মঙ্গলবার, ১০ জানুয়ারী, ২০১২

"না বলা বানী" ছোটগল্প


না বলা বানী
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়


বিরা বলেন, অনেক কথা নাকি বলতে হয় না। চোখের ভাষাই নাকি বলে দ্যায় মানুষ কী বলতে চায়। কিন্তু সব চোখের ভাষা কি তা পারে? সকলে কি সকলের কথা বুঝতে পারে? পারলে অতীন কেন আজ আড়ালে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে হঠাৎ তাঁর চোখ থেকে গড়িয়ে আসা জল মুছলো? নিজের চোখ নিজে যে মুছবে, তারও জো নেই। পুরুষ না! একটু যে দুঃখ করবে, তার তো উপায় নেই। পুরুষের নাকি চোখের জল ফেলা বারণ। কে নাকি এই বিশ্বাস মানুষের মনে গেঁথে দিয়ে গেছে। এমনকি রামায়ণে রামচন্দ্র সীতাদেবীকে হারিয়ে অশ্রুমোচন করেছিলেন বলে তাকে নানা নানা ভাষায় নিন্দামন্দ করা হয়েছিলো। এক কবি আবার বলেছেন, বীরশোক অশ্রু নহে, অসির ঝংকার...।
তাই গোপনে চোখ মুছেছে অতীন। আজ সরস্বতী পুজো। সকলে নানা নানাদিকে আনন্দ করছে, বেড়াতে বেরোচ্ছে, রেস্টুরেন্টে খাচ্ছে, ভিডিও দেখছে দল পাকিয়ে, এমনকি সিটি সেন্টার-এ গিয়ে আইনক্সে মুভি  দেখছে। কিন্তু অতীন একা সরে গেছে সকলের ছোঁয়াচ থেকে। ওর মনে হচ্ছে, ও যেন একটা আলাদা জাতি, আলাদা গোষ্ঠীর মানুষ। সকলের সাথে আজকে অন্তত ও বেমানান। অড। তাই সকলের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে পালিয়েছে পাড়ার পুজো প্যান্ডেল থেকে। কাউকে তো বলতেও পারছে না, ঘটনাটা কী। কেউ জানলেই বলবে, ভ্যাট্‌, এটা নিয়ে ভাবছিস! এতোই যদি কেত্‌রে যাস তো আগে বলিস নি কেন? শ্রীরাধাকে তোর মনের  কথাটা বলিসনি কেন? এসব কবিতা মেরে জীবন চলবে না, বস্‌। কিন্তু সবই কি সবাই বলতে পারে? সব কি বলতে হয়? ভাষা কি পড়ে নেওয়া যায় না? যায় তো... ও কেন পারলো না পড়তে?
কবিতা লেখে অতীন। ক্লাশ নাইন থেকে ও কবিতা লিখছে। আগে স্কুলের ম্যাগাজিনে, পাড়ার ওয়াল ম্যাগাজিনে, পরে এখানে ওখানে আঞ্চলিক নানা পত্র-পত্রিকায় কবিতা দিতে দিতে আজ একটু পরিচয় হয়েছে। আজ দু-একটা কবি সম্মেলিনীতে ডাক-টাক পড়ে। নতুন ও প্রাচীন কবিরা কবিতা শোনান। সেখান থেকে আহ্বান আসে অতীনের। তবে কবি বা সাহিত্যিকের পরিচয় মানে তো এই দূরদর্শনের যুগে হায় ভোলা মন! বিশেষ করে কবি। আজকের কবি কী যে লেখে! আগামাথা মানুষ নাকি বুঝতে গিয়ে ভিরমি খায়। তারা নাকি লেখে, গাছের ডালে কাক... আমি তো অবাক। ভগবান, তুমি নাকি চানাচুর...। এইসব। মাথা নেই, মুণ্ডু নেই। যা নয় তা। নিজেরাই লেখে, নিজেরাই পড়ে, কিন্তু নিজেরাও মানে বোঝে না। যে কবিতা যত দুর্‌বোদ্ধ, সে কবিতা ততই গভীর নাকি। ফলে অতীনের কবি হিসেবে লোকখ্যাতি ওদের কবি সমাজেই আবদ্ধ। মানুষকে নাকি ওদের কবিতা বুঝতে গেলে আলাদা করে গভীর পড়াশুনো করে তবে কবিতা পড়তে হবে। কিন্তু মানুষের সে সময় কোথায়!
কবিতা লেখা অতীনের পেশা নয়। এই দুর্‌মূল্যের বাজারে একটা সরকারী চাকরী ও ব্যবস্থা করে নিয়েছে। বাবা চলে গিয়ে এই জেদটা ওর মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিলো যে, একটা চাকরী পেতে হবে। কে একজন একদিন শুনিয়েছিলো, ওসব কবিতা-ফবিতা লিখে কি পেট চলবে? বাবার পেনশান ছিলো বলে বেঁচে আছো। মা যদি একবার চোখ বোজে, তবে তো খাওয়ায়-দাওয়ায় ঘণ্টা বেজে যাবে। মা আজ বিছানায়। বাবা চলে যাবার পর থেকেই মা বিছানা নিয়েছে। বিশেষ করে মার হাই সুগার। কী যে একটা অটুট বন্ধন ছিল ঐ বুড়োবুড়ির মধ্যে, কে জানে। প্রেমের মানে কী, তা কি বাবা বা মা বুঝতো? মনে তো হয় না। কিন্তু বাবা যাবার পর থেকে মা বিছানায়। বাবা তো অফিষ থেকে ফিরে অবধি বৈঠক খানায় বসে বসে তাস পেটাতেন। এটাই ছিল তাঁর বিনোদন। মা শুধু চা সাপ্লাই করে করে ক্লান্ত হতো। কোনো কোনোদিন মা রেগে গিয়ে চার কথা শুনিয়েও দিতো। মা রেগে গেলে গৌরকাকা, ভবতোষ কাকা বা বাবা নিজেও একে অপরকে চোখ টেপাটেপি করে মা-এর রাগ হয়েছে, এই ইঙ্গিত পরস্পরকে জানিয়ে খেলা ভঙ্গ করে দিতেন। যে যার বাড়ি চলে যেতেন। সেই বাবা চলে গেলে মা-ই সুগারে, বাতে, একটা হার্ট এ্যাটাকে একেবারে শয্যাশায়ী। সম্পূর্ণ মেডিকেশনে আছে মা। নার্স রাখতে হয়নি বটে। তবে দেখতে হয় অতীনকেই।
তাই মা মাঝে মাঝে অতীনকে তাগাদা দ্যায়--- আর কতদিন রে? এবার একটা বিয়ে কর। আমি অন্তত পুত্রবধূর সেবা পাই না পাই, তোকে তো হাত পুড়িয়ে খেতে হচ্ছে, দেখে যেতে হয় না। এই তো আমার অবস্থা। আজ সুস্থ, তো কাল বিছানায়। তুই তো রান্নাবান্না কিছুই পারিস না।
কিন্তু এই সম্বন্ধ দেখে একটার পর একটা মেয়ে রিফিউজ করতে করতে শেষে নিজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে একটাকেই পছন্দ করে নিয়ে জীবন সঙ্গিনী বানাবার ব্যবস্থা কোনোদিন মেনে নিতে পারেনি অতীন। ও লক্ষ্য করেছে, রাস্তাঘাটে এত সুন্দর সুন্দর মেয়ে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। কিন্তু তারা যেন বিয়ের সম্বন্ধ করবার সময় কোথায় হারিয়ে যায়! সম্বন্ধের পাত্রী মানে... সুশ্রী হোল তো সে এইসা মোটা, সুদেহী হলো তো কথা বলার কায়দা কেমন যেন বাচালের মতো ফটর ফটর করা... এইসব। এমন একটা পাত্রী পাওয়া যায় না, যে স্বর্গের অপ্সরা হবে না, কিন্তু তাকে দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। ফলে বিয়ে করা হয় না অতীনের। মায়ের আশঙ্কাকে নিবৃত্ত করতে তো তাড়াহুড়ো করে একটা কিছু তো ঘটিয়ে দেওয়া যায় না।
বয়সটা এভাবে বেড়ে চলেছিলো অতীনের। সময় তো বসে থাকে না। একটা অপেক্ষায় ছিল অতীন। কেউ নিশ্চয়ই ওর জন্যে তৈরী হয়ে বসে আছে। মানুষ যতই কবিতা লিখুক, মন থেকে জন্ম-মৃত্যু-বিয়ের প্রবাদটা মুছে দিতে সে পারে না। ওটা বিশ্বাসের সাথে লেগেই থাকে। তাই অপেক্ষা। হঠাৎ ওর অপেক্ষা যেন একটা সুফল দেখালো।
দু বছর আগের সরস্বতী পুজোর দিন। পাড়াতে যে ক্লাবটায় ছেলেরা পুজো করে, সেখানে অতীনকেই সাজসজ্জার কাজটা করে দিতে হয়। ফাইন আর্টের নানা দুর্‌বোধ্য আঁকিবুঁকি নকল করে আর কাগজের নানা মডেল বানিয়ে ছোটোদের সরস্বতী মণ্ডপ সেজে ওঠে ওর হাতে। সেবারও এক মনে মণ্ডপ সাজাচ্ছিলো অতীন। পুরোহিত মশাই এসে পড়ে-পড়ে। অন্যত্র একটু কাজের চাপেই আগেভাগে নিজের দায়িত্বটা সম্পন্ন করে উঠতে পারেনি অতীন। তখনও কাজ করছে। হঠাৎই একটা নারীকণ্ঠ।
--- বাঃ বেশ সুন্দর তো আপনাদের প্যান্ডেল! উনি কি ভাড়া করা শিল্পী?
চোখ বেঁকিয়ে তাকিয়ে দেখলো অতীন। একটা মেয়ে। বাসন্তী রঙ্গের শাড়িতে বেশ সরস্বতী সরস্বতী চেহারা। ফর্সা, ছিপছিপে।
পাশ থেকে পাড়ার নিমাই বললো--- না না। উনি তো আমাদের পাড়ার দাদা। অতীন দা। প্রত্যেকবার অতীনদাই আমাদের প্যান্ডেল সাজায়। আপনারা তো নতুন এসেছেন। তাই ওকে জানেন না।
মিঠুন যোগ করলো--- অতীন দা কিন্তু এ তল্লাটের নাম করা কবি, দিদি।
অতীন প্রসঙ্গটা চাপা দিতে একটু অভিভাবকত্ব দেখিয়ে বললো--- আমার আইডেন্টিটি না দিয়ে আর কয়েকটা সবুজ সেলোফেন পেপার হাতে দে। একটু বাকি আছে। এখুনি তোদের ঠাকুরমশাই এসে পড়বেন। আর এই সব সাজুগুজু বন্ধ রাখতে হবে।
হঠাৎই অতীনের নাকে এলো একটা চেনা গন্ধ। এক্সেলেন্‌ট আফটার শেভ। এটাকেই পারফিউম করে ও অনুষ্‌ঠান বাঃ আমন্ত্রণে ব্যবহার করে। কিন্তু এমনটা তো কেউ করে না! তাহলে এই গন্ধটা কার থেকে এলো? অতীন ঘাড় ঘোরাতেই লক্ষ্য করলো, ওর বাঁ-পাশে চারটে চাঁপাফুলের মতো আঙ্গুল কয়েকটা সেলোফেন পেপার এগিয়ে ধরেছে। আড়চোখে দেখে নিলো অতীন। অতীনের মনে হলো, এভাবে একটা অজানা অচেনা মেয়ে যেন একটু ইচ্ছে করেই ওর সাথে ঘনিষ্ঠতা করতে এগিয়ে এলো। তা নয়তো এভাবে আগ বাড়িয়ে কাজে হাত দেবার তো অন্য কোন অর্থ হতে পারে না। মনে মনে অতীন ভাবে, এরা কোন বাড়িতে এলো? এ অঞ্চলে তো কোন ফ্ল্যাটবাড়ি গড়ে ওঠেনি। তাহলে কি ভাড়া এলো? ভাড়া তো... কোন বাড়িতে? ওর মনের প্রশ্নের উত্তর যেন মেয়েটাই নিজে দিয়ে দিলো।
--- আমি শ্রীরাধা। আমরা অনুদের বাড়িতে নতুন ভাড়া এসেছি। এসেই দেখছি, বাড়ির গোড়াতেই সরস্বতী পুজো হচ্ছে। তাই চলে এলাম।
অতীন এতোটা আনস্মার্ট নয় যে, একটা মেয়ের সাথে ইন্টারাকশান করতে পারবে না। কিন্তু আজই প্রথম ওর ভাষা-টাশা কোথায় যেন হারিয়ে গেলো! শুধু কোনোরকমে একটু হেসে দিয়ে বলতে পারলো,
--- ওয়েলকাম।
সেদিন আর কোনো কথা হয় নি। কথা হয়নি, মানে অতীন কথা হারিয়ে ফেলেছিলো। কেন যে কথা হারিয়ে ফেলেছিলো, তা ও জানে না। মেয়েটা পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে। এক্সেলেন্‌টের গন্ধটা ঘাড়ের কাছে লেগেই রয়েছে। বাসন্তী রং-এর শাড়িটাও মাঝে মাঝে উড়ে শ্রীরাধার উপস্থিতি জানিয়ে দিচ্ছিলো। একটা অস্বস্তি, শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শিরশিরে অনুভূতি অতীনকে কেমন যেন নার্ভাস করে দিচ্ছিলো। আর কিছু বলতে হয় কিনা, ওর জানা নেই। একটা মেয়ের সাথে কীভাবে বিহেভ করতে হয়, কে জানে! তার চেয়ে সেফ্‌ হলো, কিছু না বলা। মেয়েটা কিছু বললে না হয় একটা দুটো উত্তর মেপে ঝুপে দেওয়া যাবে।
কোনো বছর প্যান্ডেলে অতীন তেমনভাবে থাকে না। কিন্তু এবছর একটা অজানা টানে প্যান্ডেলে ও কয়েকবার ঘুরে গেছে।। প্রত্যেকবার দেখতে চেয়েছে, যেন শ্রীরাধা আসে। কিন্তু পর পর তিনবার গিয়েও ওর দেখা পেলো না। আসেনি। সন্ধ্যেবেলা যখন ক্লাবের ছেলেগুলো জলসার অনুষ্ঠান করে, সে অনুষ্ঠানে তো মোটে আসেনা ও। হিন্দিগানের আসর জমায় ওরা। এসব একেবারে পছন্দ করে না অতীন। বিশেষ করে বীণাপাণির আরাধনায় স্প্যানিশ গিটার একেবারে বরদাস্ত করতে হয় না অতীনের। কিন্তু এবারে সন্ধেবেলা এলো প্যান্ডেলে। কিন্তু না। নো শ্রীরাধা। চলে যাবে যাবে করছিলো, হঠাৎ রিন্‌টু ওকে দেখতে পেয়ে বললো,
--- কী গো, অতীন দা, তুমি তো এইসব মিউজিক্যাল ফাংশান পছন্দ করো না! তুমি যে?
একবার মনে হোল অতীনের, রিন্‌টু কি ধরে ফেলেছে, কীসের টানে অতীন প্যান্ডেলে এসেছে? কিন্তু না। ওকে তো চুলমাত্র বুঝতে দেওয়া যাবে না। তাই একটা বিরাট এ্যাক্‌টিং করে বললো--- খুব খারাপ লাগছে না? এইসব বোগাস অনুষ্ঠান করবি, তার জন্যে চাঁদা নিবি, আর আমরা প্যান্ডেলে হানা দিলে তোদের হাঁপ উঠে যাবে, না? হচ্ছে সরস্বতীর আরাধনা, আর রাত হলেই শুরু হবে ইয়ো মার্কা মিউজিক!
শ্যামল হঠাৎ জানালো--- ঐ যে নতুন মেয়েটা? ও না দু-বার প্যান্ডেলে এসেছে। একবার তো অঞ্জলি দিয়েছে। তোমাকে খুঁজছিলো।
--- আমাকে? বেশ অবাক হয় অতীন। কথাটা বললো বটে কিন্তু কোথায় যেন একটা ভালো লাগা কাজ করে গেলো। একটা মেয়ে... একেবারে নতুন... তন্বী, সুন্দরী। ওকে খুঁজছে। এর মানে কী হতে পারে?
এইভাবে প্রেমে পড়ে যায় অতীন। শ্রীরাধার প্রেমে একেবারে হাবুডুবু খায়। বলা হয় না কিছুই। শুধু পথে ঘাটে দেখা হয়। একবার দু-বার চোখ তাকাতাকি, দেখিনি-দেখিনি ভাব করতে হয়, তারপর কথা,
--- একদিন আপনার কবিতা শুনবো। কবিতা আমিও লিখি। তবে সে বোধহয় ঠিক কবিতা নয়। কবিতার মতো।
--- তা কেন? লিখুন না। লিখতে লিখতেই তো একদিন লেখা আসবে। অতীন সান্ত্বনা দ্যায়।
--- না না। আমাদের কলেজের প্রফেসর বলতেন, অনুশীলন করে কর্মী হওয়া যায়, শিল্পী হওয়া যায় না। শিল্প জন্মের সাথে সাথে প্রাণের মধ্যে জন্ম নেয়, আপনা-আপনি। বর্ষাকালে দেখবে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত স্থানে নানা রকম ফার্ন গাছ গজিয়ে উঠেছে। কী তার রং! কী তার গড়ন! কিন্তু তুমি তোমার টবে একটা ফার্ন গাছ লাগাতে যাও তো দেখি, পারো কিনা। ও গাছ আপন মনে জন্ম নেয়, আপন মনেই মরে। শিল্প তেমনই। ওটা হওয়া যায় না। ওটা হয়েই জন্মায় মানুষ। তা শুধু চর্চায় ধারালো হয়ে ওঠে। এটা কি আপনি মানেন?
অতীন বুঝে উঠতে পারে না, কেমন প্রশ্নে কেমন উত্তর লাগসই হবে। তাই কোনো দায়িত্ব না নিয়ে বলে--- আসলে আমি তো থিয়োরিটিশিয়ান নই। আমি তো শুধু লিখি। কী লিখি, কে জানে। অতটা তত্ত্বজ্ঞান তো আমার নেই। ওটা অধ্যাপকদের বিষয়। হতে পারে।
পরের বছর ক্লাবের ছেলেগুলোকে চম্‌কে দিয়ে অতীন সরস্বতী পুজোর প্যান্ডেলে অনেকটা সময় দিয়ে প্যান্ডেলটাকে বেশ বর্ণময় করে দিয়েছিলো। অনেকটা সময় পরিশ্রম করে শুধু অপেক্ষা করেছে, কখন শ্রীরাধা প্যান্ডেল দেখতে আসবে। কিন্তু এলো না। পুজোর দিন। একটু ব্যর্থ মনোরথ হয়ে প্যান্ডেলে বৃথা আশা মরিতে মরিতেও মরে নালেই থুম্‌ মেরে বসেছিলো। এরা সব বাচ্চা-কাচ্চা। এদের কাছে তো বলা যায় নয়া, শ্রীরাধা আসেনি কেন রে? যা তো, গিয়ে দেখে আয় তো। বিল্‌টু তো সোজা এসে অতীনকে একবার বলেও দিলো,
--- তুমি কোথায় ছিলে, অতীন দা? ঐ যে নতুন মেয়েটা... শ্রীরাধা...? তোমার কথা জানতে চাইছিলো।
--- জানতে চাইছিলো মানে? আমি কি সাস্পিশাস মানুষ নাকি?
--- না না। তুমি প্যান্ডেলে এসেছো কিনা, খোঁজ নিচ্ছিলো। আমি তো বললাম, অতীন দা পুজো-টুজোতে তেমন আসে না।
কথাটা শুনে হেসে দিলো অতীন। মনে মনে ও নিশ্চিত হলো, শ্রীরাধার সাথে দেখা হলেই ও বলে বসবে, আপনি কি কমিউনিস্ট? পুজো-টুজো নাকি তেমন পছন্দ করেন না? কিন্তু এখন বিলটুকে একটা ধমক দিতে হবে। তাই বললো,
--- বাঃ! বেইমান। আমি আসি না? তাহলে মণ্ডপটা সাজায় কে রে? তোর ঠাকুরদা? তারপরই একেবারে ছোটদের মতো অতীন হঠাৎ বিল্‌টুকে ভেঙ্গিয়ে বলে--- তুই বলতে গেছিস কেন অতীন দা তেমন পুজো-টুজোতে আসে না? তুই কি আমার পি.. নাকি?
মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন--- শ্রীরাধা অতীনকে খুঁজেছিল কেন? সেটা কি এমনিই? টুক করে ওদের বাড়িতে গিয়ে কি একটা নাটক মতো করে প্রশ্ন করা সঙ্গত হবে, আপনি আমায় খুঁজছিলেন? নাকি ঐ খোঁজাটা নিছক একটা প্রশ্ন মাত্র? এর জন্যে পাড়ার কোন নবাগতার বাড়িতে ঠেলে গিয়ে জানতে চাওয়াটা কি বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়? অতীন তো আর বাচ্চা ছেলে নয়। দুম্‌ করে না ভেবে কোনো কাজ করাটা কি ভদ্রতা হবে? শ্রীরাধাও কি ওকে কিছু বলতে চায়? চাইলে কি ও যা চায়, তাই-ই বলতে চায়? একটু অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবে কাজ করার মতো বয়সও ওর নয়। পাড়াতে সে পোজিশনও নয় ওর। একজন চাকরীজীবীর একটু দাম তো পাড়াতে বাড়েই।
হঠাৎ শ্রীরাধা প্যান্ডেলে এলো। ও দেখতে পায়নি অতীনকে। অতীন দেখলো, ওর দু-চোখ লাল টক্‌টকে। মনে হয়, জ্বর-টর কিছু হয়েছে। নাকি কোনো অজ্ঞাত কারণে কান্নাকাটি-টাটি করেছে। কিন্তু একটা মেয়েকে দুড়ুম করে এসব বিষয়ে প্রশ্ন করাটা ভব্যতার মধ্যে পড়ে না চেপে গেলো অতীন। তা না হলে লোকে বলবে শিভালরির অভাব। শ্রীরাধা প্যান্ডেলে এসে যখন বিল্‌টুদের সাথে কী একটা কথা বলছিলো, অতীন টুক্‌ করে অন্তরালে সরে গেছে। দেখে নিতে চেয়েছে, শ্রীরাধা সত্যিই ওকে খুঁজছে কিনা। অন্তরাল থেকে পরিষ্কার দেখলো অতীন, বিল্‌টু নিজের হাত নেড়ে নেড়ে কী একটা দেখাচ্ছিলো মেয়েটাকে। মেয়েটা সেই সেই দিকে একবার করে গেলোও। তারপর হঠাৎ নিজের বাড়ির দিকে হাঁটা দিলো। অতীন স্পষ্ট অনুমান করে নিলো, তাহলে সত্যি সত্যি শ্রীরাধা ওকেই খুঁজছিলো না। ওটা ছিল একটা কথার কথা। কিন্তু যে কথাটা অতীন শ্রীরাধাকে বলবার জন্যে একটা মানসিক বল আনার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলো, সেটা আর বলা হোল না। নিজের মনেই ভাবলো, এতো ব্যস্ত কী? হবে।
কিন্তু যা বলা হয় না, তার জন্যে চিরকাল একটা আফশোষ যে থেকে যেতে পারে, তা হয়তো জানে না অতীন। শিভালরিটা যে বড়ো কথা নয়, মনের চলাচলটাই আসল--- এসব হয়তো ওকে কেউ শেখায়নি। কিন্তু সময় বসে থাকে না। সে তার আপন গতিতে চলতে চলতে নানা ঘটনার জন্ম দ্যায়। সেই ঘটনাগুলোকেই হয়তো মানুষ বলে ভবিতব্য, নিয়তি বা ভাগ্য। কিন্তু আসলে তা তো পরিণাম মাত্র। নিছক কর্মফল, যাকে কেউ ব্যাখ্যা করে বলে পূর্‌বজন্মকৃত ফল। সেই নিয়তি-ই ঠিক এর একদিন পরে অতীনকে মুম্বাই নিয়ে গেলো তিনমাসের একটা ট্রেনিং-এ। অফিসই পাঠালো। যাবার কথাটা আগেই ছিলো। বাড়িতে বিধবা অসুস্থা মায়ের দোহাই দিয়েও পার পেলো না অতীন। এই যাবার আগে একটা বোঝাপরা করতে চেয়েছিল শ্রীরাধার সাথে। হলো না। সুতরাং বাড়িতে রান্নার মহিলাটিকে রেখে প্রচুর দুশ্চিন্তা নিয়ে সে দেশান্তর হলো।
যেদিন ফিরলো, সেদিন অনুদের বাড়িতে সানাই বাজছে। বিরাট করে প্যান্ডেল হয়েছে। হতেই পারে। অনুর তো বিয়ে হয়ে যেতেই পারে। সে তো সময়ের গতিতে ছোট্ট মেয়েটি হয়ে থেমে নেই। নিঃশব্দে বড়োটি হয়ে গেছে। তাছাড়া সকলে তো আর তাদের ছাব্বিশ বা সাতাশ বছর বয়সে মেয়ে বিয়ে দেবে, এমনটা ভেবে বসে থাকে না।
বাড়িতে ঢুকতে যাবে, হঠাৎ পাড়ার টুব্লু ডেকে বসলো--- অতীন দা, তুমি নাকি মুম্বাই গেছিলে? শুনলাম।
--- আর বলিস না। অসুস্থ মাকে ফেলে চাকরী বাঁচাতে কাটিয়ে এলাম এক নব্বই দিন। জানি না, আমার বুড়ি কেমন আছে। ফোন করলে তো বলে, তুই ভাবিস না। রান্নার দিদি আছে। এরপরই একবার কনফার্ম করতে প্রশ্ন করে বসে--- হ্যাঁরে, অনুর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এর মধ্যেই?
অতীনকে পথে বসিয়ে দিয়ে টুব্লু জানালো--- অনুর বিয়ে! কে বললো? অনু নয়, অতীন দা। ও তো শ্রীরাধাদির বিয়ে।
--- শ্রীরাধা! কী বলছিস! তুই শিয়োর?
--- আমি শিয়োর তো বটেই। সকলেই শিয়োর। অনু তো দিব্যি ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিয়ে হলে কি ঘুরে বেড়াতো?
অতীনের গোটা শরীরটা নাড়া দিয়ে গেলো টুব্লুর এসব এলোমেলো কথাগুলো। তাহলে কি মানুষ যা বলে, সে সব সত্যিই বাস্তব কথা? মেয়েরা এমনটাই হয়? কুমারী বয়সে একে তাকে সোজাসুজি অথবা আকারে ইঙ্গিতে ঘায়েল করে, আর পরে একদিন বাবা-মার বাধ্য মেয়েটির মতো অনেক বেশী প্রতিষ্ঠিত অন্য একটা পুরুষের হাত ধরে বিয়ের পিড়িতে গিয়ে বসে? ওদের মন কি নিজের ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তার ঘেরাটোপেই ঢাকা? সেখানে অনুভূতি বলে কি কিছুই নেই? শ্রীরাধাকে দেখে তো এমনটা মনে হয়েছিলো না। যদি সে এমনটা না হয়ে থাকে, তবে অতীনেকে এভাবে পরোক্ষ টানে বাঁধলো ক্যানো? কথাটা মনে আসতেই আবার এটাও মনে এলো, না, ও তো তেমন কোন ইঙ্গিত অতীনকে সত্যিই দ্যায় নি। একটা মেয়ে কি একটা ছেলেকে একটু বেশী প্রেফারেন্স দিতে পারে না? তাকে তার কি একটু বেশী ভালো লাগতে পারে না? তার মানে সেটাকেই তো অতীনের প্রেম ধরে নেওয়াটা উচিত হয়নি। আজ নিজেকে বড়ো অপরাধী মনে হতে থাকে অতীনের। মনে মনে বেশ বোঝে যে, ও একটু বেশী মাত্রায় মেয়েটার সৌন্দরযে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলো। জীবনে প্রেমের পক্ষে এতোটা লেট আওয়ারসে এতোটা আপ্লুত হওয়াটাই ওর বোকামি হয়েছে। শ্রীরাধা ওর থেকে বেশ খানিকটা ছোটই হবে। একটা ছোট মেয়ে সম্বন্ধে...।
তবে ঘুরে ফিরে একটা কথা নিজেকে বোঝাতে বেশ সমর্থ হোল অতীন যে, মেয়েটা ওর দিকে ঝুঁকেছিলো। পলকের জন্যে হলেও এটা সত্যি। ওর চোখে সেই দৃষ্টি ছিল। অতীন ভুল দ্যাখেনি। ও তো আর মেয়েদের প্রতি ছোঁকছোঁকে নয়। বরং মেয়েদের ব্যাপারে বেশ একটা ছুতমার্গ ওর ছিলো। তবে আজ আর সে কথা ভেবে লাভ নেই--- এমন সান্ত্বনা নিজেকে দিয়ে শরীরের ক্লান্তি আর মনের এই ভারকে টেনে বেশ খানিকটা ঝুঁকে পড়ে বাড়িতে ঢুকতে যাবে, এমন সময় বিলটু সামনে আবির্ভূত।
--- অতীন দা, তুমি এতদিন পরে এলে!
--- এতদিন পরে এলাম, মানে? কোন এতদিন? একটা অজানা আশঙ্কা ধাক্কা দিয়ে যায় অতীনকে।
--- তুমি কি কিছুই জানো না, কিছুই বোঝোনি?
--- কীসের কথা বলছিস? একটু স্পষ্ট করবি, নাকি আমাকে সাসপেন্সেই ঠেলে দিবি?
--- আমি শ্রীরাধা দির কথা বলছি। তোমাকে যে সে চাইতো, সেটা কি তুমি বুঝতেই পারোনি?
--- বুঝবো কী! সে তো কোনোদিন আমাকে বলেনি।
ভুলে যায় অতীন যে, বিলটু ওর সমবয়স্ক নয়, বন্ধু নয়, এমনকি সম-সামাজিক অস্তিত্বেরও নয়। আজ যেন একেবারে আপন অস্তিত্ব ভুলে গিয়ে অতীন নিতান্ত অভিযোগের সুরে বললো কথাটা। ভুলে গেলো, একটা মেয়ের পক্ষে এভাবে এ কথা বলাটা কতটা সম্ভব, কতটা অসম্ভব। কিন্তু বিলটু যা শোনালো, সেটা অতীনকে মোটে শান্তি দিলো না।
--- তুমি কেন বলোনি? তুমি কি জীবনে কিছুই করবে না, অতীন দা? কিছুই বুঝবে না? সরস্বতী পুজোর দিন, তুমি প্যান্ডেলে এসেছিলে। সেই সময় হঠাৎই শ্রীরাধা দি একবার প্যান্ডেলে আসে। বাড়িতে বাবা বিয়ের জন্যে হেভি চাপ দিচ্ছিলো। সেদিন শ্রীরাধা দি বিরাট ঝামেলা গণ্ডগোল করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলো তোমার সাথে একটা বোঝাপড়া করে নিতে। আমাকে এসে বললো, তোমাদের অতীন দা কোথায় গো? যদিও আমরা গোটা ব্যাপারাটা তখন তো জানতাম না। মানে তোমার সাথে তার কতটা কথা হয়েছে... আর কি। কিন্তু তোমাকে কত খুঁজলাম আমরা! তুমি এই ছিলে, এই নেই। একেবারে ধাঁ। ভ্যানিশ। তার একদিন পরেই তো তোমার খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি, তুমি সোজা মুম্বাই...।
--- তোদের কী মনে হয়? আমাকে ও কী বলতে এসেছিলো?
এবারে যেন কোনো অবুঝ ছেলেকে বোঝাতে বাধ্য হচ্ছে, এমন একটা অস্বস্তির মুখভঙ্গি করে বিলটু বললো--- তুমি কি জানো না, শ্রীরাধা দি তোমাকে ভালোবাসে? তুমি কি এসব কিছুই বোঝো না? কী গো তুমি!
একবার অতীন ভাবে, বিলটু বোধহয় ওকে বললো তুমি কি গাড়ল। বলতেই পারে। সত্যিই তো এক্ষুণি নিজেকে একটা জ্যান্ত গাড়ললেই মনে হচ্ছিলো অতীনের। সেদিন কেন যে বড়ো চালাকি করে লুকিয়ে পড়তে গেলো? অন্তরাল থেকে শ্রীরাধাকে দেখে পুরোটা ভুল বুঝে আজকে পস্তাতে হচ্ছে। কিন্তু সে তো মোটে তিনটে মাস আগের ঘটনা। এর মধ্যে বিয়ে কী রকম? এই প্রশ্নটা শ্রীরাধার বাবাকে না করে অতীন হাতের কাছে পাওয়া বিলটুকেই করে বসে,
--- এই তিন মাসেই বিয়ে! এ তো ওঠ্‌ ছুড়ি তো বিয়ে! এটা কী করে হয়? আর আজকের দিনে এভাবে জোর করে বিয়ে মানে?
--- সবাই তোমার মতো নয়, অতীন দা। যেদিন শ্রীরাধা দি মাকে একটু ছোট করে তোমার কথাটা জানিয়েছিলো, সেদিন থেকে চুপচাপ ওর বাবা সম্বন্ধ দেখতে শুরু করে। গোটা নিগোশিয়েশন সাজিয়ে নিয়ে সরস্বতী পুজোর দিন শ্রীরাধা দিকে জানাতে শ্রীরাধা দি প্রটেস্‌ট করেছিলো। তাই চট্‌জলদি এই ব্যবস্থা।
কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকে অতীন অনুদের বাড়িটার দিকে। মনে পড়ে, শ্রীরাধাকে নিয়ে কয়েকটা স্বপ্ন ও একা একা দেখেছিলো। কিন্তু এইমাত্র ঘরেতে এলো না সে তো, মনে তার নিত্য যাওয়া-আসা।... অনুদের বাড়িটা আলোয়, সানাইয়ে, লোকজনের ছুটোছুটিতে মেতে উঠেছে। তার মধ্যে শুধু বেমানান সানাইটার এই বেদনাদায়ক শব্দ। আসলে শব্দ তো নয়। যে রাগে সানাইটা বাজছিলো, সেই রাগটাই বেদনার রাগ। জউনপুরী। কিন্তু অতীন জানে না, বেদনা জউনপুরী রাগেও ছিলো না, ছিলো মনে। পরিষ্কার দেখতে পেলো অতীন, এর মধ্যে চোখের জলে বন্দিনী রাজকন্যার মতো বসে আছে শ্রীরাধা। শ্রীরাধাকে মুখ ফুটে বলাই হলো না, আমি তোমাকে চাই। সে তো মেয়ে। সে কীভাবে বলবে এ্যাতো বড়ো কথাটা! এটা তো বলার কথা পুরুষের। যুগের পর যুগ তো তাই হয়ে আসছে। দু-জনেই মনে মনে জানলো যে, তারা একে অপরকে চায়, কিন্তু বলাই হোল না। বলি বলি করে কেটে গেলো দুটো বছর।
ঘরের দিকে পা বাড়াচ্ছিলো অতীন। মায়ের ডাক শোনা যাচ্ছিলো--- কে রে? অতীন এলি?
উত্তর দিতে ইচ্ছে করছিলো না মোটে। ভালো লাগছিলো না কিছু। বিলটু বা টুবলুকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ক্লান্ত পায়ে ঘরের দিকে পা বাড়াতে মনে পড়লো, এভাবে তো ওকে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। ওর জীবনে শ্রীরাধাই তো একমাত্র নয়। মাকে ইনসুলিন দিতে হবে। আজ থেকে তো কম্পাউন্‌ডারটি আসবে না। তেমনিই তো কথা। দায়িত্ব এবার তো ওর, যেমনটা ছিল নব্বইটা দিন আগে। ঘরে ঢুকে গেলো অতীন। বন্ধ হয়ে গেলো ওদের দরজা।

-----------------------

কোন মন্তব্য নেই: