থাকি শুধু গাইতে তোমার গান…
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়
য
|
দি যে কোনো একজন বাঙ্গালিকে ডেকে প্রশ্ন করা যায়, ‘আপনার প্রিয় চলচ্চিত্র
নির্মাতা কে?’ তিনি হয়তো অকাতরে উত্তর দেবেন, ‘সত্যজিৎ রায় অথবা তপন সিনহা।’ যদি প্রশ্ন করা
যায়, ‘প্রিয় কবি কে?’ তিনি হয়তো অকাতরে উত্তর দেবেন, ‘রবিঠাকুর বা
জীবনানন্দ দাশ।’ অথবা যদি জানতে চাওয়া যায়, ‘আপনার প্রিয় রহস্য রোমাঞ্চকর এ্যাডভেঞ্চার কাহিনি লেখক কে?’ তিনি নিশ্চয়ই
উত্তর দেবেন, ‘আবার সত্যজিৎ রায়।’ যদি ব’লি, ‘আপনার প্রিয় লোকগীতি শিল্পী কে?’ হয়তো উত্তর পাবো,
‘নির্মলেন্দু চৌধুরী’। ‘নজরুলগীতি শিল্পী? উত্তর, ‘ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র বা মানবেন্দ্র
মুখোপাধ্যায়।’ বাংলা রাগপ্রধান? ‘ভীস্মদেব চট্টোপাধ্যায় বা জ্ঞানগোঁসাই (জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ
গোস্বামী) ।’ যদি ব’লি, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত?’ কে না ব’লবে, ‘দেবব্রত বিশ্বাস আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।’
কেন বলবেন? কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ ছাড়া প্রায়
সকলে আর কারোর নাম না ব’লে এই নামগুলো কেন ব’লবেন? তাঁরা কি খুব বুঝদার? ঐ ঐ ক্ষেত্রেগুলোতে
সমঝদার? নিশ্চয়ই না। তাঁরা হয়তো একেবারে সাধারণ মানুষ। আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের
মতো খুবই সাধারণ মন নিয়ে তাঁরা হয়তো সিনেমা দ্যাখেন, কবিতা ও রহস্যরোমাঞ্চ কাহিনি
পড়েন, গান শোনেন, খুঁজে খুঁজে দ্যাখেন, কোথায় এই বইগুলো বা কম্প্যাক্ট সিডি বা ডিভিডিগুলো
পাওয়া যাবে, আর তাঁরা সংগ্রহ ক’রবেন। কিন্তু কেন? তাঁদেরকে কি কেউ এই কথা ব’লতে বাধ্য ক’রেছেন, উদ্বুদ্ধ ক’রেছেন? তাঁরা কি
কারোর প্রচার ক’রবার জন্যে দায়বদ্ধ? নিশ্চয়ই না। এটা তাঁদের মন ব’লছে। মনের সাথে
যুদ্ধ ক’রে তাঁদেরকে এমনটা ব’লতে হয়নি। এ তাঁদের স্বতঃস্ফূর্ত মন্তব্য। কী কী কারণে
তাঁরা অমন ব’লছেন, এমন বলার পিছনে শৈল্পিক কোনো যুক্তি-তক্ক বা গপ্প আছে কিনা, তা হয়তো
তাঁদের অনেকেই জানেন না। তাঁদেরকে চেপে ধ’রলে তার হয়তো কোনো সদুত্তর তাঁরা দিতেও
পারবেন না। কিন্তু তাঁদের মন থেকে ঐ ভালো লাগাটা উপড়েও ফেলা যাবে না। তাঁদের এমন
কথার ওপরে হাজার বিরুদ্ধ ব্যাখ্যা কোনো সমঝদার দিতেই পারেন, তাঁদেরকে বার বার ভুল
প্রমাণিত করার প্রচেষ্টা ক’রতেই পারেন। এমনকি তাঁরা হয়তো ভয়ঙ্কর যুক্তি আর
তত্ত্বজ্ঞানের ভয়ে নীরব নিঃশব্দ নিরুত্তর হ’য়ে যেতেই পারেন। কিন্তু তাঁদের নিজেদের মনে
ভালোলাগাটাকে তাঁরা মনে মনে অস্বীকার ক’রতেও পারবেন না।
কিন্তু বিতর্ক তো র’য়েই যায়। আজ এমনি
একটা বিতর্কিত লেখা আমি হয়তো লিখতে ব’সেছি। বিতর্কিত, কারণ যাকে নিয়ে আমার এই লেখা’র প্রচেষ্টা,
তিনিই তো স্বয়ং বিতর্কিত। তাঁকে নিয়ে হয়তো নানা তথ্য ও তত্ত্বজ্ঞানসম্পন্ন লেখালেখি
ইতিমধ্যে হ’য়েছে। এইসব লেখালেখি’র মধ্যে অনেক লেখাপত্র বেশ মূল্যবানও বটে। তাঁরা সকলে সেই
মানুষটি’র প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এসেছেন। তবু তো সামান্য একজন মানুষ যে দূর থেকে তাঁর
অসামান্য কীর্তি’র সাক্ষী, সে একই মাপের বা একই মানের না হ’য়েও অনেকবার বলা কথা নিজের মতো ক’রে বলে, যদি তা
বলার দরকার হয়। হয়তো এই লেখা নতুন ক’রে না লিখলেও কিছু হ’তো না। তিনি তিনিই
আছেন এবং থাকতেন, কিন্তু আমার মতো যারা অনেক কথা ব’লতে চান, কিন্তু ব’লতে পারেন না,
তাঁদের কথা শুনবার কেউ নেই, তাঁদের হ’য়ে এই লেখা একটি ভক্তের নৈবেদ্য মাত্র।
এক বিতর্কের মধ্য দিয়ে এই বিতর্কিত
ব্যক্তিটি’র ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটেছে। তিনি দেবব্রত বিশ্বাস। তিনি কারোর কাছে ‘জর্জ দা’, কারোর কাছে ‘দেবব্রত বিশ্বাস’। এই ‘জর্জ দা’ সম্বোধনটি নিয়েও
একটা বিতর্ক আছে। তাহ’লে তিনি কি খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ ক’রেছিলেন? তাই কি
তিনি ‘জর্জ বিশ্বাস’? যেমন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। কিন্তু যেই মানুষ লক্ষ্য ক’রেছে, তাঁকে ‘জর্জ দেবব্রত
বিশ্বাস’ বলা হয় না, অমনি তাঁর গুণগ্রাহী থেকে শুরু ক’রে তাঁর প্রতি বীতশ্রদ্ধ এক শ্রেণীর মানুষ
বিতর্ক ক’রেছে, কেন তিনি ‘জর্জ? বেশী বেশী!’ এমনও প্রশ্ন হ’য়েছে, তিনি কি
কম্যুনিস্ট পার্টি’র একজন আদর্শ সদস্য কোনোকালে ছিলেন, কেননা মোটে বারোটা বছর
তিনি কম্যুনিস্ট পার্টি’র সাথে যুক্ত ছিলেন। যেন এলেন, দেখলেন ও ছাড়লেন। এমনকি কিছু
অবিমৃশ্যকারী এককালে এমনও প্রশ্ন তুলেছিলেন, তাঁর কি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবার
স্বাধীনতা আছে। আবার অনেকে ব’লেছিলেন, এ ক্ষেত্রে ‘কেবল’ শব্দটি যদি একটি শর্ত হয়, তবে দেখা
যাবে, কেবল তাঁরই হয়তো সেই অধিকার আছে। আর কেউ নয়। অথচ অনেকে ব’লেছিলেন, তিনি
রবিঠাকুরের গান গাইবার অধিকার রাখেন না। একটি বিতর্কিত বিতর্ক।
এই বিতর্ক এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে
পৌঁছেছিল যে, তিনি একটা সময় মানুষের সামনে ও রেকর্ডিং-এ ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ পরিবেশন বন্ধ ক’রে দিয়েছিলেন। কেবল
নিজের ঘরের দরজা বন্ধ ক’রে গাইতেন, গাইতেন মনের মতো ক’রে ‘মোরে ভিখারি
সাজায়ে কী রঙ্গ তুমি ক’রিলে...’। এ যেন অনেকটা রবিঠাকুরের গানের কথায় ‘আমায় বলোনা
গাহিতে, বলোনা...।’ অথবা সেই বড়ো পরিচিত কবিতা’র ছত্র ‘গাইবো না আর গান আমি, গাইবো না আর
গান...।’ রবিঠাকুর কি তাঁকে উপলক্ষ ক’রে ঐ ‘আমায় বলোনা গাহিতে, বলোনা...’ কথাগুলো লিখেছিলেন? উত্তর--- নিশ্চয়ই
না। সেটা ছিল কবি’র নিজের মনের এক রাজনৈতিক বেদনা থেকে উদ্ভূত একটি গান। এমন একটি বেদনা যেন একটা
সময় জর্জ বিশ্বাসেরও বেদনা হ’য়ে বেজেছে। গান ক’রে, কেবল সঙ্গীতচর্চা ক’রে কেউ যে স্বাধীন
দেশের কিছু স্বাধীন মানুষের দরবারে আসামী’র কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বাধ্য হ’তে পারেন, এমনটা
ভাবতে যেন কেমন অদ্ভুত লাগে। এই পরিণাম তো ঘ’টতো ইংরেজ সরকারের আমলে। এই গান গাওয়া
যাবে না, সেই গান করা যাবে না। গাইলেই জেল-হাজত। তা সে হোক না কেন ‘কারার ঐ
লৌহকবাট...’ অথবা ‘ফেলে দে রেশমি চুড়ি বঙ্গ নারী, কভু হাতে আর পরো না...।’ কিন্তু সে তো বিদেশী
শাসকের রক্ত চক্ষু’র পরিণাম। এতে তো আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এইটাই তো
স্বাভাবিক। শাসকের থেকে তো এর বেশী কিছু আশা করাই বাতুলতা। কিন্তু জর্জ বিশ্বাস
আবার কেমন গান ক’রলেন যে, তাঁকেও বিচারসভা’র কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার আয়োজন করা হ’য়েছিলো? কার পাকা
ধানে তিনি মই দিয়েছিলেন তিনি! তাও আবার নিজের স্বাধীন দেশের কিছু অশাসক মানুষের তৈরী
একটি সংগঠনের বিচারসভা। সে তো খুব লজ্জা’র কাহিনি। লজ্জাকর সেই বিচার অধিবেশন।
একটু একটু উত্তর দেবার চেষ্টা করা যাক।
প্রথমেই আসি ‘জর্জ দা’ সম্বোধনে। তথ্য বলে যে, তাঁর জন্মকালে ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জ এ দেশে (দিল্লি
দরবার) এসেছিলেন। আর তাই দেবব্রত’র ডাক নাম দেওয়া হ’য়েছিল ‘জর্জ’। ঠিক হ’য়েছিলো না, ভুল? সেই বিতর্ক থাক। শুধু
এটুকু সত্য যে, না, তিনি খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেননি। কম্যুনিস্ট পার্টিতে থাকার
ফলে তিনি এই ‘ধর্ম’ বিষয়টিকে ব্যক্তিজীবনে স্বাভাবিকভাবেই কোনোকালে বরণ করেননি।
এবারে তাঁর কম্যুনিস্ট পার্টি’র সদস্য পদের কথায়
আসি। তিনি যে তৎকালীন কম্যুনিস্ট পার্টি’র সক্রিয় একজন সদস্য ছিলেন, এ খবর প্রায়
সকলেই জানেন। কিন্তু আচমকা ১৯৫০-এ তিনি দল থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। একটা সময়
কম্যুনিস্ট পার্টি’র সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘গণনাট্য সঙ্ঘ’, প্রকারান্তরে ‘আইপিটিএ’ (ইন্ডিয়ান পিপ্লস
থিয়েটার এ্যাসোসিয়েশন)-এ ছিলেন। গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে গ্রামেগঞ্জে গণসংগীত গেয়ে
বেরিয়েছেন, নাটকে অভিনয়ও ক’রেছেন। নাম না উল্লেখ ক’রেও বলা যায়, তাঁর সাথে ছিলেন তখনকার
উদীয়মান এবং পরবর্তীকালীন শিল্প জগতের অনেক বড়ো বড়ো তারকা, যাঁরা প্রতিভায় এবং সেই
প্রতিভা বাস্তবায়িত ক’রে জীবিকায় যথেষ্ট সফল হ’য়েছিলেন। পার্টি’র আজীবন হোল
টাইমার হবার একটা সুপ্ত বাসনা ছিল দেবব্রত বিশ্বাসের, কেননা তাঁর ওপর কারোর
দায়িত্ব ছিলো না। তখন কম্যুনিস্ট পার্টি’র নাম ছিল ‘সিপিআই’ অর্থাৎ কম্যুনিস্ট
পার্টি অফ ইন্ডিয়া। কিন্তু তাঁর স্বপ্নের এই রাজনৈতিক আদর্শ দলটি ভেঙ্গে দু-খণ্ড হ’য়ে যায়। জন্ম নেয় পুরনো
সিপিআই দলের থেকে আবির্ভূত নতুন দল ‘সিপিআইএম’ অর্থাৎ কম্যুনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া
(মার্ক্সবাদী)। কেমন যেন শোনালো নামটা। ‘কেমন যেন শোনালো’ কারণ এটা একটা
নাম মাত্র। মূল দলটাই তো ছিল ‘মার্ক্সবাদী’। তাহ’লে কি ‘সিপিআই’ আর মার্ক্সবাদে বিশ্বাস ক’রতো না? আর এই
নতুন দল হ’ল গিয়ে নির্ভেজাল মার্ক্সবাদী? ওঁদের প্রশ্ন ক’রলে কিন্তু উত্তর দিতে ওঁরাই বিভ্রাটে প’ড়বেন। তাই এটা
ভাবাই শ্রেয়, কম্যুনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্ক্সবাদী) হ’লো একটা নাম
মাত্র। তাহ’লে আলাদা হওয়া কেন? নিশ্চয়ই নেতিবাচক আর ইতিবাচকদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব ঘ’টে যাচ্ছিলো। তাহ’লে কি পার্টিতে
বেনোজল ঢুকছিলো? মানে ইতিবাচক আর নেতিবাচকদের চির দ্বন্দ্বটি কম্যুনিস্ট
পার্টিতে নিশ্চয়ই বেশ কালো হ’য়ে ঢুকছিল। তা
নয়তো একটা মুখ্যত গণমুখী রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতান্তর থেকে মনান্তর হ’য়ে একেবারে
দলান্তর ঘ’টে যেতে পারে না। একে অপরের দায় নিতে অস্বীকার করতে পারে না। আসলে তো ওঁরা উভয়েই
কম্যুনিস্ট পার্টি। কাক তো কাকই। দাঁড় কাক হ’ক বা পাতি কাক। ডাকটা কারোর ‘কা কা’, কারোর ‘আ আ’। একটা সময় তো ছিল,
যখন নিজেদের অনেক রক্ত ঝরিয়ে ওঁরা শুধু এ দেশে নয়, আরো বেশ কিছু দেশে মার্ক্সবাদকে
একটা প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছিলেন এবং পেরেছিলেনও। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। সব
গোল্লায় গেলো। নিজেদেরকে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে খণ্ডিত ভারতবর্ষের মান রাখলো।
এই বেনোজল, ভাঙ্গন, মতান্তর, মনান্তর,
দলান্তর কিছুই মেনে নিতে পারেননি জর্জ বিশ্বাস। তিনি যেন বুঝতে পেরেছিলেন যে,
এখানেই এই দল গণমুখ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে। কম্যুনিস্ট পার্টি’র মধ্যে অন্য প্রেত
তিনি যেন দেখতে পেয়েছিলেন। সকলেই জানেন, একটি মানুষ তখনই কম্যুনিস্ট পার্টি’র সদস্য হ’তে পারেন, যখন
তাঁর ব্যক্তিজীবনে আদর্শ আর দলীয় আদর্শ এক এবং অভিন্ন হয়। ব্যক্তিজীবনে আমি এক ভোগবাদী
(বুর্জোয়া), আর দলে গেলে আমি অন্য মুখ (পাঁড় কম্যুনিস্ট)--- এমনটা তো চ’লতে পারে না। সে
দল তো টেকে না। সে দলকে পোকায় কাটে, ঘুণে খেয়ে যায়। কখনও অচিরেই আবার কখনও বিলম্বে
একদিন তার পতন তো ঘটেই। আর তারপর কী ঘ’টেছিলো? তা তো ইতিহাস। পৃথিবী জুড়ে
কম্যুনিস্ট পার্টি’র পতন ঘটে। সোভিয়েত রাশিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, রুমানিয়া... কোন
দেশ নয়! আসলে গোপনে ব’লে রাখি, কম্যুনিজমের পতন কিন্তু ঘটেনি কোথাও। পতন ঘ’টেছে কম্যুনিস্ট
পার্টি’র, কম্যুনিজ্মের ধারক আর বাহকদের। কম্যুনিজম তো এ্যান ‘ইজ্ম ফর দি কমিউন’। সেই ইজ্ম তো
মুখ থুবড়ে পড়ে না। প’ড়তে পারে না। যতদিন কমিউন থাকে, ততদিন এই ইজ্ম থাকে।
মলাটটাই শুধু খ’সে পড়ে। তাই প’ড়েছে। যারা কম্যুইনিজ্মকে নিজেদের জীবন ক’রে নিতে প্রস্তুত
ছিলেন, তাঁরাই তো তাই ‘পার্টি’ নামক প্রতিষ্ঠান থেকে সেকালে বেরিয়ে এসেছিলেন। এই নিয়েই
নাট্যকার ও অভিনেতা ব্রাত্য বাবু রিপ ভ্যান উইঙ্কলের স্বপ্নভঙ্গের আদলে লিখলেন ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’। অনেকের মুখোশ আর
মুখ আলাদা আলাদাভাবে মানুষের সামনে বেরিয়ে এলো। কলকাতায় তথা বাংলায় তা আলোড়ন
তুললো। সেখানেও তো দল ছেড়ে বেরিয়ে আসা একটি মানুষের কথা পাই।
এ কথাও সকলে জানেন, কম্যুনিস্ট পার্টি একটি
রেজিমেন্টেড পার্টি। এই দলছুটদের কম্যুনিস্ট পার্টি একেবারে পছন্দ ক’রতে পারে না।
বিরোধী শিবির থেকেও এদেরকে তারা অনেক বড়ো শত্রু জ্ঞান করে। তাকে আবার নতুন ক’রে পরিগ্রহন করা
নয় তো বটেই, তাকে ‘বিক্ষুব্ধ’ ঘোষণা করাই শ্রেয় মনে করে তারা। সাম্প্রতিককালে এর
দৃষ্টান্ত তো আমরা দেখেছি। এই পার্টিতে সদস্যপদ যেমন অনেক কাঁটা’র পথ পেরিয়ে পেতে
হয়, তেমনি এই পার্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হ’য়ে যাওয়াটাকে অত সরল চোখে দেখা হয় না।
তাকে নিয়ে ছেঁড়াকাটা করা হয়, তার ব্যবচ্ছেদ করা হয়। এমনকি ধোপা-নাপিত বন্ধ করা নয়,
তাকে এক অভিনবভাবে একঘরে ক’রে রাখা হয়। কমপ্লিট আইসোলেশন। এখানেই অনেকে কম্যুনিস্ট
পার্টি’র প্রেত দেখতে পান। তেমন দলছুটই তো জর্জ বিশ্বাস। তিনি যেন এই বিষয়ে রবিঠাকুরের
কথা বুঝতে পেরেছিলেন,’আমার এ ঘর বহু যতন ক’রে ধুতে হবে, মুছতে হবে মোরে...’। ফলে তাঁর সেই এই
স’রে যাওয়াটা অনেক কমরেড মেনে নিতে পারেননি, কেননা তাঁর স’রে যাওয়ার পিছনে
প্রচলিত কোনো কারণ ছিল না। অর্থাৎ তিনি শারীরিকভাবে শয্যাশায়ীও হননি, আবার পারিবারিকভাবে
এমন জড়িয়ে যাননি যে, দায় ও দায়িত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষ যেভাবে তাঁর ডেডিকেশন থেকে
স’রে যান, তেমনভাবে তিনিও স’রে গেছিলেন। তিনি তো অকৃতদার ছিলেন। একাই থাকতেন তাঁর নিরালম্ব
জীবনে। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন কম্যুনিস্ট। তাই পার্টি’র কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন,
তিনি কি কম্যুনিস্ট পার্টি’র একজন আদর্শ সদস্য হবার যোগ্যতা রাখেন। কেউ তাঁকে এই
প্রশ্ন সরাসরি হয়তো করেনি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা কালো মেঘ তাঁর বিরুদ্ধে কাজ ক’রেছিল যার প্রকাশ
ঘটেছিল তাঁর সঙ্গীত জগতে। এ ঘটনাও তাঁকে ভেঙ্গে দেয় নি। তিনি অন্তত লোকসমক্ষে ব’লেছেন যে, তাঁর
ভাগ্য নাকি ভালো কেননা পার্টি’র দুটি উইং-ই (সিপিআই এবং সিপিআইএম) তাঁকে সারাজীবন
ভালোবাসা দিয়েছে। এটি ছিলো তাঁর বিনয় মাত্র।
জর্জ বিশ্বাসের মধ্যে কোনো আভিজাত্য,
আমিত্ব বা শিল্পের বেসাতি করার মনোভাব কোনোকালে ছিল না। তাঁর সংস্পর্শে যারাই
এসেছেন, তাঁরাই জানেন এ কথা। সঙ্গীতই তাঁকে আবদ্ধ রেখেছিলো তাঁর তিন অক্টেভ
ক্ষমতাসম্পন্ন হারমোনিয়ামের রিডে। শৈল্পিকভ্যানিটি তাঁর ছিলো না। যাকে তাকে তিনি
কাছে টেনে নিতেন। সে কে, আমি তাকে ডাকতে পারি কিনা, সেটা আমার সম্মানের পক্ষে
ঠিকঠাক হবে কিনা--- এসব কোনো কথা তিনি বিচার ক’রতেন না। একজন অনন্য সাধারণ মানুষ তিনি।
সংসারে থেকেও সন্ন্যাসী। আমি ব্যক্তিজীবনে তাঁর অক্ষয় ভক্ত হ’লেও এই
ব্যক্তিত্বের সাথে সরাসরি পরিচিত হ’তে পারিনি। আমি এ্যাতো বড়ো মাপের তো কেউ
নই। কেবল কাকতালীয়ভাবে আমাদের বাংলা জন্ম তারিখটি এক মাত্র (৬ই ভাদ্র)। কিন্তু এমন
একজনের সম্বন্ধে আমি জানি, যিনি এই ব্যক্তিত্বটি’র ঘনিষ্ঠ হ’তে পারতেন। জর্জ
বিশ্বাস নিজেই তাঁকে নিজের কাছে ডেকেছিলেন। না, বন্ধু হিসেবে নয়, সঙ্গীতের ছাত্র
হিসেবে। তিনিও কম্যুনিস্ট পার্টি’র একজন আমরণ সদস্য ছিলেন। পার্টি আর জনগণের সেবায়
আত্মনিবেদিত তিনি আততায়ীর গুলিতে প্রাণও দেন। এইটিই স্বাভাবিক। একজন আদর্শ
কম্যুনিস্ট তো প্রাণ দেবেনই। দিতে তাঁকে হবেই। মৃত্যুর আগের দিনটিতে আমি তাঁকে
টেলিফোনে ব’লেছিলাম, ‘আপনি শিল্পী। রাজনীতি ছেড়ে একটু গান
করুন। এটাই আপনার যুদ্ধক্ষেত্র।’ তিনিও আমাকে টেলিফোনে ব’লেছিলেন, ‘হিমাদ্রি, এসব কথা
ব’লে পালিয়ে যেতে পারবে না। খুব সঙ্কটের দিন আসছে...।’ তিনি
সঙ্গীতশিল্পী শ্রী শৈলেন দাস। তিনি আমার অগ্রজ বন্ধু, আমাদের পারিবারিক সঙ্গীত
প্রশিক্ষক এবং চিকিৎসক। জর্জ বিশ্বাসের সমসাময়িক এবং তাঁরই সঙ্গীত গুণগ্রাহীরা এই
বয়োকনিষ্ঠ সাধক রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী’কে ‘একলব্য’ ব’লে ডাকতেন। জর্জ বিশ্বাসও স্বয়ং তাঁকে
তাই ডাকতেন। তিনি নাকি জর্জ বিশ্বাসের আদর্শ উত্তরসুরী। কিন্তু তিনি কোনোদিন জর্জ
বিশ্বাসের কাছে সঙ্গীতশিক্ষা নেননি। তাঁর গুরু ছিলেন ‘প্রমিত সেন’ (পুরনো)। তিনি এই
কম্যুনিস্ট পার্টি থেকে দাঁড়িয়ে একবার বিধায়ক এবং শেষ জীবনে পুরপ্রধান পর্যন্ত ছিলেন।
কিন্তু কোনোদিন জর্জ বিশ্বাসের এই পার্টি পরিত্যাগ থেকে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে একটি বিরুদ্ধ
কথাও বলেননি। আকাদের মধ্যে একে অপরের বাড়িতে গিয়ে ব্যক্তিগতস্তরে নানা কথা হ’ত।। নানা কথা। আমি
তাঁকে প্রশ্ন ক’রেছিলাম, ‘আপনাকে আহ্বান করা সত্বেও আপনি কেন দেবব্রত বাবু’র কাছে সঙ্গীত
শিক্ষা’র জন্যে গেলেন না? এটি তো আপনার কাছে আশীর্বাদ হ’তো।’ তিনি উত্তর
দিয়েছিলেন, ‘তাঁর কাছে সঙ্গীতের প্রশিক্ষণ না নিয়েই যদি আমাকে ‘একলব্য’ বলা হয়, তবে কি
আমার তাঁর কাছে প্রশিক্ষণের জন্যে যাওয়া উচিত? তুমিও একজন শিল্পী। শিল্পী হিসেবে
তুমি কী মনে করো?’ ভেবে দেখলাম, না। যাওয়া উচিত হ’তো না, কেননা এমনটা হ’লে শৈলেন দাস হ’তেন ‘ছোট জর্জ বিশ্বাস’, বড়ো জোর ‘দ্বিতীয় জর্জ বিশ্বাস’। একজন শিল্পী
এমনটা হ’তে চাইতেই পারেন না। তিনি তো নিজস্ব সঙ্গীত সত্তা, নিজস্বতা এবং মৌলিকত্ব হারাতেন।
হয়তো একজন ‘কণ্ঠি’ হ’য়ে উঠতেন। ‘কণ্ঠি’ কথাটি যখন ব’ললাম, তখন কণ্ঠি’র উদাহরণ না দিয়ে পারছি না। কোনো বড়ো শিল্পী’র অনুকরণে সঙ্গীত
পরিবেশন ক’রে আজকাল অনেক শিল্পীই সস্তায় নাম-ধাম ক’রেছেন, দেখতে পাই। প্রকৃতপক্ষে একজন ‘কণ্ঠি’র তো শিল্পজগতে কোনো
মূল্য থাকে না। কিন্তু দেবব্রত বিশ্বাসের জনপ্রিয়তা কতটা উচ্চ ছিল, তার পরিচয় মেলে
তাঁরই ছাত্র শিল্পী স্বপ্নন গুপ্ত’কে দিয়ে। স্বপন গুপ্ত ভালো শিল্পী বা
মন্দ--- সে বিচার তো তাঁরা ক’রবেন, এসব ক’রে যাদের দুটো পয়সা হয়। তবে তিনি যে জর্জ
বিশ্বাসের ছাত্র হ’য়ে তাঁর কণ্ঠ, গায়কী ইত্যাদি’র কার্বন কপি ছিলেন, সে তো তাঁদের
সমসাময়িক এবং অত্যন্ত নিকট মানুষ ব’লে গেছেন। আমরাও জানি, কেননা তাঁদের
উভয়ের গান আমাদের শোনা অভ্যেস ছিল। কিন্তু শিল্পী স্বপন গুপ্ত’কে আমরা সহ্য
করেছি, মান দিয়েছি, কারন তিনি আর কারো নন, স্বয়ং আমাদের জর্জ কণ্ঠি।
যাঁরা জর্জ বিশ্বাসের সংস্পর্শে এসেছিলেন, তাঁরা সম্যক জানেন যে, তিনি
ছিলেন আপাদমস্তক একজন রসিক মানুষ। নানা ব্যক্তিত্ব তাঁর এই রঙ্গরস নিয়ে নানা লেখা
লিখেছেন। কিন্তু এমন কী ঘ’টলো যে, সেই মানুষটা’র মুখ থেকে হাসিটুকু কেড়ে নিয়েছিলো? তিনি
নিজেকে নির্বান্ধব, নিঃসঙ্গ ক’রে ফেলতে শুরু ক’রেছিলেন? ডুবে গিয়েছিলেন মদ্যপানের
মধ্যে? তবে কি এর জন্যে দায়ী তাঁর কোনো ব্যাধি? অত্যন্ত ভয়ঙ্করভাবে তাঁকে আক্রমণ
করা ‘হাঁফানি’। মাঝে মাঝে তিনি নাকি ব’লতেন, ‘আপনারা তো খুব ভগবানে বিশ্বাস করেন, দেখি। আমার কী অপরাধ কন
তো? সারাজীবন গান কইরা আমি আনন্দ দিতাছি। তাইলে আমার হাঁফানি হয় ক্যান?’ কেউ কি সেই উত্তর
দিতে পেরেছেন? না। এটাই কি তাঁর এক এবং একমাত্র বেদনা ছিল? না, তাও নয়। এসব তিনি তুচ্ছ ক’রেছেন। তাঁর শেষ
সঙ্গীত পরিবেশনে যেভাবে গলায় পাম্প ক’রে ক’রে তাঁকে শ্বাস সঞ্চয় ক’রে ক’রে সেই শেষ গান
গাইতে হ’য়েছিলো, তা আর কারোর পক্ষে সম্ভব কিনা, সন্দেহ করেন তাঁর সাথে থাকা মানুষেরা। তাঁর
কণ্ঠে সেইদিন ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে...’ গানটি এমন একটি মাত্রায় পৌঁছেছিল যে, সেই
গানটি যেন তাঁর ‘পেটেন্ট’ হ’য়ে গেলো। তাঁর সেই আর্তি আজো মানুষের কানে বাজে। রোগ’কে তিনি পরোয়া
করেননি। তবে সে কি কোন নারী? কেন তিনি জনসমক্ষে সঙ্গীত পরিবেশন ক’রতেন না? কোনো নারী’র সাথে সঙ্গীত পরিবেশনের
কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে ব’লে তো মনে হয় না! বস্তুত নারীও নয়, অন্য কিছু, অন্য কিছু
বটে। প্রকৃতপক্ষে গানই তাঁকে গান দিয়ে নিষ্ঠুর আঘাত ক’রেছে। প্রাতিষ্ঠানিকতা,
শিল্পের তহশিলদারি, শিল্পী’র ওপর মাতব্বরি, মাফিয়ারাজ ইত্যাদি এ সবের জন্যে দায়ী।
যতদিন গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে জর্জ
বিশ্বাস রাস্তায় রাস্তায় গণসংগীত ক’রে বেরিয়েছেন, ততদিন তা ছিল একটা আদর্শ
থেকে দলীয় বানী প্রচারের উদ্দেশ্যে গান গাওয়া। তার সাথে কোনো প্রেম ছিল না। গণসঙ্গীতে
প্রেম থাকবার কথাও নয়। দায় ছিল, দায়িত্ব ছিল, ছোটদেরকে নিয়ে একত্রিত ক’রে সেই দায়িত্ব
পূর্ণরূপে পালন করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। আমরাও যখন নাট্যদলে গণসংগীত শিক্ষা ক’রতাম, আমাদের
প্রেম উদ্ভূত হ’তো না। একটা চার্জ অনুভব ক’রতাম। একটা উদ্যম, একটা কিছু ক’রে দেবার উদ্যম। প্রেম
ছিল তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি। একদিকে ভীস্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের মতো মানুষদের
সুর-সাধনা, আর একদিকে নিজের মা ও কনক দাসের (বৌদি) দেওয়া গুরুদেবের গানের প্রতি
প্রেম--- এই দুইয়ে তিনি ভেসে যান। মায়ের প্রভাব না থাকলে হয়তো তাঁকে
রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে আমরা পেতামই না। অন্তত তাঁকে তো তাঁর পার্টি কোনো
উৎসাহ দেয়নি। তৎকালীন কম্যুনিস্টরা তো রবীন্দ্রনাথ’কে ‘বুর্জোয়া’ আখ্যা দিয়ে বর্জন ক’রেছিলেন। রবিঠাকুরের
প্রেম, পুজা, প্রকৃতি ইত্যাদি পর্যায়ের প্রতিক্রিয়াশীল গান তো গাওয়াই যেতো না।
কম্যুনিস্ট পার্টি’র তো একটা গোঁড়া ছুতমার্গ ছিল। ফলে বামপন্থী অনুজপ্রতিম সঙ্গীতশিল্পী
হেমাঙ্গ বিশ্বাস পর্যন্ত জর্জ বিশ্বাস’কে ব’লেছেন, কেন তিনি ঐ রবিবাবুর প্যানপ্যানানি
গান করেন। এই ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীতের পরিচয়--- প্যানপ্যানানি। সেই রাজনৈতিক
মতাদর্শের মানুষ হ’য়ে এবং সেই দলের সদস্য হ’য়ে তো দলীয় চিন্তাধারার বাইরে সেকালে
দাঁড়ানো যেতো না। সেই সময় কম্যুনিস্ট পার্টি’র শিরদাঁড়া’র জোর ছিল, যা পরে
বেনোজল ঢুকে নষ্ট ক’রে দিয়েছে। কিন্তু দেবব্রত বিশ্বাসের সাথে তো এই জগতের
গাঁটছড়া অনেক আগেই বাঁধা হয়ে গেছিলো। পরে সেই হেমাঙ্গ বিশ্বাসকেই ব’লতে তিনি বাধ্য ক’রেছিলেন যে,
রবিবাবু’র এইভাবে গাওয়া যায়, তিনি ভাবতেই পারেননি। ভাবলে আশ্চর্য লাগে যে, এই
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো একজন বুর্জোয়া মানুষের লেখা নানা নাটক বা নৃত্যনাট্য
মঞ্চস্থ ক’রে ক’রে এই জর্জ বিশ্বাস তৎকালীন গোঁড়া কম্যুনিস্ট পার্টি’কে অর্থ সংগ্রহ ক’রে দিয়েছেন তাঁদের
দুর্দিনে।
দেবব্রত বিশ্বাস রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রথম
রেকর্ড করেন সম্ভবত ১৯৪০ সালে যখন তিনি গুরুদেবের সঙ্গীত জগতে সবে প্রবেশ ক’রেছেন। ফলে তাঁর
বোধ, চিন্তা, মনন ইত্যাদি তেমন পরিণত না হওয়ায় সে সময় তাঁর সাথে কারোর কোনো বিরোধ
বাঁধেনি। এটি বেধেছিল মোটামুটি ১৯৬০ সাল থেকে যখন রবিঠাকুরের গানের অর্থ, গভীরতা,
তাৎপর্য বা তার প্রান-প্রতিমা তিনি অনুধাবন ক’রে উঠতে পেরেছিলেন। ঠিক তখনই তিনি বার
বার আহত হন সকলের রবীন্দ্রনাথের গানের ওপর বেশ কিছু জায়গীরদারদের খোদকারী’র কারণে। সন্দেহ
নেই, রবিঠাকুর নিজেই তাঁর সমগ্র রচনাবলীর প্রকাশ থেকে শুরু ক’রে তাঁর সংরক্ষণ,
সুরসৃষ্টি, পরিবর্তন, পরিবর্ধন অথবা পরিমার্জন, নিজস্বতা রক্ষা ইত্যাদি সমগ্র দায়
ও দায়িত্ব তাঁরই নির্মিত ‘বিশ্বভারতী’র হাতে প্রদান ক’রে যান। সে তো বেশ
ভালো কথা। এ তাঁর স্বাধীনতা। যথেষ্ট বিষয়বুদ্ধি ছিল তাঁর। এমনটি না থাকায়
নজরুলসঙ্গীত ছিন্ন ভিন্ন হ’য়েছে। কিন্তু বাস্তবে না চাইলেও কার্যত রবিঠাকুর নিজের
সঙ্গীতসহ সমগ্র রচনাকে কেউ যেন ব্যবসায়ের মাধ্যমে যথেচ্ছ দুর্ব্যবহার না ক’রতে পারে, তার
ব্যবস্থা নিতে গিয়ে নিজের অগোচরেই একটি জায়গীরদারী সৃষ্টি ক’রে গিয়েছিলেন। বিশ্বভারতী’র নির্বাচিত বা
নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ নয়, এমন অন্য কারোর রবীন্দ্র সম্পদের ওপরে কোনোপ্রকার স্বাধীন
বিচরনের অধিকার থাকলো না। অথচ রবীন্দ্রনাথ কিন্তু নিজে লালন ফকিরের বেশ কিছু গানের
ওপর পরিবর্তন ও পরিমার্জন ক’রেছিলেন। সে কি শুধু লালন সাহেব নিজে হাতে লেখেননি ব’লে, নাকি তিনি কোনো
প্রতিষ্ঠানকে এর জায়গীরদার ক’রে রেখে যাননি ব’লে? না, ত নয়। তিনি এই পরিবর্তন,
পরিমার্জন ইত্যাদিতে অবিশ্বাস রাখতেন না। তাই এই বিশ্বভারতী’র ওপরে দায়িত্ব
অর্পণ ‘ভালো ভালো’ বিষয় থাকলো না। এর ফল হ’ল অবাঞ্ছিত। তাঁর সন্তানেরা তাঁকে মনে না রেখে যথেচ্ছ শাসন
ক’রেছেন তাঁর সাধের শান্তিনিকেতনে, আর বিশ্বভারতীতে। শান্তিনিকেতনের ছাতিমতলায় ব’সে বিশ্বভারতীর কর্তৃপক্ষের
নির্দিষ্ট ক’রে দেওয়া বাঁধা গতে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষা না ক’রে কোনো উৎকৃষ্ট শিল্পী’রও গণ-আদৃত
রবিঠাকুরের গান মনের আনন্দে গাইবার বা সেই গাওয়া গান রেকর্ডের মাধ্যমে মানুষের
কাছে তুলে ধরার কোনো অধিকার ছিল না। এই অধিকার ছিল কেবল তাঁদের, যাঁরা বিশ্বভারতী’র ছায়ায় শিল্পী হ’য়েছেন। সন্দেহ
নেই, রবিঠাকুর তাঁর সমস্ত গানের সুরারোপ নিজে ক’রে যেতে পারেননি। একটা জীবনে তাঁর মতো
একটি মানুষ এ্যাতো কাজে লিপ্ত ছিলেন যে, কোনো একটিমাত্র কাজ নিয়ে গোটা জীবন কাটিয়ে
দেবার উপায় তাঁর ছিলো না।। তাই শান্তিনিকেতনের ছাপ মারা শিক্ষক তাতে সুর দিয়েছেন
নানা সময়। সে সুর কেমন, মানুষের তা কেমন লাগবে, সেইসব শিল্পীদের গাওয়া গান কি
মানুষ সংগ্রহ ক’রতেন, যেমনভাবে জর্জ বিশ্বাসের গান সংগ্রহ করেন ? জর্জ বিশ্বাসের পূর্বেকার
রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া হ’তো বস্তুত প্যানপ্যান ক’রেই। আজো হয়। এক শ্রেণী তাই-ই করেন। এমনকি
বিশ্বভারতী থেকে রবিঠাকুরের যে পুস্তক ছাপা হ’তো, তার মূল্যও থাকতো অত্যন্ত চড়া। সাধারণ
মানুষ তা কিনতে পর্যন্ত পারতেন না। একটা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসা তৈরী হ’য়েছিল সকলের
রবীন্দ্রনাথ’কে নিয়ে। সেই বিধিনিষেধের অভিভাবকত্ব আরোপিত হ’য়েছিলো স্বয়ং দেবব্রত বিশ্বাসের ওপরেও। শুধু
তাই নয়, তাঁকে অত্যন্ত অপমানজনক পরিস্থিতির মধ্যেও প’ড়তে হয়। এ আঘাত
তাঁকে রবীন্দ্রনাথ করেননি, শৈলজারঞ্জন করেননি, পঙ্কজ মল্লিক করেননি, এমনকি সন্তোষ
সেনগুপ্তও করেননি। করেছে একদল অবিমৃশ্যকারী, যাদের হাতে দায়িত্ব কেউ বা কারা
দিয়েছিলেন বিশ্বভারতী পরিচালনা’র। এখানেই তিনি আঘাত পেয়েছিলেন।
দেবব্রত বিশ্বাসের ওপর অভিযোগ আনা হ’য়েছিল যে, তিনি ধৃষ্টতাসম্পন্ন
চালে ভুল ভাবধারায়, ভুল মেজাজে, সুরের ওপর অযথা খবরদারিসহ রবীন্দ্রসঙ্গীতের
পবিত্রতা বিনষ্ট ক’রেছেন। এসব নিষিদ্ধ। হ’তে পারে। অবশ্যই হ’তে পারে। তাঁদের
এই কথা বলার ভার তো স্বয়ং গুরুদেবই দিয়ে গেছিলেন। কিন্তু গুরুদেবের কথার যথার্থতা
তো তাঁদেরকেই বুঝতে হ’ত। গুরুদেব তো শুধু তাঁদেরকে দায়িত্বই দিয়ে যান নি, দায়ও দিয়ে
গিয়েছিলেন। সেই দায় তাঁরা যথার্থরূপে বহন করেননি। ভারতীয় সংবিধানে তো শুধু মানুষের
অধিকারের কথাটুকুই লেখা নেই। দায়িত্ব-কর্তব্যের কথাটাও আছে। হয়তো গুরুদেব সেই
কথাগুলো সম্পূর্ণ আইনসম্মত শর্তের আদলে, বা ধারা বা উপধারা’র আকারে লিখিতভাবে
দিয়ে যাননি। অথবা দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু শিল্পী তো ‘সব কথা লিখিত থাকবে’বা ‘থাকবে না’, সেইটুকুই মেনে
চলেন না। ‘বোধ’, ‘বুদ্ধি’, ‘ভালো’, ‘মন্দ’ ব’লে তো নানা শব্দ আছে, তাঁর যাথার্থ্য আছে। শিল্পীর তো সেইটাই মুখ্য অবলম্বন। সেই
বোধ কাজ করেনি রবীন্দ্রসম্পদ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে। কাজ ক’রেছে শুধু মাফিয়া
রাজ আর ব্যবসা। বিশ্বভারতী ভাবলোই না, এই দায়িত্ব তাঁদের চিরকালের নয়। একদিন
রবীন্দ্রসম্পদ বিশ্বভারতী’র গণ্ডী ছেড়ে বেরিয়ে প’ড়বে। তখন কী দিয়ে রুখবেন তাঁরা? তখন এই
পবিত্রতা’র কী হবে! রবীন্দ্রনাথ তো আগামীকালই ফুরিয়ে যাবেন না। আজ তো সেই জায়গীরদারি খ’সেও পড়েছে। আর কি
রোখা যাবে! আসলে তাঁরা অতোকিছু চাননি। নিজেদের ব্যবসাটুকু বুঝেছিলেন। ব্যস্। আজ
আর তাঁরা নেই। রবীন্দ্রসঙ্গীতও অচলায়তন ভেঙ্গে বেরিয়ে প’ড়েছে।
আসলে মানুষ যা কিছু ভালো, তাকে পরম আদরে
সযত্নে রক্ষা করেন। মন্দ’কে ফেলে দেন। আজ রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে যা খুশী তাই অসভ্যতা হ’চ্ছে, এমনটা কেউ
মনে ক’রছেন না। সকলেই জানেন যে, মানুষ মন্দ’কে ফেলে দেন। নিয়ম তো মানুষের স্বার্থে,
সৃষ্টি’র স্বার্থে করা হয়। নিয়মের স্বার্থে তো মানুষ নয়, নিয়মের স্বার্থে তো সৃষ্টি
নয়। এই নিয়মের বেড়াজাল’কে অর্থাৎ শৃঙ্খল’কে ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়ার ডাক তো স্বয়ং
গুরুদেবই লিখে গেছেন ‘তাসের দেশ’ রচনায়। তিনি সৃষ্টি’কে বিকৃতিকরণ থেকে বাঁচাতে ‘সংরক্ষণ’ নামক একটি উপায়
অবলম্বন ক’রতে চেয়েছিলেন। তার এই পরিণাম হবে--- তিনি কি এমনটা ভেবেছিলেন? ভাবতে
পেরেছিলেন? আসলে কোনো কিছুকে কেউই বাঁচিয়ে রাখতে পারে না। কোনো কিছু বেঁচে থাকে
সেটির নিজের বেঁচে থাকবার প্রয়োজনে আর ক্ষমতায়। যদিচ বাঁচিয়ে রাখতে হয়, তবে জোর ক’রে বাঁচিয়ে রাখা
যায় না। বাঁচিয়ে রাখার যথার্থ পথ ভাবতে হয়। তাই রবীন্দ্রসম্পদ’কে জেলখানায় পুরে
না রেখে পুষ্পে-পত্রে-শাখায়-প্রশাখায় আরও বিকশিত করার প্রচেষ্টার দায় কি তাঁদের
ছিল না? বস্তুত রবিঠাকুরের গান ‘আপন হ’তে বাহির হ’য়ে বাইরে দাঁড়া...’ তাঁদের মধ্যে
কোনো আন্দোলন সৃষ্টি করেনি। তা তাঁরা বিশ্বাসও করেননি। আজো অনেকের মধ্যে সেই
বিশ্বাস কাজ করে না।
দেবব্রত বিশ্বাস কদাপি রবীন্দ্রসঙ্গীতকে
বিকৃত ক’রতে চাননি। নিজের পাণ্ডিত্য প্রকাশও ক’রতে চাননি রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্পদের ওপরে।
তিনি রবীন্দ্রনাথের মনোভাব অনুধাবন ক’রে তাঁর সঙ্গীতকে আরো আধুনিক ও
পরীক্ষামূলক চলনে সমৃদ্ধ ক’রতে চেয়েছিলেন। তিনি যে তা পেরেছিলেন, তাতে তো কোনো সন্দেহ
নেই। মানুষ তাঁকে গ্রহণ ক’রেছিলো। বিরাট ক’রে গ্রহণ করেছিলো। আমরা তাঁকে গ্রহণ ক’রেছিলাম। সেকালের
বা একালের যে কোনো রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী’র থেকে তাঁর গান তো আজও (তিনি প্রায় অর্ধশতক
সময়কাল জীবিত না থাকলেও) বাজারে বিকোয় বেশী। ‘বিকোনো’ হয়তো শিল্পের ঔৎকর্ষের মাপকাঠি নয়। মানুষ
তাও জানে। আসলে ‘ভালো’ না ‘মন্দ’--- তাও তো মানুষ নির্ধারণ করে ব’লেই তাবড় শিল্পীরা মনে করেন এবং সোচ্চারে
বলেন। তাহ’লে তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর কী এমন ইম্প্রোভাইজেশন ক’রেছিলেন? এমন কোন
অন্যায় ক’রে ব’সেছিলেন যে, সমস্বরে ছাতিমতলাকার মানুষদের ভাবতে হ’য়েছিলো--- ‘থামাও। ওকে থামাও।
যে কোনো প্রকারে থামাও। এই লোকটা ধৃষ্টতাসম্পন্ন। গুরুদেবের ওপরে এ নিজের ভাবনা, অনুভূতি
ইত্যাদি চাপিয়ে দিয়ে রাবীন্দ্রিক শব্দ-ছন্দ-তাল’ইত্যাদিকে এক নতুন অর্থে তুলে ধ’রতে চাইছেন। গানের
তাল ছন্দ ইত্যাদি নিয়ে লোফালুফি খেলছেন। স্বরলিপি মানছেন না, গানের কথা বদলাচ্ছেন,
গুরুদেবের সাড়ে সর্বনাশ ক’রছেন।’ বস্তুত দেবব্রত বিশ্বাস পাশ্চাত্য নানা বাদ্যযন্ত্র, যেমন
স্প্যানিশ গীটার, সেক্সাফোন, ক্ল্যারিওনেট, পিয়ানো, চেলো শুধু নয়, সেতার, সরোদ,
এস্রাজ, বেহালা ইত্যাদি নানা স্বদেশী বাদ্যযন্ত্রও একসাথে রবীন্দ্রসঙ্গীতে ব্যবহার
ক’রতে চেয়েছিলেন, যার অনেকগুলিরই সেকালে হয়তো প্রচলন ছিল না। জর্জ বিশ্বাসের মতো
একজন অভিজ্ঞেরই তো সাজে এমন পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যেমন পূর্বে অনেকে ক’রেছেন, আজও করেন। কিন্তু
নতুন কিছুকে গ্রহণ ক’রতে না পারাটাই তো এই বিশ্বের একটি পুরনো সমস্যা। তাই অন্য
যা কিছু সব নূতন ভোরের আলোয় বদলে যাবে, আর গুরুদেবের অনন্য সঙ্গীত সেই প্রাচীন
সনাতনী ধারায় অর্থাৎ কৃত্রিম নাসিকাধ্বনি আর চাপা কণ্ঠে বাজতেই থাকবে, বাজতেই
থাকবে, আর মানুষকে ক্লান্ত ক’রবে--- এমনটা মেনে নিতে কষ্ট হ’য়েছিল তাঁর। তিনি
ছিলেন একজন পারফর্মিং আর্টিস্ট। এজন্যে তাঁকে রবিন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে পর্যাপ্ত
পড়াশুনো ও গবেষণ ক’রতেও হয়েছিলো। একটু ব্যাখ্যা ক’রলে বিষয়টি বোঝা
যাবে।
একটি নাটক একজন নাট্যকার লিখে দিতেই
পারেন। তিনি বিশ্বের একজন সেরা নাট্যকার হ’তেই পারেন। কিন্তু সেই নাটকের মঞ্চায়ন
সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। লেখা এক আর পারফর্ম ভিন্ন। সেখানে অনেক পরিবর্তন বা পরিবর্ধন
ক’রতে হ’তেই পারে। নাট্যকার নিজে তাঁরই নাটকের মঞ্চায়ন দেখে বিস্মিত বিমুগ্ধ হ’তে পারেন। তিনি যে
এমনটি লিখে ব’সে আছেন, এমনটি পূর্বে ভেবে না উঠতেই পারেন। ব্যাকরণ থাকে। তার মূল্যও থাকে। কিন্তু
পারফর্মিং আর্টে ব্যাকরণই শুধু থাকে না। থাকতে হয় প্রাণ, প্রত্যয়, ব্যবহারিক
প্রয়োজন। এই তারতম্যটি অনেকেই অনুধাবন করেন না। শুনলে হয়তো অবাক লাগতে পারে যে, কবিতা,
গল্প বা উপন্যাস পাঠযোগ্য শিল্প। নিভৃতে নিবিষ্ট মনে এগুলো পাঠ ক’রতে হয়। ভরা সভায়
এর পাঠ একটি আরোপিত বিষয় ও প্রচেষ্টা মাত্র। কবিতা’কে তো প্রায় জোর ক’রেই ‘আবৃত্তি’ নাম দিয়ে একটি
পারফরমিং আর্টে রূপায়িত করার চেষ্টা চালিয়েছেন কিছু মানুষ। এমনকি তাতে অনেকে সুনাম
সুখ্যাতি অর্জনও ক’রেছেন। আবৃত্তি অনেকের জীবিকা হয়েও উঠেছে। কিন্তু আবৃত্তি কী?
কোনো রচনা’কে, বিশেষত কোনো ছন্দকেন্দ্রীক রচনাকে পাঠ ক’রবার অভ্যাস করা, বারংবার পাঠ করা, অথবা
ছন্দ ইত্যাদি যতদূর সম্ভব পালন ক’রে উচ্চৈস্বরে পড়া। এতে না থাকে নির্দিষ্ট সুর, না থাকে নির্দিষ্ট
লয়, এমনকি না থাকে অভিনয়। আবার তা থাকবে না, এ কথাও কেউ জোর দিয়ে ব’লতে পারে না। অর্থাৎ
যার যেমন খুশি। একটি গড়ে হরিবোল প্রচেষ্টা। অনেক কবিই (জীবিত) ভ্রান্ত আবৃত্তি’র কথা উল্লেখ ক’রে অভিযোগ ক’রেছেন। অর্থাৎ কোনো
কোনো কবি নিজে অভিযোগ ক’রেছেন যে, তাঁর যে কবিতা আবৃত্তি করা হয়েছে, তেমনটি তিনি ব’লতেই চাননি।
আবৃত্তিকার তাঁকে অনুধাবনই করেননি। আসলে এটি তো কোনো শিল্প হ’তে পারে না। এটি
একটি থেরাপি হ’তে পারে। একটি অভ্যাস। যাদের পাঠের সমস্যা আছে, তারা এর মাধ্যমে শুদ্ধ
পাঠাভ্যাস ক’রতে পারে। ফলে আজকের আবৃত্তি শিল্পে সাধারণত কবিতার ভুলভাল বানী উঠে আসে
স্রোতা’র কানে। এটি অশিল্প হবার কারণেই বাংলার এক তথাকথিত বিখ্যাত ‘আবৃত্তিকার’ (মুখ্যত অভিনেতা)
আর প্রখ্যাত আবৃত্তিকারকে (মুখ্যত অভিনেতা) অনুপযুক্ত আবৃত্তিকার হিসেবে পত্রিকায়
লিখে ব’সে আছেন (নাম না উল্লেখ করাটাই শ্রেয়)। কোনো নাট্যশিল্পীকে কিন্তু অপর কোনো
নাট্যশিল্পী কদাপি অনুৎকৃষ্ট ব’লে গালি দেননি। আসলে আবৃত্তি গোটাটাই তো ভুয়ো। আবৃত্তি
কাউকে শোনানোর শিল্প নয়। একা অভ্যাস ক’রতে পারা যায় মাত্র। তেমনি আবার গীতিকবিতা
একটি পারফর্মিং আর্ট কেন্দ্রীক রচনা। এর পাঠযোগ্যতা নেই। ফলে এর সার্থকতা শ্রোতা’র শ্রবণের ওপর
নির্ভর করে। সম্পূর্ণ ব্যাকরণ অনুসরণে এর ব্যাপ্তি বা জনপ্রিয়তা ঘটে না। জনপ্রিয়তা
না ঘ’টলে পারফর্মিং আর্টের দামও থাকে না। তা শুধু তত্ত্ববিদদের কাজে লাগে মাত্র।
জর্জ বিশ্বাস রবীন্দ্রসঙ্গীতের মতো এমন একটি
আধুনিক সঙ্গীতকে আরো দূরে, আরো বহু দূরে নিয়ে যাবার একটি দায় বহন ক’রতে চেয়েছিলেন
তিনি। সৃষ্টি সম্পন্ন হ’লে তো তা আর সৃষ্টিকর্তার হাতে থাকে না, বা তাঁর
নিয়ন্ত্রণেও থাকে না। তা হ’য়ে যায় মানুষের, সকল রসগ্রাহীর। এ কথা তো স্বয়ং রবিঠাকুরই
লিখেছিলেন। ফলে রবীন্দ্রসঙ্গীত’কে শুধু ছাতিমতলাকার মানুষদের জায়গীরদারী ক’রে দেওয়া কতটুকু
যথার্থ হয়েছিলো, তা নিয়েও দ্বন্দ্ব আছে। আমরা তো দেখতে পাই, রবিঠাকুরের নিজের সুরসৃষ্টি’র অফুরন্ত ক্ষমতা
থাকা সত্বেও তিনি যে কখনও কারোর অনুমতি না নিয়েই রামপ্রসাদী, কখনও বাউল, কখনও
বিদেশী সুর পছন্দ ক’রেছিলেন, তারই আদলে কথা ব’সিয়ে গান লিখেছিলেন, তার তো একটা বৃহত্তর
উদ্দেশ্য ছিল। তেমনিই তো একটা প্রচেষ্টা ক’রেছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস। যদি তিনি মন্দ
কিছু ক’রতেন, তবে মানুষ তাঁকে গ্রহণ ক’রতেন না। শুনতেন না সেই গান। ফেলে দিতেন।
না হয় বিশ্বভারতী’র ধ্বজাধারীরা তাঁদের অধিকার অনুযায়ী কথা ব’লতেন এই প্রবীণ শিল্পী’র সাথে। তাঁরা শুনতেন
তাঁর কথা। তাঁরও তো কিছু বলার থাকতে পারে। তিনি তো সঙ্গীত জগতে অপরিচিত কোনো
ব্যক্তি ছিলেন না। আর এই বিষয়ে দেবব্রত বিশ্বাসের প্রিয় রাজনৈতিক দলের কোনো কোনো
ব্যক্তিরও নানা কটু ভূমিকা ছিল। এটাও তাঁকে ব্যথা দিয়েছিলো। দল তিনি ছাড়লেও কখনও
বাইরে দলের বিরুদ্ধ কোনো প্রচার তিনি করেননি। এমনকি বিশ্বভারতী’র অভিজ্ঞ কোনো
শিক্ষক নয়, বয়সে তরুণ পরীক্ষকের সামনে তাঁকে পরীক্ষা দিতে বাধ্য করার মতো
অবমাননাজনক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিলো। তিনি এই শাসন অস্বীকার ক’রলে বিশ্বভারতী
থেকে এই ফতোয়া দেওয়া হ’য়েছিল যে, রেকর্ডে প্রকাশিতব্য তাঁর সমস্ত গান বন্ধ ক’রে দিতে হবে। বাধ্যতামূলকভাবে
তাই করা হ’য়েওছিল। তিনি নাকি রবিঠাকুরের লিখিত ও অলিখিত সমস্ত বিধি-নিষেধ পেরিয়ে নিজের
মতো যথেচ্ছ ব্যবহার ক’রেছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত’কে। তিনি নাকি স্বেচ্ছাচারিতা ক’রেছেন। ১৯৬৪ সাল
থেকে তাঁর বিরুদ্ধে এই জেহাদ ঘোষণা শুরু করে বিশ্বভারতী। যার ফলে তিনি একটি
আত্মকথন রচনা করেন, আর তার নাম দেন ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত’। ১৯৮০-তে তাঁর
মৃত্যুর এক বছর আগে এই বইটি প্রকাশ পায়। হয়তো তিনি এই পুস্তকে তাঁর বেদনা লিখে রেখে গেছেন।
সঙ্গীত তাঁর জীবিকা ছিল না। তিনি চাকরী ক’রতেন ‘লাইফ ইনশিওরেন্স
কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া’-তে। ফলে বাধ্য হ’য়ে তাঁকে আঁতাত ক’রতে হয়নি
প্রাতিষ্ঠানিকতা’র কুঞ্চিত ভ্রূ’র সাথে। বশ মানেনি তিনি। বশ না মানার অন্য নাম জর্জ
বিশ্বাস। তিনি এক কিংবদন্তী। আমি তাঁর বহুমুখী প্রতিভা, অর্থাৎ অভিনয়, ছবি অঙ্কন
ইত্যাদির কত্থা ব’লছি না। তিনি কে কী কেমন--- এসব মানুষ জানেন, তাঁর অলিখিত ভক্তেরা জানেন। কোনো
পণ্ডিতের কলমের আঁচড়ে তাঁকে চিনতে হয় না। তাঁরা জানে, রবীন্দ্রসঙ্গীত’কে মানুষের দরবারে
আনার জন্যে যে সব মানুষ একটি বিরাট ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাঁদের শীর্ষে আছেন তিনি।
মানুষ যখন একটা কৃত্রিম কণ্ঠে, আরোপিত গায়কীতে একঘেয়ে গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা
প্রায় বন্ধ ক’রে দিতে শুরু ক’রেছে, তখনই তিনি আবির্ভূত হন। মানুষ তাদের বহুবার শোনা গান
নতুন ক’রে তাঁর মেঘমন্দ্র কণ্ঠ আর স্পষ্ট অর্থবহ রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার অনন্য আস্বাদ
আর অভিজ্ঞতা লাভ করেন। তারা গানের মধ্য দিয়ে অভিনয় শুনতে পান। অনুধাবন করেন
রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনন্য অস্তিত্ব। মানুষ ভালোবাসতে শুরু করেন এই গানকে। আমিও তো
বটে। রবীন্দ্রসঙ্গীত জগতে কে আছেন, যিনি অমন ক’রে ‘মেঘ ব’লেছে যাবো যাবো...’ কিম্বা ‘আমার যে দিন ভেসে
গেছে চোখের জলে...’ অথবা ‘আমি হেথায় থাকি শুধু গাইতে তোমার গান...’ বা ‘তুমি এসেছিলে তবু
আসো নাই জানায়ে গেলে...’ কিম্বা ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি...’ অথবা ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু...’গাইবেন! কেউ নেই। আজও
কেউ নেই। কোনোকালে ছিলেনও না। অথচ এসব গান তৎকালীন বিশ্বভারতী অনুমোদন দেয়নি।
আসলে সত্যি তিনিই ছিলেন গুরুদেবের গান শোনার
মতো ক’রে, বোঝার মতো ক’রে, অনুভব করার মতো ক’রে গাইবার জন্যে। শুধুমাত্র গানের মতো
গাইবার জন্যে নয়। ‘আমি হেথায় থাকি শুধু গাইতে তোমার গান...’ রবিঠাকুর এই কথা
লিখেছিলেন সর্বশক্তিমান’কে উদ্দেশ ক’রে, আর দেবব্রত বিশ্বাস গাইলেন স্বয়ং গুরুদেব’কে উদ্দেশ ক’রে। যেন গুরুদেব
তাঁকে লক্ষ্য ক’রেই এ গান রচনা ক’রেছিলেন। তাঁর কণ্ঠে কত অনন্য গানের কলি ব’লবো! অফুরন্ত,
অশেষ, অসীম। যে গান তিনি একবার গেয়ে ফেলেছিলেন, তা যেন আর কারোর কণ্ঠে বেমানান
লাগে। এ কোনো সংস্কার বা কুসংস্কার নয়। এ সত্য। গানের পণ্ডিত কী ব’লবেন, মানুষ তো
তার জন্যে অপেক্ষা করেন না। মানুষ তাঁর কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত নির্বিচারে শোনেন,
ভালো লাগলে যত্নে তাকে সংরক্ষণ করেন। বিশ্বভারতী রবিঠাকুরের গান সংরক্ষণ করেছিলো,
আর মানুষ সংরক্ষণ ক’রেছিলেন জর্জ বিশ্বাসের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতকে। বিশ্বভারতী
সংরক্ষণ ক’রেছে কাগজে কলমে, আর মানুষ সংরক্ষণ ক’রেছিলেন তাদের হৃদয় মন্দিরে।
‘গানের মধ্যে অভিনয়’ কথাটা হয়তো
সাধারণ মানুষের অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়। এমনকি গানে এই অভিনয় কেন থাকবে, এই নিয়েও
বিশ্বভারতী কম অসম্মান করেনি দেবব্রত বিশ্বাস’কে। এই অভিনয় থাকবে কিনা, এই বিষয়ে একটি
উদাহরণ দিলে বোধহয় আমি স্পষ্ট ক’রতে পারবো। সন্দেহ নেই, ‘সঙ্গীত’ আর ‘অভিনয়’--- দুটি ভিন্ন ভিন্ন পারফমিং আর্ট।
সকলেই জানেন। কিন্তু কোনো মানুষ অস্বীকার ক’রেন না যে, যেখানেই বানী, সেখানেই অভিনয়
থাকবে। অভিনয়ে যেমন তাল-ছন্দের দরকার, তেমনি সঙ্গীতে তো তা অবশ্যই দরকার। গানের
বানী, বিশেষ ক’রে যখন তা রবিঠাকুরের সৃষ্টি, যাকে সুর আর বানী’র অনন্য মিলন ব’লে ব্যাখ্যা করা
হয়, তাকে মানুষের কাছে, শ্রোতার কানে আর মনে পৌঁছে দিতে গেলেই অভিনয় লাগে। শুধু
সুর মানুষকে একটা আবেগে বাঁধে, আবেশে বাঁধে। সুরের আবেগ। সুরের আবেশ। রবিঠাকুর
শুধু সুরের আবেগ বা আবেশ সৃষ্টি ক’রতে চাননি ব’লেই তো সকলে বলেন।
রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখতে এইজন্যে গুরুদেব বার বার বিশুদ্ধ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের জগতে শুধু
প্রাথমিক পাঠটুকু নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। গভীর পাঠ নয়। অন্যথায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনন্যতা
হারিয়ে যাবে ব’লে তিনি মনে ক’রেছিলেন। এর অন্যথা ক’রলে প্রতিটি শব্দের ব্যঞ্জনা, মূর্ছনা,
গভীরতা, তাৎপর্য মানুষের দরবারে পৌছবে না। তারই তো অন্য নাম অভিনয়। সুরের যেমন
মূর্ছনা থাকে, তেমনি শব্দেরও তো মূর্ছনা থাকে। কিন্তু উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে বানী
প্রধান থাকে না, সূরই মুখ্য থাকে। শব্দ মূর্ছনা সেক্ষেত্রে গুন, অর্থাৎ অভিনয়
সেক্ষেত্রে গৌণ। তাই উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শিল্পীরা অস্পষ্ট, প্রায় অনুচ্চারিত শব্দ বলেন
তাদের গানে। ‘বাজুবন্ধ খুলু খুলু যায়...’ শোনায় ‘অয়াজু অন্ধ কুলু কুলু ইয়ায়...’। তাতে সেই গানের
ক্ষতি হয় না। কিন্তু আর যে কোনো গানে সেই ক্ষতি হয়। রবীন্দ্রসঙ্গীতে তো হয়ই। ভয়ঙ্কর
ক্ষতি হয়। তার ওপরে এ গানে যে সুর আর বানী ওতপ্রোতভাবে হাত ধরাধরি ক’রে চলে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের
সাধক শ্রী শৈলেন দাস মহাশয় ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে... গানটির একটি রেকর্ডে এমনভাবে ‘আনন্দধারা’ শব্দটির ওপর একেক
বার এমন এমন নোটেশন চাপিয়ে চাপিয়ে গেয়েছিলেন, যেটি সাধারণত পূর্ববর্তী রেকর্ডে
শোনা যায়নি। গানের লয়’কেও এমন ধারায় বেঁধেছিলেন যে, তাও শোনা আমাদের মতো সাধারণ শ্রোতার
অভিজ্ঞতা ছিলো না। এই বিষয়ে আমি তাকে প্রশ্ন ক’রতে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, আপনারা যখন
একই শব্দ আমাদের কথায় একাধিকবার ব’লেন, আপনারা কি সেই শব্দটির ওপর হাল্কা
থেকে ক্রমশ জোর আরোপ ক’রতে ক’রতে বলেন না? একইভাবে কি বারে বারে শব্দটিকে প্রক্ষেপ করেন?
সত্যিই তো করিই না। শব্দটির ওপর স্ট্রেস একটু একটু ক’রে চাপাই আমরা।
শব্দটিকে আরো গুরুত্ব দেবার জন্যেই এমনটা ক’রি। লয়ের প্রশ্নে তিনি এমনও ব’লেছিলেন ‘আনন্দধারা বহিছে
ভুবনে...’ কি একটি বেদনার বানী আমাদের কাছে ব’য়ে আনে? এতকাল এই গানটিকে একটা বেদনাময়
সুরে আর লয়ে গাওয়া হ’য়েছে। অথচ ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে তো...’ আনন্দের বানী ব’য়ে আনে আমাদের
কাছে। এই সঙ্গীতটিকে বিলম্বিত লয়ে গাইলেই তো এটি বেদনার গান হ’য়ে দেখা দেয়। এই
যে গানের ‘লয়’, এর মধ্যেও তো সেই অভিনয়ের কথা লুকিয়ে আছে। কৃত্রিম কণ্ঠে ইনিয়ে বিনিয়ে
রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবার যে একটি প্রাচীন ধারা এই সঙ্গীতটিকে মানুষের থেকে দূরে স’রিয়ে নিয়ে
যাচ্ছিলো, তা থেকে যেন উদ্ধার ক’রলেন দেবব্রত বিশ্বাস। স্বয়ং রবিঠাকুরের কণ্ঠে যে সব গান
রেকর্ড করা আছে, তাতে তো এই ইনিয়ে বিনিয়ে গাইবার কোনো প্রবণতা দেখা যায় না! তবে কি
রবীন্দ্রসঙ্গীতে বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড় হ’য়ে উঠেছিলো?
গানে যে নোটেশন তৈরী করা হয়, তাতে যে
শুধু রাগ, তাল, ছন্দ মানা হয়, তা তো নয়। অভিনয়ও সেক্ষেত্রে কাজ করে। যে শিক্ষক
ক্লাসে অত্যন্ত জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দেন, যদি তাঁর ভাষণে কোনো প্রাণশক্তি না থাকে, তবে তাঁর
ভাষণ তো শিক্ষার্থীরা শোনে না। ভাষণ দিতে গেলেও একটা অভিনয় চাই। তারই নাম
প্রাণশক্তি। বক্ষ্যমাণ যদি বিশ্বাস থেকে বিবৃত হয়, তবেই লাগে অভিনয়। আবৃত্তিকারই
হোক, বা সঙ্গীত শিল্পী--- উভয়কেই একটি কথা মাথায় রাখতে হয়, ‘আমি কবি’র বানী ঠিকঠাক
পৌঁছে দিতে পারছি তো? আমি এ রচনার যাথার্থ্য অনুধাবন করেছি তো? শুধু তত্ত্বটি আমি
আয়ত্ব ক’রিনি তো? আমি কথাগুলোকে বিশ্বাস ক’রি তো?’ শিল্পী’কে তো ‘হ’য়ে উঠতে’ হয়। আগে ‘শিল্পী’ নয়, আগে ‘মানুষ’। বাংলার শিল্পীরা তা হ’তে পেরেছেন তো? সদ্য
প্রয়াত ভুপেন হাজারিকা’র যে জীবনেতিহাস, আর শিবদাস বাবু’র সাথে তাঁর যে
অভব্যতা, তাতে তো শিউরে উঠতে হয় দৃষ্টান্ত দেখে। সকলের হাঁড়ি’র খবর তো নেওয়া
সম্ভব নয়। শুধু ভয় হয়। আমরা ঘরপোড়া গুরু। সিন্দূরে মেঘেই চামকাই। তাই এই ‘নোটেশন’ বিষয়টি নিয়ে দুটি
কথা না ব’ললেই নয়। শোনা গেছে, জর্জ বিশ্বাস রবীন্দ্রসঙ্গীতের ছাপা স্বরলিপিতে (স্বরবিতান)
পরিবর্তন ক’রে নিজস্ব নোটেশন বসাতেন। কিন্তু এতো শুধু জর্জ বিশ্বাস নন, আমি শৈলেন
দাস’কেও এমন সংশোধন ক’রতে একধিকবার নিজে চোখে দেখেছি। তাঁর ক্লাসে ব’সে এমনটা ক’রতে দেখেছি। কোনো
সন্দেহ নেই, অন্যের সম্পদে হস্তক্ষেপ করা একান্ত অনুচিত। বিশেষ ক’রে যখন তিনি হন
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি যে একেবারে চিরনির্ভুল, অপরিবর্তনীয় এবং সংশোধনের
অতীত, তা তো হ’তে পারে না। কিন্তু তা সত্বেও এই পরিবর্তন অনেকটা অপরের দ্রব্য ব্যবহার ক’রে ভেঙ্গে চুরে
রেখে দেওয়া। কিন্তু এ কাজ তো জর্জ বিশ্বাস একাই করেননি। ছাতিমতলায় ব’সে যদি
রবীন্দ্রসঙ্গীত না শেখা যায়, তবে এসব কিছু করা যাবে না। যেহেতু জর্জ বিশ্বাস এমনটা
করেননি, সেহেতু তিনি এসব ক’রতে পারবেন না। ছাপা স্বরলিপিতে কোনো কোনো গানে ‘সুরান্তর’ করা থাকে। উদাহরণ
দেওয়া যায়--- ‘হার মানা হার পড়াবো তোমার গলে...’ গানটি। এই সুরান্তর কে ক’রেছেন? কেন ক’রেছেন? তাঁর বা
তাঁদের অধিকারটিই বা কী এমনটা ক’রবার? কোথা থেকে এমন অধিকার তিনি বা তাঁরা পেলেন? যদি
পেলেন, তবে আর কি কারোর সেই অধিকার থাকার কথা নয়? হয়তো নয়। কারো কারো হয়তো
আইনসম্মত রাবীন্দ্রিক ডিলারশিপ ছিলো। সেখানে অন্য কারোর হস্তক্ষেপের অধিকার নেই। এমনও
অভিযোগ আছে যে, দেবব্রত বিশ্বাস গীতবিতানের কোনো কোনো গানের কথাতেও পর্যন্ত
পরিবর্তন ক’রেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়--- ‘মম দুঃখবেদন, মম সফল সাধন তুমি ভরিবে
সৌরভে...’। দেবব্রত বিশ্বাস ‘সফল’ শব্দটিকে ‘সকল’ ক’রেছেন কেননা ‘সফল’ শব্দটি এ
ক্ষেত্রে কোনো অর্থ বহন করে না। সাধন যদি সফলই হবে, তবে তাকে আর সৌরভে ভোরে কী
হবে! সে তো সাফল্যেই সুরভিত। এমনও তো হ’তে পারে যে, এই শব্দটি সেই গীতবিতান
পুস্তকের জন্মলগ্ন থেকে ভুল ছাপা হ’য়ে আসছে। ‘সফল’ আর ‘সকল’ শব্দদুটি পাণ্ডুলিপি’র হাতের লেখায় গঠনে
অনেকটা তো একই। ‘কর্ণকুন্তীসংবাদ’ নাট্যকাব্য-তে এমন ছাপা-বিভ্রান্তি বার বার ঘ’টেছে। একটি ছত্র
ছাপা হয়নি, একটি ছত্র’তো নিশ্চিতরূপে গুরুদেব লিখতেই ভুলে গেছেন। উদাহরণ দেওয়ায়
যায়--- ‘রাখিলে বিচ্ছিন্ন করি অর্জুনে আমারে / তাই শিশুকাল হ’তে তানিছে দোঁহারে
/ নিগুর অদৃশ্য পাশ হিংসার আকারে ...’ (এখানে তিনটি শব্দ ‘আমারে’, ‘দোঁহারে’ এবং ‘আকারে’ কেমন যেন বিনা
যুক্তিতে এলো। কিম্বা ‘এই শান্ত স্তব্ধক্ষণে / অনন্ত আকাশ হ’তে পশিতেছে মনে /
জয়হীন চেষ্টার সঙ্গীত, আশাহীন (এ ক্ষেত্রে ‘আশাহীন’ শব্দের সহযোগী শব্দ পরের ছত্রে এলো না) /
কর্মের উদ্যম--- হেরিতেছি শান্তিময় / শূন্য পরিণাম।...’। একটু মন দিয়ে প’ড়লেই একটা
অসংলগ্নতা চোখে প’ড়বে। এসব হয়তো নজরেই আসেনি। এলে তো সংশোধন করা হ’তো পরবর্তীকালে। হয়তো
নজরে এসেছে কিন্তু অন্ধত্ব তাঁদেরকে বুঝিয়েছে যে, গুরুদেবের এমন ভ্রান্তি ঘ’টতেই পারে না। হয়তো
মুল পাণ্ডুলিপিতে তা যথার্থই আছে, শুধু ছাপতে গিয়েই বিভ্রান্তি ঘ’টেছে। কতকিছুই তো
সম্ভব। আমরা সকলেই তো রবিঠাকুরের পাণ্ডুলিপি স্বচক্ষে দেখিনি।
তবুও যন্ত্রণায় কাতরেছেন দেবব্রত
বিশ্বাস। সঙ্গীত তাঁকে যথেষ্ট যন্ত্রণা দিয়েছে, আর তিনি মদের জগতে নিজেকে ডুবিয়ে
রেখেছেন, ভুলতে চেয়েছেন সেই যন্ত্রণা। যে সমস্ত বড়ো বড়ো শিল্পীরা তাঁর অনুজতুল্য
ছিলেন, ভক্ত ছিলেন, তাঁর আশেপাশেই ঘোরাঘুরি ক’রতেন, তাঁরাও তাঁর পাশে এসে দাঁড়াননি
তাঁর দুর্দিনে, অর্থাৎ তাঁরা অন্তত ‘বিশ্বভারতী বয়কট’ আন্দোলনে নামতে
পারতেন। পারেননি কেননা, নিজেদেরকে তুলে ধ’রতে গিয়ে কেউই বিশ্বভারতী’র সাথে কোনো দ্বন্দ্বে
লিপ্ত হ’তে চাননি। কিন্তু যেইদিন বিশ্বভারতী’র হাত থেকে রবীন্দ্রসৃষ্টি বিচ্ছিন্ন হ’লো, তাঁদের
হারাবার আর কোনো ভয় থাকলো না, তখনই তাঁরা এই ‘শিল্পে বিশ্বভারতী’র জায়গীরদারি’ নিয়ে নানা কটু
মন্তব্য ক’রেছেন। আর তো বিপদ নেই, এবার তো বলা যায়। তাঁদের কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথ’কে ভাঙ্গিয়ে খেয়েছেন,
কেউ জর্জ বিশ্বাস’কে। কিন্তু জর্জ বিশ্বাস’কে তো থামানো যায়নি। থামানো তো যায় না। যোগ্যতমের উদ্বর্তন
হয়। মানুষ যদি পাশে থাকেন, তবে আর কারোর প্রয়োজন হয় না। মানুষের দরবারে জর্জ
বিশ্বাস বেঁচে ছিলেন, বেঁচে আছেন আর বেঁচে থাকবেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন ক’রবার জন্যে তাঁর
জন্ম, তা তিনি পালন ক’রে গেছেন। আজ মনে হয়, হয়তো এই বিরোধিতা না থাকলে তাঁর এই জীবনটা
পান্শে হ’তো। তিনি যোদ্ধা না হ’য়ে কেবল একজন শিল্পী হ’য়েই থাকতেন। হয়তো তিনি যন্ত্রণা স’ইতে পারেন ব’লেই যন্ত্রণা
তাঁকে এমন যন্ত্রণা দিয়েছে।
---------------------------
শব্দসংখ্যা- ৬,০০০