শনিবার, ১ অক্টোবর, ২০১১

'একদিন হঠাৎ' ছোটগল্প

IF YOU DON'T HAVE BANGLA WORD FONT, YOU CAN'T READ THE BLOG



একদিন হঠাৎ

হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়

                                                
মা
থায় হেনা লাগিয়ে ব’সেছিল মৈথেলি। আজকে উইক অফ। এই উইক অফ’টাতেই ও একটু রূপচর্চা করে। রূপচর্চা মানে একটু চুলের যত্ন, একটু মুখের ত্বক দেখাশুনো, একটু নখ শেপ করা। এমনিতে তো সময় হয় না। টেকনোপলিসের ব্যাক অফিসে আছে ও। বিরাট ওয়ার্ক লোড। শুধু অফিসে কাজ করলেই হয় না। ল্যাপটপ-এ বাড়িতে ব’সেও অনেক কাজ আপডেট করতে হয়। এদিকে বাড়িতে বাবা শয্যাশায়ী। জোর ক’রে কোম্পানি থেকে ভোলানটারি রিটায়ারমেনট ক’রিয়ে দেবার আঘাতটা মেনে নিতে না পারায় একটা সেরিব্রাল এ্যটাক বাবাকে বিছানায় ফেলে দিয়েছে। আজ মৈথেলির মাকে গোটা ভেতরটা আর ওকে বাইরেটা সামলাতে হয়। যে টাকা বাবা পেয়েছে, তা ব্যাঙ্কে ফিক্সড করলেও তো ভিক্ষা। তাই মৈথেলিকে বাবার অমত সত্বেও বাড়ি থেকে বেরোতে হয়েছে। ও অফিসে বেরিয়ে যায় সকাল সাতটায়। তারপর থেকে সে-ই মা। সংসার সামলায়, বাবাকে সামলায়, কিন্তু মুখে রা-টি কাটে না। মানুষ যে নিতান্ত আপনজনকেও শুশ্রূষা করতে করতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তা যেন মাকে দেখে বুঝতে পারে না মৈথেলি। ক্লান্ত হয়ে মেয়ে বাড়ি ফেরে, তাকেও দেখতে হয় সেই মাকেই। মৈথেলির কিছু করারও নেই। অনেকবার ভেবেছে, চাকরীটা ছেড়ে মার পাশে থাকবে। তবে মা একটু সঙ্গী পায়। মা-টা আর পারেনা এই বয়সে। কিন্তু ভয় হয়। এ্যাতোগুলো টাকা মাইনে! মার যদি কিছু হয়ে যায়, তবে অন্তত বাড়িতে কাজের লোক, নার্স বা অন্য কোন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখতে গেলে টাকা চাই। বাবার জমানো টাকাতে সারা জীবনটা চলবে না, চলতে পারে না। তাই বিয়ে-টিয়ে করার কথা ভাবতে পারে না মৈথেলি। একগাদা রূপ নিয়েও মৈথেলি আইবুড়ি। অবশ্য ওর হাবভাব দেখে কোন ছেলে ওর আইবুড়িত্ব ঘোচাতে ধারে-কাছে ঘেঁষে না। ঘেঁষাই সার হবে। ঘেঁষাঘেঁষি তো হবে না। হতে পারে না। বাবা বা মা ছেড়ে ওর পক্ষে চলে যাওয়া সম্ভব নয়।
মৈথেলি কালকেও রাত তিনটে পর্যন্ত ল্যাপটপ-এ কাজ করেছে। মনে মনে ভেবেছে, কাল তো উইক অফ। বেশ করে স্নান-টান করে খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে নেবে ঘণ্টা বারো। তাই-ই করে ও। কিন্তু---। ভাবলেই তো হয় না। ভাগ্য চাই। ঘুম তো হলই না, মাকে নিয়ে বেরোতে হোল। বাবা বলল,
--- যা না, মাকে একটু রেখেই আয় না। সারাটা দিন না হয় এখানে সাধনা থাকবে। অবশ্য না থাকলেও তেমন কিছু হবে না। রান্না তো করেই যাবি। আমি তো চলতে-টলতে পারি, না কি! ম্যানেজ করে নেবখন।
--- তুমি বেশি পাকামো করো না তো। চুপ করে চা-টা খাও। আমরা বড়রা বুঝবো, কী করতে হবে।
মেয়ের রসিকতায় বাবা চুপ করে। বাবার শরীরটা এমন খারাপ হওয়া ইস্তক মেয়ে এমনটাই বলে। এটুকুই তো জীবন। মেয়ে আর তার মায়ের সাথে একটু রঙ্গ-রসিকতা। এটা তো ছাড়া যায় না। মেয়ে-ও তাই শিখেছে। আমরা বড়রা মানে মেয়ে, ও নিজে, ওর মা আর কাজের লোক সাধনা। মাঝে মাঝে সাধনাকে বললে সন্ধে পর্যন্ত সে এ বাড়িতে কাটিয়ে দেয়। অন্তত টিভি-টা তো দেখতে পারে প্রান ঢেলে। সেই প্রস্তাব-টাই বাবা দিয়েছে। কিন্তু মেয়ে চুপ করিয়ে দিয়েছে। অবশ্য পরে সেই প্রস্তাব-টাই মানতে হোল ওদেরকে। তবে একটু অধিকন্তু চাপিয়ে নিয়ে। মা যে-কটা দিন বড়মামার বাড়িতে থাকবে, ততদিন দু-বেলাই খাবার আসবে হোম ডেলিভারি থেকে। আর সে-ই সাধনা অন্য কাজ সেরে-তেরে এ বাড়িতে সন্ধে পর্যন্ত কাটাবে। ওর খাওয়াটাও আসবে হোম ডেলিভারি থেকে। মৈথেলি ফিরে আসে সন্ধে সাত-টার মধ্যে। তখন সাধনা চলে যাবে। কটা মাত্র দিন। মা ফিরে এলেই সাধনা যেমন কাজ করে চলে যায়, তেমনই যাবে।
মাকে যেতেই হচ্ছে বড়মামার বাড়ি। বাবা-ই জোর করল। সত্যি-ই তো। যাওয়া তো উচিত। দিদুনের বয়স হয়েছে। তার ওপর এটা থার্ডবার এ্যাটাক। যদি সারভাইভ না করে? তবে মার মনে একটা খিঁচ সারা জীবনের জন্যে ধরে থাকবে। তাছাড়া একটা মানসিক উচাটন নিয়ে তো কাজও করা যায় না। নানা ভুল্ভাল হবে, চোখের জল ফেলবে, বাবা নিজেকে অপরাধী মনে করবে। তাই বাবা-ই বলল,
--- যা না। মাকে রেখে আয় না। তুই তো আছিস। কী আর হবে!
মৈথেলি জানে, মার বিরাট দুর্বলতা মার বাপের বাড়ি। সেখানে কারোর এ্যাতোটুকু কিছু হলে মা অস্থির দারুন হয়। বাবা-ও জানে। তাই এ্যাতো কথা বাবা বলছে।
মাথায় হেনা মেখে বসেছিল তো এসব জানার আগে। ল্যাপটপ ছিল লাপ-এ। ন-আঙুল চলছিলো ঝড়ের বেগে। কাল রাতে পুরোটা সারতে পারেনি। একটু বাকি ছিল। সেটাকে সবে কাজটা কমপ্লিট করেছে, বেজে উঠলো আমার রাত পোহালো---। এটা মৈথেলির রিং টোন। কানে ধরতেই বড়মামা।
--- মিতু, তোর মা কোথায় রে?
--- ক্যানো, বড়মামা?
--- আস্তে কথা বল। মা কোথায়?
--- মা তো কিচেনে। ক্যানো? বলো না।
--- আরে, বলবো বলেই তো ফোনটা করলাম। কিন্তু দিদিকে বলা যাবে না।
ফিসফিস করে মৈথেলি বলে--- কী হয়েছে গো, বড়মামা? দিদুন ক্যামন আছে? ভালো তো?
--- না। সকালে একটা এ্যাটাক হয়েছে। তাই তোকে জানালাম। তোর মাকে বললে তো জানিস---। তুই তো এখন বেরোবি অফিসে। ফেরার পথে একবার ঘুরে যাস। তা হলেই হবে। তোর মার কাছে দোষ কেটে যাবে।
--- না। আমার তো আজ উইক অফ। কিন্তু বড়মামা, মাকে আদৌ না বলাটা কী ভালো হবে? তার মা বলে কথা। তুমি তো জানো সবই। আমি দেখছি, কী করা যায়।
--- দ্যাখ, যেটা ভালো বুঝিস। কিন্তু সাবধানে।
--- দিদুন কোথায় এখন? নার্সিংহোম-এ কি?
--- হ্যাঁ।
--- তুমি ভেবো না। দেখছি, কোনটা সুবিধে হয়।
ফোনটা কেটে মনে মনে একটা গৎ আওড়ে নেয় মৈথেলি। মাকে কী বলবে, কেমন কায়দায় বলবে। এই কারণেই বাড়িতে গোটা সিস্টেম পালটে ফেলতে হোল। মা কিন্তু সব শুনে-টুনে তেমন কোন রি-এ্যাকশন দেখালো না। শুধু তার যাওয়া পাকা হতে একবার মেয়েকে বলল,
--- তুই অফিস সামলে এসব পারবি?
কিন্তু মেয়ের চোখ পাকানোতে মা-ও চুপ করে যায় বাবার মতো।



মা
কে নিয়ে বেরিয়েছে মৈথেলি। তিনটে বেজে গেলো। বাবার খাবার ব্যবস্থাটা করে বাবাকে খাইয়ে-দাইয়ে উঠেছিলো। কিন্তু সাধনা তো তার কাজকর্ম সেরে আসবে। ও না এলে যাওয়া চলে না। এমনকি ও রাজি না হলে আদৌ মার যাওয়া হতো না হয়তো। স্টেশনের কাছেই মৈথেলিদের বাড়ি। বড়মামার বাড়ি যেতে ট্রেন ধরতে হয়, শিয়ালদায় নেমে বাস। স্টপেজে নেমে মিনিট ছয়েক হেঁটে বড়মামার বাড়ি। ও অফিস যায় বাস-এ। সোজা এক বাসেই অফিস। নো ঝুট, নে ঝামেলা। এক ঘণ্টার জার্নি। বসার সীট-টীট জুটে যায়। টারমিনাস ওদের বাড়ির সামনেই। ফলে ট্রেনে ওঠা একটা বিরাট বিরক্তিকর ব্যাপার মনে করে মৈথেলি। সেই ভিড়, ঠেসাঠেসি, গাদাগাদি, গায়ের দুর্গন্ধ। এসব বালাই নেই ওর বাসে। যারাই বাসটায় ওঠে, তাদের পকেটে রেস্ত আছে। ভাড়া বেশি। শিয়ালদা থেকে বাস মানে লক্কর-ঝক্কর। চৌতিরিশ-এর বি--- না যেন কত! মাই গড! আজকে মারাই যাবে টেকনোপলিসের একজিকিউকিউটিভ ম্যাডাম মিত্র। মামার বাড়ির সামনে যে রাস্তা, সেটা তো দুঃস্বপ্নের মতো। দোকান-ফোকান কিছু নেই। শুধু গাদা গাদা হকার ফুটপাথ ফখল করে বসে আছে। প্লাস্টিক টাঙ্গিয়ে, উনুন জ্বালিয়ে, যমের মতো মাছ কাটার বঁটি খাড়া করে--- সে এক যা তা কাণ্ড। হাঁটার কোন কায়দা নেই। কোনরকমে শরীর একিঁয়ে-বেঁকিয়ে পেরোতে হবে পথটা। বড়মামারা ভাড়া থাকে। বাড়িটা প্রায় তিনশো বছরের পুরনো। দাদুর বাবা ভাড়া নিয়েছিলেন। ভাড়া ছিল তেরো টাকা। মালিক অনেক দয়া ভিক্ষা চাইবার পর আজ তা হয়েছে সাকুল্যে একশো বারো টাকা। আজকাল মালিক ভাড়া নিতে আসেওনা। তার তো গাড়ি ভাড়াও পোষাবে না। সাকুল্যে তিনটে ঘর। কিন্তু স্যাতলা পড়া ছাল ওঠা দেওয়াল, রহস্যময় কড়ি-বড়গার ছাদ। মনে হয়, জোবচারণক-এর আমলের কোন বাড়িতে এসে উঠেছি। কিন্তু যেতে হবে। একটাও কিল খেতে না চাইলেও কেউ যদি ধরে কিল মারে, তবে যে কটা মেরে পারে, তা খেতে হবে। কিচ্ছু করার নেই। আজ অন্তত বছর ঘুরে গেছে, বড়মামার বাড়িতে যায়নি মৈথেলি।
ট্যাক্সি নেয়ার ক্ষমতা নেই মৈথেলির, তা নয়। কিন্তু ফাঁকা লোকাল ট্রেনটা দাঁড়ানো দেখতে পেয়েই মনে হলো, টাকাটা বাঁচানো যাক। তাহলে মামার হাতে আরো কিছু বেশি টাকা দেওয়া যাবে। তাই টিকিটটা কেটে ট্রেনে উঠেছে। শুরুতে তেমন ভিড়-টিড় ছিল না। কিন্তু দুটো স্টেশন যেতে না যেতে পিল পিল করে মানুষ ছুটে এসে ট্রেনের দরজায় ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগলো। বেলা বাজে তিনটে। এ্যাতো বেলায় এরা সব যায়টা কোথায়! একটু বাড়িতে কি তিষ্ঠোতে পারে না! কী মানুষ রে বাবা! এদের সবার তো বিপদ ঘটেনি। দরজার সামনে একটা ফলওয়ালা তার ঝাঁকাটা ঘটের মতো বসিয়ে রেখেছে আর নিজে কয়েকটা ফল হাতে নিয়ে ভেতরে ডেমো দিতে গেছে। কীভাবে মানুষ উঠবে গাড়িতে! ওর মা না হয় ভেতরে ঢুকে গেছে। শিয়ালদায় নামতে কোন প্রবলেম হবে না। কিন্তু একটা জিনিস অবাক হয়ে দেখছে মৈথেলি--- কেউ তেমন ভ্রুক্ষেপ করছে না। কেউ কিছু বলছে না। তারপর শুরু হোল বাদাম, দাদ, হাঁজা, চুলকানি, লেবু লজেন্স, পেয়ারা, আপেল--- মানে হরেকরকম্বা। এবার এলো সারা গায়ে মোবাইল কভার থেকে শুরু করে সেফটিপিন পর্যন্ত ঝুলিয়ে বিক্রী। তার গা-এ কী আছে, আর কী নেই! তারপর তাদের গা জ্বালানো কণ্ঠে আর কায়দায় হকিং। একেকজন একেকরকম। কী বিরক্তিকর! এরপর একটা রুই-কাতলা-ট্যাংরা-তেলাপিয়া উঠলেই সোনায় সোহাগা। ষোলো কলা পূর্ণ হয়। গোটা বাজারটাকে ট্রেনে এনে তোলা যায়। সত্যি, একটা বিদেশীর কাছে এ দৃশ্য!--- কী লজ্জা! কী লজ্জা! ভাগ্যিস, এটা ঘোর গ্রীষ্মকাল নয়। যাত্রীরা তো একে অপরের গায়ে ডলাই-মলাই করতে করতে চলেছে। তাতে যদি ঘেমো হতো তো কথাই নেই। কিন্তু সবাই নির্বিকার! মৈথেলি হাঁ করে দ্যাখে, কী অদ্ভুত এ্যাড্যাপটেশন! কী টলারেন্স! সরকার করছেটা কী! এই কি ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম? বসে বসেই অস্থির হয়ে উঠছে ও। দাঁড়িয়ে থাকলে তো হয়তো মেরে-মুরেই দিতো।
কিন্তু মৈথেলির মায়ের কোন হেলদোল নেই। মা একটু চুপচাপ। মেয়ে সবটা খুলে না বললেও নানা চিন্তা হয়তো করছে। মা তার ছোট্ট গণ্ডির বাইরে ভাবতে জানে না। রাজনীতি, অর্থনীতি, বেকারী, গণহত্যা, দুর্নীতি, জঙ্গি--- কিছুই না। আজকে বোধহয় নিজের মাকে নিয়ে খুব ভাবছে। মা একটু বেশি ভাবে। সত্যিটা বুঝতে পারে না। আরে, তুমি তো  ডাক্তার নও। ভেবে-চিন্তে তো কোন স্টেপ নিতে পারবে না। ভাববে, ডাক্তার আর বড়মামা। তাছাড়া তোমার মা-এর বয়স হয়েছে। চলে যাবার বয়স থেকে বেশি। মেনে নাও। বড়মামীরও তো বয়স হয়েছে। সে বেচারি কি পারে এ্যাতো নার্সিং করতে!
শিয়ালদায় নামতে দেখলো, সেখানেও গিজ গিজ করছে হকার। গোটা প্লাটফর্ম-টা জুড়ে ওদের রাজত্ব। হাজার পসরা সাজিয়ে বসে আছে। সেই যে, আমার এ ছোট্ট ঝুড়ি, এতে রাম-রাবণ আছে---। মানুষ এমন করে ডাকছে যেন ওদের থেকে জিনিস-পত্র কিনতেই মানুষ বেরিয়েছে বাড়ি থেকে। ওদিকে স্টেশনে জন-সমুদ্র ঢুকছে-বেরুচ্ছে। মৈথেলিকে এসব পোয়াতে হয় না। ও যায় সেক্টর ফাইভ-এ। সেটা তো ঝাঁ চক-চকে করপোরেট পাড়া। ওর অফিস তো কথাই নেই। সরকারি লেভেলের আচ্ছা-আচ্ছা উছছ-পদস্থ কর্মচারীও ওই অফিসে কোন কাজে ঢুকতে দু-বার ভাববে।
কিন্তু রবিঠাকুর বলেছেন, আজি সবার রঙে রঙ মেলাতে হবে। তার মানে, যাত্রীদের সাথে রং-মেলান্তি করতে করতে, গা ঘষতে ঘষতে অগত্যা মা-কে নিয়ে বেরলো স্টেশন থেকে। সামনেই এবার বাস। সেটা ততটা জ্বালালো না। স্টপেজে নেমে সেই কুখ্যাত রাস্তা। এখানে-ওখানে ছড়ানো শালপাতা, পলিথিন, মাছের আঁশ, ফলের আর তরকারির খোসা-ভুতি গড়াগড়ি খাচ্ছে। সেসব ডিঙিয়ে-পেরিয়ে যেতে হবে। ফলে সালোয়ারটা খানিক তুলে নিয়ে ঘিন ঘিন করা গা সামলাতে সামলাতে নিজেকে কন্ট্রোল কন্ট্রোললতে বলতে যখন পৌঁছল বড়মামার বাড়িতে, তখন বিকেল পাঁচটা। সস্তায় জার্নির তিন অবস্থা। বড়মামা, ভাই, পঞ্ছুমামারা সব গেছে নার্সিং হোম-এ। এখন সেখানে যাবার কোন মানেই হয় না। নার্সিংহোমটা কাছাকাছি নয়। তাছাড়া চেনাও নয়। থাক, এখানেই ডিটেল জেনে নেওয়া যাবেখন। মা বলল,
--- তুই কিন্তু এখনই চলে যাস না, মিতু। একটু বসে যা।
--- ক্যানো গো?
--- মামারা ফিরুক আগে। অন্তত জেনে যা, দিদুন কেমন আছে।
সেটা তেমন জরুরি নয়। তবুও মনে মনে ভেবে নেয় মৈথেলি--- কত আর রাত হবে! সাত-টা, বা আট-টা। বসাটা ভদ্রতা। টা নয়তো বাবা-ও জানতে চাইবে তার শাশুড়ির খবর। তাই মাকে বলল--- সে তো বটেই। এ্যাতোদূর এলাম ক্যানো?
ল্যাপটপটা তাড়াহুড়োয় আনেনি সাথে। আনলে বসে কিছু কাজ এ্যাডভান্স করে নেওয়া যেতো। ঘুম তো কলা হলনা। শরীর-টা বেশ ঝুঁকে আসছে। ক্লান্ত লাগছে। মোটে ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়েছে রাতে। এতে কি হয়! তাই বড়মামীকে বলে নিজেই চা বানালো, সকলকে দিলো, আর ফ্লাস্কে রেখে নিজে নিলো। যদি ম্যাজমেজে ভাবটা যায়। সোফায় বসে দেখলো, তলাকার তাকে একটা লেডিস ম্যাগাজিন রয়েছে। সেটা উল্টে-পাল্টে দেখে ঝিমুনি ভাবটা কাটাতে চাইলো মৈথেলি।




খান থেকে বেরোতে সেই বেজে গেল সাড়ে সাতটা। ভাই বলল--- চল দিভাই, তোকে এগিয়ে দিয়ে আসি।
--- না না, তুই বাড়িতে থাক। বড়মামী তো দিদুনকে দ্যাখে। তুই একটু তোর মাকে দ্যাখ। মা কিন্তু ভেঙ্গে পরবে। আমি বেরিয়ে যাবো ঠিক। আমি তো একাই চলি রে, বাবা।
বেরিয়ে পড়ে শেষে মৈথেলি। কিন্তু রাস্তায় এসে দ্যাখে, একি! গোটা রাস্তা শুনশান। কোন হকার-ফকার কোথাও নেই। সব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। এ্যাতো সকাল সকাল সব গেলো কোথায়! ওদের বিক্রী-বাটা কি মিতে গেলো! এটা কি সম্ভব! তাহলে কি হল্লাগাড়ি আসবে বলে কোন খবর আসতে সব কেটে পড়েছে? ওদের সাথে তো পুলিশের একটা আঁতাত থাকে। আগে থাকতে এসব খবর এসে যায়। ওরাই ভক্ষক, আবার ওরাই তো রক্ষক এদের। সর্বনাশ! এ তো কেউ কোথাও নেই! একটা দমকা হাওয়া যেমন রাস্তায় পড়ে থাকা কাগজের টুকরোগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে যায়, ত্যামন করে এদেরকে কোথায় নির্বাসন দিয়ে এসেছে! এর আগেও তো এখানে এসেছে ও। রাত অন্তত সাড়ে নটা অবধি তো রাস্তাটায় লোকারণ্য থাকে। অবাঞ্ছিত স্পর্শ বাঁচাতে হেলে, গা বেঁকিয়ে-চুরিয়ে পার হতে হয়। তা নয়তো যেখানে সেখানে পা পড়ে যাবে, যার-তার গায়ে ধাক্কা লাগবে। কিন্তু এ তো ভালো জ্বালা হোল। এতো রাত দুটোর রাস্তা! ঈশ্বর যেন ওর প্রার্থনা শুনে একটা পরিষ্কার রাস্তা ওকে উপহার দিয়েছেন। এবারে তো নো ঝুট, নো ঝামেলা। কিন্তু বেশ ভয় ভয় করছে তো! অচেনা অজানা জায়গা। তাই একবার মনে মনে ভাবল মৈথেলি, তাহলে ফিরে গিয়ে ভাইকে সাথে নিয়ে আসবে। ও যদি বাসে তুলে দিয়ে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই নারীত্বে লাগলো ওর। ক্যানো? একজন পুরুষকে এভাবে অবলম্বন করতে হবে ক্যানো? ভাই হলেও ও তো পুরুষ বৈ অন্য কিছু নয়। যদি দুম করে কোন অবাঞ্ছিত মন্তব্য করে বসে? থাক। কী আর হবে! একবার পেছনে তাকিয়ে ফেলে আসা রাস্তাটা দেখে নিয়ে একটু সাহসিনীর মতো পা দাবড়ে-দাবড়ে এগিয়ে চলল মৈথেলি। একটু এগিয়েই মনে হোল, কেউ বাঁ কারা যেন ফলো করছে। একটু ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখে নিলো। হ্যাঁ, পেছনে আসছে দুটো লোক। চুপচাপ। সন্দেহজনক নয়, আবার সন্দেহজনক। একটু ভেবে মৈথেলি হাঁটা-টা একটু আস্তে করে দিলো। ওমা! লোকগুলোও তো ওদের গতি আস্তে করেছে! কী কেস? এবারে সাহসে ভর করে সোজা পেছন তাকায় মৈথেলি। মা বলে, ভয় পেলে নাকি এসব হয়। আসলে কেউ নেই, কিন্তু কেউ আছে বলে মনে হয়। কিন্তু কৈ? কেউ তো নেই! খেয়েছে! ভূত-টুত নাকি রে বাবা! বেমালুম উবে গেলো লোকদুটো! এখানে তো কোন গলি-ঘুজি নেই যে, ঢুকে পড়বে।
ভূত কখনও দ্যাখেনি মৈথেলি। কিন্তু এ দেশের মেয়ে ভূত মানে না, মানে, সে মেয়ে নয়। তাকে বলা হয়--- এ মেয়ে তো মেয়ে নয়, দেবতা নিশ্চয়। ফের হাঁটতে গিয়ে গতি-টা বেশ বারিয়ে নিলো মৈথেলি। হঠাৎই ও আবিষ্কার করলো যে, ওরা দুজন নয়। এবারে চারজন জোরপায়ে ওকে ফলো করছে। মৈথেলি জানে, ওরা ওর থেকে কিছু নিতে পারবে না। ও সোনা-ফোনা পরে না। আর ব্যাগ-এ ত্যামন কিছু নেই। অনেকাটাই মাকে দিয়ে এসেছে বড়মামার হাতে দেবে বলে। অন্তত মা তো বড় বোন। তাই আর কোন চান্স না দিয়ে, সময় নষ্ট না করে এবারে দে ছুট। ওই তো বাস স্টপেজ। ওখানে তো লোকজন থাকবে নিশ্চয়ই। দেখলো, হ্যাঁ, আছে। একটা বাসও দাঁড়িয়ে আছে। ওদেরই বাস। ধাঁ করে বাসে উঠে তবে নিশ্বাস নিলো মৈথেলি। যাক বাঁচা গেলো। ম বলল, না, তাহলে গোটাটা মনেরই ভুল। ওরা হয়তো নীরিহ মানুষ। বেকার ভয় পাচ্ছিলো।
শিয়ালদা স্টেশনে এসে দেখলো, আর একটা বিস্ময় ওর জন্যে অপেক্ষা করছিলো। গোটা শিয়ালদা চত্বর-টা খা খা। কোন হকার নেই। চাকরীর ফর্মওয়ালা থকে শুরু করে লেবুওলা পর্যন্ত। কেউ নেই। হোলটা কী! প্লাটফর্ম-এর বাইরে নেই, ভেতরে নেই। সিগারেট-বিড়ি তো আগেই উঠেছে। সাজানো-গোছানো একটাও দোকান, এমনকি হুইলারসগুলো পর্যন্ত নেই। এই তো যাবার সময় দেখে গেলো। এর মধ্যে সব গেলো কোথায়! না হয় নতুন সরকার এসেছে। নানা ম্যাজিক করছে রোজ। করুক। কিন্তু এটা কী! দেশ কি পাল্টে যাচ্ছে দ্রুত? কলকাতাকে তিলোত্তমা করতে সরকার হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। কিন্তু এটা কি সম্ভব! এ্যাত দ্রুত! চারদিকে যদি এরকম নৈশব্দ থাকে, তবে তো মহা মুশকিল। না, প্যাসেঞ্জার আছে। তারা নানা ট্রেনে রোজকার মতো উঠছে-নামছে। সেখানে কোন গণ্ডগোল নেই। তবে আজকে ভিড় বেশ পাতলা। হঠাৎ মনে পড়লো, ওহো! আজ তো ঈদ ছিলো। জেনারেল বা সরকারি ছুটিগুলো মৈথেলি-রা ভোগ করতে পায় না বলে আজকাল মনেও থাকে না কবে কোন হলিডে।
প্লাটফর্‌ম খুঁজে দেখলো, ওদের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। শিডিউল টাইম জানে না ও। জানবার দরকার-ই বা কী? ছাড়বে তো বটে। এবারে বেশ নিশ্চিন্ত হল মৈথেলি। কিন্তু ট্রেন- এর মধ্যে যে আতঙ্ক আবির্ভূত হবে, তা কল্পনা-ও করেনি। একেই ভীষণরকম পাতলা প্যাসেঞ্জার, আর তার ওপর একটা-ও হকার নেই। নো লেবু লজেন্স, নো হরেকরকম পাঁজিপুঁথি, নো বাদাম, নো সেদ্ধ ডিম। কী কেস রে বাবা! সব গেলো কোথায়! ও লেডিস-এ ওঠেনি। লেডিস কম্পার্‌টমেন্‌ট কোথায় পড়ে, জানেও না মৈথেলি। আজকে অত খোঁজা যাবেও না। গোটা চার নম্বর প্ল্যাটফর্‌ম-টা ঘুমন্ত সাপ-এর মতো একটু বেঁকে শুয়ে আছে। আরো আগে এগিয়ে যাওয়া যেতো। কিন্তু কেমন যেন অন্ধকার অন্ধকার! বড় নির্জন, বড্ড একা একা। একটা নিরাপত্তাহীনতা গ্রাস করছিলো ও-কে। কবে যেন কে বলেওছিলো, লেডিস কামরায় কোনোদিন ভুলেও উঠবি না। সব অসভ্য মহিলা উঠে বেজায় ঝামেলা করতে করতে যায়। মুখ খারাপ করে। তাছাড়া আজ যদি জেনারেলে এমন হাল হয়, তবে তো সেখানে একটা-ও মহিলা পাওয়া যাবে না। থাক বাবা। দরকার নেই মহিলা সঙ্গ করবার। পুরুষেরা অতটা অসভ্য হয়ে পারে নি আজও।
কিন্তু ট্রেন যখন ছাড়ল, তখন কামরায় সবর্সাকুল্যে গোটা দশেক যাত্রী। হঠাৎ কোথা থেকে চারটে লোক ধাঁ করে দক্ষ হাতে গেট-এর মুখে দাঁড় করানো রড-টা ধরে উঠে পড়লো কামরায়। মৈথেলি-র মনে হল, এরাই যেন রাস্তা-র সেই চারটে লোক। ওকে ফলো করতে করতে ট্রেন অবধি এসে উঠেছে। ঐ রাস্তায় আলো ছিলো বটে, কিন্তু সেই কভার দেওয়া টিউব লাইট। তাতে তো পোকা পড়ে পড়ে আর মরে মরে অন্ধকার। অন্ধকারে তো ওদের মুখ-টাও দেখতে পায়নি ও। ট্রেন ছাড়তেই লোকদুটো হঠাৎ কোমর থেকে আগ্নেয়াস্ত্র বের করলো। বেশ পরিষ্কার হওয়া গেলো যে, ওরা ডাকাত। ঘড়ি, চেন, মানিব্যাগ, মোবাইল, আংটি কেড়ে নিতে এসেছে। সবাই চুপচাপ। এরা সবকটা পুরুষ মানুষ! বাড়িতে গিয়ে বৌ-বাচ্চার ওপর হম্বি-তম্বি মারে। এখন দেখো, যেন ভ্যাদা মাছ। চোখ নেই, কান নেই, মুখ নেই। এর মধ্যে একটা লোক মৈথেলির কাছে এসে কোন কথা না বলে প্রায় ওর বুকে হাত দেবার মতো করে হাত বাড়িয়ে বলল,
--- গলার চেন-টা খুলে দেবেন, না হ্যাঁচকা মারবো?
কাঁপতে কাঁপতে মৈথেলি বলল--- এটা….. না…. ইমিটেশন। আমি….. সোনা….. পরি না।
--- সোনা পরিস না কেন, মাগী?
লে এবারে ওর যত্নে ক্রীম মাখা ফেসিয়াল করা তুলতুলে গালে পড়লো লোকটা-র হাতে মারা ঠাস শব্দ করা একটা চড়।



ব্যস, চড় খেয়ে একটা ঝটকায় তন্দ্রা-টা কেটে গেলো মৈথেলির। তাকিয়ে দেখলো, সামনে ভাই দাঁড়িয়ে।
--- দিভাই, তুই খুব ক্লান্ত না? ঘুমিয়ে পড়েছিলি পত্রিকা-টা পড়তে পড়তে? ঠাম্মা একটু বেটার রে। তুই এবারে বেরিয়ে যা। পিসেমশাই আছে। তোকে তো বেরোতেই হবে। আর কত রাত করবি! সাড়ে সাত-টা বাজে। আমি তোর জন্যেই ছুটতে ছুটতে আসছি। জানি, তুই খবর-টা জেনে তবে যাবি। চল্‌, তোকে এগিয়ে দিয়ে আসি।
--- থাক। তোরা ক্লান্ত না! আমি পারবো। তোর দিদি লবঙ্গলতিকা নাকি?
ভাই-কে থামিয়ে দিয়ে এবারে মা-কে ডেকে মা-এর হাতে বেশ কিছু টাকা দিয়ে চোখেমুখে একটু জলের ঝাঁপটা মেরে বেরিয়ে পড়ে মৈথেলি। রাস্তায় এসে দেখলো, নাঃ, সব-ই ঠিক আছে। চারদিক আলো ঝলমল। লোহা-র রডে বাল্ব ঝুলিয়ে কত হকার নানা জিনিস বিক্রি করছে! জমজমাট গোটা রাস্তা। দুটো লোক বসে দারুণ দারুণ পারশে আর রুইমাছ বেচছে। রূপোলী ঝক্‌ঝকে মরা মাছ কিন্তু দেখলে মনে হয় জ্যান্ত জ্যান্ত। পারশে মাছগুলো যেন মৈথেলি-কে বলছে, এই মেয়ে-টা ভেলভেলে-টা / ঝোল খাবি? তো মাছ নিয়ে যা। পারশে মাছ প্রিয় মৈথেলি-র। মন-টা বড় ফুর্‌ফুরে লাগছে। তাই কোন অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবে আড়াই-শো টাকা দরে কিনে নিলো হাফ কেজি। গোটা রাস্তা-টা যেন একটা উৎসবে মেতেছে। বেশ লাগছে। কত মানুষ! এখানে কে কাকে ফলো করবে! কার বাবা-র সাধ্য! এ্যাতগুলো মানুষ আছে না! মেরে তক্তা খসিয়ে দেবে। মাছওয়ালা-কে বলল মৈথেলি,
--- বড়ভাই, একটু ভালো করে প্যাক করে দেবেন। আমি অনেক-টা যাবো কিন্তু। লোকে গালাগাল না করে।
--- কোন চিন্তা নেই, দিদি। আমি কেটে সাইজ করে দারুণ করে দিচ্ছি। আপনি-ও মনে রাখতে পারবেন না, এটাতে মাছ, না আপেল।
--- আপনি আবার কাটবেন! আপনার তো অনেকটা সময় নষ্ট হবে, ভাই।
--- আপনি দিদি, বোধহয় বাজার-টাজার যান না, না? আমাদের সময় কে শুনছে, বলুন? এখন এটাই তো আমাদের কাজ। করতেই হবে।
মাছ-টা প্যাক করে নিয়ে হাঁটা দিলো মৈথেলি। গুন গুন করে গান-ও ধরলও, আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ, সুরের বাঁধনে। এবারে ছ-খানা হ্যান্ড রুমাল কিনলো ফুট থেকে। বেশ ভালো। দোকানে কিনলে অনেক দাম নিতো। স্টেশনে এসে টিকেট কেটে দেখলো, ট্রেন-টা অপেক্ষারত। নাঃ, কলকাতা আছে কলকাতা-তেই। কোথাও কোনো চেঞ্জ নেই। কোন নতুন আইন কোনো সর্‌বনাসা ম্যাজিক করেনি। ভিড়ে ভিরাক্কার। সরগরম শিয়ালদা প্ল্যাটফর্ম- টাও। চীৎকার চেঁচামেচি ব্যস্ততা/এই নিয়ে হল কলকাতা। ট্রেনে উঠে আরামে নিশ্চিন্তে চোখ-টা বুজলো মৈথেলি। না, ঘুম আসছে না। মন গাইছে, বড় বিস্ময় লাগে…..’. ওর বড় আনন্দ লাগছে আজ। কোথাও কোন বিপদ নেই, খেদ নেই, ক্ষোভ নেই, রাগ নেই, ঘেন্না নেই, ছুতমার্গ নেই। চারদিকে মানুষ আছে। অনেক অনেক মানুষ। তারা-ই তো ভরসা। পানের থেকে চুন খসলে রে রে করে ছুটে আসবে। এটাই তো মৈথেলি-র চেনা শহর। মৈথেলি-দের তিলোত্তমা।
হঠাৎ কানে আসে, ছোলে! সেদ্ধ ছোলে! মশলা ছোলে!
চোখ তাকায় মৈথেলি। একটা বাচ্চা ছেলে রাত ন-টায় একটা ঝুড়িতে লাল কাপড় দিয়ে আবৃত করে সেদ্ধ ছোলা বেচছে। কাপড়ের ওপরে সাজিয়ে রেখেছে অর্ধেক করে কাটা পাতিলেবু। এই মশলা ছোলা ছোটবেলা খেত ও। নোলা-টা সপ্‌ সপ্‌ করে উঠলো। বড় হয়ে অবধি এসব তো খাওয়াই হয় না।
--- আমাকে চারটাকা-র ডে তো, বাবা। ফাইন করে দিবি কিন্তু। লেবু দিবি না।
এ্যাত রাতে কোনো মেয়ে-র কাছ থেকে অর্ডার তো পায় না ব্যাটা। তাই মন দিয়ে ঝাল- টাল দিয়ে লোভনীয় মিক্সচার বানালো। একটু মুখে দিয়ে মৈথেলি বলল--- দারুণ বানিয়েছিস তো। তোর নাম কী-রে?
--- মন্‌টু। ছেলে-টা উত্তর দ্যায়।
--- কোথায় থাকিস?
--- আগরপাড়ায়। রেল বস্তি-তে।
--- শোন, এরপর থেকে লেবুগুলো না, কেটে কেটে রাখবি না।
ছেলে-টার কৌতূহল--- কেন? কী হয়?
--- ওগুলো না, বিশ হয়ে যাবে। বুঝলি?
ছেলে-টা মাথা নেড়ে সায় দিতেই ওকে টাকা দ্যায় টেকনোপোলিসের এক্সিকিউতিভ মিস্‌ মিত্র। আর এই প্রথম ওরকম একটা নোংরা ছেলে-র চিবুক নিজের হাত-এর পাঁচ আঙ্গুলের মাথা দিয়ে ছুঁয়ে নিজের ঠোঁটে ছোঁয়াতে গিয়ে-ও ছোঁয়াল না মৈথেলি। বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। সবাই দেখছে।

--------------------





















কোন মন্তব্য নেই: