেন, নিশীথ তারও
আগে থেকে আউট অফ স্টেশন। সকলেই জানে। কিন্তু পুলিশ ছাড়ে না। যেহেতু এটা কোনো
প্রভাবশালী মানুষের বাড়ি নয়, সেহেতু একটু লেজে খেলার সাহস পায় পুলিশ। কেননা একজন সন্দেহজনক
মানুষ অঞ্চলে না থাকলেই যে একটা ক্রাইমের সাথে যুক্ত হ’তে পারবে না,
এমনটা অপরাধতত্ব বলে না। এসব এ্যালিবাই বানানো, বেনিফিট অফ ডাউট পাবার ফিকির হ’তে পারে। তারা নিশীথের
যাবার জায়গা’র নাম, কারণ ইত্যাদি সবই জানতে চায়। কিন্তু সুবিমল বাবু এবারে কোনো শক্ত উত্তর
দিতে পারেন না। বরং তিনি পুলিশের সামনে ভেঙ্গেই পড়েন। আবার বিষয়টা পুলিশের কাছে
জটিল হয়ে ওঠে। সত্যিই তো, যদি নিশীথ অজয়ের মৃত্যু’র কদিন আগেই বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যায়, আর
তার কোনো হদিশ বাড়ি’র লোক ক’রতে না পারে, তবে অজয় হত্যা’র পেছনে তার থাকা দাবিও করা যায় না, প্রমাণও
করা যায় না। আদালতে সেই অভিযোগ ধোপে টিকবে না। শুধু একটা বিষয় এক্ষেত্রে উল্লেখ
করা যেতে পারে--- নিশীথ বাড়ি ছেড়ে, বা বাড়ি থেকে না ব’লে উধাও হয়েছে,
এমনটা জানিয়ে সুবিমল বাবু থানায় কেন ডায়রি করেননি। যদিও তাঁর মতো একজন সামাজিক
মর্যাদা সম্পন্ন মানুষ হুট ক’রে ঘরের বিষয়ে থানা-পুলিশ করেন না। একটা পর্যায় অবধি তাঁরা
অপেক্ষা করেন। যদিও ভেতরের কথা জানবার জন্যে সুবিমল বাবু’কে এই বিষয়টা দিয়ে
ভয় দেখানো যেতে পারে, কিন্তু বাস্তবে নিশীথ নির্দোষ প্রতিপন্ন হবেই। সুবিমল বাবু
জানান যে, নিশীথ একটা চিঠি লিখে রেখে এ্যাব্স্কন্ড হয়ে গেছে, বাড়ি থেকে চ’লে গেছে। কিন্তু
পুলিশ এতেও নিরস্ত হয় না। তারা এর কারণ উদ্ধার ক’রতে চায়, কেননা এখন নিশীথ ছাড়া আর কাউকে
সন্দেহের তালিকায় রাখা যাচ্ছে না। পুলিশ চায় না যে, এই শোকাহত পরিবার কোনো ঘোর
অভিযোগে জড়িয়ে যাক।
পুলিশ জেনেছে, সুবিমল বাবু সম্বন্ধে
অঞ্চলের মানুষ নানা কথা ফিসফাস ক’রে বলে বটে, কিন্তু মানুষের ছোট-বড়ো নানা বিপদে-আপদে এই
মানুষটার ভূমিকা অঞ্চলের মানুষ অস্বীকার ক’রতে পারে না। অনেকে এঁকে পাগল ডাক্তার ব’লেও ডাকে। কিন্তু
স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁর হাতযশ শুধু এই অঞ্চলেই নয়, বাইরের নানা স্থানে
শোনা যায়। লোকে বলে ‘ধন্বন্তরি’। সুবিমল ডাক্তার রোগী’র গায়ে হাত দিলেই নাকি রোগী অর্ধেক ভালো
হয়ে যায়। অনেকেরই চিকিৎসাগত নাড়া বাঁধা আছে এই মানুষটা’র কাছে। এর মধ্যে
পড়েন আঞ্চলিক থানা’র বড়বাবুও।
কিন্তু ডিউটি ইজ ডিউটি। সেখানে মা-বাপ তো
বিচার ক’রলে জীবিকা চলে না। ফলে পুলিশ’কে গর্তে হাত ঢোকাতেই হয়। তাতে সাপ-ই
বেরোক, বা ইঁদুর। কে কার গর্তে ঢুকেছে, সে সব পরে হবে। সুবিমল বাবুই নিজে পুলিশ’কে সুবিধা ক’রে দিলেন। তিনি ব’ললেন,
--- আপনারা তো একবারও ব’ললেন না, ঘটনাটা
কী। কোন ক্রাইমের জন্যে আমার ছেলেকে আপনারা খুঁজছেন? কীভাবে, কোথায়, বিশেষ ক’রে ক্রাইমটা কী ঘ’টেছে--- এগুলো তো আমাকে মিলিয়ে দেখতে
হবে। বাবা হিসেবে ছেলে’র বিরুদ্ধে অভিযোগ শোনা’র আগে তো আমাকে জানতে হবে, অভিযোগটা কী। তাকে
এ্যারেস্ট ক’রতে হ’লে তো ওয়ারেন্ট দেখাতে হবে। আমি তো গ্রামের অশিক্ষিত মানুষ নই যে, যা খুশী ক’রতে পারবেন।
এবারে পুলিশকে জানাতেই হয় যে, দিন
পাঁচ-ছয় আগে নিশীথ তারই কলেজের একটি ছেলেকে কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে মারধোর করে। তারপরেই
সে উধাও হয়। অথচ ছেলেটি, যার নাম অজয়, সে মারা গেছে। অজয় এই অঞ্চলের এই ভদ্রলোকের
ছেলে। বাড়ি’র অভিযোগ, কদিন ধ’রে অজয়ের মধ্যে অস্বাভাবিক আচার-আচরণ দেখা গেছে। এইসব ঘটনা বার
বার নিশীথ’কেই দোষী সন্দেহ ক’রতে বাধ্য ক’রছে প্রশাসন’কে।
পুলিশের এই বর্ণনায় একেবারে পাল্টে যান
সুবিমল বাবু। তাঁর চোখ-মুখ যেন একেবারে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়। তিনি নিজেকে সংবরণ
ক’রে শুধু একটাই প্রশ্ন করেন---অজয় মারা গেছে? আর ইউ শিয়োর, অফিসার? পুলিশের কাছ
থেকে সদর্থক ইঙ্গিত পেয়ে আবার তিনি প্রশ্ন করেন--- অজয় কিভাবে মারা গেছে?
--- ট্রেনে কাটা প’ড়ে। সুইসাইড।
মাথায় হাত দিয়ে ব’সে পড়েন সুবিমল
বাবু। তাঁর এমন আচরণে পুলিশ আরো ধন্ধে প’ড়ে যায়। তারা সুবিমল বাবু’কে ঝাঁকি দিয়ে
বলে--- আপনি কি কিছু ব’লতে চান? তাহলে যা জানেন, খুলে বলুন। বিজয় বাবু’র পরিবার একেবারে ভায়োলেন্ট
হয়ে প’ড়েছে। একজন মানুষের এ্যাতো বড়ো একটি সন্তান যদি চ’লে যায়, তবে বাড়ি’র মানুষের মনের
অবস্থা তো আপনি বুঝতেই পারেন। আপনি তো একজন চিকিৎসক। মানুষের জীবন বাঁচানোই তো
আপনার প্রফেশনাল ওথ ছিল।
যেন টাল খেতে খেতে টেবিল-চেয়ার ছেড়ে উঠে
দাঁড়িয়ে সুবিমল বাবু বলেন--- থানায় চলুন। আমাকে তো থানাতে যেতেই হবে। আমিই অজয়ের
মৃত্যু’র জন্যে দায়ী। আমিই অপরাধী। আমার ছেলে নয়। ও যেখানেই থাকুক, যেমন থাকুক, ও
নির্দোষ।
এমন আকুতিতে পুলিশ হাল ছাড়ে না। তারা
সুবিমল বাবু’কে বলে--- আপনি দোষী, কি আপনার ছেলে--- সেটা না হয় আদালত বিচার করুক। আপনার
সন্তান’কে তো আপনি বাঁচাতে পারবেন না, ডক্টর রায়।
মলিন হেসে সুবিমল বাবু উত্তর দেন--- সব
বিচার কি আর আপনাদের আদালতে হয়, স্যার! কোনো কোনো বিচার না-হয় ওপরওয়ালা’র হাতে ছাড়ুন। সেখানে
সাক্ষী, উকিল, পেশকার, কোর্টবাবু কিছুই লাগে না। চলুন, থানায় গিয়েই সবটা শুনবেন।
পুলিশ সুবিমল বাবু’কে সাথে নিয়ে বেশ
ধন্ধে মাথা চুলকোতে চুলকোতে থানায় গিয়ে হাজীর হয়। সেখানে সুবিমল বাবু একেবারে
নাটকীয় কাহিনি শোনান। বছর কুড়ি আগে মুর্শিদাবাদে বসবাস ক’রতেন তিনি।
সেখানেই তাঁর ভালোমন্দ পশার ছিলো, জনপ্রিয়তা ছিলো। ছোটবেলা থেকেই সুবিমল বাবু তাঁর
চরিত্রে, ব্যবহারে একেবারে দুনিয়া ছাড়া ছিলেন। পরিবারে তাঁর সম্বন্ধে হাজার
অপব্যাখ্যা ছিল। সামাজিক সাধারণ রীতিনীতি মানতেন না কোনোকালেই। এমনি একদিন একটি
মহিলা এ্যাবরশনের জন্যে আসে তাঁর ক্লিনিকে। সুবিমল বাবু জানতে পারেন, মেয়েটির
জীবিকা সমাজের রীতিনীতি’র পরিপন্থী ছিল। যে কোনো কারণেই হোক, এই জীবিকা মেয়েটিকে গ্রহণ
ক’রতে হয়েছিল। এসব পেশাতে মেয়েরা সাধারনত সতর্কই থাকে, কিন্তু ভবিতব্য! জীবনের
প্রতিটা দিন তো একইভাবে কাটে না। সামান্য অসতর্কতা থেকে মেয়েটি গর্ভধারণ ক’রে ফেলে। সমাজ
ব্যবস্থা’র স্বার্থে, জীবিকা’র স্বার্থে এবারে তাকে মুক্ত হ’তেই হবে। এই সমাজ
সন্তান প্রসব গর্বের তখনই মনে ক’রবে, যখন সেটি সম্বন্ধে তারা সম্যক অবহিত হবে। এ বিষয়ে গোপন
চ’লবে না। আমার সন্তান আমি কখন বা কীভাবে চাইবো, সেটা আমি নই, সমাজ ঠিক ক’রে দেবে। সমবেত
মানুষের সম্মতি নিয়ে তুমি একটি জীবন সাথী পছন্দ করো, তাদের সম্মতি নিয়ে তাকে নিয়ে
এক ঘরে ঢোকো, বিছানায় যাও, সন্তান উৎপাদন করো। তুমি একা একা এসব করার কে! তাই অপরিজ্ঞাত
গর্ভধারনে গর্ভপাত অনিবার্য। কিন্তু মন থেকে সায় দিতে পারেনি মেয়েটি। এই প্রথম
বারের জন্যে সে মা হ’তে চ’লেছে। মাতৃত্ব তাকে যেন কোথায় বাস্তবের সাথে বার বার সঙ্ঘাত
ক’রিয়ে দিচ্ছিলো। বিষয়টা বুঝতে পারেন ডাক্তার সুবিমল রায়। দুনিয়া’র নিয়ম-নীতি’র ক্ষেত্রে
কালাপাহাড় ডাক্তার সুবিমল মেয়েটিকে বিবাহের প্রস্তাব দেন, নিশ্চিন্ত জীবনের
প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু সঙ্কটে প’ড়লেও মেয়েটি ডাক্তারের এমন দয়া নিয়ে
বেঁচে থাকতে চায়নি। সে শরীর বেচে খাওয়া মানুষ। সেটাই তার অভিমান। কিন্তু সুবিমল
বাবু জানিয়ে দেন যে, তিনি মেয়েটিকে দয়া নয়, ভালবেসে বিয়ে ক’রতে চাইছেন।
সন্তান হ’লে মুর্শিদাবাদের বাস উঠিয়ে সুবিমল বাবু
সস্ত্রীক চ’লে আসেন এখানে, যাতে মেয়েটিকে অথবা সন্তানটিকে কোনো সামাজিক প্রশ্নে প’ড়তে না হয়। এখানে
তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অপরিচিত এবং নিরাপদ। ভালোই ছিলেন এখানে, কিন্তু ‘বায়ুর আগে বার্তা
ছোটে’ ব’লে একটা প্রবাদ আছে, আর তাঁর জেরেই কবে যেন কোনো সূত্রে এই গোপন ইতিহাস প্রকাশ
হয়। তবে তা ছিল আপাত গুপ্ত। জনপ্রিয় এই ডাক্তারের ব্যক্তিগত জীবন’কে নিয়ে প্রকাশ্যে
কেউ স্ক্যান্ডাল ছড়ায়নি। কিন্তু গোপনে যে সেই সব নিয়ে এই সভ্য-সুশীল সমাজ আচারের
মত তারিয়ে তারিয়ে খাবে না, এমনটা অপ্রত্যাশিত কখনও ছিলো না, থাকেওনি। তারই
বহিঃপ্রকাশ ঘ’টলো কলেজে। দুই রাজনৈতিক দলের কোন্দলের কারণে হঠাৎই অজয় নিশীথ’কে বাবা-মায়ের
অবাঞ্ছিত সন্তান ব’লে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ক’রে কলহে তাৎক্ষনিক জয় চায়। ফলে তাকে অনিবার্যভাবে
প্রচণ্ড প্রহার সইতে হয় নিশীথের হাতে। কলেজ ক্যাম্পাসে সকলের সামনে এমন অপদস্ত হ’য়ে অজয় ওর বাবা’কে কিম্বা ওর বাবা’র পোশ্য মাস্ল
পাওয়ারদের দিয়ে নিশীথের একটা মোক্ষম জবাব দিতে পারতো। কিন্তু বাবা’র রাজনৈতিক
ক্ষমতা, বদনাম বা প্রভুত্ব কোনোদিন সন্তান হিসেবে মেনে নিতে পারেনি অজয়। তাই কলেজের
এসব কথা অজয় বাড়িতে প্রকাশ করে না। নানা অছিলায় নিজের শরীরের, বিশেষত মুখের ছোটবড়ো
বিকৃতি কোনোভাবে গোপন করে বাড়িতে। কিন্তু বিষয়টা সেখানেই থেমে থাকে না। নিশীথ অজয়কে
শায়েস্তা ক’রলেও ওর বলা কথাগুলো না পেরেছে বিশ্বাস ক’রতে, না পেরেছে ভুলতে। ও বাড়িতে ফিরে
গিয়ে সরাসরি তার মা’কে এবং পালক পিতাকে আক্রমণ করে, জানতে চায় এই স্ক্যান্ডালের
ইতিহাস কী? আর গোপন ক’রতে পারেন না সুবিমল রায় এবং তাঁর স্ত্রী। এই সত্যের মুখে
দাঁড়িয়ে নিশীথ নিজেকে সত্যিই অবাঞ্ছিত মনে ক’রে একটা চিঠি লিখে রেখে বাড়ি ছাড়ে। লিখে
রেখে যায়,
“আমি চ’লে যাচ্ছি। কোথায়,
আমি জানি না। ম’রতেও পারি, বেঁচে থাকতেও পারি। সেটা সময় ব’লবে। কিন্তু একটা মিথ্যে অস্তিত্ব,
অনাত্মীয়ের দয়া নিয়ে আমি বাঁচতে পারবো না। আমার জন্যে আমার অজ্ঞাতকুলশীল বাবা,
আমার বারবনিতা মা কখনও কোনো প্রার্থনা করেনি। তাই আমি কারোর নই। আমার জন্যে কেউ
নেই। আমাকে অজয় এই ইতিহাস না জানালে আমি কোনোদিন জানতেই পারতাম না, কী অযথা আমার
অস্তিত্ব! আমি অজয়’কে মেরেছি, সত্যি। নিজেকে সামলাতে পারিনি। কিন্তু ও আমার
উপকারই ক’রেছে। সেই কারণেই আমি চ’লে যাচ্ছি।”
এই ঘটনায় যথেষ্ট বিচক্ষণ মানুষ হয়েও এই
একটি নিষ্ঠুর পরিণামে সুবিমল বাবু নিজেকে সংযত রাখতে পারেন না। তিনি অজয়’কে নিষ্ঠুরভাবে
প্রহার করার জন্যে নিশীথের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাইবার অছিলায় ডেকে পাঠান। তখন নিশীথ
বাড়ি ছেড়ে চ’লে গেছে। অজয় জানত না, তার মৃত্যুবান ছিল ডাক্তার সুবিমল রায়ের হাতে। তিনি
একেবারে প্রতিশোধের আগুনে জ্ব’লে উঠে অজয়’কে জানিয়ে দেন যে, অজয়ের বাবা ওর মা’কে নিয়ে বছর কুড়ি
আগে ওঁর কাছে এসেছিলেন এ্যাবরশনের জন্যে। ওঁদের একটি ছেলে ও একটি মেয়ে আছে। ওঁরা বারো
বছর পরে আর একটি নতুন সন্তান চান না। এতে ওঁদের সামাজিক সম্মান আহত হবে। কিন্তু
ওঁদের অজ্ঞতাবশত ওঁরা সিদ্ধান্ত নিতে দেরী ক’রে ফেলেছিলেন। এ্যাবোর্ট ক’রলে পেশেন্টের
প্রানহানি’র আশঙ্কা ছিলো ব’লে ওঁদেরকে ফিরে যেতে হয়। সেই সন্তানই হ’লো অজয়। ডাক্তারি
শাস্ত্রে আনএথিক্যাল হ’লেও ব্যক্তিসত্তা ডাক্তারের পেশাদারী নীতি থেকে বড়ো হয়ে
ওঠে। ফলে সুবিমল বাবু অজয়’কে নিশীথের মতোই অবাঞ্ছিত সন্তান ব’লে ওর গায়ে কলঙ্ক
দেগে দেন। এর পরের ঘটনা আজকের সঙ্কট।
পুলিশ এরপরে ফিরে আসে বিজয় বাবু’র বাড়িতে। তাঁদেরকে
এই কেসের একটা রাহা ইতি টানতে হবে। অজয়দের সারা বাড়ি তল্লাশ ক’রে খুঁজে পুলিশ পেতে
চায় অজয়ের কোনো সুইসাইডাল নোট। তাদের কথা, একটি ছেলে আত্মহত্যা ক’রেছে, কিন্তু সে
কোনো সুইসাইড নোট লিখে রেখে যায়নি--- এমনটা অপ্রত্যাশিত। শেষে জানা গেলো, মানসিক
দ্বন্দ্বের চার-পাঁচটা দিনের মধ্যে একটা দিন ও ব্যাঙ্কের লকারে গিয়েছিলো। এ বাড়িতে
সংসারের টাকা-পয়সা, সোনা-দানা কোনোকিছুই অন্য পরিবারের মতো ছেলে-মেয়েদের কাছে
গোপনীয় ছিল না। ফলে কেউ কোনো প্রশ্ন
করেনি, কেন ও লকারে যাবে। সেখানে ওঁর আংটি আছে, চেন আছে। যুবক ছেলে--- হয়তো প’রবে, মাথায় এসেছে।
এবারে সেখানেই পাওয়া গেলো সুইসাইডাল নোট-টি। অনেকটা নিশীথের আদলেই লেখা একটি চিঠি।
শুধু তাতে একটি অধিক তথ্য পাওয়া গেলো। সুবিমল বাবু’র কাছে থেকে ফিরে অজয় কয়েকটা দিন নিজের
সাথে যুদ্ধ ক’রেছে। শেষে আর যুঝতে পারেনি। এই অপ্রার্থিত জীবন, মূল্যহীন অস্তিত্ব এবং দায়ে
প’ড়ে বাঁচিয়ে রাখা জীবন ছেলেটি মেনে নিতে পারেনি। যে অপমানে নিশীথ’কে সে বিদ্ধ ক’রেছে, সে যে নিজেই
একই পরিণামের শিকার, এটা মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি ওর পক্ষে। কিন্তু মৃত্যু’র আগের চার-পাঁচ
দিন সে একটা উপযুক্ত অভিজ্ঞান হাতে পাবার জন্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।
একটা ধন্ধ ওর মনে ছিলোই। অজয় ওদের শিফটিং-এর কাজে প্যাকিং ক’রতে গিয়ে ওর মায়ের
মেডিক্যাল ফাইলে পেয়ে যায় কুড়ি বছর আগেকার ডাক্তার সুবিমল রায়ের সেই প্রেসক্রিপশন।
তখনই ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়।
বিজয় বাবু চেপে ধরেন পুলিশ’কে--- এখনই ঐ
স্কাউন্ড্রেল ডাক্তারটাকে এ্যারেস্ট করুন। এখনই। আমার ছেলেকে সুইসাইড করায় ঐ লোকটা
প্রভোক ক’রেছে।
কিন্তু পুলিশের এসআই হেসে বলে--- কাকে
কাকে এ্যারেস্ট ক’রবো, বলুন তো, স্যার? কজনকে এ্যারেস্ট ক’রবো? আপনাদের দুই পরিবারই নিজেদের
জলজ্যান্ত সন্তান হারিয়েছেন। দুজনেই দুঃখ করুন। আর নতুন কিছু হারাবেন না, স্যার। এই
হিংস্রতা থাক না। আপনারা সম্মানীয় মানুষ। এসব ক’রলে আপনার অসম্মান, ও পক্ষেরও অপমান।
আমাদের ডাকলে যে আপনাদের মান থাকে না, স্যার।
---------------------------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন