ফেরা
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়
(১)
ফ্ল্যাটের ব্যাল্কনি-তে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
রবিবারের সকালে চা-এর আমেজ উপভোগ ক’রছিলো প্রান্তিক। সঙ্গে দুটো বিস্কুট।
চা-টা শুধু শুধু খেতে পারে না ও। এ্যাতোটা বয়সেও বাচ্চাবেলা’র বিস্কুট-প্রীতি
যায়নি প্রান্তিকের। যারা চা-তাল মানুষ, তারা সাধারণত চা খায় কোনো অনুষঙ্গ ছাড়াই। কিন্তু
প্রান্তিক আজো চা-বিস্কুট। হঠাৎই ওর চোখে পড়ে কুকুরটা। রাস্তায় ব’সে গ্যাছে। সামনের
পা দুটো জোড় করা টান্ টান্। পেছনের পা দুটো ভাঁজ ক’রে রাস্তায় রেখে
তার ওপরেই যেন উবু হয়ে ব’সেছে। লেজটা ন’ড়ছে। সামনের পা দুটো খটাখট খটাখট ক’রে লেফ্ট-রাইট ক’রছে যেন। মুখে
একটা কুই কুই শব্দ আর চাকুম-চুকুম ক’রে জিভ চাটছে। কুকুরটা’র দৃষ্টি সোজা
দোতলায়।
সামনের মাসে পুজো। সবাই উৎসবে উন্মত্ত। প্রান্তিকদের
এবারের পুজো কাটবে বিদেশে। কিন্তু কুকুরদের তো পুজো থাকে না। আজ অন্তত মাস খানেক হ’য়ে গেছে, এই জরাজীর্ণ
কুকুরটাকে পাড়ায় ঘুরতে দেখছে প্রান্তিক। আগে তেমন দোতলা’র দিকে
তাকাতো-টাকাতো না। বড়োজোর একবার টেরা চোখে তাকিয়ে চ’লে যেতো। বেশ সলজ্জ তাকানো। যেন কাউকে
কিছু বলার নেই, কিছু চাইবার নেই। কোথায় চ’লে যেতো, কে জানে! ওর শরীরে তেমন কোনো
চমক নেই যে, চোখে প’ড়বে। না বড়ো বড়ো লোম, না মোটা লেজ, না বেশ ঝোলা ঝোলা কান।
বরং উল্টো। কুকুরটার গায়ের লোম খাবলা খাবলা উঠে গেছে এখানে ওখানে। কোমরের হাড় দুটো
ভীষণভাবে জেগে ওঠা, একটা কান খাড়া, একটা কান ভেঙ্গে ঢুকে গেছে। সেখানে একটা ঘা
মতো। মাছি ব’সছে। সেই কানটা ঠিক মতো নাড়াতেও পারে না। যে কানটা খাড়া, সেটা নড়ে। অপুষ্টি বা
খাদ্যহীনতায় শিরদাঁড়া-টা পর্যন্ত কিছুটা বেঁকে গেছে। একটা লজ্জা লজ্জা ভাব ক’রে ঘুরে বেড়ায়
পাড়া’র মধ্যে। কুকুরটা মাদী কুকুর। কিন্তু শরীরে এমন জৌলুস নেই যে, বেপাড়া’র কোন একটা মদ্দা
কুকুরকে প্রলুব্ধ ক’রবে। তবুও যৌবন থাকুক না থাকুক, ওরা পোয়াতি হয় আশ্বিন মাস এলেই। কুকুরটাকে কে-ই বা
খাবার-টাবার দ্যায়, কে জানে! কে জানে, এটা থাকেই বা কোথায়! দেখে বোঝা যায়,
কুকুরটার গায়ে যে লোম ছিলো, তা বোধহয় লালচে আর সাদা দিয়ে ছোপ ছোপ দেওয়া। বোধহয়।
নিশ্চিত বোঝার তেমন কোনো উপায় নেই। লোকে বলে ‘ঘিয়ে ভাজা’।
প্রান্তিক দেখেছে, পাড়া’র বাচ্চাগুলো মাঝে
মাঝে ঢিল নিয়ে তাড়া করে কুকুরটাকে। দেখলে মনে হয়, কুকুরটা যেন ওদের বিরাট কোনো
ক্ষতি ক’রেছে। এমন নয় যে, ওটা সারা রাত ঘেউ ঘেউ ক’রে পাড়া’র মানুষের মাথা খায়। না কাউকে দেখলে
কামরাতে যায়। শান্ত, নির্ঝঞ্ঝাট। তবুও...। তাড়া খেয়ে কুকুরটা পালাতে পথ পায় না।
গায়ে তেমন শক্তিও নেই যে, ছুটে ওদের নাগালের বাইরে চ’লে যাবে। ঢিলটা বা
লাঠিটা’র বাড়ি খেয়েই যায়। আঘাত খেয়েই কেউ কেউ ক’রে ওঠে। বাচ্চাদের সেদিকে দৃকপাত নেই।
যেটা ওদের কাছে খেলা, সেটা যে ওর কাছে অত্যাচার--- তা বোধহয় ওদের কেউ কখনও
শেখায়নি।
প্রান্তিকের মনে পড়ে, ছোটবেলায় এমনটা ছিল
না ও নিজে। রাস্তা থেকে বেড়াল ছানা বা কুকুর ছানা কুড়িয়ে নিয়ে আসতো। ভয় ছিলো, বাবা
ব’কবে। জন্তুশুদ্ধ বাড়ি থেকে বের ক’রে দেবে। তাই লুকিয়ে নিজের খাবারের ভাগ
নিয়ে যেতো খাটের তলায় ঝুরি চাপা দিয়ে রাখা জন্তুটার জন্যে। বাবা কখনও কোনো পোশ্য
বরদাস্ত ক’রতে পারতেন না। কিন্তু বাড়িতে কোনো গরুটা বা ছাগলটা ঢুকলে বাবা তাদেরকে মারতেও
দিতেন না। তাড়িয়ে দিতে ব’লতেন। ফলে জন্তু-জানোয়ারকে এভাবে মারা-টা শেখেইনি
প্রান্তিক। তাই বাচ্চাদের এমনটা ক’রতে দেখলেই ব’কে দ্যায়
প্রান্তিক।
কিন্তু আজ তো কুকুরটা রাস্তাতেই ব’সে গেছে।
প্রান্তিকের কাছে খাবার চাইছে--- এটা স্পষ্ট। কিন্তু একে খাবার দেওয়া তো বিড়ম্বনা। মাথায় উঠে ব’সবে। রাস্তার কুকুর। এর দিকে দয়া-দৃষ্টিপাত করা দায়। কিন্তু এর দায় নেওয়া? নৈব
নৈব চ। সেটা তো চলে না। তাই কুকুরটার নির্বাক প্রার্থনায় সাড়া দিলো না প্রান্তিক।
বিস্কুটের অবশিষ্ট টুকরো মুখে ফেলে দিয়ে সবে পেছন ঘুরেছে, দ্যাখে, মা দাঁড়িয়ে। কখন
যেন মা এসে দাঁড়িয়েছে পাশে।
--- বিস্কুটের টুকরোটা দিলে পারতিস
বেচারাকে।
--- তুমি ক্ষেপেছো! দিয়ে ম’রি আর কি! কাল
থেকে এটাই ওর বরাদ্দ হ’য়ে যাবে।
--- না, আসলে কুকুরটার না বাচ্চা হ’য়েছে সবে। এখন তো
ওর বিরাট খিদে। রাস্তার কুকুর। কে-ই বা খাবার দেবে ওকে, বল্!
এবারে খেয়াল হয় প্রান্তিকের--- সত্যিই
তো, কুকুরটা মা হ’য়েছে। কুকুরটার বুক জুড়ে মাতৃস্তন। সেগুলো দুধে টই-টম্বুর। কিন্তু ততক্ষণে কুকুরটা
হতাশ হ’য়ে হাঁটা দিয়েছে। যেই দেখেছে যে, প্রান্তিক বিস্কুটের একটু অংশও দিলো না, অমনি
হাঁটা দিয়েছে। প্রান্তিক ব্যাল্কনি থেকে একটু ঝুঁকে দেখে নিলো। কিন্তু কুকুরটা
নেই। অন্য কোথাও খাবারের সন্ধানে হয়তো হাঁটা দিয়েছে। একবার মনে হ’লো ওর, দুটো
বিস্কুট দিলে কীই-বা ক্ষতি হ’তো!
--- তোদের কি যাওয়া ঠিক হ’য়ে গেছে?
প্রান্তিক একটু অন্যমনস্ক হ’য়ে গেছিলো। আজকাল
এই একটা ব্যাপার হ’য়েছে। কেন যেন মনটা হঠাৎ হঠাৎ ক’রে কোথায় চ’লে যায়! তাই মা’র কথাটা তেমন কানে
ঢোকে না। মা আবার প্রশ্ন করে,
--- হ্যাঁরে, তোদের ঐ যে ভিসা, না কি বলে
যেন... তা কি হ’য়ে গেছে?
চম্কে তাকিয়ে প্রান্তিক বলে--- না, মা। এখনও
হয়নি। তবে হ’য়ে যাবে। এটা তো আমার হাতে নেই। কোম্পানী দেখছে। তাদের সব বড়ো বড়ো ব্যাপার।
পাঁচটা সোর্স। ওসব পেতে সমস্যা হবে না। চিন্তা একটাই। তোমাকে ফেলে যেতে হ’চ্ছে।
মা বলে--- না, আমি আমার কথা ভাবছি না।
আমি তো আর অসুস্থ নই। আমি ভাবছি অন্য কথা।
--- অন্য কথাটা কী?
--- ভাবছি, তোরা সবাই যদি এভাবে বিদেশে চ’লে যাস, তবে এই
হতভাগা দেশটার কী হবে?
--- ‘দেশটার কী হবে’ মানে? কী আবার
হবে! সবাই তো যাচ্ছে না। কেউ কেউ। সবাই কি এই সুযোগ পায় নাকি! প্রান্তিক আত্মপক্ষ
সমর্থন করে।
মা বলে--- একটা কথা ভেবে দ্যাখ, পিতু।
সবাই এই দেশের সন্তান। এটা আমিও মানি যে, দেশের কাছে সবাই সমান। কিন্তু একটা দেশ
কোন সন্তানের বেশী নির্ভর করে? যে সন্তান নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, দেশকে কিছু
দিতে পারে, দেশের মান-মর্যাদা বাড়াতে পারে।
--- ঐ তো। ওইটাই তো ব’লছি, মা। একটা
দেশের কোনো সন্তানকে যখন বিদেশ ডেকে নিয়ে যায়, তাকে পেতে গেলে অনেক দাম দিতে হবে
জেনেও ডেকে নিয়ে যায়, সেটা কি দেশের পক্ষে গর্বের ব্যাপার হয় না? তাতে কি দেশের
মান-মর্যাদা বাড়ে না, মা? তার সন্তানের ওপরে যে বিদেশ নির্ভর ক’রে থাকে, এতে কি
দেশের অহংকার হয় না?
--- শুধু অহংকার দিয়ে তো পেট ভরে না রে,
পিতু। এই দেশের অন্ন-জলে তুই বড়ো হ’লি। এই দেশের মানুষ তোকে অর্থ দিলো
এঞ্জিনিয়ারিং প’ড়বার জন্যে, মান-সম্মান দিলো, সরকার তোকে নানা সুযোগ-সুবিধে দিলো। আর তুই তাদেরকে
ছেড়ে চ’ললি! এটা কি ভালো, বাবা? একটা কৃতজ্ঞতাও তো থাকে, নাকি।
প্রান্তিক এসব ব্যাপার নিয়ে বেশী কথা ব’লতে চায় না মা’র সাথে। তাই মা’কে এই কথাটা ব’লে চুপ ক’রিয়ে দেয়। একটাই
কথা ওর মনে হয়। কৃতজ্ঞতা থাক, না থাক--- কৃতঘ্নতা তো ওর মধ্যে নেই। এ দেশের
মন্ত্রীগুলো তো তাও মানে না।
অটোমোবাইল এঞ্জিনীয়ারিং পাশ
ক’রে বেরোবার আগেই প্রান্তিকের মতো ট্যালেন্টকে ক্যাম্পাস থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে
ইন্ডিয়া’র অন্যতম প্রথম সারীর ‘ফারগুসন অটোমোবাইল্স’ চাকরী দিয়েছে। শুধু চাকরী নয়, নিজের
গাড়ি, ফ্ল্যাট, মোটা মাইনে, যখন তখন বিদেশ ভ্রমণ--- কী নয়! সব দিয়েছে। লোন নিয়ে
পড়াশুনো শুরু ক’রেছিলো ও। চাকরী ক’রতে ক’রতে ঝটিতি লোন পরিশোধ ক’রে দিয়েছে। প্রান্তিকের বাবা’কে কোন চিন্তা ক’রতে হয়নি। কিন্তু
তিনি ছেলে’র নাম, খ্যাতি বা ধন-ঐশ্বর্য কিছুই ভোগ ক’রতে পারেননি। হঠাৎ একটি সেরিব্র্যাল
আক্রমণে সোজা হাসপাতাল, আর সেখান থেকে বাড়িতে এসেছিলেন বটে, কিন্তু নিথর নিষ্প্রাণ
দেহ নিয়ে এসেছিলেন। প্রথম দিকটায় পুরনো বাড়ি ছেড়ে ওরা ফ্ল্যাটে আসেনি। কিন্তু বাবা’র মৃত্যুর পর আর ঐ
ঝর্ঝরে বাড়িতে প’ড়ে না থেকে তিন তলায় এসে উঠেছে। মা’কে যাবতীয় ভোগ-সুখ দিয়েছে প্রান্তিক। মা’র নিজস্ব একটা
রঙ্গিন টেলিভিশন, একটা ছোট্ট নিরামিষ রেফ্রিজারেটর, একটা শ্বেত পাথরে মোড়া ছোট্ট
ঠাকুর ঘর। আসলে বাবা যা যা ভোগ ক’রতে পারেননি, সে সব মা’কে দিতে চেয়েছে প্রান্তিক। কিন্তু
প্রান্তিক মনে করে, ওর যে ট্যালেন্ট, তাতে এ দেশ ওকে যথেষ্ট এন্টারটেইন ক’রছে না। একবার এই
কোম্পানিটা ধ’রে বছর দশেকের জন্যে ফরেন ঘুরে আসতে পারলেই ওর দাম বেড়ে যাবে। তারপর একটার পর
একটা কোম্পানী লাইন লেগে যাবে প্রান্তিক সরকার’কে তুলে নিয়ে যেতে। কে ওকে আগে নিতে
পারে, কে ওকে বেশী অফার দিতে পারে--- এই নিয়ে টানাটানি প’ড়ে যাবে। কোম্পানি
ওকে বিদেশ পাঠাতে চায়। তাদের মনে এটাই আশা যে, প্রান্তিক তাদের সুপারিশে যাবে
বিদেশে। ফলে ওকে বেঁধে ফেলা যাবে একটা অটুট বন্ধনে। অন্তত একটা কৃতজ্ঞতা থেকে ও
ছিট্কে যাবে না। কিন্তু প্রান্তিক জানে, একবার বাইরেটা মেরে এলে ওসব ফারগু-মারগু
পাত্তা দেবে না প্রান্তিক সরকার। ফ্যালো কড়ি মাখো তেল। এ লাইনে কে কার! যেখানে
চাঁদি ফুটবে সেখানে চাঁদ উঠবে। সোজা কথা। কে আমাকে কবে কি দিয়েছে, তার লেবেঞ্চুশ
আমি চিরকাল চুষবো, সে গুড়ে বালি।
ইন্টারন্যাশনাল পাসপোর্ট আগে থাকতেই ছিলো
প্রান্তিকের। ভিসাটার জন্যে আটকে আছে। তবে সেটা তো আর ওর মাথাব্যথা নয়। বিদেশি
কোম্পানী ঠিক বুঝে নেবে বাঘের দুধ কীভাবে মেলে। সামনের মাসেই যেতে হবে। কিন্তু মা’কে সাথে নেওয়া হবে
না। কারণ নম্বর এক, কোম্পানী এ্যালাউ ক’রবে না। মিনিমাম দশ বছর। অনলি ফ্যামিলি।
স্ত্রী আর সন্তান। কারণ নম্বর দুই, মা তো বিদেশে যাবে না। সেখানকার মানুষদেরকে মা ‘ম্লেচ্ছ’ বলে। ওরা নাকি
এঁটো-কাঁটা মানে না, পুজো-অর্চনা নেই। মা’র তো আবার গোপাল আছে। তাকে নিত্য ভোগ
দেবার ব্যাপার আছে। ছেলে তো অফিসেই খায়, আর তাই ঘরের গোপালকে ভোগ না দিতে পেরে
ধাতু’র গোপাল-ই সই। সে সব তো ব্রিসবেনে হবে না। এসব প্রান্তিক ভালোই বোঝে।
মা-ও জানে ছেলে, বৌ আর নাতি চ’লেছে বিদেশে অন্তত
দশটা বছরের জন্যে। কিন্তু সে রা-টি কাটেনি। এই আজ প্রথম প্রান্তিককে দেশের দোহাই দিলো
মা। এই প্রথম। প্রান্তিক জানে যে, আজকাল টেলিভিশনে প্রায়ই এই নিয়ে নানা
তর্ক-বিতর্ক হয়, ফিল্ম হয়, ম্যাগাজিন প্রোগ্রাম হয়। ব্রেনড্রেন, নারী নির্যাতন, শিশুশ্রম,
বা শিশু নির্যাতন, আরো কত কী! মা এসব দ্যাখে। হাতে তো কোন কাজ নেই। মনে মনে
প্রান্তিক বলেও, ‘আরে বাবা, সিনেমা দ্যাখো না। সিরিয়াল দ্যাখে মেয়েরা। তাই দ্যাখো না। এসব বাজে
ঘেঁষো কথা শুনতে কে যে বুদ্ধি দেয়, কে জানে।’ বাবা মারা যাবার আগে মা’র এসব ছিলো না। আজকাল
মা আবার বই পড়া ধ’রেছে। সব দামী দামী বই প’ড়ছে অঞ্চলের এক লাইব্রেরী থেকে এনে। এর
জন্যে অবশ্য দায়ী প্রান্তিকের স্ত্রী মধুরিমা। সে-ই ওর মা’কে এই নেশা
ধরিয়েছে। তাতে অবশ্য ওর একটা প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য আছে। শাশুড়ি যাতে রাতদিন তার সাথে
নানা বিষয়ে দ্বন্দ্বে জড়াতে না পারে, তাই এই কৌশল। মহিলা ব্যস্ত থাক। প্রান্তিক
বেশ বুঝতে পারে যে, মা এসব কথা ব’লছে বই প’ড়ে। কিন্তু মা তো শুধু বই পড়ে। বহির্বিশ্ব তো জানে না। বইতে
এসব বড়ো বড়ো কথা লেখে লেখকেরা। অবশ্য তারা নিজেরা এসব মানে না মোটেই। এরা সব এক
একটা জ্যান্ত হিপোক্রীট। সারাজীবন এদেশ ওদেশ ঘুরে বেরিয়ে শেষে লিখলেন, ‘আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি...’। ভালবাসিস তো দেশে থাকলেই পারতিস গোটা জীবনটা। সব বুকুনি
মারা পার্টি। ওরা ক’রলে ব’লে লীলা, আর আমরা ক’রলেই বিলা!
এমনটাই ভাবে প্রান্তিক। এই ব্রিসবেনে
যাবার বিষয়ে ও মধুরিমা’র কাছেও কোনো বিশেষ সমর্থন পায়নি। বার বার ও ব’লেছে--- এভাবে মা’কে ফেলে যাওয়া কি
ভালো হবে? বাবা নেই। মা একা হ’য়ে যাবে না?
মনে মনে ভেবেছে প্রান্তিক, আরে তোমার মা
নাকি? মা-এর চেয়ে মাসী’র দরদ বেশী। বড়লোকি করার টাকাটা আসবে কোথা থেকে? একটা শাড়ি
কিনতে গেলে তো পঁচিশ শো টাকা’র নীচে মন ওঠে না। এই পঁচিশ শো-টা কি ভূতে যোগাবে! এই
ইন্ডিয়া-তে? সে গুড়ে বালি, সোনা। তাছাড়া মা’র তো শরীর-গতিক ভালো। বাতব্যাধি নেই,
প্রেশার নেই, রক্তে কোন কমপ্লেইন্ট নেই। বয়স মোটে আটান্ন। এটাই তো সুযোগ। আর মা
একা থাকবে কেন? মন্টু’র মা’র সাথে তো টাকা-পয়সা নিয়ে কথা হ’য়ে গেছে। সে তো
এখানে থাকবে। চব্বিশ ঘণ্টা। একবার ব্রিসবেনটা ঘুরে এসে দ্যাখো না, সোনা। আর ফিরে আসতে
ইচ্ছে ক’রবে না। প্রান্তিক এ কথাও ভেবেছে, আমি তো আর চিরকালের জন্যে যাচ্ছি না। ফিরে
আসবো। মোটে তো দশটা বছর। কত ছেলেমেয়ে বিধবা মা’কে রাস্তায় বের ক’রে দিচ্ছে! কিন্তু
আমি তো মা’কে আরো সুখ দেবো ফিরে এসে। সব যাওয়াটা কি যাওয়া নাকি! আরো ভালো ক’রে ফেরা’র জন্যে যাওয়া।
তাছাড়া মা’কে তো এখানে না খেয়ে প’ড়ে থাকতে হবে না। বাবা’র কোন পেনশান নেই। এটা তো জানে
প্রান্তিক। মা’কে টাকা পাঠানো হবে, রে বাবা। ও তো কুলাঙ্গার বা অকাল কুষ্মাণ্ড নয়। কর্তব্য
তো আছেই। তাই ব’লে নিজের দিকে না তাকালে কি চ’লবে? ছেলে’র উন্নতি হ’চ্ছে--- এটা কোন
বাবা-মা দেখতে না চায়!
তবে প্রান্তিক দেখেছে, বয়স হলে মানুষ বেশ
আত্ম-কেন্দ্রীক হ’য়ে যায়। সময় মতো খাওয়া, কারণে-অকারণে ডাক্তার দেখানো, ভালোমন্দ ফুড নেওয়া,
মাঝে-মধ্যে বেড়ানো--- যদি ছেলে’র আর্থিক অবস্থা ভালো হয়, তবে এসব নেশা তাদের পেয়ে বসে। বাড়ি’র যে মানুষটা আয়
করে, তার অবস্থা কী, সেটা বয়স্ক মানুষেরা দেখতে চায় না। তার নিজেরটুকু হ’লেই ব্যাস্। সব
সময় মনে করে, আমাকে দেখাশুনো, আমাকে যত্ন-আত্মি ক’রছে কিনা। পানের থেকে চুন খ’সলেই তারা মনে
করে, তাদেরকে অবহেলা করা হ’লো। ঐ সেই বাল্মীকি’র বাবা-মায়ের মতো। তুমি কোথা থেকে
চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য, পেয় আনলে, সেটা তো আমাদের দেখার কথা নয়। আমরা তার কী জানি!
তুমি যখন ছোট ছিলে, তোমাকেও খাইয়েছি। এখন তুমি খাওয়াবে। তোমার পাপ আমরা ব’ইবো কেন?
তবে মা প্রান্তিকের যাবার বিষয়টা কী চোখে
দেখছে, এটা প্রান্তিকের বোঝা হ’য়ে ওঠেনি। মা মুখে কিছু বলে না। চুপ ক’রে থাকে। প্রান্তিক
লক্ষ্য করেছে, মা চুপ ক’রে দেখেছে, তার ছেলে বাজার থেকে কী কী নতুন জামা-কাপড়, গরম
জামা, চাদর, পুলওভার, কোট, টুপি ইত্যাদি কিনছে। সেগুলোর প্যাকিং-ও প্রায় রেডি।
কিন্তু মা বলেনি কিছু। আজ প্রথম। প্রান্তিক জানে, মা’র কথাটা পুরো ফেলে
দেবার কথা নয়। দেশের কৃতিরা যদি দেশের বাইরে চ’লে যায়, তবে দেশের অবস্থাটা কী হবে!
কিন্তু সবটা কি প্রান্তিকরাই ভাববে? দেশের কোন দায় নেই? এ দেশের যেন দারিদ্র একটা
কোয়ালিফিকেশন হ’য়ে উঠেছে। ‘তোমার দেশ গরিব। তুমি দেশকে দাও। শুধু দাও। দেশ তোমাকে দিক, না দিক, তুমি দাও।’ এই যে কমনওয়েলথ
গেম্সে একটার একটা সোনা জিতে আনছে দেশের ছেলেমেয়েরা। এর জন্যে দেশ কী ক’রছে? কী দিচ্ছে তাদেরকে?
নাথিং। দেশ এদেরকে কতটা ব্যাকআপ-ই বা দিয়েছিলো এই সোনা আনা’র জন্যে? নাথিং। নিজের
চেষ্টায় এরা দাঁড়িয়েছে। আর অমনি মঞ্চে উঠে মন্ত্রীরা ব’লতে শুরু ক’রেছে, ‘দেশের সম্মান
রক্ষা ক’রেছে...’। মন্ত্রীরাই তো লুটেপুটে খাচ্ছে
দেশটাকে। তাহ’লে আমি কোন অপরাধী?
এইসব নানা আত্মপক্ষ সমর্থন খুঁজছিলো
প্রান্তিক একা একা। বৌ তো ওর সমর্থনে নেই। সে তো শুধু ভোগটুকু ক’রতে পারে। দুর্ভোগ?
না না। সে ওতে নেই। তাই প্রান্তিক এতে কোনো পাপবোধে ভোগে না। যেতে ওকে হবেই।
ভাগ্যটাকে একবার নেড়ে-ঘেঁটে-তলিয়ে দেখতে চায় ও। প্রান্তিক না হ’লে তো অনির্বাণ
যেতো। অনির্বাণ ওর থেকে জুনিয়ার। কিন্তু কৃতিত্বে ওর থেকে অনেকটা এগিয়ে। ওকেই
পাঠানোর কথা হ’য়েছিলো। কিন্তু প্রান্তিক কোম্পানিকে পুরো ব্ল্যাকমেইল ক’রেছে এই ডিসিশন
বদলাবার জন্যে। প্রান্তিক সিনিয়ার, এক্সপেরিয়েন্সড। ওর পদটাও বেশ রেস্পনসিব্ল।
প্রান্তিক যদি কোম্পানিকে চাকরি ছেড়ে দেবার ভয় দেখায়, তবে কোম্পানি তো ভয় খেয়ে
যাবেই। ওর হাত দিয়েই নানা প্লানিং, ড্রইং, প্রজেক্ট সব পাশ হয়। এটা কোম্পানী’র ট্রেড সিক্রেট।
তাই মান বাঁচাতে ওকেই ব্রিসবেন পাঠাচ্ছে কোম্পানী। অনির্বাণ ক্যান্সেল।
------------------------
(২)
এইসব ভাবনা আজকাল প্রায়ই মনের মধ্যে ভিড়
করে। তাই আজও এইসব ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতে প্রান্তিক ড্রাইভ ক’রে বাড়ীতে আসছিলো।
ব্যারাকপুর রোড থেকে যেই নেমেছে ওদের রাসমনী সরণিতে, হঠাৎ ওর চোখে পড়ে সেই
কুকুরটা। রাস্তা দিয়ে প্রাণ বাঁচাবার মতো ক’রে চ’লেছে আর ওর বুকের স্তনগুলো ধ’রে ঝুলছে
হৃষ্টপুষ্ট কয়েকটা বাচ্চা। কুকুরটা বেঁকে গেছে বাচ্চাগুলোর ভারে। বাচ্চাগুলো কী যে
পাচ্ছে ঐ হাড় জিরজিরে শরীর থেকে, কে জানে! আর ওরাই বা কী ক’রবে! ওটাই তো ওদের
খাদ্য, পানীয় আর বেঁচে থাকবার জন্যে প্রতিরোধক পথ্য বা ওষধি। বাচ্চাগুলো দেখতে বেশ
লাগছে। একটা পুরো কালো, একটা কালো-সাদা ছোপ মারা, একটা তো পুরো সাদা। আরো নানা রং।
আজ প্রান্তিক চেয়েছিলো, ওকে একটা বিস্কুট দেবে। গলির মুখেই তো চা-এর একটা দোকান
আছে। আগেও ও দেখেছে যে, কুকুরটা ঐ চা-এর দোকানে হত্যে দিয়ে প’ড়ে থাকে কোনো একটা
টুকরো পাবার প্রত্যাশায়। যদি কারোর দয়া হয়। কিন্তু দোকানটার পাশ দিয়ে যাবার সময় তো
আজ প্রান্তিক কুকুরটাকে দেখতে পাবে না। সেটা তো এইমাত্র চ’লে গেলো। মনে মনে
ভাবে ও, যাকগে। মরুকগে। গাড়ি গ্যারাজে ঢুকিয়ে ঘরে এসে দ্যাখে, মা পাপাইকে নিয়ে
নিজের ঘরে ব’সে গান গাইছে। নিজের ঘরে সরাসরি না ঢুকে একবার মা’র ঘরে উঁকি দিলো। দেখলো, পাপাই ওর ঠাম্মা’র কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে আর ঠাম্মি গান গাইছে, ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়
মাথায় তুলে নে রে ভাই / দীন দুখিনী মা যে তোদের, তার বেশী আর সাধ্য নাই...’।
--- কী ব্যাপার, মা? পাপাই যে শুয়ে আছে? এই
সময়? ওর পড়াশুনো নেই? টিচার আসবে না?
--- এসেছিলো তো। কিন্তু ওর গা-টা গরম। তাই
তাকে ছেড়ে দিলাম।
--- গরম? কতটা গরম? ওর মা কৈ?
--- জ্বরটা তো থার্মো দিয়ে দেখিনি রে।
একশো-ট্যাকশো হবে।
--- একশো! এতেই কাৎ হ’য়ে প’ড়লো!
এবার প্রান্তিক একবার ডাকলো ছেলেকে।
কিন্তু সাড়া পেলো না। তারপর মা’কে ব’ললো--- তুমি এ্যাতোটা বাড়াবাড়ি ক’রো না, মা। এটা
প্রশ্রয়।
--- আমার কাছে আর কতদিন প্রশ্রয় পাবে,
পিতু! তোরা তো যাবার জন্যে পা উঠিয়ে ব’সে আছিস। তাই যে কটা দিন আছে, থাক না আমার কাছে। এরপর তো আমাকে পাবে না।
প্রান্তিক রাগ করে মা’র কথায়--- এসব কী
কথা, মা! না পাপাই জগৎ ছেড়ে চ’লে যাচ্ছে, না তুমি যাচ্ছো।
এবারে মা যেন একটু ধমকায় ছেলেকে--- তোর
কি মঙ্গলামঙ্গল ব’লে কিছু মাথায় থাকে না! ছেলে সম্পর্কে এসব কথা কেউ কি বলে!
অবাক হয় প্রান্তিক--- কেন? আমি কী এমন
বললাম? যাই হোক, তুমি মা, ওকে এসব গান দয়া ক’রে শিখিয়ো না।
মা-ও অবাক--- এসব গান মানে? রজনীকান্তের
গান। এ গান কি ‘এসব গানের’ মধ্যে পড়ে? কী ব’লিস তুই?
--- ওদের স্কুলে এসব গান শুনলে
পানিশমেন্ট দেবে। ওদের তো ভেতো বাঙ্গালী স্কুল নয়, মা। সেখানে নির্দিষ্ট নিয়ম আছে।
তা আমাদেরকে মেনে চ’লতে হয়। এসব গান ওদের চলে না।
মা বুঝতে চায় না। জীবনে সে তো এসব কথা
শোনেনি। এটা যে বাস্তব। তা কী ক’রে মা’কে বোঝানো যাবে, এটা বুঝতে পারে না প্রান্তিক। প্রান্তিকের
মা রেগেই বলে--- বাজে কথা ব’লিস না, পিতু। আমার নাতি স্কুলে গান শিখতে যায় না। প’ড়তে যায়। পড়ার
ব্যাপারে ওরা খবরদারি ক’রতে পারে। সেখানে আমি কিছু ব’লি না। কিন্তু এসব কী কথা! স্কুলটা তো
একটা ফাজলামোর জায়গা নয় রে। আজ টিচারের জন্মদিন, গিফ্ট দাও। সেটা আবার টিচারই মনে
করিয়ে দেয়। কাল ক্লাসমেটের জন্মদিন। আবার গিফ্ট দাও। ওটা কি জন্মদিন পালন ক’রবার জায়গা?
--- তুমি বুঝবে না, মা। প্রান্তিক
বোঝাবার চেষ্টা করে।
--- আমার বুঝে কাজ নেই। আমিও স্কুলে প’ড়েছি। আমি
অশিক্ষিত নই রে। তোকেও স্কুলে পড়িয়েছি। তুই কি অমানুষ হ’য়েছিস? এমন স্কুলে
প’ড়তে দিস কেন যেখানে নিজের কোনো সত্তা থাকে না? এমন জায়গায় যাস কেন? ভাগ্যিস ব’লিসনি, নিজের
ধর্মটাকেও ছাড়তে হবে। এটা আমার দেশের গান। আমাদের কান্তকবি’র গান। দেশাত্মবোধক
গান। এসবই বাচ্চাদের শেখাতে হবে।
প্রান্তিক বুঝলো, মা’র সাথে তর্ক ক’রে কোনো লাভ নেই।
মা আছে মা’র জগতে। জগতটা যে ব’দলে গ্যাছে, এটা তো মা’কে বোঝানো যাবে না। এসব গান যে মনের
মধ্যে একটা বাজে রেখাপাত করে, সেটা প্রান্তিক বোঝে। মোটা কাপড় যদি পড়াটাকে জীবনের
অঙ্গ ব’লে গ্রহণ ক’রতে হয়, তবে তো হ’য়েছে। ঐ মোটা কাপড় প’রেই জীবন কাটাতে হবে। তার চেয়ে ঘরে যাওয়া
ভালো। এক কাপ কফি খাওয়া অনেক দরকারি। তাই কথা না বাড়িয়ে মাথাটাকে অসহায়ভাবে নাড়তে
নাড়তে সোজা ঘরে গিয়ে ঢুকলো। সেখানে মধুরিমা’কে একহাত নিলো,
--- কী করো তুমি সারা দিন? পাপাই মা’র কাছে ব’সে থাকে কেন? মা
ওকে উল্টো-পাল্টা বিষয় বোঝায়। তুমি কি তা জানো?
মধুরিমা মানতে চায় না। সে-ও প্রান্তিককে
আক্রমণ করে--- এসব কী ব’লছো তুমি? তোমার দেখছি এই ব্রিসবেন যাওয়ার ব্যাপারটা পাকা হ’তেই তুমি ব’দলে যাচ্ছো। মা’র নাতি পাপাই। ওর
জ্বর হ’য়েছে। আর ও ওর ঠাম্মি’র কাছে গিয়ে ব’সতে পারবে না!
--- না, পারবে না। আমি ব’লছি, পারবে না। মা’র বলা গল্প-গান ওর
ক্ষতি ক’রবে। ও একটা ইংরেজী স্কুলে পড়ে, মাধু। সেখানে এসব গান, আলাদীনের আশ্চর্য
প্রদীপ, ঠাকুরমা’র ঝুলি, ঠানদিদি’র থ’লে চলে না। তুমি ওর পড়া পড়াতে পারবে না ব’লেই আমি এ্যাতো
টাকা দিয়ে টিচার রেখে দিয়েছি। তাকে কথা নেই বার্তা নেই, একটা দিনের
জন্যে বিদেয় ক’রে দিলে!
মধুরিমা রেগেমেগে জানিয়ে দেয়--- তোমার
মা, তুমি ক’রবে যা করার। আমি পারবো না। শেষে তোমার কাছেই আমায় কথা শুনতে হবে, ‘এমনটা কেন ব’ললে... এমনটা কেন
ক’রলে?’ আমি ওর মধ্যে নেই। আমরা ঠাকুমা’র কোলেই বড়ো হ’য়েছি। কৈ, আমাদের
তো কোনো ক্ষতি হয়নি। আমি পাপাইকে ওর ঠাকুমা’র কাছে থেকে কেড়ে আনতে পারবো না। সোজা
কথা।
প্রান্তিকও রেগে যায় এমন কথায়। ও ব’লে ওঠে--- এই
জন্যেই ছেলেটার কোনো প্রোগ্রেস হ’চ্ছে না। মায়েরা ছেলের জন্যে দুনিয়ার সাথে লড়ে যায়। কোনো
কম্প্রোমাইজ করে না। তাদের সন্তানই কিছু ক’রে দেখাতে পারে। এভাবে গা ছেড়ে থাকলে
তোমার ছেলে অষ্টরম্ভা হবে। সে এ দেশই হোক আর বিদেশই হোক।
--- আমি পারবো না, ব্যস্। জানিয়ে দেয়
মধুরিমা।
প্রান্তিক হাঁ ক’রে তাকিয়ে থাকে গমনোদ্যত
বউ-এর দিকে। ও বেশ বুঝে নেয়, কেন বাল্মিকী’র পাপ তার বাবা-মা-স্ত্রী-সন্তান শেয়ার ক’রতে চায়নি। তাই ও
নিজের হাত জোড় ক’রে ব’ললো--- আমার ঘাট হ’য়েছে, অন্যায় হ’য়েছে তোমাদের সুখের কথা ভাবা। তোমাদের
নিয়ে কোনো গ্রামে থাকলে ভালো হ’তো।
--- তুমি খালি ‘আমাদের সুখ,
আমাদের সুখ’ কেন ব’লছো! আমরা কি তোমাকে ব’লেছি, চক্ষুলজ্জা’র মাথা খেয়ে আমাদের সুখ এনে দাও? তার
চেয়ে বলো, চা খাবে, না কফি? কফি আনবো?
--- আনো।
এবারে মধুরিমা গট্ গট্ করে কোমর দুলিয়ে
চ’লে যায় রান্নাঘরের দিকে যাকে প্রান্তিক রান্নাঘর বলে না। বলে কিচেন। প্রান্তিক
বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ভাবে, ওর অপরাধটা কী? এদেরকে নিয়ে বিদেশ যাবে,
এদেরকে একটা ভালো পরিবেশ দেবে, আরাম, আয়েশ। আর এরা তার কোনো দামই দিচ্ছে না! এরা
বুঝছে না, কোথায় যাচ্ছে এরা। আজ পর্যন্ত যারা ওসব দেশে গ্যাছে, তারা আর ফিরে
আসেনি। ওখানেই জমিয়ে সংসার ক’রছে। এরা ভাবছে যে, ব্রিসবেন বোধহয় কোনো জেলখানা। এর মধ্যে
চা নিয়ে এসে মধুরিমা জানায়,
--- কফিটা ফুরিয়েছে। আমি তোমায় ব’লতে ভুলে গেছি।
তাই চা-ই নিয়ে এলাম। পরেরবার কফি দেবো। আমি পাশের দোকান থেকে আনছি।
চা-এর কাপে একটা চুমুক মেরে প্রান্তিক
বলে--- চা খাবে ওখানে। চলো, বুঝতে পারবে।
অমনি খ্যাঁক্ করে ওঠে মধুরিমা--- বাজে
কথা বোলো না তো। তুমি গ্রামের কোনো অশিক্ষিত মেয়েকে বিয়ে ক’রে আনোনি যে, যা ব’লবে, সে বুঝে
যাবে। চা তো ওরা খায় আমাদের দয়ায়। ওটা উৎপাদন হয় এ দেশে। তুমি কি আর এসব জানো না!
খুব জানো। এখন তোমার দুচোখে বিদেশ। ওরা এ্যা ক’রলেও তোমার ভালো লাগছে। বাবা-মা’কে ছেড়ে... একটা
অজানা অচেনা বিভুই--- সেখানে চ’লেছি। আমাদের কেউ নেই সেখানে। তুমি কি এসব জানো
না! সব জানো। এখন তোমার দু-চোখে স্বপ্ন--- বিদেশ যাবে। সেখানে আরাম ক’রবে, আয়েশ ক’রবে। এ দেশের
পলিউশন বাজে, দারিদ্র্য বাজে, কোরাপশান বাজে, গরম ভ্যাদভ্যাদে, বৃষ্টি ঝ্যাঝ্ঝেরে,
রাস্তা কাদা প্যাচ্পেচে। এসব তোমাকে ছুঁতে না পারে।
প্রান্তিক বোকার মতো শুনলো, মেয়েটা ওর
বলা কথাকটাই বেশ কায়দা ক’রে ওকে শুনিয়ে দিলো। ‘যার জন্যে ক’রি চুরি, সে-ই বলে
চোর!’ বুঝবে, একদিন ঠিক বুঝবে, তোমার এই এতো অভিযোগে অভিযুক্ত হাজব্যান্ড কী ক’রলো তোমাদের
জন্যে। ওখানে না গেলে বুঝবে না। জানি, বাড়ি ছেড়ে যেতে সকলেরই কষ্ট হয়, মায়া হয়।
বিশেষ ক’রে মেয়েদের। একটা ভয় মনের ওপর চেপে বসে। একটা গণ্ডীর মধ্যে থাকতে ভালো লাগে
ওদের। থোর-বড়ি-খাড়া নিয়ে জীবন ওদের বড়ো প্রিয়। ওখানে একবার জ’মে গলে শেষে ওরাই
ফিরে আসতে চাইবে না। মায়ের গাওয়া গানটা একবার মনে আসে। ‘মায়ের দেওয়া মোটা
কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই...’। এই যদি একটা দেশের ফিলজফি হয়, তবে তো সেই দেশের কিস্সু
হবে না। ঐ মোটা কাপড় প’রেই বেঁচে থাকতে হবে। দিনের বেলা ওটাই প’ড়বে, রাতে ওটাই
খুলে নিয়ে গায়ে চাপা দিয়ে শোবে। পৃথিবী এগিয়ে চ’লেছে হু হু ক’রে। আর আমি মোটা
কাপড় মাথায় নিয়ে বাবা ব্রহ্মচারী হ’য়ে হেদিয়ে মরি আর কি! তাহ’লে এই এ্যাতো
পড়াশুনো, খাটা-খাটনি এসব করার কী দরকার ছিলো! মোটা কাপড় তো গ্রামের চাষাভুষোর
অবলম্বন। চাষা হোলেই হোতো।
এইসব আবোল-তাবোল ভাবতে ভাবতে একটু চোখ
বুজে থাকতে চায় প্রান্তিক। একটু চোখ বুজে প’ড়ে থাকতে পারলেই একটু রেস্ট হয়। কিন্তু
চোখটা বুজলেই ঐ ঘিয়েভাজা কুকুরটা চোখের সামনে ভেসে ভেসে উঠছে। কুকুরটা রাস্তায় ব’সেছিলো
প্রান্তিকের দিকে তাকিয়ে। একটু খাবারের আশায়। প্রান্তিক দেয়নি। কুকুরটা’র বুক জুড়ে গোটা
আটেক স্তন দুধে ভরো ভরো, লেজটা নড়ছে, জিভটা বার বার লালা গড়াচ্ছে ব’লে চেতে নিচ্ছে।
মাঝে মাঝে গায়ে এটা-ওটা, মানে মশাটা, মাছিটা, পোকাটা ব’সলেই সেটাকে
তাড়াবার চেষ্টা ক’রছে। এটা মা’র জন্যেই হ’য়েছে। মা-ই মাথা’র মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, কুকুরটা বাচ্চা প্রসব ক’রেছে। ওর এখন
খাবার চাই। তাই চোখটা বুজতেই পারছিলো না কিছুতে। হঠাৎ কখন যেন সত্যিই ঘুমিয়ে প’ড়েছে প্রান্তিক!
ঘুমটা ভাঙল যখন, তখন রাত ন’টা। পাপাই এসে ডেকেছে। তারপর খাওয়া-দাওয়া সেরে নৈশ নিদ্রা।
------------------------
(৩)
নাক দিয়ে সমানে জল গড়াচ্ছিলো
প্রান্তিকের। আজকেই ভিসাটা পাওয়া গেছে। জি.এম. নিজে ফোন ক’রে ব’লেছেন কথাটা। কনফার্মও
ক’রেছেন। প্রান্তিক যাবার জন্যে কতটা প্রিপারেশন নিয়েছে, সে বিষয়ে খবরা-খবরও
নিয়েছেন। এমনকি তিনি সাজেশনও দিয়েছেন যে, মানুষ যেভাবে শিফ্ট করে, প্রান্তিক সেভাবে
যেন ক’রতে না যায়। ওখানে ফ্ল্যাট থাকবে, আর তাতে যাবতীয় নিত্য ব্যবহার্য যা কিছু,
সবই থাকবে। কিন্তু এই সর্দি-টা বড়ো জ্বালাচ্ছে প্রান্তিককে। বিকেলের মধ্যে ওর জ্বর
চ’লে আসে। একটা জিনট্যাক দিয়ে একটা লেমোলেট খেয়েছে। কিন্তু ম্যাজমেজে ভাবটা
যায়নি তবুও। নাক ঝাড়তে ঝাড়তে নাকটা জ্বালা ক’রছে এখন। পাঁচটা নাগাদ অফিস থেকে গাড়ি
বের ক’রেছে প্রান্তিক। একটু স্লো ড্রাইভ ক’রে বাড়ি এসেছে। বাড়িতে ঢোকার আগেই গলির
মোড়টায় ঢুকে একটা দৃশ্য প্রান্তিককে একেবারে ভেঙ্গেচুরে দিয়েছে। মাথা’র মধ্যে একটা টিপ্
টিপ্ টিপ্ টিপ্ ব্যথা ক’রেই চ’লেছে।
গাড়িটা দাঁড় করাতে বাধ্য হ’য়েছে প্রান্তিক।
রাস্তা’র ধারে কুকুরটা শুয়ে আছে আর গোটা পাঁচেক বাচ্চা মায়ের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে প’ড়ে আকণ্ঠ তৃষ্ণা
আর ক্ষুধায় তাদের প্রাপ্য টেনে খাচ্ছে। মা-টা নীরবে প’ড়ে আছে ঘাসের
মধ্যে। গাড়িটা দাঁড় করিয়ে তাকিয়েছিলো প্রান্তিক। কুকুরটা বেঁচে আছে তো? মনে তো হয়
না। এবারে কে বা কারা যেন প্রান্তিকের মাথায় একটা হাম্বর দিয়ে দমাদম আঘাত হানতে
শুরু ক’রেছে। মাথাটা প্রচণ্ড ব্যাথায় যেন ফেটে যাবে। কোনরকমে গাড়িটা থেকে বেরিয়ে এলো
ও। একটা ছেলেকে দেখতে পেয়ে ডেকে ব’ললো,
--- হ্যাঁরে, দ্যাখ তো। কুকুরটা বেঁচে
আছে কিনা।
ছেলেটা দেখে-টেখে জানালো--- না
প্রান্তিকদা, বেঁচে নেই। বাচ্চাগুলো তো আর মৃত্যু বোঝে না। ওরা মা’র দুধের জন্যে
হাঁকপাক ক’রছে মায়ের বুকে।
প্রান্তিকের চোখে যেন একটা অন্ধকার পর্দা
নেমে আসছিলো। দুটো চোখকে ঢেকে দিচ্ছিলো। মাথাটা ভয়ানক ঘুরছে। তাহ’লে কি জ্বরটা বেড়েছে?
চট্ ক’রে গাড়িতে উঠে কোনোরকমে গাড়িটা গ্যারাজ ক’রে আর বারান্দায় উঠতে পারেনি ও। সিঁড়ি’র মুখেই মুখ থুব্রে
প’ড়ে গিয়েছে। প’ড়েই অজ্ঞান। এরপর কে-ই বা ওকে তুলে এনেছে, ঘরে খাটে শুইয়েছে, কিছুই জানে না
প্রান্তিক। চোখ মেলেছে অনেক রাতে। তাকিয়ে দ্যাখে, পাপাই ওর পাশে শুয়ে আছে। আর মা
চরম উৎকণ্ঠায় ব’সে তাকিয়ে আছে ওর মুখের দিকে। মধুরিমা চেয়ারে ঢুলছে। রাত কত হ’লো রে বাবা! কী হ’য়েছে ঘটনাটা---
মনে ক’রতে চেষ্টা করে প্রান্তিক। মনে পড়ে না। ছেলেকে তাকাতে দেখে মা তাড়াতাড়ি
রান্নাঘর থেকে গরম দুধ আর দুটো বিস্কুট নিয়ে এসেছে। মধুরিমাও তাকিয়েছে শব্দ পেয়ে।
তাকিয়েই ব’লেছে,
--- বাবা রে বাবা! কী জোর ভয় পাইয়ে
দিয়েছিলে! বড়াল বাড়ি’র মেয়েটা চীৎকার দিয়ে ডেকে উঠেছে আমাকে। ঐ তো তোমাকে দেখেছে
প্রথম। আমরা কি জানতে পারতাম নাকি! শেষে ডাক্তার-ফাক্তার এনে একসা। তুমি তো কিছুই
জানো না।
মা এসে প্রান্তিককে দুধটুকু খাইয়ে দেয়।
তারপর শুধু নিজের মুখে আঙ্গুল রেখে ওকে চুপ ক’রে শুয়ে থাকতে বলে। প্রান্তিক চুপ ক’রে তাকিয়ে থাকে
মায়ের দিকে। মা’কে ঠিকঠাক বুঝতে পারে না। মা কী চায়? মা কী ভাবছে? গরম দুধটা খেয়ে গায়ে যেন
একটু জোর আসে প্রান্তিকের। প্রান্তিকের মা চ’লে যায় বারান্দায়। আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকে
অসহায় মা। ছেলেটা এভাবে জ্বরে প’ড়েছে আর সেটাই মা’কে এক চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। বিদেশ-বিভুয়ে
গিয়ে কি বৌমা একা সামলাতে পারবে? পাপাই বড়ো হ’য়েছে। তারই বা কী হবে? সংস্কারাচ্ছন্ন
মহিলা বুঝতে চায়, এসব কীসের ইঙ্গিত। অবশেষে দেওয়ালে টাঙ্গানো প্রান্তিকের বাবা’র আবক্ষ ছবিটা’র সামনে দাঁড়িয়ে
কী যেন বলে। যেন ব’লতে চায়, ‘আমাকে কী ক’রতে বলো তুমি? আমার কী করা উচিত?’ কিন্তু ছবি
নিরুত্তর। উত্তর মেলে না।
তখন শেষ রাত। অন্তত একটু কাল তো বিশ্রাম
নিতে হবে। ঘুম না আসলেও তো চোখ বুজে শুয়ে ঘুমোবার একটা চেষ্টা ক’রতে হবে। সকাল হ’তেই তো শুরু হবে
আবার যুদ্ধ। একটু বিশ্রাম না ক’রলে তো দিনের অবশ্য করনীয় কাজগুলো করার সামর্থ্য থাকবে না। মধুরিমা
ঘরের সবুজ আলোটা জ্বেলে দেয়। এসে শোয় প্রান্তিকের পাশে। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে চুলে
বিলি কাটতে কাটতে ব’লতে থাকে,
--- তুমি জ্বরের মধ্যে কী সব ব’লছিলে আবোল-তাবোল!
প্রান্তিক পিন পিন ক’রে ব’ললো---
আবোল-তাবোল! ব’লছিলাম নাকি?
--- ঠিক আবোল-তাবোল নয়। অনেকটা
আবোল-তাবোল।
--- কী ব’লছিলাম?
--- কী সব...। মা আমি তোমার দুধের
অবমাননা ক’রবো না... দুধের দাম দিতে না পারি, তার মর্যাদা রক্ষা ক’রবো... আমাকে
বিশ্বাস করো, মা... আমি তোমার খারাপ সন্তান নই...’ এইসব। তাই মা একটু চুপ হ’য়ে গেছে। তখন মা
তোমার মাথায় জলপটি দিচ্ছিলো। ডাক্তারের একটা ইনজেকশনে আর জলপটিতে তো জ্বরটা একটু প’ড়লো। মা ব’লছিলো, ‘বিদেশ যাও বিদেশ
যাও ক’রে ক’রে ছেলেটার মাথাটা একেবারে খারাপ ক’রে দিচ্ছে এই অফিস। কেউ বাবা-মা’কে ছেড়ে এভাবে
একটা বিদেশ-বিভুয়ে থাকতে পারে!’
প্রান্তিক এবারে বালিশে মুখ লুকোয়। আজ
বহুকাল পরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। মধুরিমা ওর মাথায় তখনও তার আদরের হাত বুলিয়ে
দিচ্ছে। প্রান্তিকের মনে পড়ে, বড়মামা ওর ছোটবেলায় একটা কার যেন লেখা, না প্রচলিত
গল্প শুনিয়েছিলো। এক ছেলে তার বউ-এর প্ররোচনায় মাকে হত্যা ক’রে মায়ের হৃদপিণ্ড
বউ’কে যৌতূক দেবে ব’লে খুশী ক’রতে নিয়ে যাচ্ছিলো। পথে ছেলেটি একটা হোঁচট খায়। মায়ের
হৃদপিণ্ড সন্তান’কে লক্ষ্য ক’রে ব’লে ওঠে, ‘আহা! বাবা, তোর লাগলো?’ এই গল্পটা কেন যে আজ হঠাৎ ওর মনে প’ড়লো, বুঝতে পারে
না ও। মনে প’ড়তেই আবার চোখ ফেটে জল এলো প্রান্তিকের। বালিশে মুখ চেপে ধ’রে বিড়বিড় ক’রে এবার জ্ঞানতই ব’লে উঠলো,
--- মা, তুমি বিশ্বাস করো। আমি তোমার
খারাপ সন্তান নই। আমি ভালো হবো, মা। আমি ভালো হবো।
মধুরিমা মাথায় চুলে বিলি কাটতে কাটতে ব’ললো--- তুমি
কান্নাকাটি ক’রো না। আবার জ্বরটা বাড়বে।
প্রান্তিক এবার মধুরিমা’কে উদ্দেশ ক’রে ব’লে ওঠে--- জানো
মাধু, আজ কয়েকটা দিন আমার মনের ওপর দিয়ে একটা ঝড় যাচ্ছে। একটা মাদি কুকুর... এই
অবধি ব’লে প্রান্তিক ‘মাদি’ শব্দটাকে সংশোধন ক’রে নেয়। আবার বলে--- একটা মা কুকুর
আমাদের পাড়ায় ঘুরছে। কোথা থেকে এলো, কে জানে। বাচ্চা দিয়েছে পাঁচ-ছটা। কিন্তু
বাচ্চাগুলোকে খেতে দেবার মতো দুধ তো ওর বুকে নেই। ওর পেটে খাবারই নেই, তো দুধ দেবে
কোথা থেকে! কুকুরটা ম’রে পড়েছিলো রাস্তায়, আর বাচ্চাগুলো ওদের মা’কে ছিঁড়েকুটে দুধ
খাবার প্রাণান্ত যুদ্ধ ক’রছিলো। এই ছবিটা আমি মোটে সহ্য ক’রতে পারছি না। একটা
কিছু ক’রতে হবে। মনে হ’চ্ছে বার বার--- শুধু আমার চোখের সামনে ঐ কুকুরটার জায়গায়
একটা বৃদ্ধা’র মুখ ভেসে ভেসে উঠছে। মনে হ’চ্ছে, এই তো মা। আমাদের ঘরের কালোকুলো, রোগা বা মোটা, লম্বা
বা খাটো মা। সবই তো মা। তাহলে আমি কী ক’রছি!
--- তুমি আবার কী ক’রছো? মধুরিমা অবাক
হয়।
--- আমি? কি জানি, আমি কী ক’রছি।
--- যাকগে। এখন তো ঘুমিয়ে পড়ো। এইসব
আজেবাজে কথা ভাবতে হবে না। সব ঠিক হ’য়ে যাবে।
প্রান্তিক বিড়বিড় করে--- হ্যাঁ, আমায় সব
ঠিক ক’রতে হবে। আমায়ই ক’রতে হবে। আমি পারবো। তুমি দেখো, আমি পারবোই।
হাল্কা সবুজ আলোতে দুলতে দুলতে কখন যেন
প্রান্তিক ঘুমিয়ে পড়ে। মাথায় কেউ হাত দিলে আর তাকিয়ে থাকতে পারে না প্রান্তিক। সেই ছোটবেলা’র অভ্যেস।
---------------------
(৪)
সকালে ঘুম ভাঙ্গতে তাকিয়ে দ্যাখে, মা ওর
কপালে, বুকে হাত গুঁজে গুঁজে তাপ অনুভব করার চেষ্টা ক’রছে। প্রান্তিক
চোখ মেলতেই মা ব’ললো--- যাক বাবা, টেম্পারেচারটা গ্যাছে। বেশ চিন্তায় ফেলেছিলি। এখন জ্বরটা
নেই। নে, চা খেয়ে নে। জ্বর মুখে ভালো লাগবে।
প্রান্তিক একটা মলিন হাসি হাসি মুখ ক’রে বলে--- না মা,
আর চিন্তা নেই। আমি ভালো হ’য়ে গেছি।
--- তা যা ব’লেছিস। কাল জ্বরের
ঘোরে কী সব ব’লছিলি! আমি ভাবলাম, এই বুড়ো বয়সে কি ছেলে’র তরকা-ফরকা লাগলো নাকি! তোর তো
ছোটবেলাতে জ্বর হ’লেই তরকা লেগে যেতো। কি জানি!
প্রান্তিক এই প্রথম মুখ না ধুয়ে বাসিমুখেই
চা-এর কাপে চুমুক মেরে মনে ক’রলো যে, আজকের চা-টা ওর বত্রিশ বছরের জীবনে শ্রেষ্ঠ চা। তাই
পরম আয়েশে ব’ললো--- মা, তরকাই তো দরকার। তা নয়তো তো ঘোর কাটে না, মা।
মা ব’ললো--- আমি তো অত বুঝি না বাপু। বিদেশ
যাচ্ছিস। ওখানে সব ভালো ভালো বিরাট বিরাট ডাক্তার আছে, শুনেছি। একটা ফুল চেক আপ ক’রিয়ে নিবি। কেন এমনটা
হ’চ্ছে।
--- যাচ্ছি না তো।
মা তো অবাক। ছেলে বিদেশ যাচ্ছে, এটাই তো
সে জানে। এখন ব’লছে, যাচ্ছে না! তাই বিস্ময়ে মা বলে--- সে আবার কী! গরম জামা-কাপড় কিনলি, সব
গুছোচ্ছিস, পাপাই-টা বিদেশ যাবার নামে নেচে বেড়াচ্ছে?
--- ও তো জানে না, তুমি যাচ্ছো না। তাই
নেচে বেড়াচ্ছে। যখনই জানবে, ওর ঠাম্মি যাচ্ছে না, ব’লে আমরাও যাচ্ছি না, তখন খুশী হবে। আমি
জানি।
--- কিন্তু কেন যাবি না? জীবনে এমন সুযোগ
নাকি আসে না? আমার কথা ছাড়। যাবি না-টা কেন?
মিথ্যে বলে প্রান্তিক--- ভিসা হয়নি, মা।
এখন ভিসা দিচ্ছে না। এই যে সব জঙ্গী হামলা হ’চ্ছে না? এই কারণে ভিসা দিচ্ছে না।
--- তাহলে? মা তাকায় বিস্ফারিত চোখে।
প্রান্তিক দুর্বল গলায় ব’লে ওঠে--- ‘মায়ের দেওয়া মোটা
কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই/ দীন দুখিনী মা যে তোদের, তার বেশী আর সাধ্য নাই...’
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মধুরিমা হাসে।
নির্ভেজাল হাসি। আনন্দের হাসি। এটাই তো ও চাইছিলো। বিদেশ মানে ইংরেজিতে কথা ব’লতে হবে। এটা ওর
গায়ে একটা জ্বর এনে দিচ্ছিলো। ইংরাজি ওর যম। তাই ঠাকুরের কাছে মানত ক’রেছিলো, ‘যাওয়া না হয়’।
---------------------------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন