IF YOU DON'T HAVE ''BANGLA WORD'' FONT, YOU CAN'T READ THE BLOG.
আইডেন্টিটি
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়
গাড়িটাকে বিচের বাইরে রেখে শুভ্রকান্তি একা এসে
দাঁড়িয়েছে একেবারে সমুদ্রের ঢেউ-এর কাছাকাছি। বেশ জোরে হাওয়া বইছে এখানে। ওর মাথার
চুলগুলো উড়ছে ফরফর ক’রে। একটু আগেও ওর ছায়াটা বিচের বালিতে লম্বা হয়ে প’ড়েছিল।
নিজের লম্বা ছায়া দেখতে বেশ লাগে ওর। ছোটবেলা থেকে। হাত নাড়লে সে নাড়ে, চ’ললে সে
চলে। এইমাত্র ছায়াটা হাল্কা হ’য়ে গেছে। রোদ প’ড়ে এসেছে। সামনে অনন্ত
জলরাশি। এত যে ভীষণ, তথাপি কেমন একটা বিনীতভাবে মানুষের পায়ের কাছে এসে যেন
নমস্কার ক’রে যাচ্ছে। মনে পড়ে, সার আইজাক নিউটন নাকি বলেছিলেন যে, তিনি বিজ্ঞানের
একগুচ্ছ আবিষ্কার পৃথিবী-কে দিলেও তা এই সমুদ্রের তীরে যেন দু-একটা নুড়ি কুড়োবার
মতো। জাতীয় পুরষ্কারের পর আরও গোটা কয়েক স্বদেশী ও বিদেশী পুরস্কার পকেটে ঢুকেছে
চলচ্চিত্র নির্মাতা এই শুভ্রকান্তি সরকারের। সে টালিগঞ্জ সিনেমা পাড়ায় শুধু নয়,
দর্শক মহলে বেশ একটা পরিচিত নাম। গোটা তেরো-চোদ্দ ছবি উপহার দিয়েছে বাংলার
দর্শক’কে, আর চলচ্চিত্র জগত’কে। কিন্তু এই সমুদ্র শুভ্রকান্তি’কে যেন ব’লে দিচ্ছে,
‘তুমি এমন কিছুই করনি। মাত্র তেরো- চোদ্দ। কয়েকটা নুড়ি কুড়িয়েছ মাত্র। মাইলস টু গো
বিফোর ইউ স্লিপ।’
জলপাই রঙ-এর টয়োটা-টা নীরব হ’য়ে দাঁড়িয়ে আছে একটু
দূরে। সকলেই চ’লে গেছে সকালে। গোটা টিম। একা শুভ্রকান্তি সাগরবেলায়। শুভ্র ঠিক ক’রেছে, কাল ফিরবে। একটু
বিশ্রাম তো পাওয়া যাবে। বিকেল হ’য়েছে। দূরে দিনমণি লাল হ’তে
হ’তে জলের ওপারে কোন অতলে টুক ক’রে তলিয়ে যাবে। আকাশটা এখনই
বেশ নানা রং-এ রেঙ্গে গেছে। দিননাথ বিদায় নিলেই রং-টা টাট্কা হ’য়ে উঠবে। অনেকটা
শুভ্রকান্তি’র ল্যাপটপ-এ থাকা বেশ কয়েকটা ওয়ালপেপার-এর মতো। ডিজিটালটা বের ক’রে একটা
ছবি নিতে গিয়ে চোখে প’ড়ল একজন মহিলাকে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে। একা। হাওয়ায় তার
সিন্থেটিক কাপড়-এর আঁচলটা ফুর ফুর ক’রে উড়ছে। উড়ছে মাথার আর কানের
পাশ দিয়ে বেরিয়ে থাকা বেঁকা বেঁকা চুল। হাতদুটো আড়াআড়িভাবে ঝুলিয়ে রাখা। এমন কোন
বিরল দৃশ্য নয়। কিন্তু এক্ষুনি এই পড়ন্ত আলোয় যখন বীচে এখানটাতে কেউ নেই, তখন
মহিলাটিকে বেশ একটা ছবি-ছবি লাগছে। যদি আকাশের একটা ছবি নিতেই হয়, তবে মহিলাটিকে
নিয়েই নেওয়া উচিত। না, এমন কোন আকর্ষণীও নয় মহিলা। বরং বেশ ভারী শরীর ব’লে মনে হ’চ্ছে। হয়তো বয়স-টয়সও
হ’য়েছে। তবু এই পটভূমিতে মহিলাকে পেছন থেকে বেশ ভালো লাগছে দেখতে। মনে মনে ঠিক
করে, এটাকেই ল্যাপটপ-এ ওয়ালপেপার ক’রে রাখবে। কিন্তু মহিলার ছবি ব’লে কথা। একটা মিনিমাম
কনসেন্ট তো লাগে। তাই ডিজিটাল-টা হাতে নিয়েই এগিয়ে যায় শুভ্রকান্তি।
--- এক্সকিউজ মী, ম্যাম্।
পেছন থেকে এমন একটা ডাক শুনে মহিলা পেছন ফিরতেই
হতবাক শুভ্রকান্তি। এ তো ঈশিতা! হঠাৎ এখানে! তারপরেই মনে হয়, এখানে এই বালুকাবেলায়
যদি বাংলার চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম সেলিব্রিটি শুভ্রকান্তি সরকার-এর দাঁড়িয়ে
থাকাটা অপ্রত্যাশিত না হয়, তবে ঈশিতা’র থাকাটাও কোন অস্বাভাবিক নয়। ও তো আর
সেলিব্রিটি নয়। কেউ ওকে চেনেও না। ও তো যেখানে শেখানে যেতে পারে। ওড় তো বাধা নেই। তবু
ব’লতে হয়,
--- আরে! ঈশিতা! তুমি! কেমন আছো ?
--- ওমা! বাংলার গর্ব শুভ্রকান্তি সরকার যে! আমি তো
ভালো আছি। তুমি ?
কেমন যেন একটা ব্যঙ্গ ভরা শব্দজব্দে ঈশিতা’র কথা শুনে না বুঝেই শুভ্রকান্তি
উত্তর দ্যায়--- ফাইন।
আবার প্রশ্ন ছোঁড়ে ঈশিতা--- তা... তুমি একলা যে বড়ো?
তোমার দলবল সব কৈ?
--- পুরো টিম পাঠিয়ে দিয়েছি। সব সময় দলবল ভালো লাগে
না।
--- বাবা! সেলিব্রেশনে অরুচি! কী ব্যাপার?
--- না না। তা নয়। তা তুমি! এখানে! একা একা!
শুভ্র লক্ষ করে, ঈশিতা’র
সীমন্তে লাল রেখা র’য়েছে। কপালে এমনি একটা টিপ। বরাবর বড় ঘরের ছেলে শুভ্র।
ফিল্ম ইন্সটিটিউট থেকে বেরিয়ে একটা শর্ট ফিল্ম ক’রে ও রাতারাতি সারা ফেলে দেয়
চলচ্চিত্র জগতে। বুদ্ধিজীবী আর বোদ্ধামহল ব্রেক দেয় ওকে। সে তো সেই কবে! ব্যাস, আর
পেছনে তাকাতে হয়নি ওকে। একেবারে হপ, স্কিপ অ্যান্ড জাম্প। আজকাল তো মুম্বাই থেকে
তাবড় নায়ক-নায়িকা এসে ওর ফিল্মে কাজ ক’রে দিয়ে যায়। ঈশিতার সাথে আলাপ
হ’য়েছিল প্রতিষ্ঠার প্রত্যুষ কালে। ঝট ক’রে আলাপ, চট ক’রে প্রেম, কিন্তু দুম্ ক’রে ঈশিতা’র সাথে
বিয়েটা হয়নি শুভ্র’র। ঈশিতাই দুম্ ক’রে শুভ্র’কে না ব’লে-ক’য়ে কাকে যেন বিয়ে ক’রে
ব’সেছিল। বিয়ের দিন খবর পেয়েছিলো শুভ্র। কিন্তু ঝামেলা বাড়ায়নি ও।
একটু থেমে উত্তর দেয় ঈশিতা--- আমার তো পাঠিয়ে দেবার
মতো দলবল নেই। অবশ্য আমি একা নই, শুভ্র। পলাশ আছে।
--- পলাশ ?
তাচ্ছিল্যের সঙ্গে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েই জিজ্ঞাসু
চোখে তাকায় শুভ্রকান্তি। শুভ্র লক্ষ্য করে, বেশ বয়সের ছাপ প’ড়েছে ঈশিতার চেহারায়।
কতো হবে? পঞ্চাশ-টঞ্চাশ হয়তো। কিন্তু ওর চেহারায় একটা ঝড়ে পড়া মহিলার ছায়া এসেছে,
এটা শুভ্রকান্তির নজর এড়ায় না। ঝানু ফিল্ম
মেকার সে। মানুষের মনের মধ্যে থাকা নানা জটিল বিষয় নিয়েই তার ছবি--- ‘চড়ুই ভাতি’, ‘নীলপাখি’, ‘আকাশপ্রদীপ’ আরো নানা।
--- ওহো ! তুমি তো পলাশ’কে চেনোই না।
--- বা রে! চেনালে তো চিনবো।
--- না শুভ্র, পলাশ চেনানোর মতো কোনো সেলিব্রিটি নয়।
ও আমার স্বামী। পলাশ বসু।
--- আই সি! তোমার স্বামী! তা তিনি কোথায় ? আলাপটা
করা যেতো। তুমি তো একাই দাঁড়িয়ে।
--- ও লজে। ব’লে পায়ের নখ দিয়ে বালিতে কী
যেন লিখছিল ঈশিতা।
আগের মতো যুবক যুবক কণ্ঠে শুভ্র ব’লল--- উ-ম্-ম্-ম্
! ঝগড়া ক’রেছো ?
--- কী ক’রে বুঝলে ?
--- বুঝতে হয়, ম্যাডাম। বুঝতে হয়। মৃদু হেসে আর একটু
সহজ হ’তে শুভ্রকান্তি বলে--- তা... মাথা’র এতগুলো চুল সাদাটে ক’রে ফেললে কী ক’রে ?
এবারে মুখ তোলে ঈশিতা। তাকায় শুভ্রকান্তি’র মাথায়
পুরো সাদা হ’য়ে যাওয়া চুলের দিকে। বলে--- আমি না, শুভ্র। সময়। নিজের মাথায় হাত
রাখো না।
শুভ্র জানতে চায় অনেক কথা। কুড়ি বছর আগের না জানা
অনেক কথা। পুরুষ মানুষের কৌতূহল থাকতে নেই, এমন তো নয়। তাই পরের প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,
--- তাহ’লে ভালই আছো, বলো।
--- ভালো তো থাকতেই হয়।
--- তা... তোমার ক’টি ছেলেমেয়ে ?
--- এক।
--- মেয়ে ?
--- না। ছেলে। চাকরী করে। এই তো দু’বছর।
এবারে পকেটে হাত ঢুকিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে টান
হ’য়ে দাঁড়িয়ে নিয়ে অনুযোগ ক’রলো শুভ্র--- কৈ ? আমাকে তো পাল্টা প্রশ্ন ক’রলে না?
--- তুমি সেলিব্রিটি। তোমারটা কি জিজ্ঞাসা ক’রে
জানতে হয় ? ঐ যে ছেলেগুলো জলে ঝাঁপাচ্ছে, ওদেরকে ডেকে জিজ্ঞাসা করো। ওরাও ব’লে দেবে, ‘তুমি বিয়ে
করোনি। কথাটা ব’লেই নিজেকে শুধরে নিয়ে বলে--- না, ভুল ব’ললাম। বিয়ে করার সময় পাওনি।
--- একেবারে ঠিক কথা ব’লেছো। কবে যেন বয়সটা ঝপ ক’রে
জানিয়ে দিল, আর হবে না। তা কী নিয়ে ঝগড়া ক’রলে ?
--- কার সাথে ?
--- হাজব্যান্ড। পলাশ বাবু।
--- ঝগড়া ক’রিনি তো। ও ঘুমোচ্ছে।
--- বেড়াতে এসে! এখন !! ঘুমোচ্ছে !!!
--- সারাটা দুপুর যন্ত্রণায় ছটফট ক’রে এই তো ঘুমোলো।
চম্কে যায় শুভ্র। বলে--- যন্ত্রণা ! কীসের যন্ত্রণা?
শুভ্র-ও ঈশিতা’র মতো নিজেকে সামলে নিয়ে বলে--- অবশ্য যদি তোমার একান্ত পারসোনাল কথা ব’লতে
কোন আপত্তি না থাকে।
ঈশিতা আবার তাকায় শুভ্র’র দিকে। শুভ্র প’ড়তে চেষ্টা করে ঈশিতা’র
দৃষ্টি, যা সে এক সময়ে খুব সহজে প’ড়তে পারতো। কিন্তু আজ ধ’রতে
পারে না। কুড়ি বছরের শূন্যস্থান। বয়স গিয়েছে চ’লে তাহাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার।
কুয়াশায় ঢেকে গিয়েছে অনেককিছু।
--- ক্যান্সার। লাস্ট স্টেজ। ছেলে ডাক্তারের পরামর্শ
মতো ব’লল, ‘যাও মা, বাবা’কে নিয়ে একটু ধারে কাছে ঘুরে এসো। বাবা’র ভালো লাগবে।’ তাই এখানে আসা। এখানে
তো খরচ-টা কম। ও কাল বিকেলেও এসেছিলো বীচে। আজকে আর পারলো না।
ইচ্ছে না থাকলেও কথা-টা ব’লেই ফেলে শুভ্রও--- ও,
আই সি! ইট্স ভেরি শকিং। এবারে একটু থেমে শুভ্র আবার প্রশ্ন ছোঁড়ে--- একটা সত্যি
কথা ব’লবে, ঈশিতা ?
--- মিথ্যে কেন ব’লবো! বলো।
সোজা ঈশিতা’র দিকে দৃষ্টি ফেলে বলে
শুভ্রকান্তি--- এভাবে একা একা আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটা কাটাতে চেয়েছিলে বুঝি? দুঃখবিলাস
ক’রতে চেয়েছিলে ? আর তাই যদি হবে, তবে এভাবে আমাকে অপমান ক’রলে কেন ? আজকে আমার
সঙ্গে থাকলে, আমাকে বিয়ে ক’রলে তুমি একটা নিশ্চিন্ত জীবন পেতে নাকি ?
--- থাক না ওসব কথা, শুভ্র। সেই সময়-টা চ’লে গেছে। আজ দেখা হ’ল। কথা হ’চ্ছে। এটাই কি ভালো
না।
একটু রেগে, একটু নিরীক্ষা’র ঢঙে শুভ্র প্রতিবাদ
ক’রলো--- আমাকে তো এ্যাটলিস্ট জানাতে পারতে। অন্ততঃ আমি তো মনে মনে একটা
প্রস্তুতি নিতাম। এভাবে আমাদের এতদিনের সম্পর্ক-টা ছুঁড়ে ফেলে দিলে! কেন, বলতো। আমি
নিজে গিয়ে তোমার বাবা-মা’র সাথে কথা অবধি ব’লেছি। তাদের তো কোন আপত্তি
দেখিনি। তাহলে পলাশ কি আমার থেকে আরও বেশি কিছু ছিল?
--- তোমার প্রশ্নের উত্তর তো তুমি নিজেই দিয়েছো। তাছাড়া
আমাকে সব কথা মুখ ফুটে ব’লতে হবে কেন? তুমি তো মানুষের জীবনের অনেক জটিল জটিল বিষয়
নিয়ে সিনেমা ক’রেছো। এ তো আমার মতো আটপৌরে মেয়ে’র আটপৌরে ভাবনা’র কথা।
--- মানে !
--- দ্যাখো, তুমি একজন নামী মানুষ ছিলে, নামী মানুষ
আছো। আমি সামান্য মেয়ে। তোমার বিরাট জীবনে আমি এই এত্তটুকু। তোমার কি এসব সামান্য
বিষয় নিয়ে ভাবা সাজে, বলো। বরং তুমি চিরকাল তোমার নিজের কথা ব’লতে ভালোবাসো। সেটাই
বলো। নতুন কী কী কাজ ক’রলে?
একটু রেগে যায় শুভ্র। বুঝতে পারে যে, ঈশিতা ওকে
এড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মনের মধ্যে যে অপমান-টা দেগে আছে, সেটার তো একটা সদুত্তর
পেতে হবে। তাছাড়া কৌতূহল বড় বালাই। এটা একবার মাথায় চাপলে তো মাথা থেকে যেতে চায়
না। যাদের কৌতূহল নেই, তারা বড় সুখী মানুষ। অজ্ঞতা’র সুখ তাদের। তাই শুভ্র ব’লে,
--- এড়িয়ে যেতে চাইছো ? সত্যি বলো তো, আমাদের
সম্পর্কে কি কোন ফাঁকি ছিল?
--- ছি! ছি! জিভ কাটে ঈশিতা। বলে--- না না। তবে একটা
ফাঁক ছিলো, শুভ্র। বিরাট ফাঁক।
--- ফাঁক!
--- ঠিক ফাঁক নয়। একটা দুস্তর পরিখা। সেটা টপ্কে
যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না।
--- তোমার কাছে পরিখা থাকতে পারে। আমার কাছে তো ছিল
না। থাকলেও, কোন পরিখা টপ্কে যাওয়া তো শুভ্রকান্তি’র পক্ষে কোন প্রবলেম নয়।
--- তাই বুঝি! তা তুমি যখন শুনলে যে, আমার বিয়ে হ’চ্ছে, তখন এলে না কেন?
জানতে চাইলে না কেন, ব্যাপারখানা কী?
--- কী ক’রতাম এসে? তোমার হাত ধ’রে ব’লতাম, ‘তুমি এমনটা কোরো না। আমি
ম’রে যাবো।’
--- বলতে।
--- তুমি তো জানো ঈশিতা, আমি ভালোবাসা ব’লতে দাসত্ব বুঝি না।
--- ওইখানেই তো ফাঁক, শুভ। ওইটাই তো ফাঁকি। ঐ
উত্তরটাই তো তুমি আজও আমাকে দিলে। আগেও দিয়েছো।
কথা-টা বুঝতে পারে না দুঁদে চিত্রপরিচালক
শুভ্রকান্তি, যার বানানো ফিল্ম দেখে ফিল্ম-এর গোড়ায় পৌঁছোতে ভালো ভালো দর্শকের
কাল-ঘাম ছুটে যায়। অথচ আজ এই সামান্য মহিলা’র সামান্য সামান্য কথাগুলো ওর
কাছে এমন দুর্বোধ্য লাগছে কেন? জানতে হবে। তাই প্রম্পট্লি জানতে চায়,
--- খুলে বলো।
শাড়ি’র আঁচলটা পেঁচিয়ে কোমরে আটকে
নিয়ে আস্তে আস্তে শুভ্র’র দিকে এগিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে ঈশিতা ব’লল--- তোমাকেও খুলে ব’লে দিতে হয় আজকাল!
দ্যাখো শুভ্র, আসলে তোমার বিরাট প্রতিভায় ক্রমশ আমি ঢাকা প’ড়ে যাচ্ছিলাম। নিজেকে
খুঁজে পাচ্ছিলাম না। হারিয়ে ফেলছিলাম আমার অস্তিত্ব। আমার নাচের স্কুল,
বাচ্চাগুলোকে নিয়ে আমার ছোট ছোট অনুষ্ঠান, ওদের-কে কম্পিটিশন মঞ্চে প্রাইজ
জেতানো--- সব কোথায় যেন জলাঞ্জলি যাচ্ছিলো।
--- কেন? তুমি আমার সাথে যে অনুষ্ঠানে, মহরতে বা
ফেলিসিটেশনে যেতে, সেখানে কি সম্মান পেতে না? সবাই জানতো, তুমি আমার উড বি। আমার
জগত কি তোমাকে যত্ন-আত্তি ক’রতো না, ব’লতে চাও? তোমার কি অমযার্দা হ’ত?
--- যত্ন-আত্তি ক’রতো তো। ভীষণ করতো। সেটাই
আমার বুকের মধ্যে একটা জ্বালা হ’য়ে জ্ব’লছিলো। তোমার
ছত্র-ছায়ায় বেশ সুখেই ছিলাম। সবাই বেশ ‘ম্যাডাম! ম্যাডাম!’ ক’রতো। কিন্তু আনন্দ
থেকে বঞ্চিত ছিলাম। মুষড়ে ছিলাম, ম্লান হ’য়ে ছিলাম। যেমন ক’রে রাতের উজ্জ্বল
নক্ষত্র দিনের আলোয় কোথায় হারিয়ে থাকে! যেদিন তোমার ঐ ছবিটা….. ঐ যে কী যেন নাম...!
হ্যাঁ, ‘সীমানা পেরিয়ে’…….ঐ ছবির মহরত ছিলো, আমাকে তুমি মহরতে আসতে ব’ললে, চাপাচাপি ক’রলে? আমি ব’ললাম, আমার নাচের
ক্লাশ আছে? মনে আছে? তুমি আমার ‘নাচের ক্লাস’ কথা-টাকে উড়িয়ে-ই
দিলে। তোমার চাপাচাপিতে আমি নাচের ক্লাশ ছুটি দিলাম। এমন তো হরবখত-ই আমায় করতে হ’ত। একটা ঘোরের মধ্যে
ছিলাম। যাবার জন্যে বাড়িতে সাজছি, এমন সময় একটা বাচ্চা মেয়ে আমার ঘোর-টা কাটিয়ে
দিলো। আমাকে ব’লে ব’সলো, ‘আন্টি, তুমি আমাদের আর নাচের ক্লাশ করাবে না?’ আসলে আমি বড় দেরি ক’রে বুঝি তো। সেদিন
ভেবে দেখলাম, আমি তো তোমার ফিল্মের কেউ নই। আমি তো ওদের আন্টি। নাচ শেখাই। ছবি’র মহরতে আমার কী কাজ!
কে চেনে আমাকে! আমার জগত-টা তো আলাদা। আয়না’র দাঁড়িয়ে বুঝলাম, আমি হারিয়ে
যাচ্ছি, আয়নায় আমার প্রতিবিম্ব-টাও হারিয়ে যাচ্ছে। মন ব’ললো, এটা ঠিক নয়। এসব
ভাবনা দূরে রেখে আবার নতুন ক’রে ভাবলাম, না, ভালবাসা’য় এসব ভাবতে নেই। কিন্তু
সেটাও কেটে গেলো সেদিন, যেদিন তুমি আমাদের বাড়ি-তে এলে। বাবা-কে মা-কে জানালে
আমাদের সম্পর্ক-টা। মা তোমাকে সন্দেশ আর জল দিল। তুমি কিন্তু কিছু-ই মুখে তুললে
না। এক কাপ চা-ও না। তোমার মধ্যে একটা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভাব দেখেছিল বাবা। আমিও
লক্ষ্য ক’রেছিলাম। সেদিন বুঝলাম, আমাদের সম্পর্ক-টা শুধু আমাদের দু-জনের নয়। দুটো
পরিবারের, দুটো সমাজের। আর সেটা হ’চ্ছে না, মিশ খাচ্ছে না। তাই
তুমি আমাকে ব’ললে, ‘আমাকে অপমান করলে কেন?’ তুমি কিন্তু ব’ললে না, ‘আমাকে ঠকালে কেন?’ এটাই ছিল আমাদের
মধ্যেকার সম্পর্ক। বাবা-ই ব’লল, ‘ভেবে এগোচ্ছিস তো, মা?’ সত্যি, ভেবে এগোইনি আগে।
এবারে ভাবলাম। তাই ছায়া হ’য়ে বেঁচে থাকা-টা পরিহার ক’রলাম, শুভ্র। তুমি ব’লছিলে না, পলাশ তোমার
থেকে বেশি কিছু কিনা? না, ও খুব সামান্য। কিন্তু এইখানটায় ও বেশি। ও কর্পোরেশনের সামান্য
লোয়ার ডিভিশনের ক্লার্ক। আমার-ই মতো। বড় ক্ষুদ্র। কিন্তু ও বেশি এই যে, আমরা একে
অন্যের ওপরে নির্ভর ক’রতাম। আজ তো ও নির্ভর করেই। আমি ওর স্ত্রী। ছায়া নই।
তখন একটু-ও রং নেই আকাশে। শুধু একটা আলো-র ছোঁয়া
মাত্র। কখন যেন কথাগুলো বলা শেষ হ’য়ে গেছে! কখন যেন ঈশিতা তাদের
লজের দিকে হাঁটা দিয়েছে! কখন যেন শুভ্রকান্তি এগিয়ে গেছে তার টয়োটা-র দিকে।
শুভ্র-র খেয়াল নেই। শুধু ও দেখলো, প্রাক-সন্ধ্যাকালে মাটি-তে ওর কোন ছায়া পড়ল না।
---------------------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন