মাদারি
এখানে পরশু এসেছি আমরা/ কাছেই একটা ফ্লাট বাড়ি গড়ে উঠছে/ নাম 'শ্যামলী এপার্টমেন্ট'/ এখানেই একটা ফ্লাট কিনব বলেই অলরেডি বুকিং করেছি/ কিন্তু প্রমোটার-এর হাতে ছেড়ে দিলে তো চলে না/ নিজেকে দেখাশুনো করে নিতে হয়/ তাছাড়া ডিজাইনিং-এর ব্যাপার আছে/ কোথায় কী কেমন হবে/ কিচেন, বৈঠাকখানা বা বারান্দা/ ভেতরের রং-ই বা কী হবে/ সুমু, মানে আমার পাঁচ বছরের যে ছেলে, তার মা'র এসব ব্যাপারে দারুন খুঁতখুঁতে স্বভাব/ তাই ভাড়া নিয়েছি ফ্লাট-এর কাছেই একটা বাড়ি/ এখানে বছর দশেক আগে একবার এসেছিলাম একটা নিমন্ত্রণে/ এসেই জায়গাটা পছন্দ হয়ে গিয়েছিল/ তাই বসবাসের এই সিদ্ধান্ত/ এসেছি যখন, এখানকার বাজার-হাট, মুদিখানা, মনোহারী দোকান--- এসব চিনে নিতে তো হবেই/ কিছুই চেনা হয়নি/ এমনকি সুমু'র স্কুল পর্যন্ত ঠিক হয়নি/ গোছগাছ করতে করতেই সময় চলে যাচ্ছে/ রং মিলিয়ে নতুন পর্দা কেনা, নতুন নতুন আসবাবপত্র...... আরও কত কি! ফ্লাটে নাকি এসব করতে হয়/ তা নয়তো মান থাকে না/ তাই ফাঁক পেলেই একটু ঘরে চিনে নিই এটা-ওটা/ তবে ছেলে'র স্কুল নিয়ে কোনো চিন্তা নেই, কেননা সে পারে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে/ সেখানে তো টাকা-র ব্যাপার/ টাকা ধরো, ছাত্র ভরো/ ছেলে সুমু কদিন ধরে বায়না করছিল একটা ভিডিও গেমস-এর জন্য/বায়না ঠিক নয়, ওর ওমা-ই ওকে দেবে বলে কমিট করেছে/ সর্ত ছিল, সুমু-ক লাস্ট পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে হবে/ হয়েছে/ দেবে বাবা, কমিট করে মা/ ওই যে বাচ্চাদের ছড়াটা--- ফাথার আর্নস মানি, মাথার স্পেন্দস মানি/ মা তার জীবনে কোনকালে ভালো ফল না করুক, ছেলেকে তা করতেই হবে/ মেরে ধরে বানাতে হবে/ তা নয়তো মান থাকে না/ তাই ভিডিও গেমস/
বেরিয়েছি/ দেখলাম, দশ বছর আগের দিন শেষ/ দ্রুত সব পাল্টে যাচ্ছে/ এখানে যেমনটা দেখে গিয়েছিলাম, তেমনটা আর নেই/ একটা আধা শহর-শহর ভাব ছিল/ এবারে এসে দেখি, ইট-কাঠ-পাথরের অরন্য হতে চলেছে/ আমিও তো তেমন-ই একটা আশ্রয় খুঁজছি/ অনেকগুলো ফ্লাট বাড়ি স্কাই রাইজের মতো দাম্ভিক মাথা তুলেছে/ আর ফ্লাট না হওয়া বাড়িগুলোকে সূর্যের আলো থেকে শুধু বঞ্চিতই করছে না, তাদেরকে দুয়ো দিচ্ছে/ এ ছাড়া শপিং মল, নানা স্বদেশী-বিদেশী কোম্পানি-র জুতো, জামা-কাপড়ের শোরুম, রিবোক, আদিদাস, কস্টলি জুএলারী শোরুম, মোবাইল শপ, ঘড়ির শোরুম ...... আরো কত কি! সব ঝপাঝপ গড়ে উঠছে/ মানুষ তাই হামলে পড়ছে এখানে ছশ-সাতশ স্কয়ার ফিট কিনবে বলে/ আমিও তাদের মধ্যে পরি বটে/ ফ্লাই ওভার-টোভার দিয়ে একেবারে রীতিমত পশ এলাকা/ আমি উন্নতি পছন্দ করি/ যদি থার্ড ওয়ার্ল্ড দেশগুলোর উন্নতির মতো উন্নতি বা অগ্রগতি বলতে শহর ও শিল্প সভ্যতা বোঝায়, তবে আমি তা ভালবাসি/ রিটায়ার করে কোনো প্রত্যন্ত গ্রামে নির্জনে বসবাসের কোনো অভিপ্রায় আমার নেই/ আই ওয়ান্ট ফেসীলিটিস এন্ড আভেলেবিলিটিস/ কিন্তু পরিবর্তন বা অগ্রগতি যে আমাকে এভাবে আঘাত করবে, তা ভাবিনি/
যাইহোক, ছেলেকে নিয়ে বেরিয়েছি একটা ভালো দোকানের খোঁজে/ মহার্ঘ ভিডিও গেমস কিনতে হবে, মাযের সম্মান রাখতে হবে/ পেয়ে যাব/ যথেষ্ট বড় বড় দোকান রয়েছে এখানে/ পেয়েও গেছি/ ছেলে খুশি ভিডিও গেমস পেয়ে/ মনে মনে ভাবি, এসব মহার্ঘ তো আমরা পাইনি/ বাবা-কে দিয়ে ঘুরি-লাটাই কেনাতে পারিনি আমার ছোটবেলাতে/ লাট্টু কেনাতে পারিনি/ বেলুন বা আতসবাজি পর্যন্ত কেনাতে পারিনি/ এসব কোনটাই নাকি ভদ্রলোকের ছেলে-মেয়েদের কেনা উচিত নয়/ তখন তো বয়স কচি/ তাই বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে পারিনি, 'ভদ্রলোকের লক্ষনটা কী, বাবা? এসব না কেনা? না, যারা এসব কিনছে, তারা অভদ্র বলেই কিনছে? আমাদের পাড়াতেই বিরাট বড়লোক উকিলবাবু'র ছেলে দিব্যি ঘুরি ওরায় বিশ্বকর্মা পুজোতে, কালী পুজোতে বাজি পড়ায়/ তাহলে.....? তারা কি সব......?' না, জিজ্ঞাসা করিনি এ কথা/ সে সাহস হয়নি/ মেনে নিয়েছি/ বাধ্য হয়েছি মেনে নিতে/
কিন্তু না, আমি পাইনি বলে ছেলেকে পকেট ভরিয়ে সব দেব, আমি যা পাইনি, তা ওকে পেতে হবেই--- এমন কোনো কমিটমেন্ট আমি করিওনি বা করিওনা/ তাই পকেট খসিয়ে বউ-এর মান রেখেছি/
দোকান থেকে বেরিয়ে মনে পড়ল, ছেলের মা বলেছিল দশ টাকার ফুল কিনে আনতে/ পুজোর ফুল/ কুচো ফুল, বেলপাতা, তুলসীপাতা, আমের পল্লব, দুর্বা ইত্যাদি/ কোথায় পাই? কোথায় পাই--- করতে করতে পেয়ে গেলlম ফুটে বসা একটা বুড়োকে/ সে ফুল নিয়ে বসেছে/ কিন্তু বুড়োটার কাছে ফুলের অর্ডার দিতে গিয়ে আমি তো থ/ মন বলছে, একে যেন আমি চিনি? মনে হচ্ছে, যেন চিনি চিনি/ কিন্তু কেমন করে চিনি, এটাই মনে আসছে না/ স্মৃতির সাথে বাস্তব চিত্রটাকে মেলাতে পারছি না/ ততক্ষনে কেক্জন খদ্দর ফুল নিয়ে চলেও গেল/ অবশেষে সুমু বলল,
--- বাপি, ফুল নাও/ বাড়ি গিয়ে ভিডিও গেমস খেলতে হবে না?
সাথে সাথে বুড়োটাও বলল--- কিতনা চাহিয়ে বাবুজি?
আমি কেমন অন্যমনস্ক/ এই সময় হঠাত পাশের একটা গলি থেকে সাইকেলে একটা লোক একটা ডুগডুগি বাজিয়ে বাজিয়ে বেরিয়ে এলো/ তার সাইকেলের দুপাশে রেখেছে চট দিয়ে বানানো বিরাট বিরাট দুটো ব্যাগের মতো খাপ/ সে ডুগডুগি বাজাচ্ছে, আর মুখে চেচিয়ে বলছে,
--- পুরানো ভাঙ্গা লোহা, কাগজ বিক্রি-ই-ই-!
ব্যাস, ম্যাজিক/ আমি ফুলঅলাকে চিনে গেলাম/ যেইমাত্র ডুগডুগি শুনলাম, গত অতীত কlলটা আমার সামনে বর্তমান কাল হয়ে উঠলো/ ফুলওয়ালা আর কেউ নয়, স্বয়ং আফজল মিয়া/ কিন্তু মুসলমান হয়ে হিন্দুদের পুজোর ফুল বেচছে! বিরল দৃশ্য/ মনে মনে বললাম, 'সাবাস পেট, তুমি তো অন্তত দুটো যুযুধান গোষ্ঠীকে খাবারের কারণে মিলিয়ে দিয়েছ/' কিন্তু আফজল মিয়া ফুল বেচছে কেন? তাহলে বাদশা-বেগম কই? ওহ! মনে পড়ল, এতদিনে তাদের তো মরে যাবার বয়স হয়েছে/ তারা তো আর আমাদের মত আশি-একশ বছর বাঁচে না/ সাকুল্যে তিরিশ, কি চল্লিশ হবে হয়তো/ আমি না বলে পারলাম না,
--- তুমি আফজল মিয়া না?
নিজের মুখে আঙ্গুল দিল আফজল--- সlব, চুপ যাইয়ে/ মেহেরবানী করকে চুপ যাইয়ে/ কই সুন না লে/ মুসলমান হোকে ফুল বেচ রহা হু/ ই তো গলত হয় না? বলে আফজল মিয়া আমার পায়ে হাত দিতে গেল/
আমি তিন হাত সরে গিয়ে আস্তে বললাম--- তুমি আফজল মিয়া তো?
একটা সাদা ঘোলাটে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল লোকটা--- আপ কইসে পেহ্চান্তে হ্যায় হামকো, বাবু?
--- আগে তুমি বলো/
মাথা নেড়ে মনে নিল সে/ আবার বললাম--- তুমি মাদারী না? বান্দর খেলা দেখাতে না? বাদশা-বেগম?
--- বাপি, ফুল নাও/ বাড়ি গিয়ে ভিডিও গেমস খেলতে হবে না?
সাথে সাথে বুড়োটাও বলল--- কিতনা চাহিয়ে বাবুজি?
আমি কেমন অন্যমনস্ক/ এই সময় হঠাত পাশের একটা গলি থেকে সাইকেলে একটা লোক একটা ডুগডুগি বাজিয়ে বাজিয়ে বেরিয়ে এলো/ তার সাইকেলের দুপাশে রেখেছে চট দিয়ে বানানো বিরাট বিরাট দুটো ব্যাগের মতো খাপ/ সে ডুগডুগি বাজাচ্ছে, আর মুখে চেচিয়ে বলছে,
--- পুরানো ভাঙ্গা লোহা, কাগজ বিক্রি-ই-ই-!
ব্যাস, ম্যাজিক/ আমি ফুলঅলাকে চিনে গেলাম/ যেইমাত্র ডুগডুগি শুনলাম, গত অতীত কlলটা আমার সামনে বর্তমান কাল হয়ে উঠলো/ ফুলওয়ালা আর কেউ নয়, স্বয়ং আফজল মিয়া/ কিন্তু মুসলমান হয়ে হিন্দুদের পুজোর ফুল বেচছে! বিরল দৃশ্য/ মনে মনে বললাম, 'সাবাস পেট, তুমি তো অন্তত দুটো যুযুধান গোষ্ঠীকে খাবারের কারণে মিলিয়ে দিয়েছ/' কিন্তু আফজল মিয়া ফুল বেচছে কেন? তাহলে বাদশা-বেগম কই? ওহ! মনে পড়ল, এতদিনে তাদের তো মরে যাবার বয়স হয়েছে/ তারা তো আর আমাদের মত আশি-একশ বছর বাঁচে না/ সাকুল্যে তিরিশ, কি চল্লিশ হবে হয়তো/ আমি না বলে পারলাম না,
--- তুমি আফজল মিয়া না?
নিজের মুখে আঙ্গুল দিল আফজল--- সlব, চুপ যাইয়ে/ মেহেরবানী করকে চুপ যাইয়ে/ কই সুন না লে/ মুসলমান হোকে ফুল বেচ রহা হু/ ই তো গলত হয় না? বলে আফজল মিয়া আমার পায়ে হাত দিতে গেল/
আমি তিন হাত সরে গিয়ে আস্তে বললাম--- তুমি আফজল মিয়া তো?
একটা সাদা ঘোলাটে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল লোকটা--- আপ কইসে পেহ্চান্তে হ্যায় হামকো, বাবু?
--- আগে তুমি বলো/
মাথা নেড়ে মনে নিল সে/ আবার বললাম--- তুমি মাদারী না? বান্দর খেলা দেখাতে না? বাদশা-বেগম?
বুড়োটা তেমনি ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে আমার দিকে। কোন উত্তর নেই। সেই চোখে বিস্ময়, না ভয়--- আমি বুঝতে পারলাম না। আমি আবার ব’ললাম,
--- তুমি আমাকে চেন না। আমি বাদশা-বেগমের খেলা কত দেখেছি! থাকতাম শ্যামনগরে। তিমি সেখানে বাঁদর খেলা দেখাতে আসতে। তখন আমি এতটুকু। ব’লে আমি সুমু’কে দেখিয়ে দিলাম। এটাও ব’ললাম---এটা কিন্তু আমার ছেলে।
একগাল হেসে আফজল ব’লল--- বহুত খুব। তবতো আপনি হামার বেটা-বেটি’র খেল্ দেখিয়েছেন। আমি মাথা নাড়তে ব’লল--- ক্যা বাত! ক্যা বাত!
আমি ভাবলাম, আফজল মিয়াঁ বাদশা -বেগম’কে ‘বেটা-বেটি বলছে কেন। সে তো দুটো বাঁদর আর বাঁদরী। তাই ব’ললাম--- না, তোমার বেটা-বেটি নয়। বাদশা-বেগম।
--- বহি তো। ও দোনো তো হামার বেটা বেটি ছিল, খোকাবাবু। হামাকে রেখে চ’লিয়ে গিলো। ব’লে নিজের কাপড়ের খুটে চোখ মুছল আফজল। যেন কোন আপনজন কেউ চ’লে গেছে। আমার ছেলে বিস্মিত। আমার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে ব’লল,
--- বাপি, তোমাকে লোকটা ‘খোকাবাবু’ বলছে কেন ?
আমি ছেলে’র প্রশ্নের উত্তর দিলাম। ইংরেজিতে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলাম। ওর মা’র ওর মা’র কঠিন আদেশ, ছেলে’র সাথে বাংলা কথা বলতে পারব না। সে নিজে না পারুক, আমাকে ইংরেজি ব’লতে হবে। আমার মিসেসের সে মানও রাখলাম। আফজল’কে ব’ললাম,
--- বাদশা-বেগম’এর খানা মিলল না কেন ? তুমি কি বিমার পড়েছিলে?
ব’ললাম বটে কিন্তু চোখের সামনে ভেসে উঠলো আমাদের ছোটবেলা। আমাদের বাবা’র দৌলতে আমাদের ছোটবেলায় তো ফুটবল খেলেলে পা ভাঙ্গবে। তাই বল কেনা যাবে না। ক্রিকেট খেললে মাথা ভাঙ্গবে। তাই ব্যাট-বল দেওয়া যাবে না। আতসবাজি পোড়ালে দুর্ঘটনা হবে। তাই আমোদ-প্রমোদ প্রায় কিছুই ছিল না। বাবা এসব দিতে পারেননি, না দিতে চাননি, তা জানি না। কিন্তু আফজল মিঞা ছিল আমাদের আমোদ, আমাদের প্রমোদ। সে আমাদের পাড়ায় পাড়ায় ডানহাতে একটা অদ্ভুত কায়দায় তার ম্যাজিক ডুগডুগি ধ’রে সেটা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বাজিয়ে খেলা দেখাতে আসতো। প্রায় রোজ। সাথে থাকতো তার বাঁদর বাদশা আর বাঁদরী বেগম। তাদের গায়ে জামা, পরনে প্যান্ট। আফজলের নিজের হাতে বানানো বস্ত্র। বেশ রঙিন। অনেকটা বাউলদের জোব্বার মতো দেখতে। বাঁদর দুটো আমাদের জীবনের সাথে এমনভাবে জড়িয়ে ছিল যে, তাদেরকেই মনে হতো আমাদের জীবনের আনন্দ, আমাদের স্ফূর্তি। তারা না এলে পড়ায় মন বসতো না আমাদের। একবার খেলাটা দেখলেই আমরা এনার্জি কালেক্ট করে নিতাম। খেল্ মানে--- স্বামী বউ-এর আদেশে জল তুলছে, রান্না ক’রছে, বউ-কে খুশি ক’রছে, তোয়াজ ক’রছে, তারপর আনন্দে ডিগবাজি খাচ্ছে। নানা খেল্। আর আফজলের অদ্ভুত ডুগডুগি’র শব্দ। কী দারুন দক্ষতা! ঐ বাজনা ছাড়া যেন বাঁদরকেই মানায়ই নয়া। আর আজ তা উঠে এসেছে পুরনো কাগজওয়ালা’র হাতে। কী অন্যায়! শিল্পের কী অপব্যবহার! কিন্তু শিল্পী হিসেবে আফজল কিন্তু কোন খেতাব পায়নি, পাবেও না। সে যে শিশুদের আনন্দ দেয়, তাদের মনকে তাজা রাখে, চাঙ্গা রাখে--- এর কোন মূল্য নেই। মূল্য ছিল না আমাদের মা-বাবা’র কাছেও। খেলা শেষ হ’তে না হ’তে মা বা বাবা আমাদের ঘরে ডেকে নিয়ে যেতো। ওরা হয়তো ভাবতো, ওরা বাচ্চা-কাচ্চা ধ’রে নিয়ে যায়। শুধু সুমু’র মা নয়, সকলেই। আজকের মায়েদের মতো আমাদের মায়েরাও আমাদের আমোদ-প্রমোদ থেকে, স্বাধীনতা থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে ‘’পড়া পড়া পড়া’’ ক’রে অতিষ্ঠ ক’রত, উদ্ব্যস্ত করে মারত। আমাদের বাবাদের সময়েও তাদের মায়েদের হাতে এমনটা ঘ’টতে পারতো। কিন্তু তাঁদের মায়েদের সেটুকু অবসর ছিল না। তারা তো দাসী-বান্দী’র মতো খিদ্মদ খেটে ম’রত। ছেলে’র পড়াশুনো দেখবে কবে!
যাইহোক, বাড়ি থেকে ডাকলে সব বাচ্চারা একে একে চ’লে যেতো। আফজল অল্প হেসে মাথায় করাঘাত ক’রে সব গুটিয়ে-বাটিয়ে চ’লে যেতো। আমাদের বড়রা ভাবতোও না, আফজল’কে কিছু দিতে হবে। এটা ওর জীবিকা। কিন্তু আমরা আমাদের টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে আফজল’কে দিতাম। দিতাম, কারণ ও যেন পরদিন আবার আসে। কিছু না পেলে তো ও আসবে না। ওকে যে আমাদের চাই। একটুখানি আনন্দ, একটুখানি খেলা, একটুখানি হাসি। এই তো ছিল আমাদের জীবনীশক্তি, সঞ্জীবনী সুধা।
সম্বিত ফিরল আফজলের কথায়।
--- ক্যায়সে খানা মিলবে, খোকাবাবু! তব তো আপলোগ বড়ে হো যা রহে থে। ফির কোই খোকা-খুকু বান্দর কা খেল্ মাদারি কা খেল্ দিখতো না। ফির সানিমা আ গয়া, টিভি আ গয়ি। উস্ মে আচ্ছা আচ্ছা খেল্ দিখানা সুরু হো গিয়া। ঘর বয়ঠে বয়ঠে সব খোকা-খুকু হরেক রকম নয়া নয়া খেল্ দিখতো। হামি কিতোবার এসেছে! সব বাচ্চা লোগো কো ডেকেছে ভি। ডমরু বাজিয়েসে জোর জোর সে। শোর ভি মচায়েথে, “আও! বাদশা বেগম কা খেল্ দেখো।” মগর কোই বাচ্চা লোগ নেহি আয়া। বান্দর কা খেল্ বাচ্চা লোগো কা পাস ফালতু হো গয়া। আপকা বাদশা বেগম কো ক্যায়সে খানা মিলবে, খোকাবাবু! কৌন পয়সা দিবে! খানা দিতে পারি না। নিজে খাই ‘সাত্তু ঔর পানি। বাদশা বেগম তো বো খানা খেতো না। একরোজ হামি দিমাগ খরাপ করকে বোলা, “যা বাদশা, যা বেগম, খুদ কা খানা খুদ ঢুন্ড লে। খুদ বাচ লে। ছোড় মুঝে। মাফ কর।” মগর বো তো কহিঁ গিয়া নেহি। বাপুজিকো ছোড়কে কাঁহা যাবে! খানা মিলতো না। ফির--- এক রোজ বো দোনো গুজার গিয়া।
চুপ ক’রে শুনছিলাম আফজলের দুঃখ-কষ্টের কথা। আফজল চোখ মুছছিল। এসব তো আমার বা আমাদের জানা। আমার বাবা গল্প ক’রতেন, তাঁদের সময়ে নাকি বহুরূপী ছিল। কালী-দুর্গা-কৃষ্ণ--- অনেকটা গো এজ ইউ লাইক-এর মতো নানাভাবে সেজে মেকআপ নিয়ে আসতো, সকলকে চমকে দিতো, পয়সা পেতো। আমি তো তাদের দেখিনি? তারমানে, তারা তখন ঐ বাদশা বেগমের মতো না খেতে পেয়ে ম’রে গিয়েছিলো বোধহয়। এমনি ম’রে যাচ্ছে ‘ছৌ নৃত্য’। তাই এই শিল্প নিয়ে টিকে থাকবার জন্য একদল ছৌ’কে মৌ বানাচ্ছে। হয়তো বাদশা বেগম কে বাঁচতে হ’লে তেমনই কিছু ক’রতে হতো। নিষ্পাপ বাঁদর খেলার সাড়ে সর্বনাশ হ’তো। আজ আবেগকে ছেড়ে বেগ-এর হাত ধ’রে আমাদের বাড়িতে এসেছে টিভি, ভিসিডি, ভিডিও গেম্স, মোবাইল, ইন্টারনেট, রক, পপ, বলিউড, ট্রলিউড। কী নয়! এক নিমেষে হাজার খেল্। আজকে প্রথম আক্ষেপ ক’রলাম, নতুন তো আসবেই। কিন্তু এভাবে! পুরনোকে একেবারে নিশ্ছিহ্ন ক’রে দিয়ে, নির্মূল ক’রে দিয়ে, শেষ ক’রে দিয়ে! তা নয়তো কোথায় গেলো সেই ভালুক খেলাওয়ালা, সাপ খেলাওয়ালা, যা দেখে আমরা নয়ন জুড়োতাম? কিম্বা কোথায় গেল আমার বাবা’র মুখে শোনা পুরনো দিনের গম্ভীরা, ভাওয়াইয়া, যা মানুষ’কে কাঁদাতো- হাসাতো? রবিবাবু’র ‘কাবুলিওয়ালা’ কি আর কোনোদিন ছবিবাবু’র কণ্ঠের আদলে ব’লবে, ‘খোকি, তুমি সসুরবাড়ি যাবিস?--- এ স্লোগান তো আজকের সভ্যতার স্লোগান। একদিকে টাকা খেয়ে গোপনে চোরা শিকারিদের অরন্যে ঢুকিয়ে দাও, আর অন্যদিকে কালেভদ্রে একটা দ্যাখনদারি ইন্সপেকশন করো। ব্যাস, কাজ শেষ। পরিবেশ বাঁচাও। মানুষ ম’রে যাচ্ছে ? যাক, কুছ পরোয়া নেই। রাস্তায়, ঘাটে, বস্তিতে, কুঁড়েতে ফুটপাথে, ব্যাধিতে, নেশায়, না খেয়ে, অখাদ্য খেয়ে তারা ম’রে যাক, পচে যাক, ধ’রে যাক। ওরা তো উচ্ছে’র ঝার। হাতির পাল ঢুকে দশটা বাড়ি ভেঙ্গে দিয়েছে বা ফসল বিনষ্ট করেছে? চুপ ক’রে থাকো। ফসল তো আবার হবে। কিন্তু ওরা যে পরিবেশ বাঁচাবে। বাঘে কাঁকড়া ধ’রতে যাওয়া দুটো মানুষকে থাবা মেরে মৃত্যু’র মুখে ঠেলে দিয়েছে? যাক না। বাঘ তো বাঁচাতে হবে। তুমি বাঁচো, না বাঁচো। কিন্তু হে সভ্যতা! কার জন্যে এই পরিবেশ রক্ষা। শুধু পরিবেশ তো শুধু বাবুদের পেট ভরায়। কিন্তু আফজলরা? ওদের কী হবে? পশু’কে নিয়ে সারা বিশ্বব্যাপী মাতামাতি চ’লবে। অথচ চিড়িয়াখানা থাক। পশু দেখিয়ে সরকার পয়সা কামাক। কিন্তু আফজলেরা? নৈব নৈব চ। সকলেই জানে, সার্কাস পার্টি বা আফজলেরা তো তাদের বাঁদর, বাঘ, ভালুক, সিংহ’কে সবাই তাদের ছেলেমেয়ে মনে না করুক, মূলধন তো মনে করে। পশুরাই তো ওদের ভাত দেয়। তাই মূলধনের তো যত্ন নিতেই হয়। কিন্তু এখন তা চ’লবে না, চ’লবে না।
হে সভ্যতা! হে বিজ্ঞান! তুমিও তো দেখছি, নদীর মতই নিষ্ঠুরা। এ কুল গড়ো, ও কুল ভাঙো। একদিকে মানুষকে নতুনভাবে বাঁচার রসদ এনে দাও, আবার অন্য হাতে না খাইয়ে মারো। সভ্যতা ব’লছে--- সারভাইভাল অব দি ফিটেস্ট। চুপ ক’রে থাকো। দেশ এগোচ্ছে। সভ্যতা এগোচ্ছে। একটা সময় আসবে, চারদিকে ‘সভ্যতা সভ্যতা’ গন্ধ ভাসবে। সব ছকে চলবে। চারদিক ঝাঁ- চকচকে হয়ে যাবে। সব পালটে যাবে। যান্ত্রিক হয়ে যাবে।
আমার চিন্তার তার কেটে দিলো আফজল মিয়াঁ। সে তার বুড়ো হাড় নিয়ে রাস্তার পাশেই নানা রকম অঙ্গভঙ্গি ক’রছে। অনেকটা বাঁদরের মতো। অনেকটা বাদশা’র মতো। কী ব্যাপার! ওর তো চোট-টোট লেগে যাবে। মাথাটা গেল নাকি? বুড়ো মানুষ! আজ আমাকে দেখে কি পুরনো দিনের কথা মনে পড়তে মাথাটা---। হঠাৎ আবিষ্কার ক’রলাম, না। মাথা খারাপ নয়। একটা সত্যি জানলাম আজ। আফজল শুধু পয়সার জন্যে আমাদেরকে বাঁদর খেলা দেখাতো না। একটা মহান উদ্দেশ্য তার ছিল যেটা আমাদের বাবা-ও আমাদেরকে অনীহা বা অক্ষমতা থেকে দিতে পারেনি। সেটা হল নির্মল আনন্দ। তাই তো আমার ছেলেকে বাঁদর খেলা দেখাতে চেষ্টা ক’রছে। আমার ছেলে জীবনে যা দ্যাখেনি, তার একটা আস্বাদ পাচ্ছে। আফজলের খেলা দেখে আমার ছেলে সুমু হেসে কুটিপাটি। আফজল’কে দেখেই এতো খুশি! তাহলে বাদশা-বেগম না জানি কতটা আনন্দ দিতে পারতো আমার ছেলেকে! আমি কোনোদিন ওকে এতোটা আনন্দ দিতে পেরেছি কি? ওর পুরনো ভিডিও গেম্সটা নিয়েও ওকে খেলতে খেলতে এতোটা খুশী হতে দেখিনি।
-----------------------
1 টি মন্তব্য:
khu`nje pelam. porhe comment korchhi. :-)
apni likhe cholun, Sir.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন