পরস্বর
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়
কৃষ্ণনগর থেকে পূর্ণিমা’কে নিয়ে সকাল সকাল বাসে চেপে ব’সেছে কান্তি। একেবারে
গম্ভীর, চুপচাপ। নিঃশব্দ্ নীরব। সারা রাত জাগার পরে চুপচাপ থাকতে থাকতে বাসের
একটানা গোঁ গোঁ শব্দ আর জানলা দিয়ে ব’য়ে আসা ফুরফুরে হাওয়ায় বেশ চোখটা লেগে আসছিলো ওর। পূর্ণিমা ছেলেকে কোলে নিয়ে ব’সে আছে ওর ডান পাশে। জানলার গায়ে। ছেলেটা বায়না ক’রলো ব’লে জানলাটা ছেড়ে
দিতে হ’লো কান্তি’কে। তা নয়তো জানলাটার দিকে ও ব’সলে মাথাটা বাসের
জানলায় ঠেসান দিয়ে বেশ ভালো ক’রে ঘুমোনো যেতো। ছেলেটা
জানলায় ব’সবে, বাইরেটা দেখতে দেখতে যাবে, এ তো
বাচ্চাদের জন্মগত অধিকার। বাচ্চা’র মা-ও কম যায় না।
সে ও তো তেমন বাড়ি’র বাইরে যায় না।
তাই তারও শখ জানলা। সে-ও ছেলের দোহাই পেড়ে জানলা’র দিকটাতেই ব’সেছে। তাই অগত্যা
পূর্ণিমা’র গা ঘেঁষে হেলে গিয়ে ঘুমোতে ঘুমোতে চ’লেছে কান্তি।
একটু ঘুমিয়ে প’ড়তে পারলে ও এই যন্ত্রণাটার হাত থেকে অন্তত নিস্তার পেতো। সীটের বাইরের
দিকটাতে বসার ফলে কান্তি’কে একটু সাবধান
থাকতে হ’চ্ছে। ঘুমিয়ে গেলে দুম ক’রে প’ড়েও যেতে পারে। যে
ঘুমটা আজ ওর দু-চোখ বেয়ে নেমে আসছে, এমনটা ঘুম আজ বহুদিন ওর পায় না। ঘুমোতে হবে,
তাই রাতে ঘুমোতে যায়। ঘুম হয়ও। এমন নয় যে, সংসারের কোন সমস্যায় ওর দু-চোখের ঘুম চ’লে গেছে। তা নয়। কিন্তু দু-চোখ জড়িয়ে ঘুম পাবে, কোন রকমে
বালিশ হাতড়াতে হাতড়াতে বিছানায় গিয়ে পড়া মাত্র ক্লান্ত চোখদুটো ধাঁ ক’রে বুজে আসবে--- এমন একটা আরামের ঘুম কান্তি’র বহুদিন হয় না। ঘুম ওর পায় না। আজকে পাচ্ছে। এই বাসের
জার্নিতে সেই বহুদিনের আশ মিটে যাচ্ছে। কিন্তু মনটা অস্থির। একটা উচাটন ওকে যেন
তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না। তাই ঝট্কা মেরে ঘুমটা মাঝে মাঝে কেটেও যাচ্ছে।
কালকে কান্তি’র হোলনাইট প্রোগ্রাম ছিল। কৃষ্ণনগরে। এই প্রথম একটা হোলনাইট প্রোগ্রাম ক’রলো কান্তি। তার ওপরে আবার সঞ্চালনা’র কাজ ক’রলো ও। সঞ্চালনা তো
ও করে না। ক’রতে জানেও না। অবশ্য
ও নিজে মঞ্চে যা করে, কালকেও তা-ই ক’রতে হ’য়েছে বটে। সেই জন্যেই ওকে ডেকে নিয়ে
যাওয়া। শুধু আয়োজকদের হঠাৎ বিপদে এই কাজটা ক’রে দিতে হ’য়েছে ওকে। এই নতুন
ধরনের কমিক ক’রতে ক’রতে মাঝে থামিয়ে দিয়ে পরবর্তী শিল্পী’র নাম ওকে নিজেকেই এ্যানাউন্স ক’রতে হ’য়েছে। ওরা একজন
সঞ্চালক’কে বায়না ক’রে রেখেছিলো। টাকা এ্যাডভান্স ক’রেওছিল। কিন্তু লোকটা নাকি কী একটা কারণে সুইসাইড ক’রে ব’সেছে। সকালবেলা
খবর পেয়েছে ওরা। ফলে নতুন কাউকে ওরা আর পায়নি। এক ঢিলে দুই পাখি মারতেই এরা কান্তি’কে দিয়ে কাজটা ক’রিয়ে নিয়েছে।। আজকাল তো এ্যানাউন্স করা একটা বিশেষ শিল্প। নানা কায়দা জানতে হয়
এক শিল্পী মঞ্চ থেকে প্রোগ্রাম ক’রে নেমে গেলে আর
এক শিল্পী আসা পর্যন্ত মঞ্চটাকে ধ’রে রাখতে। সুতো
দিয়ে মালা গাথা’র মতো অনুষ্ঠান
একটার পর একটা জুড়ে দিতে হয়। আজকাল এর সাথে বৈচিত্র্য যুক্ত হ’য়েছে হাস্যকৌতুক। এই হাস্য কৌতুকের জন্যে ডাকা হয় কান্তিকে।
কান্তি কিন্তু নির্ভেজাল হাস্যকৌতুক শিল্পী নয়। ওর একটা
অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। অন্যকে নকল করা। নকল করা যদি কোন ক্ষমতা’র মধ্যে পড়ে, তবে কান্তি’র সেই ক্ষমতা আছে। আর এইটাই আজ ওর পার্শ্ব-পেশা, ওর পার্শ্বজীবিকা। অনুষ্ঠান
সঞ্চালকের সাথে বার বার মঞ্চে আবির্ভূত হ’য়ে তাকে সহায়তা করাই ওর জীবিকা। সঞ্চালক তার সুন্দর কণ্ঠে আর সুলোলিত
বাচনভঙ্গিমায় পরবর্তী কোন শিল্পী মঞ্চে আসছেন, তা ঘোষণা ক’রবেন। এই সঞ্চালকের সাথে কমেডি করে কান্তি। অপরকে নকল করার
কমেডি।
ছোটবেলা থেকে বাবা’কে, কাকা’কে,
মাস্টারমশাইকে, দুধওয়ালা’কে, রাস্তা দিয়ে
যাওয়া যে কোনো হকারকে হুবহু নকল ক’রে কিছু মানুষের
যেমন বিরাগভাজন হ’য়েছে ও, তেমনি
অনেকে ওর এই নিখুঁত ক্ষমতাটাকে নিয়ে বিনোদন ক’রেছে। পরে বাবা, কাকা ছেড়ে শুরু ক’রেছে বাঙ্গলা, হিন্দি সিনেমার নানা নায়কের গলা নকল করা, রাজনৈতিক নেতাদের গলা
নকল করা। বিয়ে বাড়িতে, বাসরঘরে, পিকনিকে, স্কুলের ফাউনডেশন সেরিমনিতে--- এমনি নানা
জায়গায় অন্যকে শুধু কথায় নয়, তার চলায়-বলায় নকল ক’রে সকলকে তাক লাগিয়ে দিতো কান্তি। আরো পরে শুধু গলা নকলই নয়, তাদের হাঁটা-চলা
পর্যন্ত নকল ক’রে পাড়ায় বেপাড়ায় বেশ
নাম ক’রে নেয় ও। নিখুঁত, নিভাঁজ এবং নির্ভেজাল
নকল। সেটা যে ওর একদিন জীবিকা হ’য়ে উঠবে, সেটা
কান্তি নিজেও ভাবেনি কোনদিন। হঠাৎ ক’রে বাবা মারা যেতে কলেজে প’ড়তে পারেনি কান্তি।
পরিবারের দায় কাঁধে তুলে নিতে হ’য়েছে। দোকানে
দোকানে কাজ ক’রে সংসার
চালিয়েছে। আজও কাজ করে একটা কাপড়ের পট্টিতে। যেহেতু সাধারণত কোনো ফাংশান হয় শনি বা
রবিবার, সেহেতু পট্টি থেকে ছুটি পায় ও। ছুটি পায় মানে হাফ মাইনে কাটা যায়। যেহেতু
কান্তি অত্যন্ত সৎ এবং বিশ্বাসী, মালিক ওকে ভরসা করে। মালিক জানে যে, একটা পয়সা
এদিক থেকে ওদিক ক’রবে না এই ছেলেটা।
মালিক এও জানে যে, কান্তি এই কাপড়ের পট্টিতে যে মাইনে পায়, তাতে সংসার চালাতে পারে
না। ওর মা অসুস্থ হ’য়ে শয্যাশায়ী হ’য়ে পড়ায় ওকে বিয়েও ক’রতে হ’য়েছে। একজন পার্টনার ওর দরকার ছিল। ও কাজে
বেরিয়ে গেলে অসুস্থ মা’কে দেখবে কে! ফলে ওর
দায়-দায়িত্ব বেড়েছে। তাই মালিক ওকে কিঞ্চিৎ রেয়াৎ করে।
আজ এ্যাতোদিন ওর বিয়ে হ’য়েছে, বউকে কোনোদিন কান্তি নিজের অনুষ্ঠান দেখাতে নিয়ে যেতে পারেনি। যাবে
কীভাবে! বাড়িতে মা’কে দেখবে কে! ওর
ছেলেটা হবার সময়ও পূর্ণিমাকে তার বাপের বাড়িতে রাখা যায় নি। ওর শাশুড়ি পর্যন্ত এসে
এ বাড়িতে ছিলেন। তা নয়তো তো পূর্ণিমা’কে হাসপাতালেও পাঠাতে পারে না। উপার্জন তো ক’রতে হবে কান্তি’কে। বাড়িতে ব’সে মা’কে পাহারা দিলে তো
পেট ভ’রবে না। বিপদে প’ড়লে নিয়ম খাটে না। তাই ওর শাশুড়ি বিপদে আপদে এখানে এসে
থাকতেন।
আজ কান্তি’র মা-ও আর বেঁচে
নেই। পূর্ণিমা নিজে জানে যে, ওর বর কান্তি মঞ্চে হাস্যকৌতুক করে। হাস্যকৌতুক তো
একটা আর্ট। একটা শিল্প। তাই স্ত্রী হিসেবে বেশ গর্ব ছিল পূর্ণিমা’র। নিজেদের আত্মীয়-পরিজনদেরকে বুঝিয়েছিলো যে, ওর স্বামী
একজন আর্টিস্ট। মঞ্চে মঞ্চে অনুষ্ঠান করে শুধু নয়, তার জন্যে ও টাকাও নেয়। পেশাদারী।
তাই শ্বশুরবাড়ি দিককার কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে হ’লে কান্তি’র জন্যে বিশেষ কয়েকটা
নীল বা হলুদ রঙের যে শিল্পীসুলভ পাঞ্জাবি পূর্ণিমা ক’রিয়ে রেখেছে, তা-ই পরিয়ে বর’কে নিয়ে যায় পূর্ণিমা। শার্ট-প্যান্ট প’রতে দেয় না। এতে পূর্ণিমা’র সম্মান বাড়ে। পূর্ণিমা
দেখেছে যে, শিল্পীরা এরকম ঝকমকে রঙ্গিন পাঞ্জাবী প’রে অনুষ্ঠান ক’রতে যায়। সংসারে
যে ছোটমোটো অভাব আছে, তাতে খুব একটা বিবাদ করে না ওর বৌ। সে তো অত্যন্ত দরিদ্র
পরিবারের মেয়ে। কান্তি ওকে বুঝিয়ে রেখেছে যে, শিল্পীদের অভাব থাকে।
নিজেকে শিল্পী ব’লে গর্ব যে কান্তি করে না, তা নয়। মঞ্চে ও উঠলে মানুষ ওকে চায়, ওর কথা শুনতে
চায়, ওর ডায়লগ শুনতে চায়। তাহ’লে ও অন্য কোনো
শিল্পী থেকে কম কীসে! আয়োজকরা ওকে পয়সা দেয় কেন? ওকে নিয়ে যায় কেন? নিশ্চয়ই ওর দাম
আছে। কিন্তু কোনো না কোনো কারণে পূর্ণিমা’কে ওর নিজের অনুষ্ঠান দেখাতে নিয়ে যেতে পারে নি কান্তি। সবই তো বাইরে বাইরে
ফাংশান। যাবে কী ক’রে! ওকে না হয় আয়োজকেরা
আলাদা গাড়িতে নিয়ে যাবে। কিন্তু পূর্ণিমা? সে যাবে কীসে? নানা ঝামেলায় কোনো না
কোনো ভাবে পূর্ণিমা দ্যাখেনি, স্বামী কী ধরনের শিল্পী। ভেবেছে, কী ধরন আর হবে! লোককে
নানাভাবে হাসায়। যেমন বাংলা-হিন্দি সিনেমায় নানা আর্টিস্টরা হাসায়, তেমনই কোনোভাবে
হাসায় নিশ্চয়ই। হাস্যকৌতুক কী, জানে পূর্ণিমা। তাই ও কোনদিন বায়নাও করেনি ফাংশান
দেখার জন্যে। তাছারা আর একটা মুশকিল আছে পূর্ণিমা’র। ও জানে, ও নিজে ভালো শিক্ষিতা নয়। যদি সত্যি একদিন কান্তি ওকে নিয়ে যায় কোন
অনুষ্ঠানে, তবে অন্য শিল্পীদের সাথে তো কথা ব’লতেই পারবে না ও। সেটা তো ওর স্বামী’র পক্ষে খুবই অসম্মানের হবে। সকলে জেনে যাবে যে, কান্তি মণ্ডলের স্ত্রী
অশিক্ষিতা। তাই শুধু আত্মীয় মহলেই ঝাঁঝ দেখিয়ে ঘোরে পূর্ণিমা। মঞ্চে গিয়ে স্বামী’র ঝাঁঝ সে দ্যাখেনি।
কান্তিদের পাড়ায় একটি ছেলে থাকে যে বিয়ে ক’রেছে কৃষ্ণনগরে। সে-ই কান্তিকে এই অনুষ্ঠান দিয়েছে। সেই
ছেলেটি শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে সে আবিষ্কার ক’রেছে তার শ্বশুরবাড়ি পাড়ায় ফাংশানে সঞ্চালক আসছে না। অমনি ও কান্তি’র সাথে ফোনে কথা ব’লেছে। কান্তি’কে এখানে
হাস্যকৌতুকের জন্যে বলাই হ’তো না। ঐ পাড়ার
ছেলেটি কান্তিকে একটা অনুষ্ঠান পাইয়ে দেবার জন্যে, আর শ্বশুরবাড়ি অঞ্চলের হ’য়ে একটা উপকার ক’রে দেবার জন্যেই নিজে উদ্যোগ নিয়েছে। আর তখনই পূর্ণিমা জানিয়েছে,
--- তুমি যেমন সেই কৃষ্ণনগরেই যাচ্ছ, তখন আমাকে নিয়েই চলো
না কেন। আমার তো সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী’র বিয়ে হ’য়েছে ওখানে। অনেকবার
ও আমাকে ব’লছে যাবার জন্যে। এই সুযোগে তুমিও
প্রোগ্রাম ক’রে আসবে, আর আমিও
বন্ধুর বাড়ীতে একটা দিন কাটিয়ে আসি।
--- কেন? আমি যে প্রোগ্রাম ক’রতে যাচ্ছি, আমার প্রোগ্রাম দেখতেও কি ইচ্ছে করে না তোমার? কান্তি শুধোয় পূর্ণিমা’কে।
--- না গো, এবারেও হবে না। এর পরে একদিন দেখলেই চ’লবে। ফলে এবারেও কান্তি’র অনুষ্ঠান দেখা হয়নি পূর্ণিমা’র।
বাসে উঠে ইস্তক পূর্ণিমা দেখেছে যে, কান্তি কেমন যেন মনমরা
মনমরা ভাব ক’রে ব’সে আছে। গম্ভীর। একটাও কথা ব’লছে না। যেটুকু না হ’লে নয়, সেটুকু ব’লছে। অনেকবার জিজ্ঞেস ক’রবে ভেবেও কোনো
কিছু বলেনি পূর্ণিমা। ঠিক ক’রেছে যা বলার, যা
প্রশ্ন করার, তা বাড়ি গিয়েই ক’রলে হবে। এই ভেবেই
সে-ও ছেলে’র সাথে বাইরেটা দেখতে দেখতে চ’লেছে। বাইরেটা দেখতে দেখতে একবার ভেবেছে, তাহলে কি কান্তি
কালকে রাতের প্রোগ্রামে পুরো টাকা পায়নি? মাঝে মাঝে এমনটা হয়। কান্তি আগেও ব’লেছে। ফাংশান কর্তাদের সাথে মাঝে মাঝে ঝগড়া ক’রে টাকা আদায় ক’রতেও হয়, শুনেছে। মনে মনে কয়েকবার অজানা অচেনা আয়োজকদের প্রতি শাপমন্যিও ক’রেছে পূর্ণিমা।
কৃষ্ণনগরে এসে টাকা খুব খারাপ পায়নি কান্তি। এ্যাতো টাকা এর
আগে কখনও একসাথে পায়নি। গোটা রাতটা জাগতে হ’য়েছে বটে। টাকায় পুষিয়ে গেছে ওর। কিন্তু মনটা ওর মোটে ভালো নেই। প্রোগ্রামটা
পেয়ে পাড়ার ছেলেটাকে মনে মনে অনেকবার ধন্যবাদ জানিয়েছিলো কান্তি। সামনা সামনি দেখা
হ’লে সরাসরি ব’লবে, ভেবেওছিলো। কিন্তু যেটা এখানে এসে ঘ’টেছে, সেটাকে সইতে পারেনি মন থেকে। মনে মনে প্রায় ঠিকই ক’রে ফেলছিলো যে, আর এইসব অন্যের হাঁটা-চলা-হাত-পা নাড়া,
তাকানো, নকল ক’রে অন্যের গলায়
সংলাপ বলা’র কাজ ক’রবে না। সত্যিই তো, উনি তো ঠিকই ব’লেছেন। ও তো একটা বাড়িতে পোষা টিয়াপাখি’র মতো। টিয়াপাখি যদি রাতদিন মানুষের বলা কথা নকল ক’রতে থাকে, তবে নিজের ডাকটাই তো একদিন ভুলে যায়। তাহলে তো সে
আর টিয়াপাখি থাকে না। তার কোন নামই থাকে না। না মানুষ, না টিয়াপাখি। ওর ছেলে
পাপ্পু হোক বা পূর্ণিমা--- একদিন তো ওর গলার স্বরটা যে কী, তা-ই ভুলে যাবে। তারাই
ভুলে যাবে শুধু নয়, ও নিজেও তো নিজের গলায় কথা ব’লতে পারবে না একদিন। এ কী সর্বনাশ! না। আর এ কাজ করা যাবে না। তাতে হয়তো ওর
বছরে যে একটা এক্সট্রা টাকা ইনকাম হয়, তা হবে না। তবু নিজের সত্তা ভুলে গিয়ে ‘অন্য’ হ’য়ে বেঁচে থাকতে পারবে না ও। ভাগ্যিস পূর্ণিমা’কে কোনদিন ওর প্রোগ্রাম দেখাতে নিয়ে আসেনি। ভাগ্যিস
পূর্ণিমা পুরো জানে না, ও কী করে স্টেজে।
কালকে মঞ্চে ঘোষণা ক’রতে ক’রতে গ্রীনরুমে এক ঝলক গিয়ে দ্যাখে যে, ওর
প্রিয় গানের শিল্পী ব’সে আছেন। এই
মানুষটার সাথেই এক স্টেজে যে ও কোনোদিন অনুষ্ঠান ক’রতে পারবে, এমনটা স্বপ্নেও ভাবেনি। গর্বে বুকটা ফুলে উঠেছিলো। অগ্র-পশ্চাৎ
ভুলে গিয়ে ওর সামনে গিয়ে ঢিপ্ ক’রে একটা প্রনাম
ঠুকে দিয়েছে। মানুষটা চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে ব’লে উঠেছেন,
--- কে তুমি, বাবা? আমি তো তোমাকে চিনি না।
--- আমাকে আপনি চেনেন না। আমি কান্তি। আজকে আমি আর আপনি একই
স্টেজে যে অনুষ্ঠান ক’রছি, এটা আমার
বিরাট সৌভাগ্য। আমি আপনার গানের মস্ত ভক্ত। ছোটবেলা থেকে আপনার গান শুনে শুনে
গুনগুন ক’রেছি।
--- তাই? তুমি এখানে অনুষ্ঠান ক’রছো? বা বা বেশ! তা তুমি কি গান করো?
--- না না। আপনার সঙ্গে সমানে সমানে কি আর গাইতে পারি। আমি
অন্যের গলা নকল ক’রে তাদের বলা নানা
ডায়লগ মঞ্চে ব’লি। আমি আপনার
গলাও নকল ক’রতে পারি। ক’রে দেখাবো?
ব’লেই অনুমতি তিনি
দিন না দিন, কান্তি ব’লতে শুরু করে, ‘আজ এখানে এসে আমি নিজেকে খুব ধন্য মনে ক’রছি। আপনাদের শুভেচ্ছায় আমি আজ গানের জগতে এই এ্যাতো বড়ো
আসন পেয়েছি।’ আরো কিছু ব’লতো কান্তি কিন্তু ভদ্রলোকটি ওকে থামিয়ে দিয়ে মুচকি মুচকি
হেসে ব’ললেন,
--- তুমি মিমিক্রি করো? তোমার তো সাহস কম নয়। এর জোরেই তুমি
ব’লছো, তুমি আর আমি এক মঞ্চে অনুষ্ঠান ক’রছি! অনুষ্ঠান কাকে বলে, জানো? এভাবে টিয়াপাখি’র মতো অন্যের গলায় কথা ব’লে অনুষ্ঠান করা যায় না। নিজের গলায় কাজ করো। নিজের মতো ক’রে গান করো বা
কবিতা বলো। মিমিক্রি ক’রে নয়। এটা কি আদৌ
কোন শিল্প নাকি?
ঠাস্ ক’রে যেন কান্তি’র গালে একটা চড় পরে যখন ও দ্যাখে যে ওঁর কথায় আর যাঁরা
সেখানে ব’সেছিলেন, তারাও হেসে উঠলেন। লজ্জায়
মাথাটা নিচু হয়ে যায় কান্তি’র। মনে হয়, তাহলে
এ্যাতোদিন যে ও জানতো যে, ও একজন শিল্পী, সে সব বাজে কথা? এই অন্যের গলা নকল করাকে
কী যেন একটা ইংরেজি নাম ব’ললেন লোকটা? মনে প’ড়ছিল না। এই অনুষ্ঠানে শেষ কয়েকটা শিল্পীকে কোনরকমে মঞ্চে
তুলে দিয়ে খুব যেমন তেমন ক’রে প্রোগ্রামটা
চালিয়ে যেন পালিয়ে এসেছিলো কান্তি। বন্ধু’র বাড়ি থেকে পূর্ণিমা’কে তুলে নিয়ে সোজা
এই কৃষ্ণনগর থেকে যেন পালাতে চাইছিলো ও। বার বার কানে এসে বাজছিলো, ‘তোমার তো সাহস কম নয়। এর জোরেই তুমি ব’লছো, তুমি আর আমি এক মঞ্চে অনুষ্ঠান ক’রছি! অনুষ্ঠান কাকে বলে, জানো? এভাবে টিয়াপাখি’র মতো অন্যের গলায় কথা ব’লে অনুষ্ঠান করা যায় না। নিজের গলায় কাজ করো।’
এইসব আবোল-তাবোল ভাবছিলো আর বাসে ব’সে ঝিমোচ্ছিলো কান্তি। হঠাৎ একটা প্রচণ্ড ধাক্কা লাগে ওর
শরীরে। এক ধাক্কায় সীট থেকে প’ড়ে যায় নীচে। কেউ
দেখছে কিনা--- তাকিয়ে দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করে যে ওর মাথা থেকে দরদর ক’রে রক্ত ঝরছে। চোখ তুলে তাকিয়ে এবারে যা দেখলো কান্তি, তাতে
ওর জ্ঞান হারাবার মতো অবস্থা হ’লো। ও শুধু নয়,
বাসের প্রায় সকলেই উল্টে পড়েছে এখানে ওখানে। সকলেই আহত। সকলেই চীৎকার ক’রছিলো যন্ত্রণায়। তাহলে কি এ্যাক্সিডেন্ট? বাসটা
এ্যাক্সিডেন্ট ক’রেছে? তাহ’লে পূর্ণিমা’র কী অবস্থা?
পূর্ণিমা শুধু নয়, পাপ্পু? সে-ও তো মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ওদের কী হ’লো? তাকিয়ে মাথা ঘুরে যাবার যোগার হ’ল কান্তি’র। পূর্ণিমা সীটে
বসা অবস্থাতেই আছে। শুধু ওর জ্ঞান নেই। কপাল বেয়ে রক্তের ধারা নেমেছে আর পাপ্পু’র গলায় একটা জানলা ভাঙ্গা কাচ ঢুকে গেছে। সে-ও রক্তাক্ত। পাগলের
মতো উঠে দাঁড়াতে গিয়ে মাথা ঘুরে প’ড়ে যায় কান্তি।
কান্তি’র জ্ঞান ফেরে
হাসপাতালে। মাথায় মোটা ব্যান্ডেজ। ডাক্তার ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন যে, পূর্ণিমা
সুস্থ আছে। কান্তি ওর ছেলে পাপ্পু’র কথা জিজ্ঞেস ক’রতেই জানতে পারে যে, পাপ্পু’কে বাঁচানো যায়নি। ও বাসেই মারা গিয়েছে। সামনে থেকে একটা লরি এসে ওদের বাসটাতে
সরাসরি ধাক্কা মেরেছিলো। ড্রাইভার দু-জন ওখানেই মারা গেছে। ও জেনেছে যে, পূর্ণিমা
এই হাসপাতালেই আছে। একবার পূর্ণিমা’কে চোখের দেখা
দেখে দুঃখ শোক সব থাকতেও কান্তি’কে একা হাতে
পাপ্পু’র অন্ত্যেষ্টি ক’রতে হ’য়েছে। পাপ্পু’কে নিয়ে নদীর পাড়ে মাটি চাপা দিতে হ’য়েছে। এ্যাতোটুকু শিশুকে দাহ করা যায় না। নিয়ম নেই। কিন্তু
পূর্ণিমা’কে নিয়ে আরো বড়ো সমস্যা হ’য়েছে কান্তি’র। প্রথমত
পূর্ণিমা’কে পাপ্পু’র অন্ত্যেষ্টিতে সাথে নেওয়া যায়নি। মা ব’লে কথা। সন্তানের মৃতদেহ মাটির তলায় প্রোথিত করা হ’চ্ছে--- এই দৃশ্য মা হ’য়ে সহ্য ক’রতে পারবে না
পূর্ণিমা। কিন্তু তাতে সমস্যাটা আরো বেড়ে গেছে কান্তি’র। ডাক্তার ব’লেছে,
--- আপনার স্ত্রী ছেলে’র মৃতদেহ দেখার পরে জ্ঞান হারিয়েছে। আর ওর স্মৃতি ওইখানেই ঐ দৃশ্যেই রুদ্ধ হ’য়ে আছে। জ্ঞান ফেরার পরে তিনি ছেলের কথাও জানতে চাননি,
আপনার কথাও জানতে চাননি। কোনো অশ্রুপাতও করেননি, বা কোনো বেদনাও প্রকাশ করেননি।
একটু সাবধানে আপনার স্ত্রী’কে রক্ষা ক’রতে হবে। অন্তত ওকে প্রথমে কাঁদাবার একটা উপায় বের ক’রতে হবে। আপনার ছেলে’র মৃত্যু কিন্তু এখনও ওর মস্তিষ্কে স্থাপিত হয়নি। এটা যে কী ক’রে ক’রবেন, সেটা আমরা ব’লতে পারি না। তবে নিশ্চিত থাকতে পারেন, আপনার স্ত্রী কিন্তু
পাগল হ’য়ে যাননি।
কান্তি বুঝে নিয়েছে যে, পূর্ণিমা’র এই অস্বাভাবিকতা, নীরব মূক-বধির হ’য়ে যাওয়া এক ধরনের সাময়িক বিস্মৃতি। পাপ্পু’কে যে মাটি দেওয়া হ’য়েছে, সেই দৃশ্যটা হয়তো পূর্ণিমা দেখলে এমনটা হ’তো না। অন্য সকলের পরামর্শ মতো পূর্ণিমা’কে না দেখানোর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো ও। কিন্তু এ তো পূর্ণিমা’র ভালো ক’রতে গিয়ে মন্দ হ’য়ে গিয়েছে। কিন্তু কান্তি কিছুতে এটা বুঝে উঠতে পারেনি, কী
ক’রে পূর্ণিমা’র স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারবে ও। কী ক’রে পূর্ণিমা’কে বোঝাবে
যে,পাপ্পু আর নেই। এটা একটা দুর্ঘটনা। পূর্ণিমা’কে নিয়ে যথারীতি বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু দিনে দিনে একটা ভয় ওকে পেয়ে ব’সেছে, পূর্ণিমা সুস্থ হবে তো? এই যে সারাদিন একটা পাথরের
মূর্তি’র মতো ব’সে থাকে, নিজে থেকে চলাফেরা করে না, কথা বলে না, খাওয়া-দাওয়া করে না, ঘুমোয়
না--- এগুলো ক্রমে ওর মাথাটাকে পাগল ক’রে দেবে না তো? কান্তি’কে নিজে হাতে
পূর্ণিমা’র যাবতীয় কাজ ক’রে দিতে হয়। ওকে ব’লে দিলেও ও নিজে ক’রতে পারে না। এইসব
সমাধা ক’রে পাশের বাড়ি’র পল্টন’এর মা’কে ব’লে পূর্ণিমা’র দিকে নজর রাখতে ব’লে কাজে যায় কান্তি। পেট তো কোনো বিপদ শুনবে না। সারাদিন একটা মানসিক চাপ থাকে
ওর মাথায়। বাড়িতে কী হ’চ্ছে, পূর্ণিমা
কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেললো কিনা, এইসব নানা আবোল-তাবোল ভাবনা অতিষ্ঠ করে কান্তি’কে। বাড়ি ফিরে দ্যাখে, যেখানে পূর্ণিমা’কে ব’সিয়ে রেখে গিয়েছিলো,
সে সেখানেই ব’সে আছে। একটা
স্ট্যাচু যেন। হাসেও না, কাঁদেও না, নড়েও না, চরেও না। মাঝে মাঝে কান্তি’র মনে হয়, ওকে তো নিজে হাতে পাপ্পু’র যাবতীয় শেষ কাজ নিষ্ঠুরের মতো ক’রতে হ’য়েছে। কিন্তু ওর
নিজের তো জ্ঞান র’য়েছে। শোক-তাপ ওকে
কেন একেবারে ভেঙ্গে দেয়নি? তাহলে কি মায়ের বেদনা বাবা’র থেকে অধিক? পাপ্পু’র জন্যে কি বাবা হিসেবে ওর মনে কোনো আঘাত লাগেনি? তাহ’লে কি ও নিষ্ঠুর মানুষ? ওর নিজের হৃদয় কি পাথর দিয়ে গড়া? সন্তানের
মৃত্যু কি সেই হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করেনি? মা-ই কি একা সন্তানের বিরহে কাতর হ’য়ে থাকে? বাবা কি একেবারে ফালতু? তা না হ’লে ও নিজে সব কাজ ঠিক ঠিক ক’রে ক’রছে কী ক’রে? ও কেন পূর্ণিমা’র মতো পাথর হ’য়ে যায়নি? মাঝে মাঝে চীৎকার ক’রে ওর ব’লতে ইচ্ছে হয়, ‘পাপ্পু আমারও ছেলে। আমি ওকে ভালোবাসি। ওকে আমি সর্বক্ষণ মিস
ক’রি। আমি কাঁদি, আমারও বুকে পাপ্পু’র জন্যে যন্ত্রণা হয়...’। কিন্তু কিছুই ব’লতে পারে না
কান্তি। পূর্ণিমা’র করুন অবস্থা ওকে
কেমন যেন আরো শক্ত ক’রে দিয়েছিলো। পাপ্পু’কে যে আর ফেরানো যাবে না, এটা কান্তি’র কাছে স্পষ্ট হ’য়ে গিয়েছিলো? তাই পূর্ণিমা’কে কী ক’রে এই অবস্থা থেকে সুস্থ করা যায়, এই নিয়েই একটা ভয়ঙ্কর
উচাটন ছিল কান্তি’র। মাঝে মাঝে
ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় পূর্ণিমা’কে। ডাক্তারকে
বলে,
--- আমার স্ত্রী পাগল-টাগোল হ’য়ে যাবে না তো, ডাক্তার বাবু? আমি যে কিছুতেই কিছু ক’রতে পারছি না। কত কথা ব’লি ওর সাথে! কিন্তু ও তো যে পাথর, সে-ই পাথর।
ডাক্তার বলেন--- পাগল ঠিক হ’য়ে যাবার কথা নয় বটে। কিন্তু এই অবস্থা বেশিদিন চলা ঠিক নয়। যে কোনো মানসিক
বিকৃতি ঘ’টতে পারে। এটা তো সুস্থ অবস্থা নয়। ধরুন
আপনিই যদি দীর্ঘ একটা বছর একেবারে কথাবার্তা না বলেন, আপনিই তো একটা এ্যাবনর্মাল
সাবজেক্ট হ’য়ে উঠবেন একদিন। আন-ন্যাচারাল অবস্থা
বেশীদিন চ’ললেই আন-ন্যাচারিলিটি দেখা দেবে।
--- তাহলে?
--- আপনি এক কাজ করুন। আপনার স্ত্রী’র কাছে আপনার ছেলে’র সম্বন্ধে নানা কথা বলুন। এমনকি ও যে আর নেই, তা-ও বলুন। দেখুন, কী হয়। একটা
ভালোমন্দ কিছু তো হওয়াতে হবে। হয় ইস্পার, নয় উস্পার। এভাবে থাকাটাকে আমি অন্তত
ভালো মনে ক’রছি না। ওকে কাঁদতে হবে। জানতে হবে যে,
ওর সন্তান আর বেঁচে নেই। তাকে আর পাওয়া যাবে না।
কান্তি ডাক্তার’কে জানায়--- আমি সব সময় সেই চেষ্টাই ক’রি, ডাক্তার বাবু। নানাভাবে ওকে বোঝাতে চাই এই কথাটা। কিন্তু ও যেন কানে শুনতে
পায় না, চোখে দেখতে পায় না। ফ্যাল ফ্যাল ক’রে শুধু চেয়ে থাকে। চোখের দৃষ্টিও ভালো নয়, মানে স্বাভাবিক নয়। কেমন ঘোলাটে!
--- ওইটাই তো ডেঞ্জার। আপনি কোনো চেষ্টা ছাড়বেন না। আসলে
মাঝে মাঝে আমরা এমন সাধারণ ঘটনা থেকে, অভিজ্ঞতা থেকে বা সত্যি থেকে মানুষকে সরিয়ে
রাখি যে, তাদের এই সম্বন্ধে কোনো ধারনাই হয় না। মানুষ বড়ো হয় কিন্তু ওদের না-জানা
অনেককিছু থেকে যায়। কখনও যদি এমন ঘটনার মুখে পড়ে, তবে সইতে পারে না। বাড়ি’র ছোটদের আবেগপ্রবণ ভেবে বড়োরা তাদেরকে কঠিন বাস্তব থেকে
বাঁচিয়ে রাখতে চায়। তাতেই নানা সমস্যা পরবর্তীকালে দেখা দেয়। জন্ম, মৃত্যু,
দুর্ঘটনা ইত্যাদি মানুষকে বয়সের সাথে সাথে দেখাতে হবে, বোঝাতে হবে, শেখাতে হবে। তা
নয়তো তারা তো অজ্ঞান থেকে যাবে। কোনো অনিবার্য শক-ও নিতে পারবে না। আপনার স্ত্রী’র সেই দশা হ’য়েছে। আপনি,
কান্তিবাবু চেষ্টা চালিয়ে যান। একদিন না একদিন একটা কিছু ঘ’টে যাবে। আর সেটা ভালো ফল দেবে।
কান্তি’র মনে হয়, তাহ’লে কি ডাক্তার এই ইঙ্গিত দিলো যে, পূর্ণিমা পাগল-টাগোল হ’য়ে যাবে? ছেলেকে হারিয়েছে কান্তি। কিন্তু এখন যদি পূর্ণিমা’কে হারাতে হয়, তবে তো এই সংসারে ও একা হ’য়ে যাবে। কিছু একটা ক’রতে হবে। কিন্তু
কী ‘কিছু একটা’? কান্তি’র তো অন্য কোনো
জ্ঞান-গম্যি নেই যে, তাই দিয়ে পূর্ণিমা’কে একটা ধাক্কা দেবে। আর সেই ধাক্কায় পূর্ণিমা বাস্তবের মাটিতে ফিরে আসবে।
ডাক্তার তো ব’লেই খালাস।
সেদিন সন্ধেবেলা। বাড়িতে ছিল পূর্ণিমা। কাজ থেকে ফিরছিল
কান্তি। আজকাল আর কোনো ফাংশানে যায় না ও। অবশ্য যাবার কোনো সময়ও ওর থাকে না। কোন
রকমে সংসার যাত্রা চালায়। মাঝে মাঝেই যেটা হয়, সেই কৃষ্ণনগরের কথাগুলো ওর বুকের
মধ্যে একটা জঙ্গল সাফ করা খুপরি দিয়ে যেন খুঁচিয়ে
খুঁচিয়ে দেয়। ওকে রক্তাক্ত করে। ঐ একটাই তো গুন ছিল ওর। কিন্তু সেটাও নাকি কোনো
গুন নয়, ও নাকি আদৌ কোনো শিল্পীই নয়। তাহ’লে ওর আর রইলো কী? সেদিনও কৃষ্ণনগরের সেই জ্বালাময় কথাগুলো ভাবছিলো কান্তি। ওর
প্রিয় সঙ্গীত শিল্পী’র বলা নিষ্ঠুর
কিন্তু সত্যি কতগুলো কথা, ‘এভাবে টিয়াপাখি’র মতো অন্যের গলায় কথা ব’লে অনুষ্ঠান করা যায় না। নিজের গলায় কাজ করো।’ হঠাৎই একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতো একটা ভাবনা ওর মাথায় এসে যায়। বোধহয় এই একটা
চালে পূর্ণিমা’কে কাঁদিয়ে দিতে
পারবে। ডাক্তারবাবু তো ব’লেছে যে, পূর্ণিমা’কে কাদাতে হবে। পাপ্পু যে নেই, এটা বুঝিয়ে দিতে হবে। আজ শেষ
চেষ্টা ক’রবে কান্তি। এটাই ওর শেষ, আর একমাত্র
চেষ্টা। এর বেশী কিছু করার সাধ্য তো ওর নেই।
সন্ধেবেলা। পূর্ণিমা একা ব’সে ছিল বারান্দাটায়। নিথর, নিশ্চল, পাথরের মূর্তি যেন। হঠাৎই পূর্ণিমা’র কানে আসে, ঘরের ভেতর থেকে পাপ্পু যেন ভয় পেয়ে ব’লে উঠছে, ‘মা, তুমি কোথায়?
আমার একা অন্ধকারে ভয় ক’রছে। আলো জ্বালাবে
না?’ একবার, দুবার, তিনবার। পূর্ণিমা সচকিত
হয়। হ্যাঁ, পাপ্পুই তো। পাপ্পুই তো ওকে ডাকছে। ওকে আলো জ্বালাতে ব’লছে। হ্যাঁ, সন্ধের অন্ধকার তো নেমে এসেছে। সত্যিই তো আলো
জ্বালানো হয়নি। পাপ্পু’র কণ্ঠ এ্যাতোদিন
পরে শুনে পূর্ণিমা পাগলের মতো ঘরে যায়। ঘরটা অন্ধকার। অন্ধকারে পাপ্পু’কে দেখতেই পায় না। আর্তস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে ও,
--- কোথায় তুই, বাবা? আমি যে তোকে দেখতে পাচ্ছি না। তুই
কোথায়, সোনা?
একেবারে পূর্ণিমা’র কাছে থেকে পাপ্পু ব’লে ওঠে--- এই তো
মা আমি। তোমার কাছেই তো আছি।
একেবারে স্বাভাবিক আচরণ করে পূর্ণিমা। দৌড়ে গিয়ে সুইচ টিপে
ঘরের আলো জ্বালায়। কিন্তু পাপ্পু’কে দেখতে পায় না।
বিছানাটার ওপরে ব’সে আছে কান্তি। ও
কখন যেন পূর্ণিমা’র অগোচরে চুপচাপ
ঘরে ঢুকে অন্ধকারে ব’সে আছে! একেবারে
স্বাভাবিক স্বরে পূর্ণিমা ব’লে ওঠে কান্তি’কে--- পাপ্পু কোথায়? ও যে আমাকে ডাকলো? আমাকে আলো জ্বালাতে
ব’ললো?
পূর্ণিমা’র হাতদুটো শক্ত ক’রে ধ’রে কান্তি এবারে ব’ললো--- পাপ্পু নেই, পূর্ণিমা। ও আমাদের ছেড়ে চ’লে গেছে। কৃষ্ণনগর থেকে ফেরার পথে বাসের মধ্যেই তোমার কোলে
ও মারা গেছে। তুমি মনে করো। সব মনে প’ড়বে তোমার।
--- তুমি মিথ্যে কথা ব’লছো। আমি নিজে পাপ্পু’র গলা শুনেছি।
এইমাত্র। এই তো এই ঘর থেকে। তুমি ওকে লুকিয়ে রেখেছো নিশ্চয়ই।
পূর্ণিমা’র চোখ-মুখ লাল হ’য়ে উঠেছে, উত্তেজনায় ওর গলার শিরা ফুলে উঠেছে। চিৎকার ক’রে কথা-কটা ব’লে যেন ও হাঁপাতে শুরু ক’রেছে। উত্তেজিত
কান্তি নিজেও। মনে মনে ঠিক ক’রে নেয় ও, আজ হয়
ইস্পার, নয় উস্পার। একটা কিছু হ’য়ে যাক। শরীরের
সমস্ত শক্তি এক ক’রে কান্তি
পূর্ণিমা’র গালে ঠাস্ ক’রে একটা চড় কষায়। আর পাগলের মতো চিৎকার ক’রে ব’লে ওঠে,
--- আমার কথা বিশ্বাস করো তুমি। আমিই পাপ্পু’র গলা ক’রে তোমায় ডেকেছি।
আমি স্টেজে স্টেজে এইভাবে বিখ্যাত মানুষের গলা নকল ক’রে মানুষকে আনন্দ দেই। আজকে পাপ্পু’র গলা নকল ক’রে তোমাকে
শুনিয়েছি। পাপ্পু নেই, পুনিমা। ওকে আমি নিজে হাতে মাটি চাপা দিয়ে এসেছি। আমার কথা
বিশ্বাস করো। মেনে নাও। পাপ্পু নেই, পূর্ণিমা। আমাদের পাপ্পু আমাদেরকে ছেড়ে চ’লে গেছে।
আর্তনাদ ক’রে ওঠে
পূর্ণিমা--- তুমি ওর বাবা। কেন তুমি ওকে বাঁচাতে পারলে না? কেন তুমি ওকে চ’লে যেতে দিলে? আমরা কেন পাপ্পু’কে হারালাম?
কান্তি পূর্ণিমা’র মুখটা নিজের বুকে চেপে ধরে। ডুকরে কেঁদে উঠে বলে--- আমাকে তুমি ক্ষমা ক’রে দাও, পূর্ণিমা। আমি তোমার পাপ্পু’কে বাঁচাতে পারিনি। আমাকে মাফ ক’রে দাও।
পূর্ণিমা স্বামী’র বুকের মধ্যে মুখ রেখে পাগলের মতো ছটফট ক’রতে ক’রতে এক সময় শান্ত হয়। ওর দেহটা শিথিল হ’য়ে যায়। রোরুদ্যমান কান্তি’র মুখে যেন একটা আনন্দের ঝলক খেলে যায় হঠাৎ। ভাবে, ছেলেজে নাই বা বাঁচাতে
পারুক, আজ অন্তত পরস্বর দিয়ে নিজের স্ত্রী-কে বাঁচাতে পেরেছে কান্তি। এবারে
পূর্ণিমা বাঁচবে।
------------------------