অকপট
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়
সমবেত গুণীজন ও এই সোসাইটি-র মান্যবর অধিবাসিবৃন্দ! আমাকে যে আপনারা আজ এ্যাতো মূল্য দিয়ে সম্বধর্না আর বিদায় অভিনন্দন জানাতে ইচ্ছে প্রকাশ ক’রেছেন, এতেই আমি সম্মানিত ও ধন্য। তবে এ্যাতোটা দরকার ছিল না। আমাকে আপনারা যে ভালোবাসা দিয়েছেন, আমার অভিনীত ছবিগুলো যে আপনারা নানা থিয়েটারে গিয়ে দেখে আমাকে আর আমার কাজ-কে সার্থক করেছেন, তাতেই আমার প্রতি আপনাদের যথেষ্ট সম্বর্ধনা আর সম্মান দেখানো হ’য়েছে। আর কী চাই! অন্তত আমাকে আপনারা তো কিছুকাল সহ্য ক’রেছেন। কিন্তু আজকের দিনে এখানে দাঁড়িয়ে আমি একটু লজ্জিত হ’চ্ছি। আপনারা আমাকে দুটো কথা আপনাদের কাছে ব্যক্ত ক’রতে আদেশ করেছেন। শুধু তাই দুটো কথা ব’লে চ’লে যাবো।
আপনাদের ঘোষকের ঘোষণা আজ আমাকে দুটো সত্যের মুখে দাঁড় ক’রিয়েছে। সে সত্য আজ এখানে অনেকে অথবা কেউই জানেন না। আমি সে কথায় পরে আসছি। সেটা এমন তিক্ত আর নিষ্ঠুর সত্য যে, সেই তিক্ততা দিয়ে আমার সামান্য কিছু বলা-র মিষ্টতা-টুকু শুরুতেই নষ্ট ক’রতে চাই না। কিন্তু এটাও সত্য যে, পরে ব’ললেও বলতে আমাকে হবেই। না ব’ললে একটা ভুলকে যে আমরা এতকাল ব’য়ে বেড়াচ্ছি, সেটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো হবে না। এটা যে আমার উপলব্ধি, আমার অভিজ্ঞতা, তার শেয়ার তো আপনাদের সাথে আমাকে ক’রতেই হবে। আমাদের মতো গ্ল্যামার জগতের মানুষদের তো এক এবং একমাত্র আশ্রয় আপনারাই।
মিডিয়া-র ভাষায় আমরা রূপোলী জগতের মানুষ। আমি আপনাদের সাথে একই বিল্ডিং-এ না হ’লেও একই সোসাইটি-তে থাকি ব’লে হয়তো আপনারা নন্, কিন্তু আমাদের সম্বন্ধে নানা ফিসফাস, গোপন কথা, খুঁটিনাটি ইত্যাদি নামে নানা সত্যি-মিথ্যে সংবাদ নানা পত্র-পত্রিকায় প’ড়ে থাকবেন। এগুলো মানুষ গেলেন। এ কথা-টাও সত্য যে, আপনারা না গিললে আমাদের মান থাকে না। আপনাদের দুবর্লতাই তো আমাদের মূলধন। আমাদের নিয়ে আপনারা যত কৌতূহল প্রকাশ ক’রবেন, ততই আমাদের দাম। ততই আমরা আপনাদের কাছে রহস্যময় হ’য়ে উঠবো। এটাই তো আমাদের সম্পদ। এই সম্পত্তি তো ভাঙ্গিয়েই আমরা খাই। এর অপর নাম ‘বক্স অফিস’। অবশ্য কাগজে বার বার কৃত্রিম অভিযোগ ক’রে আমরাও ব’লবো যে, আমাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টানাটানি হ’চ্ছে। আমরা জানি, আমরা তা না ক’রলেই আমরা হারিয়ে যাবো, মুছে যাবো, ঠিক যেমন ক’রে আজ আমি মুছতে ব’সেছি। কে-ই বা মুছে যেতে চায়!
কিন্তু আপনারা আমার প্রতিবেশী। আপনাদের সাথে এই সোসাইটি-র শারদীয়া উৎসবের নানা অনুষ্ঠানে আমি আগেও যোগ দিয়েছি, কুইজের প্রশ্নোত্তরে অংশ নিয়েছি, ঢাকের বাদ্যে নেচেছি। আপনাদের কাছে আমি তেমনভাবে সেলিব্রিটি নই। তথাপি আপনাদের ঘোষক আজকে এই সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে একটু আগে আমাকে ‘এক সময়ের সেলিব্রিটি’ ব’লে আমার সম্মান বৃদ্ধির চেষ্টা ক’রেছেন। সে কথায় পরে আসছি। কাল আমি আমার পরিবার নিয়ে চ’লে যাচ্ছি সাউথ আফ্রিকায়। এবার থেকে ওখানেই হবে আমার পাকা ঠিকানা। আমার স্বামী জনৈক এন.আর.আই. প্রবীর জৈন আমাকে আর এখানে থাকতে দিচ্ছেন না। কেনই বা দেবেন! আমি তো তাঁর স্ত্রী। যদি এটা নিয়ে কোনো কানাকানি হয়, তবে সেটা হোক। যদি ‘আমি কেন এ্যাতো বেশি বয়সে কেন বিয়ে ক’রলাম, অথবা আমার স্বামী জৈন কেন’--- সেসব নিয়ে কোনো কানাকানি হয়, তা হোক। আমি ‘এক সময়ের সেলিব্রিটি’ ব’লে কি আমার সম্বন্ধে একটাও ফিসফাস থাকবে না!
তবে এর একটা উত্তর আমি দিয়ে যাবো। আপনারা তো বিলক্ষণ জানেন, যখন আমার যৌবন ছিলো, এখানে আমি থাকতাম না, তখন আপনাদের মধ্যে অনেকেরই স্বপ্নে আমি আবির্ভূত হ’তাম। একটা বেলার জন্যে আমার সান্নিধ্য পাবার জন্যে আপনারা অনেকেই ব্যাকুল হ’তেন। এমনকি নব বিবাহিতা স্ত্রী-কে পাশে নিয়েও অনেকে আমার সাথে একটু হাসি, একটু বাক্য বিনিময় ক’রতে কতই না সাধ ক’রেছেন! আমি তেমনই একজন মানুষ-কে আমার জীবনে পেয়েছি। সে আমার ফ্যান নয়। সে প্রবীর জৈন। আপনাদের সাথে ওর তফাত এই যে, ও আমাকে চিরকালের জন্যে পাশে পেতে চায়। আমার হয়ে থাকতে চায়। এর জন্যে নিজের ব্যবসা-পত্র পর্যন্ত ছাড়তে রাজী। সে একটু কালের জন্যে নয়। সারাজীবন আমাকে পেতে চায়। তাই আমিও ওকে চাই। হ্যাঁ, এমন একটা সিদ্ধান্তে আসতে বড় দেরী ক’রে ফেললাম। হোক, তবু তো অবশেষে……। আমাকে বাকি জীবনটা একা কাটাতে হবে না। নিঃসঙ্গতা তো আপনাদের মল্লিকা সেন-কে গ্রাস ক’রবে না। আজ এই নজরুল এ্যাভিনিউ-র পাশে দাঁড়ানো এই স্কাইরাইজ ‘নীলাকাশ এ্যাপার্টমেন্ট’ এর ফোরটিন্থ ফ্লোর-এর বাইশ শো স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট ছেড়ে আমি পাড়ি দিচ্ছি দক্ষিণ আফ্রিকায়। আর তো আপনাদের সাথে আমার দেখা হবে না। তাই কয়েক-টা অকপট সত্য আপনাদের সাথে ভাগ করে নিয়ে চ’লে যাবো। তবে আমি জানি, আজকের ঘটনা, আর আমার এই বক্তব্য একটা সোরগোল তুলবে। তাকে কেন্দ্র ক’রে হয়তো কাল ক্যামেরা, মাইক্রোফোন আমাকে আবার ব্যবহার ক’রে একটা স্কুপ বিক্রি করার জন্যে ছোটাছুটি শুরু ক’রবে। কিন্তু ততক্ষণে আমি তো ফ্লাইট-এ, সাত সমুদ্র তেরো নদী-র পার।
আজকে আপনাদের ঘোষক আমাকে ‘এক সময়ের সেলিব্রিটি’ ব’লে আমার চোখদুটো হঠাৎ তাঁর নিজের অজান্তে খুলে দিয়েছেন। তিনি-ও জানেন না, তিনি কী ব’লে ব’সেছেন। হয়তো তিনি সামনে ব’সে এখন খুব লজ্জা পাচ্ছেন, অথবা অন্যের কাছে নিঃশব্দে তিরস্কার শুনছেন। কিন্তু সম্বোধন-টা অর্ধসত্য। ব’লে রাখা দরকার, সেলিব্রিটি কখনও এক সময়ের হয় না। সেলিব্রিটি তো সেলিব্রিটি। চিরকাল তিনি সেলিব্রিটি। মানুষ তাকে নিয়ে নানা উৎসব করেন, তাঁর নামে পার্বণ হয়, তাকে মানুষ পুজোও করেন। কেন? আসলে তিনি মানুষ-কে কিছু দিয়েছেন। যা তিনি দিয়েছেন, তা তো পুরনো হবেই না, বরং তাদের জীবনে পাথেয় হ’য়ে থাকবে। আমি কি তা দিতে পেরেছি? আমি একজন চলচ্চিত্রাভিনেত্রী। আমার নানা ছবি যেমন ‘সাঁঝের প্রদীপ’, ‘এখনও বৃষ্টি’, ‘অন্তর মানুষ’, বা ‘ভালবাসা-র ভিন্ন নাম’….. এইসব সিনেমা আপনারা দেখেছেন, তৃপ্ত হ’য়েছেন, আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু আমি? আমি কি আপনাদের কিছু দিতে পেরেছি, না দিতে এসেছিলাম? অভিনয় পারি, কি পারি না, জানি না। আমার রূপ আছে। নিপাট শালীনভাবে নয়, তাকে যেন-তেন-প্রকারেণ মূলধন ক’রে বিখ্যাত হ’তে চেয়েছিলাম। সব মানুষ নয়, যারা চলচ্চিত্র পাগল, তাদেরকে আরো পাগল বানাতে এসেছিলাম। বাড়ি-তে অর্থের-ও তেমন অভাব-টভাব ছিল না। জাস্ট ফেম। সেলিব্রিটি হবার বাসনা। তাই প্রযোজকের অঙ্গুলি হেলনে পাতলা পোশাক প’রেছি, পোশাক খাটো ক’রেছি, চলনে-বলনে-দৃষ্টি-তে আরো আরো জৈবিকতা-কে প্রকট করেছি। কারণ নান জেনেই ক’রেছি। প্রথম রিপুরস আর বিনোদন ছাড়া অন্য কিছু তো দিতে আসিনি। সৃষ্টি ক’রিনি কিছু। শুধু বিক্রি ক’রেছি। প্রথমে শরীর, পড়ে অল্প-স্বল্প অভিনয়। কিন্তু সেদিন বুঝিনি, এটাতে সেলিব্রিটি হওয়া যায় না। আমার অভিনীত চলচ্চিত্র দেখে তো আপনারা বাড়ির জন্যে, আপনার সন্তানদের জন্যে, আপনার সমাজের জন্যে নিদেনপক্ষে নিজের জীবন আর জীবনাদর্শের জন্যে তো কিছুই নিয়ে যেতে পারেননি। একটা সিনেমা দেখেছেন, আর তার মাদকতায় আগেরটা ভুলে গিয়েছেন। মনে থেকেছে শুধু আমার নাম, আমার মুখমণ্ডল, আর আমার আকর্ষণীয় যৌবন। সিনেমা নয়, আমাকেই দেখতে ছুটে গিয়েছেন এই থিয়েটার থেকে সেই থিয়েটারে। কে সেই সিনেমা-র নির্দেশক, কে কাহিনীকার, আবহে কে আছেন….. এসব প্রশ্ন তো ছিলো বাতুলতা মাত্র। তাই আমার সেই মাদকতাময় দৃষ্টি, আমার কোমরে দর্শক-দের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া বাঁক, মরালী-র মতো গ্রীবা, গালে এসে ঢলে পড়া কুঞ্চিত কুন্তল, দেখা-না-দেখা নাভিকুণ্ড…… এসব আমি বিক্রী ক’রেছি। তা একবার চ’লে গেলেই ব্যস। আমরা তখন কক্ষচ্যুত, খ’সে পড়া তারকা মল্লিকা সেন, সোহিনী রায় বা পৌলমী ঘোষদাস নামে নানা তারকা, যাদের হদিশ আগামীকাল কেউ রাখে না। তখন নতুনেরা মাতায়। আমার খোঁজ-ও আপনারা রাখবেন না আর ক-দিন পর। ফলে আমি তো আপনাদের ভাষায় যথার্থই একজন ‘এক সময়ের সেলিব্রিটি’। কিন্তু ‘এক সময়ের সেলিব্রিটি’ কেউ হয় না। আমি তো কোন মানুষ-কে কোনো দিশা দেইনি, কোনো পথ দেখাইনি, উন্নীত ক’রিনি। যদি সকলেই চেনে ব’লে কেউ সেলিব্রিটি হয়, তবে তো ‘মেঘনা বিড়ি’ কোম্পানী-র নির্মাতা-ও একজন সেলিব্রিটি। অন্তত যারা বিড়ি-র ধোয়া পান করে, তারা সবাই তাকে চেনে, তার নাম জানে, তার ছবি ছাপা থাকে বিড়ি-র প্যাকেটে। সেই সংখ্যা-টা নেহাত কম নয়। অথবা অতদূর যাবো কেন? শ্রী বেনীমাধব শীল, যিনি ফুলপঞ্জিকা প্রকাশ করেন, তিনি তো অন্তত মানুষের অনুভূতি নিয়ে খেলা করেন না ব’লেই সবাই মানেন। তিনি কেন আপনাদের কাছে সেলিব্রিটি নন্?
নিছক ছলাকলা ক’রে নিবেদিত বিনোদনের সাথে সেলিব্রেশনের সম্বন্ধ কোথায়? আমি তো এই অভিনয় জগতেও কোনো দিগন্ত উন্মোচনকারী অভিনেত্রী নই যার পদাঙ্ক অনুসরণ ক’রে আগামী অভিনয়জগতে একটা ঘরানা আসবে। আমরা অধিকাংশই তো সেই তাবড় গবেষণাকারী অভিনেতাদের মধ্যে প’ড়ি না। চলচ্চিত্র একটি মহান শিল্প। এই মহান শিল্প-কে ‘মেইনস্ত্রিম’ নাম দিয়ে আমরা তাকে ব্যবহার ক’রেছি, ক’রে থাকি। এটা আমাদের কাছে শিল্প নয়, জীবিকা মাত্র। জীবিকা ‘সেলিব্রিটি’ নাম দিতে পারে না। আমাদের সাথে সব্জি বিক্রেতা-র পার্থক্য এই যে, তাদের আর্থিক সামর্থ্য লঘু, আর আমাদের ভালোমন্দ। আমরা উভয়েই তো বিক্রি ক’রেছি। পণ্য। সে সব্জি, আর আমরা দেহ-রূপ-লাবন্য। প্রযোজকের হাতে আমরা পাপেট মাত্র। অভিনেত্রী হিসেবে আমাদের সকলের তো কোন জাত নেই। আমাদের জগতের গুটিকয় মানুষ চলচ্চিত্র শিল্প-কে জীবিকা করেননি। তাঁরা হয়তো সেলিব্রিটি। শিল্প-কে বিক্রি করেননি ব’লে নয়। শিল্পে এক নতুন মাত্রা তাঁরা এনেছেন। তাঁদের আত্মত্যাগ আছে। আমার তো নেই। আজকের কোন অভিনেত্রী তাদের ডেবিউ-তে আমাকে স্মরণ ক’রে বা প্রণাম ক’রে কাজে নামবে না। যে শিল্পে কিছু মানুষ তাঁদের নানা আবিষ্কার রেখেছেন, তাকে আমরা নিছক পণ্য বানিয়ে বেচছি। কিন্তু তা তো পণ্যসামগ্রী নয় ব’লেই প’ড়েছি। আপনারাও প’ড়েছেন। তা মননের বিষয়, চিন্তনের বিষয়, বিপ্লবের বিষয়।
আজ এখানে না এলে এই সত্য আর একবার আমার সামনে হাজির হ’ত না। আজ মনে প’ড়ছে, এখানে এই পূজা প্যান্ডেলে একটা কুইজ কনটেস্ট-এর দিন। সেদিনটা-র কথা ভুলেই গেছিলাম। কিন্তু সেটা আজ মনে চ’লে আসছে। তখন আমি চলচ্চিত্রের মধ্য গগনে। আমাকে দিয়ে একটা সই করানো একটা হৈ হৈ কাণ্ড ছিলো। সেবার পুজো উপলক্ষে এখানে বাচ্চাদের কুইজে কয়েকটি নাম ব’লে প্রশ্ন করা হয়েছিলো--- এদের মধ্যে কে সেলিব্রিটি? নামগুলো হ’ল ‘ফুটবলার গোষ্ঠপাল, রাজনীতিক প্রনব মুখারজী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর আমি মল্লিকা সেন।’ একটি শিশু দাঁড়িয়ে প’ড়ে ব’লেছিল--- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই উত্তর শুনে সকলের মুখে আমি হাসি দেখেছিলাম। হাসি আমারও মুখে ছিলো। তখন কি ছাই জানতাম যে, কেবল তিনি-ই এক এবং একমাত্র সেলিব্রিটি। আর সকলেই আপন আপন কাজে বা জীবিকায় কৃতি। সেদিন উপস্থিত সকলে এবং লোকাল কুইজ মাস্টার বুঝিয়ে দিলো,
--- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো বিশ্বকবি। তিনি সেলিব্রিটি কেন হবেন! সেলিব্রিটি হ’লেন মল্লিকা সেন।
শিশুটি প্রথম জানলো, আমিও সেলিব্রিটি। আসলে সেদিন ঐ শিশু-টিই ঠিক ছিলো। বর্তমানে শব্দের পিতামাতা ব’দলে যাচ্ছে। ধরুন, ‘এনিওয়ে’ ইংরেজি শব্দটা আজ হ’য়েছে ‘এনিওয়েজ’। সিনেমা বা সিরিয়ালে শুনতে পাবেন। ‘এনভেলপ’ হ’য়েছে ‘আনভেলপ’, বাংলাতে ‘জনসাধারণ’ হ’য়েছে ‘আমজনতা’। আরো কত কী! তেমনি আজ ‘সেলিব্রিটি’র অর্থ হ’য়েছে ‘খ্যাত’। ‘পূজনীয়’ নয়, বা ‘অণুসরণীয়’ নয়। সেলিব্রেশনের সাথে সেলিব্রিটি-র কোনো সম্পর্ক না থাকলেও দুঃখ নেই। তাই ‘সেলিব্রিটি’ আজ অভিধানে দেখবেন, একেবারে নীচের দিকে আলাদা ক’রে একটা নতুন অর্থ লিখিত হ’য়েছে। অর্থাৎ সেটি আধুনিক সংযোজন। যাইহোক, সেদিন আমার নাম একটা কুইজে আসতেই আমি বেশ গর্বিত হ’য়েছিলাম। কিন্তু আজ আমি লজ্জিত, কুণ্ঠিত, অবনমিত। হয় রবীন্দ্রনাথ কোনো সেলিব্রিটি নন্, অথবা আমরা একই জাতিগত বা গোষ্ঠীগত সেলিব্রিটি। কেউ ছোট বড়ো নয়। কিন্তু সত্যি সত্যি আমি কি কবির সাথে একই পঙক্তি-তে বসা’র উপযুক্ত? নাকি সেলিব্রিটিদের কোনো গ্রেডেশন হয়? রবীন্দ্রনাথ প্রথম সারির, আমি তৃতীয় সারির সেলিব্রিটি? আর কে কী ভাবে জানি না। আমি অন্তত তা মনে ক’রি না। তাই নিজেকে সেলিব্রিটি ব’লে আর মেনে নিতে পারছি না। এর জন্যে আপনাদের ঘোষক-কে ধন্যবাদ না দিয়ে পারি না। আজ আমি যে দশটা বছর চলচ্চিত্রে অভিনয় ক’রি না। সেই সত্যটা থেকেই তিনি আমাকে ‘এক সময়ের সেলিব্রিটি’ ব’ললেন। তিনি-ই আমাকে আর একটা ঘটনা মনে ক’রিয়ে দিয়ে আজ একেবারে সত্যের মুখে দাঁড় ক’রিয়ে দিলেন। সেই ঘটনাটা ব’লে আমার বক্তব্য শেষ ক’রবো।
আমি তখন ছোটো। সিনেমায় আসিনি। ছ-বছরের বাচ্চা মেয়ে। স্কুলে প’ড়ি। একেবারে জাপানি ডলের মতো চেহারা। এই সময় বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা শ্রী স্মরণজিত মুখার্জি, আমাদের কাকু আমাকে রাস্তায় দেখে তুলে নিলেন তাঁর বিখ্যাত সিনেমা ‘টিকলি’-তে কাজে লাগাবার জন্যে। মুখ্য চরিত্রও। টিকলি। আপনারা আমার টিকলি দেখেছেন। আমি খ্যাত হ’লাম। আমি রাস্তায় বেরোলে চেনালোকও আমাকে হাঁ করে দেখতো। আমি কিন্তু আগে থাকতে স্মরঞ্জিত কাকুকে চিনতাম না। আমাদের বাড়ির কেউই তাঁকে চিনত না। আমাকে স্কুল বাসের জানলায় দেখে তিনি সরাসরি আমাদের বাড়িতে এসে আমাকে দাবি ক’রলেন। বাবা তাঁর বিরাট ভক্তও। ফলে বাবা তো গ’লে জল। কিন্তু ঠাম্মা রেগেমেগে ব’ললেন,
--- হবে না। বাড়ির মেয়ে সিনেমায় যাবে! সেন বাড়িতে এটা চ’লবে না।
শেষে বাবা লুকিয়ে আমাকে স্কুলে নিয়ে যাবার নাম ক’রে সিনেমায় নিয়ে গিয়ে চান্স ক’রিয়ে দিয়েছেন। আমি তো প্রথমদিন শুটিং ক’রে স্কুলে গিয়ে ব্যাপারটা ব’লে সকলকে চম্কে দিলাম। তারা কেউই ঠাম্মা’র মতো মুখ বেঁকালো না। এমনকি আমাদের এ্যাংরি ক্লাশ টিচারও না। আমি তখন স্কুলে একজন সেলিব্রিটি। আমাদের এ্যানুয়ালে স্কুলের রেক্টর নিজে আমাকে একেবারে কোলে নিয়ে মঞ্চে উঠলেন। সেদিন অত ছোট বয়সে বুঝেছিলাম, খ্যাতির স্বাদ কেমন। সেটাকেই তারিয়ে তারিয়ে খেয়েছি বহুদিন। এরপরে বাবা জানালেন যে, স্মরণজিত কাকু আর একটা সিনেমায় আমায় অভিনয় করাবেন। একটি বাচ্চা ছেলে চাই। তিনি নাকি তেমন ছেলে খুঁজে পাচ্ছেন না। তাই ছেলে সাজতে হবে আমাকে। ছয়-সাত বছরের বাচ্চা--- ছেলে মেয়ে কী বোঝে! সবাই তো ঠাম্মা নয় যে একটা নির্দলীয় নির্বিশিষ্ট শিশুকেও মেয়ে বানিয়ে ছাড়বে। তাই আমি তো আমার ক্লাসমেটদের ব’লে-ট’লে দিয়েছি, আমি আবার অভিনয় ক’রছি। স্কুলে তখন আমার কী দাম! সকলেই তাদের টিফিনবক্স থেকে আমাকে শেয়ার দ্যায়, আমার না খাওয়া টিফিন প’ড়েই থাকে। তারা আর তাদের মায়েরা আমাকে নানা সাহায্য করে। একটা দিন স্কুলে না গেলে পড়া লিখে আনার জন্যে তাদের বাড়িতে আমার মা-কে যেতে হয় না। তারাই আমাদের বাড়ি ব’য়ে আসে, ক্লাসের লেখাগুলো দিয়ে যায়। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস! একেবারে শেষে এসে আমাকে দ্বিতীয় সিনেমাতে কাকু নিলেন না। একটা ভালো ছেলে নাকি পেয়ে গেছেন। আমি তো কেঁদে-কেটে একসা। পরদিন আমি কিছুতেই স্কুলে যাবো না। আমার বন্ধুরা আমাকে দুয়ো দেবে। আমি তো প্রচার ক’রে ব’সে আছি যে, আমি আবার সিনেমায় নামছি। নায়িকাদের মতো তখন আমার চাল-চলন। ততদিনে নানা নায়িকাদের নানা আদব-কায়দা আমার মা আমাকে রপ্ত করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমার স্বপ্ন দুঃস্বপ্নই র’য়ে গেলো। সেদিন থেকে স্কুলে আমার জনপ্রিয়তা কমতে কমতে একেবারে তলানিতে এসে ঠেকল। আমাকে কেউ আর পাত্তা দ্যায় না। আমি সেদিন আমাদের জীবনের বা আলোছায়া জগতের সত্যিটা বুঝতে পারিনি। বোঝার বয়সও ছিলো না। তাই বোকার মতো পরে মনে মনে চ্যালেঞ্জ ক’রেছিলাম যে, আমাকে সিনেমা ক’রতেই হবে। বিরাট নায়িকা হ’তেই হবে। সেলিব্রিটি হ’তেই হবে।
এই সময় যখন আমি বাংলা চলচ্চিত্র জগতে একেবারে সরবোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত, তখন একদিন একটা নতুন ছবিতে আমাকে সই ক’রতে হবে জেনে আমি বসে আছি, কিন্তু আমার বাচ্চাবেলার সেই ঘটনা আমার জীবনে আবার ঘ’টলো। হঠাৎ আমাকে ড্যাশ ক’রে অন্য একটি মেয়ে এসে অভিনয় ক’রে বেরিয়ে গ্যালো। আজ সে আপনাদের চোখে একজন স্টার। আমি ‘এক সময়ের সেলিব্রিটি’। প্রাক্তন স্টার। সেদিন ডিরেক্টর আমাকে জানালো যে, মেয়েটি প্রডিউসারের রেকমেন্ডেশনে এসেছে। তাকে নিতেই হবে। আমি বুঝলাম, আমার দিন শেষ হ’য়ে আসছে। তেমন রেকমেনডেশন কী ক’রে হয়, তাও জানতাম। কিন্তু আমি তখন বুঝিনি, আমি একজন সত্যিকারের প্রফেশনাল নায়িকা নই যে, ফিল্মের জন্যে সব ক’রতে পারে। বুঝিনি, মানুষের সেন্টিমেন্ট নিয়ে খেলা আমাদের পেশা হ’লেও আমাদেরকে নিজেদের সেন্টিমেন্ট বাড়িতে রেখে আসতে হয়। বুঝিনি ব’লেই আবার বোকার মতো মনে মনে ঠিক ক’রলাম যে, এই প্রডিঊসার আর ডিরেক্টর-এর আর কোনো আমি কাজ ক’রবো না। ফলে আমার আমিত্বের জন্য আমি কবে যেন ধীরে ধীরে কর্মহীন হয়ে প’ড়তে লাগলাম। আমি নিজমুখে নাম না ব’লে দিলেও আপনারা জানেন, আমি কোন মেয়েটির কথা বলেছি। তারপর আমার বেশ কিছুদিন কোনো কাজ নেই। জিদ ক’রে বাড়িতে বসে থাকি। ধীরে ধীরে আমার নামে নানা অপপ্রচার র’টে যেতে লাগলো। কাজ পাই না। কোনো কোনো সহৃদয় মানুষ আমাকে ছবিতে বা সিরিয়ালে ভালো ভালো সাইড রোল, মানে পার্শ্ব চরিত্র দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নায়িকা থেকে এভাবে ডিমোশন মেনে নিতে পারিনি। ফলে একদিন আবিষ্কার করলাম, আমাকে কেউ আর ডাকছে না। আমার গ্লামার জগত-টা কবে যেন হারিয়ে গেলো। আমি ‘অফ ক্যামেরা’ হ’য়ে গেলাম। আর আজ বুঝলাম, এ জগতে সো-কোল্ড সেলিব্রিটি তুমি ততদিন, যতদিন তুমি ‘অন ক্যামেরা’ আছো, লাইম লাইটে আছো, প্রচারে আছো। ওটা চ’লে গেলেই তুমি কেবলই একজন সাধারণ মানুষ। একদিন ছিলে। মানে ‘অতীত গিয়াছে অতীতে মিলায়ে…..’। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো কোনদিন ক্যামেরার ধার ধারেন নি। মৃত্যুর এ্যাতগুলো বছর পরেও আমরা তাঁর জন্মদিন পালন করি, মৃত্যুদিনে বেদনা প্রকাশ ক’রি, তাঁকে ভাঙ্গিয়ে কত মানুষ ক’রে খাচ্ছে! তিনি হলেন প্রকৃত সেলিব্রিটি।
মাফ করবেন, আমি সুবক্তা নই। আমাকে কিছু ব’লতে আজকে হবেই, এটাই দস্তুর ভেবে একটু আতঙ্কিত-ই ছিলাম। ওটা তো পারি না। অন্যের লেখা কথায় কথাবলা পুতুলের মতো গলা দেওয়াই ছিলো আমার বা আমাদের কাজ। কিন্তু আপনারা আমাকে আর একবার সহ্য ক’রলেন আজকে এই সভায়। নেমে যাবার আগে একটাই অনুরোধ, নিছক বাঁচার জন্যে, টাকা-র জন্যে বা নিজেকে দেখানোর জন্যে যে মানুষগুলো এই বড়ো বা ছোটো পর্দায় রূপোলী জগতে আসে, কৃতি হয়, খ্যাত হয়, তাদেরকে দেখে আনন্দ পান, কিন্তু তাদেরকে ‘সেলিব্রিটি’ ব’লে সত্যিকারের সেলিব্রিটিদের অশ্রদ্ধা ক’রবেন না। আমরা কোনো সেলিব্রিটি নই। অভিনেতা বা অভিনেত্রী মাত্র। অনেকে আমাদেরকে শিল্পী ব’লেও মানেন না পর্যন্ত। নমস্কার!
----------------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন