টক টাইম
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়
--- সন্দীপ বাবু !
পেছন থেকে মাধব বাবু ডাকতেই ফিরে দাঁড়ালাম । দোকানদার মাধবদা ডাকছে । মনে মনে ভাবলাম, কীরে বাবা ! সেই টাকা-টা লোকটা গুনলোই গুনলো ! আর যদি বা গুনলোই, তবে ডাকছে কেন? আবার ভাবি, ডেকেছে তো ? ঠিক শুনেছি তো ? বেশি দিতে গিয়ে কম দিলাম না তো ? চোরের মন নানা কথা বলে ।
মাধব বাবু-র দোকান থেকে একটা নতুন মোবাইল কিনলাম । আমার মাল্টিমিডিয়া- ফিডিয়া দরকার নেই । যে কোনো একটা হ’লেই হোল । কিন্তু সেই মাল্টিমিডিয়া-ই কিনলাম । বস্তুটা ভালো দামী হ’তে হবে । মাধব বাবু-র যেন পরতা থাকে । তাই দাম বেশি দিয়ে কিনেছি । দরদাম করে রফা ক’রে তো টাকা গুণেই দিলাম । তাহ’লে ডাকছে কেন ?
মাধব দা । তাকে পাড়ার সকলে ডাকে ঐ এক নামে । এটাই তার ডাক নাম হ’য়ে উঠেছে আজ । বাবা-ও মোবাইল রিচার্জ করাতে এলে ডাকে ‘মাধব দা’ বলে, ছেলেও টাকা ভ’রতে গিয়ে সেই ‘মাধব দা’ । আমাদের বাজার থেকে বেরিয়ে যদি ডানদিকে টার্ন নেওয়া যায়, তবে একটা দশকর্মা র দোকানের পরেই মাধব বাবুর দোকান । দোকানে হরেক রকম জিনিস পাওয়া যায় । বাচ্চাদের স্কুলে যাবার পথে টিফিনের কেক, মিনারেল ওয়াটার, লেইজ, কুরকুরে ভাজা, ডট পেনের রিফিল, পেন্সিল, বেশ কিছু মাপের খাতা, চানাচুর, বাদাম নানা আকৃতির বয়ামে হরেকরকম্বা………। তার মধ্যে বহুদিন থেকে মোবাইল রিচার্জের একটা ছোট মতো ব্যবসা শুরু ক’রেছে সকলের মাধব দা । আর সত্যি সত্যি সকলেই আসে তার দোকানে রিচার্জ ক’রতে । ইজি-ও হয়, কার্ড-ও হয় । আমি জানি না, এতে কত পরতা থাকে রিটেলারের। আবার গত বছর খানেক ধ’রে দোকানে কয়েকটা মোবাইলও রাখছে সে । এই গুটিকয় । কমদামী । আজকাল যে চোদ্দ-পনেরো হাজার টাকা-র মোবাইল সেট দেখা যায় ছেলে-ছোকরাদের হাতে, তা নয় । ঊর্দ্ধে হাজার তিনেক দাম । আফটার অল, সকলের মাধব দা বেশ ব্যস্ত থাকে তার দোকান নিয়ে । আমার অফিসের পাশেই সাধারণত রিচার্জ ক’রি আমি । কিন্তু আমি ক্কচিত-কদাচিৎ এই দোকানটাতে যাই রিচার্জ ক’রাতে । তবে হয়তো কখনও কখনও চানাচুর বা বাদাম কিনতেও যাই । তাও সে ন-মাসে ছ-মাসে ।
সম্প্রতি আগের মোবাইলটা চুরি গেছে । চুরি না ব’লে ডাকাতি বলা ভালো । ট্রেনে । মোবাইলটা ট্রেনে কে যেন ব্যাগের চেন কেটে নিয়ে মেরে দিয়েছে । তাই ভাবলাম, নতুন একটা কিনতে হবে । কিনতেই হবে । না কিনলে তো সংসার টেঁকে না । যখন তখন ডিভোর্স হ’য়ে যেতে পারে । আমার মোবাইল তো জরুরী ফোন করা, আর ফোন এলে ধরার জন্যে । কিন্তু তার তো কোনো উপায় নেই । আগেরটা কেনার সময় ছেলে ব’লেছিলো,
--- বাবা, একটাই তো সেট কিনবে । বারবার তো নয় ।
এমন ক’রে ব’লল যেন আমি বাড়ি করছি । একটাই তো বাড়ি ক’রবো । বারবার তো নয়। এরা নতুন নতুন শব্দ আবিষ্কার ক’রছে । আজকাল এটাই চ’লছে । মোবাইল-কে সেট, সিনেমা-কে বই, আরো কত কি ! আবার সভ্যতায় মোবাইল যুক্ত হওয়ায় তো আরও শর্ট হ’চ্ছে শব্দভাণ্ডার । এস.এম.এস. মানে শর্ট মেসেজ । তাতে যা লেখে আজকাল, সব শর্ট-কাট । ইংরাজির ‘ইউ’ মানে ‘তুমি’ লিখতে গেলে সোজা এ্যালফ্যাবেটের ‘ইউ’- টা বসিয়ে দিচ্ছে । অথবা ইংরাজি হরফে বাংলায় ‘তুমি আর আমি’ লিখতে গেলে লিখে দিচ্ছে ‘U r me’।
যাইহোক, আমার ছেলে পড়ে ক্লাশ সেভেনে । ছেলের কথার মানে না বুঝে ব’ললাম---তা তোর মত-টা কী ? তুই চাইছিসটা কী ?
--- একটা মাল্টি মিডিয়া কেনো অন্তত । যাতে আমি নেট-টা ক’রতে পারি । মোবাইল-এ তো একটু সস্তা পাই ।
--- ক্লাশ সেভেনে নেট ! নেটে তুই করিসটা কী ?
--- ও কত রেফারেন্স থাকে । তা নয়তো মার্ক্স দেবে না ।
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল হ’তেও পারে । তাই একটা দ্ব্যর্থবোধক শব্দ বের হ’লো আমার মুখ দিয়ে--- অ !
ছেলে ব’লল--- তাছাড়া ধরো, তুমি অফিস যাচ্ছ । জ্যামে আটকে আছো । চুপচাপ বসা । কিচ্ছু করার নেই । তখন যদি মোবাইলে গান লোড করা থাকে, তবে ঐ সময় মনটা অস্থির হয় না। কানে ইয়ারফোন গুঁজে দাও । চোখের সামনে অসহ্য জগৎ থেকে মুক্তি । ব’সে ব’সে বা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান শোনো । তুমি যে গান পছন্দ করো । পুরনো দিনের বাংলা আধুনিকই সই ।
আমি কী ক’রে ওকে বোঝাবো, ওরে, বাস জ্যামে প’ড়লে কানে গান ঢোকে না । চোখের সামনে বসের আক্রোশ ভরা চোখদুটো ভেসে ওঠে । চাকরী কর্ । বুঝবি । আবার আমার মতো প্রাইভেটে । কিন্তু কিছু ব’লতে পারলাম না । আমার চোখমুখ-এর ভাব দেখে ছেলের মা লাফিয়ে প’ড়লো,
--- আহা ! ও তো ওর জন্যে কিনে দিতে বলেনি । তোমার জিনিস, তোমাকেই একটা পরামর্শ দিয়েছে । তোমারই স্বার্থে । সন্তান বড়ো হ’লে তাদের কথা একটু-আধটু শুনতে হয় । তবে তো ওরা বোঝে যে বাবা-মা ওদেরকে মূল্য দ্যায় ।
বেবি-র কথাটা মিথ্যে নয় । হয়তো এতদিনে ছেলের মা একটা মূল্যবান কথা ব’লে ফেলেছে । তাকে মূল্য দিতে হবে । শুনতে হবে ছেলের কথা । কিনলাম সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে একটা ঝাঁ চক্চকে মোবাইল সেট । ব্যস, সন্তানের মাতা অচিরেই বুঝে গেলেন, কেন সন্তান তার বাবা-কে সেটি কেনাবার জন্যে চেপে ধ’রেছিলো । বাড়িতে ঢোকা মাত্রই সেটা চ’লে যেতো ছেলের হাতে । সে তখন এটা টিপছে, সেটা দেখছে, আর কানে আছে সেই ইয়ারফোন । আমার মোবাইলে একটিও বাংলা আধুনিক গান লোড করার কোন জায়গা সে রাখেনি । তার পরিবর্তে গাদা গাদা মুম্বাই মার্কা গানে ভ’রে দিয়েছে । আমি বাড়ি এলে সেলফোনটি সে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যায় । ব’লে যায়,
--- বাবা, তোমার ফোন এলে ঠিক তোমার ঘরে পৌঁছে দেবো ।
প্রথম দিন কিছু না ব’ললেও পরে বুঝলাম, এবং দেখলাম, সে কানে ছিপি গুঁজে শুনছে তো শুনছেই । মাথা নাড়ছে তো নাড়ছেই । কোথায় নেট, কোথায় কী ! ভাবলাম, মাধব বাবু বোধহয় এতে গান-টান লোড ক’রে দিয়েছেন । ছেলেকে জিজ্ঞেস ক’রতে শুনলাম, এতে নাকি পড়াশুনোয় ওর কনসেন্ট্রেশন বাড়ে । কে জানে, এটা কোন শ্রেণীয় কনসেন্ট্রেশন । আমরা তো আর কনসেন্ট্রেশন দিয়ে পরাশুনো ক’রিনি । রাস্তাঘাটেও সেই একই দৃশ্য । ছেলেমেয়ে--- সব চ’লেছে কানে ছিপি গুঁজে । হয় গান শুনছে, নয় কথা ব’লছে । কী যে ব’লছে, কাকে ব’লছে, কে জানে । এ্যাতো টকটাইম পাচ্ছে কোথা থেকে? তাই বা জানে কে ? টেলিভিশনে যে এ্যাতো বিজ্ঞাপন, ‘কানে মোবাইল নিয়ে গাড়ি চালাবেন না, মোটর সাইকেল চালাবেন না, রাস্তা পার হবেন না, রেল লাইনে হাঁটবেন না’--- তা কে শোনে কার কথা ! আজকাল তো বিজ্ঞাপনে লিখছে ‘এ কথাই শেষ কথা নয়তো ?’ তবুও কে শোনে ! মানুষকে নাকি এ্যাওয়ার ক’রতে হবে । একটা বাচ্চাও তার জানের মায়া করে । কোনো উঁচু জায়গা থেকে সে লাফিয়ে নামে না । জানে, পড়ে যাবে । আর এই দামরাগুলোকে নাকি এ্যাওয়ার করতে হবে । হেসে বাঁচি নে ।
পরদিন যখন অফিস যাবার সময়, তখন মোবাইল সেট-টা আমার হাতে আসে । দেখি, তিন-চারটে মিস্ড কল । হয় অফিসের হেড ক্লার্ক, নয় স্বয়ং বসের কল, অথবা আমার পাশের টেবিলের দাস-দা, নতুবা ট্রেন পথের একটা সহযাত্রীর ।
এতো গেলো ছেলের নাটক । এবার তার মাতৃ দেবী । রবিবার তো বটেই, অন্য অন্য দিন তার ছেলের থেকে তার দয়াময়ী মা মোবাইল-টা কেড়ে নিয়ে যায় । এরপর চলে গপ্পো । এর সাথে বা তার সাথে । অকারণ । ‘এই কী রাঁধলি ? শাশুড়ি কী ব’লল ? কোন সিরিয়াল দেখলি ? কোন কোন দৃশ্যে কাঁদলি ? অমুক ক্যারাকটার-টা বেজায় পাজি, তমুক ক্যারাকটার-টা ভীষণ ভালো, এরপর কী হবে, হয়তো তমুকের বিয়েই হবে না…. ইত্যাদি। তারপর ফোনের অপর প্রান্তে যে আছে, তার ছেলের বৌ-এর আদ্যশ্রাদ্ধ করা, আর একজনের বিবাহিতা মেয়ের শাশুড়ির সপিণ্ডকরন করা তো আছেই । আমার টকটাইম যায় । কাজের কথা ব’লতে গিয়ে দেখি, টাকা নেই । যাকে আজকের ভাষায় বলে--- ‘ব্যাল্যান্স নেই ।’ তাই আমি ডিস-ব্যাল্যান্সড হই ।
সেদিন রবিবার । একটা জরুরী ফোন করবো । ছেলের ঘরে গিয়ে দেখি, মোবাইলটা তার কাছে নেই । তার মার কাছে । শুনলাম, তিনি কাকে যেন ফোনে আগের দিন দেখা একটা মেগা সিরিয়ালে কী কী ঘটেছে, তার ফিরিস্তি দিচ্ছেন । ফোনের অপর প্রান্তে যে আছে, সে নাকি আগের দিন কোথায় গিয়েছিলো । সে দেখতে পায়নি সেই জ্বালাতনি সিরিয়ালের খলচরিত্রের জনৈকা প্রতিবেশিনীর শয়তানি-বজ্জাতি কাণ্ড । মাথাটা গরম হ’য়ে গেলো । অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবে মোবাইলটা হাত থেকে কেড়ে নিলাম । ধ’মকে উঠলাম,
--- এটা কী হচ্ছে ? এটা কি সমাজসেবার বিনি পয়সার সেলফোন নাকি ? তোমাদের কি একটু কাণ্ডজ্ঞান থাকবে না ! পয়সা আয় ক’রেছো জীবনে ? জানো, তার কী মূল্য ? জানলে এভাবে নষ্ট ক’রতে না ।
ব্যস, ফুটন্ত তেলে যেন বেগুন পড়লো । কেঁদে-কেটে আমার সিরিয়ালপ্রেমী সমাজসেবিকা স্ত্রী একটা ভয়ানক কাণ্ড ক’রলেন । এ্যাতোটাই ক’রলেন যে, আমি ভয় পেয়ে গেলাম । দেখলাম, আমার ব্যাল্যান্সে আছে মাত্র পনেরো পয়সা । কার মাথা ঠাণ্ডা থাকে ! তখন বৃষ্টি প’ড়ছে । ছুটে গেলাম মাধব বাবুর দোকানে । এখনই টাকা ভ’রতে হবে। একটা ফোন ক’রতে হবে দাস দা-কে। জরুরী । তবে এই ফোন কেলেঙ্কারির বিরাট খেসারতই শুধু দিতে হলো না আমাকে, আমার গায়ে এক বালতি কালো রং ছুঁড়ে দিলো সেই দিনটা ।
সেদিন তো রান্না-বান্না কিছুই হোল না । কোনোরকমে আলুভাতে, কুমড়ো ভাতে--- এইসব ভাতে ভাত ক’রে খেলাম বাপ-বেটায়। কিন্তু বেবি, মানে আমার স্ত্রী সেদিনকার মতো অনশন ক’রলেন । কাকুতি-মিনতি ক’রে কোনো লাভ হোল না। উপোষ করা তার একটা বাতিক আছে । ফলে সেটা বিরাট কিছু নয় । কিন্তু পরেরদিন সেই উপোষ থাকতে একটু অসুবিধায় প’ড়লাম । অবশেষে তার হাতে তুলে দিলাম আমার মোবাইল । তার সাথে পাঁচশো টাকার টকটাইম । মাসের শেষ । এ্যাতো টাকা ভরার কোনো মানে হয় না । দাস দা-কে ফোন ক’রে ব্যাল্যান্স চেক করতে গিয়ে দেখি, ভরেছি, তেত্রিশ টাকা আর ব্যাল্যান্স দেখাচ্ছে পাঁচশো বারো টাকা । চেপে গেলাম । এখন তো ঘর সামলাই । তখন বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি আর ঘরেও অঝোরে ঝ’রছে । ছেলে পর্যন্ত আমাকে দোষ দিয়ে ব’লল,
--- হাতি ঘোড়া তো নয়, বাবা । তোমার সবটাতে বাড়াবাড়ি । মা- টা সারাদিন বাড়ি থাকে । একটা চেঞ্জ তো লাগে । একটু ফোনে কথা বলে । এই তো ।
মনে মনে ভাবলাম, তাই তো । বেবিকে নিয়ে তো কোথাও যাইও না আজ বহুকাল। মহিলার তো কোনো দাবি-দাওয়াও নেই । না শাড়ি-টা, না নাইটি-টা, না চপ্পলটা। সাজগোজ তো দূর । তাই টকটাইম ভরা মোবাইলটা তার হাতে তুলে দিয়ে ব’ললাম,
--- নাও বাবা, যত ইচ্ছে কথা বলো । আমি কৃপণ নই । কিন্তু সাধ্য-অসাধ্য ব’লে তো একটা ব্যাপার আছে । তাই কটু কথা ব’লে ফেলেছি ।
একেবারে হাতে-পায়ে ধ’রে তাকে এই বুড়ো বয়সে অভিমান থেকে মুক্ত ক’রি । আমি বরাবর নারীদেরকে ভয় পাই । বিবাহ ক’রতে হবে, তাই ক’রেছি । ছাত্রজীবনে কোনোদিন আমি কোনো নারী-র সংস্পর্শে আসিনি । কোথায় যেন প’ড়েছিলাম, ‘একজন পুরুষ একটি মানুষের বা একটি নারীর, ঊর্দ্ধে একটি অঞ্চলের ক্ষতি ক’রতে পারে । কিন্তু একটি নারী নাকি গোটা বিশ্বকে ডুবিয়ে দিতে পারে ।’ ‘হেলেন অব ট্রয়’ মনে আছে । ফলে কে প্রেম ক’রতে যাবে এমন বিদ্ধংসী চরিত্রের সাথে ! বিবাহ তো আর প্রেম নয় । পাঁচশো টাকা টকটাইম পেয়ে বেবি সেদিন এবং পরের দিন প্রচুর বকবক ক’রেও, প্রচুর আল্তু-ফাল্তু ব’কেও টকটাইম শেষ ক’রতে পারেননি । তাতে সে বেশ খুশি । আশ্চর্য ! এইটুকু দাবী ! এইটুকু অভিমান !
আমার সংসার বেঁচেছে । কিন্তু কার দৌলতে ? মাধব বাবু । মাধব বাবু বাঁচিয়ে দিলেন আমার প্রায় ভেঙ্গে পড়া পড়ো পড়ো সংসার । তা নয়তো আমার স্ত্রী-র ষণ্ডা-ষণ্ডা ভাইরা আছে না, তারা এই বুড়ো বয়সে আমার ছাল তুলে দিতো । নো কেস, নো কামারি। সোজা ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট । সেই যে কোন সিনেমায় কে যেন অভিনয় ক’রতে গিয়ে নাকি ব’লেছে একটা কথা, ‘মারবো এখানে, লাশ প’ড়বে শ্মশানে ।’ তেমন আর কি ।
সেই মোবাইল-টা হারালো । হারলো তো না, চুরি গেলো । প্রথমটা ভেবেছিলাম, আর কিনবো না । এর দুঃখ ভুলতে ভুলতে আমার বাকি জীবন কেটে যাবে । কিন্তু কিনতে হোল । একটা সময় ছিলো, যখন এই ফোন, মানে এক সময়ের ল্যান্ড লাইন, আর আজকের মোবাইল সেট ধনী মানুষদের আভিজাত্যের প্রতীক ছিলো । এই তো গত নয়ের দশকে এলো মোবাইল । কিন্তু আজ এটা আমার কাছে শুধু নয়, অনেকের কাছে একটা অপরিহার্য মাধ্যম হয়ে উঠেছে । একেবারে খাদ্য-পানীয়ের মতো । মানুষের আজকে অল্প খেতে পেলেও চ’লবে, কিন্তু মোবাইল চাই । এমনকি খাদ্য-পানীয় রোজগার ক’রতেও আজ মোবাইল । এমনকি, রিকশয়ালা তার লুঙ্গি তুলে ভেতরে পড়া শর্ট প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের ক’রে কি কি কিনে নিয়ে বাড়িতে ফিরতে হবে, তার ফিরিস্তি নিয়ে নেয় বউ-এর থেকে । মোবাইল তাই কিনতেই হবে আর একটা।
মাধব বাবুর কাছে আমার একটা ঋণ হ’য়ে গেলো । অকথিত, অলিখিত, আর অননুমোদিত ঋণ । সেটা জানি কেবল আমি । আর কেউ জানে না । তাই ভাবলাম, যাই, মাধব বাবুর দোকান থেকে মোবাইল-টা কিনে আনি । অন্তত একটু ঋণ পরিশোধ ক’রতে পারবো । ইচ্ছে ক’রলেই আমার অফিস পাড়া থেকে কিনতে পারতাম । সেখানে হাজার সেট থাকে। বেছে বেছে কেনা যায় । মাধব বাবুর দোকানে তো গুটিকয় । তবু এ তো আমার পাপ বা ঋণ স্খালনের সুযোগ দেবে । আসলে ঋণটা কী, মাধব বাবুকে ব’লেই দিতে পারতাম । কিন্তু আজকে এ্যাতোটা দেরী হ’য়ে গেছে যে, সে প্রসঙ্গ তুললে তার চোখে আমিই ছোট হ’য়ে যাবো । ও দোকানদার । আর আমি শিক্ষিত বাবু । তাই থাক । অন্যভাবে, মানে ঘুরিয়ে ঋণটা পরিশোধ করা যাবেখন ।
দোকানে গিয়ে এটা দেখি, সেটা দেখি । যে ক’টা মোবাইল ছিলো, তা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবকটাই দেখলাম । মাধব বাবু অগত্যা ব’ললেন--- মোবাইল কিনবেন ? আপনি তো কলকাতা যান । সেখানে তো হাজার সেট পাবেন । আমার কাছে তো এই গোটা পনেরো-কুড়ি । আপনার চলবে ?
--- আরে মশাই, মোবাইল মানে তো আমি সিনেমা বায়স্কোপ দেখবো না । কল ক’রবো, আর কল ধ’রবো । ব্যস। তাতে এ্যাতো বাছার কী আছে !
--- সে তো বটেই । তবে আমার কাছে কিনলে আমি আপনার একটা উপকার ক’রতে পারি ।
--- কী, বলুন তো ?
--- আপনার হারানো যে নম্বরটা ছিলো, সেটা পাইয়ে দিতে পারি ।
--- তাই নাকি ? পারবেন ! আর টকটাইম ?
মাধব বাবু সদর্থক ঘাড় নাড়তেই আমি ফের বললাম--- তাহলে তো খুব ভালোই হয় । ঐ নাম্বারটা তো অনেককেই দেওয়া । নতুন ক’রে নম্বর নেওয়া মানে তো আবার ডকুমেন্ট জমা দাও, সিম নাও, টাকা দাও, আবার খরচা ক’রে পরকে জানাও যে, তোমার নতুন নম্বর হ’য়েছে ।
মাধব বাবু ব’ললেন--- না না । আজকাল আর সিম নিতে টাকা দিতে হয় না । পেঁয়াজের দাম আঠেরো টাকা হ’লেও সিমের কোনো দাম নেই । এরপর তো মাংস রাঁধতে গেলে দেখবেন তাতে পেঁয়াজের বদলে সিম বেটে দিলেই মাংসটা ঝাল হয়, মেটে হয় আশিটা । কিন্তু এটা আমি ক’রিয়ে দেবো ।
আমি বুঝলাম যে, মাধব বাবু আবার আমাকে ঋণে আবদ্ধ ক’রছেন । তাই ব’লতেই হোল--- বাঁ, এটা তো বেশ সুবিধে । তাহলে তো আপনার থেকে মোবাইল না নিলেই চলে না ।
মাধব বাবু সবিনয়ে ব’ললেন--- সেকি ! আপনারা আমার নিত্য দিনের খদ্দের । আপনাদের তো একটু কিছু পাইয়ে দিতে হবেই । না নিলেও। এটা তো আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে । তবে আমি হলফ ক’রে ব’লতে পারি, আপনি যদি আমার থেকে মোবাইল নেন, তবে আমি কলকাতার দাম থেকে একটা পয়সা বেশি নেবো না । আপনি যাচাই করে দেখে নেবেন ।
আমি মনে মনে ব’ললাম, ‘তুমি তো জানো না মাধব বাবু, তুমি আমাকে কী পাইয়ে দিয়েছো মাসের একবারে শেশ লগ্নে । আমার পরিবারের মধ্যে যে ঝামেলার পাহাড় গ’ড়ে উঠতে উঠতে, আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিতে নিতে নেয় নি, সে তোমার কৃপায় । তাতে আমি তো এমনিতেই আকণ্ঠ ঋণে নিমজ্জিত । অবশ্য তুমি জেনে বুঝে কিছু করোনি। জেনে বুঝে কেউ কারোর জন্যে কিছু করে না । জানলে তুমিও ক’রতে না । তবুও তো ক’রেছ । আমাকে আমার স্ত্রী এখন আর কঞ্জুস, পরশ্রীকাতর, আত্মসুখী বলে না । অন্তত কিছুদিনের জন্যে তো তার মুখটা আমি চেপে ধ’রতে পেরেছি । তাই আমিও সবিনয়ে বললাম,
--- যাচাই করার কী আছে ! আপনি তো পাড়ার মানুষ ।
অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো। আমি কিনলাম মাধব বাবুর সাজেশান মতো একটা মোবাইল সেট । দাম সাতাশ শো । আমি ওআলেট থেকে টাকা গুনে গুনে দিয়ে এলাম তাঁকে । তারপর যখন মুখ ঘুরিয়ে হাঁটা দিয়েছি, মাধব বাবু পেছন থেকে ডাকলেন ।
ফিরে গেলাম । তিনি হেসে বললেন--- আপনি বোধহয় খুব অন্যমনস্ক রয়েছেন, না ?
আমি প্রশ্ন করলাম--- কেন, বলুন তো ? কী হয়েছে ?
--- আমরা দোকানদার । আমরা বুঝতে পারি, মানুষ কম টাকা দিলে অন্যমনস্ক হ’য়ে দ্যায় না । অন্যমনস্ক মানে বেশি পেমেন্ট । আপনি একটা পাঁচশো টাকার নোট বেশি দিয়েছেন । বস্তুত সেদিন অফিসে একটা ফাউ পেমেন্ট পেয়ে গিয়েছিলাম । এটাকে উৎকোচ না বলাই ভালো । দোকানে গিয়ে মনে মনে ভেবেছিলাম যে, উৎপাতের ধন আজ চিতপাতে যাক । তাই টাকাটা বেশীই দিয়ে দি-ই মাধব বাবুকে । আমি তো পাপ স্খালনের জন্যে টাকা-টা দিয়েছিলাম । ভেবেছিলাম, লোকটা বোধহয় টাকা-টা তেমনভাবে গুনে-টুনে দেখবে না । আমি অঞ্চলের মানুষ । তায় বিশিষ্ট ভদ্রলোক । এমনকি তাঁর দোকান থেকে নয় নয় করে সাতাশ শো টাকা দামের মোবাইল কিনেছি । সেই মানুষ পেমেন্ট ক’রছে । চুপচাপ টাকা-টা নিয়ে নেবে । কিন্তু সে যে গুনে নেবে, তা অনুমান ক’রিনি । তদুপরি ভেবেছিলাম, যদি টাকা গোনেও, তবে হয়তো এ্যাতোগুলো টাকা বেশি দেখে প্রাণে ধ’রে ফেরত দেবে না। দোকানদার মানুষ । সামান্য মার্জিনে কারবার করে । টাকা-টা চুপচাপ পার্সে ঢুকিয়ে নেবে । অন্তত আমি তো ফেরত দেবার পার্টি নই । তাই মৃদু হেসে ব’ললাম,
--- আপনি গুলিয়ে ফেলেছেন । আপনার ক্যাশবাক্সের পাঁচশো টাকার নোটের সাথে মিলিয়ে ফেলছেন ।
--- না না । টাকা-টা তো আমি ঢোকাইনি । তাছাড়া আমাকে পাঁচশো টাকা-র নোটে কেউ আজকে পেমেন্ট করেওনি । ক্যাশবাক্সে আসবে কোথা থেকে ?
--- আপনি শিয়্যোর ? আমি তো টাকা এ.টি.এম. থেকে তুলেছি । সেখানে বেশি দেবে কী করে !
কিন্তু টাকা টার নম্বরটা আমাকে ধ’রিয়ে দিলো যে, ওটা আমার ই টাকা । আমি তো টাকা-টা এ.টি.এম. থেকে তুলিনি । এটা ব্যাঙ্ক থেকে কালেক্ট করা সেই ফাউ টাকা-র বাঞ্চ থেকে আমি দিয়েছি । আজও আমি ব’লতে পারিনি যে, ওটা আমি ইচ্ছে ক’রে দিয়েছি । আমি মুক্তি চাই । এই বোঝাটা আমি বেশ কিছুদিন ধ’রে ব’য়ে বেড়াচ্ছি । এবার নামাতে চেয়েছিলাম । কিন্তু পারলাম না । মাধব বাবুর কাছে ধরা প’ড়ে গেলাম । মাধব বাবু তখনও হাসছেন । একটা মলিন হাসি । এই মলিন হাসিটা কিছুদিন ধ’রেই তার ঠোঁটে ঝুলছে, দেখেছি । আগে এমনটা ছিলো না । এখন পাড়ার দোকানদার, পোস্টম্যান, মাসে মাসে আসা গ্যাস ডেলিভারার, তিনমাস অন্তর আসা ইলেকট্রিক মিটার রিডার, বা বৃষ্টিতে কাকভেজা ভিজে যাওয়া চুপচুপে হ’য়ে কদাচিৎ আসা ক্যুরিয়ারের ছেলেগুলোর ব্যক্তিগত জীবনে কী কী ঘটলো, সে কে-ইবা খবর নেয় ! ফলে জানতে চাইনি কোনোদিন, আপনার কী হয়েছে । বেশ তো একটা মিষ্টি হাসি দিতেন দোকানে কাস্টমার এলে ! আজকাল এমনটা কেন ? ব’লে দিলেন মাধব বাবু নিজেই ।
আমার কথা শুনে শুকনো হাসি হেসে বললেন--- জানেন সন্দীপ বাবু, কত মানুষ দেখি এই ছোট্ট দোকানটাতে ব’সে ব’সে । যেন বিশ্ব দেখি । তাদের কত না চরিত্র, কত না মানসিকতা ! আপনাকে তো দেখছি এ্যাতদিন । জানেন, ক-দিন আগে কে যেন ফোনে রিচার্জ ক’রতে এসেছিলো । বোধহয় তেত্রিশ টাকা চেয়েছিল । আমি এ্যাতোটা অন্যমনস্ক ছিলাম যে, আমি ভুল করে পাঁচশো তেত্রিশ টাকা রিচার্জ ক’রে ফেলি । লোকটা কিন্তু চ’লে গেলো । কে যে সে-টা আমি হ’দিস ক’রতে পারলাম না । সে কিন্তু ফিরে এলো না । আর আপনি পাঁচশো টাকা আমাকে এভাবে পাইয়ে দিচ্ছেন । মানুষ কত রকমের হয় !
আমার গা-টা কাঁটা দিয়ে ওঠে এই কথায় । আমি সন্দেহ নিরসনের জন্যে বলি--- আপনি তার নাম্বারটা দেখেন নি ? সে নাম্বার তো আপনার রিচার্জ করার মোবাইলে আছে।
--- এটাই তো ভাগ্যের পরিহাস, মশাই । সেদিন ভুল ক’রে আর একটা কাজ আমি ক’রে বসি । ঐ মোবাইল-টা দোকানেই থাকে । অনেক টাকা ওতে ভরা থাকে তো । সঙ্গে নিই না । যদি কোথাও হারিয়ে যায় । আজকাল যা মোবাইল চুরি হয় ! কিন্তু সেদিন ভুল ক’রে সেটা পকেটে ফেলে বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে পড়ি । হাসপাতালে যাচ্ছিলাম । সেটা যে কাছেই আছে, সাবধান হ’তে হবে বৃষ্টিতে, তা তো মনে ছিলো না । পুরনো কমদামী মোবাইল । জলে ভিজে সেটা শেষ । যে টাকা ভরা ছিলো, সেটা তো পেয়ে গেছি কোম্পানী থেকে । কিন্তু সেই পাঁচশো টাকা কাকে দিয়েছি, তার খবর নিতে পারিনি । সে বড়ো ঝামেলা । তাছাড়া জানলেই কী ! কত মানুষ এখান দিয়ে যায় । সবাই তো পাড়ার নয় । পাড়ার মানুষ তো এমনটা ক’রবেনা । তাই তার হদিশ পাবো কী ক’রে ? সেদিনই টাকাটা বড়ো দরকার ছিলো । কিন্তু আজকে এই অতিরিক্ত টাকাতো আমার কাছে নিতান্ত নিষ্প্রয়োজন ।
টাকা দরকার নেই ! এ কথা এই প্রথম শুনলাম । মনে হ’লো, টাকা কি শুধু দরকারি ? টাকা মানে টাকা । এলেই তা পকেটে রাখতে হয় । টাকা কি দরকারের জন্যে মানুষ আয় করে নাকি ! তাছাড়া মানুষের দরকারের তো কোন লিমিট থাকে না । রতন টাটা কি মনে করে, তার এ্যাতো টাকা আছে । আর দরকার নেই । তাই ব’ললাম,
--- আপনি এ্যাতো অন্যমনস্ক ! তাহলে দোকান চালান কী ক’রে ? পদে পদে তো এমন নানা ঘটনা ঘ’টবে ।
মলিন হাসি দিয়ে সে বলে--- না । তা ঘটে না । আর ঘ’টবেও না । আসলে সেদিন আমার স্ত্রী চলে গেলেন ।
--- চলে গেলেন ! কোথায় ? আমি বোকার মতো প্রশ্ন ক’রি ।
ভদ্রলোক দোকানে একটা মহিলার ছবি আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন । দেখলাম, তাতে নতুন মালা দেওয়া, চন্দনে চর্চিত । কোনো কথা যোগালো না মুখে । শুধু ব’লতে হয়, তাই ব’ললাম--- ও ! বেশ সুন্দরী ছিলেন আপনার স্ত্রী।
মাধব বাবু তার উত্তর না দিয়ে বললেন--- ক্যান্সার । এবার ব’লুন তো, এই বেশি টাকা নিয়ে বা আপনার কাছে ঋণগ্রস্ত হ’য়ে আজ আমি কী করবো ? আমার খরচ তো তিনি ছেড়ে চ’লে গেছেন ।
ব’লে টাকা-টা আমার হাতে গুঁজে দিলেন । মাথা নিচু ক’রে নিলাম টাকা-টা স্বীকার ক’রতে পারলাম না যে, আমি কোনো মহাপুরুষ-টুরুশ ন’ই । অপরাধ করার থেকে অপরাধ স্বীকার করে নেওয়া যে অনেক কঠিন, সেটা আমি হাড়ে হাড়ে সেদিন উপলব্ধি ক’রলাম । আজ পাপ স্খালনের জন্যে এসেছিলাম । কিন্তু পারলাম না । আমি যে ভদ্রলোক ! কী করে বলি সত্যি কথা-টা ! তথাকথিত ভদ্রলোকরা যে সত্যি ব’লতে জানে না । পথেঘাটে চোখের সামনে ঘ’টে যাওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যি কথা ব’লতে পারে না, আদালতে কোনো অন্যায়ের শিকার হওয়া মানুষের সমর্থনে সত্যি ব’লে তার পাশে দাঁড়াতে পারে না, অন্যায় করে স্বীকার ক’রতে পারে না, তর্ক করে, ‘আমিই ঠিক ।’ আমিই তো সেই ভদ্রলোক । মাথা নিচু ক’রে বাড়িতে এলাম । এই পাঁচশো টাকায় তো আমি কপালবশত সেদিন আমার ক্ষেপে ওঠা স্ত্রী-কে খুশি ক’রেছি । সে নানা মানুষের সাথে আল্তু-ফাল্তু কথা ব’লেছে । যার সাথে কস্মিনকালে কোনো সম্পর্ক নেই, তার হাঁড়ির খবর নিয়েছে, আর আমাকে ভেবেছে ‘পতি পরমেশ্বর’। অকারণ টকটাইম বাড়িয়ে নিয়েছে । আর আমি ? আসলে আমি আমার টকিং পাওয়ার হারিয়েছি । আমি চুরি ক’রেছি।
------------------
1 টি মন্তব্য:
valo laglo
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন