শুক্রবার, ১৩ জুলাই, ২০১২

'এক অদ্ভুত গল্প' ছোটগল্প


এক অদ্ভুত গল্প
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়


সকাল ৮টা, উকিলবাবুর বাড়ি
রমা        কী রে লক্ষ্মী, এই তোর আসার সময় হলো? আটটা বাজে!
লক্ষ্মী       আর বলো না গো, রমা দি। মেয়েটার ভীষণ জ্বর। একটু গুছিয়ে দিয়ে তবে তো আসবো।
রমা        কেন? তোর বর নেই বাড়িতে?
লক্ষ্মী       ও তো কাজে বেরিয়ে গেছে কোন সকালে! মেয়েটা তো আজকে আর উনুনের ধারে যেতে পারবে না। তাই একটু রেঁধে-টেধে দিয়ে এলাম। আমার তো ফিরতে ফিরতে সেই তিনটে চারটে।
রমা        একটা মোবাইল তো নিতে পারিস। একটা খবর দিয়ে দিতে হয় না?
লক্ষ্মী       রমা দি, তুমি মোট কটা বাড়িতে রান্না করো, বলো। চারটে? কত করে পাও এক-একটা বাড়িতে? কমসে কম হাজার টাকা, বারোশ টাকা? তাহলে তোমার মাসে কটা টাকা হলো? আর আমি কটা বাড়িতে বাসন মাজি, আর কতো করে পাই? এক একটা বাড়িতে চারশো। পাঁচটা বাড়ি আমার। আমি কি তোমার মতো মোবাইল কিনতে পারি? বাবুদের বাড়ি থেকে বউদিরা এসব বলে, বলুক। কিন্তু তুমি তো আমার মতোই পরের বাড়ি কাজ করে খাও। তুমি বলো না।
রমা        বাবা! আমি কি অতো ভেবে বলেছি নাকি? বৌদি ঘুম থেকে উঠে পড়লে তোকে পাঁচ কথা শোনাবে। তাই বললাম।
লক্ষ্মী       পাঁচ কথা শুনেই তো আমাদের জীবন। পরের এঁটো পাত কুড়োই, তাদের এঁটো পাত পরিষ্কার করি। ও কি আর আমাদের গায়ে মাখলে চলে, রমা দি!
রমা        নে নে, আর ডায়লগ ঝাড়িস না। কাজে হাত দে।...

সকাল সাড়ে দশটা, মাস্টার মশাইয়ের বাড়ি
বৌদি       কী রে, লক্ষ্মী? উকিলবাবুর বাড়িতে কি তোকে আমাদের থেকে বেশী মাইনে দেয় নাকি রে?
লক্ষ্মী       কেন গো, বৌদি? এমন বলছো কেন?
বৌদি       তা তুই যদি সেখানে বেলা তিন প্রহর কাটিয়ে আসিস, তবে ওরা তোকে পাঁচ বাড়ির মাইনেটা একা দিলেই তো পারে। আমাদের আর তোর জন্যে হা-পিত্যেস করে বসে থাকতে হয় না। এখানে তোর আসার কথা ন-টায়। আর তুই এলি সাড়ে দশটায়!
লক্ষ্মী       কী যে করবো, গো বৌদি! ইচ্ছে করে কি আর...
বৌদি       থাক থাক। আর একটা ছুতো খুঁজে বের করিস না। তোদেরকে আমি চিনি না! তোরা একটা আলাদা ক্লাশ। তোদেরকে যতই আদর যত্ন করি না কেন, তোরা বেইমান-ই থাকবি। নিজের টুকু ছাড়া তোরা আর কিছু বুঝিস না।
লক্ষ্মী       আমি আবার কবে বেইমানি করলাম গো?
বৌদি       ওরে, বেইমানি নানা ধরনের হয় রে। পুজোতে আমাকে শাড়ি দিয়ো না, বৌদি। আমাকে তোমরা যেমনটা বোঝো, তেমনই টাকাটা দিয়ে দাও। ছেলেমেয়ে দুটোকে তো জামা-জুতো দিতে পারি না...। তুই বেশ ভালো করেই জানিস, ক্যাশ টাকা দিলে যেমন তেমন করে দিতে পারবে না। তাতে তোর আখেরে লাভই হবে। এভাবে চালাকি করে কি জীবন চলে রে?...  

বেলা একটা, কাউন্সিলার সাহেবের বাড়ি
ডিঙ্গ্‌ ডং!
মাসিমা     কে রে? লক্ষ্মী বুঝি?
লক্ষ্মী       হ্যাঁ, মাসীমা। আমি লক্ষ্মী।
মাসীমা     (দরজা খোলে) ওঃ! একটু দু চোখের পাতা এক করতে দিবি না তুই! রোজ রোজ তোর এই বাহানা। তোর যদি দেরী হয়, তবে তরুদের বাড়িটা সেরেই আয় না, বাবা। সবে গালে পান দিয়ে একটু চোখ বুজেছি... ওমনি ডিঙ্গ্‌ ডং!
লক্ষ্মী       ওদের বাড়ি সেরে আসতে গেলে যে আমাকে সাত রাজ্য পেরিয়ে বাড়ি যেতে হবে, মাসীমা। একবার আপনাদের বাড়ি ডিঙ্গিয়ে ওদের বাড়ি, আবার আপনাদের বাড়ি। আমি ওদের বাড়িটা সেরে ঐ পথেই বাড়ি চলে যাই। সব কাজ সেরে এ্যাতোটা ঘুরতে পারি না।
মাসীমা     তাই বলে তুই রোজ আমার দুপুরে ভাত-ঘুমটার বারোটা বাজাবি! তাহলে আগে আগে আয়।
লক্ষ্মী       আগে এসে কী করবো! আপনি তো পুজোর কাজ না সারলে আমাকে কাজে হাত দিতে দেবেন না। আমাকে তো বসে থাকতে হবে।
মাসীমা     বড্ড মুখে মুখে কথা বলিস তো! একদিন দেবো দূর করে। মাস গেলে আর এই পাঁচশোটা টাকা পেতে হবে না। বাংলাদেশ থেকে অনেক বৌ আসে কাজের জন্যে। ওদের একটাকে রেখে দেবো।
লক্ষ্মী       রাখুন না, রাখুন। একদিন আপনার বাংলাদেশী বৌ ঘরে অন্য লোক ঢুকিয়ে আপনার মুখ বেঁধে রেখে সব সাফ্‌ করে নিয়ে যাবেখন। বুঝবেন। লক্ষ্মী আছে, তাই বুঝছেন না।...

বেলা দুটো, তরুদের বাড়ি
লক্ষ্মী       কাকিমা! তোমাকে বলেছি, যদি কাচাকুচি থাকে, তবে আগেরদিন আমাকে বলবে। আমি সেইভাবে কাজ গুছিয়ে আসবো। এই এ্যাতো বেলায় এই এক ডাঁই কাঁচা যায়! বাড়ি যাবো কখন আমি?
কাকিমা    সেটা কি আমি দেখবো? আমার বাড়ি, আমার ঘর, আমার কাজের লোক। কবে কাচবো, কবে কাচব না, এসব কি কাজের লোককে জিজ্ঞেস করে করবো?
কাকা       (চুপিচুপি) তোর কথা কেউ বুঝবে না রে। হ্যাঁরে, তোর ছেলেমেয়ে নাকি স্কুলে পড়ে?
লক্ষ্মী       হ্যাঁ, পড়ে।
কাকা       তা ওদের বাড়িতে পড়াবার কোনো মাস্টার রেখেছিস তুই?
লক্ষ্মী       মাস্টার! কোথা থেকে রাখবো, কাকা! খেতে পাই না, তো মাস্টারের টাকা যোগাবো কোত্থেকে?
কাকা       আমি যদি তোকে মাসে মাসে চারশো টাকা করে দিই?
লক্ষ্মী       আপনি? দেবেন? আমাকে?
কাকা       তবে তোকে আমার কথা শুনতে হবে।
লক্ষ্মী       বলেন।
কাকা       কাল তোর কাকিমা দক্ষিণেশ্বরে যাবে পুজো দিতে। আর তরু তো অফিসে যাবে। তুই এখানে চলে আসবি সকাল সকাল। আমি আর তুই... ঐ একটু...
লক্ষ্মী       ছিঃ কাকা। আমি আপনাকে কাকা বলি না! আর কাকিমা থাকতে আপনি...
কাকা       ও তুই বুঝবি না।
লক্ষ্মী       আমার বোঝার দরকার নেই। ছিঃ ছিঃ!
কাকা       তাহলে কিন্তু লবডঙ্কা।...

বেলা চারটে, লক্ষ্মীদের বাড়ি
পল্‌টু       দিদি, মা কখন আসবে রে? মা যে দেরী করছে। আমার যে খুব খিদে পেয়েছে রে?
দিদি        আজকে মা এলে খাস, ভাই। মা যে আজকে দেরী করে বেরিয়েছে রে। কাজ সেরে তবে তো আসবে।
পল্‌টু       আমাকে বারান্দার গেটটা খুলে দে না। আমি খেলতে যাই।
দিদি        আমার যে খুব জ্বর রে। আমাকে ফেলে যাবি? যদি আমি মরে যাই?
পল্‌টু       তাহলে আমি বারান্দাটায় যাই?
দিদি        যা। বারান্দায় গিয়ে খেল্‌। আমি ঘরে শুয়ে আছি। আমি তোর খেলা দেখতে পাবো। যা।
পল্‌টু       দিদি, দেখে যা। একটা কাণ্ড দেখে যা। আমাদের বাগানে একটা ছোট্ট পাখি বাসা করেছে। একটা বেড়াল ঐ গাছটার তলায় এসেছে বলে ছোট পাখিদুটো বেড়ালটাকে ঠুকরে দিচ্ছে। দেখে যা। 
দিদি        আমি জানি। আমাদের বেগুন গাছে ওটা টুনটুনি পাখির বাসা। ওদের ছানা হয়েছে। তাই বেড়ালটা ছানা খেতে না পারে বলে ওরা লড়াই করছে।
পল্‌টু       রাত্তিরবেলা আমি টুনটুনি পাখিটাকে ধরে আনবো, দিদি। পুষবো।
দিদি        তাহলে ওদের ছানার কি হবে? ওরা খেতে পাবে কী করে? মা না হলে ওদের খেতে দেবে কে, বল।  
পল্‌টু       তাহলে ওদেরও পুষবো।
দিদি        ওদের পোষা যায় না রে পাগল। ওরা মরে যাবে।
পল্‌টু       দিদি, ঐ যে মা আসছে। মা এসে খেতে দেবে। মা আসছে! মা আসছে!!...

বেলা সাড়ে চারটে, বাড়ির পথে লক্ষ্মী
একবার লক্ষ্মী ভাবে যে, আর কাজে যাবে না। এইভাবে রোজ যুদ্ধ করতে করতে কি কাজ করা যায়! এ্যাতো অপমান! পল্‌টুর বাবা অনেকবার ওকে আর কাজে যেতে বারন করেছে। কিন্তু মানুষটা এই রোদে জলে মাটি কুপিয়ে একা কি পারে এই গোটা সংসারটাকে টানতে! মাস গেলে তো অন্তত হাজার দুয়েক টাকা ও আনতে পারে। এই-ই বিরাট ভরসা। ছেলেমেয়েগুলোর বইটা, খাতাটা, পেন্সিলটা, পুজোতে জামা জুতো...। তাই কাজে ওকে যেতেই হয়। একটাই জ্বালা লক্ষ্মীর। ওর শরীরটা। আধপেটা খেয়েও যে কী করে এই গতরটা ওর থাকে, সেটাই ও বোঝে না। সারা গা-টা ঘিনঘিন করে লক্ষ্মীর। বাড়ি গিয়ে স্নান না করলে ওর শান্তি হবে না। রাস্তার কলে গা ধুয়ে তবে ঘরে গিয়ে খাবারে হাত দেবে। তরুদের বাড়ি থেকে আজ যে খাবারটা দিয়েছে, সেটাও লক্ষ্মী রাস্তায় ফেলে দিয়েছে। খাবারটা দেখলেই ঘেন্না করছিলো ওর। কিন্তু যেই বাড়ির সামনে গেছে, ছেলেকে দেখেছে মায়ের আসার আনন্দে লাফাতে, ওমনি লক্ষ্মী মনে মনে একবার আওড়ে নিয়েছে, কেউ আমাকে মূল্য দিক না দিক, তবু তোরা তো আমাকে দেখলে নেচে উঠিস আনন্দে। তোদের জন্যে আমি সব পারি রে, পল্‌টু। সব পারি। সব সইতে পারি।

------------------------------