শুক্রবার, ৭ অক্টোবর, ২০১১

'প্রত্যর্পণ' ছোটগল্প


প্রত্যর্পণ

হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়

বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটা । জগন্ময় বাবু-র বাড়ি-র একেবারে সামনে, অর্থাৎ পরিস্কারভাবে বললে বলতে হবে যে, খোদ জগন্ময় বাবু-র বাড়িতেই একটি টাটা-৪০৭ গাড়ি এসে থামল, যাতে রয়েছে বাড়িতে ব্যবহার্য নানা বৈদ্যুতিন এবং অন্যান্য নানা আধুনিক ও অত্যাধুনিক পণ্যদ্রব্য, যা জগন্ময় বাবু ও তাঁর পরিবার দেখে পরিষ্কার চিনতে পারলেন । কিন্তু পরিষ্কার হতে পারলেন না, এগুলো কী কারণে তাঁদের বাড়িতে ফিরে এলো। গাড়িটা থামল আর তা থেকে নামলেন স্বয়ং পরিতোষ গাঙ্গুলি । পরিতোষ গাঙ্গুলি জগন্ময় বাবু-র সদ্য আত্মীয়তা-বন্ধনে আবদ্ধ কুটুম, অর্থাৎ আরো স্পষ্ট করে বললে তিনি জগন্ময় বাবু-র সাম্প্রতিক বেহাই মহাশয় । বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরে । গাড়িটা দাঁড়াতে বাড়ির সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হল সেদিকে । এদিকটাতে তো নেহাৎ কেউ নতুন বাড়ি-টারি করে শিফ্‌ট করা ছাড়া গাড়ি নিয়ে ঢোকে না । ঢোকার জায়গাই নেই । বড়োজোর একটা টাটা-৪০৭ কোনোভাবে ঢুকতে পারে । তাই প্রায় সকলে, এমনকি বাড়ির ঠিকা ঝি পর্যন্ত বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো, ব্যাপারখানা কী । জগন্ময় বাবুও বাড়িতে উপস্থিত । সকলের চোখ চড়কগাছ । সাত সকালে হচ্ছেটা কী ! পাড়ার মানুষ কী বলবে! এবার তো সকলেই দেখবে । গাড়িতে যে মালপত্র আছে, তা কেউ কখনও ফেরত দিয়েছে, এমনটা শোনেনি কেউ, দ্যাখেনি বা গল্প-উপন্যাসেও পড়েনি পর্যন্ত । না, পরিতোষ বাবু তো মানুষটা মন্দমানুষ নন্‌ । এসব তো তিনি নিতেই চাননি । তিনি বেশ আধুনিক আর সজ্জন মানুষ । তাঁর থেকে এমন আচরণ অপ্রত্যাশিত তো বটেই, কল্পনাতীত। তবে কি সরষের মধ্যেই ভূত ছিলো ? এগুলো কি পছন্দ হয়নি, নাকি ? কিন্তু তাহলে এ্যাতদিন বাদে ? দেখতে হচ্ছে কী ব্যাপারটা ।


অঞ্জলি-র জন্যে একটার বেশি দুটো সম্বন্ধ দেখতে হয়নি হয়নি জগন্ময় বাবুকে । প্রথম এ্যাপয়েন্‌মেন্‌ট-ই পরিতোষ বাবুর সঙ্গে, আর এটাই ফাইনাল । তবে একথা ভাববার কোনো কারণ নেই যে, অঞ্জলি এমন সুন্দরি, তাকে দেখে পাত্র তো পাত্র, পাত্রপক্ষেরও মাথা-উথা ঘুর গিয়া অবস্থা । বরং অঞ্জলি একটি অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে । সাধারণ গা-এর রং, সাধারণ তার শিক্ষাগত যোগ্যতা, চুল, চোখ, উচ্চতা ইত্যাদি যা যা পাত্রপক্ষকে দেখে-টেখে নিতে হয়, তার কোনটাই বাহ্‌বা দেবার মতো নয় । বরং পরিতোষ বাবু-ই বাহ্‌বা পাবার যোগ্য । তিনি জগন্ময় বাবুকে বললেন,
--- এটা শুধু আপনার প্রথম ম্যারিটাল এ্যাপয়েন্‌টমেন্‌ট নয়, জগন্ময় বাবু । আমাদেরও ।
--- তাই নাকি ! সেটা তো আমার মেয়ের সৌভাগ্য । আপনাদের ছেলে তো সত্যি-ই সুকুমার । আপনি ইচ্ছে করলে আরো অনেক ভালো পাত্রী পেতেন । তাছাড়া ভালো চাকরী, আপনার মতো সজ্জন পিতা তার । সেখানে তো আমার মেয়ে সামান্য, অতি সাধারণ । তবে আপনি দয়া করে বাবাজীবনের একেবারে ভেতরের কথাটা জেনে নেবেন । সে হয় তো বাবা-র ব্যক্তিত্বে এ সম্বন্ধটা মেনে নিতে বাধয় হচ্ছে । হতেও তো পারে । আমার কিন্তু ভয় হচ্ছে । আজকাল তো ওদের মতের একটা বিরাট অর্থ এসে দাঁড়িয়েছে ।
পরিতোষ বাবু চোখ থেকে নিজের চশমাটা খুলে একবার জগন্ময় বাবুর দিকে চেয়ে নিলেন। তারপর বললেন--- আপনি আমাকে কী ভাববেন, জানিনা মশায় । আমি কিন্তু এ ব্যাপারে একেবারে গোঁরা প্রকৃতির মানুষ । ছেলেদের বিয়ে দেবো, ঠিক আছে । কিন্তু পরিবার-টা আমার । আমি তার প্রধান । সেখানে অন্যদের তেমন কথা-টথা আমি বলতে দেই না । দিলেই বিপদ । গণতন্ত্রের অনেক জ্বালা । যত মত তত পথ । মানে, নানা মুনির নানা মত । মানে ? কোন মত-ই কাজ করছে না । মানে ? ঢোল বাজছে কিন্তু নাচা যাচ্ছে না । তবে বাজিয়ে লাভ কী ? তার চেয়ে একজন-এর মত-ই ভালো ।
--- ও!
হাঁ করে শোনেন জগন্ময় বাবু। -এর বেশি কোনো শব্দ করতে পারেন নি তিনি । বুঝে নিয়েছেন যে, এটা কঠিন ঠাঁই । তবে তিনি বিস্মিত এটা জেনে যে, আজও পরিতোষ বাবুদের একান্নবর্তী পরিবার । বিয়ে করলেই যে ছেলেরা বাবা-মাকে ছেড়ে পালায়, সেটি এখানে খাটছে না । তিনি নিজেও অবশ্য চান না এমনটা । আজ-কালকার ছেলেদের বিশ্বাস নেই কোন । যে কোন ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারে । কিন্তু যদি এমন একটি শ্বশুর তার মেয়ের থাকেন, তবে চিন্তা আর কী ? এ তো বন থেকে ধরে আনা বাঘ ।
--- তাছাড়া, দেখুন । বিবাহ শুধু দুটি নারী-পুরুষের মিলিত সম্বন্ধ নয় । দুটো পরিবার, দুটো সমাজ, দুটো সংস্কৃতি আর দুটো সংস্কার এর মাধ্যমে মিলে যায় এক বন্ধনে । এ সম্বন্ধ পাকা হলে আপনাদের সম্মান আমাদের, আমাদের সম্মান আপনাদের। বিশেষ করে আমার ওপরে ওদের ভরসা আছে । ছোটো-টা তো তার বউদিকে দেখছে । সে তো আমারই পছন্দ । কিন্তু আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায় ।
--- বলুন । আপনার কী প্রশ্ন ?
--- আপনারা তো যথেষ্ট বিত্তশালী পরিবার । আমাদের মতো ছা-পোষা পরিবারে কি আপনার মেয়ে বিয়ে দেওয়া সমীচীন হবে, জগন্ময় বাবু ? আমি তো আপনাদের অবস্থা জেনে আসিনি । এসে দেখছি, এগোনো ঠিক হবে না ।
ব্যস্ত হয়ে ওঠেন জগন্ময় বাবু । ক্যানো ? এমনটা মনে হচ্ছে ক্যানো ? আমরা কি আপনাদের সামনে আমাদের বিত্তের কোন গরিমা প্রকাশ করেছি ? তাছাড়া লক্ষ্মী তো চঞ্চলা । আপনার ছেলেদুটি তো সবে চাকরী পেয়েছে। দেখতে থাকুন ।
--- বলছেন ?
--- তাছাড়া আপনাকে আমার মনে ধরেছে । এখানে আমার মেয়ে-র বিয়ে হলে সে একটা ভালো পরিবেশে থাকবে, আমাকে মেয়ের বাপ হয়ে বিবাহোত্তর নানা দুশ্চিন্তায় পড়তে হবে না । শান্তিতে মরতে পারবো অন্তত । আজকাল তো শোনেনই, কতই না ঘটনা ঘটছে । ভয় লাগে । তাই বলে মানুষের পেটের মধ্যে ঢুকে যেমন তাকে যাচাই করতে পারি না, তেমনই মেয়ের বিয়ে তো দিতে হবেই । আর যদি আমার মেয়ের কথা বলেন তো, বলি । আমার মেয়ে তো কোন বিরাট কোন বিদুষী নয়, অপ্সরাও নয় । বিত্ত তো আছে ওর বাবার । ওর তো নয় । আপনিই বলুন, শুধু ধনে কি কাজ হবে, পরিতোষ বাবু ? আপনি কি আপনার মেয়ের বিয়ে ধনৈশ্বর্য দেখে দিয়েছিলেন ? একটা ভালো ফ্যামিলি, ভালো জীবনসঙ্গী--- এই তো চাই । জীবনে সুখ না পাক, আনন্দ যেন পায় ।
--- বা ! বা !! বেশ বলেছেন । সুখ না পাক, আনন্দ যেন পায় । এবারে বলুন তো, সুখ আর আনন্দের এই তফাৎ কি ওরা, মানে এই প্রজন্ম বোঝে ? ওদের মতের কী দাম ! নিন, আমি রাজী ।
--- তাহলে হয়ে যাক ।
--- হ্যাঁ, হয়ে যাক ।


বিবাহ ঠিক হয়ে গেছে । পরস্পর পরস্পরকে মিষ্টিমুখ করিয়েছে । মহিলামহলে হাসি-হুল্লোড়ের মধ্যে জগন্ময় বাবু আসল বিষয়টি তুলেছেন--- পরিতোষ বাবু, এবারে আসল কথাটা হোক ।
--- কোনটা বলুন তো ? হয়েই তো গেলো । আকাশ থেকে পড়েন পরিতোষ বাবু ।
--- বিয়ের ব্যাপার, মশাই । এ্যাতো তাড়াতাড়ি কি হবে ? সাত কথা না হলে কি বিয়ে হয় ? এবারে বলুন তো আপনাদের দাবি-দাওয়া কী ।
ঝুলে পড়ে পরিতোষ বাবু-র মুখ। কী বলবেন, ভেবে পান না। কীভাবে উত্তর দেওয়া যায়, তার আগা-মাথা বুঝতে পারলেন না । পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন--- আমাদের একটাই দাবি । দয়া করে বিয়েতে মেয়ে ছাড়া অন্য কিছু দেবেন না। আমাদের মেয়েটিই চাই । ব্যস ।
--- বা বা বা ! সে তো ভালো কথা । তবু তো একটা কর্তব্য আছে আমার । অবশ্য পাত্রপক্ষ-কে আমি চাইবার কোনো সুযোগ দেবো না । চাইবার বেশি-ই দেবো আমি ।
প্রতিবাদ করেছেন পরিতোষ বাবু--- না, জগন্ময় বাবু । দয়া করে ওটাও করবেন না ।
--- সে কি বলছেন ! আমাদের তো একটা সমাজ আছে, পাঁচজন আত্মীয়-পরিজন আছে, নিমন্ত্রিত মানুষজন আছে । অন্তত ঘরের মহিলারা তো আছে । তাদের মুখে মুখে তো ঢি ঢি প'ড়ে যাবে, পরিতোষ বাবু । আমার গায়ে তো তারা স্ট্যাম্প মেরে দেবে, আমি আমি কিপটে বুড়ো, হাড় কেপ্পন, তারপর আজকাল ঐ যে 'মক্ষীচুষ' না কি বলে যেন । এসব গঞ্জনা সইতে হবে । এটা হয় কী করে ? এটা আমার বাড়ির শেষ কাজ । নমো নমো করে কীভাবে সারি বলুন তো ? তাছাড়া আমার বড়ো মেয়ের বিয়ে দিয়েছি । তাকে তো নানা যৌতূক দিয়েছি । সে সব যদি ছোট মেয়েকে না দিই, তো তার কাছে আমি ছোটো হয়ে থাকবো । সেটা কি…..
--- তাই বলে এভাবে বড়ো হওয়া কিনবেন ?
--- কোনো উপায় নেই। এইভাবেই কিনতে হয়, দাদা । যস্মিন দেশে যদাচারঃ। আপনিও এভাবেই কিনেছেন ।
মৃদু হেসে টেবিল থেকে জলের গেলাস-টা তুলে নিয়ে ঢক ঢক করে গোটা-টা গলায় ঢেলেদিলেন পরিতোষ বাবু । তারপর বলেন--- না, আমার মেয়ে বা বড়ছেলে, কারোর ক্ষেত্রে এসব দেওয়ানেওয়া ঘটেনি । দুটি ঘটনাই ঘটেছে আমার ছোটোবেলাকার দুই খেলার সাথীর পরিবারে । আপনি ঠিকই বলেছেন । সেই বিবাহ দুটি ঘটেছে কেবল পরিবার দেখে । আমাদের দিকটা ভাববেন না । ওক্ষেত্রে আমাদের বড়ো হওয়া থেকে আত্মীয়তা-টাই বড়ো হয়ে উঠেছিল । তাই আপনার প্রস্তাব মানতে পারছি না । বস্তু বড়ো ভয়ের জিনিস । মানুষকে অমানুষ করে দ্যায় ।
এবারে পরিতোষ বাবুর দুটি হাত ধরেন জগন্ময় বাবু । একেবারে অনুনয় করে বলেন--- আমাকে বাঁচান আপনি । এভাবে এই সম্বন্ধ টা ভেঙ্গে দেবেন না । আমাকে আমার মেয়ের কাছে, বা মেয়ের মায়ের কাছে ছোটো হতে দেবেন না । আপনিই তো বললেন, আমার সম্মান আপনার সম্মান । আমি তো পণ দিচ্ছি না । আর আপনিও তো চাইছেন না । কিন্তু বাবা কি তার মেয়েকে হাতে ধ'রে কিছু দিতে পারে না ? এই কি আপনার বিচার !
বাধা দিতে পারেননি পরিতোষ বাবু । বুঝতে পেরেছেন যে, তিনি হয়তো যেমন করে জীবনটাকে দেখেন, তেমনটা করে দেখতে পারেন না জগন্ময় বাবু । হতেই পারে । কী আর করা যাবে ! হাতের পাঁচটা আঙ্গুল তো একই রকম হয় না । ভদ্রলোকটির সাথে যতই কথা বলেছেন, ততই তাঁকে আরো বেশি করে শ্রদ্ধেয় মনে হয়েছে । যে বাড়ির বিত্তবান পারিবারিক প্রধান এমন বিনয়ী, সে বাড়ির অন্যান্য সকলে হুবহু না হলেও তাঁর ধারে কাছে টো বটেই। থাক, যদি বাবা মেয়েকে কিছু যৌতুক দিতে চান, দিন । বস্তুটার কোন দাম তো থাকে না যদি মানুষটা ভালো হয় । ব্যক্তিরই তো মূল ভূমিকা । মানুষ বস্তু নিয়ে যখন মাতামাতি করে, তখনই তো বস্তু এসে মানুষের মাথায় ওঠে । বস্তুকে বস্তুর মতো থাকতে দিলেই হয় ।



তাই বিবাহ হয়ে গেছে মহা সমারোহে এবং সত্যিই জগন্নাথ বাবু যৌতূক হিসেবে যা যা দিয়েছেন সাজিয়ে, তা সবটা দাবি-দাওয়া করে নেওয়া সম্ভব নয় । এর অনেক কিছুর নাম এবং ব্যবহার তিনি নিজেই জানেন না । সব অত্যাধুনিক ব্যবহার্য সামগ্রী । যে টেলিভিশন-টা জগন্ময় বাবু দিয়েছেন, তেমনটা যে টেলিভিশন আদৌ হয়, তাই তিনি জানতেন না। এ যেন দেওয়ালে টাঙ্গানো একটা ক্যালেন্ডার। অবশ্য বাইরের জগতের কতটুকুই বা তিনি জানেন ! তিনি যে বিদেশী কোম্পানী-তে উচ্চ পদে কাজ করতেন, তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো । সে তো আজ ইতিহাস। কিছুদিন চালিয়েছেন জমা টাকায় । সে বয়সে তো নতুন করে চাকরী পাওয়া দুরাশা । বড়ো ছেলে বড়ো ছেলের মতো কাজ করেছে সে সময় । সারা দিনরাত ছাত্র পড়িয়ে নিজের পড়াশুনো, ভাইবোন-এর পড়াশুনো আর সংসার চালিয়েছে । আজ এ বাড়ি একটু সুখের মুখ দেখছে । দারিদ্রের মহিমা বুঝতে পেরে তিনি বড়ো ছেলের বিবাহ-ও দিয়েছেন দরিদ্র পরিবারে । তাঁর-ই কোলিগ। কোম্পানী বন্ধ হতে তিনি সর্বহারা হয়ে গিয়েছিলেন। প্রকৃত একজন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা-কে তিনি উদ্ধার করেছিলেন ।
ফলে পরিতোষ বাবু পড়ে আচ্ছেন সেই উনিশ-শো চল্লিশ সালে । প্রাচীন মূল্যবোধ, প্রাচীন মানবিকতা, আতিথেয়তা, অর্থাৎ পুরনো দিনের যা কিছু, তা তাঁকে টেনে রেখেছে পেছনে । তিনি তা ভুলতেও চান না । তবে তিনি অন্ধের মতো চলেন না, বা অন্ধের মতো কোনকিছু মানেন না । পেটে যে তাঁর শিক্ষা আছে, তা তাঁর সাথে বাক্যালাপ করলেই বোঝা যায় । তিনি আধুনিক ভোগ্যপণ্য বলতে একেবারে অজ্ঞ । আসলে যারা শেয়ার বাজার নিয়ে বিকিকিনি করেন, তারাই জানেন ভালো, রিসেশন কী, বা তার ভয়ানকতা কোথায় । আদার ব্যাপারী কি আর জাহাজের খবর রাখে! জানার কি কোনো শেষ আছে! সবাই তো সবটা জানতে চানও না। তাঁদের জানার দরকার থাকেও না । হিন্দিতে বলে, আদমি, আপনি কুরতে মে রহো। তবে আজকাল মহিলারা যে উইন্ডো শপিং করে-টরে বেড়ায়, তাতে তারা এসব পণ্যদ্রব্যের খবর-টবর রাখে ।




এ বাড়িতে নব পরিণীতা বধু এলো । তার সাথে এলো নানা ভোগ্য পণ্যও । সেগুলো গিয়ে জমল ছোট ছেলে বিপ্র-র ঘরেই । এমনকি রান্নাঘরের জন্যে মাইক্রোওভেন, ও.টি.জি., ফব্‌স ইত্যাদি  নামে যা কিছু অত্যাধুনিক সামগ্রী এলো, সবই ছোট বৌ জমা করলো তার নিজের ঘরে। যেন তা নিতান্তই স্বর্ণালঙ্কার, নিতান্ত ব্যক্তিগত । এ বাড়ির সংস্কার তো সে জানে না। পরিতোষ বাবু কিছু না জানলেও তাঁর স্ত্রী মহামায়া গোটা-টা নীরবে দাঁড়িয়ে দেখলেন ।  এও দেখলেন যে, এ বিষয়ে কনিষ্ঠাত্মজ শ্রীমান বিপ্রদাস একেবারে নীরব । তিনি শুধু মুচকি হাসলেন । ভাবলেন, নতুন সংসার করতে এসেছে মেয়েটা। হয়তো অনেককিছু জানে না, বা বোঝে না । এটা আমার ওটা তোমার বলার মধ্যে যে একটা হীন স্বার্থবুদ্ধি জড়িয়ে থাকে, তা থেকে বড়ো বড়ো মানুষই মুক্তি পেলো না, তাতে এ তো ছোট একটি মেয়ে ! বাচ্চামানুষ । সব ঠিক হয়ে যাবে ।
কিন্তু বিষয়-টা সোনা সোনা পর্যায়ে থাকলো না । বাবা সজ্জন হলেই যে সন্তানকে সজ্জন হতেই হবে, তার যে কোনো মানে নেই, তা এ বাড়ির মানুষ বুঝতে পারলো অচিরেই । বিশেষতও, গর্ভধারিণী যদি বিপ্রতীপ প্রশিক্ষিকা হন, তাহলে কিছুতেই কিছু হয় না । ছোট বৌ অঞ্জলি মোটেই তার শ্বশুরবাড়ি-কে চিনতে পারেনি । তার জীবনসঙ্গীও তাকে তেমনটা জানায়নি । এখানে যে মানুষগুলো আলাদা আলাদা স্ত্রী-সন্তানের অধিকারী হলেও একটা অচ্ছেদ্য বন্ধনে তারা আবদ্ধ, এবং ততদিন তেমনটা থাকবে, যতদিন পরিতোষ বাবুরা বেঁচে আছেন--- তেমনটা মেয়েটি ধরতেই পারলো না । সে এ বাড়ির মানুষ হয়ে উঠতেই চাইলো না । তাই যে সংসারের বৃন্দগানে সে যুক্ত হতে এসেছিলো, সেখানে সে সকলের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে নয়, বরং তার একান্ত আপন কণ্ঠে, আপন তার-এ, আপন গায়কী-তে গান গাইতে লাগলো । অসংলগ্নতা আসতে অন্য গায়ক-গায়িকারা যে বারে বারে বিস্মিত হয়ে তাকাচ্ছিলো, সেটা সে দেখতেই চাইল না । বারবার তানপুরার তার কাটছিল, সমড়ছিল ভুল জায়গায় । অনেকের কানে সেই একক উচ্চকিত কণ্ঠ বেকায়দা লেগেছে । তাই প্রথমদিকে পরোক্ষভাবে ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলেওছিল । পরে তা হোল প্রত্যক্ষ, সরাসরি, তিক্ত আর বিষময় ।



প্রথম ঘটনাটা ঘটলো রাখি উৎসবের দিনে, এ বাড়ির মেয়ে টুকটুকি তার দুইভাই-কে রাখি পড়াতে এলো । মেয়ে টুকটুকি-র একমাত্র ছেলে এখানে দেওয়ালে টাঙ্গানো টেলিভিশন দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে দিয়েছে চালিয়ে, আর তার সাথে করে নিয়ে আসা প্রিয় ভি.ডি.. গেম্‌স জুড়ে দিয়েছে । আজকের শিশু । প্রযুক্তি-টা বড়ো ভালো বোঝে । যেটা বড়ো-রা জানে না, তারা তা অনায়াসে করে দেখায় মোবাইলে বা টেলিভিশনে । ছোট বৌ অঞ্জলি বাড়িতে ছিলো না । সে তার সাজসজ্জা-র দ্রব্য কিনতে গিয়েছিল দোকানে । ফিরে এসে ঘটনা-টা দেখতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে,
--- কেন তুমি এটা চালিয়েছো, দুষ্টু ? তুমি জানো না, ছোটদের সবটাতে হাত দিতে নেই ?
নিষ্পাপ কণ্ঠে সে জানিয়েছে--- আমি তো পারি । আমাদের বন্ধুদের বাড়িতে প্লাজ্‌মা আছে তো । আমরা তো চালাই । খেলা দেখি ।
--- যেখানে চালাও, চালাও । বাচ্চাদের এসব দামী জিনিসে হাত দিতে নেই । আর ভি.ডি.. গেম্‌স তো খেলতেই নেই । যাও, বাইরে খেলো গে ।
এ কথা বলে সে দিয়েছে টেলিভিশন বন্ধ করে । দমে গেছে এ বাড়ির আদরের শিশু যার এখানে অবাধ রাজত্ব ছিল । বিষয়টা সে ভালো চোখে নেয় নি ।  আজকের সন্তান । হা করতে রা বোঝে । আজ যে এখানে তার রাজ্যপাট যেতে বসেছে, এটা অনুমান করেই বৃদ্ধ সম্রাট-এর কাছে সে অভিযোগ জানিয়েছে । বৃদ্ধ সম্রাট নতুন যুবরাজ কে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন,
--- দাদুভাই, তুমি তো আর ছোটটি নেই । তুমি তো অনেক কিছু বোঝো । এটাও জেনে রাখো, কখনও নিজের ঘরে ছাড়া অন্যের ঘরে কোনোকিছুতে হাত দিতে নেই । তাতে যে নিন্দে হয়, ভাই । মাইমা যখন বলেছেন, এতে গেম্‌স খেললে ওটার ক্ষতি হবে, তাহলে নিশ্চয়ই তাই হবে । সে তো বড়ো । সে তো জানে ।
নিউক্লিয়াস পরিবারের শিশু তো এর অর্থ অনুধাবন করতেই পারেনি । বরং দাদু-কে সে মাইমা-র সমর্থক ভেবে নিয়েছে । তাই সে খুশি হয় নি । কিন্তু বিষয়টা আপাতত বেশিদূর গড়াতে পারেনি । এভাবে ছোট-বড়ো অনেক জিনিস কাটিয়েও দেওয়া গেছে । এরই মধ্যে পাশের বাড়ির পরেশ বাবু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন । প্রতিবেশী বলে কথা । মহামায়া দেবী ছোটবউ-কে এসে বলেছেন,
--- বউমা, তোমার ঘরে ঐ যে মশলা করা জিনিসটা আছে না ? কী যেন নাম……ওটার । আমার তো ছাই মনেও থাকেনা । ওটা একটু দাও না । পাশের বাড়ির পরেশ বাবু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন । ওঁকে ডাক্তারবাবু খাবার-দাবার, ওষুধ সব পিষে খাওয়াতে বলেছে । হাতে আর কত করবে বুড়ি মানুষ ! কটাদিন । মাস পড়লেই ওরা কিনে নেবে, বলেছে ।
মহামায়া দেবি-র এটা বলার পেছনে একটা যুক্তি ছিল । তিনি দেখতে চেয়েছিলেন, সত্যি সত্যি ছোট বউমা কী বলে । কেননা ছোট ছোট অনেক ঘটনা ঘটেছে ইতিপূর্বে । এটি তারই একটি পরীক্ষা । এক সময়ের ঠাকুমা-দিদিমা, পরে দূরদর্শনের নানা ধারাবাহিক কাহিনী মহিলাদের মধ্যে এসব বৈশিষ্ট্য ঠুসে দিয়েছে । আজকাল সবাই সিরিয়ালের ভ্যাম্প হয়ে উঠতে তৎপর হয়েছে। তাই পরীক্ষার একটা সিদ্ধান্তে তিনি আসতে চেয়েছিলেন । ছোট বৌ গ্রাইনডারটা দিয়েছে বটে, কিন্তু তার সাথে একটা মন্তব্য জুড়েও দিয়েছে,
--- জানেন মা, কিছু লোক আছে, যারা ঘোড়া দেখলেই খোঁড়া হয় ।
ইঙ্গিত বোঝেন শাশুড়ি মা। তিনি বলেন--- না, আমি কোন কথা-টথা দেইনি, বউমা । এমনকি বলিওনি যে, আমাদের আছে । ওরা কিন্তু তোমার শ্বশুরমশাই অসুস্থ হলে অনেক করেছিলো।
--- সবাইকে কি আপনি এনটারটেইন করতে পারবেন, মা ? যদি মেশিন-টার কিছু খারাপ-ভালো হয়, তখন মুখটা বেজার করে থাকবে ওরা । আপনি না পারবেন বলতে, না পারবেন সইতে ।
সমুচিত কোনো উত্তর দেননি মাহামায়া দেবী । শুধু বলেছেন--- তাহলে খারাপ আছে বলে দি-ই ? কী বলো ?
--- না, নিয়ে যান । তবে সবাইকে সবটা জানাবেন না । আজকাল কে কার তবিল সামলায়, বলুন তো?
মহামায়া দেবী এটাও পরিতোষ বাবু-র কানে তোলেননি। আর একটু দেখা যাক । আর একটু । যে কথা-কটা মেয়েটা বলেছে, সেটা শুনতে খারাপ হলেও একেবারে ফেলে দেবার কথা নয়। কিন্তু শাশুড়িকে জ্ঞান দেওয়াটা মেনে নিতে পারেননি তিনি শাশুড়িমাতা। এসব কি তিনি জানেন না ? সংসার জীবনে একটা দুধের বাচ্চার কাছে এসব শোনার মতো ভীমরতী তার এখনও হয়নি ।
কিন্তু বিস্মরণ মানুষের জীবনে বেঁচে থাকার একটা অনন্য উপায় । মানুষ যদি অতীত-কে না ভুলতে পারতো, তবে তো রোমন্থন করতে করতে একদিন সে মরেই যেতো । পারস্পরিক দূরত্ব, দ্বেষ, ঈর্ষা, ইত্যাদি ভাব তাৎক্ষণিক বিস্মরণের প্রকৃষ্ট মাধ্যম হোল একটা পরিবারের মধ্যে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা বা কোনো উৎসব অনুষ্ঠান । সে সময় পরিবারের ছোটবড়, জ্ঞানী-অজ্ঞান সকলেই এমনভাবে যূথবদ্ধ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে যে, মনে মনে তারা এই হিসেব ভুলে যায়, কে, কাকে, কবে, কীভাবে, কতটুকু অপমান করেছিলো বা অমর্যাদা করেছিলো । যুযুধান দুটি বা তার অধিক মানুষ আবার জীবনকে নতুন করে গড়ে নেয় । হয়তো তার অভিজ্ঞতা তাকে শিক্ষা দ্যায়, অথবা আবার একদিন তার চরিত্র বেরিয়ে আসে পুরনো আকৃতি নিয়ে । তখন উৎসব-আনন্দ নিক্ষিপ্ত হয় আদারে । এভাবেই পাপ, অসন্তোষ, অশান্তি-র সরীসৃপ বেড়ে উঠতে উঠতে একদিন একেবারে মাথায় এসে ছোবল মারে । তেমনটাই ঘটলো পুজোর ঠিক পরে । এ্যাতোটা ঘটলো যে, বাড়ি-র মেয়ে টুকটুকি রেগেমেগে তার জিনিসপত্র গুটিয়ে-বাটিয়ে নিজের বাচ্চাকে বগলদাবা করে চলে গেলো সোজা নিজের বাড়িতে । বাবা ডাকলেন পেছন থেকে । কিন্তু সে জানালো,
--- তোমরা তোমাদের বড়লোক বাড়ির বড়লোক পুত্রবধূ নিয়েই থাকো । এ বাড়িতে আমাদের সমাগমের দিন ফুরিয়েছে । আজকে ছোড়দা পর্যন্ত নেমে এলো বউ-এর হয়ে কলহ করতে ! এটা এ বাড়িতে কি কখনো ঘটেছে ? বউদি তো আজ চার চারটে বছর এসেছে…….। আমাদের চলে যাওয়াই ভালো ।
কেলেঙ্কারি হলো । জামাই ভাববে কী ! একটু চেঁচামেচি-তে পাড়ার কেউ কেউ শুনলও ঘটনাটা । শিউরে উঠলেন পরিতোষ বাবু । মাথা তাঁর হেট । এবারে বাড়ির বড়ো বৌ থেকে শুরু করে মহামায়া দেবী, এমনকি কাজের লোক পর্যন্ত…… সকলের মুখ থেকেই নানা ঘটনার পূর্ণ বিবরণ জঙ্গি বিস্ফোরণের মতো তাঁর কর্নকুহরে এসে পড়তে লাগলো একের পর এক । প্রত্যেকটাতে ছোট বৌ অভিযুক্তা । আর এর সবটা তার পতিদেবতাও জানে না ।
বাড়ির একমাত্র কন্যা অর্থাৎ কনিষ্ঠতমা টুকটুকি এসেছিলো বাবা-মায়ের কাছে। পুজোর পোশাক দেওয়া হলো একে অপরকে । মনেও রাখল না কেউ যে, এ বাড়ির ছোট বৌ একটু আপনি-কোপনি-র জীবনে বেশি আসক্ত । ননদ ভ্রাতৃবধু-র জন্যেও পছন্দ মতো শাড়ি আনলো । পছন্দ হলো, কি হলো না--- তা জানতে দিলো না সে । দাতা জানতে চাইলোও না । অন্তত কোনো কটু মন্তব্য গ্রহীতা করলো না। তাতে পুরনো কথা ভুলে গেলো বাড়ির মানুষ । পাঁচটা দিন কেটে গেলো নির্মলতায় । মেয়ে লৌকিকতা সেরে ফেরে গেছে নিজগৃহে। সে এলো ভাইফোটা-র দিন । ছোট বৌ যে তার বাপের বাপের বাড়িতে যাবে, তার কোনো দরকার নেই, কেননা তার কোনো ভাই-ই নেই। তারা মাত্র দুটিই বোন। হয়তো বড় বোন অন্য কোথাও কোন তুতো ভাই-টাই পাতিয়ে নিয়েছে । কিন্তু অঞ্জলি তা পারে না। পাতানো সম্পর্কে ওর রুচি নেই । তাই ওর মা ডাকে শিং জ্বালালে ।
আজকাল ননদের ছেলেকে নিয়ে কোন বিপত্তি বাধে না । সে জেনে গেছে, অন্য কোথাও চলে চলুক, এখানে তার ছোট মাইমা-র ঘরের কোনো জিনিসে হাত দেওয়া যাবে না । তাই শিশু হয়েও সে ছোটমামা-র ঘরটা এড়িয়ে চলে । আজকাল অঞ্জলি তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেও সে মাইমা-কে এড়িয়ে চলে। হয়তো গর্ভধারিণী তাকে এ বিষয়ে বিশেষ কোনো প্রশিক্ষণ দিয়েছিলো । বিগত মাস দুয়েক এ বাড়িতে সবাই চলছিলো সহজ ছন্দে, যথার্থ তালে আর প্রীতিকর নানা বানীতে । অর্থাৎ সুরে ও বানীতে তেমন কোনো সংঘর্ষ ঘটছিলো না । কিন্তু অকস্মাৎ অনর্থ ঘটে গেলো ।
ননদ তার বাবা, মা, নিজের ছেলে-র কিছু জামাকাপড় কাচতে নিয়েছে । সকাল থেকে নিজের গায়ে একটু ঘুষঘুষে জ্বর লক্ষ্য করেছে সে । তাই বাথরুমে জল ঘেঁটে কাচতে না বসে মনে মনে ঠিক করে নেয় যে, ছোট বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে দেওয়া ওয়াশিং মেশিনটায় কাজটা সেরে নেবে । বাবা-মায়ের জামাকাপড় যে নিয়মিত কাচাকুচি হয় না, সেটা বাবার লুঙ্গি-গেঞ্জি, আর মায়ের সায়া-ব্লাউজ দেখলেই বোঝা যায় । মেয়ে বাড়িতে নিজে না থেকে বাবা-মাকে দেখতে পারে না বলে মন খারাপ করে । আর নিজের ছেলে বান্‌টি তো ছোট । ওদের তো পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কোন মাথামুণ্ডু নেই । অঞ্জলি তখন বাথরুমে ছিল । বাবা-মা না জানলেও ননদিনী রায়বাগিনী জানে, কীভাবে এসব ব্যবহার করতে হয় । তার বাড়িতেও একটা মেশিন আছে । কিন্তু তা এত উঁচু মানের নয় । সাধারণ মানের । সেটা সামনে থেকে নয়, মাথা থেকে খুলে কাজ করতে হয় । সবে জামাকাপড় মেশিনে চাপিয়ে যথাযথ পদ্ধতিতে সে দিয়েছে চালিয়ে। সাথে সাথে বাথরুম থেকে প্রায় অর্‌দ্ধলঙ্গ অবস্থায় বেরিয়ে এসে চেঁচিয়ে উঠেছে অজলি,
--- কী করছো ! কী করছো, দিদি ! আমাকে অন্তত জিজ্ঞেস তো করবে ।
প্রথমটা বুঝতে না পেরে বোকার মতো তাকিয়ে থাকে সে । পরে বলে--- ওটা আমি পারি, ছোট বউদি। আমার বাড়িতেও মেশিন আছে । আমিই তো কাচি-টাচি।
ভ্রাতৃবধুকে জানাতে চায় ননদ যে, সে আকাট নয় । তাকে যেন আনাড়ি মনে করা না হয়। কিন্তু ভবি তো ভোলে না । সে-ও প্রতিবাদ করে,
--- সেটা তোমার মেশিন । তুমি চালাও । আর সেটা ম্যানুয়াল। এটা যে আমার মেশিন, দিদি । এটা তো তুমি চালাও না । এটা অটো টেকনোলজির মেশিন । কোথা থেকে কী করে দেবে, সর্বনাশ হবে । তুমি রাখ তো । আমি কেচে দেবো ।
--- হ্যাঁ, তুমি কাচবে ! তাহলে হলেই হ'য়েছে । তোমার কাচার বহর দেখেই তো আমাকে গুছিয়ে নিতে হ'য়েছে ।
--- ঠিক আছে । এবার থেকে না হয় তুমি এসে জামাকাপড় নিয়ে গিয়ে নিজের মেশিনে কেঁচে এনো । এবার তুমি সরো । সরো-ও-ও ।
এই শেষ সরো শব্দটা বেশ কঠিন আর আপত্তিকর ছিলো । সেটাই এমন আছ্‌ড়ে পড়তে ব্যস, অগ্নিতে ঘৃতাহুতি পড়ে বহুদিন বাদে । পুরনো রাগ জ্বলে ওঠে । অব্লিভিওন ইজ ম্যান--- দুদিন আগের সুখের দিনগুলো ভুলে যায় দুই মহিলা । আবার হয়ে যুযুধান । যেমন যুদ্ধ তারা শতাধিক বৎসর কাল ধরে দেখে আসছে, তেমনই কাপড় জড়িয়ে যায় কোমরে, কেশদাম দৃঢ়বিজরিত হয়ে ওঠে মাথা-র সুউচ্চে, কণ্ঠ ওঠে তার সপ্তকে, চোখ হয়ে ওঠে ক্ষিপ্ত বাঘিনীর মতো, থাবা পড়তে থাকে পরস্পরের মুখে চোখে ।
চেঁচিয়ে ওঠে বাড়ির মেয়ে--- তুমি এ্যাতো ছোট মনের কেন, বৌদি ? আমাদের বাড়িতে তো এমনটা ছিলো না আগে । বড়ো বউদি-ও তো এ বাড়িতে এসেছে । কৈ ? সে তো তোমার মতো আমার আমার করে না !
মহিলা সকলের প্রশস্তি শুনতে প্রস্তুত, কিন্তু স্বজাতির প্রশস্তি ? তা-ও নিজেকে তুলনায় রেখে ? না না। তা কি হয় ! তাই অঞ্জলি ঝাল লঙ্কা ডলে দিলো । কার জিভে দিলো, কে জানে । যুদ্ধের আক্রমণে কি ব্যক্তি বিচার হয় ? সে তেড়ে বলল,
--- আমার মুখ খুলিও না, দিদি । দিদিভাই-এর সাথে আমাকে তুলনা করো না । সকলে শেষে তোমার কথাটা ভুলে যাবে । আমাকেই দুষবে ।
--- তোমার মুখ ? সে তো খোলাতে হয় না, ভাই । তোমার মুখ তো কলকাতা-র ম্যানহোল। খোলাই থাকে । দুর্গন্ধ তো বেরোচ্ছেই ।
--- তা তুমি সুগন্ধ তো নিজের বাড়িতে গিয়ে শুঁকলেই পারো । বিয়েওয়ালা ননদ এখানে দুমদাম করে এসে পড়ে থাকো কেন ? আর বাপের বাড়িতে খবরদারি করোইবা কেন ? আমাদের জামাকাপড় আমরাই কাচবোখন । তুমি নিজের চরকায় তেল দাও । ভাইফোঁটা তো আজ নয় । এ্যাতো সকাল সকাল আসো কেন ?
এসব মধুভাষ বাড়ির সকলে শুনতে পেলো । পরিতোষ বাবু, মহামায়া দেবী, বড়ো ছেলে প্রতীক, অঞ্জলির কর্তা বিপ্রদাস--- সকলেই একে একে জুটল বটে কিন্তু কেউই কিছু বলতে পারলো না উভয়ের অগ্নিমূর্তি দেখে । শেষে বিপ্র মুখটা খুলতেই মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো । বিপ্র জানে যে, তার স্ত্রী চেঁচানোর অপর নাম হলো অসুস্থ হয়ে পড়া । তাই বিপ্র সবে বলেছে,
--- জানিস তো টুকটুকি, অঞ্জুর হাই থাইরয়েড । মাথাটা ঠিক রাখতে পারে না । তোরাই বা কেন এমন একটা পরিস্থিতি বানাস !
--- বানাই মানে ! কী বলতে চাস তুই, ছোড়দা ? একটু খোলসা করতো ।
তাতে বিপ্র কিঞ্চিত অসম্মানিত হয় । আক্রমণ সে-ও শানায়--- তোর কাছে খোলসা করতে হবে কেন রে ? তুই তো বিবাহিতা । তুই আসবি, খাবি, ফুর্তি করবি, চলে যাবি । ব্যস। তুই এই পরিবারের হাঁড়ি আগলাতে যাস কেন ?
তাতেই বাড়ির মেয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, তোমরা তোমাদের বড়োলোক বাড়ির মেয়ে বড়লোক পুত্রবধূ নিয়েই থাকো । এ বাড়িতে আমাদের সমাগমের দিন ফুরিয়েছে । আজকে ছোড়দা পর্যন্ত নেমে এলো বউ-এর হয়ে কলহ করতে ! এটা এ বাড়িতে কি কখনো ঘটেছে ? বউদি তো আজ চার চারটে বছর এসেছে…….। আমাদের চলে যাওয়াই ভালো ।



পরিতোষ বাবু আর বিলম্ব করেননি । এবারে বিলম্ব করলে আর ভদ্রতা দেখালে তাঁর পরিবারে বড়ো রকমের ক্ষতি ঘটে যাবে । যৌতূক নামে এই নিষ্প্রাণ বস্তুগুলো এ বাড়ির প্রাণীগুলোকে শুধু নিষ্প্রাণ করেই দিচ্ছে না । গোটা পরিবারের যূথবদ্ধতা-কে কৌতুক পর্যন্ত করছে। না, আর বিলম্ব নয় । কিছুমাত্র কাল বিলম্ব নয় । যেখানকার জিনিস সেখানে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে হবে । এটাই তাঁকে করতে হবে । ভদ্রস্থ কোনো একটা উত্তর দিয়ে দেওয়া যাবেখন । এখন বেলা দশটা । একটা টাটা চারশো সাত পাওয়া যাবে ঠিক । কাউকে দরকার নেই । একাই পারবেন তিনি । তাঁকে পারতে হবেই ।
গোটা বাড়িটা আর গোটা পাড়াটা-র মানুষ চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখল, দৃঢ় মনের মানুষটা কোনো বিঘ্ন ছাড়াই সব মালপত্র গুটিয়ে রওয়ানা দিলেন কুটুম বাড়ির উদ্দেশে । কারোর সাহস হলো না টুঁ শব্দটি করার ।

-------------------

কোন মন্তব্য নেই: