শনিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১২

নিবন্ধ ৩



শিশির কুমার ভাদুরী---- একটি নাট্যযুগ

হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়

বাংলা থিয়েটারের আজ সুদিন বলা যায়। সুদিন আজ এমন একটা অবস্থায় এসেছে যে, আজ মানুষ একশো বা দেড়শ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে গ্রাম বা শহরতলী থেকে ঠেঙ্গিয়ে কলকাতায় শিশির মঞ্চ ( নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুরীর নামে উৎসর্গীকৃত), মধুসূদন মঞ্চ, রবীন্দ্র সদন অথবা অন্য কোথাও গিয়ে কিম্বা কোনো ক্লাব বা কোন থিয়েটার সংস্থার মাধ্যমে আহ্বায়িত নানা নাট্যদলের অভিনয় অর্থ ব্যয় করে দেখতে যান। যারা থিয়েটার করেন, এটা তাঁদের কাছে অনেক দিনের একটা স্বপ্ন, একটা সম্মান। আজ তা সফল হয়েছে। তাই অনেকে আজ বেশ প্রসন্ন। তাঁরা বলেন, আজ আমাদের থিয়েটার মানুষের চোখে জাতে উঠেছে। তাদের চোখে থিয়েটারের একটা কৌলীন্যপ্রাপ্তি ঘটেছে। কেউ কেউ বলে, নাটক ছিলো একটা নীরস দুর্বোধ্য জগত। আজ সাধারণের জগতে এসে দাঁড়িয়েছে। অভিনয় জগতকে একটি জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করবার জন্যে যে থিয়েটার শিল্পের সাথে গাঁটছড়া বাঁধতে হবে, এমন বিশ্বাস আজ শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের মধ্যেও একটা স্থান পেয়েছে। কিন্তু এমনটা তো একটা সময় ছিল না। এক সময় অর্থাৎ বিগত শতাব্দীর আট বা নয়ের দশকে থিয়েটার শিল্পকে দূরদর্শনের সাথে লড়তে হয়েছিলো। তখন দূরদর্শন নতুন এসে গোটা বিনোদন জগতটাকে মাত করেছিলো। তারও আগে, নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, গত শতাব্দীর প্রথম বা দ্বিতীয় দশকে থিয়েটার ছিলো একটা অচ্ছুত, অপাংক্তেয় ও অসুষ্ঠু বা উচ্ছৃঙ্খল কাজ মাত্র। সমাজে এর কোন স্থান ছিলো না। এই কারণে মহিলাদের এই শিল্পে আসাটাকে একেবারে সমাজবিরোধী কাজ বলে মনে করা হতো। সমাজ বহির্ভূত মহিলারাই এই জগতে পদার্পণ করতো। এমনকি আজও কোথাও কোথাও বলা হয়, মেয়ে কী করে? নাটক করে বেড়ায়? ও মেয়ে কোন বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চলবে না। নাটুকে মেয়ে চলবে না। সেই সময় যে মহিলারা দেহ ব্যবসা করতো, অথবা কলগার্ল ধরনের ছিলো, তাদেরকেই নাটকে পাওয়া যেতো, কেননা তাদের জীবনে হারাবার কোন ভয় ছিল না, পাশাপাশি একটা অন্য জীবিকাও তাদের হলো। আজও গ্রাম বা শহরতলীতে মেয়েরা নাটকে আসতে যে সঙ্কোচ করে না, এমন নয়। নাটক করলে বিয়ে হবে না--- এমন একটা প্রবাদ প্রচলিতও আছে। পুরুষদেরকেও একটা সময়ে নাটুকে বলা হতো। এমনকি আজও এমনটা বলা হয়, নাটক করিস না। যেন নাটক করাটা একটা কৃত্রিম, অবিশ্বাস্য বা ভরসাহীন ফালতু কর্মমাত্র। অনেকেই মনে করে, সত্যকে গোপন করার অপর নাম নাটক করা। কিন্তু নাটক যে একটা সম্মিলিত শিল্প সমন্বয়, ইংরেজিতে যাকে বলে কালেকটিভ আর্ট, সেটা আজও মানুষের রোজকার কথাবার্তায় ব্যবহৃত হয় না। এমন মনে করা হয়, যেন দু-চারটে মিথ্যে কথা বলাই হলো নাটক করা। কিন্তু আজ অন্তত একটা কাজ হয়েছে যে, শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা এমনটা মনে করছে না। তারা নাট্যচর্চাকে একটি মহান শিল্প মনে করুক, না করুক, নাটকে অভিনয় করা যে একটা বিরাট কাজ, এমনটা বুঝে ফেলেছে। নেহাত অকর্মণ্যেরা নাটক করে আর ছিপ দিয়ে মাছ ধরে--- এমনটা আজ আর সব মানুষ মনে করে না। অন্তত এটুকু আজ হাতে এসেছে। এটুকুই একটা প্রাপ্তি নাট্যচর্চাকারীদের কাছে। আজকে তারা মানুষের চোখে যে জাতে উঠে এসেছে, এমনটা কোন বিরুদ্ধবাক্য ব্যবহার না করেই বলা যায়। এমনটা সেই থিয়েটারে প্রত্যুষকালে ছিল না। তথাকথিত ভদ্রলোকেরা নাটক দেখতে যেতেন না। ইংরেজদের দেখাদেখি বাবুসমাজ নাটকের আয়োজন করতো আর তাতে তাদের উপপত্নীরা নাচাগানা করতো বলে সন্ধেবেলা মদ্যসহ ফুর্তি করতে তারা যেতো নাট্যাভিনয় দেখতে। তারা অনেকে এইসব নাটকের পৃষ্ঠপোষকও ছিল। কিন্তু দিন বদলেছে। আজ নাট্যশিল্প যে একটা মহান শিল্প, তা মানুষ একটু একটু করে হয়তো অনুধাবন করতে পারছে। সত্যিকারের ভদ্র-শিক্ষিত মানুষ আজ পরিবার সমভিব্যাহারে নাটক দেখতে পছন্দ করেন।
কী করে এমনটা সম্ভব হলো--- এমন যদি প্রশ্ন করা যায়, নিশ্চয়ই উত্তর আসবে, লেবেদফ থেকে বিজন ভট্টাচার্য প্রমুখ মহান শিল্পীদের হাত ধরে আজ এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে নাট্যশিল্প। কথাটা নিতান্ত মিথ্যে না হলেও সম্পূর্ণ সত্য নয়। এই শিল্পের প্রতি আত্ম-নিবেদন করেছেন, এমন আরো বেশ কিছু মানুষ ছিলেন। আজ মঞ্চে মঞ্চে যাদের নাম বার বার শোনা যায়, তাঁরা হলেন স্তানিস্লাভস্কি অথবা ব্রেটল ব্রেক্সট। কিন্তু সেই তাঁরা যাঁরা তাঁদের জীবন-যৌবন-ধন-মান উৎসর্গ করেছিলেন এই তথাকথিত অচ্ছুত, অস্পৃশ্য শিল্পকলার জন্যে, তাঁদেরকে বাঙ্গলা নিশ্চয়ই ভোলেনি। নাট্যমোদী মানুষ নিশ্চয়ই ঋষি ভরত বা শুদ্রককে ভোলেনি। কিন্তু তাঁদের কথা ওঠে কৈ? আর একটু আধুনিক হলে বলা যায় যে, তাঁরা গিরিশ বাবু, অহীন্দ্র চৌধুরী, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি প্রমুখ এবং যার কথা না বললে ইতিহাসটাই প্রতিবন্ধী হয়ে থাকে, তিনি শিশিরকুমার ভাদুরী। তাঁদের কথা ওঠে কৈ? বিশেষত শিশির কুমার ভাদুরী এমন একটি পর্বতপ্রমাণ ব্যক্তিত্ব যাঁর কথা বলতে গেলে যেটুকু যোগ্যতা থাকা দরকার, তা হয়তো আমাদের সকলের নেই। অথবা পর্বতকে খুব উঁচু পর্বত বললে, বা না বললে তার কিছু যেমন যায় আসে না, তেমনি আমাদের মতো ক্ষুদ্র মানুষের একটি সামান্য রচনায় তাঁর কথা না বললে বা না বললে অন্তত তাঁর কিছু যায় আসে না। তবুলে তো একটা ব্যাপার থাকে। তাই আজ তাঁর কথা বার বার মনে আসে। মনে আসেলতে, তাঁকে চাক্ষুষ সাক্ষাৎ পাইনি বলে তাঁর সম্বন্ধে যেটুকু পড়াশুনো করা গেছে, সেই কথা মনে আসে।
তিনি আজ থেকে দুটো শতাব্দী আগের মানুষ। বিগত সহস্রাব্দের শিল্পী। কিন্তু তিনি ইতিহাস নন। জীবিত, জাজ্বল্যমান ও চির-আধুনিক। আজকের কোন নাট্যশিল্পী তাঁকে বাদ দিয়ে নাটক রচনা থেকে শুরু করে নাট্য নির্দেশনা, অভিনয়য়, আলো, মঞ্চ, সাজসজ্জা কিছুই ভাবতে পারেন বলে অন্তত একজন নাট্যদর্শক হিসেবে আমার মনে হয় না। একজন স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়া মানুষ যে তথাকথিত উচ্চ পেশায় নিজেকে নিযুক্ত না রেখে, এমনকি সাহিত্যের অধ্যাপনা ছেড়ে দৃঢ় পদক্ষেপে নাটকের জগতে একেবারে পেশাদারী হয়ে চলে আসতে পারেন, এটা ভাবাও যেন সেকালে একটা দুঃস্বপ্ন ছিল। আজকের অনেক খেলোয়াড় আছে যাদের পড়াশুনো হয়নি বলে খেলাটাকে তারা বেছে নিয়েছে। কিন্তু শিশির বাবু যে সেকালের একজন এম.., তা তো ইতিহাস বলছে। শুধুমাত্র ছাত্রজীবনে স্কুল বা কলেজে যেটুকু অভিনয় তিনি করেছেন, তা যে তাঁর অন্য অন্য সাথীদের মতো তাঁরও হৃদয় থেকে কর্পূরের মতো উদবায়ু হয়ে যায়নি, সেই নাট্যাভিনয় যে তাঁকে পরবর্তীকালে নিয়ত সতত এক অমোঘ আকর্ষণে টেনেছে, তাঁর প্রমান মিললো যখন তিনি একটি স্থায়ী চাকরী পরিত্যাগ করে একটি অনিশ্চিত জীবনে ও জীবিকায় পা রাখলেন। নাট্য জীবন। অভিনয় করবো। পেশাদারী অভিনয় করতে হবে যাতে মনের এবং প্রয়োজেনের সবটুকু ঢেলে দিতে পারি নাট্যাভিনয়ের জন্যে। সময়টা ১৯২১ সাল। অবশ্য সেকালে অপেশাদার নাট্যাভিনয় নিয়মিত ছিলো না বা ছিলো না গ্রুপ থিয়েটারের অস্তিত্ব। ছিলো বোর্ড থিয়েটার অর্থাৎ পেশাদারি নাটক। অর্থাৎ অর্থের জন্যে নাটক। আদর্শ বা দায়বদ্ধতার জন্যে নয়। তখন তাঁর সামনে নাটকে আধুনিকত্বের দিশারী কে? তাঁর আইডল কে? কেউ না। নিজের দিশারী তিনি নিজে। এই পেশায় প্রাণধারণ করা যাবে তো? ভাবেননি। এই পেশায় নিজেদের পরিবারে ঠাই মিলবে তো? তাকিয়ে দ্যাখেননি। নাটকটা করতে হবে। যেন তেন প্রকারেণ--- করতে হবে। তা নয়তো যে প্রাণ বাঁচে না। মঞ্চে আমি, নানা চরিত্রকে নিজের মতো করে ভেবে ভেবে এঁকে এঁকে দেখাবো, মানুষ দেখবে, বিস্মিত হবে, সামনে সারি সারি মাথা, অগণিত মাথা, তাদের করতালি, শিল্পীর সাথে মানুষের এই যে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের মন্দির নাটমঞ্চ, তা থেকে সরে থাকা যাবে না। এইসবই তাঁর বুকে অনুরণন হয়ে বেজেছে অহরহ। সর্বক্ষণ। নাট্যদল কী করে গঠন করা যায়, সে অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রথমেই তিনি কলকাতার একটি পেশাদারী সংস্থায় যোগ দেন। নাম ম্যাডান থিয়েটার। কতই বা বয়স তখন? তিরিশ-টিরিশ। স্কুলে বা কলেজে নাট্যাভিনয় আর একেবারে সোজা গণ-দর্শকের সামনে এসে অভিনয় করা যে অনেক অনেক পার্থক্য, তা অনুভব করেই তিনি ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যপনাকে তুচ্ছ করে বেরিয়ে আসেন। ম্যাডান থিয়েটারে ডি.এল. রায়ের লেখা আলমগির নাটকে একেবারে সোজা লিড রোলে অভিনয় করেন। স্বয়ং নায়ক আলমগির। আর প্রথম অভিনয়েই সাফল্য।  
কোনো সন্দেহ নেই, শিল্পকে পেশাদারী ক্ষেত্রে গ্রহণ করলে একটা নেতিবাচক দিক ক্রিয়া করে। দর্শকের মনোরঞ্জন করতে হয়। দর্শক ও ব্যবসার সাথে কম্প্রোমাইজ করতে হয়। নিজের চেতনা বা সত্তাকে বিক্রি করতে হয়। ফলে মন চায় না, এমন অনেক কাজ করতে হয়। আজকের মঞ্চের বাঘা বাঘা অভিনেতা যেমন ওমপুরি, নাসিরুদ্দিন শাহ্‌, নানা পাটেকর, শাবানা আজমীদেরকে দেখলে তাই দুঃখ হয়। অমন অমন প্রতিভা প্রোডিউসারদের হাতের পুতুল! কী সস্তা খেলো কাজে নিজেদেরকে হিন্দি সিনেমায় বিক্রি করছেন! টাকা চাই, আরো টাকা। মেনে নিতে হয়। শিল্পে পেশাদারিত্বে লক্ষ্মীদেবী সর্বস্বতী দেবীর ওপর রাজত্ব করেন। কিন্তু আপোষ করেননি নাকি শিশির বাবু। তিনি যা করতে চেয়েছেন, দর্শককে তাই দেখতে হয়েছে। তিনি অভিনেতা, অর্থাৎ নেতা। তিনি যা বলবেন, যা করে দেখাবেন, তাই দর্শককে দেখতে হবে, কেননা তিনি রাতের পর রাত বিষয়টি নিয়ে ভেবেছেন, জেনেছেন, পড়েছেন। দর্শক একবার অভিনয় দেখেই দুম করে ভালো বা মন্দ বিশেষণ দিয়ে দেবে, এমনটা অন্তত তিনি মেনে নেন নি। একটা উদাহরণ দিলে এই দুর্‌বিশ্বাস্য সত্যটি হয়তো পরিষ্কার হবে। একবার তিনি রীতিমতো নাটক অভিনয় করছেন। সেখানে একটি দৃশ্যে তিনি দর্শক আসনে অভিনেতা বসিয়ে রেখে অভিনয় চলতে চলতে তাকে অভিনয়ের অংশ হিসেবে দর্শক আসন থেকে সোজা তুলে এনে মঞ্চে কাজ করিয়ে নেবার পরীক্ষা করতে কিছু দর্শক জীবনে প্রথম নাটকে এমনটা দেখে বিস্মিত হয়ে সোরগোল করে ওঠে। শিশির বাবু অভিনয় বন্ধ করে দিয়ে তাদেরকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনারা যারা অভিনয়ের এই নতুন ধারাটি বুঝতে পারেননি, তাঁরা আপনাদের দয়া করে আসন ছেড়ে চলে যেতে পারেন। আপনাদেরকে টিকিটের মূল্য ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু কোন গণ্ডগোল অভিনয় চলাকালে করবেন না। পরে এই দর্শক আসন থেকে অভিনেতা উঠে আসার বিশেষ কায়দাটি নাট্যশিল্পে বার বার অনুসৃত হয়েছে। আমি সাক্ষী, উৎপল দত্ত মহাশয়ও তাঁর একটি নাটকে এমনিভাবে অভিনয় ভেঙ্গে বেরিয়ে এসে দর্শকদের সাথে এই একইভাবে একই পরিস্থিতিতে কথা বলে উঠেছিলেন। তিনি কাকে অনুসরণ করেছিলেন? শিশিরকুমার ভাদুরি। শাহজাহান চরিত্রে অহীন্দ্র চৌধুরী শাহজাহানের একদিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত দেখিয়ে অভিনয় করেছিলেন। সেটাই ছিল তখনকার চল। কিন্তু অভিনবত্বের ওপর নাম শিশির কুমার ভাদুরী। তিনি শাহজাহানকে সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্ত দেখিয়ে দাবি করেন, ইতিহাসে কোথাও সম্রাটের এক অঙ্গ পক্ষাঘাত লেখা নেই। এমন আরো অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায় এই বিরল প্রতিভা সম্বন্ধে। গল্পের শেষ নেই। তিনি যে কিংবদন্তী।
শিশির বাবু কতটা অনাপোষবাদী মানুষ ছিলেন, পেশা রক্ষা করতে গিয়ে যে তিনি নিজেকে বিক্রি করতে চাননি, তার বিরাট ও জ্বলন্ত প্রমান তাঁর স্বাতন্ত্র বোধ। আর তাই এরপরেই তিনি ম্যাডান থিয়েটারএর সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেন তাদের হাতের পুতুল হয়ে অভিনয় করবেন না বলে। তিনি শিল্পী, তিনি স্বাধীন, স্বতন্ত্র। মঞ্চের ব্যাপারে কারোর খবরদারী তিনি মেনে নেননি। হয়তো আজ গ্রুপ থিয়েটারের আমলে তাঁর এই চরিত্রকে অনেকে একনায়কতন্ত্রের আলোকে বিচার করতে পারে, কিন্তু তিনি তিনি ছিলেন। তাঁর তুলনা তিনি নিজে। তিনি স্বাধীন ছিলেন কিন্তু স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না। ম্যাডান থিয়েটার ছেড়েই কথা নেই বার্তা নেই, তিনি সরাসরি চলে যান চলচ্চিত্র জগতে। কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই আবার ঝুঁকি। তখন সিনেমাকে বলা হতো মোশন পিকচার। তিনি পরপর দুটি সিনেমায় অভিনয় করেন কথা সাহিত্যিকের রচনার ওপর--- আঁধারে আলো এবং চন্দ্রনাথ। নাট্যাভিনয় ও চলচ্চিত্রাভিনয় যে সম্পূর্ণ পৃথক, তা অন্তত যাঁরা অভিনয় করেন, তাঁরা জানেন। হয়তো সে সব কোন প্রগতিশীল প্রযোজনা নয় এবং তা তাঁর নিজের নির্দেশনার ওপরেও তৈরী হয়নি, তথাপি তাঁর শুরুটি ছিলো একেবারে হপ্‌, স্কিপ এ্যান্‌ড জাম্প
তিনি প্রথম চলচ্চিত্রে নির্দেশনা দেন মোহিনিতে। শুধুমাত্র অপরের চলচ্চিত্র নির্দেশনা দেখেই তিনি এই শিল্পটি আয়ত্ত করে নেন্‌। কোনো ব্যক্তির আয়ত্বে বা কোনো সংস্থাতে তিনি এই চলচ্চিত্র নির্দেশনা শিল্প কিম্বা ক্যামেরা শিল্প অথবা চিত্র নাট্যকার হবার শিল্প তিনি শিক্ষা করেননি। আকাশছোঁয়া আই.কিউ. ছিলো তাঁর, যাকে মানুষ বলে জাত শিল্পী। আর তারই ওপর ভর করে তিনি নাট্যাচার্য। এই চলচিত্রের পর আবার তিনি ফিরে আসেন নাট্যশিল্পে। নিজের একটি দল প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময় দল প্রতিষ্ঠার চল ছিলো না। কিন্তু তিনি যেন গ্রুপ থিয়েটার কনসেপ্ট দিয়ে গেলেন নাট্য চর্চাকারীদেরকে। গ্রুপ থিয়েটার গঠন হবার হবার পর তারা কাজ করতো একটা দায়বদ্ধতা মাথায় নিয়ে। একটা সামাজিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক দায়বদ্ধতা ছিল তাদের। তার ওপর দাঁড়িয়ে তাঁরা নাট্য রচনা ও অভিনয় করতেন। আজ অবশ্য সেই আদর্শের দিন আর নেই গ্রুপ থিয়েটারের। বিনোদের কাছে অনেকে বিকিয়ে  গেছে। কিন্তু শিশির বাবু হয়তো তেমন কোনো দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করেননি। শুধু অভিনয়প্রিয়তা তাঁকে ছুটিয়ে নিয়ে বেরিয়েছে। পর পর তিনি সীতা,চাণক্য, রীতিমত নাটক (টকি অব টকিজ---নিজের রচনা), পল্লীসমাজ, বিচারক, বরের বাজার, কমলে কামিনী আলমগির, শাহজাহান, মাইকেল, বিপ্রদাস, তখৎ-এ-তাউস, বিন্দুর ছেলে, দুখীর ইমান আরো অনেক প্রযোজনায় তিনি অভিনয় করেন মঞ্চে এবং পর্দায়। হয়তো এই সব নাটকের বা চলচ্চিত্রের তৎকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কোন উপযোগিতা বা দায়বদ্ধতা ছিল না, হয়তো এর মধ্যে কিছু কিছু নাটক ইতিহাস আশ্রিত হলেও ঐতিহাসিক নয়, ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে বা বিকৃত করেই শুধু নাটকের স্বার্থে ডি.এল. রায় প্রমুখ মানুষ সেইসব রচনা করেছিলেন, হয়তো আলমগির-শাহজাহান বা সিরাজদউল্লা চরিত্রগুলো কোন সাহিত্য রচনার আধার হতে পারে না, অন্তত ইতিহাস তা বলছে না, হয়তো এইসব নাটক রামকৃষ্ণের মতে কোন লোকশিক্ষা দেবার মতো নাটক ছিল না, তথাপি তা নাট্য ও চলচ্চিত্র জগতের উত্তরাধিকারদের কাছে এক একটি নক্ষত্র হয়ে আছে।
যেহেতু তিনি পেশাদারী ছিলেন, তিনি কখনও নাট্য বিষয়কে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে নাট্যাবেগ, নাটকীয় দ্বন্দ্ব ও সংলাপকে বেশী গুরুত্ব দিতেন, যাতে তা দর্শকদেরকে অডিটোরিয়ামে বন্দি করে রাখে। এমন নয় যে, তাঁর ইতিহাস প্রীতি ছিল না। কিন্তু মানুষের মধ্যে থিয়েটার প্রীতি সৃষ্টিতে এটুকু আপোষ তিনি করেছিলেন হয়তো। সেইসব নাটকে তিনি তাঁর নিজের সৃজনী সত্তা যে স্পষ্ট তুলে ধরেছিলেন, তাতে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। তবে তাঁর অভিনীত বিসর্জন নাটকটি এবং তাতে জয়সিংহরঘুপতি চরিত্রে তাঁর অভিনয় অবশ্যই একটি উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা। হয়তো সামাজিক বা অন্য কোনো দায়বদ্ধতা থেকে তিনি রবিঠাকুরের বিসর্জন প্রযোজনার জন্যে বেছে নেননি। এই কাব্যনাট্যে অভিনয়ের সুযোগ, নাটকীয় সংঘাত, সংলাপের ভার ইত্যাদি তাঁকে টেনেছিলো। শিল্পকে তিনি চিরকাল সুরুচিসম্পন্ন বিনোদনের বিষয় বলে দেখে এসেছেন। শিল্প পাঠশালা নয়--- এই বিতর্ক আজও আছে। এ থেকে মানুষ কোন শিক্ষা লাভ করুক, এমনটা রামকৃষ্ণ ভেবে নিলেও তিনি বাস্তববাদী হিসেবে এই বিষয়কে গুরুত্ব দেন নি। মাধ্যমটিকে মানুষের দরবারে পৌঁছে দিতে হবে। যে কোন উপায়ে তা করতে হবে। শুধু মনেন রাখতে হবে যে, নিজের মাথা বিক্রি করে দিয়ে নয়। এমনকি সেকালে নিজের দেশে নাট্যচর্চা শুধু নয়, সীতা নাটকটি নিয়ে তিনি সুদূর অ্যামেরিকা পাড়ি দেন, যে সীতার সামাজিক সত্তা সে দেশের সংস্কৃতির সাথে আদৌ মেলে না। সেকালে ও দেশে তেমন সংখ্যক বাঙ্গালী বসবাসও করতো না। কিন্তু এই দুঃসাহস তিনি দেখাতে পেরেছিলেন এবং এই একটি প্রযোজনায় ও দেশে তাঁর যথেষ্ট খ্যাতিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। আজ যখন কোনো কোনো নাট্যদল দালাল ধরে বিদেশ যায়, তখন এই বিদেশে গিয়ে এ দেশের নাট্যচর্চা প্রচারের ও প্রসারের পথটা যে তিনিই দেখিয়ে দিয়েছিলেন, তা মনে পড়ে যায়।
তাঁর এই অনাপোশবাদী মন তাঁকে বিতর্কিত মানুষ হিসেবেও উপস্থাপিত করেছিলো। এমনকি তথাকথিত রাষ্ট্রীয় সম্মাননা যে অনাপোশবাদী হিসেবে প্রত্যাখ্যান করা যায়, সেই দৃষ্টান্ত তিনিই দেখিয়েছেন। তাঁর প্রতিভা প্রত্যক্ষ করে সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ সম্মাননা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি সরাসরি ফিরিয়ে দেন। মনে মনে হয়তো বলেছিলেন এ মণিহার আমায় নাহি সাজে...। তাঁর এই প্রত্যাখ্যানের মূল কারণ এই যে, তিনি এই উপাধির বদলে একটি নাটমঞ্চ চেয়েছিলেন সরকারের কাছে। কিন্তু তা হয়নি। মানুষের অর্থ নিয়ে অনেক পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা হয়েছে, মানুষ মারার জন্যে প্রতিরক্ষা খাতে বহু টাকা ব্যয় হয়েছে। কিন্তু নাটমঞ্চ? পরে হবে। তাই তিনি নিজের উদ্যোগেই শ্রীরঙ্গম প্রতিষ্ঠা করেন, যার পরে নামকরণ হয় বিশ্বরূপা
এমন ঔজ্জ্বল্যের মধ্যেও তাঁর জীবনে সুখ আসেনি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন দুঃখী। এর জন্যে যে তিনি দায়ী নন্‌, তা নয়। তিনি এমন একটি মহিলাকে বিবাহ করেছিলেন যিনি তাঁর সংসার ছাড়া এই অতিব্যস্ত জীবন এবং অত্যন্ত পরিশ্রমজনিত কারণে মদ্যপানের অভ্যাস সইতে করতে পারেননি। একজন সাধারণ নারী হিসেবে এই যন্ত্রণা সইতে না পেরে তাঁকে আত্মহত্যা করতে হয়েছিলো। যেমনভাবে প্রতিভাশালী মানুষ জীবন যাপন করেন, তেমনই পরিবারের প্রতি শিশির বাবু অত্যন্ত উদাসীন ছিলেন। এই যন্ত্রণা তিনি তাঁর প্রথমা স্ত্রীকে দিয়েছিলেন। অবশ্য পরে তিনি নিজেকে শুধ্‌রে নেন বটে। একজন নাট্যসংযুক্ত মহিলা কঙ্কাবতী সাউকে পরবর্তীকালে বিবাহ করেন। শিশির কুমার ভাদুরী কী মাপের যোদ্ধা ছিলেন, তা একটি উপমায় অনেকটা পরিষ্কার হতে পারে। আজ জীবনের প্রায় অশীতিপর মানুষ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে আজও মঞ্চে দাপিয়ে নাটক লিখছেন, রাজা লিয়ার বা আরো নানা নাটকে অভিনয় করে চলেছেন, তা তো কেবল তাঁরই প্রদর্শিত পথ। এই বিরল প্রতিভা তো আজ তাঁরই একমাত্র জীবিত নাট্যসন্তান। এই বয়সে কিভাবে এমন শক্তি তিনি পান, যখন মানুষ এই বয়সে জবুথবু পঙ্গু জীবন যাপন করে! এই জীবনী শক্তির বীজ রোপণ করেছেন নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুরী।
হয়তো এই ইতিহাস অনেকের জানা, কিন্তু আমি নিশ্চিত, সকলের জানা নয়। তাদের উদ্দেশেই এই নাতিদীর্ঘ নিবন্ধ।
------------------------

শব্দসংখ্যা ২,৫০০


আলমগির-শাহজাহান বা সিরাজদউল্লা চরিত্রগুলো----- হয়তো প্রচলিত পাঠ্য ইতিহাস বইগুলোতে এইসব ব্যক্তিদেরকে নিয়ে নানা গল্পগাথা লেখা হয়েছে, তথাপি ইতিহাস জানে যে, এ দেশের ইতিহাসে তাদের কোন স্থান নেই। আলমগির বা সাজাহান এ দেশের কেউ ছিল না। তারা ছিল সাম্রাজ্যবাদী শাসক মাত্র। বাবরের হাত ধরে তাদের এই দেশে আগমন। আর সিরাজ? সে তো লম্পট, মদ্যপ ও একটি স্বেচ্ছাচারী তরুণ মাত্র যে তার মাতামহর অন্যায় প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠেছিল। কোন নাটকে এই চরিত্রগুলো নায়ক হওয়ার অর্থ ইতিহাসকে বিকৃত করা। মিথ কখনও কোন মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। দেশাত্মবোধ কোন মিথ্যেকে আশ্রয় গড়ে উঠতে পারে না।

কোন মন্তব্য নেই: