বৃহস্পতিবার, ২৪ মে, ২০১২

"পরস্বর" ছোটগল্প

পরস্বর
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়

কৃষ্ণনগর থেকে পূর্ণিমাকে নিয়ে সকাল সকাল বাসে চেপে বসেছে কান্তি। একেবারে গম্ভীর, চুপচাপ। নিঃশব্দ্‌ নীরব। সারা রাত জাগার পরে চুপচাপ থাকতে থাকতে বাসের একটানা গোঁ গোঁ শব্দ আর জানলা দিয়ে বয়ে আসা ফুরফুরে হাওয়ায় বেশ চোখটা লেগে আসছিলো ওর। পূর্ণিমা ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে আছে ওর ডান পাশে। জানলার গায়ে। ছেলেটা বায়না করলো বলে জানলাটা ছেড়ে দিতে হলো কান্তিকে। তা নয়তো জানলাটার দিকে ও বসলে মাথাটা বাসের জানলায় ঠেসান দিয়ে বেশ ভালো করে ঘুমোনো যেতো। ছেলেটা জানলায় বসবে, বাইরেটা দেখতে দেখতে যাবে, এ তো বাচ্চাদের জন্মগত অধিকার। বাচ্চার মা-ও কম যায় না। সে ও তো তেমন বাড়ির বাইরে যায় না। তাই তারও শখ জানলা। সে-ও ছেলের দোহাই পেড়ে জানলার দিকটাতেই বসেছে। তাই অগত্যা পূর্ণিমার গা ঘেঁষে হেলে গিয়ে ঘুমোতে ঘুমোতে চলেছে কান্তি।
একটু ঘুমিয়ে পড়তে পারলে ও এই যন্ত্রণাটার হাত থেকে অন্তত নিস্তার পেতো। সীটের বাইরের দিকটাতে বসার ফলে কান্তিকে একটু সাবধান থাকতে হচ্ছে। ঘুমিয়ে গেলে দুম করে পড়েও যেতে পারে। যে ঘুমটা আজ ওর দু-চোখ বেয়ে নেমে আসছে, এমনটা ঘুম আজ বহুদিন ওর পায় না। ঘুমোতে হবে, তাই রাতে ঘুমোতে যায়। ঘুম হয়ও। এমন নয় যে, সংসারের কোন সমস্যায় ওর দু-চোখের ঘুম চলে গেছে। তা নয়। কিন্তু দু-চোখ জড়িয়ে ঘুম পাবে, কোন রকমে বালিশ হাতড়াতে হাতড়াতে বিছানায় গিয়ে পড়া মাত্র ক্লান্ত চোখদুটো ধাঁ করে বুজে আসবে--- এমন একটা আরামের ঘুম কান্তির বহুদিন হয় না। ঘুম ওর পায় না। আজকে পাচ্ছে। এই বাসের জার্নিতে সেই বহুদিনের আশ মিটে যাচ্ছে। কিন্তু মনটা অস্থির। একটা উচাটন ওকে যেন তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না। তাই ঝট্‌কা মেরে ঘুমটা মাঝে মাঝে কেটেও যাচ্ছে।
কালকে কান্তির হোলনাইট প্রোগ্রাম ছিল। কৃষ্ণনগরে। এই প্রথম একটা হোলনাইট প্রোগ্রাম করলো কান্তি। তার ওপরে আবার সঞ্চালনার কাজ করলো ও। সঞ্চালনা তো ও করে না। করতে জানেও না। অবশ্য ও নিজে মঞ্চে যা করে, কালকেও তা-ই করতে হয়েছে বটে। সেই জন্যেই ওকে ডেকে নিয়ে যাওয়া। শুধু আয়োজকদের হঠাৎ বিপদে এই কাজটা করে দিতে হয়েছে ওকে। এই নতুন ধরনের কমিক করতে করতে মাঝে থামিয়ে দিয়ে পরবর্তী শিল্পীর নাম ওকে নিজেকেই এ্যানাউন্স করতে হয়েছে। ওরা একজন সঞ্চালককে বায়না করে রেখেছিলো। টাকা এ্যাডভান্স করেওছিল। কিন্তু লোকটা নাকি কী একটা কারণে সুইসাইড করে বসেছে। সকালবেলা খবর পেয়েছে ওরা। ফলে নতুন কাউকে ওরা আর পায়নি। এক ঢিলে দুই পাখি মারতেই এরা কান্তিকে দিয়ে কাজটা করিয়ে নিয়েছে।। আজকাল তো এ্যানাউন্স করা একটা বিশেষ শিল্প। নানা কায়দা জানতে হয় এক শিল্পী মঞ্চ থেকে প্রোগ্রাম করে নেমে গেলে আর এক শিল্পী আসা পর্যন্ত মঞ্চটাকে ধরে রাখতে। সুতো দিয়ে মালা গাথার মতো অনুষ্ঠান একটার পর একটা জুড়ে দিতে হয়। আজকাল এর সাথে বৈচিত্র্য যুক্ত হয়েছে হাস্যকৌতুক। এই হাস্য কৌতুকের জন্যে ডাকা হয় কান্তিকে।
কান্তি কিন্তু নির্ভেজাল হাস্যকৌতুক শিল্পী নয়। ওর একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। অন্যকে নকল করা। নকল করা যদি কোন ক্ষমতার মধ্যে পড়ে, তবে কান্তির সেই ক্ষমতা আছে। আর এইটাই আজ ওর পার্শ্ব-পেশা, ওর পার্শ্বজীবিকা। অনুষ্ঠান সঞ্চালকের সাথে বার বার মঞ্চে আবির্ভূত হয়ে তাকে সহায়তা করাই ওর জীবিকা। সঞ্চালক তার সুন্দর কণ্ঠে আর সুলোলিত বাচনভঙ্গিমায় পরবর্তী কোন শিল্পী মঞ্চে আসছেন, তা ঘোষণা করবেন। এই সঞ্চালকের সাথে কমেডি করে কান্তি। অপরকে নকল করার কমেডি।
ছোটবেলা থেকে বাবাকে, কাকাকে, মাস্টারমশাইকে, দুধওয়ালাকে, রাস্তা দিয়ে যাওয়া যে কোনো হকারকে হুবহু নকল করে কিছু মানুষের যেমন বিরাগভাজন হয়েছে ও, তেমনি অনেকে ওর এই নিখুঁত ক্ষমতাটাকে নিয়ে বিনোদন করেছে। পরে বাবা, কাকা ছেড়ে শুরু করেছে বাঙ্গলা, হিন্দি সিনেমার নানা নায়কের গলা নকল করা, রাজনৈতিক নেতাদের গলা নকল করা। বিয়ে বাড়িতে, বাসরঘরে, পিকনিকে, স্কুলের ফাউনডেশন সেরিমনিতে--- এমনি নানা জায়গায় অন্যকে শুধু কথায় নয়, তার চলায়-বলায় নকল করে সকলকে তাক লাগিয়ে দিতো কান্তি। আরো পরে শুধু গলা নকলই নয়, তাদের হাঁটা-চলা পর্যন্ত নকল করে পাড়ায় বেপাড়ায় বেশ নাম করে নেয় ও। নিখুঁত, নিভাঁজ এবং নির্ভেজাল নকল। সেটা যে ওর একদিন জীবিকা হয়ে উঠবে, সেটা কান্তি নিজেও ভাবেনি কোনদিন। হঠাৎ করে বাবা মারা যেতে কলেজে পড়তে পারেনি কান্তি। পরিবারের দায় কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে। দোকানে দোকানে কাজ করে সংসার চালিয়েছে। আজও কাজ করে একটা কাপড়ের পট্টিতে। যেহেতু সাধারণত কোনো ফাংশান হয় শনি বা রবিবার, সেহেতু পট্টি থেকে ছুটি পায় ও। ছুটি পায় মানে হাফ মাইনে কাটা যায়। যেহেতু কান্তি অত্যন্ত সৎ এবং বিশ্বাসী, মালিক ওকে ভরসা করে। মালিক জানে যে, একটা পয়সা এদিক থেকে ওদিক করবে না এই ছেলেটা। মালিক এও জানে যে, কান্তি এই কাপড়ের পট্টিতে যে মাইনে পায়, তাতে সংসার চালাতে পারে না। ওর মা অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ায় ওকে বিয়েও করতে হয়েছে। একজন পার্টনার ওর দরকার ছিল। ও কাজে বেরিয়ে গেলে অসুস্থ মাকে দেখবে কে! ফলে ওর দায়-দায়িত্ব বেড়েছে। তাই মালিক ওকে কিঞ্চিৎ রেয়াৎ করে।
আজ এ্যাতোদিন ওর বিয়ে হয়েছে, বউকে কোনোদিন কান্তি নিজের অনুষ্ঠান দেখাতে নিয়ে যেতে পারেনি। যাবে কীভাবে! বাড়িতে মাকে দেখবে কে! ওর ছেলেটা হবার সময়ও পূর্ণিমাকে তার বাপের বাড়িতে রাখা যায় নি। ওর শাশুড়ি পর্যন্ত এসে এ বাড়িতে ছিলেন। তা নয়তো তো পূর্ণিমাকে হাসপাতালেও পাঠাতে পারে না। উপার্জন তো করতে হবে কান্তিকে। বাড়িতে বসে মাকে পাহারা দিলে তো পেট ভরবে না। বিপদে পড়লে নিয়ম খাটে না। তাই ওর শাশুড়ি বিপদে আপদে এখানে এসে থাকতেন।
আজ কান্তির মা-ও আর বেঁচে নেই। পূর্ণিমা নিজে জানে যে, ওর বর কান্তি মঞ্চে হাস্যকৌতুক করে। হাস্যকৌতুক তো একটা আর্ট। একটা শিল্প। তাই স্ত্রী হিসেবে বেশ গর্ব ছিল পূর্ণিমার। নিজেদের আত্মীয়-পরিজনদেরকে বুঝিয়েছিলো যে, ওর স্বামী একজন আর্টিস্ট। মঞ্চে মঞ্চে অনুষ্ঠান করে শুধু নয়, তার জন্যে ও টাকাও নেয়। পেশাদারী। তাই শ্বশুরবাড়ি দিককার কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে হলে কান্তির জন্যে বিশেষ কয়েকটা নীল বা হলুদ রঙের যে শিল্পীসুলভ পাঞ্জাবি পূর্ণিমা করিয়ে রেখেছে, তা-ই পরিয়ে বরকে নিয়ে যায় পূর্ণিমা। শার্ট-প্যান্ট পরতে দেয় না। এতে পূর্ণিমার সম্মান বাড়ে। পূর্ণিমা দেখেছে যে, শিল্পীরা এরকম ঝকমকে রঙ্গিন পাঞ্জাবী পরে অনুষ্ঠান করতে যায়। সংসারে যে ছোটমোটো অভাব আছে, তাতে খুব একটা বিবাদ করে না ওর বৌ। সে তো অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। কান্তি ওকে বুঝিয়ে রেখেছে যে, শিল্পীদের অভাব থাকে।
নিজেকে শিল্পী বলে গর্ব যে কান্তি করে না, তা নয়। মঞ্চে ও উঠলে মানুষ ওকে চায়, ওর কথা শুনতে চায়, ওর ডায়লগ শুনতে চায়। তাহলে ও অন্য কোনো শিল্পী থেকে কম কীসে! আয়োজকরা ওকে পয়সা দেয় কেন? ওকে নিয়ে যায় কেন? নিশ্চয়ই ওর দাম আছে। কিন্তু কোনো না কোনো কারণে পূর্ণিমাকে ওর নিজের অনুষ্ঠান দেখাতে নিয়ে যেতে পারে নি কান্তি। সবই তো বাইরে বাইরে ফাংশান। যাবে কী করে! ওকে না হয় আয়োজকেরা আলাদা গাড়িতে নিয়ে যাবে। কিন্তু পূর্ণিমা? সে যাবে কীসে? নানা ঝামেলায় কোনো না কোনো ভাবে পূর্ণিমা দ্যাখেনি, স্বামী কী ধরনের শিল্পী। ভেবেছে, কী ধরন আর হবে! লোককে নানাভাবে হাসায়। যেমন বাংলা-হিন্দি সিনেমায় নানা আর্টিস্টরা হাসায়, তেমনই কোনোভাবে হাসায় নিশ্চয়ই। হাস্যকৌতুক কী, জানে পূর্ণিমা। তাই ও কোনদিন বায়নাও করেনি ফাংশান দেখার জন্যে। তাছারা আর একটা মুশকিল আছে পূর্ণিমার। ও জানে, ও নিজে ভালো শিক্ষিতা নয়। যদি সত্যি একদিন কান্তি ওকে নিয়ে যায় কোন অনুষ্ঠানে, তবে অন্য শিল্পীদের সাথে তো কথা বলতেই পারবে না ও। সেটা তো ওর স্বামীর পক্ষে খুবই অসম্মানের হবে। সকলে জেনে যাবে যে, কান্তি মণ্ডলের স্ত্রী অশিক্ষিতা। তাই শুধু আত্মীয় মহলেই ঝাঁঝ দেখিয়ে ঘোরে পূর্ণিমা। মঞ্চে গিয়ে স্বামীর ঝাঁঝ সে দ্যাখেনি।  
কান্তিদের পাড়ায় একটি ছেলে থাকে যে বিয়ে করেছে কৃষ্ণনগরে। সে-ই কান্তিকে এই অনুষ্ঠান দিয়েছে। সেই ছেলেটি শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে সে আবিষ্কার করেছে তার শ্বশুরবাড়ি পাড়ায় ফাংশানে সঞ্চালক আসছে না। অমনি ও কান্তির সাথে ফোনে কথা বলেছে। কান্তিকে এখানে হাস্যকৌতুকের জন্যে বলাই হতো না। ঐ পাড়ার ছেলেটি কান্তিকে একটা অনুষ্ঠান পাইয়ে দেবার জন্যে, আর শ্বশুরবাড়ি অঞ্চলের হয়ে একটা উপকার করে দেবার জন্যেই নিজে উদ্যোগ নিয়েছে। আর তখনই পূর্ণিমা জানিয়েছে,
--- তুমি যেমন সেই কৃষ্ণনগরেই যাচ্ছ, তখন আমাকে নিয়েই চলো না কেন। আমার তো সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবীর বিয়ে হয়েছে ওখানে। অনেকবার ও আমাকে বলছে যাবার জন্যে। এই সুযোগে তুমিও প্রোগ্রাম করে আসবে, আর আমিও বন্ধুর বাড়ীতে একটা দিন কাটিয়ে আসি।
--- কেন? আমি যে প্রোগ্রাম করতে যাচ্ছি, আমার প্রোগ্রাম দেখতেও কি ইচ্ছে করে না তোমার? কান্তি শুধোয় পূর্ণিমাকে।
--- না গো, এবারেও হবে না। এর পরে একদিন দেখলেই লবে। ফলে এবারেও কান্তির অনুষ্ঠান দেখা হয়নি পূর্ণিমার।


বাসে উঠে ইস্তক পূর্ণিমা দেখেছে যে, কান্তি কেমন যেন মনমরা মনমরা ভাব করে বসে আছে। গম্ভীর। একটাও কথা বলছে না। যেটুকু না  লে নয়, সেটুকু বলছে। অনেকবার জিজ্ঞেস করবে ভেবেও কোনো কিছু বলেনি পূর্ণিমা। ঠিক করেছে যা বলার, যা প্রশ্ন করার, তা বাড়ি গিয়েই করলে হবে। এই ভেবেই সে-ও ছেলের সাথে বাইরেটা দেখতে দেখতে চলেছে। বাইরেটা দেখতে দেখতে একবার ভেবেছে, তাহলে কি কান্তি কালকে রাতের প্রোগ্রামে পুরো টাকা পায়নি? মাঝে মাঝে এমনটা হয়। কান্তি আগেও বলেছে। ফাংশান কর্তাদের সাথে মাঝে মাঝে ঝগড়া করে টাকা আদায় করতেও হয়, শুনেছে। মনে মনে কয়েকবার অজানা অচেনা আয়োজকদের প্রতি শাপমন্যিও করেছে পূর্ণিমা।
কৃষ্ণনগরে এসে টাকা খুব খারাপ পায়নি কান্তি। এ্যাতো টাকা এর আগে কখনও একসাথে পায়নি। গোটা রাতটা জাগতে হয়েছে বটে। টাকায় পুষিয়ে গেছে ওর। কিন্তু মনটা ওর মোটে ভালো নেই। প্রোগ্রামটা পেয়ে পাড়ার ছেলেটাকে মনে মনে অনেকবার ধন্যবাদ জানিয়েছিলো কান্তি। সামনা সামনি দেখা হলে সরাসরি বলবে, ভেবেওছিলো। কিন্তু যেটা এখানে এসে ঘটেছে, সেটাকে সইতে পারেনি মন থেকে। মনে মনে প্রায় ঠিকই করে ফেলছিলো যে, আর এইসব অন্যের হাঁটা-চলা-হাত-পা নাড়া, তাকানো, নকল করে অন্যের গলায় সংলাপ বলার কাজ করবে না। সত্যিই তো, উনি তো ঠিকই বলেছেন। ও তো একটা বাড়িতে পোষা টিয়াপাখির মতো। টিয়াপাখি যদি রাতদিন মানুষের বলা কথা নকল করতে থাকে, তবে নিজের ডাকটাই তো একদিন ভুলে যায়। তাহলে তো সে আর টিয়াপাখি থাকে না। তার কোন নামই থাকে না। না মানুষ, না টিয়াপাখি। ওর ছেলে পাপ্পু হোক বা পূর্ণিমা--- একদিন তো ওর গলার স্বরটা যে কী, তা-ই ভুলে যাবে। তারাই ভুলে যাবে শুধু নয়, ও নিজেও তো নিজের গলায় কথা বলতে পারবে না একদিন। এ কী সর্বনাশ! না। আর এ কাজ করা যাবে না। তাতে হয়তো ওর বছরে যে একটা এক্সট্রা টাকা ইনকাম হয়, তা হবে না। তবু নিজের সত্তা ভুলে গিয়ে অন্যয়ে বেঁচে থাকতে পারবে না ও। ভাগ্যিস পূর্ণিমাকে কোনদিন ওর প্রোগ্রাম দেখাতে নিয়ে আসেনি। ভাগ্যিস পূর্ণিমা পুরো জানে না, ও কী করে স্টেজে।
কালকে মঞ্চে ঘোষণা করতে করতে গ্রীনরুমে এক ঝলক গিয়ে দ্যাখে যে, ওর প্রিয় গানের শিল্পী বসে আছেন। এই মানুষটার সাথেই এক স্টেজে যে ও কোনোদিন অনুষ্ঠান করতে পারবে, এমনটা স্বপ্নেও ভাবেনি। গর্বে বুকটা ফুলে উঠেছিলো। অগ্র-পশ্চাৎ ভুলে গিয়ে ওর সামনে গিয়ে ঢিপ্‌ করে একটা প্রনাম ঠুকে দিয়েছে। মানুষটা চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে বলে উঠেছেন,
--- কে তুমি, বাবা? আমি তো তোমাকে চিনি না।
--- আমাকে আপনি চেনেন না। আমি কান্তি। আজকে আমি আর আপনি একই স্টেজে যে অনুষ্ঠান করছি, এটা আমার বিরাট সৌভাগ্য। আমি আপনার গানের মস্ত ভক্ত। ছোটবেলা থেকে আপনার গান শুনে শুনে গুনগুন করেছি।
--- তাই? তুমি এখানে অনুষ্ঠান করছো? বা বা বেশ! তা তুমি কি গান করো?
--- না না। আপনার সঙ্গে সমানে সমানে কি আর গাইতে পারি। আমি অন্যের গলা নকল করে তাদের বলা নানা ডায়লগ মঞ্চে বলি। আমি আপনার গলাও নকল করতে পারি। করে দেখাবো?
লেই অনুমতি তিনি দিন না দিন, কান্তি বলতে শুরু করে, আজ এখানে এসে আমি নিজেকে খুব ধন্য মনে করছি। আপনাদের শুভেচ্ছায় আমি আজ গানের জগতে এই এ্যাতো বড়ো আসন পেয়েছি। আরো কিছু বলতো কান্তি কিন্তু ভদ্রলোকটি ওকে থামিয়ে দিয়ে মুচকি মুচকি হেসে বললেন,
--- তুমি মিমিক্রি করো? তোমার তো সাহস কম নয়। এর জোরেই তুমি বলছো, তুমি আর আমি এক মঞ্চে অনুষ্ঠান করছি! অনুষ্ঠান কাকে বলে, জানো? এভাবে টিয়াপাখির মতো অন্যের গলায় কথা বলে অনুষ্ঠান করা যায় না। নিজের গলায় কাজ করো। নিজের মতো করে গান  করো বা কবিতা বলো। মিমিক্রি করে নয়। এটা কি আদৌ কোন শিল্প নাকি?
ঠাস্‌ করে যেন কান্তির গালে একটা চড় পরে যখন ও দ্যাখে যে ওঁর কথায় আর যাঁরা সেখানে বসেছিলেন, তারাও হেসে উঠলেন। লজ্জায় মাথাটা নিচু হয়ে যায় কান্তির। মনে হয়, তাহলে এ্যাতোদিন যে ও জানতো যে, ও একজন শিল্পী, সে সব বাজে কথা? এই অন্যের গলা নকল করাকে কী যেন একটা ইংরেজি নাম বললেন লোকটা? মনে পড়ছিল না। এই অনুষ্ঠানে শেষ কয়েকটা শিল্পীকে কোনরকমে মঞ্চে তুলে দিয়ে খুব যেমন তেমন করে প্রোগ্রামটা চালিয়ে যেন পালিয়ে এসেছিলো কান্তি। বন্ধুর বাড়ি থেকে পূর্ণিমাকে তুলে নিয়ে সোজা এই কৃষ্ণনগর থেকে যেন পালাতে চাইছিলো ও। বার বার কানে এসে বাজছিলো, তোমার তো সাহস কম নয়। এর জোরেই তুমি বলছো, তুমি আর আমি এক মঞ্চে অনুষ্ঠান করছি! অনুষ্ঠান কাকে বলে, জানো? এভাবে টিয়াপাখির মতো অন্যের গলায় কথা বলে অনুষ্ঠান করা যায় না। নিজের গলায় কাজ করো।


এইসব আবোল-তাবোল ভাবছিলো আর বাসে বসে ঝিমোচ্ছিলো কান্তি। হঠাৎ একটা প্রচণ্ড ধাক্কা লাগে ওর শরীরে। এক ধাক্কায় সীট থেকে পড়ে যায় নীচে। কেউ দেখছে কিনা--- তাকিয়ে দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করে যে ওর মাথা থেকে দরদর করে রক্ত ঝরছে। চোখ তুলে তাকিয়ে এবারে যা দেখলো কান্তি, তাতে ওর জ্ঞান হারাবার মতো অবস্থা হলো। ও শুধু নয়, বাসের প্রায় সকলেই উল্টে পড়েছে এখানে ওখানে। সকলেই আহত। সকলেই চীৎকার করছিলো যন্ত্রণায়। তাহলে কি এ্যাক্সিডেন্‌ট? বাসটা এ্যাক্সিডেন্‌ট করেছে? তাহলে পূর্ণিমার কী অবস্থা? পূর্ণিমা শুধু নয়, পাপ্পু? সে-ও তো মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ওদের কী হলো? তাকিয়ে মাথা ঘুরে যাবার যোগার হল কান্তির। পূর্ণিমা সীটে বসা অবস্থাতেই আছে। শুধু ওর জ্ঞান নেই। কপাল বেয়ে রক্তের ধারা নেমেছে আর পাপ্পুর গলায় একটা জানলা ভাঙ্গা কাচ ঢুকে গেছে। সে-ও রক্তাক্ত। পাগলের মতো উঠে দাঁড়াতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যায় কান্তি।
কান্তির জ্ঞান ফেরে হাসপাতালে। মাথায় মোটা ব্যান্ডেজ। ডাক্তার ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন যে, পূর্ণিমা সুস্থ আছে। কান্তি ওর ছেলে পাপ্পুর কথা জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারে যে, পাপ্পুকে বাঁচানো যায়নি। ও বাসেই মারা গিয়েছে। সামনে থেকে একটা লরি এসে ওদের বাসটাতে সরাসরি ধাক্কা মেরেছিলো। ড্রাইভার দু-জন ওখানেই মারা গেছে। ও জেনেছে যে, পূর্ণিমা এই হাসপাতালেই আছে। একবার পূর্ণিমাকে চোখের দেখা দেখে দুঃখ শোক সব থাকতেও কান্তিকে একা হাতে পাপ্পুর অন্ত্যেষ্টি করতে হয়েছে। পাপ্পুকে নিয়ে নদীর পাড়ে মাটি চাপা দিতে হয়েছে। এ্যাতোটুকু শিশুকে দাহ করা যায় না। নিয়ম নেই। কিন্তু পূর্ণিমাকে নিয়ে আরো বড়ো সমস্যা হয়েছে কান্তির। প্রথমত পূর্ণিমাকে পাপ্পুর অন্ত্যেষ্টিতে সাথে নেওয়া যায়নি। মা বলে কথা। সন্তানের মৃতদেহ মাটির তলায় প্রোথিত করা হচ্ছে--- এই দৃশ্য মা হয়ে সহ্য করতে পারবে না পূর্ণিমা। কিন্তু তাতে সমস্যাটা আরো বেড়ে গেছে কান্তির। ডাক্তার বলেছে,
--- আপনার স্ত্রী ছেলের মৃতদেহ দেখার পরে জ্ঞান হারিয়েছে। আর ওর স্মৃতি ওইখানেই ঐ দৃশ্যেই রুদ্ধ হয়ে আছে। জ্ঞান ফেরার পরে তিনি ছেলের কথাও জানতে চাননি, আপনার কথাও জানতে চাননি। কোনো অশ্রুপাতও করেননি, বা কোনো বেদনাও প্রকাশ করেননি। একটু সাবধানে আপনার স্ত্রীকে রক্ষা করতে হবে। অন্তত ওকে প্রথমে কাঁদাবার একটা উপায় বের করতে হবে। আপনার ছেলের মৃত্যু কিন্তু এখনও ওর মস্তিষ্কে স্থাপিত হয়নি। এটা যে কী করে করবেন, সেটা আমরা বলতে পারি না। তবে নিশ্চিত থাকতে পারেন, আপনার স্ত্রী কিন্তু পাগল হয়ে যাননি।
কান্তি বুঝে নিয়েছে যে, পূর্ণিমার এই অস্বাভাবিকতা, নীরব মূক-বধির হয়ে যাওয়া এক ধরনের সাময়িক বিস্মৃতি। পাপ্পুকে যে মাটি দেওয়া হয়েছে, সেই দৃশ্যটা হয়তো পূর্ণিমা দেখলে এমনটা হতো না। অন্য সকলের পরামর্শ মতো পূর্ণিমাকে না দেখানোর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো ও। কিন্তু এ তো পূর্ণিমার ভালো করতে গিয়ে মন্দ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কান্তি কিছুতে এটা বুঝে উঠতে পারেনি, কী করে পূর্ণিমার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারবে ও। কী করে পূর্ণিমাকে বোঝাবে যে,পাপ্পু আর নেই। এটা একটা দুর্ঘটনা। পূর্ণিমাকে নিয়ে যথারীতি বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু দিনে দিনে একটা ভয় ওকে পেয়ে বসেছে, পূর্ণিমা সুস্থ হবে তো? এই যে সারাদিন একটা পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকে, নিজে থেকে চলাফেরা করে না, কথা বলে না, খাওয়া-দাওয়া করে না, ঘুমোয় না--- এগুলো ক্রমে ওর মাথাটাকে পাগল করে দেবে না তো? কান্তিকে নিজে হাতে পূর্ণিমার যাবতীয় কাজ করে দিতে হয়। ওকে বলে দিলেও ও নিজে করতে পারে না। এইসব সমাধা করে পাশের বাড়ির পল্টনএর মাকে বলে পূর্ণিমার দিকে নজর রাখতে বলে কাজে যায় কান্তি। পেট তো কোনো বিপদ শুনবে না। সারাদিন একটা মানসিক চাপ থাকে ওর মাথায়। বাড়িতে কী হচ্ছে, পূর্ণিমা কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেললো কিনা, এইসব নানা আবোল-তাবোল ভাবনা অতিষ্ঠ করে কান্তিকে। বাড়ি ফিরে দ্যাখে, যেখানে পূর্ণিমাকে বসিয়ে রেখে গিয়েছিলো, সে সেখানেই বসে আছে। একটা স্ট্যাচু যেন। হাসেও না, কাঁদেও না, নড়েও না, চরেও না। মাঝে মাঝে কান্তির মনে হয়, ওকে তো নিজে হাতে পাপ্পুর যাবতীয় শেষ কাজ নিষ্ঠুরের মতো করতে হয়েছে। কিন্তু ওর নিজের তো জ্ঞান রয়েছে। শোক-তাপ ওকে কেন একেবারে ভেঙ্গে দেয়নি? তাহলে কি মায়ের বেদনা বাবার থেকে অধিক? পাপ্পুর জন্যে কি বাবা হিসেবে ওর মনে কোনো আঘাত লাগেনি? তাহলে কি ও নিষ্ঠুর মানুষ? ওর নিজের হৃদয় কি পাথর দিয়ে গড়া? সন্তানের মৃত্যু কি সেই হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করেনি? মা-ই কি একা সন্তানের বিরহে কাতর হয়ে থাকে? বাবা কি একেবারে ফালতু? তা না হলে ও নিজে সব কাজ ঠিক ঠিক করে করছে কী করে? ও কেন পূর্ণিমার মতো পাথর হয়ে যায়নি? মাঝে মাঝে চীৎকার করে ওর বলতে ইচ্ছে হয়, পাপ্পু আমারও ছেলে। আমি ওকে ভালোবাসি। ওকে আমি সর্বক্ষণ মিস করি। আমি কাঁদি, আমারও বুকে পাপ্পুর জন্যে যন্ত্রণা হয়...। কিন্তু কিছুই বলতে পারে না কান্তি। পূর্ণিমার করুন অবস্থা ওকে কেমন যেন আরো শক্ত করে দিয়েছিলো। পাপ্পুকে যে আর ফেরানো যাবে না, এটা কান্তির কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলো? তাই পূর্ণিমাকে কী করে এই অবস্থা থেকে সুস্থ করা যায়, এই নিয়েই একটা ভয়ঙ্কর উচাটন ছিল কান্তির। মাঝে মাঝে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় পূর্ণিমাকে। ডাক্তারকে বলে,
--- আমার স্ত্রী পাগল-টাগোল হয়ে যাবে না তো, ডাক্তার বাবু? আমি যে কিছুতেই কিছু করতে পারছি না। কত কথা বলি ওর সাথে! কিন্তু ও তো যে পাথর, সে-ই পাথর।
ডাক্তার বলেন--- পাগল ঠিক হয়ে যাবার কথা নয় বটে। কিন্তু এই অবস্থা বেশিদিন চলা ঠিক নয়। যে কোনো মানসিক বিকৃতি ঘটতে পারে। এটা তো সুস্থ অবস্থা নয়। ধরুন আপনিই যদি দীর্ঘ একটা বছর একেবারে কথাবার্তা না বলেন, আপনিই তো একটা এ্যাবনর্মাল সাবজেক্ট হয়ে উঠবেন একদিন। আন-ন্যাচারাল অবস্থা বেশীদিন চললেই আন-ন্যাচারিলিটি দেখা দেবে।
--- তাহলে?
--- আপনি এক কাজ করুন। আপনার স্ত্রীর কাছে আপনার ছেলের সম্বন্ধে নানা কথা বলুন। এমনকি ও যে আর নেই, তা-ও বলুন। দেখুন, কী হয়। একটা ভালোমন্দ কিছু তো হওয়াতে হবে। হয় ইস্পার, নয় উস্পার। এভাবে থাকাটাকে আমি অন্তত ভালো মনে করছি না। ওকে কাঁদতে হবে। জানতে হবে যে, ওর সন্তান আর বেঁচে নেই। তাকে আর পাওয়া যাবে না।
কান্তি ডাক্তারকে জানায়--- আমি সব সময় সেই চেষ্টাই করি, ডাক্তার বাবু। নানাভাবে ওকে বোঝাতে চাই এই কথাটা। কিন্তু ও যেন কানে শুনতে পায় না, চোখে দেখতে পায় না। ফ্যাল ফ্যাল করে শুধু চেয়ে থাকে। চোখের দৃষ্টিও ভালো নয়, মানে স্বাভাবিক নয়। কেমন ঘোলাটে!
--- ওইটাই তো ডেঞ্জার। আপনি কোনো চেষ্টা ছাড়বেন না। আসলে মাঝে মাঝে আমরা এমন সাধারণ ঘটনা থেকে, অভিজ্ঞতা থেকে বা সত্যি থেকে মানুষকে সরিয়ে রাখি যে, তাদের এই সম্বন্ধে কোনো ধারনাই হয় না। মানুষ বড়ো হয় কিন্তু ওদের না-জানা অনেককিছু থেকে যায়। কখনও যদি এমন ঘটনার মুখে পড়ে, তবে সইতে পারে না। বাড়ির ছোটদের আবেগপ্রবণ ভেবে বড়োরা তাদেরকে কঠিন বাস্তব থেকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। তাতেই নানা সমস্যা পরবর্তীকালে দেখা দেয়। জন্ম, মৃত্যু, দুর্ঘটনা ইত্যাদি মানুষকে বয়সের সাথে সাথে দেখাতে হবে, বোঝাতে হবে, শেখাতে হবে। তা নয়তো তারা তো অজ্ঞান থেকে যাবে। কোনো অনিবার্য শক-ও নিতে পারবে না। আপনার স্ত্রীর সেই দশা হয়েছে। আপনি, কান্তিবাবু চেষ্টা চালিয়ে যান। একদিন না একদিন একটা কিছু ঘটে যাবে। আর সেটা ভালো ফল দেবে।
কান্তির মনে হয়, তাহলে কি ডাক্তার এই ইঙ্গিত দিলো যে, পূর্ণিমা পাগল-টাগোল হয়ে যাবে? ছেলেকে হারিয়েছে কান্তি। কিন্তু এখন যদি  পূর্ণিমাকে হারাতে হয়, তবে তো এই সংসারে ও একা হয়ে যাবে। কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু কী কিছু একটা? কান্তির তো অন্য কোনো জ্ঞান-গম্যি নেই যে, তাই দিয়ে পূর্ণিমাকে একটা ধাক্কা দেবে। আর সেই ধাক্কায় পূর্ণিমা বাস্তবের মাটিতে ফিরে আসবে। ডাক্তার তো বলেই খালাস।
সেদিন সন্ধেবেলা। বাড়িতে ছিল পূর্ণিমা। কাজ থেকে ফিরছিল কান্তি। আজকাল আর কোনো ফাংশানে যায় না ও। অবশ্য যাবার কোনো সময়ও ওর থাকে না। কোন রকমে সংসার যাত্রা চালায়। মাঝে মাঝেই যেটা হয়, সেই কৃষ্ণনগরের কথাগুলো ওর বুকের মধ্যে একটা জঙ্গল  সাফ করা খুপরি দিয়ে যেন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেয়। ওকে রক্তাক্ত করে। ঐ একটাই তো গুন ছিল ওর। কিন্তু সেটাও নাকি কোনো গুন নয়, ও নাকি আদৌ কোনো শিল্পীই নয়। তাহলে ওর আর রইলো কী? সেদিনও কৃষ্ণনগরের সেই জ্বালাময় কথাগুলো ভাবছিলো কান্তি। ওর প্রিয় সঙ্গীত শিল্পীর বলা নিষ্ঠুর কিন্তু সত্যি কতগুলো কথা, এভাবে টিয়াপাখির মতো অন্যের গলায় কথা বলে অনুষ্ঠান করা যায় না। নিজের গলায় কাজ করো। হঠাৎই একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতো একটা ভাবনা ওর মাথায় এসে যায়। বোধহয় এই একটা চালে পূর্ণিমাকে কাঁদিয়ে দিতে পারবে। ডাক্তারবাবু তো বলেছে যে, পূর্ণিমাকে কাদাতে হবে। পাপ্পু যে নেই, এটা বুঝিয়ে দিতে হবে। আজ শেষ চেষ্টা করবে কান্তি। এটাই ওর শেষ, আর একমাত্র চেষ্টা। এর বেশী কিছু করার সাধ্য তো ওর নেই।


সন্ধেবেলা। পূর্ণিমা একা বসে ছিল বারান্দাটায়। নিথর, নিশ্চল, পাথরের মূর্তি যেন। হঠাৎই পূর্ণিমার কানে আসে, ঘরের ভেতর থেকে পাপ্পু যেন ভয় পেয়ে বলে উঠছে, মা, তুমি কোথায়? আমার একা অন্ধকারে ভয় করছে। আলো জ্বালাবে না? একবার, দুবার, তিনবার। পূর্ণিমা সচকিত হয়। হ্যাঁ, পাপ্পুই তো। পাপ্পুই তো ওকে ডাকছে। ওকে আলো জ্বালাতে বলছে। হ্যাঁ, সন্ধের অন্ধকার তো নেমে এসেছে। সত্যিই তো আলো জ্বালানো হয়নি। পাপ্পুর কণ্ঠ এ্যাতোদিন পরে শুনে পূর্ণিমা পাগলের মতো ঘরে যায়। ঘরটা অন্ধকার। অন্ধকারে পাপ্পুকে দেখতেই পায় না। আর্তস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে ও,
--- কোথায় তুই, বাবা? আমি যে তোকে দেখতে পাচ্ছি না। তুই কোথায়, সোনা?
একেবারে পূর্ণিমার কাছে থেকে পাপ্পু বলে ওঠে--- এই তো মা আমি। তোমার কাছেই তো আছি।
একেবারে স্বাভাবিক আচরণ করে পূর্ণিমা। দৌড়ে গিয়ে সুইচ টিপে ঘরের আলো জ্বালায়। কিন্তু পাপ্পুকে দেখতে পায় না। বিছানাটার ওপরে বসে আছে কান্তি। ও কখন যেন পূর্ণিমার অগোচরে চুপচাপ ঘরে ঢুকে অন্ধকারে বসে আছে! একেবারে স্বাভাবিক স্বরে পূর্ণিমা বলে ওঠে কান্তিকে--- পাপ্পু কোথায়? ও যে আমাকে ডাকলো? আমাকে আলো জ্বালাতে বললো?
পূর্ণিমার হাতদুটো শক্ত করে ধরে কান্তি এবারে বললো--- পাপ্পু নেই, পূর্ণিমা। ও আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। কৃষ্ণনগর থেকে ফেরার পথে বাসের মধ্যেই তোমার কোলে ও মারা গেছে। তুমি মনে করো। সব মনে পড়বে তোমার।
--- তুমি মিথ্যে কথা বলছো। আমি নিজে পাপ্পুর গলা শুনেছি। এইমাত্র। এই তো এই ঘর থেকে। তুমি ওকে লুকিয়ে রেখেছো নিশ্চয়ই।
পূর্ণিমার চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছে, উত্তেজনায় ওর গলার শিরা ফুলে উঠেছে। চিৎকার করে কথা-কটা বলে যেন ও হাঁপাতে শুরু করেছে। উত্তেজিত কান্তি নিজেও। মনে মনে ঠিক করে নেয় ও, আজ হয় ইস্পার, নয় উস্পার। একটা কিছু হয়ে যাক। শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে কান্তি পূর্ণিমার গালে ঠাস্‌ করে একটা চড় কষায়। আর পাগলের মতো চিৎকার করে বলে ওঠে,
--- আমার কথা বিশ্বাস করো তুমি। আমিই পাপ্পুর গলা করে তোমায় ডেকেছি। আমি স্টেজে স্টেজে এইভাবে বিখ্যাত মানুষের গলা নকল করে মানুষকে আনন্দ দেই। আজকে পাপ্পুর গলা নকল করে তোমাকে শুনিয়েছি। পাপ্পু নেই, পুনিমা। ওকে আমি নিজে হাতে মাটি চাপা দিয়ে এসেছি। আমার কথা বিশ্বাস করো। মেনে নাও। পাপ্পু নেই, পূর্ণিমা। আমাদের পাপ্পু আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছে।
আর্তনাদ করে ওঠে পূর্ণিমা--- তুমি ওর বাবা। কেন তুমি ওকে বাঁচাতে পারলে না? কেন তুমি ওকে চলে যেতে দিলে? আমরা কেন পাপ্পুকে হারালাম?
কান্তি পূর্ণিমার মুখটা নিজের বুকে চেপে ধরে। ডুকরে কেঁদে উঠে বলে--- আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও, পূর্ণিমা। আমি তোমার পাপ্পুকে বাঁচাতে পারিনি। আমাকে মাফ করে দাও।
পূর্ণিমা স্বামীর বুকের মধ্যে মুখ রেখে পাগলের মতো ছটফট করতে করতে এক সময় শান্ত হয়। ওর দেহটা শিথিল হয়ে যায়। রোরুদ্যমান কান্তির মুখে যেন একটা আনন্দের ঝলক খেলে যায় হঠাৎ। ভাবে, ছেলেজে নাই বা বাঁচাতে পারুক, আজ অন্তত পরস্বর দিয়ে নিজের স্ত্রী-কে বাঁচাতে পেরেছে কান্তি। এবারে পূর্ণিমা বাঁচবে।

------------------------