গর্ভযন্ত্রণা
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়
--- তোমার হয়েছে-টা কী, ব’ইলবে তো, নাকি! রেতের পর রেত ঘুমুচ্ছোনি, ঠিক মতো খাচ্ছোনি, শরীলডা দড়ি-র মতো শুকিয়ে যাচ্ছে! তোমার ওপর কি তেনারা কেউ ভর-টর কিছু ক’রেছেন? কী হইয়েছে, খুলি তো বল।
নিবারণ তবু চুপ ক’রে ব’সে থাকে। তার মুখে আজ প্রায় মাস খানেক হোল, কোন কথা কেউ শুনছে না। মানুষ-টা কেমন চুপ মেরে গেছে। কে যে তাকে বান মেরেছে, কিম্বা কে তাকে তুকতাক ক’রেছে, তা তার বৌ মালতী বুঝতে পারে না। সে শুধু দেখে যে, তার সোয়ামী নিবারণ প্রায় সারা রাত জেগে ব’সে থাকে, মাঝে মাঝে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে, কী যেন বিরবির ক’রে বলে! গ্রামে, যেখানে ভাত জোটে না পেট ভ’রে, সেখানে তো লেখাপড়া-র বালাই নেই। তাই ডাক্তার-বদ্যি থেকে গুনীন-ওঝার মূল্য সেখানে বেশি। আর লেখাপড়া-র বালাই থাকলেই বা কী! শহর এলাকা, যেখানে শিক্ষা-দীক্ষা গড়াগড়ি খাচ্ছে, সেখানেও তো এমন একটা উপসর্গ বাড়ি-র কোনো মানুষের মধ্যে দেখলে বাড়ি-র মেয়ে-মানুষেরা শিক্ষিত-অশিক্ষিত নিবির্শেষে প্রায় এমনটাই ক’রে থাকে। ফলে জলপড়া, তেলপড়া, হাতদেখা, পা-দেখা, ছোটখাটো পুজো-মানত শুরু ক’রে দ্যায় মালতী। আজ মাস তিনেক এমনটা চ’লছে। কারণ-টা জানা যাচ্ছে না। এমন কি, এবারে মালতী-র মন থেকে এই ওঝা-গুনীনদের প্রতি ভরসা-টা উঠতে ব’সেছে। নিবারণের মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই। আজ ক-মাস হল।
ঠিক ক-মাস নয়, যবে থেকে মিনতি-কে দেখে চার বারের বার পাত্রপক্ষ পছন্দ ক’রে গেলো, তার ঠিক পরের থেকে এমনটা লক্ষ্য ক’রছে ও। ছেলে পিন্টু একেবারে ছোটো। তার সাথে তো কোনো আলোচনা চলে না। তাই গ্রামের একে ওকে ধ’রে ঝার-ফুঁক করার কাজটা মালতী চালিয়েছে এ্যাতদিন। নিবারন-কে গ্রামের পাঁচজন মানুষ চেনে, জানে। এমনকি মানে গোনে। শুধু গ্রাম কেন! শহর থেকে যে বাবু-রা আসে, তাদের মুখেও তো নিবারণের নামে সুনাম-সুখ্যাতি ঝ’রে পড়ে। তাদের কয়েকজন-কে ডেকেও কথা-টা ব’লেছে মালতী। তারা বলেছে,
--- তুমি মা। তুমি এটা বুঝলে না! মিনতি-কে দেখে পাত্রপক্ষ পছন্দ ক’রে গেছে। তার মানে কী? মেয়ে ঘর ছেড়ে চ’লে যাবে। সকলে তো একভাবে ব্যাপার-টা নিতে পারে না। নিবারণ দা তাতেই ভেঙ্গে প’ড়েছে।
কথা-টা তো মিথ্যে নয়। মালতী ভেবে দেখেছে। যখন মিনতি তার পেটে, তখন মালতী খুশি-তে যতটা না ভ’রে উঠেছিল, তার থেকেও একটা ভয় ওকে পেয়ে ব’সেছিল। প্রথম পোয়াতি হবার ভয়। পেট-টা যত ফুলে উঠেছে, ততই মনের মধ্যে একটা আতঙ্ক মালতী-কে গ্রাস ক’রছিলো। রাতে ঘুমোতে পারতো না, ভালমতো খেতে পারতো না।
তখন নিবারণ তাকে ব’লতো--- তুমি ঝে মা হ’তি চ’লিছো, গো। ভয় হবে নে! মা হওয়া কি মুখের কথা! ভয় পেয়ো নে। তাতে সন্তানের ক্ষেতি হবে। মন-টাকে শান্ত করো। দেখবে, তোমার সোন্দর সন্তান হবে।
কত বুঝতো নিবারণ! তারপরে দিব্যি ভালোয় ভালোয় মিনতি এলো, তার আট বছর পরে এলো পিন্টু। পিন্টু-র বেলায় কোন ভয় ছিল না মালতী-র। কিন্তু নিজে কেন নিজেকে শান্ত রাখতে পারছে না নিবারণ! গ্রামের মাধব কাকা বলেছে,
--- শুধু তো বিয়ে আয়োজন নয়, বউমা। তোমরা হ’লে মেয়েমানুষ। পুরুষমানুষের ভাবনা তোমরা বুঝবে নে। হাজার ভাবনা। আমরা গুছিয়ে দেব, তবে তো তোমরা ব্যবস্থা কইরবে, নাকি? তাই নিবারণ চিন্তেয় একটু ভেঙ্গি প’ড়িছে। বিয়ে ঝে অনেক ট্যাকার ব্যাপার। সব ঠিক হ’ইয়ে ঝাবে। নিবারণ আমাদের গেরামের গব্ব। এ্যাতবড় শিল্পী ও। ও ঠিক নিজেকে সামলে নেবে। তুমি বউমা, ওকে এসব নিয়ে ব্যস্ত ক’রনে। ধইজ্য রাখো।
মিনতি-র বিয়ে-টা ঠিক হ’য়েছে সামনের অঘ্রানে। সবে নতুন টাকা উঠবে ঘরে। এখন থেকেই তো শহরের বাবুরা নিবারণের কাছে আসতে শুরু ক’রেছে। বায়না দিচ্ছে। আগে থাকতে না দিলে নিবারণের গড়া প্রতিমা মণ্ডপে তোলা যাবে না। আর নিবারণ পাল প্রতিমা গড়েনি মানে, সে তো পাতে দেওয়া যাবে না। ঠাকুর গড়া শুরু হ’য়ে গেছে। যিনি যেরকমই অর্ডার দিন না কেন, গোড়াকার কিছু কাজ তো ক’রে রাখতেই হয়। সেই কাজ চ’লছে। নিবারণ কোনো কারিগর রেখে কাজ করায়নি কোনকালে। সে নিজে, আর তার মেয়ে-বউ। মূর্তি গ’ড়ে দ্যায় নিবারণ, আর তাকে সাজায় ওরা। মালতী এ কাজ বিয়ের পরেই শিখেছে সোয়ামীর কাছে। এখন তারও হাতের কাজের নাম আছে।
মূর্তি গড়া-র সময় নিবারণের সাথে মালতী-র একটা ঝগড়া হবেই হবে। মালতী নিবারণের চোখে একটা গগল্স প’রিয়ে দ্যায়। মেয়েদের শরীর গড়ার সময় তার সোয়ামী যেন সাদা চোখে না দেখে। পুরুষমানুষ-কে কোন বিশ্বাস নেই তার। বিয়ের পর প্রথম যেবার মালতী মূর্তি গড়া দেখলো, সেবার রাতে নিবারণ বিছানায় মালতী-কে বলেছিল,
--- পতিমা-র শরীর-টা গড়া-র সময় না, তোমার শরীর-ডা আমার মনকে এই প’রথম টানল।
মালতী বলেছিলও--- ছি! ছি! এসব কেউ বলে নাকি!
পটুয়াদের বংশে নিয়ম আছে যে, প্রতিমা গড়ার সময় কোন পাপ চিন্তা করা যাবে না । কিন্তু জীবনের অনুষঙ্গ কি নিয়মের তোয়াক্কা করে ! সেবার মিনতি পেটে এলো। তাই পরের বছর থেকে প্রতিমা গড়া-র সময় মালতী নিবারণের চোখে গগল্স আটকে দ্যায়। সেই প্রতিমায় যখন কাপড় পরানো হয়, তখন সেই গগল্স খুলে দ্যায় মালতী। এটা আজ সবাই জেনেও গেছে। প্রতিমা-ও গড়ে নিবারণ! দেখার মতো প্রতিমা। মাটি দিয়ে যেন প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে। কে ব’লবে, মৃন্ময়ী মূর্তি! রূপ যেন ফেটে পড়ে মূর্তি থেকে। মাঝে মাঝে মনে হয় মালতী-র, ‘অসুর মশাই কি দুর্গা-র পীরিতে পড়েছিল? অন্তত পড়া-টা অস্বাভাবিক নয়। তা নয়তো অতো বড়ো বীর একটা মেয়েমানুষের কাছে যুদ্ধে হেরে যায় কী করে!’ উত্তর পায় না মালতী। বাড়িতে বড়ো আয়না নেই, তাই। তা নয়তো মালতী নিজের শরীর মেপে মেপে দেখতো, দুর্গামূর্তি-তে যে আকৃতি দ্যায় তার সোয়ামী, তা থেকে ভালো তো নয়ই, কতটা খারাপ দেখতে তার নিজের শরীর। বড়ো হবার সাথে সাথে জানতো মালতী, তার শরীরে যে সম্পদ ঈশ্বর ভ’রিয়ে দিয়েছেন, তেমনটা ক’রে তাদের গ্রামের অনেক মেয়ের কপালে জোটে নি। কিন্তু তার সব অহংকার ভেঙ্গে দিয়েছে তার সোয়ামী নিবারণ। ঐ হাতে কী অদ্ভুত জাদু-তে সে গ’ড়ে তোলে প্রতিমা। এইটাই মালতী-কে বিরক্ত করে। মেয়েমানুষের শরীর কেমন ক’রে গ’ড়ে তোলে নিবারন! তাহলে ও কি বিয়ের আগে কোন না কোন মেয়েমানুষের শরীর দেখেছে? প্রমাদ গুনত মালতী প্রথম প্রথম। তা নয়তো মেয়েমানুষের মাই, পেট, মাজা, দাবনা কী ক’রে অমন ভয়ংকর বানায় ও? কী সব্বনাশ! বাবা এ কার হাতে তার মেয়ে-কে সঁপে দিলো! পরে এই উত্তরটা না পেলেও ধীরে ধীরে কেটে গেছে এসব ভাবনা। অভ্যেস হ’য়ে গেছে। কিন্তু একটা অভ্যেস হয়নি। যখন মলমের মতো মাটি হাতে নিয়ে প্রতিমা-র শরীরের নানা জায়গায় হাত বোলায় নিবারণ, তখন মালতী তা একেবারে সহ্য ক’রতে পারে না আজো। তাই তাকে গগল্স পরিয়ে কিছুটা শান্তি পায় সে। এটা নিয়ে নিবারণের সাথে অনেক ঝগড়া হ’য়েছে ওর। রাতের পর রাত।
কিন্তু এবারে শুধু ফ্যাল ফ্যাল ক’রে তাকিয়ে থাকাই নয়, বা কান্নাকাটি নয়। আরো কতগুলো উপসর্গ চোখে পড়ছে মালতী-র। একনম্বর, যেন প্রতিমা গড়ায় তেমন কোন উৎসাহ নেই নিবারণের। ইংরেজী-র তিরিশ তারিখে এবারে সবাই প্রতিমা ডেলিভারি নেবে। হাতে মোটে সময় নেই। এবারে আকাশটা বড়ো ঝামেলা ক’রছে। আবার কখন বৃষ্টি চ’লে আসে, ঠিক কী! কিন্তু নিবারণের কেমন যেন কাজে একটা গড়িমসি ভাব। একটা উদাসীনতা। দুই নম্বর, প্রতিমা গ’ড়ে দিয়ে যে তাকে সাজাবার দায়িত্ব দ্যায় মেয়ে-বৌ এর ওপর, এবারে তা দেয়নি। এই প্রথম ভাড়া ক’রে লোক এনেছে। কেন? বুঝতে পারে না মালতী। আজ আঠেরো বছর এই কাজ ক’রছে মালতী। এমন কী ত্রুটি সে ক’রল যে, তাকে একেবারে বাতিল ক’রে লোক ভাড়া ক’রতে হল! তিন নম্বর, কিছুদিন ধ’রে দেখছে মালতী যে, নিবারণ কেমন যেন মেয়ে-বৌকে একটু এড়িয়ে চ’লছে।
প্রথম প্রথম ভেবেছে, আজকাল তো ক্লাবগুলো নতুন নতুন কায়দা-র ঠাকুর চায়। সেসব ভাবতে ভাবতে একটু নিজের মধ্যে মিশে আছে মানুষ-টা। ঠিক হ’য়ে যাবে। তাছাড়া মেয়ে-টার বিয়ে নিয়ে নিশ্চয়ই একটু চিন্তায় আছে। টাকা-পয়সার ব্যবস্থা ক’রতে হবে। পাত্রপক্ষ এটা-ওটা দাবি ক’রেছে। তা তো মেটাতে হবে। মাধব কাকা ঠিকই ব’লেছে। এ ছাড়াও একটা মাত্র মেয়ে মিনতি। সে চ’লে যাবে শ্বশুরবাড়ি। সেটাও হয়তো বাবা নিবারণকে একটু ভেঙ্গে দিয়েছে। সবার দুঃখ তো এক রকম হয় না। কিন্তু বিষয়-টা এখন বেশ সন্দেহ করার মতো হ’য়ে উঠছে। একটা কোন গণ্ডগোল হ’চ্ছে কোথাও। বোধহয় মেয়েমানুষের মূর্তি বানিয়ে তাকে কাপড় পরালে এমনটাই হয়। পটুয়াদের যে একটা প্রথা আছে, বিশ্বাস আছে---দেবিমূর্তি বানাবার সময় কোনো পাপ চিন্তা ক’রতে নেই। তাতে সংসারের ক্ষতি হয়। এই বাড়িতে গড়া দেবী দুর্গা-র মূর্তি-কে কোনোদিন মালতী দেবীমূর্তি ব’লে ভাবতে পারেনি। এটা ওর কাছে মেয়েমানুষের মূর্তি হয়েই র’য়ে গেছে। এই দুর্গামূর্তি-র সাথে তার একটা প্রতিযোগিতা চিরকাল। রূপের প্রতিযোগিতা। শরীরী প্রতিযোগিতা। যতবার মালতী হারে, ততবার যেন এই প্রতিযোগিতা ঘন হয়। তার সোয়ামীর দুপাশে দুই নারী। দুর্গা আর মালতী। যেভাবে মূর্তিগুলোকে আদর ক’রে বানায় নিবারণ, তেমন ক’রে তাকে আদর করে কিনা, এটা এ্যাতকাল কত রাতে বার বার পরখ ক’রেছে ও। জোর ক’রে সোয়ামীর আদর আদায় ক’রেছে। পেয়েছে, কিন্তু মনে হ’য়েছে, কোথায় যেন ওর পরাজয় ঘ’টছে! মালতী শরীরে নিবারণকে পায় বটে। ও জানে, এই মূর্তিটা তা পায় না। কিন্তু এখন তো ব্যাপারটা বেশ সন্দেহজনক হ’য়ে উঠছে। হয়তো মনে মনে নিবারণ এই মূর্তি-টার সাথে মিলিত হয়। বোঝেনা মালতী, কোন মিলনটা বেশি আনন্দ দ্যায়। এই মূর্তি-টা ডাইনী-র মতো তার সোয়ামী নিবারণের মন-টাকে আচ্ছন্ন ক’রে রেখেছে। তা নয়তো কীসের জন্যে বউ-মেয়ের ওপর এই অবহেলা! ঠিক অবহেলা নয়। উদাসীনতা। মেয়ে-টা আজ বাদে কাল চ’লে যাবে। সে একটু সোহাগ ক’রে বাপের কাজে হাত লাগাতে গেলেই একেবারে রে রে ক’রে প’ড়ছে। মনে মনে বলে মালতী, ‘মিনতি কি নতুন হাত দিচ্ছে পিতিমায়! আমরা কি মোছলমান যে মেয়েরা কিছু ছুঁতে পারবেনে! এ্যাতকাল চ’লল, আর রাতারাতি সব বদলে গেলো!’ নিবারণ এ্যাতো অন্যমনস্ক ব’লে এবারে ভাড়া করা লোকগুলো অবধি মালতী-কে একদিন ডেকে ব’লল,
--- বউদি, দাদাকে একটু কাজে মন দিতে বলুন। আমরা কি নিবারণ পাল ঝে, এ বাড়ি-তে গড়া ঠাকুর আমাদের হাতে নামবে! দাদা-র কাজে পাঁচটা খদ্দের মুচ্ছো যায়, ঝে কোনো দাম দ্যায়। কিন্তুক এবারে যে মূর্তি ভালো হচ্ছে নে। কেলাবগুলো দাম ঠিক দেবে তো? তাছাড়া আপনাদের মেয়ের বিয়ে আছে নে? ট্যাকা লাগবে নে? মা তো এবারে আপনার হাতের কাজটাও পাচ্ছেন নে। আমরা কি নিবারণ বউদি-র মতো হাতের কাজ ক’ইরতে পারি!
বুকটা গর্বে ফুলে ওঠে মালতীর। কথাগুলো সব সত্যি। সব জানে মালতী। কিন্তু কী ক’রবে, ভেবে পায় না। একটা কিছু তো ক’রতে হবে। এভাবে তো চ’লতে পারে না। একটা হেস্তনেস্ত ক’রতে হবে। যদি সত্যি-ই ক্লাবগুলো পুরো টাকা না দেয়, তবে তো চিত্তির? এই তো বছরে বড়ো পুজোতে একবার, আর লক্ষ্মীপুজো-তে কিছু, কালীপুজো আরো কম। এই টাকা-টা ঘরে না তুলতে পারলে তো মহা সব্বনাশ। তাছাড়া প্রতিমা পছন্দ না হ’লে শুধু এই বছরেই ঝামেলা হ’তে পারে, তা তো নয়। ‘নিবারণ আজকাল ভালো প্রতিমা গড়ে না’, খবরটা হু হু করে ছড়িয়ে যাবে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। এটা পটুয়া পল্লী। এখানে বা বাংলার অনেক খানে অনেকেই নিবারণের নামে যে পঞ্চমুখ, সেটা কি অন্য পটুয়া ভালোভাবে মেনে নেয় কখনো? নেয় না। নিতে পারে না। তারা সামনে নিবারন-কে প্রণাম করে বটে, গুরু মানে বটে। কিন্তু সবাই ওর প্রতিদ্বন্দ্বী। ওরা চায়, নিবারণ-টা চুলোয় যাক, আর ওরা বাজার-টা ভোগ করুক। এসব তো নিবারণ-ই ব’লেছে মালতী-কে। তাহলে! বাড়ির মানুষের ওপর কীসের প্রতিশোধ নিচ্ছে মানুষ-টা! নাঃ, মিনতি মালতী-র নাড়িকাটা সন্তান। বাপে তো বিইয়ে দে খালাস হ’য়েছে। ন-মাস গর্ভে ধারণ সে করেনি মিনতি-কে। ক’রেছে এই মালতী। তাই মেয়ের জন্যে তাকেই ল’ড়তে হবে। সে মা। গর্ভধারিণী। কোনো আপোস সে ক’রবে না স্বামীর সাথে। পাত্তা না দেওয়া কি এ্যাতো সোজা কথা! আজ রাতেই ব্যাপারটা নিকেশ ক’রতে হবে। প্রতিমা গ’ড়বে না, তো খাবে কী? নিবারণের ভূত ছাড়াবার প্রতিজ্ঞা ক’রে নেয় মালতী।
রাতে মেয়েকে আগেভাগে খাইয়ে শুইয়ে দিয়েছে চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্যে। মেয়ের সামনে বাপ-মায়ে যুদ্ধ ক’রতে লজ্জা করে। এবারে নিবারণ-কে খেতে দিয়েছে। খুট খুট করে মানুষটা খাচ্ছে। যেন তাতেও অরুচি। কোনোদিকে দৃষ্টি নেই। লম্ফও-টা জ্বলছে। তার শিখা-টা যেন আর একটা শিখা জ্বালিয়ে দিয়েছে মালতী-র বুকের মধ্যে। আজ পুড়িয়ে দেবে নিবারন-কে।
--- কী ব্যাপার গো? তোমার কী হয়েছে, শুনি তো আজ।
নিবারণ বউ-এর মুখ থেকে ছুটে আসা এমন প্রশ্নের মুখে কোনোকালে পড়েনি। নানা বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে অনেক ঝগড়া-ঝাঁটি হ’য়েছে। কিন্তু সে তো দাম্পত্য। কিন্তু আজ যেন মালতী-র মুখ-টা আষাঢ়ের ঘনিয়ে আসা মেঘ। এক্ষুনি যেন সেখান থেকে কড়্ কড়্ করে সজোরে একটা বাজ প’ড়বে নিবারণের মাথায়। ভস্ম ক’রে দেবে ওকে। চোখদুটো মালতী-র জ্বলছে। কেঁপে ওঠে নিবারণ ভেতরে ভেতরে। কিন্তু অনেক কিছু বুঝেও যেন মালতীর এমন ক্রোধের কারণ বোঝে না মানুষ-টা। মালতীও তার সোয়ামী-কে আজ পর্যন্ত এমনভাবে কটু প্রশ্ন করেনি। নিজের কণ্ঠে নিজেই চম্কায় সে। কিন্তু না। আজ ধৈর্য চাই, শক্তি চাই, সাহস চাই। প্রতিটা বাক্য যেন শানিত ছুরিকা-র মতো নিবারণ-কে রক্তাক্ত করে। মালতী-র আজ রক্ত চাই। রক্তপাত না হ’লে যেন করালি মালতীবালা দাসী তুষ্ট হবে না। মনে হয়, রক্তপাতই যেন শেষ কথা, রক্তপাতই একটা সমাধান এনে দিতে পারে। অরণ্যের ঝোপঝাড়ে ডাকপাখি যেমন ক’রে ডেকে ডেকে তার গলা থেকে রক্ত তুলে ডিম ফুটিয়ে সন্তানকে পৃথিবী-তে আনে, তেমনই তো মা। আজ স্বামীর রক্ত ফেলে সন্তানকে বাঁচাবে আর এক মা। মালতীর একদিকে স্বামী, আর এক দিকে নবোঢ়া হবার অপেক্ষায় আত্মজা, ভ্রূণ থেকে জেগে ওঠা একটা গোটা যৌবনবতী নারী। মিনতি। আজ সেই প্রাচীন পুরুষের খামখেয়ালি-র বিরুদ্ধে এক নারীর যুদ্ধ এটা, এক মায়ের সংগ্রাম। অধিকারের সংঘর্ষ। পিছিয়ে গেলে চ’লবে না।
নিবারণকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার প্রশ্ন করে মালতী,
--- আমি কী ব’লছি? তোমার হ’য়েছে-টা কী? এভাবে ফ্যাল ফ্যাল ক’রে তাইকে এবার থেকে জীবনটা কাটাবে, ভেবিছো নাকি? পরিষ্কার ক’রি বলো, কী ঘটনা? আমার মেয়ের বিয়ে অঘ্রানে। তার যাবতীয় ব্যবস্থা ঝে ক’রতি হবে, সেটা কি হুঁশ আছে? আমার বাড়ির একটাই কাজ কিন্তু। এ বছরের প্রতিমা থেকে ঝেনো পুরো আয়টা মেয়ের বিয়েতে যায়। তোমার প্রতিমা গড়ায় মন নেই। যদি কেলাবগুলো টাকা-পয়সা নিয়ে ঝকমারি করে, তবে তোমাকে কিন্তু আমি ছেরি দেবো নে, সোয়ামী দেবতা। ব’লে দিলাম।
নিবারণ কোন কথা বলে না। নীরবে তাকিয়ে থাকে বউ-এর দিকে। তাকে যেন সত্যি-ই ভূতে ধ’রেছে। মালতী এ্যাতোটা ব’লে ফেলে হাঁপিয়ে যায়। ভাবে, এ্যাতোটা না ব’ললেও চ’লতো। নারীর মন। সাপের মতো ফণা তুলে দংশনও করে, আবার পরক্ষনেই ঝিমিয়ে পড়ে। তাই ঝিমিয়ে প’ড়ে নিবারণের হাতটা ধ’রে মালতী ফের ব’লল,
--- এ্যাতো ভাবছ কেন গো? মেয়ে তো শ্বশুরবাড়ি যাবেই। তাকে পাঠিয়েই তো বাবা-মার তৃপ্তি। তার নতুন সংসার হবে, স্বামী হবে, সন্তান হবে, সে সুখী হবে। সে তো একেবারে চ’লি যাচ্ছে নে। আসবে তো।
এবারে যেন ধরে প্রাণ এলো নিবারণের। গলা দিয়ে শব্দ বেরল। একটা বেদনাবিধুর দৃষ্টি নিক্ষেপ ক’রে ব’লল,
--- তুমি মিনতির কথা ব’ইলছ? সে তো তোমার মেয়ে। তোমার। বিয়ে হইয়ে চ’ইলে ঝাবে, আবার আইসবে। কিন্তু আমার মেয়ে? মিনতি ঝদি তোমার মেয়ি হয়, তাহলে তো আমার মেয়েদেরকে তোমায় চিনতে হয়। তারা তো একজন নয়। প্রত্যেক বছর তাদের জন্ম হয়। তারা উমা, পার্বতী, ইন্দ্রানী, সর্বানী, কমলা, ষোড়শী, চন্দ্রমুখী আরও কতও। প্রতি বছর আমি তাদের জন্ম দেই, আর তোমরা মায়ে-মেয়েতে মিলে তাদেরকে সাজিয়ে-গুজিয়ে পাইঠে দাও বাজারে, বিক্রি ক’ইরে দাও। সেই টাকায় তুমি তোমার মেয়েকে বাঁচাও, মেয়ের মান বাঁচাও। আর ঝারা কেনে, তারা কটা দিন আমার সুন্দরী মেয়েগুলোর খাতির যত্ন ক’রে শেষে ফেলি দ্যায় জলে। আমার স্বপ্নে গড়া, ভালোবাসায় গড়া, সৌন্দজ্জের এক একটা উপাদানে গড়া আমার শিল্প, আমার কন্যারা উমা, আমার পার্বতী যে ভেসি যাচ্ছে জলে, তা নিয়ে তোমাদের কোনো ভাবনা আছে কি? তোমার মেয়ের বিয়ে অনিশ্চিত ভেবি তুমি আমাকে আঘাত ক’রছো। কিন্তু আমার মেয়েদের কী হবে, ভেবিছো? আমিও তো তাদেরকে আমার কল্পনার গর্ভে ধ’ইরেছি। নিজের যন্ত্রণাটাই বুঝলে, হে গর্ভধারিণী! গর্ভধারিণীর যন্ত্রণাটা বুঝলে, আর গর্ভধারকের যন্ত্রণাটা বুঝলে না! তোমরা এ্যাতো নিষ্ঠুর!
আজ মালতী সব বুঝতে পারে। সত্যি-ই তো, এ কথাটা তো সে ভাবেনি। কেউ ভাবেনি। স্বামীকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখে তাকে মালতী দুহাতে জ’ড়িয়ে ধরে। তার মুখে নারীর অক্ষয় চুম্বন এঁকে দ্যায়। তাদের দুজনের চোখে জলের ধারা ব’য়ে যায়। নিবারণকে মালতী এই এ্যাতো বয়সেও আরও আরও চুম্বন দ্যায় সারা মুখে। এ্যাত চুম্বন সারা যৌবনকালটায় সে স্বামীকে দেয়নি। তার স্বামী যে গর্ভযন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে।
------------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন