শনিবার, ১ অক্টোবর, ২০১১

'প্র্যাঙ্ক কল' ছোটগল্প

IF YOU DON'T HAVE ''BANGLA WORD'' FONT, YOU CAN'T READ THIS.

প্র্যাঙ্ককল
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়


যে মেয়ে নিজে বাড়িতে চেঁচামেচি ক’রে, অনশন ক’রে অবশেষে এই চাকরি নিয়েছে, সে-ই কিনা নিজে ফিরে এসে ব’লছে যে,ও আর এখানে চাকরি ক’রবে না। মা তো শুনে ইস্তক একটু চিন্তায় প’ড়ে যায়। কিন্তু বাবা খুশি। তিনি তো চেয়েছিলেন, মেয়ে এসব জায়গায় চাকরি না করুক। তিনি অবশ্য বস্তুত জানেন না,কেন এসব জায়গায় বিরুদ্ধে লোকে কথা বলে। কিন্তু সবাই বলে ব’লেই তিনি বলেন। কিন্তু বিপু-র মা শেষে মাঝখানে পড়ে ব’ললেন,
--- মেয়ে-টা দিন দিন এভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে। একবার এমনটা ঘ’টলো। যতদিন পারে, করুক না। মেয়ে-রা তো যাচ্ছে সেখানে। ট্রেনে তো দেখলে। তারা কি কোনো খারাপ ঘরের মেয়ে ব’লে মনে হ’লো?
--- ওভাবে দেখে খারাপ-ভালো কিছু কি বোঝা যায়!
--- তুমি তো শুনে শুনে ব’লছ। তাতে বুঝি বোঝা যায়! যাক না। আমরা তো আছি, নাকি? বাইরে মেলা–মেশা ক’রলে মন-টা তো একটু ভালো থাকবে। একটু ছেড়ে দাও। আমাদের বাবা-রা তো আমাদের না ছেড়ে-ছেড়ে এই অবস্থা ক’রেছে। না পারি ব্যাঙ্কে যেতে, না পারি পোস্ট- অফিসে। ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়েছে।
মা-এর কথায় ‘এমনটা ঘ’টলো’--- মানে, একবার বিপাশা আত্মহত্যা ক’রতে গিয়ে বেঁচে গেছে। সেটা মায়ের কাছে শুধু নয়, বাবা-র কাছে-ও একটা দুঃস্বপ্ন। এজন্য বিপাশা-র মা কালীঘাটে পুজো-ও মানত ক’রেও এসেছিলো। বিপাশা-র বাবা আক্ষেপ ক’রতে ক’রতে ব’লেছিলেন,
--- মানুষ কতো অল্পে তুষ্ট! আমাদের মেয়ে-টা যে আত্মহত্যা করতে গেলো, তাকে যে বিধাতা পিতৃকুল আর মাতৃকুল–এর যাবতীয় দৈহিক মন্দগুলো দিয়ে গ’ড়লেন, তার জন্য তাঁকে কোনো নিন্দা-মন্দ নয়। মেয়ে-টা যে বেঁচে গেলো--- তার জন্য তিনি পেয়ে গেলেন মানত, পুজো। যাবতীয় প্রশংসা জুটল তাঁর থালায়।
একটা পরিবারে একটা মেয়ে তার বাবা-মা’র চোখে বিবাহ বিষয়ে দুশ্চিন্তা করার মতো বেড়ে না উঠলেও আত্মীয়-পরিজন একটু আগ বাড়িয়ে ভাবতে শুরু ক’রে দেয়। কারনে-অকারনে, উৎসব–অনুষ্ঠানে তারা নানা বৈবাহিক সম্বন্ধ আনতে শুরু করে। কিন্তু বিপাশা-র বেলায় টা ঘটেনি। কেউ এগিয়ে আসেনি অপেশাদার ঘটকালি ক’রতে। কারন বিপাশা কালো আর উচ্চতায় খাটো। অক্ষয় বাবু বাবা ব’লে কথা। তিনি তো আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেন না। একদিন কাগজে একটা বিজ্ঞাপন তিনি দিয়েই ব’সেছেন। তারপরের ঘটনা দুঃস্বপ্ন। যে বা যারা এসেছে, কেউ সামনে, কেউ পেছনে যা নয়, তা ব’লেছে। অক্ষয় বাবু সত্য গোপন ক’রেছেন। ক’রেছেন-ই তো। একটু শব্দের কারিগরি ক’রেছেন। কে-ই বা ব’লতে পারে--- আমার মেয়ে কালো! ব’লবে ‘উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ’। ‘বেঁটে’ বলা যায় নাকি! তার চেয়ে বলা যাক ‘লঘু উচ্চতা’। ব্যস। এইসব দ্বন্দ্বমূলক শব্দ তো সাহিত্যে চলে। বিয়ের সম্বন্ধে নৈব নৈব চ। এসব শুনেছে বিপাশা। গোটা তেরো পাত্রপক্ষ আসার পরে একদিন আত্মহত্যা ক’রতে যায়। বাবা-কে এভাবে ভাঙ্গতে দেখতে পারেনি। নিজের নারী অভিমান-টা সইতে পারেনি।
তারপর বেশ কিছুদিন এখানে ছিলেন না অক্ষয় বাবু। একটু পরিবর্তনের জন্যে চ’লে গিয়েছিলেন আলিপুরদুয়ার। ছোট ভাই থাকে সেখানে। সত্যি বলতে--- তিনি মুখ লুকোতে চেয়েছিলেন। মেয়ে-র বাপ হ’লে এ দেশের তামাম বাপেরা মনে মনে যে গঞ্জিত হবার জন্যে তৈরি থাকে, তার-ও একটা সীমা থাকে। শ, ষ, স--- তারপরে তো আর কোনো ‘স’ নেই। তাই ফিরে আসার পর একটা ছোট সামাজিক অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রন রক্ষা ক’রে ট্রেনে ফিরছিলেন সপরিবার। কামরায় বিপাশা-র সাথে আলাপ হয় দুটো মেয়ের। ঝকঝকে মেয়ে দুটো। নিজেদের মধ্যে ফর ফর ক’রে ইংরেজিতে কথা ব’লছিল নিচু গলায়। বিপাশা সেইদিকে আকৃষ্ট হতে পরিচয় হয়। মেয়েদুটো ফিরছিল তাদের অফিস থেকে। ইভনিং ডিউটি। তাদের গলায় ঝুলছিল সুন্দর দেখতে আই-ট্যাগ। আলাপ ক’রে বিপাশা জানতে পেরেছিল, তার মতো বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত এবং অনিশ্চিত জীবোণ  থেকে বাঁচতে হ’লে এখনই--- এ্যাটওয়ান্স এমনই একটা কোনো কাজে ঢুকে প’ড়তে হবে। কোনো ‘একটা কাজ’ মানে ভুলে থাকার একটা উপায়। সাইকোলজিকাল এফেক্ট থেকে সহজে বের হবার একটা রাস্তা। কলসেন্টার। মেয়েদুটোই ব’লছিল যে, এসব কাজে নাকি সব বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েরা ঢুকে পড়ে। তাদের ব’লবার মতো নাকি তেমন কোনো কোয়ালিফিকেশন অবধি নেই। বড়জোর হায়ার সেকেন্ডারি। থাকার দরকার-ও নাকি নেই। একটু ভালো-মন্দ হিন্দি আর ইংরাজি ব’লতে পারলেই চ’লবে। জুটে যাবে কাজ। এসি রুম-এ ব’সে ব’সে আরামসে কাজ করো। হয় খদ্দেরদের নানা সুযোগ-সুবিধে জানাও, অথবা খদ্দের ধরো টেলিফোনে। বেসিক, পি.এফ, মেডিক্যাল, ইনসেন্টিভ পাবে। সব মিলিয়ে অবশ্য ওয়াক-থুঃ। প্রথম বছরখানেক সাকুল্যে পাঁচ হাজার পাবে হাতে। অবশ্য এসব চাকরি–তে কেউ একই বিপিও-তে আটকে থাকে না। শিফট করে আর তাদের এক্সপেরিয়েন্স অনুযায়ী মাইনে বাড়তে থাকে। তবে পেয়ে যাবে চাকরি। তুমি যদি একেবারে চলনসই না হও, ত আলাদা কথা। সেই অনুপাতে বিপাশা-র এ্যাকাডেমিক কোয়ালিফিকেশন অনেক। মাস্টার্স ক’রেছে গতবছর। বয়স তো নেই নেই ক’রে পঁচিশ। অনেকটা সময় অক্ষয় বাবু খেয়ে নিয়েছেন ডাউরি পেনাল্টি দিয়ে মেয়ে-র সম্বন্ধ লাগাতে। কিন্তু লাগেনি। শুধু অপমান আর অপমান।
বাধ্য হ’য়েই তিনি মত দিয়েছিলেন কল সেন্টারে কাজ ক’রবার জন্যে। সেই থেকে গত দু-মাস একটা কল সেন্টার-এ কাজ ক’রছিলো বিপাশা। সম্প্রতি অক্ষয় বাবু-ও দেখছিলেন যে, মেয়ে’র মধ্যে বেশ একটা পরিবর্তন আসছে। ধীরে ধীরে ও আবার হাসছে, বাবা-মা’র সাথে ব’সে রাতে খাবার খাচ্ছে। তিনি এবারে আর নতুন ক’রে বিয়ের সম্বন্ধ দেখা শুরু করেননি। ছেড়ে দিয়েছেন নিয়তি’র হাতে। দেখা যাক। সেই মেয়ে আর এ চাকরি করবে না, ব’লছে। এই প্রজন্ম কী যে করে আর কী যে ভাবে, বোঝেন না অক্ষয় বাবু। তবু বাবা’র কাছে এটা ভালো কথা। তাঁর তো বাড়িতে হাঁড়ি চ’ড়ছে না, এমন নয়।
কিন্তু কী এমন ঘটলো যে, হঠাৎ এভাবে একশো আশি ডিগ্রী ঘুরে গেলো বিপাশা ? মা বিষয়-টা জানতে একটু ব্যাকুলতা প্রকাশ ক’রলেন বৈকি। কিন্তু বাবা এ ব্যাপারে অনেকটা নিশ্চিত-ই ছিলেন যে, এসব অফিসে ভদ্র ঘরের মেয়েরা যে কাজ ক’রতে পারে না ব’লে মানুষ বলে, টা নিশ্চয়ই ঠিক। তা নয়তো তাদের বিপু ফিরে এলো কেন ? কিন্তু মানুষের কথা কতটা ঠিক, তা জানেন না তিনি। তবে এটাও ভাবেন, বাড়ির বাইরে বাসে-ট্রামে-ট্রেনে-বাজারে তো মেয়েদের সম্মান নিতে অল্প-বিস্তর মলেসটেশন তো হয়ই। তাহলে কি তার থেকেও বেশি হয় কল সেন্টার-এ? মা চিন্তিত হ’লেন বটে, তবে তা নিয়ে তাঁর কোনো কৌতূহল দেখালেন না।
কিন্তু এটা তো লক্ষ টাকা’র প্রশ্ন হ’য়েই থাকে, কী ঘ’টেছিলো।



দিব্যি কানে হেডসেট সেঁটে সকাল আট–টা থেকে বিকেল পাঁচ-টা অবধি কল নিচ্ছিল বিপাশা। বিপাশা-দেরকে বলা হয় ‘এজেন্ট’। এটা জি.পি.আর.এস. সার্ভিসের ইন-বাউনড বিপিও। ফোন এলেই ওপেনিং ভারবিইয়েজ দিতে হয়। একেবারে গতে বাঁধা মুখস্ত করা কথা--- নমস্কার! আমি মোবাইল ইন্ডিয়া থেকে বিপাশা। আপনাকে কী ধরনের সহায়তা ক’রতে পারি? হিন্দি-তে ব’লতে হয়--- নমস্কার! ম্যায় মোবাইল ইন্ডিয়া সে বিপাশা। আপকো কিস প্রকার সহায়তা কর সকতি হুঁ? গৎ-এর ইংরাজি-ও আছে। আবার ক্লোজিং ভারবিইয়েস-ও আছে--- আশা করি, আপনাকে যাবতীয় তথ্য দিয়ে আমি সহায়তা ক’রতে পেরেছি ? মোবাইল ইন্ডিয়া-তে কল করার জন্যে ধন্যবাদ। আপনার দিন-টা ভালো কাটুক।
সারি সারি কিউবিকলে এক একটা কম্পিউটার নিয়ে ব’সে এক-একটা শিফট-এ অন্তত শ-তিনেক ছেলেমেয়ে কল নেয়। একটা আলাদা কাঁচের ঘরে ব’সে ‘কোয়ালিটি ডিপার্টমেন্ট’ এজেন্ট-দের কল পরীক্ষা করে। পানের থেকে চুন খ’সলে পানিশমেন্ট। নানা ধরনের পানিশমেন্ট। ফেটাল দেয়। মানে পেনাল্টি খাওয়ায়। আর আছে টিএল। তিনি এক একটা গোটা এজেন্ট টিম চালান। আরো ওপরে আরও বড় বড় পোস্ট আছে। টিএল-এর হাতেও র’য়েছে শাস্তিদানের অধিকার। এজেন্ট-দের ছুটি বাতিল, আই-জে-পি অর্থাৎ প্রমোশন-এর জন্যে টেস্ট-এ বসা বাতিল ইত্যাদি। তাছাড়া ধমক-ধামক আছেই। সতেরো দিনের একটা ট্রেনিং দিয়ে বিপাশা-দেরকে ব’সিয়ে দেওয়া হ’য়েছে এজেন্ট চেয়ারে। বিপাশা’র ইংরেজি-তে বা হিন্দি-তে কথা বলা তো মোটেও আসতো না। তাই পাড়া-তেই ইংলিশ মিডিয়াম-এর ক্লাশ সেভেন-এ পড়া মেয়ে রিনি-র সাহায্য নিয়ে অন্তত ‘ইয়েস-নো-ভেরিগুড’ শিখে নিতে হ’য়েছে। হিন্দি-টাও শিখিয়েছে রিনি। বদলে ওকে বাংলা-টা পড়িয়েছে বিপাশা। ওকে ওর ব্যাচমেট-দের সাথে দেওয়া হয়নি। ওদের-কে অন্য প্রসেসিং-এ দেওয়া হ’য়েছে। ফলে এই মোবাইল ইন্ডিয়া-র ফ্লোরে কেউ ওর চেনা-জানা নয়। সবাই বয়সে না হ’লেও সার্ভিস সিনিয়র। বিপাশা দেখেছে, এ কাজে শুধু ফোন নিয়ে তথ্য দিলেই চলে না। নানা রেকর্ড রাখতে হয় কম্পিউটার-এ। কাজ-টা বেশ গভীর মনোযোগের বিষয়। শুরু-র দিকে একটু ভুলভাল হয়। প্রবেশন পিরিয়ডে তা মাফ করা হয়। ওর প্রবেশন চ’লছে।
প্রথম প্রথম বাড়ি বা পাড়া’র সকেলেই দেখেছে যে, বিপাশা’র মুখে হাসি, সাধারন রঙ্গ-রসিকতা একেবারে হারিয়ে গেছে। কেমন যেন নীরব, চুপচাপ। অফিসে যায়, আসে। মা নিশ্চিন্ত। তবু মেয়ে-টা একটা কিছু নিয়ে তো আছে। সব ঠিক হ’য়ে যাবে। একদিন সময় সব ঠিক ক’রে দেবে। ওকে একটু সময় দিতে হবে। মাস দুয়েক কাজ করার পর আজ মার চোখে পড়েছে যে, তাঁর মেয়ে যেন আবার জীবনী শক্তি ফিরে পেয়েছে। একটু সহজ হয়েছে। তিনি ছুপ করে মেয়েকে দেখেন।
শুধু কি সময় বিপাশাকে বদলে দিল? আসলে অফিসে বিপাশার কাছে একটা কল প্রায়ই আসে। নামটা সুপ্রিয় রুদ্রপাল। প্রথম দিন লোকটা, হয়ত লোক নয়, একটা ছেলে--- বিপাশাকে পি.সি. কনফিগারেশন করিয়ে দিতে বলেছিল। দিলো। পরদিন নেট ওয়ার্ক-এর নানা টারিফ জানতে চেয়েছে। জানিয়েছে। কিন্তু তৃতীয় দিন তাঁর কল-টা ঝংকৃত হয়েছে বিপাশার কানে। ছেলেটা বলেছে,
--- হোয়াট এ বিউটিফুল ভয়েস ইউ হ্যাভ, ম্যাম! নাইস ইজ ইয়োর স্পিকিং স্টাইল। নাইস ইজ ইয়োর নেম। বি-পা-শা! আই এ্যাম লাভিং অব দিস। এমন কথা-টা বিপাশা-কে এর আগে কেউ বলেনি। বিপাশা জানতো যে ওর গলার স্বর খুব সুন্দর। সুন্দুর ওর কথা বলার কায়দা। একেবারে ভুলেই গিয়েছিলো বিষয়-টা। যখন ও ক্লাশ নাইন-এ পড়ে, তখন স্কুলে এক নতুন গেম টিচার এসেছিলেন। তাঁর নাম-টা আজ আর মনে নেই বিপাশা-র। স্কুলের এ্যানুয়ালে যে মেয়ে-টা ডান্স-ড্রামা-তে ভাষ্যপাঠ করতো, তাকে বাদ দিয়ে এই নতুন শিক্ষক বিপাশা-কে দিয়ে কাজ-টা করান।  তিনি বলেনও,
--- তুমি আবৃত্তি শেখো না? শিখবে। তমার ভয়েস আর কথা বলার স্টাইল খুব ভালো। মাইক্রোফোনিক।
সে-বার বিপাশা বেশ সুখ্যাতি পেয়েছিলো। ফলে এ বিষয়-টা ওর জানা ছিল। কিন্তু সে তো সুদূর অতীত কালের ঘটনা। বাস্তবে প্রত্যাখ্যানের পর প্রত্যাখ্যান ওকে কোণঠাসা করে ফেলেছিল। ওর কী আছে, না আছে, তা একেবারে উধাও হয়ে গিয়েছিলো। তাছাড়া বিয়ের বাজারে তো কণ্ঠ কোনো কোয়ালিটি নয়। তাই নিজেকে নিঃস্ব, রিক্ত, একটা ভিখিরির থেকেও নিকৃষ্ট আর অসহায় বলে মনে করতো বিপাশা। কিন্তু আজ এই  সুপ্রিয় রুদ্রপাল ওকে যে সেই পুরনো কথা মনে করিয়ে দিল, তাই শুধু নয়। ছেলেটার কথা যেন শততন্ত্রী বীনার মতো ঝংকৃত হল বিপাশার কানে। আজ প্রথম যেন ও অনুভব করল যে, ওর সবটাই অসুন্দর নয়।। কিছু অতুলনীয় সম্পদ ওর-ও আছে যাকে কেউ পছন্দ করতে পারে। কিন্তু এটা অফিস। এটা পারসোনাল ফোন করবার বা ধরবার জায়গা নয়। এখানে ফ্ল্যাটারিং শুনতেও ওকে বসানো হয়নি। তাছাড়া ছেলেটাকে কোনো প্রশ্রয় দিতেও চায় না ও। এই তো সুযোগ। এতদিন ও সয়েছে। আজ জবাব। অবশ্য বিপাশা বলে দিতে বাধ্য-ও হয়েছে,
--- থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার। আশা করি, আপনাকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে পেরেছি। মোবাইল ইন্ডিয়া-তে কল করার জন্যে ধন্যবাদ। আপনার দিন-টা ভালো কাটুক।
কিন্তু ঘটনা-টা এখানেই থেমে থাকল না। পরের দিন, পরের দিন, তার-ও পরের দিন সুপ্রিয় রুদ্রুপাল এমন-টাই করতে থাকলো। এসব ক্ষেত্রে টি.এল.- কে ডেকে কলার-কে ম্যানেজ করতে বলে এজেন্ট-রা। কিন্তু বিপাশা তা করে না। বারবার-ই বিপাশা আনন্দে পুলকিত হয়ে ওঠে কল-টা এলে। না আসা অবধি তিষ্ঠোতে পারে না। এইটুকই-তো ওর বাঁচার রসদ, বিশল্যকরণী বা সঞ্জীবনী সুধা। বার বার ওকে প্রত্যাখ্যান করবে আর মনে মনে বিলাস করবে যে, কাউকে প্রত্যাখ্যান করার মত সামর্থ্য আছে বিপাশা রায়-এর। সবার দেওয়া তাচ্ছিল্য-এর শুধু প্রতিশোধ নয়, এটা দুবন্ত মানুষের খড়কুটো ধরে বেঁচে থাকার প্রানান্ত প্রচেষ্টা। এই একটা কল-এর দৌলতে ঝারা ন-ঘণ্টা কাজ করতে পারে বিপাশা। বাড়িতে যতই ভির হক বাসে, কষ্ট হয় না। পরের দিনের জন্য অপেক্ষা করে। কখন সকাল হবে, অফিস যাবে, আর সুপ্রিয় পাল-এর স্তোকবাক্য শুনবে।
--- বিপাশা, তুমি তো আমার মোবাইল নম্বর-টা দেখেই ফেলেছ। রাতে ফোন কোরো, প্লীজ।
কিন্তু বিপাশা-কে উত্তর দিতেই হয়েছে--- এটা জি.পি.আর.এস. হেল্প ডেস্ক, স্যার। এটা আমার পারসোনাল নাম্বার নয়। এখানে আমি আপনার মোবাইল নেটওয়ার্ক সংক্রান্ত সমস্যা-র সমাধান করতে পারি।
ছেলেটা কী বুঝলো, কে জানে। হয়তো বিপাশা-র কথায় বা শব্দ ব্যবহারে কোনো অসংলগ্নতা বেরিয়ে গেছে। ছেলেটা বিগলিত হয়ে বলে উঠেছে--- থ্যাঙ্ক ইউ! থ্যাঙ্ক ইউ!! ত্থ্যাঙ্ক ইউ!!! তমার পারসোনাল ফোন নম্বর-টা দাও। আমি-ই তোমাকে ফোন করব।
একবার বিপাশা ভেবেওছে, যাই, দেখা করি। ছেলে-টা দিনের পর দিন আরো আরো বিনম্র, কোমল আর বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠছে। হয়তো ছেলে-টার কাছে মানুষর বাইরের রূপ-টাই সব নয়। হয়তো ছেলে-টা উচ্চ রুচি-র মানুষ। হয়তো বিপাশা এবারে ওর বাবা-কে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিতে পারবে। কিন্তু পরক্ষণেই ভেবেছে, নাঃ। এ্যাতো-টা ভেবে নেওয়া ঠিক নয়। যে বাস্তব অভিজ্ঞতা ওর আছে, তাতে ছেলে-টাকে অনেকটা নামতে দিতে হবে। এ্যাতো সহজে ধরা দেবে না বিপাশা। হয়তো আদৌ ধরা দেবে না। আর যদি দেয়-ও, তবে একটা প্রতিশোধ নেবে। চরম প্রতিশোধ। ওকে যেমন করে একের পর এক পাত্রপক্ষ দিনের পর দিন অসভ্যের মতো প্রত্যাখ্যান করেছে, তেমনি ছেলেটাকে মুখোমুখি প্রত্যাখ্যান করতে হবে। আবার এ কথাও মনে হয়েছে--- যদি সামনে থেকে ছেলে-টাকে দেখে সত্যি সত্যি প্রত্যাখ্যান করতে না পারে? যদি ভেতর-টা কেঁদে ওঠে? হায়! কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে কীসে, কভু আশীবিষে দংশেনি যারে…….’। একাই এসব মনে মনে ভেবেছে। পাশে যারা--- মানে শুভমিতা, দেবযানী, মনিকা বসে কল নেয়, তারা তো ওর পরিচিত নয়। ব্যাচমেট-ও নয়। বয়সে ছোট-ও বটে। তাদের সাথে তো এসব নিয়ে আলোচনা করা যায় না। ওদের সাথে ভালো মতো পরিচয়-ই হয়নি। এই তো দুটো মাস ও এখানে। ওরা সব কেমন যেন এক্সপার্ট এক্সপার্ট ভাব দেখায়। যদি ওরা টি.এল.-কে নালিশ করে দ্যায়? চাকরি-টা যেতে পারে। সবে প্রবেশন পিরিয়ড চলছে। নাঃ, পরে, পরে পরে। এ্যাতো তাড়াতাড়ি নয়।
ইতিমধ্যে সুপ্রিয় রুদ্রপাল একদিন সোজা বিপাশা-কে প্রপোজ করে বসেছে। কিন্তু বিপাশা আবার সেই পুরনো গৎ আওড়েছে। ছেলে-টা এবারে বলে উঠেছে--- বিপাশা, তোমার কণ্ঠ-টাই কি শুধু সুন্দর? তুমি প্রাণে এ্যাতো-টা নিষ্ঠুর? একটা ছেলে এ্যাতোদিন ধরে তোমাকে নানাভাবে প্রোপোজ করতে চাইছে, আর তুমি কিনা সেই জি.পি.আর.এস. হেল্প ডেস্ক-এ আটকে আছো!
বিপাশা-র মন বলছে, না না না। তুমি ভুল ভাবছ। আমি নিষ্ঠুর নই। আমি তো বাস্তবের হাতে খেলার পুতুল। সে আমাকে যেমন-টা করাচ্ছে, তেমন-টাই তো করছি। বিপাশা-র মনে একটা ভয়-ও ঢুকে যাচ্ছিলো। যদি ছেলেটা ওকে মানসিকতায় মন্দ ভেবে সত্যি সত্যি ফোন করা বন্ধ করে দেয়? তাহলে তো ও মরে যাবে। এই তো। এইটুকুই তো বাঁচার সম্বল। এটাও যদি যায় তো থাকে কী? মতে সাড়ে চার হাজার টাকা-র জন্যে ও এখানে আসে না। ওদের বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে না, এমন নয়। এখানে আসে বাঁচতে। একটু ভুলে থাকতে। একটু ব্যস্ত থাকতে। মানুষ-কে তো এমন কোনো না কোনোভাবে বাঁচতেই হয়। একটা অবলম্বন তো খুঁজতেই হয়। এই একটা ভালো উপায়। এটাও কি যাবে? এখন কী করা? কাকে বলবে এসব কথা? কার সাথে শেয়ার করবে? কে-ই বা বুঝবে! মনে মনে হাত জোড় করে বিপাশা, হে ঈশ্বর, তোমাকে বিশ্বাস করতাম। কিন্তু তুমি যেভাবে আমার সাথে নিষ্ঠুর খেলা খেলেছ, তাতে তোমার ওপর আমার যাবতীয় বিশ্বাস উঠে গেছে। তুমি পারশিয়াল। একচোখো। যাকে দাও, তাকে আঁচল ভরে দাও। রং দাও, দেহ দাও, চুল দাও, চোখ দাও। সব দাও। কিন্তু আমার বেলায়? এর একটাও দিলে না। কেন আমার এ্যাত হেনস্থা করলে? কিন্তু আজ আর একবার তোমাকে ডাকছি। আমাকে পথ দেখাও। বলে দাও, কী করব আমি।
ওদিকে তখনও সুপ্রিয় রুদ্রপাল বকে চলেছে--- ম্যাম! ম্যাম! ডু ইউ লিসন টু মী? ম্যাম, প্লীজ সে সামথিং। ম্যাম! আর ইউ ইন দি লাইন?
বহু কথিত নারীহৃদয় আর নারীবুদ্ধি একযোগে আর একবার বিপাশা-র সাথে বিধাতা-র মতো বিমাতৃসুলভ আচরণ করল। একবার বিপাশা ভাবল, কী হয় যদি ও একবার রাতে ফোন করে ছেলে-টাকে? একবার-ই তো। নাম্বার-টা তো মুখস্ত হয়ে গেছে। একবার কল করলে তো মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। আজ রাতে একবার কলমাত্র। টা নয়তো তো ছেলে-টা কে মোটে জানা-ই হবে না। না জেনে, না চিনে মানুষ থাকতে পারে! সন্দেহ নেই, ছেলে-টা দেখা করতে চাইলে দেখা করবে না বিপাশা। আবার কেউ ওর উচ্চতা, গা-এর রং নিয়ে কিছু বলুক, সে সুযোগ দেবে না ও। এ্যাতসব ভেবে-টেবে নিচু গলায় বলে দিলো,
--- ডোন্ট মাইন্ড, মিস্টার রুদ্রপাল। আমি রাতে আপনাকে ফোন করবো।
--- সো কাইন্ড অব ইউ! বলে ছেলে-টা একটা মোক্ষম চুম্বন দেগে দিলো তার মোবাইল ফোনে।
বিপাশা লক্ষ্য করেনি কখন পাশের সীটের শুভমিতা এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। সে ফিস ফিস করে প্রশ্ন করে বসে--- কাকে এসব বলছ? তুমি জানো, টি এল জানতে পারলে রক্ষে থাকবে না। আর তোমার কল-টা যদি বার্জ করে কোয়ালিটি? ফেটাল-টেটাল নয়। সোজা টার্মিনেশন। জানো তুমি, বিপাশা দি?
চমকে ওঠে বিপাশা। তারপর অনুনয় করে শুভমিতা-কে বলে--- তুমি কাউকে বোল না, প্লীজ। ছেলেটা রোজ হাতে-পায়ে ধরে প্রোপজ করে, গো। আজকে কেমন যেন হলো! আমি কী করি, বলোতো?
--- আমাকে কাউকে বলতে হবে না। কলগুলো রেকর্ড হয়, তুমি জানো না?
তখনও রুদ্রপাল ফোন ছাড়ে নি। হয়তো আরো কিছু প্রত্যাশা করেছিল। এবারে শুভমিতা বলল--- দেখি, এটা কোন নাম্বার। দেখামাত্র প্রায় চেঁচিয়ে উঠল--- এ তো সেই কুত্তা-টা! সুপ্রিয় রুদ্রপাল! তুমি ওকে এসব বলেছ! এ ব্যাটা প্রাঙ্ক কলার। আমাকে-ও জ্বালায় রোজ। শুধু আমাকে না। দেবযানী, মনিকা, রিনি--- সবাইকে কল করে জ্বালায়। আশ্চর্জ তোমার কাছে আগে কক্ষনও প্র্যাঙ্ককল আসেনি?
কথা-টা শোনামাত্র কান-মাথা ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে বিপাশার। কোনো কথা কানে ধুক্তে চায় না। ও শুনেছে, এই অফিসে কুত্তা গালাগাল-টা খুব চলে। কিন্তু প্র্যাঙ্ককল কী--- সেটা তো জানে না। তাই শুভমিতা-কে জিজ্ঞেস করে,
--- প্র্যাঙ্ককল কী গো?
--- ফালতু কল। কোন কোন কাস্টমারের খেয়ে বসে কাজ নেই। কিম্বা হয়তো সাইকো। টোল নম্বরে কল করে, হেজায়, গালাগাল করে, ফ্লার্ট করে। আরো কতো কী করে! কাটো কাটো। খবর্দার! এদের-কে প্রশ্রয় দেবে না। বাজে কথা বললেই কল-টা ভারবিএজ দিয়ে কেটে দেবে। না পারলে টিএল-কে ধরিয়ে দেবে। তোমাকে অনেক টেকনিক শিখে নিতে হবে। এসব সেনটিমেন্টে নেবে না। এটা প্রফেশন। তুমি তো নতুন। তোমাকে এসব জেনে নিতে হবে, শিখে নিতে হবে।
ততক্ষণে চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেছে বিপাশা। চোখের সামনে মনের মধ্যে গড়ে ওঠা রং-বেরংএর সৌধটা হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়েছে। মনে মনে ভাবে বিপাশা, তাহলে আমি তাস দিয়ে একটা মিথ্যে প্রাসাদ বানাচ্ছিলাম! সামান্য হাওয়ায় সেটা যেই পপারচ, অমনি আমি মমারচ! ছি! ছি! ছি!
এরপর বিপাশা চোখের জল রুখতে পারেনি। মুখে হাত চাপা দিয়ে ওআশরুমে গেছে। লজ্জায়-ঘেন্নায় মরে যাচ্ছিল ও। কিন্তু শুভমিতা বয়সে ছোট হলেও যেন জীবন-টাকে বেশি দেখেছে। মেয়ে-টা ওকে অনেক-টা সাপোর্ট দিয়েছে। চোখের জল মুছতে মুছতে বাড়ি-তে এসেছে। জল যেন আর বাঁধ মানছে না। একটা সময় তো সব শোক ভুলে যেতে হয়। সময় ভুলিয়ে দেয়। তখন চোখের জল মুছেছে বিপাশা। বাড়ির সকলে বিস্মিত। মেয়েটার কী হলো! কেমন যেন আগের মত আগের মতো লাগছে! আবার কী হল! ঠিক তখনই বিপাশা বাবা-কে জানালো,
--- আমি আর চাকরীতে যাবো না। আমি স্কুল সার্ভিস পরীক্ষায় বসবো, বাবা। একটা টিচারি ঠিক জুটিয়ে নেবো। এ চাকরি-তে থেকে আমার কোয়ালিফিকেশন-টা নষ্ট করবো না। তাতে তোমার অমর্যাদা হবে। কারোর মুখাপেক্ষী হতে হবে না, বাবা। কারোর দয়া নয়। আমি বাঁচবো, বাবা। আমরা বাঁচবো।
--- তোর যা করতে ইচ্ছে হয়, মা, তাই করিস। আমরা তোর সাথে আছি।

---------------------


 

কোন মন্তব্য নেই: